শুনলাম_বসন্ত_নাকি_আবার_এসেছে #লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান #পর্বঃ৩

0
1

#শুনলাম_বসন্ত_নাকি_আবার_এসেছে
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ৩

সূর্যিমামা সবেমাত্র উকি দিয়েছে তখনই তুবার চিৎকারে বাড়ির মধ্যবয়স্ক আর বয়স্ক মানুষ তিনজন ধরপরিয়ে উঠে পড়ল ৷ ঘটনা কি বোঝার জন্য দ্রুত ছুটে তুবার চিৎকারের উৎসের দিকে যেতে লাগল ৷ গিয়ে দেখল তুবা বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে নিজের লম্বা চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ৷

রাইশা এগিয়ে গিয়ে বলল,,, কি হয়েছে?

তুবা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই বলল,,, বউমা আমার চুল এতো বড় কবে হলো? বিদেশী তেল রোজ লাগিয়ে দিতে নাকি আমায়?

তুবার কথা শুনে তিনজনই ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে গেল ৷ এই বিষয়টা তো ভেবেই দেখেনি ওরা ৷ কারো থেকে কোনো জবাব না পেয়ে তুবা পুনরায় বলে উঠল,,,

ঠিক আছে ৷ তানজিদ বাবা আমাকে সেলুনে নিয়ে চল তো চুলগুলো কাটিয়ে আনি ৷

তিনজনই তৎক্ষণাৎ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,,, না!

তুবা অবাক হয়ে বলল,, কি হলো? চিৎকার করলে কেন সবাই?

তুবা নিজের চুলের প্রতি কতোটা সেনসিটিভ সে বিষয়ে সকলেই অবগত ৷ নরমাল হওয়ার পর যদি দেখে ওর মাথায় চুল নেই তাহলে সকলকেই টাকলা বানিয়ে দিবে নিশ্চিত!

ওরা তিনজন একে অপরের দিকে অস্থিরভাবে তাকাচ্ছে ৷ এখন কিভাবে বিষয়টা সামলাবে সেটা মাথায় আসছে না ৷ হঠাৎ তুলি বেগম বলে উঠলেন,,,

তুবা ম-মানে আপনি প্লিজ চুল কাটবেন না ৷

তুবা ভ্রু কুঁচকে বলল,, কেন?

আসলে আপনাকে লম্বা চুলে অনেক সুন্দর লাগে ৷

কিন্তু তোমার তো লম্বা চুল পছন্দ না ৷ আমার চুল অল্প একটু বড় হলেই বাড়ি মাথায় তুলে রাখতে চুল না কাটা পর্যন্ত ৷

তুলি বেগম ঢোক গিলে ছেলে আর ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন ৷ কয়েক মূহুর্ত পর আবারও তুবার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

আরে তখন আমার আবেগের বয়স ছিল ৷ এখন বিবেকের বয়স ৷ আমরা হলাম প্রাচীন যুগের মানুষ ৷ আর প্রাচীন যুগে লম্বা চুলই ছেলেদের সৌন্দর্যের প্রধান আকর্ষণ ছিল ৷

তুবা পুনরায় আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চুলগুলো দেখতে দেখতে বলল,,, মন্দ বলোনি ৷ এতোদিনে একটা আক্কেলওয়ালা কথা বলেছো ৷

তুলি বেগম ঘোরের মধ্যে থেকে খেকিয়ে উঠে বললেন,,, তার মানে এতোদিন বেহুদা কথা বলতাম? আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে এভাবে অ*পমান করার?

তানজিদ আর রাইশা আহাম্মক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল ৷ কন্ঠটা নিচু করে তানজিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,,

আম্মু এটা তুবা , বাবা না ৷

তুলি বেগম থতমত খেয়ে নিজেও আস্তে করে বললেন,,, আসলে এতো বছরের অভ্যাস তো তাই ভুলে ধমক দিয়ে ফেলেছি ৷ তোর বাবার সাথে কোনো অবস্থাতেই আমি ঝ*গড়ায় হারব না ৷ যদিও সেটা তুবার মধ্যে থাকা উনিই হোক না কেন!

তানজিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,, ওম্যান!

রাইশা তানজিদের পেটে গু*তা মে*রে ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকাল ৷ অন্যদিকে তুবা সামান্য হেসে বলল,,,

বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছো তবুও তোমার তেজ কমেনি! মেয়ে মানুষ আসলেই ভ*য়ঙ্কর, বাচ্চা থেকে বুড়ি সবাই ৷

তুলি বেগম আবারও হুশ হারিয়ে কিছু বলতে ধরলেই তানজিদ মাকে ইশারায় বলল,,, মা এটা তুবা ৷ নিজেকে সামলাও ৷

তুলি বেগম লজ্জিত ভঙিতে হেসে চুপ করে থাকলেন ৷ তুবা আবারও আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,,,

আচ্ছা আমার দাঁড়ি…

সামনের কথা কি হতে পারে বুঝতে পেরে রাইশা জোরে বলে উঠল,,, আরে স*র্বনাশ! বাবা আপনার ওষুধের সময় হয়ে এসেছে ৷

তুবা পিছু ঘুরে বলল,, কিন্তু বউমা আমার দাঁড়ি..

তানজিদ তুবাকে থামিয়ে দিয়ে ওকে ধরে ধরে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলল,,, বাবা থামো তো ৷ সারাদিন শুধু পটরপটর করে কথা বলতেই থাকো তো বলতেই থাকো ৷ কম করে কথা বলো , কবে না জানি দম আটকে যায় তোমার ৷

তুবা আবারও গালে হাত দিয়ে ‘দাঁড়ি’ শব্দটা উচ্চারণ করার সাথেই তুলি বেগম চিৎকার করে বললেন,,,

এই ম*রার বুড়ো কি দাঁড়ি দাঁড়ি শুরু করেছেন? আপনার দাঁড়িতে ফ্রিতে উকুনদের বাসা ভাড়া দিয়েছিলেন তাই সব ছিঁলে দিয়েছি ৷ আর একবার যদি দাঁড়ির কথা বলেন তাহলে জিহ্বাও ছিঁলে দিব!

রাইশা আর তানজিদ হতভম্ভ হয়ে রা*গে গজগজ করতে থাকা তুলি বেগমের দিকে তাকাল ৷ তুবা কাঁচুমাচু মুখে বলল,,,

দেখছো তোমাদের মা এই বয়সে এসেও আমাকে হুমকি দেয় ৷ আমি খুব দ্রুতই বৃদ্ধ নি*র্যাতনের মামলা দিতে যাব এই বুড়ির নামে ৷

তুলি বেগম গ*র্জন করে বললেন,, কি! আমি বুড়ি? আরে বয়স আপনার হতে পারে কিন্তু আমি এখনও ইয়াং আছি ৷

তানজিদ কপাল চাপড়ে বলল,,, হায় আল্লাহ এখানে তো দেখছি রোগী দুইটা ৷ এক আমার মেয়ে , দুই আমার মা ৷ কবে না জানি আমার বাড়িটা পাগলাগারদে পরিণত হয়! একজন নিজেকে অন্য কেউ ভাবছে আর একজন তার সাথে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে ঝ*গড়া করছে!

হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখল তুবা নেই ৷ ও উঠে গিয়ে তুলি বেগমের সাথে ঝ*গড়া করছে ৷ আর রাইশা উনাদের দুজনকে থামানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে ৷ এসব দেখে তানজিদ আরেক দফা নিজের কপাল চা*পড়াল ৷

বেশ কয়েক মিনিট পর তুবা ক্লান্ত হয়ে ধপ করে তানজিদের পাশে বসে হতাশ কন্ঠে বলল,,,

হেরে গেছি ৷ বরাবরের মতো এবারও তোর মায়ের কাছে হেরে গেলাম ৷

তানজিদ তুবার দিকে চোখ তুলে তাকাল ৷ তুবাকে একদম তাহির ইসলামের মতোই পরাজিত সৈনিক লাগছে ৷ উনিও ঝ*গড়ায় হেরে গেলে এভাবে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়তেন ৷ তুবার থেকে চোখ সরিয়ে তানজিদ বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ৷

°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°

হাসান ভিলায় সবাই ব্যস্ততার সাথে কাজ করে চলেছে ৷ কারন তাদের গন্তব্য এখন তানিয়া ইসলামের বাবার বাড়ি যেখানে তুবা সকলের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে ৷ ব্রেকফাস্ট করা শেষে সবাই যে যার রুমে চলে গেছে তৈরি হওয়ার জন্য ৷ তানিয়া ইসলাম বোরকা পড়ে ড্রয়িংরুমে এসে গলা খানিকটা উচিয়ে বলল,,,

বাচ্চারা দ্রুত আসো ৷ বাবা ধ্যাত তুবা আমাদের না দেখতে পেয়ে ভাইয়া ভাবীকে পাগল করে দিচ্ছে ৷ একটু তাড়াতাড়ি করো ৷

তানিয়ার কথা শেষ হওয়ার সাথেই আয়েশা আর শেহনাজ নিচে আসতে আসতে বলল,,, এসে গেছি ছোট মা ৷

ওদের পরপরই তুষার সাদা শার্ট পড়ে নিচে চলে এলো ৷ শেহনাজ হা হয়ে সেদিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল ৷ তুষার ওর দিকে তাকাতেই শেহনাজ চট জলদি চোখ সরিয়ে নিল ৷ সিনু কিচেন থেকে আসতে আসতে বলল,,,

তোমরা এখনও যাওনি কেন?

আয়েশা ব্যঙ্গ করে বলল,,, কারন তোমার রুপবতী ছেলে এখনও আসেনি মাম্মা ৷

এখনও আসেনি? রুমে কি করছে ও?

দেখো গিয়ে রূপচর্চা করছে ৷

সাভাশ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,,,

নিজের কাজ আমার উপর চাপিয়ে দিবি না ৷ প্রতিদিন রাতে তুই মুখে কালি মেখে বসে থাকিস , আমি না ৷

আয়েশা তেতে উঠে বলল,, ওটা কালি না মূর্খ ৷ ওটাকে ফেসপ্যাক বলে ৷

পাতিলের তলার কালি দিয়েই ওরা ফেসপ্যাক বানায় ৷

বেশি কথা বলবি না সাভাশ ৷

ঝ*গড়া শুরু হওয়ার পূর্বাভাস দেখে সিনু ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল,, আহ চুপ করবে তোমরা! সবসময় শুধু কিচিরমিচির করতে থাকো ৷ এসব বাদ দিয়ে এখন একটু তুবার বিষয়টা ভাবো ৷

মায়ের ধ*মকে দু ভাইবোন চুপ হয়ে গেল ৷ তানিয়া ইশারা করতেই সবাই গাড়ির দিকে চলে গেল ৷ সিনু তানিয়ার হাত ধরে বলল,,,

ওখানে সব সামলে নিস ৷ তুবা যেন টের না পায় তোরা অভিনয় করছিস ৷ বাড়ি ফাঁকা না থাকলে আমিও যেতাম ৷ যাকে গে আঙ্কেল আই মিন তুবার খেয়াল রাখিস ৷

তানিয়া মুচকি হেসে বাচ্চাদের কাছে চলে গেল ৷ সাভাশ সোজা গিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে হাত পা মেলে বসে পড়ল ৷ আয়েশা ওর পাশে গিয়ে বসে টিটকারি মে*রে বলল,,,

যতই রূপচর্চা কর না কেন কালামানিক কালাই থাকবি হুহহ!

সাভাশ ওর মাথায় চা*টি মে*রে বলল,,, আমার বউ হবে ধলা আর তোকে টাকলা পেটমোটা একটা সুদর্শন বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দিব ৷

আয়েশা রে*গে গিয়ে ওর কান টেনে ধরে বলল,,, তোকে মে*রে ফেলব সাভাশ! বাবাকে বলে তোকে কয়লার খনিতে কাজ করাতে পাঠিয়ে দিব ৷

সাভাশ আয়েশার থেকে নিজের কানকে বাঁচিয়ে ওর মাথায় টোকা মা*রল ৷ এভাবে ওদের সা*পে নে*উলে ঝ*গড়া অব্যাহত থাকল ৷ অন্যদিকে তুষার ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে পড়ল ৷ এই পরিবারের সবচেয়ে শান্ত সন্তান হচ্ছে তুষার ৷ সহজে কারো সাথে রা*গারাগি করে না ৷ বড়রা যা বলে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাকে বলে আদর্শ সন্তান ৷

তুষারকে ড্রাইভিং সিটে বসতে দেখে শেহনাজ ওর পাশের সিটে বসার জন্য ছুটল ৷ কিন্তু অভ্যাস বশত গাড়ির কাছাকাছি আসতেই চিৎপাটাং হয়ে পড়ে গেল ৷ ওর পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে সবাই ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল আর শেহনাজ দাঁত কেলিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকল ৷

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here