হৃদয়েশ্বরী – ৩৫ সাদিয়া মেহরুজ দোলা

0
27

#হৃদয়েশ্বরী – ৩৫
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

রজনীর তৃতীয় প্রহর। জানালার উন্মুক্ত কপাট দিয়ে মুক্ত সমীর সাইঁ সাইঁ করে কক্ষে প্রবেশ করছে। হীম অনিল। মীরা কাঁপুনি দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে চেপে বসলো।দৃষ্টি ফেললো ল্যাপটপ স্ক্রিনে। স্ক্রিনে স্পষ্টত দৃশ্যমান উশানের ঘুমন্ত মুখোশ্রী। মীরা বিরক্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত! উশানের যদি ঘুমোতেই হতো তাহলে তাকে ফোন দিয়ে এভাবে বসিয়ে রাখার মানেটা কি? কই এতোটা দিন, পুরো তিন সপ্তাহ পর ফোন দেয়ায় উশান তার সাথে একটু কথা বলবে তা না! লোকটা ঘুমাচ্ছে!

বিরক্ত ভঙ্গিতে কন্ঠ দ্বারা শব্দ উচ্চারণ না করে মীরা ল্যাপটপের স্ক্রিনে পরাপর কয়েকবার টোকা দেয়।বেশ জোড়ে! যার দরুন উশানের তন্দ্রা কাটে। চোখ পিটপিট করে তাকায় মীরার পানে। বিরক্ত সহিত বলে,

-” কি সমস্যা? ঘুমোতে দিচ্ছো না কেনো? ”

মীরা ফুঁসে উঠলো। কন্ঠে কঠোরতা টেনে বলল,

-” আপনি কি আমায় ফোন দিয়েছেন এভাবে আমায় বসিয়ে রেখে ঘুমানোর জন্য? ”

-” হ্যা তবে তোমাকে তো আর বসে থাকতে বলিনি।তুমি চাইলে শুয়েও থাকতো পারো।পড়তেও পারো। যা ইচ্ছে করতে পারো শুধুমাত্র স্ক্রিনের সামনে থাকলেই চলবে। ”

-” এমন করে লাভ? এতদিন পর ফোন দিলেন একটু কথা বললেন না! ”

উশান শোয়া থেকে উঠে বসে। মৃদু হেঁসে মাথার চুল এলোমেলো করে নিজের। কতক্ষণ পর মীরাকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দর্শন করতে করতে শুধায়,

– ” আমি ঘুমাই কতক্ষণ জানো মীরা? মাত্র তিন ঘন্টা! এই তিনটা ঘন্টা আমি ঘুমাতে পারিনা কিছুতেই। বারবার তোমার চেহারা চোখের সামনে ভাসে। তোমার হাসি, তোমার হুটহাট রাগ করার দৃশ্য!এসব আমায় ঘুমোতে দেয় না কিছুতেই। ফোন তেমন একটা ইউজ করা হয়না ক্যাম্পে বাট আজ তোমার কথা মনে পড়লো! ভাবলাম পাশে না হোক অদূরে তোমার অস্তিত্ব আমার পাশে থাকলেও ঘুম হবে জম্পেশ! তাই এমনটা করা। বুঝেছো? আমি প্রায় ২ সপ্তাহ ঠিকমতো ঘুমাইনি। একটু ঘুমাতে দাও?এতো নিষ্ঠুর হলে চলে? ”

মীরার কঠিন হৃদয় গললো। গলে পানির মতো স্বচ্ছ এবং নরম হলো। তার দৃষ্টিপাত আটকালো উশানের মুখোশ্রীতে। উশান যে ঘুমোয়নি কতদিন তার স্পষ্টত প্রমাণ দিচ্ছে উশানের নেত্রজোড়া, মুখোশ্রীর বেহাল দশা! মীরার আচানক তিক্ত খারাপ লাগায় মন প্রাণ উজাড় হলো। সে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-” খেয়েছেন রাতে? ”

-” হু! তোমার খাওয়া হয়েছে? নাকি খাওনি এখনো, তাহলে আমি কল কাটি। খেয়ে আসো। ”

মীরা অস্থিরচিত্তে তাকাল। তার নেত্র যুগলে অস্থিরতা ফুটে। উত্তেজিত হয়ে বলল,

-” আরেকটু দেখিনা। ”

উশান হেঁসে ফেললো। বলল,

-” কি দেখবে? আমায় আর কখনো দেখোনি? আচ্ছা আমি ছবি পাঠাচ্ছি। মন ভরে দেখিও। ওকে? আল্লাহ হাফেজ। ”

-” উঁহু! আমি বলতে চাচ্ছিলাম আরেকটু কথা বলি না?”

উশান জোড়াল শ্বাস ফেললো। কন্ঠে অসহায়ত্ব টেনে বলল,

-“টাইম শেষ মীরা। এরথেকে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না।আমাকে ট্রেনিং দিতে যেতে হবে। যাদের আমি ট্রেনিং দেই তারা ঘুম থেকে উঠে বসে আমার অপেক্ষায়! যেতে হবে যে! জেদ করেনা।”

– ” আপনি তো ঘুমাতেই পারলেন না আমার জন্য। এখনি যেতে হবে? একটু ঘুমান। ”

উশান গায়ে সাদা শার্ট জড়িয়ে নিচ্ছিলো। তারই মাঝে ব্যাস্ত গলায় বলে উঠলো,

– ” আমি এমনিতেও ঘুমাতে পারতাম না তোমাকে সামনে রেখো। তুমি আমার মাদকতা! মাদকতা কে সামনে রেখে তাকে দর্শন না করে দেদারসে আমি ঘুমাই কি করে? ”

কয়েকপল চোখে চোখে কাটলো। বিদায় বার্তা ছাপিয়ে আসলো। উশান মীরাকে আরেক নজর দেখে চটজলদি ফোন কাটল। দু’জনের মাঝেই ব্যাবধান অনেকাংশ। এই ব্যাবধান ঘুচিয়ে অন্তঃস্থল ছটফট করাটা শিথিল করার উপক্রম নেই বৈকি। তবে একটিবার চক্ষু দর্শন যেনো তাদের জন্য অনেক, অনেক কিছু!

____

তারপর কাটল কয়েকমাস। বড়জোর তিন মাস তো হবেই। মীরার আর তার শেহজাদার সাথে বাক্য আলাপ হয়নি। লোকটা নিশ্চিত তুমুল পরিমাণে ব্যাস্ত! এই ভেবে ভেঙে আসে আর্তনাদময়ী ক্রন্দন থামিয়ে রেখেছে মীরা। তার মন উচাটন হয়ে। কবে? কবে পাবে আবার দর্শন উশানের? কবে সেই গায়ে কাঁপুনি ধরা কন্ঠস্বর শ্রবণ করতে পারবে?
মীরার পড়াশোনা চলছে পুরোদমে। পরিক্ষার চাপে তার বেহাল দশা। শত ক্লান্তির মাঝে উশানের সাথে কথা বলার প্রহর, রুহির উদ্ভট কথা শুনে খিলখিল করে হাসা, টুইঙ্কেলের সাথে চমৎকার কিছু সময় অতিবাহিত করা, মায়ানের সাথে রাত নামলেই দীর্ঘ ক্ষণ আড্ডা, বাবার কন্ঠ শুনে ক্লান্তি মেটানোর চেষ্টা, এভাবেই কাটছিলো মীরার দিনকাল। কখনো অস্থির মন আছড়ে পড়তো মন খারাপ নিয়ে তখন নিজেকে কায়দা করে সামলায় মীরা। ভেঙে পড়া চলে নাকি এতটুকুতে?

-” মিষ্টি রুহি আমার চকলেট খেয়ে ফেলেছে।”

মীরা মাহদির সাথে কথা বলছিলো। বাবাকে বিদায় জানিয়ে সে কল কেটে এগোল টুইঙ্কেলের নিকট। মেয়েটা গাল ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো চাহনি নিক্ষেপ করে আছে। লজ্জাবতী গাছে ছোঁয়া দিলেই যেমন তারা কুঁকড়ে যায় তেমনি টুইঙ্কেলকে এখন আহ্লাদ সহিত কিছু বললে নিশ্চিত সে কেঁদে কেটে একাকার করবে। হলোও তাই!

-” কি হয়েছে প্রিন্সেস? ”

টুইঙ্কেল নাক ফুলিয়ে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে হাত নাড়িয়ে অভিযোগের সুরে বলল,

-” রুহি! ঐ লাফঝাপঁ আমার চকলেট খেয়ে নিয়েছে মিষ্টি। ব্যাড গার্ল! ওকে বকে দাও এক্ষুনি। ”

মীরা টুইঙ্কেল কে দু-হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে।গালে লেগে থাকা পানি মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

-” কাঁদে না সোনা। আমি এক্ষুনি রুহিকে ধরে বকে দিচ্ছি, ওকে? ”

-” ওকে। ”

মীরা রুম থেকে বেরোনোর পূর্বেই রুহি আসলো তার রুমে। রুহিকে দর্শন মাত্র মীরা কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,

-” তুই ওর চকলেট খেয়েছিস রুহি? ”

রুহি ভনিতা ছাড়া জবাব দেয়, ” হ্যা। ”

-” টুইঙ্কেলের থেকে কেনো নিয়ে খেলি। বাচ্চা মানুষ ও! তোর খাওয়ার হলে বাহির থেকে কিনে আনতি।”

-” খাওয়ার একটা ভ্যালিড রিজন আছে জান। ঐটা তো শোন আগে। ”

মীরা ললাটে ভাজ ফেলে। জিজ্ঞেস করে,

-” কি রিজন?”

-” টুইঙ্কেল মিল্ক বার খাচ্ছিলো। ধবধবে সাদা রঙের চকলেট। দ্যাখ টুইঙ্কেল এমনিতেও কাগজের মতো সাদা এখন যদি আবার সাদা চকলেট খেয়ে আরো সাদা হয়ে যায়? টুইঙ্কেলের ব্যাপার আমি রিস্ক নিতে পারবো না মীরা। তাই খেয়ে ফেলেছি। ”

রুহির অহেতুক বক্তব্য শ্রবণ করে মীরা রক্তিম দৃষ্টিতে তাকায়। রুহি আমতা করতে করতে কামড়া হতে পগারপার। রুহি যেতেই মীরা হাসে। গলায় শব্দ করে!

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here