#হৃদয়েশ্বরী – ৪৪
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
উশানের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাস্ত সময় কাটছে। ব্যাস্ততার দরুন খাওয়া – দাওয়াও সে করতে পারছে না ঠিক মতো। ঘুম তো দূরে থাক!উশান যেই মিশনের দায়িত্ব পেয়েছে সেই মিশনে যাওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি এবং একটা টিম গঠন করতে হয়েছে তাকে। টিমকে প্রতি মূর্হত সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া, কিভাবে কি করতে হবে তা সম্পর্ক বিশদ বর্ণনা সাথে মিশনে কিভাবে সফল হওয়া যায় পূর্ণ রূপে তার পরিকল্পনা তৈরি! সব মিলিয়ে শ্বাস ফেলার সুযোগটুকু তার নেই আপাতত। মীরার সাথে উশানের কথা হয়না বেশ কয়েকদিন। উশান সুযোগ পাচ্ছেনা ফোন দেয়ার। মীরাও ফোন দিচ্ছে না। দুই, একবার যা দিয়েছিলো সেই ফোনকল রিসিভ করতে পারেনি সে! তারপর হতেই মীরা তাকে আর কল দেয় না। উশান ভেবেই নিয়েছে, মেয়েটা নিশ্চিত অভিমানে গাল ফুলিয়ে রয়েছে।
-” স্যার আপনার গাড়ি বের করেছি। ”
উশান ল্যাপটপ হতে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত সরালো। সামনে দাঁড়ানো অল্প বয়স্ক তরুণ যুবক। সে মূলত এখানকার পরিচ্ছন্ন কর্মী এবং সিকিউরিটি গার্ড। নাম তুরান! বয়স খুবই কম।
-” যাও আসছি আমি। ”
প্রতিত্তুর শ্রবণ করা মাত্র তুরান সালাম দিয়ে প্রস্থান করলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামড়া থেকে। উশান উঠে দাঁড়ায়।আজ তাকে নিজের ফ্লাটে ফিরতে হবে।গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু তথ্য বাসায় রাখা। যা এ মূর্হতে প্রয়োজন তার। তথ্যভর্তি ফাইলটা দিগন্তকে আনতে বলেছিল উশান। কিন্তু এই দিগন্ত একবার ফোন তুলে ‘ হ্যা স্যার, আনছি স্যার। ‘ বলা শেষে ফোন সেই যে কাটলো, বর্তমানে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেছে দিগন্ত আসেনি। উশানের ফোনও ধরেনি। দিগন্তের এমন হেয়ালিপনায় উশান ক্ষুদ্ধ ভীষণ! ছেলেটা গেলো কোথায়? তাকে কিছু না বলে এভাবে হুট করে গায়েভ হওয়ার মানেটা কি? আশ্চর্য!
মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি, একরাশ রুষ্ঠতা নিয়ে নিজের ফ্লাটে পৌঁছাতে উশানের প্রায় আধাঘন্টার মতো সময় লাগল। কাঙ্ক্ষিত পৌঁছাতেই লম্বা লম্বা পা ফেলে সে নিজের ফ্লাটের উদ্দেশ্য চলল। বহুদিন আসা হয়নি তার এখানে। ঢাকায় আসার পর সে উজান, উমাইশার সাথেই থাকতো। উশান ঠিক করলো এ মাসেই ফ্লাটটা ছেড়ে দিবে। অযথা তাকে মোটা অঙ্কের ভাড়া দিতে হচ্ছে প্রতিমাসে।
ফ্লাটের সামনে এসে উশান বুঝতে পারলো কিছু একটা ঠিক নেই। গড়বড়, ঝট পেকেছে বিশাল!তার ফ্লাটের দরজা উন্মুক্ত। নবের লক ভাঙা। কোমড়ের কাছে গুঁজে রাখা পি’স্তলটা আলগোছে হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো উশান। ফ্লাটে পুরোদস্তুর মৌনতার বিস্তার। আঁধার লেপ্টে আছে চারিপাশে। গুমোট পুরো ফ্লাট! দক্ষিণ দিকের উন্মুক্ত কপাট দিয়ে বাতাস আসছে। সতেজ বাতাস। সাইঁ সাইঁ শব্দ তুলছে প্রাণবন্ত অনিল। অনিলে বইছে পোড়া গন্ধ। কোনো কাঠ অথবা পাতা পোড়ানোর গন্ধ না পোড়া লা’শের গন্ধ। উশানের মস্তিষ্ক সচেতন হলো তুমুল। তার স্নায়ুকোষ উদগ্রীব হয় জানতে, আবার কার প্রাণ ঝড়লো?
উশান খেয়াল করলো পোড়া লা’শের গন্ধটা তার শয়নকক্ষ হতে ভেসে আসছে। উশান নিঃশব্দে এগোল সেদিকটায়। শয়নকক্ষে প্রবেশ করতেই আচানক স্ব-শব্দে দরজা বন্ধ হয়ে যায় কামড়ার। তৎক্ষনাৎ কামড়ায় থাকা লাইটের সুইচ অন করে কেও। আঁধারে বিলীন কক্ষে রশ্মির উৎপত্তি হওয়ার পর উশানের সর্বপ্রথম দৃষ্টি আটকায় মেঝেতে পড়ে থাকা দিগন্তের পোড়া লা’শের পানে। দিগন্তের পুরো দেহ ঝলসানো! শুধুমাত্র মুখোশ্রী বাদে। যার দরুন দিগন্তকে চিনতে বেগ পেতে হয়নি উশানের। শান্ত দৃষ্টিপাতে দিগন্তের প্রাণহীন দেহ পরখ করে সম্মুখে তাকাল। এরিক বসে! পায়ের ওপর পা তুলে। তার পাশে দাঁড়িয়ে চারজন রা’ইফেল হাতে।
এরিক বিদ্রুপ হেঁসে বলল,
-” বুকে লাগল লা’শ দেখে?”
উশান তখনও শান্ত। নেত্রযুগলে কোনো অস্থিরতা নেই। রাগ নেই! নেই কোনো তাড়া। অতীব শীতল গলায় সে প্রশ্ন ছুড়লো,
– ” মে’রেছিস কেনো ওকে? ”
-” জানিস না কেনো মে’রেছি? তুই আমার তূর্শীকে জেলে পাঠিয়েছিস। ওকে অযথা শাস্তি দিয়েছিস। ”
-” অযথা? তূর্শী মীরাকে মা’রতে এসেছিলো। স্পষ্টত প্রমাণ আছে। আদালতে ও দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। শাস্তি পেয়েছে! এখানে দিগন্তের কি দোষ?কাপুরুষ এর মতো ওর প্রাণ কেনো নিলি? ”
এরিক দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়ালো। পারে না সে এখনি মে’রে ফেলে উশানকে। ভীষণ কষ্ট দিয়ে! মীরার ব্রেইন স্ট্রোক করার পিছনে তূর্শীর হাত আছে সহজ ভাষায় তূর্শী ইচ্ছাবশত মীরাকে অসুস্থ অবস্থায় মানষিক চাপসহ আঘাত করেছে। যার ফলস্বরূপ মীরা তৎক্ষনাৎ ব্রেইন স্ট্রোক করে বসে। তারপর কোমা। উশান ভাবেনি তূর্শী এমনটা করতে পারে। তার ধ্যান ছিলোনা তূর্শীর প্রতি। তবে সেদিন পার হওয়ার কয়েকদিন পর মীরা যেই আই.সি.ইউ তে এডমিট ছিলো সেই আই.সি.ইউ কক্ষে সিসি ক্যামেরা ছিলো। সেখান থেকেই যাবতীয় সব প্রমাণ পেয়েছে সে। মীরার ব্যাপারটা শুধুমাত্র তূর্শীর দ্বারা সংঘটিত বাকিদের ওপর আক্রমণ করার চিন্তাটা আসলে রাহনুমাই করেছে।পূর্ণ ঘটনা জানার পর উশান সেখানকার থানায় মামলা করে। মামলা চলে বেশ কয়েকমাস।অবশেষে কোর্টে সকল প্রমাণ সাপেক্ষে তূর্শীর শাস্তি হয়! ১২ বছরের জেল। এই সম্পূর্ণ বিষয়টি উশান সবার থেকে গোপন রেখেছে। কাওকে জানায়নি। জানতে দেয়নি!
-” তুই তূর্শীকে ইচ্ছে করে জেলে পাঠিয়েছিস। ইচ্ছে করে! এই দিগন্ত আমার তূর্শীকে ধরে নিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই ওকে পুড়িয়ে মে’রেছি। তোকে তো মারবো টুকরো টুকরো করে কেটে। ”
উশান গলায় শব্দ করে হেসে ফেলল। যেনো সে কোনো কৌতূক শ্রবণ করেছে সবেমাত্র। হাস্যরত অবস্থায় সে জিজ্ঞেস করল,
-” আচ্ছা? দারুণ তো! আমাকে টুকরো টুকরো করে কা’টবি তুই? তোর মতো কাপুরুষ? ভীতু? বাহ! ”
এরিক উশানের পায়ে লাথি মারলো। উশান নড়লো না একটুও। নিজের স্থানে সে অটল। ওষ্ঠাধর কোণে তার তেরছা হাসি। এরিক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শুধালো,
-” তোর মতো কুত্তা’কে ধরবো আমি?এই এরিক ইহরাম? হাহ্! তোকে মারবে এরা।”
মোটাসোটা চারটে পুরুষের দিকে ইঙ্গিত করলো এরিক। উশান সোজাসুজি দৃষ্টি ফেলল এবার সেই চারটে দানবীয় মানবের প্রতি। আকার – আকৃতিতে এক একজন বিশাল! দেখে মনে হবে কাবুলের সেই দানবীয় লম্বা চওড়া পুরুষ। উশান গাল চুলকালো। বলল,
-” তোরা মার’বি আমাকে? ফাইন! কতো টাকা দিল এই এরিক আমায় মা’রতে? ”
চারজন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। শেষে সত্য কথাটাই বলে ফেলল,
-” ১০ লাখ! ”
তৎক্ষনাৎ মুখোশ্রী বেজায় বিরক্তি, একরাশ তিক্ততা নিয়ে কুঁচকালো উশান। মুখোশ্রীতে তার অসন্তুষ্টতা। বিরক্ত গলায় শুধালো,
-” আমাকে মা’রার জন্য এতো কম রেট? ”
উপস্থিত চারজনকে সুক্ষ্ম নজরে অবলোকন করল উশান। অতঃপর নীরবতা বিরাজ ফ্লাটটায় ছোট্ট খাটো বিস্ফোরণ ঘটালো। লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা হাতে নিয়ে পিঠ পিছ থেকে দু’জনকে গুলি করল। আচানক গুলি বর্ষণে প্রথম কেও কিছুই বুঝলো না।যখন বুঝলো তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। লহমায় চারটে তাগড়াই পুরুষের প্রাণহীন দেহ পড়ে রইল মেঝেতে। এরিক বিষ্মিত! উশান এরিকের হতভম্ব মুখোশ্রী দেখে হাসলো কতক্ষণ।
-” তুই কি ভেবেছিস? তোকে মা’রার জন্য আমি মাত্র চারজন এনেছি? হু? পিছে দেখ! ”
উপস্থিত হলো আরো পাঁচজন। উশান ভ্রু’কুটি একত্র করলো বিরক্তিতে! তাকে ফিরে যেতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। আর এই এরিক গর্দভটার এখনি কাহিনি শুরু করতে হলো? উশান বিরক্তিমাখা কন্ঠে শুধালো,
-” শুধু শুধু নিজের টাকা ওয়েস্ট করছিস ভাই। এই পাঁচজনকে মার’তে আমার পাঁচ মিনিটও লাগবে না।”
কলিংবেলের তীক্ষ্ণ শব্দ!
সজাগ, সচেতন হলো এরিক। উশানের মনটা তখন খচখচ করছে। কে এলো? তাও এসময়! মনে মনে সে দুআ করলো যেনো আপনজন না হয়। তাহলে তাকে দূর্বল হয়ে পড়তে হবে। এরিক সুযোগ বুঝে দেখা যাবে আক্রমণ করে বসেছে।
.
দুই, তিনবার উশানের ফ্লাটের কলিংবেল বাজিয়ে থামলো মীরা। অপেক্ষায় রইল কখন উশান দরজা খুলবে। আজই ঢাকা ফিরেছে সে। একটু আগে। ফিরেই সে তীব্রর থেকে উশানের খবরা-খবর নিয়েছে। যখন জানতে পারলো উশান তার ফ্লাটে। তখন বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে সে দ্রুত পদে এসে পৌঁছালো এখানে। তার মনের অন্দরমহল উচাটন হয়ে। আচ্ছা উশান যখন তাকে প্রথম দর্শন করবে তখন তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?
মীরা ধৈর্যহারা হয়! পরপর দুইবার বেল বাজায় পুনরায়। আশ্চর্য তো! উশান কেন এতো দেরী করছে দরজা খুলতে? লোকটা কি ঘুমে?
উশানের মাথার পিছে এরিক পি’স্তল ধরে। হেলে দুলে আলসেমি নিয়ে হাঁটছে উশান। এরিক বার কয়েক ধমকেছিল উশানকে এতোটা আস্তে হাঁটার জন্য। কিন্তু উশান তো উশানই! সে কি কারো কথা শোনে?
কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা আতঙ্ক সহিত উশান সদর দরজা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হলো তার মীরার হাস্যজ্বল মুখোশ্রী। কন্ঠের খাদ নামিয়ে সে বলল,
-” মীরা..,”
মীরা জড়িয়ে ধরতে নিচ্ছিলো উশানকে। তবে তা সম্ভব হয়না। তার হাস্যজ্বল মুখোশ্রী অমাবস্যার আঁধারে ছেয়ে যায় লহমায় যখন সে উশানের পেছনের দৃশ্য দর্শন করল। হতবুদ্ধি হারিয়ে পল্লব ঝাপটালো কয়েকবার মীরা। প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বে, উশান যখন মীরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দরজা আঁটকে দেয়ার ফন্দি আটঁছিলো তখনি এরিক মীরার হাত ধরে হেঁচকা টানে মীরাকে ছিটকে ফেলে মেঝেতে। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয় চটজলদি।
কন্ঠ দিয়ে অস্ফুটে আর্তনাদ করল মীরা আঘাত পেয়ে। হাতে লেগেছে তার! এতোটা জোড়ে ছুঁড়ে মারার কারণে। উশান ঝটপট এগোল মীরার নিকট। মীরাকে তুলে নিজের কোলে বসিয়ে শুধালো,
-” লেগেছে কোথাও? ”
এরিক উশানের মুখোশ্রীর অস্থিরতা নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করল। পরপর সে হাসলো। উদ্ভট হাসি। এইতো! সে পেয়ে গেছে উশানের দূর্বলতা কে। আর কি চাই তার?
চলবে~
[ এতদিন পর দেয়ার জন্য দুঃখিত। সবাই একটু রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। ভালোবাসা। 💜]