#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৫
‘‘চাকরী ছেড়ে, রাত বিরাত রাস্তা ঘাটে মাতলামি করে কাটাচ্ছে!’’
মিশান তুচ্ছার্থক হাসি দিয়ে বলল,
‘‘স্যার টিজ মারলেন?’’
‘‘ যে যেটা মনে করে!’’
মিশান পিছিয়ে এসে তীব্রর বরাবর দাঁড়িয়ে বলল,
‘‘কি করব বলুন সাফওয়ান রেজা তীব্র স্যার! আমি তো সোনা তোলা সোহাগা না যে, আপনার মতো ডিপার্টমেন্টে আমাকে সিনিয়ররা তোয়া তোয়া করে হাতে পায়ে ধরে রাখবে!
‘‘বুঝতে হবে তো, যোগ্যতা টা হাই লেভেল!’’
‘‘ওটাকে যোগ্যতা বলে না স্যার, ওটাকে সস্তা ক্ষমতার লু পারসোনালিটি বলে। এই ডিফেন্সে এখন কি চলে? যার পাল্লা যতো ভারী তার দর ততোবেশি। আমার তো এগুলো নেই স্যার, তাই ডিপার্টমেন্ট আমাকে হাতে পায়ে ধরে রাখার প্রয়োজন মনে করে নি।’’
তীব্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘‘মাতাল কোথাকার!’’
‘‘এখনো নেশা চড়ে নি স্যার। মিশান কখনো মাতাল হয় না, দুশো বছরের পুরোনো মদ গিলেও নেশা চড়বে না। তবে আপনার মনে হয় সিগারেটে বেশ নেশা চড়ে গেছে স্যার! বাই এনি চান্স সিগারেটে গাঁজা পুরে টানছেন না তো স্যার!’’
‘‘আমার তো জানা ছিল ড্রাগ অ্যাডিকটেডরা দশমাইল দূরে থেকেও এলকোহল ড্রাগস আছে কিনা বুঝতে পারে। কুকুরের থেকেও বেশি স্ট্রং হয় ওদের ইন্দ্রিয় শক্তি।
কিন্তু তুমি তো দেখছি আমার নিষ্পাপ সিগারেটকে অপবাদ দিয়ে বসলে!’’
‘‘ওটা তখনই হয় স্যার, যখন অ্যাডিকটেড অনেকদিন ড্রাগস, এলকোহল না পায়। কিন্তু আমি তো রেগুলার পাচ্ছি, আমি কি করে বুঝব স্যার?’’
‘‘হুম একেই বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক!’’
‘‘অ্যাবসোলুটলি রাইট স্যার! জীবনের প্রথম একটা কথা আমার মন মতো বললেন স্যার!’’
‘‘লিসেন মিশান, ভালো ভাবে বলছি নেক্সট টাইম যেন ভুল করেও রাতের বেলা মাঝরাস্তায় মাতাল হয়ে ঘুরতে না দেখি!’’
‘‘স্যার আপনি একটা উত্তর দিন তো দেখি, পৃথিবীতে রাস্তা আগে তৈরি হয়েছে নাকি গাড়ি? অবশ্যই রাস্তা তাই না? যখন রাস্তা সৃষ্টি হয়েছে তখন গাড়ি ছিল না, মানুষ হেঁটে চলাফেরা করত। গাড়ির কোনো চিহ্ন ছিল না। তার মানে ঘটনা দাঁড়ায়, আমরা যারা রাস্তা দিয়ে হাঁটি তারাই রাস্তার অরজিনাল ঔনার, আর যারা গাড়ি নিয়ে চলে এদের বলা যায় অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসা কিংবা ভাড়াটে।’’
‘‘জাস্ট শাট আপ! আমি এক ওয়ার্নিং বার বার দেবো না!’’
‘‘ঘুরলে কি করবেন আপনি? হুম?যতবার মন চাইবে আমি মাঝ রাস্তা দিয়ে মাঝ রাতে চলাচল করব, এখন থেকে তো আমি রাস্তাতেই রাত কাটাবো। বাড়িঘর বাদ আজ থেকে। কিচ্ছু করতে পারবেন না! ’’
তীব্র চোখ গরম করে তাকিয়ে রাগীস্বরে বলল,
‘‘ মাছ যতই পিচ্ছিল হোক, ছাই দিয়ে ধরলে কিন্তু হাতে থেকে ছুটা অসম্ভব! কথা টা মাথায় রেখো!’’
‘‘বোমাবাজিতে ব্লাস্ট করতে অনেক প্রসেস ফলো করতে হয়, কিন্তু মুখ এমন একটা বোমা, যেটা ব্লাস্ট করতে ন্যানোসেকেন্ড সময়ও অপেক্ষা করতে হয় না। কথাটা আপনিও মনে রাখবেন স্যার!’’
‘‘মিশান খান! তোমার ক্যাপ্টেইন উপাধিটা কিন্তু পাস্ট টেনস্। তুমি যদি আমার সিক্রেট জেনে থাকো, আমি তোমার টপ সিক্রেট জানি!’’
মিশান কথার পাত্তা না দিয়ে কিটকিটে হাসি দিলো,
তীব্র চোখ গরম করে মিশানের থেকে চোখ ফিরিয়ে তাপসিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘‘অই ব্যাটারি!’’
‘‘জি জি স্যা স্যার?’’
দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র আদেশ করল,
‘‘মাতালটাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে যা, না হলে দুটোকেই জেলে পুরে দেবো। হতে পারে তোর বাবা কর্নেল, কিন্তু এমন কেসে ফাঁসিয়ে দেবো সাত জন্মে ছুটতে পারবি না কেউ।’’
মিশান ঢোলতে ঢোলতে মাতালস্বরে তীব্রর দিকে ধেয়ে বলল
‘‘অই অই কি বললেন আমি মাতাল?আরে পুরো বার শুষে নিলেও মিশানের নেশা চড়ে না কতবার বলব? মাতাল বলছে আমাকে! আর কাকে জেলে পুরবেন? লাইসেন্স দেখাবো? মিশান ইললিগাল কোনো কাজ করে না, লাইসেন্স আমার ফোনের ব্যাক কাভারের সাথে লাগিয়ে রেখেছি, ওয়েট দেখাচ্ছি লাইসেন্স, জেলে দেবে বলছে! সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ বলে খুব ডিম্যান্ড দেখাচ্ছে! ডিম্যান্ড আমিও দেখাতে পারি, ক্যাপ্টেইন মিশান খান! জব টা ছেড়ে না দিলে সময় মতো আমিও মেজর হয়ে যেতাম। শালা আমাকে পাওয়ার দেখাচ্ছে! ’’
মিশান পয়েন্টে তর্ক করলেও প্রকৃতপক্ষে ও স্বাভাবিক অবস্থার মাঝে নেই,
ওর আজকে ভালো রকম ই নেশা লেগেছে। ওভার ডোজ ড্রিঙ্ক করেই এই হাল। গভীর রাত অব্ধি বারেই কাটে ওর জীবন, আর ওকে পাহারা দেয়ার জন্য কখনো তাপসিন কখনো দ্বীপ। মিশানকে দ্বীপ ছাড়া আর কেউ কন্ট্রোল করতে পারেনা। দ্বীপ গিয়েছে টেকনাফ, একটা মেডিকেল ক্যাম্পেইনে। তাই মিশানের দায়িত্ব এখন তাপসিনের উপর।
তীব্র প্রায় ই মিশানকে এভাবে রাস্তা ঘাটে মাতলামো করতে দেখে, আর প্রতিবার ই ওয়ার্নিং দিয়ে যায়, কিন্তু ওয়ার্নিং কোনো বার ই কার্যকর হয় না।
মিশান থাকে মিশানের তালে। ছন্নছাড়া বেহায়া গতিতে চলে ওর জীবন।
মিশানের সাথে এখন তাতলামো করে লাভ নেই, যার জন্য তীব্র ঘুরে গাড়িতে উঠে বসলো, তাপসিন মিশানকে টেনে ধরে নিয়ে রাস্তার সাইডে নেয়ার চেষ্টা করছে, কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা গাড়ি সামনে এসে থামলো। গাড়িতে মিশানকে তুলে বাড়িতে নিয়ে গেল তাপসিন।
বাড়ির সামনে গাড়ি আসতেই মিশান গাড়ি থেকে বেরিয়ে শুরু করে দিলো বমি, আজকে পরিমাণে একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে যার জন্য স্টমাক লোড নিতে পারে নি। এখন সব উপচে বমি শুরু করে দিয়েছে। তাপসিন আছে মহা বিপদে একেতে শুনশান রাত, যেভাবে মিশান বমি করছে তাতে প্রচুর শব্দ হচ্ছে, বাড়ির ভেতর থেকে ওর মা আবার শব্দ শুনে জাগানা পেয়ে না যায়। মিশানকেও থামাতে পারছে না। অনবরত বমি করে যাচ্ছে। সিকিউরিটি গেট খুলে দিতেই তাপসিন ঘাবড়ে গেল, মিশান যে ড্রিঙ্ক করেছে সেটা সিকিউরিটি বুঝে যাবে যে!
গেট খোলার পর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দ্বীপ, প্রথমে তাপসিন ভয় পেলেও দ্বীপকে দেখে ভয় কাটলো, এবার যা দ্বীপ ই সামলাতে পারবে।
গম্ভীর স্বরে দ্বীপ বলে উঠল,
‘‘কল দিচ্ছি কখন থেকে?’’
‘‘আমাকে?’’
‘‘হ্যাঁ’’
‘‘আমার ফোনটা পাচ্ছি না, বারেই ফেলে এসেছি বোধয়।’’
দ্বীপ চোখ গরম করে বলল,
‘‘স্টুপিড!’’
তাপসিন চুপচাপ রইল। আর দ্বীপ মিশানকে নিয়ে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকল।
রোজ রাতে মিশান বেরিয়ে যায় ড্রিঙ্কস বারের উদ্দেশ্যে আর দ্বীপ তাপসিন ওকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে আসে। আর বাড়িতে ঢুকার সময় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকতে হয়।
মিশানের মামী মিশানের এই অবস্থা দেখলে কেবলই একটু ঘাবড়ে যাবে এর বেশি নয়। কিন্তু মিশানের মামার সামনে যদি পড়ে, মিশানের অপরাধের জন্য তাপসিন দ্বীপ সহ তিনজনকে নির্বাসন পাঠিয়ে দেবে। মামার ভয়েই মিশান আর্মি জয়েন করেছিল আর নিজের ইচ্ছা ও কিছু সমস্যার জন্য ছেড়ে দিয়েছে, মামা বাঁধা না দিলেও, জীবন আর্মিদের মতোই কাটাতে হয় মামার সামনে। শুধু মিশান না, দ্বীপ তাপসিন সহ তিন জনের ই।
চাকরী ছেড়ে দিয়েও শান্তি নেই। মামা পুরো বাড়ি আর বাড়ির এরিয়াকে একটা ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে রেখেছে। সব কিছু তার রোলস মতো চলে। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয় সবাই হাঁপ ছেড়ে প্রশান্তির শ্বাস নেয়।
এবাড়ির লোক আর কাজের লোক সবার সমান অধিকার। কর্নেল সাদেক খান সাহেবের বিচক্ষণতায় কেউ কোনো ত্রুটি খুঁজে পাবে না। সবার শুধু চিন্তা যখন উনি পেনশনে আসবে তখন কি হবে এ বাড়ির মানুষের!
ছোট্ট বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে গরীব সবার উপর তার রোলস জারীকৃত।
যেমন তার রুটিন শুরু হয় বাড়ির ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভোর বেলা এক্সারসাইজ করতে বের হওয়া দিয়ে।
তারপর বাড়ির ছেলে মেয়েদের সব দিক দিয়ে সক্ষম ও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তাদের সাপ্তাহিক কাজের রুটিন দেয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একদিন একজনের সকাল বেলা বাজারের পালা আসবে, সপ্তাহে একজনের রান্নার পালা আসবে, ঘর পরিষ্কার, নিজের কাপড় নিজে ধোয়া। হোক সে বাড়ির ছেলে।
অবশ্য মিশান এগুলো বেশ ফাঁকি দিয়েই চলে, এবাড়িতে কর্নেল সাহেবের পর সবাই দ্বীপ আর মিশানকে দেখেই ভয় পায়। মিশান সব কাজ ফাঁকি দিতে পারলেও একটা কাজ ফাঁকি দিতে পারে না, সেটা হলো বাজার করা। কারণ সকাল বেলা মামা বাড়িতে থাকে, বাধ্য হয়ে মিশানের বের হতে হয়। কেউ যেনো কাউকে সাহায্য করতে না পারে তার জন্য একজন বের হলে বাকিদেরকে বের হতে দেয় না, যতক্ষণ না মানুষটা বাড়ি ফিরে।এমনকি যাওয়ার সময় বাড়ির গাড়ি নিতে পারবে না, নিজ দায়িত্বে রিকশা, সিএনজি,বাসে যাতায়াত করতে হবে।শর্টকাট পথ অবলম্বন করে কোনো সুপার শপেও যেতে পারবে না, আর পাঁচ জনের মতোই কাঁচা বাজারে যেতে হবে। বাজারের ব্যাপারটাই মিশানের অভ্যেস হয়ে গেছে, কিন্তু তাপসিন এখনো এক্সপার্ট হতে পারে নি, প্রায় ই তার মানিব্যাগ টা পকেট মার কেটে নেয়।বাজার করলেও ভালো কিছু বাজার করে আনতে পারে না কিন্তু দ্বীপ সব দিক থেকে এক্সপার্ট, ওকে কেউ ঠকাতে পারে না, নিজের কাজ তো করেই, পারলে মিশানের কাজ এগিয়ে দেয়।
ওভার ডোজ ড্রিঙ্ক করলে মিশানের একটা দিকে উপকার হয়, সেদিন খুব ভালো ঘুম হয়। দুঃস্বপ্নটাও দেখে না, কারণ তখন মিশান আর মিশানের মাঝে থাকে না, আকাশ পাতালে উড়া উড়ি করে।
বাড়ি ফেরার পর রোজকার নিয়মের মতো আজও তীব্র ওর মাকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে, আজ তো তাও তীব্র তাড়াতাড়িই ফিরেছে।
নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে সোজা ডাইনিংয়ে গিয়ে বসলো তীব্র, পেছন পেছন ওর মাও গিয়ে প্লেটে খাবার তুলে তীব্রর সামনে দিলো, তীব্র বড় মাছের কাঁটা বাছতে পারে না বলে কাঁটা সহই খায়, ছেলের গলায় কাঁটা বিঁধবে বলে তীব্রর মা আগে আগেই ওর পাশে বসে মাছের কাঁটা বেছে দেয়, তীব্র চুপচাপ খেয়ে নেয়। একটা কথাও বলে না নিজে থেকে, মা কোনো প্রশ্ন করলে হ্যাঁ না উত্তর দিয়ে চুপ হয়ে যায়।
খাওয়া শেষ হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বেসিংয়ে হাত ধুইয়ে উপরে চলে গেলো। ছেলের খাওয়া শেষ হতেই নিজে খেয়ে নিল। তীব্র ঘরে ঢুকেই এক সেকেন্ড দেরি না করে এএসআই রাসেল মন্ডলের দেয়া পেপারস গুলো ভালো মতো চোখ বুলিয়ে নিল, অত:পর একটা হোয়াইট বোর্ডে পেপারস গুলো আলগা করে একটা একটা করে আঠা দিয়ে লাগাল।
রাসেল একটা পেনড্রাইব দিয়েছিল যেখানে ভিক্টিমদের ডেড বডির ফুটেজ প্লাস আরো কিছু তথ্য ছিল,
ল্যাপটপে পেনড্রাইব ঢুকিয়ে ভিডিও গুলো একের পর এক প্লে করে, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল, কিলার কোথাও কোনো ক্লু রেখে গেছে কিনা।
সময়ের গতির সাথে তীব্রর ব্রেন প্রচন্ড মাপের সক্রিয় হচ্ছে। টানা কয়েকঘন্টা ইনভেস্টিগেশন চালালো সব কিছুর মধ্যে থেকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুই হাত মাথার পেছনে দিয়ে উপরের দিকে তাকাল, কিছু একটা ক্লু হয়তো পেয়েছে।
গত তিন চার ঘন্টায় অলরেডি তার পাঁচ প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। বেরধক হারে সিগারেট না টানলে তীব্রর মাথার প্যাঁচ লেগে যেতো।
রাতের শেষের অংশে মগ ভর্তি ব্ল্যাক কফি নিয়ে খেয়ে নিল, তারপর রোজকার নিয়মে স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে গেল।
ভোর হতেই দ্বীপ মিশানের পাশে বসে ওর মাথা আলতো হাতে টিপে দিচ্ছে, চোখের উপর আলতো ভাবে মাসাজ করছে,যেন মিশানের ঘুম টা ভেঙে যায়।
মিশান চোখ খুলতেই দ্বীপকে দেখে বলে উঠে,
‘‘তুই কখন এসেছিস?’’
‘‘রাতে এসেছি।’’
‘‘দেখা করলি না তো।’’
‘‘তুই বাড়ি ছিলি না।’’
‘‘ওও’’
‘‘যা ফ্রেশ হয়ে আয়, বাবা উঠে গেছে। আমি তোর জন্য লেবু চা নিয়ে আসছি, মাথা ব্যাথা কমে যাবে।’’
‘‘ওকে।’’
মিশান উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
দ্বীপ এর মধ্যে কড়া লিকারের লেবু চা নিয়ে হাজির। এতে মিশানের মধ্যে যদি কোনো নেশা নেশা ভাব থাকে সেটা কেটে যাবে, সাথে মাথার যন্ত্রণাও।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মিশান চা খেতে নেয়, এরই মধ্যে বাড়ির কর্নেল সাহেবের বাঁশির হর্ন বেজে উঠে মিশান এক চুমুকে পুরো গরম চা শেষ দিয়ে দ্বীপের সাথে বেরিয়ে যায়।
ঘর থেকে বের হতেই মামা গোয়েন্দা নজরে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
মিশান দ্বীপ কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বুঝতে পারল, তিনজনের মধ্যে একজন উধাও, তাপসিন মেইবি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। মিশানের সাথে সঙ্গ দিতে গিয়ে রাতের ঘুম সাঙ্গ হয়েছে, যার ফলে সকালে জাগানা পায় নি।
‘‘মা মা মামা তাপসিনের পেটের সমস্যা হয়েছে। একটু পর পর বাথরুমে যাচ্ছে আর আসছে। আজকে ওর না গেলে হবে না?’’
‘‘কি খাবার খেয়েছিল যে পেটের সমস্যা হলো?’’
‘‘রা রাতে নাকি উঠে পানি খাচ্ছিল, কয়েক ঢোক পানি খাওয়ার পর দেখে পানিতে তেলাপোকার বাচ্চা ভাসছে, সেটা দেখেই ঘৃণায় এমন হয়েছে।’’
‘‘তোমাদের কি শেখাই নি আমি, পানি সব সময় ঢেকে রেখে দিতে হয়, আর খাওয়ার সময় চেক দিয়ে খেতে হয়?’’
‘‘জি জি মামা, ও হয়তো ঘুমের ঘোরে খেয়াল করেনি।’’
‘‘চলো দেখে আসি ওর কি অবস্থা এখন।’’
মামার মুখে এই কথা শুনে দ্বীপ মিশান দুজনের গলা শুকিয়ে গেল, ঘুম থেকে না উঠার জন্য তো তাপসিন শাস্তি পেতো, এখন মিথ্যে বলার জন্য তো পুরো টিম শাস্তি পাবে। বাবাকে আটকাতে দ্বীপ তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল।
‘‘বাবাহ!’’
সাদেক খান ঘুরে দাঁড়াল,
‘‘বলো।’’
‘‘এমনিতেই তো কথা বলে সময় নষ্ট হলো, এখন ওকে দেখতে গেলে তো আরও সময় নষ্ট।’’
বাড়ি ফিরে ওর সাথে দেখা করি আমরা?
আমার অফিসে যেতে হবে একটু তাড়াতাড়ি।
সাদেক সাহেব কিছুক্ষণ দম ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘‘ঠিক আছে চলো তাহলে।’’
দুজনেই লম্বা সস্ত্বির নিশ্বাস ছাড়ল, এ যাত্রায় বেঁচে গেল। বেরিয়ে গেল এক্সারসাইজের জন্য।
বাড়ির কাছেই একটা পার্ক সকাল বেলা যেখানে তরুণ থেকে বৃদ্ধ সকলের ভীড় জমে হাঁটা হাঁটি, দৌড়া দৌড়ি,ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের জন্য।
পার্কে পৌঁছেই সাদেক সাহেব তার সমবয়সীদের সাথে জোর কদমে হাঁটতে লাগলো। দ্বীপ ঘাসের উপর বুক ডাওন দিচ্ছে মিশান হাত পা নাড়িয়ে লাফালাফি করছে। সকালের পরিবেশ টা বেশ ভালোই লাগে, এই পার্টটাকে ওরা ফাঁকি দেয় না কখনো। শুধু সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠাটাই মুশকিল। সকালের এক্সারসাইজের জন্য সারাদিন মন বেশ ফুরফুরে লাগে, বিশেষ করে এটা মিশানের জন্য খুব জরুরী।
আটটার দিকে বাড়ি ফিরে ব্রেকফাস্ট টাইম।
ঘুম থেকে উঠার পর তাপসিন যখন দেখে ঘড়ির কাটা ৭:৩০ এটা দেখেই গলা শুকিয়ে একাকার! সকালে কেউ ডাক দেয় নি বলে একটু চিন্তায় পড়ে গেল।যেখানে এক দিন ঘুম থেকে উঠতে পাঁচ মিনিট লেট হলে তার শাস্তি ভোগ করতে হয়, সেখানে আজ এতো লেট করে উঠা।বাবাও এসে ডাক দেয় নি, ব্যাপারটা খুব ভয় জড়ো করছে তাপসিনের ভেতর। নির্ঘাত বড় কোনো শাস্তি অপেক্ষা করছে।
বাড়ি ফিরতেই ড্রয়িংরুমে তাপসিনকে দেখে সাদেক খান সাহেব পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
‘‘তোমার পেট ঠিক হয়েছে?’’
কিছু বুঝতে না পেরে ড্যাবড্যাব করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল,
‘‘কি হলো উত্তর দিচ্ছ নে কেনো ?’’
‘‘বাবা পেট ঠিক মানে?’’
‘‘তোমার যে পাতলা পায়খানা হয়েছে সেটার কথা বলছি।’’
তাপসিন বিড়বিড় করে বলল,
‘‘আমার পাতলা পায়খানা!’’
এমন সময় সাদেক সাহেবের পেছনে এসে মিশান দ্বীপ দাঁড়াল, মিশান ইশারায় কিছু একটা বুঝালো তাপসিনকে, আর এতেই তাপসিন বুঝে গেছে আসল ঘটনা কি।
তাপসিন ভীত গলায় বলল,
‘‘বাবা স্যালাইন খেয়েছি, ওষুধও খেয়েছি, এখন চিড়ের পানি খাবো। পেট প্রায় ঠিকের দিকে।’’
‘‘ঠিক আছে, খাবার দাবার সাবধানে খেও, আজকে কোনো মাছ মাংস খেয়ো না, পেট ঠিক না হওয়া অব্ধি চিড়ে, কলা, ব্রেড, ডাবের পানি এসব খাও।’’
‘‘ঠিক আছে বাবা।’’
‘হুম‘।’’
কর্নেল সাহেব সামনে থেকে চলে গেল।এতোক্ষণে তাপসিনের প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল।
ব্রেকফাস্ট শেষে মিশানের বের হতে হল
বাড়ি থেকে, বাজার করার উদ্দেশ্যে। আজকে মিশানের বাজার করার পালা।
তীব্র সকাল বেলা রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখে ড্রাইভার আর রিফাত অন্য একটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘‘কি ব্যাপার এই গাড়ি কেনো?’’
‘‘স্যার ওটা স্টার্ট হচ্ছে না, কি সমস্যা হয়েছে বুঝাও যাচ্ছে না। গ্যারেজে দিয়ে এসেছে ড্রাইভার, ওরা বলেছে দুপুরের মধ্যে ঠিক করে দেবে, তাই এখন বাড়ির গাড়িটাতেই যেতে হবে।’’
‘‘দুনিয়ার সব কিছুর অপশনাল থাকলেও, সরকারের কোনো কিছুই অপশনাল নেই, যেটা আছে সেটা নিয়েই মরো।’’
‘‘জি স্যার।’’
সরকারি গাড়ি ছেড়ে বাড়ির গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে গেল তীব্র।
ইনভেস্টিগেশনের জন্য কোথাও একটা যাচ্ছিল। গাড়ি প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পর থেমে গেল হঠাৎ। সামনে তাকিয়ে দেখে লম্বা জ্যাম। জ্যাম টা আজকেই লাগার ছিলো, প্রতিদিন সরকারি গাড়ি দেখে ট্রাফিক পুলিশরা গাড়ি যাওয়ার রাস্তা করে দেয় নিজ দায়িত্বে।
‘‘আজ সরকারি গাড়িরও নেই, সরকারি সুবিধাও নেই।’’
জানালা দিয়ে মাথা বাইরের দিকে দিয়ে তাকিয়ে দেখে এটা একটা চার রাস্তার মোড়, যে জন্য ছোটো বড় গাড়ি মিলিয়ে
মোটামুটি জ্যাম লেগেছে।
তীব্রর চোখ খুঁজছে ট্রাফিক পুলিশকে, একটা সময় দেখতে পেলো ট্রাফিক পুলিশ এক বাইক ওয়ালার সাথে তর্কবিতর্ক করছে দাঁড়িয়ে, আরেকজন ট্রাফিক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
লোকটার বাইকটা রং ওয়ে তেও নেই, তাহলে কি নিয়ে কথা হচ্ছে,
তীব্র গাড়ি থেকে বের হতে নিলে রিফাত বলে উঠে,
‘‘স্যার আপনি বসুন আমি দেখছি।’’
‘‘ওমহু ব্যাপারটা আমারো দেখতে হবে।’’
গাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছাকাছি যাবে তখনি খেয়াল করল, বাইকের লোকটা লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা বের করে পুলিশটার পকেটে ঢুকিয়ে দিলো, আর এর বিনিময়ে পুলিশটা বাইকের চাবী ফেরত দিলো।
এই দৃশ্য দেখে তীব্রর মেজাজ চটে গেল,
হাঁটার দ্রুততা বাড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের একদম কাছে গিয়ে, পকেটে হাত দিয়ে টাকা গুলো বের করে, যার টাকা তাকে ফেরত দিলো, আর ট্রাফিক পুলিশটা রেগে গিয়ে তীব্রর কলার চেপে ধরে গালী দিয়ে উঠে,
‘‘আব্বে, মা** *দ ক্যারা রে তুই? বাপের পকেটে হাত ঢুকাস?’’
গালী দিয়েই তীব্রকে ধাক্কা দিতে যাবে তার আগেই, তীব্র উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তার কাঁধের দিকে তাকায়, পদবী এএসআই ছিল, সুন্দর করে দুই কাঁধে থেকে পদবীর ফুল দুটো খুলে নিলো, এতোক্ষণে রিফাত তীব্রর কাছাকাছি এসে স্যার স্যার করতে থাকে।
এই স্যার স্যার ডাক শুনেই পুলিশটা আতকে যায়, কলার ছেড়ে দিতেই,
তীব্র ফুল দুটো রিফাতের হাতে দিয়ে পুলিশটার হাত থেকে লাঠি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজেই ট্রাফিক কন্ট্রোল করা শুরু করল।
‘‘স্যার কি করেন একটু ভেবে করবেন না?আপনি তো শেষ! আপনার ঘুষ খাওয়ার কথা বাদ ই দিলাম, এসপির গায়ে হাত তোলার পানিশমেন্ট কি হতে পারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবুন।’’
লোকটা কাঁপা গলায় বলল,
‘‘উনি এসপি?’’
‘‘জি স্যার।’’
লোকটা সাথে সাথে তীব্রর কাছে দৌড়ে গিয়ে কাকুতি মিনতি শুরু করে দিলো।
‘‘স্যা স্যার স সরি স্যার। স্যার ক্ষমা করে দিন স্যার প্লিজ স্যার! স্যার ভুল হয়ে গেছে স্যার।’’
তীব্র ফিরেও তাকাচ্ছে না লোকটার দিকে, এর ভাগ্যে কি আছে কে জানে।
চলবে…………
–
আগের পর্বের লিংক:-
https://www.facebook.com/112848997065058/posts/238961281120495/
পরের পর্বের লিংক :-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=240160727667217&id=112848997065058