হৃদয়েশ্বরী – ৪০ সাদিয়া মেহরুজ দোলা

0
30

#হৃদয়েশ্বরী – ৪০
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

মীরা যেদিন হতে উশানের জীবন হতে নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে স্তব্ধতার রাজ্যে পারি দিলো, সেদিন হতেই উশান এক বাজে অভ্যাসের সাথে লিপ্ত হলো। যেই ছেলের সিগারেট দেখলেই ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসতো! সেই ছেলে এখন দিনকে দিন সিগারেট খাওয়া রপ্ত করেছে দারুণ ভাবে। বর্তমানের বিষন্ন সব প্রহর উশানের কাটে সিগারেটের সাথে। যখনই সে ক্যাম্পে ট্রেনিং দেয়া হতে বিরতি নিয়ে তখনই সুযোগ বুঝে ক্যাম্পের বাহিরে এসে সিগারেটের প্যাকেট খালি করে।সিগারেটের এলোমেলো ধোঁয়ার মতোই তার জীবন। সবকিছুই অবিন্যস্ত! কিছুই ঠিক নেই। কিচ্ছুটি না।

মীরাকে শান্ত করার জন্য ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। কোমায় থাকা পেশেন্টদের রিকোভার টাইমে উত্তেজিত হওয়া ক্ষতিকর তারজন্য। মীরাকে ইনজেকশন পুশ করার পর সে আগের ন্যায় নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। ঔষধের প্রতিক্রিয়া কাটার পর দেখা যাবে কি হয়। উশান অস্থির, শ্বাস রুখে বাহিরে চলে এসেছে। বাহিরে আসার পর থেকে একের পর এক সিগারেট শেষ করে পায়ের কাছে স্তুপ জমিয়েছে। সে এখনো হাসপাতাল থেকে অদূরে নির্জন এক স্থানে বসে। মানষিক টানাপোড়নে মস্তিষ্কের নিউরন এখন অস্থিতিশীল, উচাটন! সিগারেটের প্যাকেট শূন্যের কোঠায়। উশান হুঁশে ফিরলো। হাত দু’টো ধুলো ঝাড়ার মতো করে উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে করতে ভাবলো কিছু। যেই ভাবনার গভীরতা অনেক। পকেটে পুরে রাখা তার ফোন হটাৎ কেঁপে উঠলো। উশান পায়চারি থামিয়ে ব্যাস্ত হাতে ফোন বের করে। ক্লিওরা ফোন দিয়েছে। বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে উশান ফোন রিসিভ করে চট করে কানে লাগালো। অপাশ হতে গমগমে সুরে তৎক্ষনাৎ ফারহা বলে উঠলো,

-‘ স্যার মীরা! সে চোখ খুলেছে। আপনাকে দেখতে চাচ্ছে স্যার। জলদি ফিরে আসুন। ‘

নিঃশব্দতা বজায় স্থানটিতে ছোটখাট্টো বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। তবে তা উশানের অন্তঃস্থলে। হাতের ফোনটা কোনোমতে পকেটে পুরে সে পাগলের মতো দৌড়ানো শুরু করলো। আশ্চর্য! পথটা এতো দীর্ঘ হলো কি করে?

ফারহা ফোন কেটে মিটিমিটি হাসছে। সে আজ খুশি। ভীষণ রকমের খুশি। হৃষ্টচিত্ততায় মন প্রাণ আজ উজার। এই ছয়টা মাস মীরা তার আন্ডারে ছিলো। প্রতিটা লহমা সে দেখেছে উশান যখন মীরার নিকট থাকতো তখন ছেলেটা কেমন করে ছটফট, হাসঁফাসঁ করতো! কষ্ট পেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যেতো তা ঢের বুঝতে পারতো ক্লিওরা। আজ যখন মীরার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলে তাকালো মেয়েটা, কাঁপা ঠোঁটে এলোমেলো করে উশানের নাম নিলো তখন ক্লিওরা বুঝেই নিলো আসলেই ভালোবাসা সুন্দর। স্বচ্ছ এবং পবিত্র!

লিফটে জায়গা পেলো না উশান। পর্যাপ্ত মানুষে ভরপুর হয়েছে তখন সেই আধুনিক যান্ত্রিক কক্ষটা। লিফটের কথা ভুলে উশান উঠে পড়ে ছুটলো সিঁড়ির দিকে। ১৭ তলা সে উঠে এলো বিনা ক্লান্তিতায়।উঠে এসে ক্লান্ততার রেশ তার মুখোশ্রীতে খুঁজে পাওয়া গেলো না। বরঞ্চ অদৃশ্য এক হৃষ্টচিত্ত, বক্ষঃস্থল ভরা লুকিয়ে রাখা চরম খুশি। তাই ফুটে উঠলো মীরার কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো সে। দুই, তিনজন ডাক্টার দাঁড়িয়ে। মীরার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তারা। উশান মীরার পানে দৃষ্টিপাত ফেললো। মেয়েটা পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতোমাস পর চোখ খুললো! বাহিরের তীব্র রশ্মির কারণে ঠিক মতো সে তাকাতেও পারছে না। ফারহা বুঝলো বিষয়টা। সে গিয়ে লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বালালো। তারপর উপস্থিত ডাক্তারদের নিয়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে উশানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘ আপনি লাকি স্যার। খুব লাকি। কোমার এই সিচুয়েশনে থেকে মূলত কেও সুস্থ রূপে বেঁচে ফিরে না। কিন্তু মীরা ফিরেছে। সুস্থ রূপে! খেয়াল রাখবেন ওর। ‘

মীরা নড়াচড়া করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না কিছুতেই। বলা চলে, নড়াচড়া কিভাবে করে? তা সে ভুলে গিয়েছে। উশান ত্রস্ত পায়ে এগোল। পা দু’টো তার এতো কাঁপছে কেনো?এতো ধীরাজ হলে চলে? মীরাবতীকে ঝাপটে ধরে আদর দিতে হবে না? বকুনি দিতে হবে না?মেয়েটা এতো এতো কষ্ট দিলো তাকে! বদমাইশ!

মীরার মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক, হাতে লাগানো স্যালাইনের ক্যানুলা আরো যাবতীয় সবকিছু খুলে দিয়ে নার্স চলে গেলো। উশান পরপরই মীরার পাশে বসলো। মীরার হাড্ডিসার গাল দু’টো নম্র, কোমল হাতে ছুঁয়ে দিলো কম্পমান হাতে। কন্ঠনালী দ্বারা সে শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না কিছুতেই। শব্দজোট বেঁধেছে গলায়। সর্বপ্রথম নীরবতা কাটালো মীরা। খুব কষ্টে আঠালো ন্যায় অধর জোড়া প্রসারিত করে ভাঙা গলায় সে বলল,

-‘ আমাকে একটু উঠিয়ে বসান না। ‘

উশান তাই করলো। মীরাকে ধরে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। কতমাস পর মীরা উঠে বসলো। মাথা চক্কর দিতে নিলেও সে নিজেকে সামলালো। সামনে বসা থাকা নিস্তব্ধ মূর্তির ন্যায় পাথর মানবটার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। দু’হাতে জোর নেই বলা চলে। তবুও অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সে উশানের পিঠ খামচে ধরলো। ধারালো আঘাতে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে পুরোপুরি শান্ত হলো উশান। মীরার পিঠে সে একহাত রাখলো। অন্যহাত দিয়ে মীরার গাল ধরে নিজের দিকে ফেরালো। মেয়েটার ঠোঁট দু’টো কেমন অবিরত কাঁপছে। কাঁদবে বোধহয়! আঁখি দু’টোও কেমন টলমলে হয়ে।

-‘ দীর্ঘ ছয় মাস আমায় নরক যন্ত্রণা দিয়েছো মীরা। এই যন্ত্রণার উপশম দাও এবার। একটু আদর করি? জাস্ট একটুখানি! ‘

কন্ঠ জমাট। মীরা নতজানু হলো। স্বগতোক্তি করে বলল, নির্লজ্জ লোক! এতো লজ্জার কথাটা সে মুখে বলে কি করে?লোকটা কি বুঝে নিতে পারে না তার ইশারা? হাহ্!

মীরার অন্তঃকরণ বার্তা বোধকরি উশান বুঝে নিলো চট করে। সে মাথা নিচু করে অধর ছোঁয়ালো মীরার গালে। অনবরত আদুরে স্পর্শ একেঁ দিলো সময় নিয়ে। মীরা তখন গুটিশুটি মেরে এমন ঝংকার তোলা আদর পেয়ে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে উশানকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় সে ব্যার্থ হলো। উশান খপ করে তার হাত ধরে ফেলে হিসহিসিয়ে বলল,

-‘ আজ না মীরাবতী। আজ বাঁধা দিও না। আজ বাঁধা দিলে উশান রেজওয়ান সেই বাঁধা মানবে না।’

বাদামী রঙের মীরার ওষ্ঠাধর। উশান আলত করে ছুঁয়ে দিলো মীরার অধর জোড়া। আঙুল দিয়ে। দুই, তিনটে প্রগাঢ় চু’মু খেয়ে উশান মীরাট জীর্ণশীর্ণ দেহটাকে নিজের সাথে আলত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। এইতো, এতোদিনের ছটফট করা হৃদপিণ্ড, হৃদঃস্থলে উৎপত্তি হওয়া বেসামাল ঝড় আজ এতোদিন পর শিথিল হলো।

___

কতক্ষণ এভাবে উষ্ণ আলিঙ্গনে নিবদ্ধ হয়ে কেটে গেলো দুজনের কারোরই জানা নেই। তবে এক সময় মীরা এই আলিঙ্গন ছেড়ে মুক্ত হয়ে সটান হয়ে বসলো। অবলোকন করলো উশানের প্রতি। উশান তখন প্রশ্নবিদ্ধ নজরে তাকিয়ে। সে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ কি হয়েছে? দূরে সরে গেলে কেনো? কাছে এসো।’

উশানকে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দর্শন করতে ব্যাস্ত মীরা।সে উশানের বলা বাক্যটা শ্রবণ করেও সে উশানের কাছ ঘেঁষলো না। কিছুক্ষণ পর ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলো,

-‘ কতদিন ধরে খাওয়া দাওয়া করেননি? ‘

শার্টের কলার ঠিক করলো উশান। মীরাকে আলত হাতে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে ফের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। উত্তর দিলোনা কোনো। মীরা তাতে ক্ষুব্ধ হয়! পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

-‘ উত্তর দিচ্ছেন না যে? ‘

-‘ এতদিন ঘুমালে। ঘুম থেকে উঠেই এতো রাগ? শান্ত হও! ‘

-‘ আপনি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। নিজের এই অবস্থা করেছেন কেনো? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হওয়া সন্নাসী প্রেমিক! সত্যি করে বলুন তো, আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তখন আপনি অন্য কোনো মেয়ের সাথে রিলেশনে ছিলেন? ‘

উশানের উচিৎ মীরাকে ধরে এখন চড়ানো! ইচ্ছে হলোও তাই। কিন্তু ইচ্ছে বাস্তবায়ন সে করলো না। রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করে সে গর্জে উঠলো। বলল,

-‘ উল্টোপাল্টা কথা বলবে না মীরা! তুমি জানো না? আমার এ অবস্থা কেনো! হাহ্? ‘

পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। মীরা বুঝলো। সে এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না। মিনিটখানেক পর নিম্ন সুরে বলল,

-‘ ভাত নিয়ে আসুন। ‘

-‘ খিদে পেয়েছে? খাবে? ‘

-‘ তো ভাত কি আমি ভূতের জন্য আনতে বলছি?’

কেবিন থেকে চলে গেলো উশান। মীরার ত্যাড়া উত্তর গায়ে মাখলো না। রাগ লেগেছিলো যদিও। তবুও চলে গেলো! মীরা সেখানেই কোনোমতে ঠেস দিয়ে বসে রইল। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই বোধহয়। বসেও থাকা যাচ্ছেনা। হাত – পা কেমন তিরতির করে কাঁপছে।

উশান ফিরে আসলো পনেরো মিনিটের মাধ্যমে। চোখ মুখ তার আঁধারে বিলীন। মীরা তা দেখে চট করে বলল,

-‘ কি হয়েছে? ‘

উশান মন খারাপ নিয়ে প্রতিত্তুর করে,

-‘ খাবার খেতে পারবেনা এখন মীরা। ডাক্তার নিষেধ করলো। বলেছে এখনি খাওয়া ঠিক হবেনা। এক ঘন্টার মতো ওয়েট করতে হবে। পারবেনা? খুব বেশি খুদা পেয়েছে? ‘

মীরা মৃদু হেঁসে বলল, ‘ ভাত কি আমি আমার জন্য আনতে বলেছি? ‘

ভ্রু দ্বয়ের মধ্যে ভাজ ফেললো উশান। ভারী কন্ঠে বলল,

-‘ তাহলে? ‘

-‘ এদিকে আসুন। ‘

উশান এগোল। খাবার প্যাকেট মীরার হাতে ধরিয়ে দিলো। ভাত আনেনি উশান।ফ্রাইড রাইস এনেছে। তাছাড়া এখানে এসময়ে আপাতত ভাত পাওয়াও সম্ভব নয়। মীরা চামচে করে কিছুটা রাইস তুলে নিলো। উশানের মুখের সামনে তুললো চামচ।জেদ ধরে বলল,

-‘ হা করুন তো জলদি! আমি খাইয়ে দিবো আপনাকে। নিষেধ করবেন না। আপনার কথা আমি শুনবো না। ‘

-‘ আপনার হাতে খাওয়ার সুযোগ আমি কিছুতেই মিস করবো না ম্যাডাম। ‘

চামচে খাবার তুলে একনাগাড়ে উশানকে খাওয়াচ্ছে মীরা। তার হাত দু’টো কাঁপছে প্রবল। কাঁপা কাঁপি থামানোর প্রবল চেষ্টা করছে মীরা। লোকটা নিশ্চিত তার কাঁপা হাত দেখলে আর খাওয়াতে দেবেনা!এটা আপাতত চাচ্ছে না মীরা। উশানকে কতদিন পর সে নিজ হাতে খাওয়াচ্ছে। আনন্দের চোটে তার নেত্র কোণে পানি এসে জমেছে। সে কোনোদিনও ভাবেইনি যে সে বেঁচে ফিরবে।

উশান খাচ্ছে আর মীরাকে নির্নিমেষে দেখে যাচ্ছে। তার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না তার সামনে মীরা বসে রয়েছে। তাকে খাইয়ে দিচ্ছে! কাল পর্যন্তও তো এই মেয়েটা এসময় স্তব্ধতা ধারণ করে ঘুমোচ্ছিলো! আর আজ দেখো। উশান ঠিক করলো খাওয়া শেষে সে দুই রাকআত নফল নামাজ পড়বে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায়ের জন্য।

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here