হৃদয়েশ্বরী #পর্ব-৫০ |শেষ খন্ড|

0
54

#হৃদয়েশ্বরী
#পর্ব-৫০ |শেষ খন্ড|

আয়মানের দাফনকার্য সমাপ্ত হয়েছে একটু আগে। সবকিছু নিজের হাতে করেছে উশান আহত শরীর নিয়েই। তখন বেলা বারোটা ছুঁই ছুঁই! কবরস্থান হতে ফিরেছে উশান সবেমাত্র। ক্লান্ত দেহ! ঘামে সিক্ত দেহ। সে এসেছে মীরার ফ্লাটে। মাহদি জোরপূর্বক তাকে নিয়ে এসেছে। ফ্লাটে প্রবেশ করার পর মাহদি বলে উঠলেন,

-” বাবা? তুমি মীরার রুমে রেস্ট করো যাও। তোমার শরীর তো ভীষণ খারাপ হচ্ছে। ”

উশান ম্লান হেঁসে উত্তর দিল, ” আমি ঠিক আছি বাবা। চিন্তা করবেন না। আপনার ওপর দিয়েও তো কম ধকল যায়নি। রেস্ট করুন বাবা। ”

মাহদি নিজের শয়নকক্ষে চলে যেতেই উশান কদম ফেলে সম্মুখে। তারা যাত্রাপথ মীরার কক্ষ। মাঝে থেমে সে একবার উজান, উমাইশা কে দেখে নিলো। তারা দু’জন মীরার পাশের কক্ষে রয়েছে। উজান তখন ওয়াশরুমে ছিল। উমাইশা নামাজরত।দরজা থেকে সরে আসলো উশান। পাশের কক্ষে প্রবেশ করলো। মীরা উপস্থিত ছিলো সেখানেই। উন্মুক্ত জানালার কপাট দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিল। কারো উপস্থিতি উপলব্ধি করতেই পেছন ফিরলো দ্রুত। উশানকে দেখে এগোল চটজলদি। ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-” ঠিক আছো? ”

উশান শার্টের বোতাম খুলছে ধীর গতীতে। শার্টের বোতাম সম্পূর্ণ খোলা হতেই শার্ট গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। বলল,

-” ঠিক আছি। আমাকে শার্ট দাও তো একটা। মাথা ভার হয়ে আছে। শাওয়ার নিবো।টাওয়াল ও এনো!”

-” আনছি। বসো একটু। ”

মীরা পাশের কক্ষে গেল। উশানের কোনো পোশাক তারা বাসায় নেই। সব উজানের বাসাতে রয়ে গেছে। সে আপাতত মাহদির একটা শার্ট আনতে যাচ্ছে। শার্ট, ট্রাউজার এবং তোয়ালে নিয়ে আসতে মীরার সময় লাগল পাঁচ মিনিটের মতোন। এসেই তার হাতের পোশাক সে উশানের নিকট এগিয়ে দিল।

-” ধরো! ফ্রেশ হয়ে আসো। ”

নিরুত্তরহীন উশান আলগোছে উঠে গেল। নিষ্প্রভ নেত্রে উশানকে আঁড়চোখে দেখল মীরা। একদিনেই কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ছেলেটা। মুখোশ্রীতে লেপ্টে রয়েছে রাজ্যের ক্লান্তি! তবুও বুঝতে দিতে সে নারাজ তার অন্তঃস্থলের হাল। মীরা জানে, উশানের অন্তরালের দুমড়ে মুচড়ে পিষে যাওয়া অনুভূতি গুলো সম্পর্কে মীরা জ্ঞান রাখে। এই পৃথিবীতে সেই হয়তো একমাত্র উশানকে এতোটা বুঝতে পারে।প্রতি মূর্হতে ঠাওর করতে পারে উশানের মনঃবস্থা! কিছু সময় যদিও বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে বৈকি।

দশ মিনিটের মতো সময় লাগল উশানের শাওয়ার নিতে।বেরুতেই তার দৃষ্টি পড়লো সোফায় বসে থাকা তারই অপেক্ষায়রত মানবীকে। মীরার হাতে খাবার প্লেট। সে উশানকে ডাক দিল,

-” এখানে এসো! কাল থেকে কিছু খাওনি। ”

হাতের তোয়ালে পুনরায় মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল উশান। চেহারায় ফুটালো বিরক্তিভাব। মুখোশ্রী বেশ বাজে ভাবে কুঁচকে নিয়ে বলল,

-” উহ্ মীরা! খাবোনা এখন। আমার ভালো লাগছে না এখন। ঘুমাবো! প্লিজ যাও। ”

-” তুমি আসবে কিনা বলো। ”

প্রায় ধমকে বলা কথাটা শুনে উশানের অন্তঃকরণ চমকালো বোধহয়। ভীষণ চমকালো!চমকিত ভাবটা বহির্ভাগে প্রকাশিত করলো না। এগিয়ে এলো সে বিনাবাক্যে। ভাব করলো এমন, যেন সে মীরার ওপর মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত!

-” হা করো। ”

উশান খাবার মুখে নিল। খাদ্যকণা চিবুতে চিবুতে শুধাল,

-” জ্বালাচ্ছো আজকাল খুব বেশি ! ”

মীরা প্রতিত্তুর করলো না। সে ভাত মেখে একের পর এক ভাতের দলা উশানের মুখে পাচার করছে অতী মনোযোগ সহকারে। খাওয়ার সময় আশেপাশে তাকাল উশান। কাওকে খুঁজছে!কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” মায়ান, টুইঙ্কেল কোথায়? ”

শেষের ভাতের দলা উশানের মুখে পুরে দিয়ে মীরা জবাব দিল,

-” রুহির সাথে বাহিরে গিয়েছে। ধানমন্ডি! রুহির মামার বাসায়। বেড়াতে গিয়েছে। ”

-” কতদিন থাকবে? কতদিন ওদের দেখা হয়না। আমায় কালকেই ফিরতে হবে। ”

মীরা থমকাল! থমথমে হলো তার মুখোশ্রী। নিষ্প্রভ কন্ঠে সে প্রশ্ন করে বসলো,

-“কালই? ”

-” হ্যা। ”

-” ছুটি নেই? তুমি তো এখনো অসুস্থ! ”

-” নেই। অসুস্থতা আমাদের জন্য কিছুই না। আমার পেশা ভুলে যাচ্ছ? গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আজই থাকতে পারতাম না।স্যারকে বলে কোনোমতে ম্যানেজ করেছি। ”

মীরার বিমূর্ত চাহনি দেখে উশান ক্ষিপ্ত হলো! এতো ইমোশনাল, মন খারাপ কেনো করবে মেয়েটা? কেন?

-” এভাবে বসে না থেকে দ্রুত হাত ধুয়ে আমার কাছে এসো। জলদি যাও! ”

মীরা ফিরে আসতেই দেখল উশান বিছানায় শুয়ে আছে। টানটান হয়ে! দৃষ্টি ওপরের সিলিং ফ্যানের মাঝে নিবদ্ধ তার। পর্দা টানানো থাকায় পুরো কক্ষ অন্ধকার প্রায়। বাহিরে রোদের তেজ নেই আজ। মেঘলাটে অম্বর! ফিনফিনে গগণ। আঁধারের মাঝে মীরা স্পষ্টত দেখল উশানের চক্ষুদ্বয় কোণে বহাল জল।

-” দাঁড়িয়ে আছো কেন? এদিকে এসো। ”

লম্বা কদম ফেলে মীরা এগোল। উশানের অনুমতি না নিয়েই উশানের বক্ষঃস্থলের মাঝ বরাবর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। অতঃপর চলল গা হিম করা ভয়ংকর মৌনতা। আর চুপটি করে না থাকতে পেরে মীরা বলে উঠলো,

-” তোমার কষ্ট হচ্ছে না? ”

উশান উত্তর দিল দুই, তিন সেকেন্ড পর,

-” কেন কষ্ট হবে? ”

-” আঙ্কেলের মৃ’ত্যু’তে! ”

-” হচ্ছে। ”

-” তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না। আর বাকি দিনের মতোই স্বাভাবিক লাগছে। ”

উশান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,

-” কষ্ট পেলে ভেতরে পেতে হয়। কাওকে দেখিয়ে পেতে হবে তার কোনো মানে আছে? নিজের কষ্ট অন্যকে দেখানো মানেই বোকামি। মানুষ বোকা ভাববে! সবসময় স্ট্রং থাকা উচিত। আমি যদি এখন মলিন হয়ে থাকতাম তাহলে আপু, উজানকে কে সামাল দিতো? আর তুমিই বা ঠিক থাকতে? কেঁদে কেটে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখা যেত! এখন কথা না ঘুমাও। ”

মীরার খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, শেহজাদা! তুমি আমায় একটু ধরে কান্না করো তো। নিজের বুকে জমে থাকা সকল কষ্ট – দুঃখ আমার মাঝে ফেলে দাও। আমি তোমার কষ্ট দুঃখ নিজের মাঝে নিয়ে তা সুখে পরিণত করে তোমায় ফেরত দেবো। ”

বলা হলোনা! মীরা যে এদিকটায় দূর্বল। উশানকে কাঁদতে দেখলে সে নিশ্চিত শ্বাস রুখে ম’রে যাবে! ছেলেটার কান্না যে ভয়ংক’র! বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়!

______

বিকেলবেলা উশান মীরাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই রেখে বাহিরে এসেছে। তার গন্তব্যস্থল কবরস্থান। বনানীর এখানকার কবরস্থানে আয়মান, সিয়া এবং এরিক কে কবর দেয়ার ব্যাবস্থা করেছিল উশান। এরিক, সিয়া! নাম দু’টো উশানের কাছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার নাম। এই দু’জন ব্যাক্তি যতই তার জীবনে ক্ষ’তি করার চেষ্টা করুন না কেন, এই দু’জন ব্যাক্তি তার খুব পছন্দের।
প্রথমত সিয়া! যে অতি অল্প সময়ে তার ছোট বোন এর জায়গা নিয়েছে। উশানের ছোট থেকেই একটা ছোট বোনের বিশাল আবদার ছিল। আবদার তার পূরণ হয়নি। সিয়া যখন তার জীবনে আসলো। সে যখন সিয়ার ‘ লাইফ হিস্টোরি ‘ রিসার্চ করল ঠিক তখন সিয়ার প্রতি উপচে পড়া রাগ তার গলে জলে পরিণত হয়েছে। তার খারাপ লেগেছে, লাগছে এবং ভবিষ্যতেও লাগবে সিয়ার জন্য!মেয়েটা ঠিক কতটা কষ্ট করেছে, কষ্ট পেয়েছে জীবনে তা বলার নয় একেবারেই। উশানের আক্ষেপ হয়, আল্লাহ তায়ালা কি এই মেয়েটাকে একটু সুখ দিতে পারতেন না?
অতঃপর উশান বাস্তবতা ঘাটলো! বাস্তবে কতজনই বা অতি দুঃখ মাখা সময় পার করার পর সুখ পায়?কতজন? হাজারে হয়ত খুবই অল্পসংখ্যক!বাস্তবতা তো এইযে, যার ভাগ্যে যা রয়েছে সে ততটুকুই পাবে এবং ততটুকুই ভোগ করবে।
দ্বিতীয়ত এরিক! এই ছেলেটা একটা পা’গল!প্রেমিকা পা’গ’ল! তূর্শীর প্রতি এরিকের ছিল অন্ধ ভালোবাসা। দিগন্তকে এরিক মা’রেনি। মে’রেছে তূর্শী! কিন্তু এরিক তার দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। তূর্শী চাচ্ছিল উশানকে কষ্ট দিতে। কারণ তার মতানুসারে উশানের জন্যই তার মা আজ তার সাথে নেই। উশানকে শাস্তি দেয়ার পায়তারা ছিল তার মনে। মীরাকে সে খু”ন করতে চায় প্রতিহিংসার কবলে পড়ে। উশান কাওকে নিয়ে সুখে থাকুক তা তূর্শী চায়নি। তূর্শীর প্রতিটি পদক্ষেপে এরিক ঠিক কিভাবে এবং কেন সায় দিল? তা ধোঁয়াশা! শুধুই কি ভালোবাসার টানে? উশানের তো তা মনে হয়না। তবে সে এতটুকু নিশ্চিত যে এরিক নির্দোষ! সম্পূর্ণ নির্দোষ!

উশান আয়মান, সিয়া এবং এরিকের কবরে ফুল গাছের চারা রোপণ করে মোনাজাত করল। তার এখন বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। কর্মস্থলে ফিরে যাবে বলে মনঃস্থির করল! এই ভীষণ ভীষণ মন খারাপ নিয়ে মীরার সামনে গেলে মীরা বেশ আহত হবে,কষ্ট পাবে, ক্ষতবিক্ষত হবে! তার এখন সময় প্রয়োজন।নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার এবং বাকিদেরকে সুখী রাখার দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার।
মীরার ফোনে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়ে উশান বাইক নিয়ে ছুটলো নিজের গন্তব্যস্থলে। তার যাত্রাপথ এখন এক মানষিক হাসপাতালে যেখানে সিয়ার বাবাকে রাখা হয়েছে। সিয়ার বাবা মানষিক ভাবে অসুস্থ। রাহনুমার শারীরিক এবং মানষিক যন্ত্রণা’র ফলে তার আজ এই বিধ্বস্ত অবস্থা। তবে ডাক্তারের দেয়া আশ্বাস, তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন!
________________

মীরা সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু করেছে। আজ প্রায় সাড়ে ছয় মাস পর উশান ফিরছে। পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে। প্রায় ছয় মাস আগে আয়মানের মৃ’ত্যুর পরদিন সেই যে উশান তার কর্মস্থলে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। মীরা এর পরিপ্রেক্ষিত কিছুই বলেনি উশানকে৷ এই ছয় মাসে তাদের কথাও হয়নি ঠিক মতো। মীরা প্রায়সই ফোন করতো! উশান ধরতো না। এক সপ্তাহ কি দুই সপ্তাহ পর নিজে থেকে কল করে এক, দুই মিনিট কথা বলে রেখে দিত। উশানের আচানক এই অবহেলা, দূরে দূরে থাকাটা মীরার জন্য প্রথমত কষ্টসাধ্যকর ব্যাপার ছিলো ব্যাপক! তবে সে নিমিষেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। উশান ব্যাস্ত মানুষ! কঠিন তার পেশা! তার তো এরূপ ব্যাস্ততার মাঝেই থাকার কথা।

-” মীরা! উশান ভাইয়া আসছে। ড্রইংরুমে! দৌড় দে মহিলা। যা! ভাইয়ার কোলে উঠে বসে থাক গা যা।”

মীরা কেঁপে উঠলো! তার হৃদঃস্থলে তৈরি হওয়া প্রলয় অবিন্যস্ত হলো। উশান এসেছে! এই বাক্যটি এ মূর্হতে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরতম বাক্য মনে হলো তার নিকট।অনুভূতি গুলো দুমড়ে মুচড়ে পিষে রাখল অন্তঃকরণে। রুহির দিকে তাকাল সে বিরক্তি মাখা চোখে! অকপটে বলল,

-” আজাইরা কথা কানের কাছে লাগাবি না তো।বের হ রুম থেকে! আমি কাজ করতেছি। ”

রুহি ভেংচি কেটে বলল,

-” এ্যাহ ঢং! তুই যে কতটা হ্যাপি আমি জানি। তোর যে খুশিতে লাফাইতে লাফাইতে নাচতে নাচতে উশান ভাইয়ের কাছে যাইতে ইচ্ছে করতেছে তাও জানি আমি! বুঝছস?”

রুহি রুম থেকে তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করল। আবারো আগের মতো নীরবতা বিরাজ রুমটাতে। মীরা তার হাতের তোয়ালে বারান্দার রেলিঙ এ মেলে দিয়ে সেখানেই দাড়িঁয়ে রইল! নড়ল না! স্থির হয়ে চেয়ে রইল দূরকাশে। আশপাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো পাহাড়ের প্রতি তার দৃষ্টিপাত আটকাঁল।
মীরা চাকরি পেয়েছে। বেশ ভালো মানের চাকরি।সে এখন চট্টগ্রামে থাকে। এখানেই চাকরি করে। ফ্লাটও কিনেছে! ফ্লাটটা মূলত তার এবং মাহদির জমানো টাকায় কেনা। মীরা, রুহি, টুইঙ্কেল, মায়ান, মাহদি সবাই এখন একসাথে এখানে থাকে। উমাইশাও! শুধু উজান বাদে। সে ঢাকায়।

-” রুহি ডেকে গেলো! আসলে না কেন? ”

ভারী কন্ঠ! মীরা উপলব্ধি করলো তার গা ঘেঁষে আরও একটি উত্তপ্ত শরীর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিয়ৎ পর পেছন থেকে উশান মীরাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঝাপটে ধরল। চিবুল রাখলো মীরার কাঁধে। মীরা থেমে থেমে কাঁপুনি দিল উশানের দাঁড়ির খোঁচা খেয়ে! কথা বলল না। উত্তর না পেয়ে উশান পুনরায় আসক্তি মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-” রেগে আছো প্রচন্ড? ”

মীরা তপ্তশ্বাস ছাড়ল। বলে উঠলো,

-” রাগ করে থাকার কথা?”

-” কথা না? ”

-” জানিনা! ”

উশান তার এবং মীরার মধ্যকার অতি সুক্ষ্ম ফাঁকা স্থানটাও মিলিয়ে ফেলল। মীরাকে কাছে টানল সে। অত্যান্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঝল। ক্ষণ বাদে শুধাল,

-” গত কয়েকবছর ধরে আমি খুব অশান্তির মাঝে ছিলাম মীরা। খুব অশান্তির মাঝে! আমার মানষিক শান্তির প্রয়োজন ছিল। খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠেছিলাম আমি। তাই পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। আমার ব্যাবহারে কেও যদি বিন্দুমাত্র কষ্ট পায় তা আমি সহ্য করতে পারব না! আমার অবস্থা এমন ছিল, আমার একা থাকাটা প্রয়োজন ছিল। নিজের মতো করে না থাকলে নিজেকে আমি সামলাতে পারতাম না। অনেক কিছু সাফার করেছি মীরা! অনেক কিছু হারিয়েছি! আর কিছু নতুন করে হারাতে চাই না। তাই নিজেকে পূর্ণরূপে তৈরি করে তোমার দায়িত্ব নিতে এসেছি। আমাকে একটা সুযোগ দাও! প্লিজ? অভিমান করে থেকো না। ”

মীরা বাঁধন মুক্ত হয়ে গহীন চোখে তাকাল উশানের প্রতি। উশানকে এলোমেলো লাগছে। ভীষণ রকমের এলোমেলো! মীরার মন গললো। শুধাল,

-” দিলাম সুযোগ! আর আমি তোমার ওপর অভিমান করে নেই। ”

উশান প্রশস্ত হাসল। বুকে টানল মীরাকে। পরপর মীরা উপলব্ধি করল উশানের গা ভীষণ তপ্ত। জ্বরে ছারখার হচ্ছে দেহ! সে বিচলিত হয়ে বলল,

-” একি অবস্থা!তোমার এতো জ্বর কেন? ”

নিরুত্তর রইল উশান। মীরার পিঠে একহাত রেখে অন্যহাত মীরার পা জড়িয়ে তাকে কোলে তুলল। রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,

-” উত্তপ্ত থাকুক দেহ! আমি আমার মাদকতার সিক্ত ভালোবাসায় সিক্তায়িত হয়ে আমার সর্বাঙ্গ আজ শীতল করবো। ”

পরিশিষ্টঃ

বছর ঘুরেছে! বর্ষা এসে পরাপর দু দু’বার আরো সিক্ত করেছে মেদিনী। বসন্ত এসেছে রঙহীন জীবন রঙিন প্রলেপে আঁকতে।পরিবর্তন এসে জনজীবনে।পরিবর্তন এসেছে রুহির জীবনে, পরিবর্তন এসেছে বিষন্নতার চিত্ররূপ উজানের জীবনে। রুহি এখন পাক্কা সংসারী মেয়ে। বিয়ে হয়েছে সাত মাস হলো। বিয়েটা তার মীরা জোড় করে দিয়েছে। রুহি বিয়ে করতে চায়না! চায়নি! তার কাছে সংসার মানেই ঝগড়া – বিবাদের অপর নাম বলে মনে হয়। রুহির বাবা মা দু’জনই ছিলেন চাকরিজীবী। তাদের প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত! শেষে ডিভোর্স হয়েছে দু’জনের। রুহি হয়েছে একলা। তার ঠাঁই হয়েছে তার মামার বাসায়। বাবা বা মা কেওই তাকে সঙ্গে না নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। সংসার জীবন মানেই বিচ্ছেদ মনে করত সে! তারই পরিপ্রেক্ষিতে এমন ছন্নছাড়া, উগ্র ছিল।ছেলেদের সাথে ক্ষনিকের জন্য রিলেশনে জড়িয়ে সময় ব্যায় করত।
আজ মীরা এবং উশানের পঞ্চমতম বিবাহবার্ষিকী। বিবাহবার্ষিকীতে প্রতিবছর মীরা উশান এতিম খানায় যায়। এই এতিমখানা উশানের প্রতি। বাবা তার এবং উজানের জন্য যা সম্পদ রেখে গিয়েছিল তা দিয়ে উশান দু’টি এতিমখানা, একটি বৃদ্ধাশ্রম, এবং একটি মসজিদ তৈরি করেছে বাবা মায়ের নামে।

-” উশান তারা কে দেখেছিস? ”

তীব্র চারপাশে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল। চিন্তিত শোনাল তার কন্ঠ।উশান ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল সামনে। তীব্র তখন সোফার নিচে, কলমদানির ভেতর, বিছানার নিচে, গ্লাসের ভেতর নিজের দুই বছরের কন্যাকে সন্ধান করছিল। উশান ভ্রু কুঁচকে নিল! বলল,

-” ও তো মীরার কাছে। ”

খাটের নিচে উঁকি ঝুঁকি দেয়া থেকে বিরতি নিয়ে তীব্র উঠে বসল। বিরক্তি নিয়ে বলল,

-” তো আগে বলবিনা শালা? আমি ওকে খুঁজতে খুঁজতে মরতাসি! ”

-” ও কি কোনো ইঁদুর? বিড়াল? ওকে তুই এসব জায়গায় খুঁজিস কেন ইডিয়ট! ”

তীব্র আমতা আমতা করে চুপ রইল। তারা তার জীবনে আসার পর থেকে সে আসলেই উদ্ভট হয়ে গেছে। ভীষণ উদ্ভট!

তীব্রর বিয়ে হয়েছে তিন বছর। তার ভার্সিটি লাইফ এর ক্লাসমেটের সাথে। উজান বিয়ে করেনি। সে বিয়ে বিদ্বেষী হয়েছে! উশান হাজার বলেও তাকে তার সিদ্ধান্ত হতে নড়াচড়া করাতে পারেনি। রুহির বিয়ে হয়েছে তার মামা – মামির পছন্দে।

বিকেলের দিকে এতিমখানার উদ্দেশ্যে বের হলো সবাই। আজ তারার জন্মদিন তার ওপর মীরা এবং উশানের বিবাহবার্ষিকী! দুটোই সেলিব্রেট করা হবে এখানে। গাড়ির ফ্রন্টসিটে বসেছে মীরা উশান। তাদের পিছে টুইঙ্কেল, মায়ান এবং তারা বসে আছে। টুইঙ্কেল, মায়ানের এখন অব্দি বনিবনা হয়নি। তারা প্রতি মূর্হতে ঝগড়া করে থাকে। এখনো করছিল! মীরা তৎক্ষনাৎ ভারী কন্ঠে বলল,

-” টুইঙ্কেল, মায়ান! মার খাবে দু’জন? এতো কিসের ঝগড়া তোমাদের? তারা বসে আছে তোমাদের সাথে। ও তোমাদের ছোট। তোমরা এমন করলে ও কি শিখবে তোমাদের থেকে? ”

টুইঙ্কেল, মায়ান একসঙ্গে বলে উঠলো,

-” সরি! ”

তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। টুইঙ্কেল, মায়ানের বলা প্রায় বাক্য সে কপি করে। এবারও তাই করল,

-” ছলিই..!”

উশান হেঁসে উঠলো গলায় শব্দ করে!

এতিমখানায় রাত পর্যন্ত থাকল সবাই। মীরা মলিন চেহারা নিয়ে বসেছিল সর্বক্ষণ এক কোণে। পুরো সময় সে একটা ফুটফুটে বাচ্চা কোলে করে বসে ছিল। বাচ্চাটা তার ভীষণ প্রিয়। দু’দিন আগেই মা, বাবা হারিয়েছে এই বাচ্চাটা। ওর নাম উহাশ! নামটা মীরাই রেখেছে। মীরার ইচ্ছে করে উহাশকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু উশানকে বলতে পারেনা সে। তার প্রায়সই মন খারাপ থাকে। আজ যদি সে মা হতে পারতো। তাহলে নিশ্চয়ই উহাশের মতো তার একটা ফুটফুটে বাচ্চা থাকতো। উহাশকে একজনের কাছে রেখে ফিরে এলো মীরা। উহাশ বড্ড কান্না করছিল। মীরা পা’গল সে! মীরা আসলে তার কোল ছেড়ে নামতেই চায় না। এতিমখানার বাচ্চাদের মাঝে নতুন কাপড়চোপড়, বইখাতা দিয়ে মীরা তখনি ফিরে আসার বায়না ধরলো।

_____

তখন রাত বারোটা হবে! উশান বাসায় নেই। মীরা জানেনা সে কোথায়? বলে যায়নি লোকটা। কর্মস্থলে তো যাওয়ার কথা না। কয়েকদিন হলো সে এসেছে পাঁচ মাস পর। সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। পার হয়েছে মাত্র দু’দিন। এতো রাতে গেল কোথায় উশান?
রুমে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল মীরা। উশান তার কল ধরছেনা। আশ্চর্য! উশান তো কখনো এমন করেনা। কিয়ৎক্ষণ পর বাচ্চার কান্নার শব্দ প্রতিফলিত হলো তার কর্ণে। উহাশের কান্না! মীরা তা ভালো করেই জানে। মীরা এক প্রকার ছুটে বের হলো রুম থেকে। উহাশকে দেখতে পেল ড্রইংরুমে। সোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। উহাশকে কোলে তুলে কান্না থামাতে ব্যাস্ত হলো সে। বিড়বিড়িয়ে বলল,

-” উহাশ কেন এখানে? ”

-” আমি এনেছি। ”

মীরা পেছন তাকাল। উশান দরজা দিয়ে তখন মাত্র ঢুকছে। এসেই সে বসল সোফায় স্ব-শব্দে! শুধাল,

-” তুমি যে প্রতি রাতে ওর জন্য কান্নাকাটি করো তা আমার ভালো করেই জানা আছে মীরা। এভাবে কান্না না করে আমাকে বললেই পারতে! লেট ইট বি! উহাশকে পার্মানেন্ট আমাদের সাথে থাকার ব্যাবস্থা করেই এনেছি। ”

মীরা স্তব্ধ! চোখমুখে তার হৃষ্টচিত্ত। সে ঝাপটে ধরল উশানকে। কেঁদে উঠলো পরপর। উশান গহীন চোখে তাকিয়ে বলল,

-” কান্না বন্ধ করো মীরা। উহাশের কান্নার গতি বাড়ছে এতে। ছেলেটা অল্প কয়েকদিনেই তুমি পাগল হয়ে গিয়েছে! ওকে আমার ফ্যান বানাতে হবে। আমার ছেলে হবে আমি পাগল। বুঝেছো? ”

নিশুতি রাত। মীরা ঘুমাচ্ছে! উহাশ উশানের বুকে।উশান নির্ঘুম চোখে দেখছে দু’জনকে। কতো সুন্দর লাগছে দু’জনকে একসাথে। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বিড়বিড়িয়ে বলল,

-” মাহদি আঙ্কেলের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা তোমার থেকে লুকিয়ে গেলাম মীরা। আমায় মাফ করে দিও! আমি চাইনা আঙ্কেল শেষ বয়সে এসে মেয়ের ঘৃণা পাক। ”

উহাশ, মীরার ললাটে টুপ করে চুমু খেল সে। মীরা কেঁপে উঠে উশানকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। উশান হাসে! মৃদু! আনমনে বলে,

-” তুমি আমার মাদকতা! আমার প্রাণোলতা মীরা। আমার অতি কাছের মানুষ। আমার শুদ্ধতম, শ্রেষ্ঠ হৃদয়েশ্বরী। ”

(সমাপ্ত)

| আজ সবার মন্তব্য চাই পাঠকমহল। শেষবারের মতো আপনাদের মন্তব্যগুলো একটু দেখতে চাই। ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ। ভালোবাসা ❤️|

#বিশেষ_দ্রষ্টব্যঃ কিছু বিষয় আমি ক্লিয়ার করিনি। উপন্যাসের সবকিছু খোলাসা করলে উপন্যাসের আসল প্রাণটাই থাকবেনা তাই! কিছু ব্যাপার নাহয় গোপনে থাক।

গ্রুপ- Sadiya’s Fiction❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here