অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৩.

0
2

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৩.

লক্ষ্মীবাজারের গাবতলি রোড। পাঁচতলা একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে তুহিন আহমেদ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মিস্টার শিকদার। ওখানকার ওসি। ওদের সামনেই পড়ে আছে একজন ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী যুবকের লা-শ। তমাল হেঁটে হেঁটে পুরো ছাদটা দেখছে। সন্দেহজনক কিছু পেলেই তুলে নিচ্ছে এভিডেন্স ব্যাগে। সন্ধ্যা নামছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশ। শীতের প্রকোপ আ-ঘা-ত হানছে তীব্র গতিতে। গা শিরশির করে ওঠার মতো ঠান্ডা। ওদের সবার গায়েই ভারী গরম পোশাক। মাঝেমাঝে হাতের তালু ঘষে কিছুটা উষ্ণতা পাওয়ার চেষ্টা করছে।

ওসি বেশ উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। বেশ কয়েকবার নাম শুনেছে গোয়েন্দা বিভাগের এই ইয়াং, ইন্টেলিজেন্ট এবং সাহসী ইনভেস্টিগেটরের কথা। আজ দেখেও নিলো। তুহিনের অসাধারণ ফিজিক্স এবং ব্যক্তিত্ব মুহুর্তেই মুগ্ধ করল তাকে। বিকেল ঠিক পাঁচটার দিকে হঠাৎ করেই কল আসে থানায়। কলটা তুহিনের ছিল। তুহিন জানায় শীঘ্রই একটা খু-ন হতে চলেছে লক্ষ্মীবাজারে। কিংবা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। শিকদার বেশ অবাক হয়েছিল। কোন খু-ন হয়েছে বা হতে চলেছে? আর সেটা আগে থেকেই জানে তুহিন? কীভাবে? হয়তো নতুন ইনভেস্টিগেশন করছে। তদন্ত করতে গিয়েই জানতে পেরেছে। ওসি আরও বেশি অবাক হয়েছে; যখন তার ঠিক কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে গাবতলি রোডে খু-ন হয়েছে। খবরটা শোনামাত্র ওসি সোজা স্পটে চলে যায়। খবর পাঠায় তুহিনকেও।

কিন্তু ছেলেটা এসে থেকে তেমন কথা বলেনি। শুধু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে লা-শটাকে। লা-শটার মাথার বাঁ পাশে লেগেছে গু-লিটা। মৃত্যু ঐ গু-লিতেই হয়েছে। তবে খুনের আগে বেশ হাতাহাতি হয়েছে। শরীরে থাকা আ-ঘা-তের চিহ্নগুলো তাই বলছে। সামান্য আফসোস হচ্ছে তুহিনের। ও জানতো খুন হতে চলেছে। এটাও জানতো খুনটা কোথায় হতে চলেছে। কিন্তু আটকাতে পারলোনা। পারার কথাও ছিলোনা। কারণ শেষ মুহূর্তে এসে বুঝেছিল ও সবটা।

তমাল এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, আশেপাশে আর কোন বু-লে-টের স্পট বা বু-লে-ট নেই। আমার মনে হচ্ছে মৃ-ত লোকটা গু-লি চালানোর সময়ই পায়নি।’

‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট গুলো কালেক্ট করেছো?’

‘ ইয়েস স্যার।’

‘ আর লোকটা যেই রুমে ছিল সেই রুমটা আটকে দিয়েছো?’

‘ জি স্যার।’

‘ এভিডেন্সগুলো সব ফরেনসিকে পাঠিয়ে দাও। দ্রুত! খুব তাড়াতাড়ি রেজাল্ট চাই আমার।’

তমাল মাথা নাড়ল। দ্রুত এগোলো নিজের কাজে। ওসি এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো তুহিনকে। তুহিন নিজে কিছু বলছেনা তাই ওসি নিজেই এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘স্যার, আমি আশেপাশে জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারল না। কেউ দেখেনি খুনিকে।’

তুহিন ওসির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘থানায় খবরটা কে দিয়েছে?’

‘ এই বিল্ডিং এর মালিক।’

‘ কোথায় উনি? আমি কথা বলব ওনার সাথে।’

মিস্টার শিকদার ইশারা করতেই কন্সটেবল ছাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে থেকে একজনকে ডাকল। লোকটা এগিয়ে এসে বলল, ‘জি, আমিই বাড়িরওয়ালা ছার।’

তুহিন ভালোভাবে তাকালো লোকটার দিকে। পাঁচ ফুট চার-পাঁচ ইঞ্চি হাইট। ফর্সা, টাকপড়া তেল চিটচিটে মাথা। তুহিন বলল, ‘আপনার নাম?’

লোকটা দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘জামাল। আমার নাম জামাল মাদবর।’

তুহিন লা-শটার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল, ‘এনাকে চেনেন?’

‘ চিনিনা মানি! খুব ভালো কইরাই চিনি। এইডাতো সুজন। বহুদিন হইল এই বিল্ডিং এই থাহে।’

‘ একাই থাকে? ওনার পরিবার?’

‘ না ছার। একলাই থাহে। কী আর কমু ছার! এতোগুলান দিন হইল এইহানে থাহে। কিন্তু একটা মাসের ভাড়াও দেয় নাই। নিজের বাপের সম্পত্তি বুইজা থাকতো।’

তুহিন এতক্ষণ চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিল। জামালের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? আপনি ভাড়া চাইতেন না? ভাড়া না দিলে রেখেছেন কেন?’

‘ খেমতা ছার, খেমতা। এগো লগে লাগোনের সাহস আমগো আছে কন?’

তুহিন কৌতূহলী কন্ঠে বলল, ‘কেন? কী এমন করতো সুজন?’

জামাল আশেপাশে একবার চোখ বুলালো। যেন কেউ শুনে ফেললেই বিপদ। অতঃপর তুহিনের দিকে এগিয়ে চাঁপা আওয়াজে বলল, ‘ঐ ছেমড়া তো একটা গুন্ডা। ওর লেইগ্গা তো এই বিল্লিং এ কোন মাইয়া রাহি না। ব্যাটায় আস্তো লুইচ্চা। দুইটা ধ-র্ষ-ণ করছে এই বিল্লিং এই। একটারে তো উডাইয়া নিজের ফেলাটে নিয়াই ধ-র্ষ-ণ করছে। মা-রা-র হু-ম-কি দিয়া মুখ বন্ধ কইরা রাখে সবগুলার। কেউ কিছু কইতে পারে নাই। এরপর থেক্কাই এইহানে আর মাইয়া রাহিনা।’

তুহিন হতবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘দু দুটো ধ-র্ষ”ণ হয়েছে এখানে? আর আপনারা কেউ পুলিশকে জানান নি? ভিকটিম মেয়ে দুটোও না?’

‘ কইলামতো ছার। পরাণের ডর নাই কার? নিজে বাঁচলে শেনা বাপের নাম। হুনছি হেয় মস্ত বড় এক স-ন্ত্রা-সী দলের নোক। কতায় কতায় মানুষ মারে। এর লগে পি-স্ত-লও দেখছি আমি।’

তুহিন একটুও চমকালো না। যখন লক্ষ্মীবাজারের খু-নের কথাটা শুনেছে তখনই অনুমান করে ফেলেছিল এই সুজনও সাজ্জাদের মতোই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ। এই দুটো খু-ন যে কানেক্টেড সেটা নিয়েতো আর কোন সন্দেহই নেই। এখন ওরও মনে হচ্ছে পুলিশ টিমের ধারণা সত্যি। বাকি খু-নগুলোও এর সাথে জড়িত। এখন অপেক্ষা শুধু শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার। তার জন্যে তুহিনকে আরও কিছুটা খাটতে হবে। তুহিনের আফসোস হলো মেয়ে দুটোর জন্যে। পত্রিকায় নিয়মিত দুই-তিনটা ধ-র্ষ-ণের কেসতো অহরহ। কিন্তু এরকম অসংখ্য ধ-র্ষ-ণের ঘটনা পত্রিকায় তো দূর; থানা অবধিও পৌঁছাতে পারেনা। তারমানে আবারও এক নরপশুর মৃত্যু হল। তবে যে এই জানোয়ারগুলোর জীবন নিচ্ছে সে কে? নিজেও একটা জানোয়ার? নাকি জানোয়ারের ছদ্মবেশে কোন দেবদূত? যেই হোক, কিন্তু সেও তো খু-নি। আইনের ভাষায় বললে সেও একটা জানোয়ার। তাকে দেবদূত বলা যায়না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুহিন বলল, ‘লাশটা কখন দেখেছেন আপনি?’

জামাল বিজ্ঞের মতো একটু ভাবার অভিনয় করল। তারপর বলল, ‘ঐ বিকাল পাঁচটা হইব। আমিতো আমার রুমে ঘুমাইতেছিলাম। কান ফাডা গু-লির আওয়াজ পাইয়া ঘুম ভাঙছে আমার। পরথম বুজি নাই কীয়ের আওয়াজ। তাড়াতাড়ি ছাদে যাইয়া দেহি এই সুজনের লা-শ। তয় ছাদে আর কেউ আছিল না ছার। জুতা খুঁজতে একটু সময় লাগছে আমার। তয় বেশি না।’

‘ গু-লির শব্দ শোনার পর উঠতে কত সময় লেগেছে আপনার?’

জামাল আবারও একটু ভাবল। হতাশ কন্ঠে বলল, ‘তাতো জানিনা ছার। কিন্তু আওয়াজ পাইয়া আমি এক মিনিটও দাঁড়াই নাই, দৌড়াইয়া আইছি।’

তুহিন নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু চিন্তা করল। এরপর হেসে বলল, ‘আপনি তো অনেক বুদ্ধিমান জামাল সাহেব। পড়াশোনা কতদূর?’

জামাল খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘বেশি না ছার। তয় কমও না। কেলাশ ফাইভ পর্যন্ত পড়ছি।’

‘ ইশ! যদি আপনি আরেকটু শিক্ষিত হতেন তো নিশ্চিত একজন ভালো গোয়েন্দা হতে পারতেন। দারুণ বুদ্ধি আপনার।’

জামালের চেহারাই পাল্টে গেল। গর্বে ফুলে উঠল তার বুক। গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালো সে। যেন ভীষণ বিজ্ঞ। তুহিন ওনার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনার আরেকটু সাহায্য পেলে খুব উপকার হতো। পুলিশের তো আপনাদের মতো বুদ্ধিমানদেরই সহযোগিতা প্রয়োজন।’

জামাল খুশিতে আটখানা হয়ে উঠল। গদগদ হয়ে বলল, ‘কইয়াই দেহেন না ছার। আমি অনেক কিছুই করতে পারি।’

তুহিন আবার হাসি চাপল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, ‘জি, সেটা আমি জানি। বেশি কিছু করতে হবেনা। আবার আপনার রুমে গিয়ে বসুন। তারপর ওসি সাহেবকে ফোন করবেন। উনি বলার সাথে সাথে ঠিক একইভাবে দৌঁড়ে ছাদে আসুন যেভাবে আগেরবার এসেছেন। জুতা খুঁজতেও ঠিক যা যা করেছেন, ঠিক তাই তাই করবেন। একইভাবে। পারবেন না? আমার মনে হয় আপনি পারবেন।’

‘ পারুম না ক্যান? এহনই যাইতাছি।’

কথাটা বলে জামাল দৌড়ে চলে গেল নিচে। নিজের রুমে গিয়ে ওসিকে কল দিয়ে বলল সে পৌঁছে গেছে। ওসি তুহিনের দিকে তাকাতেই তুহিন ইশারা করে আসতে বলতে বলল জামালকে। ওসি মাথা নেড়ে বলল ‘চলে আসুন’। সাথে সাথেই টাইমার অন করল তুহিন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ছাদে এসে উপস্থিত হল জামাল। তুহিন টাইমার অফ করল। চার মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ড। এরপর জামালের দিকে তাকিয়ে চমৎকার হেসে বলল, ‘ভালো কাজ করেছেন আপনি।’

জামাল হাপাঁতে হাঁপাতেই আবার দেঁতো হাসল। বলল, ‘থাংকু ছার।’

তুহিন আবার তাকাল চারপাশে। ছাদের চারপাশে হেঁটে হেঁটে ভালো করে দেখল। মনে মনে কিছু ক্যালকুলেট করে চলেছে অনবরত। হঠাৎই পাশের তিনতলা বিল্ডিং এর ছাদে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন ওসি সাহেব। একবার ঐ বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ঘুরে আসি। এদিকের বিল্ডিং এর গুলোর ছাদ বেশ সুন্দর। ‘

ওসি সাহেব বোকার মতো তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। এই লোকটা অদ্ভুত জানতো সে। তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে যেটুকু দেখল; সবটাই তার মাথার ওপর দিয়ে গেল। তদন্ত করতে এসে এলাকার ছাদ ঘুরতে যাচ্ছে? এ কেমন কথা!

রাতে ফ্ল্যাটে ফিরতে বেশ রাত হল তুহিনের। পাশের তিনতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে যাওয়ার কারণ ছিল একটাই। সময়সহ সব ক্যালকুলেট করার পর ওর ধারণা হয় খু-নি ওখান দিয়েই পালিয়েছে। কিন্তু ঐ বিল্ডিংটাই কেন? সেই প্রশ্নটাও জাগে তুহিনের মনে। সেই উত্তর খুঁজতেই ঐ বিল্ডিং এর মালিকের খোঁজ করে সে। কিন্তু বিল্ডিং এর মালিক এখন বাড়িতে নেই। দু-দিন পরে আসবে। নাম্বারটাও বন্ধ আছে। আশেপাশে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও বিশেষ কিছু জানতে পারেনি তুহিন। সবাই শুধু গু-লির আওয়াজই শুনেছে। কিন্তু কেউ দেখেনি এই খু-নিকে। খু-নিযে ভীষণ চালাক তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন একটা ক্লুতো তুহিন নিশ্চয়ই পাবে। পেতেই হবে.

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো তুহিন। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। বেরিয়ে দেখে, নিজের হাতে ভাত মেখে নিয়ে এসেছে মাহমুদা বেগম। আটচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে তার। তুহিন নিজের বিশ বছর বয়স থেকেই দেখছে ওনাকে। ওদের বাড়িতে কাজ করে; ওদের সাথেই থাকতো। বয়স অনেক হলেও এখনো খুব সুন্দর দেখতে। রূপ সুন্দর হলেও; কপাল ছিল ততটাই খারাপ। অকাল বৈধব্য। এরপর আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তাও করেনি। কয়েক বছর হল তুহিনের সাথেই থাকে। তুহিনকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসে সে। বোনের মেয়ের বিয়ে ছিল। দু-দিনের ছুটি নিয়ে সেখানেই গিয়েছিল মাহমুদা।
তুহিন তোয়ালেটা রেখে বলল, ‘তুমি মাখতে গেলে কেন খালা? আমি নিজে খেতে পারতাম।’

মাহমুদা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তা আমি জানি। সারাদিন দৌঁড়াদৌঁড়ি করে এসে; কোনরকম চামচ দিয়ে দু-তিনবার মুখে পুড়েই বলতে খাওয়া শেষ। আ’ম ফুল। তোমাকে আমি চিনিনা? সারাদিন এতো এতো কাজের ভার থাকে মাথায়। ঠিকভাবে না খেলে হয়?’

তুহিন হাসল। একদম মায়ের মতো শাসন করে মাহমুদা ওকে। ওর যে মা নেই তা বেমালুম ভুলে যায় ও। বিছানায় গিয়ে একদম বাচ্চা ছেলের মতো আসাম করে বসেল তুহিন। বলল, ‘দাও, খাইয়ে দাও।’

মাহমুদা পরম স্নেহে খাওয়াতে খাওয়াতে কথা শোনাচ্ছে তুহিনকে। তুহিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবা-মা দুজনেই ত্যাগ করেছেন পৃথিবীর মায়া। মা জন্মের কয়েকমাসের মাথাতেই মারা গেছে। আর বাবা গত হয়েছেন চার বছর হলো। ছোটবেলা থেকে মাহমুদার কাছ থেকেই মায়ের স্নেহটুকু পায় তুহিন। ওনাকে এখন মায়ের মতোই ভাবে। অদ্ভুত মায়া জন্মে গেছে এই মহিলার ওপর ওর।
হঠাৎই ফোন বেজে উঠল তুহিনের। তুহিন না তাকিয়ে বুঝে ফেলল কলটা ইরারই। ও ভেবেছিল খেয়েদেয়, রিল্যাক্স হয়ে কল করবে ইরাকে। কিন্তু ইরা নিজেই ওকে কল করে বসল। অথচ বিকেলেই ঝাঁঝ নিয়ে বলছিল, সামনে পেলেই নাকি খু-ন করবে। মাহমুদার দিকে একপলক তাকিয়ে; কলটা রিসিভ করল তুহিন। অপর পাশ থেকে একরাশ বিরক্তিমাখা কন্ঠে ইরা বলল, ‘সমস্যা কী তোমার? বিকেলবেলা আমি রাগ করলাম। কল কাটলাম। অথচ তুমি একটাবারও কল ব্যাক করার প্রয়োজন মনে করলেনা? মানছি নতুন কেইস নিয়ে হয়তো ভীষণ ব্যস্ত ছিলে। তাই বলে পাঁচটা মিনিট বের করে আমাকে একটা কল করা যেতোনা তুহিন? এমন কেন তুমি?’

তুহিন খাবার চিবুতে চিবুতে শুনছিল প্রিয়তমার অভিযোগ। ইরা থামতেই তুহিন সময় নিয়ে মুখের খাবারটা শেষ করল। একটু পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘একটু আগেই ফিরলাম। অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে আজ। কেইসটা বেশ জটিল বুঝলে? না জানি আর কতকিছু করতে হয়।’

তুহিনের কন্ঠে ক্লান্তি স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে যে অনেক পরিশ্রম গেছে আজ। ইরা নিভল। একটু চুপ থেকে নরম গলায় বলল, ‘খেয়েছো?’

তুহিন একপলক মাহমুদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ, খালা খাইয়ে দিচ্ছে।’

‘ খুব ক্লান্ত তাইনা?’

‘ কিছুটা। কিন্তু আরেকটু কাজ আছে। কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করে কালকের প্লান সাজাতে হবে।’

বলে খালার হাত থেকে আরেক লোকমা মুখে নিল তুহিন। ইরা ভাবল, এখন দুজন কথা বলতে শুরু করলে অনেক রাত হয়ে যাবে। এরপর আবার কাজ করতে বসলে ঘুমাবে কখন ছেলেটা? তাই বলল, ‘আচ্ছা তুমি খাও। আর বেশি রাত জেগোনা। আমি রাখছি। কাল কথা হবে।’

‘ না, আমি খেয়ে কল করছি তোমাকে।’

‘ না, তার আর দরকার নেই। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। বাই।’

তুহিন হাসল। আস্তে করে বলল, ‘ বাই।’

ও জানে ইরার ঘুম পাচ্ছেনা। ওর যাতে বেশি রাত জাগতে না হয় সেই কারণেই এমনটা বলল। মেয়েটার ভালোবাসা দেখে মাঝেমাঝে অবাক হয় তুহিন। কোন সম্পর্কে এতোটা কম্রোমাইজ, এডজাস্টমেন্ট খুব কম মানুষই করে। এতো ভালোবাসা পাওনা ওর?
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখতেই মাহমুদা তুহিনের মুখে খাবার দিতে দিতে বলল, ‘বলি কী, এবার মেয়েটাকে বিয়ে করেই নিয়ে এসো। সময়ও দিতে পারবে আর আমার ঘাড় থেকে তোমাকে সামলানোর চাপটাও কমবে।’

তুহিন ঠোঁট চেপে হাসল। কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। মাহমুদা বলল, ‘থাক আর লজ্জা পেতে হবেনা। যেটা বলছি, সেটা করে ফেলো দেখি বাপু।’

তুহিন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘হাতের কেইসটা সলভ করি, এরপর দেখা যাবে। তুমি খাওয়াও।’

তুহিনকে খাইয়ে দিয়ে চলে গেল মাহমুদা। কিছুক্ষণ পর এসে ধোয়া ওঠা গরম কফির মগ রেখে গেল। যাওয়ার সময় রাত না জাগার উপদেশ দিতে ভুলল না। কফির মগটা হাতে নিয়ে, ল্যাপটপ খুলে বিছানায় বসল তুহিন। কেইসের ডিটেইলস এ চোখ বুলাতে শুরু করল।
এরমধ্যেই আবার কল এলো। কলটা তমালের। তুহিন রিসিভ করতেই সালাম দিল তমাল। সালামের জবাব দিয়ে তুহিন বলল, ‘ফরেন্সিক থেকে রিপোর্ট চলে এসেছে?’

তমাল রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘জি স্যার। ভিক্টিমের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আমাদের রেকর্ডে আছে। উনি আন্ডারওয়ার্ল্ডেরই একজন স্যার। ডার্ক নাইট গ্রুপ। কিন্তু সেই একই কাহিনী। কী করে, কোন দলে করে সবাই জানে কিন্তু _’

তমালের কথা শেষ হওয়ার আগেই তুহিন বলল, ‘কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু সাজ্জাদ তো ব্লাকহোল গ্রুপের ছিল তাইনা?’

‘ জি স্যার। আমিও অবাক হয়েছি। সবাই বেশ অবাক। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা।’

অবাক হল তুহিনও। কারণ গোটা ডিটেইলস নিয়ে আরেকবার ভাবার পর ও নাইটি পার্সেন্ট শিওর ছিল যে সুজনও ব্লাক হোলেরই কেউ হবে। লজিকটাও সিম্পল ছিল। গত ছ’টা খুনের চারটা খুনই হয়েছে ব্লাকহোল গ্রুপ থেকে। আর সাজ্জাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যখন পরবর্তী খুনটা করেছে। তাহলে নিশ্চয়ই সেটা ব্লাক হোল গ্রুপেরই কেউ হবে। অন্যকোন গ্রুপের কারো ঠিকানা সাজ্জাদের কাছে চাইবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্ট ওর পুরো ভাবনাটাই ঘুরিয়ে দিল। প্রায় বুঝে ফেলা কেইসটা আবার অন্যদিকে মোড় নিলো। এ কেমন জটিলতা? তমাল ‘স্যার’ বলতেই ধ্যান ভাঙল তুহিনের। তমালকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই তিনতলা বিল্ডিং এর মালিককে ফোনে পেলে?’

‘ না স্যার।’

তুহিন বিরক্ত হল। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, বু-লে-টটার রিপোর্ট?’

‘আগের খুনের বু-লে-টগুলোও সেইম স্যার।’

কিছুটা স্বস্তি পেল তুহিন। যাক এই দিকটা অন্তত ঠিক আছে। কল কাটল তুহিন। আরও একবার সমস্ত ইনফরমেশন ঘেঁটে দেখল। কেইসটা জটিল। একটা পয়েন্ট ও মিস করা যাবেনা। কোথায় কোন ক্লু লুকিয়ে আছে কেউ জানেনা। কিন্তু তুহিনের মনে এখন অন্য প্রশ্ন জাগছে। মোট সাতটা খু-ন। তার মধ্যে একটা ডার্ক নাইট গ্রুপ থেকে, চারটা ব্লাক হোল গ্রুপ থেকে আর বাকি দুটো খু-ন হয়েছে দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপ থেকে। এই তিনটে গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের খবর জানা তুহিনের। কিন্তু এদের খু-নগুলো কে করছে? একই লোক? নাকি একাধিক লোক? এদের মধ্যেই কেউ? নাকি বাইরের কেউ? যদি এদের মধ্যের কেউ হয় তাহলে আরেকটা প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। কেন? নিজেরই দলের লোককে কেউ কেন মা-র-বে? এতো এতো প্রশ্ন কিন্তু একটা প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই তুহিনের। না কোন ক্লু আছে।
দুহাতে মুখ চেপে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল তুহিন। ওর হাতে সময় নেই। ওর বিশ্বাস এই হত্যালীলা এখনো শেষ হয়নি। আরও মৃত্যু এখনো বাকি। তার আগেই কিছু করতে হবে। প্রায় পাঁচমিনিটের মতো চিন্তা করল তুহিন। হঠাৎই কিছু খেলে গেল ওর মস্তিষ্কে। আরো একবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভালোভাবে চোখ বুলালো। ফোনটা তুলে দ্রুত একটা মেসেজ পাঠালো তমালকে। রিপ্লেটা আসতেও বেশি সময় লাগল না।
তুহিন আনমনেই ভাবল, তুমি যতই চালাক হও, আমিও কম নই। তুমি জাত অপরাধি হলে আমি জাত ইনভেস্টিগেটর। তুমি যেই হও, খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে আমাদের।

ডিটেইলস চেক করে আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছে তুহিন। সবগুলো খু-ন আলাদা আলাদা জায়গায় হলেও তিনটে খু-ন হয়েছে এক এলাকাতেই। শুধু তাই নয়, এই হ-ত্যালীলা শুরুও সেখানেই। গুলশান। তুহিনের মন বলছে এই খু-নের শেকড় গুলশানেই। আর এই রহস্যের সমাধান করতে হলে ওকে শেকড়েই পৌঁছাতে হবে। এই কাহিনী শেষ করতে হলে ওকে সেখানেই যেতে হবে যেখানে কাহিনী শুরু হয়েছিল। গুলশান!

#চলবে…

[ পরীক্ষা এবং ব্যস্ততার কারণে আজ একটাই পর্ব দিলাম। কাল থেকে বেশি করে পাবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here