#হৃদয়েশ্বরী – ৪১
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
উশানের ট্রেনিং দেয়া শেষ। এবার তার ঢাকা ফেরার পালা। সব প্রস্তুতি নেয়া শেষ। তীব্রর সাথেই ঢাকা ফিরছে সে আজ।এখানে ট্রেনিং দিতে সে আর তীব্রই এসেছিলো শুধু। ফিরে গিয়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ এক মিশনে যেতে হবে। এই মিশনটার জন্য সে বহুকাল যাবৎ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষায় ছিলো।
তখন পড়ন্ত বিকেল। অনিলে নাম না জানা পুষ্পের চমৎকার ঘ্রাণ। সাথে ডুবন্ত বেলার হলদেটে আলো! বাতাবরণের এই লহমা উশানের ভীষণ পছন্দের। পছন্দের সময়টা আরো আকর্ষণীয় এবং চমৎকার করা যায় প্রিয় মানুষের দ্বারা। উশান আঁড়চোখে মীরার দিকে তাকালো। মীরা সামনে তাকিয়ে আছে। তার মুখোশ্রীতে হৃষ্টচিত্তের বিস্তার। আগের তুলনায় মীরা সুস্থ এখন। অনেকটাই! মীরাকে আলগোছে দর্শন করতে করতে উশানের হটাৎ মনে হলো এই সুন্দর, মায়াবতী রমনীটা তার। একমাত্রই তার। বাসন্তী রঙের শাড়ী পড়ে মীরা। বাতাসে উড়ছে শাড়ীর আঁচল আর তার ঘন কালো কেশের দল। কি যে সুন্দর লাগলো এই দৃশ্যটুকু তার। ভালোলাগায় তার বক্ষঃস্থল কেঁপে উঠলো।
-‘কি দেখছেন এভাবে?খেয়ে ফেলবেন নাকি?আশ্চর্য! দৃষ্টি সরান। ‘
মীরা সঙ্গে সঙ্গে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। ছিহ্! কি বলল সে এটা? এই কথাটাই কেনো মুখ দিয়ে বের হলো? হায় আল্লাহ! লোকটা কি ভাবছে? কিয়ৎক্ষণ পর উশানের ভারী কন্ঠ মীরার কর্ণকুহরে পৌঁছালো। ভারী কন্ঠে লেগে ছিলো তার রসিকতার রেশ।
-‘ খেয়ে ফেলবোই তো জান।একদম আঁচড়ে,কামড়ে খেয়ে ফেলবো! তবে এখন নয় বাসর রাতে। একটু ওয়েট করো। ‘
লাজুকলতাকে ত্রপা ভর করলো না।লজ্জায় অতিষ্ঠ হয়ে কুঁকড়ে গেলো না মীরা। তার মন বিষন্ন।তবুও আলগোছে উশানকে চোখ রাঙাতে ভুললো না। হাত দিয়ে উশানের বাহুতে আলত করে থাপ্পড় মারলো সে। পরপর সামনে হাঁটা ধরলো। উশান একটু ভড়কালো! মেয়েটা লজ্জা পেলো না যে? সে কি উশানের কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করে নি?
মীরা উশানের হাত টেনে ধরে হাঁটা ধরলো নির্জন, জনমানবহীন এক স্থানে। কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতেই প্রশান্তি নিয়ে মীরা বসে পড়লো। উশান পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে ভ্র দ্বয়ের মাঝখানে ভাজ ফেলে বলে উঠলো,
-‘ এখানে আসলে যে? ‘
মীরা শাড়ীর আঁচল দিয়ে গলায়, কপালে জমে থাকা মুক্তোর দানার ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাম মুছছিলো। উশানের প্রশ্ন শুনে জবাব দিলো,
-‘ রোদ ওখানে অনেক।গরম লাগছে।তাই ছায়ায় আসলাম! ‘
উশান তৎক্ষনাৎ ব্যাঙ্গ করে বলল,
-‘ এতক্ষণ তো ঠিকই রো দিয়ে হাটাঁর জন্য জেদ করছিলে। এখন গরম লাগছে?’
মীরা বেখেয়ালি ছিলো। উশানের কথা কানে তুললো না। এক পর্যায়ে সে আচানক জেদ নিয়ে বলল,
-‘ আমিও আজ রাতে আপনার সাথে ঢাকায় ফিরে যেতে চাই। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছেনা আর। ‘
-‘ পাগল হয়েছো মীরা? তোমার পড়াশোনা এখানে।ঢাকায় গিয়ে কি করবে?’
-‘ আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। ‘
মীরার পাশ ঘেঁষে বসলো উশান। কাছে টেনে নিলো মীরাকে। আলত হাতে ছুঁয়ে দিলো মীরার কেশ। বেশ তুলতুলে মেয়েটার চুল। একবার ধরলে বারবার ধরতে ইচ্ছে করে। উশান খানিকক্ষণ বাদে কন্ঠের খাদ নামিয়ে মেঘমন্দ্র গলায় বলল,
-‘ ছেলেমানুষী আবেগী কথা যত্তসব! আমাকে ছাড়া ছিলেনা এতোদিন? তাহলে এই কয়েকটা মাস আর কেনো থাকতে পারবে না? তোমার যদি পড়াশোনাও না থাকতো এখানে, তবুও আমি তোমায় নিতাম না কিছুতেই। ফিরে গিয়েই আমাকে মিশনে যেতে হবে। ঊষা, রাহনুমা! এদেরকে আর কতদিন মুক্ত আকাশে উড়তে দেই? ‘
উশানের পরনের কালো শার্টটার বোতাম নিয়ে নড়াচড়া করছিলো মীরা। উশানের প্রতেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে এবার সে মাথা তুললো। কৃষ্ণবর্ণের মুখোশ্রী তার মাত্রাতিরিক্ত কৃষ্ণ লাগছে এখন। আঁখি দু’টো লাল হয়ে একাকার অবস্থা। সে নিজেকে সামাল দিয়ে ক্রন্দন চেপে রেখে বলল,
-‘ আপনি কি গিয়ে সেই সন্ত্রাসী দলটাকে ধরার কাজে লাগবেন?’
-‘ হ্যা। আমি এখন সেই মিশনের প্রধান দায়িত্ব পেয়েছি। ঐটা আমাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে। ‘
-‘ আচ্ছা, ওনারা আমার ওপর কেনো এমন হামলা করলো? আমি কি করেছি? ‘
উশান সময় নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। মীরার এক হাত সে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের অধরের কাছে এনে ছোট্ট ছোট্ট চুমু দিলো বেশ কয়েকটা। শেষে নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,
-‘ ওরা আমাকে দূর্বল করতে চাচ্ছে। কোনোভাবে জেনেছে তারা আমি ওদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গিয়েছি। মেরে ফেলতে না পেরে দূর্বল করার জন্য নেমেছে এখন। ওরা চাচ্ছে আমি দূর্বল হয়ে পড়ি। ভেঙে পড়ি! আর সুযোগ বুঝে তারা আমাকে মে’রে ফেলুক। এটাই ওদের একমাত্র লক্ষ্য এখন। আর আমার দূর্বলতার একাংশ তুমি। তোমরা! তীব্র, টুইঙ্কেল, উজান। যাদের হ’ত্যা করার চেষ্টা করছে এখন। পারবেনা আর। চিন্তা করোনা। ‘
মৌনতা, দীর্ঘ নিঃশ্বাস, একরাশ আতঙ্ক আচানক গ্রাস করে নিলো অনুভূতির প্রহরটাকে। মীরার মন এখন ছটফটে হয়ে! বারংবার নেত্র বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে চাইছে। উশানের চিন্তায় এবার বুঝি সে মা’রা’ই যাবে। লোকটা এতো কেনো দূর্বল করে দিলো তাকে? মীরা শক্ত হলো। এমনভাবে দূর্বল হওয়া তাকে মানায়? নাহ্! সে একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এর ওয়াইফ। তাকে থাকতে হবে পাথরের মতো শক্ত, কঠিন। যেমনটা উশান থাকে সর্বদা।
-‘ কি ভাবছেন ম্যাডাম? ‘
নড়েচড়ে উঠলো মীরা। উশানের বক্ষঃস্থল হতে ভারী মাথাটা উঠিয়ে নিলো। দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো সম্মুখে। উশান মীরাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষলো। সম্মোহনী গলায় হুট করে বলল,
-‘ এতো কেনো চিন্তা করছো? রিলাক্স হাহ্?আমার কিছু হবেনা। এতোটা দূর্বল ভাবো আমাকে? দেখবে ঠিকই ফিরে আসবো আবার তোমার কাছে। এবার আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করো তো! ‘
মীরা নাক টানলো। শ্লেষের গলায় বলল,
-‘ কি ইচ্ছে? ‘
উশান অতি আবদার সহিত মিষ্টি কন্ঠে বলল,
-‘ একবার আমায় ‘তুমি’ করে ডাকো প্লিজ। কে জানে আর কখনো তোমার কাছে ফিরতে পারি নাকি না। ‘
মীরা ক্রন্দন মাখা কন্ঠে বলল, ‘ মাত্রই তো বললেন ফিরবেন। এখন আবার রঙ পাল্টাছেন কেনো? বেয়াদব লোক! ‘
উশান হেঁসে ফেললো। একগাছি চুল হাতে নিয়ে লম্বা করে শ্বাস টেনে সে ঘ্রাণ নিলো। কন্ঠে আসক্তি মিশিয়ে বলল,
-‘ তুমি ডাকো প্রিয়লতা! একবার ডাকো। ‘
মীরা গহীন চোখে তাকালো। মিহি কন্ঠে শুধালো,
-‘ তুমি ফিরে আসবে। ওয়াদা করো! ‘
প্রতিত্তুর করলো না উশান। সে কাছে টানলো মীরাকে। গভীর করে, সময় নিয়ে ওষ্ঠাধর নিজের অধর জোড়া মিশিয়ে দিলো। অতঃপর কিয়ংদশের নিস্তব্ধতা। নির্জন ভূমিতে শব্দ হলো বৃষ্টি আছড়েঁ পড়ার। মীরা, উশান ভিজে জবুথবু হলো তবুও বিন্দুমাত্র নড়লো না।
___
টুইঙ্কেল কে হোমওয়ার্ক করাচ্ছে মীরা। পাশেই উশান দাঁড়িয়ে নিজের জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকাচ্ছে আর ব্যাস্ত গলায় কারো সঙ্গে আলাপচারিত করছে। সময় দেখে কল কাটলো দ্রুত। ব্যাগ হাতে নিয়ে ফোনে টাইপিং করে ফোন পুরে নিলো পকেটে। তারপর সে এগোল টুইঙ্কেলের নিকট। টুইঙ্কেলকে কোলে তুলে দুই গালে টপাটপ চুমু খেয়ে বলল,
-‘ চাচ্চু চলে যাই প্রিন্সেস! টাটা দাও। ‘
টুইঙ্কেলের সুন্দর, শুভ্র মুখোশ্রীতে অমাবস্যার আঁধার নামলো। অধর জোড়া ফুলিয়ে সে দৃষ্টি ফেললো একবার মীরার পানে। পরপর ফের সে উশানের গালে দুইহাত রেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
-‘ কোথায় যাও চাচ্চু? আমি আর মিষ্টিও তোমার সাথে যেতে চাই। মিষ্টি? বলো যাবেনা চাচ্চুর সাথে! ‘
-‘ যাবে তো প্রিন্সেস। আগে আমি যাচ্ছি। তারপর তুমি আর মিষ্টি যাবে। খুব দ্রুতই। তোমার এখন এক্সাম চলছে না? এক্সাম শেষ হলেই তোমাকে নিয়ে যাবো। মিষ্টিরও তো এক্সাম না? তোমরা দু’জন যখন ফ্রী হবে তখন তোমাদের নিয়ে যাবো। ওক্কে? ‘
-‘ ওকে চাচ্চু। ‘
উশান মীরার নিকট এগোল। মীরাকে জড়িয়ে ধরে লম্বা শ্বাস টানলো কয়েকবার। মিহি কন্ঠে সে বলল,
-‘ আই উইল মিস ইউ মীরা। আই উইল মিস ইউ। ‘
নিজেকে শক্ত করলো মীরা। এমন সময় কাঁদলে চলে? সে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘ আমরা দ্রুতই আসবো। নিজের খেয়াল রাখবেন। জলদি যান। আপনার লেট হচ্ছে। ‘
রাত দু’টোয় ট্রেন। উশান চলে গেলো তৎক্ষনাৎ।তীব্র ফোন দিয়েছে তাকে।
চলবে..