#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৭
হাউ মাউ যাই করছে কিচ্ছু বুঝা যাচ্ছে না। একদম কাছে আসার পর বুঝা যাচ্ছে এটা কোনো আধ্যাত্মিক মানব হবে। নীল রঙের চোখ বিশিষ্ট, কালো মাস্ক পড়া যার ফলে চেহারা দেখা যাবে তো দূর, আন্দাজ করাও যাবে না। হাতে কালো রঙের উইন্টার হ্যান্ড গ্লাভস পড়া। পকেট থেকে একটা মেটালিক হাতিয়ার বের করলো, কাচির মতো দেখতে, সাইজে ছোটো, করাতের মতো ধারালো অংশবিশেষ।
এটা দেখে মারুফ খুব বেশি কাতরাচ্ছে, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে নড়াচড়া করছে, ছুটার প্রচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। আস্তে আস্তে মারুফের প্যান্টের বেল্ট খুলে দিলো, এরপর একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হলো মারুফ! ওর তলপেটে অই কাচির মতো হাতিয়ারটা দিয়ে আঘাত করলো, সাথে সাথে অনেক অংশ কেটে গিয়ে রক্তপাত হতে লাগলো। একমুঠো বালিকণা সেই স্থানে ঝরঝর করে করে ফেললো, মারুফের অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে ও চোখের সামনে কেবলই নিজের মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছে।সারা গায়ে মৃত্যুর ভয়াবহ প্রখর যন্ত্রণার সাথে এমন অমায়িক অত্যাচার চলছে তার সাথে।
বাঁচার আকুতি দূরে থাক চিৎকার করার মতো সুযোগও হচ্ছে না শেষ সময়টাতে।
ভোর ৫ টা, চারপাশটা জনমানবে পূর্ণ হয়ে আছে ফুটওভার ব্রিজের পুরো এরিয়াটা।
পুলিশ, নিরাপত্তা কর্মী, সাংবাদিক, নিউজ পোর্টাল, আর তাদের ঘিরে আছে সাধারণ জনতার কৌতুহলী স্রোত। ফুট ওভারের দুইমাথায় আটকে দেয়া হয়েছে যেনো কোনো পাব্লিক এখানে আসতে না পারে। সরকারি কর্মীরা যেনো ভালোভাবে ইনভেস্টিগেশনস চালাতে পারে সেভাবে নিরাপত্তা কর্মীরা জায়গা আটক করে রেখেছে, ফুট ওভার ও রাস্তার মাঝ বরাবর। শুন্যস্থানে মারুফের মৃত লাশটা ঝুলছে। লাশটাকে নামানোর সাথে সাথে ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়ে যায়, সাথে সাথে হসপিটালে নেয়া হয় মৃত লাশটাকে।
মারুফের বাবা হাবিবুর রহমান বারণ করলেও কেউ উনাকে এই মুহুর্তে এমপির চোখে দেখছে না। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে বিরোধী দলের কাজ হতে পারে বলে হাবিবুর রহমান থানায় কেস করে তার বিরোধী দলের নামে। তার জবান অনুযায়ী বিরোধী দলের লোকদের আটক করা হয়। লাশটার খবর শোনার পর থেকে তীব্রকে একের পর এক কল দেয়া হচ্ছে, কিন্তু তীব্রর কোনো হুদিস নেই।
তীব্র তো স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। মিনিমাম দশটা বাজবে ওর ঘুম ছেড়ে উঠতে। ঘুম থেকে উঠার পর ফোনে এতোগুলো কল দেখে, কল ব্যাক করে। ওপাশ থেকে রিসিভ করে উত্তেজিত স্বরে কেউ বলে উঠে,
‘‘হ্যালো স্যার! আসসালামু আলাইকুম স্যার।’’
ফোনের ওপাশে কে সেটা জিজ্ঞেস না করে তীব্র চুপ করে রইল, ভয়েস টা চেনার চেষ্টা করল।
‘‘এএস আই রাসেল?’’
‘‘জি স্যার। স্যার আপনি কোথায়?’’
‘‘কি হয়েছে? উত্তেজিত লাগছে কেনো এতো?’’
‘‘স্যার লঙ্কা কান্ড হয়ে গেছে। যদি পারেন মিরপুর -১০ আসেন।’’
‘‘সারমর্ম টা বলো।’’
‘‘স্যার তোরাগ থানার এমপির ছোটো ছেলের মার্ডার হয়েছে গত রাতে। বুঝতে পারছি না এটা কার কাজ, আমরা যে কিলারকে খুঁজছি সেই নাকি অন্য কেউ।’’
‘‘আচ্ছা থাকো ওখানে আমি আসছি।’’
‘‘ওকে স্যার। আসসালামু আলাইকুম।
তীব্র কল কেটে দিয়ে তোরাগ থানার সেই ওসি কে কল করল।’’
‘‘স্যার আসসালামু আলাইকুম।’’
‘‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি অফিসার, দাদার কথা এক রাতেই ফলে গেল তাহলে? কিছু বলেছিলাম কালকে?’’
‘‘স্যার এটা কি করে হলো?আপনি যা বললেন তাই ই হলো!’’
‘‘আমি কি করে বলব! জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে, তিনিই ভাল জানেন। যাকগে ভালোই হয়েছে দেশে থেকে জনসংখ্যা কমলো তো একটা। আপনাদের এমপিকে বলে দেবেন, পুলিশের দায়িত্ব পাবলিকের প্রয়োজনে আসা, নিজের না। আর পাঁচটা পা চাটা পুলিশের দলে তীব্রকে ফেললে তো চলবে না। আমি হলাম মাথা কাটা দলের লোক। কারো বাপের খাই না, তাই কে আসলো গেল তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।’’
‘‘স্যা স্যার আমি আপনাকে আবারো সরি বলছি, আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারি নি স্যার।’’
তীব্র কল কেটে দিয়ে, তুচ্ছ একটা হাসি দিয়ে ফোন পাশে রাখল।
বারোটার দিকে হসপিটালে পৌঁছাল।
ডিস্ট্রিক কমিশনার এমপি সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত্বনা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তারাও তার আশেপাশে। তীব্র আসার পর একদল জুনিয়র অফিসাররা তীব্রর কাছে যেতেই তীব্র আঙুলের ইশারায় সবাইকে নিজের পজিশনে থাকতে বলল।
শুধু রাসেলকে ইশারায় কাছে আসতে বলল।
রাসেল তীব্রকে ডেড বডির কাছে নিয়ে গেল।
‘‘স্যার এটা আমার জীবনে দেখা সব থেকে কঠিন মৃত্যু ছিল। এতো বাজে ভাবে মারা হয়েছে!’’
তীব্র নাক মুখ রুমাল দিয়ে ছাপিয়ে ডেড বডিটা পর্যবেক্ষণ করছে।
‘‘কি মনে হয় রাসেল, আমরা যাকে খুঁজছি এটা তাঁর কাজ?’’
‘‘স্যার বডিটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় মাথায় নিখুঁত একটা আঘাত, যে আঘাতটা খুবই সরু বা ক্ষুদ্র বস্তু দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। ওর তলপেটে ধারালো বস্তু দিয়ে কাটা হয়েছে হতে পারে ব্লেড বা ছুরি। আর স্যার বড় বিষয় হলো ওর অণ্ডকোষ সহ পুরুষাঙ্গ টা কেটে প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়েছিল।
মারা যাওয়ার পর বা আগে একপায়ে শিকল বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
স্যার কোনো ভাবে এই ছেলে রেপিস্ট ছিলো না তো? যার জন্য কেউ রিভেঞ্জ নিয়েছে?’’
‘‘রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে।’’
‘‘জি স্যার, তবে মনে হচ্ছে না এটা আমরা যে কিলারকে খুঁজছি তাঁর কাজ। অন্য কেউ হতে পারে।’’
‘‘না।’’
‘‘মানে স্যার?’’
‘‘ওর তল পেটে দেখো শুধু কাটা হয়েছে তা নয়। সেই একই রকম পেরেক মারা যেখানে বালি ছিটিয়ে দিয়েছে। খুব কুল মুডে মারা হয়েছে। তাই এই বিদ্ধস্ত হাল করেছে ওর। কাল ই আন্দাজ করেছিলাম এই এমপির কোনো একটা ছেলে কোলহারা হয়ে যাবে, কিন্তু কে যাবে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। যার জন্য আমি নিজেই তাদের থানায় গিয়েছিলাম। জানি না শালা কোন চুলায় ছিল কাল আমি যাওয়ার পরেও দেখা করতে আসে নি, বলেছে সে থানার বাইরে আছে।
যাই হোক যা হওয়ার তা হয়েই গেছে।’’
‘‘জি স্যার।’’
‘‘একটা জিনিস ভেবে দেখেছ রাসেল?কিলার কিন্তু বেশির ভাগ এই রাজনৈতিক দলের কোলহারা করছে। যাদের মেরেছে তারা কেউ ই ভালো মানুষ না।
কিছু তো একটা ব্যাপার আছে!
যেমন ধরো নবীনগর থানার এমপির মেয়ের জামাই এএসআই অন্তুর মার্ডার হলো, সেটা নিয়ে সবাই উঠে পড়ে লেগেছে, তুমি এটা বলো একজন এএসআই এর পক্ষে কি করে ঢাকাই ফ্ল্যাট দামী গাড়ী করা সম্ভব? তাও নাকি প্রমোশন হয়েছে দু বছর না এক বছর আগে!’’
রাসেল হাল্কা হেসে বলল,
‘‘স্যার সাত বছর ধরে এএসআই পদে আছি। গ্রামের সবাই দারোগা বলে ডাকে, ভাবে আমার অনেক পাওয়ার আর অনেক টাকা। অথচ কোয়াটারের বাসা দরখাস্ত করে পাই নি বলে এখনো ঢাকাই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে ফ্যামিলি নিয়ে উঠার সামর্থ্য হচ্ছে না। আর এরা কি করে পারে!’’
তীব্রও হাসি দিয়ে বলল,
‘‘বুঝো না কি করে পারে? এরা স্পেশাল পাওয়ার যুক্ত, যা তোমার আমার মাঝে নেই। আমার বাবা এডিশনাল ডি আইজি ছিলেন জানো তো? সে ক্ষেত্রে সরকারি ফ্ল্যাটেই আমাদের বেড়ে উঠা। নিজের মন মতো, মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী একটা বাড়ি করার জন্য পেনশন অব্ধি অপেক্ষা করতে হয়েছে বাবার। তার সারাজীবনে মাসিক যা ইনকাম ছিল তা আমাদের ফ্যামিলির খরচ চালানো, আমাদের লেখাপড়ার পেছনে ভাঙা, আমাদের চাহিদা পূরণ সব মিলিয়ে টাকা মাস শেষে ফুরিয়েই যেতো। আমার দাদার পেনশনের টাকা, তার করা সমস্ত প্রোপার্টি থেকে বাবা এক কানা কড়িও নেয় না, যার জন্য দাদা সেগুলো দিয়ে আমাদের দেশের বাড়ি একটা হসপিটাল, একটা হাই স্কুল,আর একটা মাদ্রাসা করে দেয় বড় করে বাকি যা টাকা থাকে তা গরীবদের মাঝে ভাগ করে দেয়। আমার বাবাও তার বেতন থেকে প্রতিমাসে কিছু অংশ সরিয়ে রাখতো গরীবদের মাঝে দেয়ার জন্য।
ভবিষ্যতের কথা ভেবে কখনো দুই পয়সা আলাদা করে রাখে নি। মা বলে আমিও নাকি বাবার মতোই হয়েছি। যা আছে তাই নিয়েই বিন্দাস! খামোখা বিলাসিতা আর ভবিষ্যতে ভালো থাকার চিন্তা করে নিজের চরিত্র বিসর্জন দিব কেনো? আচ্ছা আমরা মানুষরা কেনো একটা বার ভাবি না মৃত্যুর পর এগুলো কালী হয়ে থাকবে?’’
রাসেল শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তীব্র অনেক সিনিয়র হলেও রাসেল তীব্রর সামনে অনেকটা কমফোর্টেবল ফিল করছে, কারণ তীব্রর সাথে যে যেমন তীব্রও তার সাথে তেমনই। তীব্র রাসেলের মাঝে সততা দেখতে পায় বলেই ওর সাথে এতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে মিশে যায়। রাসেলের কাছে একটা পছন্দের ক্যারেকটার হয়ে উঠেছে তীব্র। অবশ্য প্রথম যখন তীব্রর সামনে এসে কথা বলে তখন অনেক নার্ভাস ছিলো আর ভয়েও ছিল। এসপিরা থাকে অনেক ডিম্যান্ডফুল, কথা কম বলা, নিজের ডিম্যান্ডের সাথে ম্যাচ করে কথাবার্তা চালানো,স্বভাব চালচলন এসব কোনোটাই ওর মধ্যে নেই।
মর্গ থেকে বেরিয়ে আসতেই ইরফান সাহেব সামনে এসে দাঁড়াল।
‘‘আরে ইরফান সাহেব, ঘটনা কি?’’ আজকে আমার পরে আপনি?’’
‘‘সচারাচর আপনি যে প্রবলেমে ফেঁসে যান সেটাতে আমিও ফেঁসে গিয়েছিলাম।’’
‘‘বউ আটকে রেখেছিল?’’
‘‘জি স্যার।’’
‘‘গুড, যান দেখে আসুন মরা লাশ পড়ে আছে।’’
তীব্র ইরফান শেখকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো, ওর পেছন পেছন রিফাতও, আর রাসেল একটু দ্বিধা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো ইরফান শেখের সাথে আবার ভেতরে যাবে নাকি তীব্রর পিছু পিছু যাবে। ইরফান শেখ রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে, ইরফান শেখ কিছু না বলায় রাসেল তীব্রর পিছু নিল।
‘‘সিসি টিভি ফুটেজ কালেক্ট করেছেন?’’
‘‘স্যার সিসি টিভি ফুটেজটা থানায় আছে, আমি আসার পর দেখেছি।’’
‘‘কিছু পাওয়া গেছে কি?’’
‘‘না স্যার, কিলার সব কিছু সেট করেই এসেছিল। কাল রাতের ফুটেজ আছে কিন্তু কোথাও কিছু ধরা পড়ে নি, তবে স্যার রাত আড়াইটার দিকে ল্যাম্পপোস্টের সমস্ত আলো নিভে যায় মেইবি যার জন্য অন্ধকারে কিছু বুঝা যায় নি।’’
‘‘ফুটেজ কি এখনো থানায় ই আছে?’’
‘‘হ্যাঁ স্যার।’’
‘‘থানায় চলো।’’
‘‘স্যার আগে ডেড স্পটে গেলে ভালো হতো না?’’
‘‘না।’’
‘‘ওকে স্যার চলুন।’’
তীব্রর সাথে এক গাড়িতেই থানায় গেলো রাসেল।
তীব্র বিচক্ষণতার সাথে গতকাল রাতের ফুটেজ দেখছে, যার মধ্যে খেয়াল হলো আড়াইটার দিকে পুরো অন্ধকার নেমে এলো, প্রায় বিশ মিনিট পর অন্ধকার কেটে পুনঃরায় আবার আগের মতো দেখা যাচ্ছে, শুধু একটা জিনিস ভিন্ন ছিলো ফুট ওভার ব্রিজের সাথে লাগানো শিকলের সাথে ঝুলছে একটা মানব শরীর ।
‘‘রাসেল!’’
‘‘জি স্যার?’’
-ল্যাম্পপোস্টের আলো বন্ধ করা হয়েছিলো কিনা জানি না তবে, কিলার কঠিন খেলা খেলেছে, কৌশলে ক্যামেরাতে ক্যাপ পড়িয়ে রেখেছিলো হয়তো তাই ডার্ক দেখাচ্ছে এই ২০ মিনিট সময়।’’
‘‘কিন্তু স্যার!’’
‘‘আমার কথা পুরোটা শুনো।’’
‘‘জি স্যার বলুন।’’
‘‘যদি ধরি ল্যাম্পপোস্টের লাইট অফ করেছিল, তাই অন্ধকার দেখাচ্ছে তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় দুটো। এক, ল্যাম্পপোস্টের আলোটা যদি পুরো এরিয়াতে অফ করে তবেই এরকম অন্ধকার দেখানো সম্ভব। কিন্তু দেখো আশেপাশের সব এরিয়াতে সিসিটিভি ক্যামেরাতে কিন্তু স্পষ্ট দেখাচ্ছে আলো জ্বলছে চারপাশে। শুধু এই ছয়টা সিসিটিভি ক্যামেরায় অন্ধকার দেখাচ্ছে ২০ মিনিটের জন্য।
দুই. মানলাম লাইট অফ ছিল পুরো স্ট্রেটের তাহলে মাঝে মাঝে যে গাড়ি যাচ্ছিলো রাস্তা দিয়ে সেগুলোর হেড লাইটের আলো তো দেখা যাবে, কিন্তু এখানে সেসব কিছুই নেই। এখন বলো তোমার প্রশ্ন।’’
‘‘এভাবে ভেবে দেখিনি তো স্যার। মাথায় ই আসে নি। আপনিই সঠিক স্যার!’’
‘‘হুম সহজ জিনিস সব সময় মাথার বাইরে থাকে।’’
তীব্র থানার বাকি পুলিশদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে ডেড স্পটে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সবটা পর্যবেক্ষণ করলো। দুদিন পর পোস্টমর্টেম ও ফরেনসিক রিপোর্ট আসলো, পেপারসে যা যা লিখা ছিলো তীব্র সেগুলো ভালোমতো দেখলো।
‘‘স্যার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তো আর পাঁচটার মতোই প্রায় শুধু একটু ভীন্নতা এসেছে। ফরেনসিক থেকে কি বুঝলেন?’’
তীব্র বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
‘‘শালা প্লে বয় ছিল নাকি! দু একটা মেয়ের স্পর্শে যায় নি। মাদকাসক্তও ছিল, কাল রাতেও এলকোহল নিয়েছে।আমার প্রশ্ন কিলারের সাথে এর কি লেনদেন?’’
‘‘স্যার কি করবো এখন?’’
‘‘যেসব ময়না তদন্দের রিপোর্ট গুলো মিল হয় সেগুলো আলাদা করে একত্র করো, তারপর দেখো কার সাথে কে কানেক্টেড।’’
‘‘আর অই তোরাগ থানায় গত বছর যে ওসি ছিল তার খোঁজ পাওয়া গেল?’’
‘‘জি স্যার, তার সাথে কন্টাক্ট করেছি, সে এখন জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ থানায় আছে।’’
‘‘তাকে বলো খুব শীঘ্রই ঢাকাই এসে আমার সাথে দেখা করতে।’’
‘‘কিন্তু স্যার তাঁর সাথে কি দরকার জানতে পারি?’’
‘‘একবছর আগে নবীনগরের এমপির মেয়ের জামাই এএসআই অন্তু তোরাগ থানায় ছিল, আর অই সময় অই ওসিটাও ছিল নাম যেনো কি বললে?’’
‘‘রিপন হায়দার।’’
‘‘হুম, বর্তমানে যে দুটো এসআই আছে অই থানায়, সেখানকার একজন এসআই তোরাগ থানায় দু বছর ধরে আছে। তার বয়ান মতে ওসির সাথে অন্তুর ভালো সম্পর্ক ছিলো, সে হয়তো কিছু একটা ইনফরমেশন দিতে পারবে অন্তুর ব্যাপারে। এদিকে দুদিন আগে তোরাগের এমপির ছেলে মারা গেল। আপাততো হিসেব এইটুকুই মিলাতে পেরেছি একটু সময় লাগবে বাকি মার্ডার গুলোর হিস্টোরি মেলাতে। ’’
রাসেল পুরো মুগ্ধ, তীব্র কত সহজ ভাবে এতোটুকু সমাধান করে ফেলেছে। অথচ ও এতোদিন এতো মাথা খাটিয়ে কিঞ্চিৎ সমাধানও খুঁজে পায় নি, শুধু পার্থক্য এইটুকুই ছিল অন্যান্য অফিসার গুলো কেস সলভ করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়, কিন্তু রাসেল হাল ছাড়ে না।
মাঝখানে একদিন কেটে যায়, ইনভেস্টিগেশনস কেস সলভ করার প্রচেষ্টা চলছে পুরো দমে। এই মুহুর্তে যতোটুকু সলভ হয়েছে তা শুধু তীব্র আর রাসেলের মাঝেই সীমাবদ্ধ, আগে পুরো কেস সলভ করে তারপরেই পুরো টিমকে জানাবে এবং কি একশন নিতে হবে সেটা এনাউন্সমেন্ট করবে। সিক্রেট এখন রাসেল তীব্রর মাঝেই। না তো তীব্রর বডি গার্ড রিফাত কিছু জানে, না তো ইরফান শেখ কিছু জানে।
সময় বুঝে স্টেপ বাই স্টেপ জানানো হবে। পায়ের উপর পা তোলে ফুটপাতে গালে হাত দিয়ে মিশান বসে আছে, সামনে একটা পিচ্ছি মেয়ে হাতে চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে বসে আছে।
‘‘বস্ আইজক্যা আফনে চা খাইবেন কিন্তু আমি এক টাহাও নিমু না।’’
‘‘তুই এতো বেশি বুঝোস ক্যান? তুই বড় নাকি আমি বড়? আগে তুই টাকা নিবি তারপর আমি চা খাবো।’’
‘‘আফনে এমন ক্যান বস?’’
মিশান চোখ গরম করে তাকাল,
‘‘আইচ্ছা দিতাছি বহেন, ভাইব্বেন না আফনের চোখ রাঙানি দেইখা ডরাইছি, তাই রাজি অইছি।’’
‘‘চা দে, বকবক কম কর।’’
‘‘আফনে পতি দিন আমার সব চা কিনা খান, আফনের প্যাট ভরে না? আর সারা দিনে ভাত খান না?’’
‘‘অই তুই কি চা দিবি, কথা এতো বেশি কস ক্যান তুই?’’
পিচ্চি মেয়েটা কাপে চা ভরে মিশানকে দিলো, মিশান বসে বসে চা খাচ্ছে। একের পর এক কাপ খাচ্ছে আর মেয়েটা চা বানিয়ে দিচ্ছে।
‘‘ঢাকা শহরে মনে হয় এইবার খুব শীত পড়বে রে টুকটুকি।’’
‘‘শীত কম পড়ুক আর বেশি পড়ুক। দিনের বেলা রোদ উঠলেই হইলো।
‘‘তোকে আমি এইবার একটা লম্বা জ্যাকেট কিনে দিবো, জ্যাকেট পড়ে চা নিয়ে বের হবি।’’
টুকটুকি হেসে দিলো। মিশান চা খেতে খেতে টুকটুকির হাসি দেখছে। এমন সময় আরেকটা পিচ্চি ছেলে নাম লাল্লু, হাতে এক থোকা লাল গোলাপ নিয়ে মিশানের সামনে এসে বাড়িয়ে দিলো,
মিশান ভ্রুঁ বাঁকিয়ে তাকালো লাল্লুর দিকে,
‘‘তোর কি টাকা পয়সা বেশি হইছে নাকি রে?’’
‘‘এই গুলা আমি দেই নাই, এক ভাই আফনেরে দেখাইয়া কইলো এডি আফনেরে দিবার।’’
‘‘যে ভাই পাডাইছে হেই ভাইরে লগে লইয়া আয়, আমার তৃষ্ণার্ত চোখ তাঁরে দেখবার চায়।’’
‘‘আইচ্ছা যাইতাছি।’’
লাল্লু এক দৌড়ে ভ্যানিশ হয়ে গেল।
মিশান আবার চা খাওয়াই মনোযোগ দিলো।
কিছুক্ষণ পর সামনে এক ব্যক্তি হাজির, মিশান নিচ থেকে উপর অব্ধি দেখতে লাগলো।
কনভার্স পড়া সত্ত্বেও টাউজারের নিচের অংশ জুতোর বাইরে চলে গেছে, ফুল হাতা শার্ট পড়া, শার্টের বোতামগুলোও একদম উপর থেকে নিচ অব্ধি সব কটা লাগানো, চোখে চশমা পড়া, ঠোঁটে বোকা বোকা হাসি নিয়ে মিশানের দিকে তাকিয়ে আছে।মিশান ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ।
‘‘ভাই আপনিই কি ফুলডি দিছেন?’’
ছেলেটা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে বলল,
‘‘জি!’’
‘‘আমি কে?’’
‘‘ল্লালুর থেকে আপনার নাম শুনেছি, মিশান নাম আপনার। আপনি রোজ এখানে বসে চা খান আমি রোজ দেখি। আর বেশি কিছু জানি না।’’
‘‘যাকগে ভালো, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কথা হলো, এতো গুলা ফুল কোন আক্কেলে দিছেন? আমি এই ফুল দিয়া কি করতাম? আমি কি গরু পালি? গরুরে খাওয়ানের লাইজ্ঞা ফুলডি দিছেন?’’
‘‘একি কি বলছেন আপনি! ফুল কেনো গুরু খাবে! ফুল হলো সৌন্দর্য্যের প্রতীক । একজন সুন্দর তন্বী নারী, সুন্দর এক গুচ্ছ ফুল ডিজার্ব করে। ফুল ও নারী নমনীয়, সুন্দর, প্রেমমূলক। ফুল দিয়ে ভালোবাসা প্রেরণ করা হয়, গরুকে খাওয়ানোর জন্য নয়।’’
মিশান মুখ ভেঙিয়ে বলল,
‘‘আরে ব্যাটা থাম, আসছে আমার প্রেম প্রতীক প্রেরক। এই ফুল কি আমি খাবো এটা দিয়ে কি আমার এক বেলা পেটের খুদা নিবারণ হবে? ব্যাটা বাপের টাকায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলো তো টাকা কি জিনিস বুঝবা না, পেটে লাত্থি পড়লে বুঝবা তখন হাতে টাকা থাকলে ফুল না চাল কেনার জন্য দৌড়াবা।’’
‘‘ভালোবাসা একদিকে, জৈবিক চাহিদা
আরেক দিকে। নারীর সাথে ফুলের অন্তরঙ্গতা গভীর!’’
মিশান ভেংচি মেরে বলল,
‘‘আর একটা কথা বললে, চাপার দাঁত একটাও থাকবে না। যা ভাগ।’’
ছেলেটা কথা না বাড়িয়ে, সোজা মিশানের পায়ে ধরলো, কাঁদোকাঁদো ভাবে বলল,
‘‘এভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন না প্লিজ!’’ দোহায় লাগে। আপনার পায়ে পড়ি।’’
‘‘দেখ ভাই এই সব ফুল টুল দিয়ে আমি মিশান পটবো না। আইসক্রিম, চকলেট, চা, কফি, বিরিয়ানি, এসব নিয়ে এসে প্রপোজ করো আমি চিন্তা ভাবনা করে দেখবো। এগুলো দেখলে আমি কাউকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না।’’
ছেলেটা মুখে বিজয়ের হাসি টেনে বলল,
‘‘আমি এক্ষুণি আনছি ওয়েট।’’
সেকেন্ডেই ছেলেটা একটা দোকানের ভেতর ঢুকল।
‘‘শোন ও যা যা আনবে সেগুলো তোরা দুজন হাতে নিবি, আর ওকে বলবি, আমি এগুলো পরে নেবো তোদের থেকে, আমার জরুরী কাজ পড়ে গেছে আর উত্তর টাও পরে জানাবো। ও চলে গেলে তোরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিস সব।ঠিক আছে?’’
টুকটুকি লাল্লু মাথা নাড়ালো।
মিশান এক ছুটে জায়গা পরিত্যাগ করল।
আরো দুদিন কেটে যেতেই তীব্রর মাথায় কিছু একটা নাড়া দিলো, কিছু খুঁজে পেয়েছে কিনা কাউকে বলে নি, শুধু পুরো ফোর্সকে রেডি হতে বলল,
দুদিন বাদেই ওসি রিপন হায়দার দেওয়ানগঞ্জ থানা থেকে ঢাকার পথে রওনা হয়, তীব্রর সাথে দেখা করবে বলে।
সন্ধ্যা ছয়টায় দেওয়ানগঞ্জ থেকে জামালপুর অব্ধি ট্রেনে এসে
জামালপুর বাস স্ট্যান্ডে যায় যেখান থেকে ঢাকার পথে পারি জমাবে, ভোরের আগেই ঢাকা পৌঁছে যাবে।
পুরো জার্নিটা ভালো ভাবেই কাটছিল। কিন্তু মির্জাপুর রাজাবাড়ি ক্যাডেটের সীমান্ত পার হতেই একটু পর পর গাড়ী থেকে যাত্রী সব নেমে যেতে থাকে।
এক পর্যায় পুরো বাসে যাত্রী একমাত্র ওসি রিপন থেকে যায়। গাড়িতে মোট চারজন মানুষ, ড্রাইভার, কন্ডাকটর, হেল্পার,আর ওসি রিপন হায়দার। এই মুহুর্তে উনার জায়গায় কোনো মেয়ে হলে কোনো বড় এক সর্বনাশ হয়তো হয়ে যেতো, যদিও সে ছেলে তবুও ছিনতায়ের একটা ভয় আছেই, কারণ উনার সাথে নিজেকে প্রোটেক্ট করার মতো কোনো হাতিয়ার বা অস্ত্র নেই। এর মাঝে একটা শুনশান ল্যাম্পপোস্ট বিহিন অন্ধকার নিরিবিলি জায়গায় গাড়ি হুট করে থেমে গেলো,
গাড়ি থামার সাথে সাথে কেউ একজন গাড়িতে উঠল,
দেখতে অনেকটা ভয়ানক লাগছে।
লম্বা দানবের মতো, কালো রঙের হুডি পড়া যেটা একদম হাঁটু ছুঁই ছুঁই।
হাতে কালো রঙের উইন্টার হ্যান্ড গ্লাভস, এমনিতেই হুডি পড়ে মুখ ঢেকে আছে তার উপর মাস্ক পড়া, যে মাস্কে ভয়ংকর ভাস্কর্যসাজ।
সব থেকে বড় কথা নীল রঙের সেই চোখ জোড়া যা অনবরত জ্বলজ্বল করছে।
রিপন হায়দার সীটে বসেই ঘুমাচ্ছিল, হঠাৎ করে মাথায় ঝাঁকি লেগে ঘুম ছুটে যায়, হাল্কা গা ঝাঁকি দিয়ে ডানে বামে তাকাতাকি করতে যাবে তখনি দেখে পাশের সারিতে ঠিক তাঁর বরাবর অই মানুষ টা বসা, শুধু বসা না পলকহীন নজরে তাকিয়ে আছে রিপন হায়দারের দিকে। রিপন হায়দার যথেষ্ট ভয় পেয়ে যায়। চোখ জোড়ার দিকে তাকালেই গা ছমছম করা একটা ব্যাপার আছে।
রিপন হায়দারের কেনো জানি খুব ভয় হচ্ছে, ভেতরে বুক ধুকধুক করছে, হাত পা কাঁপছে,উঠে গিয়ে যে অন্য সীটে বসবে সেই সাহস শক্তিও আসছে না। কেনো এতোটা ভয় পাচ্ছে নিজেও জানে না। তবে মাঝ রাতের বেলা এমন জ্বলজ্বল করা নীল চোখ দেখলে যে কারো ভেতর ভয় জায়গা করে নেবে এটাই স্বাভাবিক।
চলবে…………
আগের পর্বের লিংক:-
https://www.facebook.com/112848997065058/posts/240160727667217/
পরের পর্বের লিংক:-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=241972140819409&id=112848997065058