অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১৬.

0
3

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১৬.

ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল রুদ্র। তীব্র আলোর ছটা লাগতেই সাথেসাথে চোখ বুঝে ফেলল। মাথাটা ঝিম ধরে উঠল হঠাৎ। গা ছেড়ে কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই পড়ে রইল। একটু ধাতস্থ হতেই পিটপিট করে চোখ খুলল রুদ্র। প্রথমে তাকাতে খানিকটা কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। না, আলোর মাত্রা তীব্র নয়, স্বাভাবিক। দীর্ঘ সময় পর চোখ খোলার কারণেই এমনটা হয়েছে। রুদ্র আস্তে করে উঠে বসল। অলস দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল ঘরটা অপরিচিত।
অফ-হোয়াইট পেইন্ট করা ধসা দেয়াল। সারাঘরে তেমন কোন আসবাবপত্র নেই। একটা শক্ত বিছানা, যেটাতে শুয়ে ছিল রুদ্র। তার ঠিক পাশে একটা টি-টেবিল আর পশ্চিম পাশে একটা আলমারি। এটাচড বাথরুমও আছে। কয়েক সেকেন্ডেই ব্যপারটা বুঝে ফেলল রুদ্র। আনমনেই হাসল। লম্বা একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল। নির্বিকার চলনে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ভালোভাবে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুম ভাবটা কাটিয়ে নিল। বেসিনের আয়নায় গভীরভাবে কিছুক্ষণ দেখল নিজের মুখের আদল। ওর গায়ে পাতলা কালো একটা টিশার্ট। টিশার্টটা ওরই। কিন্তু রাতে রুদ্র খালি গায়ে শুয়েছিল। ভদ্র কি-ড-ন্যা-পার! ওয়াশরুমে টাওয়েল রাখাই ছিল। ওটা দিয়ে মুখটা ভালোভাবে মুছে বেরিয়ে এলো। ঘরের দরজাটার দিকে একবার তাকিয়ে বসল বিছানায়। অভিজ্ঞ চোখে চারপাশটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল রুদ্র। বের হওয়ার দরজা একটাই। এবং সেটা বাইরে দিয়ে আটকানো। এমনকি জানালাটা পর্যন্ত লোহার গ্রিলের, ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। বেরোনোর কোন উপায় নেই। বেরোতে চায়ও না ও।
বিছানার পাশে ওর জুতো জোড়া রাখা আছে। দেখে আবার হাসল রুদ্র। জুতো পরতে পরতে একই ভাবনা মাথায় এলো ওর। ভদ্র কি-ড-ন্যা-পার। কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ। কিন্তু বেশি অপেক্ষা করতে পছন্দ করেনা রুদ্র। তাই আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না। উঠে গেল দরজার কাছে। হালকা করে টোকা দিয়ে বলল, ‘পাহারায় থাকা বৎসগণ? জেগে আছো?’

ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলোনা। রুদ্র আবার ধাক্কা দেওয়ার আগেই দরজা খুলে গেল। সঙ্গেসঙ্গেই দুজন লোক ব-ন্দু-ক তাক করে দাঁড়াল। রুদ্র হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল দুজনের দিকে। অলস ভঙ্গিতে তুলে দিল দুই হাত। বলল, ‘ক’টা বাজে?’

‘ দুপুর দুটো। বাঁ দিকে চলো।’

গম্ভীর কন্ঠে বলল প্রহরী। রুদ্র একটা কথাও না বলে চুপচাপ বাঁ দিকে হাঁটা দিল। ওর দিকে বন্দুক তাক করে পেছন পেছন এলো দুজনেই। দুজনেই চমকেছে। ওরা ভেবেছিল রুদ্র ঝামেলা করবে; কিন্তু এতো সহজে ওদের কথা শুনবে সেটা ভাবেনি। তবে যে শুনেছিল এই ছেলে খুবই ভয়ানক। সব বাড়িয়ে বলা হয়েছিল নাকি? করিডর পেরিয়ে সিঁড়ি দেখতে পেল রুদ্র। প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইল সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে কি-না। মাথা নেড়ে সম্মতি দিল দুজন। সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে রুদ্রকে একটা ঘরে নিয়ে গেল ওরা।
রুদ্র একবার ভালোভাবে চোখ বুলালো রুমটায়। মোট ন-জন ব-ন্দু-ক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে একটা টেবিল। সেখানে বেশ আয়েশ করে বসে বসে খাবার খাচ্ছে ‘ব্লাক হোল’ গ্রুপের লিডার করিম তাজওয়ার। গায়ে একটা কালো পাঞ্জাবী। লম্বায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির মতো হবে। পেছন দিকে আঁচড়ানো চুলগুলোতে বেশ খানিকটা পাক ধরেছে। মুখে বার্ধক্যের ছাপও পড়েছে খানিকটা। তার দু পাশে দু’জন বসে আছে। দুজনেরই কালো শার্ট গায়ে। পার্থক্য হচ্ছে একজন ফর্সা, একজন কালো। কালো লোকটার মাথায় আবার বিশাল টাক। রুদ্রর ডান দিকে থাকা লোকটা বলল, ‘বস, নিয়ে এসছি।’

সবে আপেলে কামড় বসাতে নিচ্ছিল করিম। আপেলটা মুখের কাছ থেকে নামিয়ে তাকাল দরজার দিকে। রুদ্রকে দেখে কৌতুক হাসল। আপেলে কামড় বসিয়ে চিবুতে চিবুতে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘রুদ্র আমের! এসো, বসো।’

রুদ্র খুব স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। রুমের ন-জন মানুষের হাতের ন’টা একনলা ব-ন্দু-ক এখন রুদ্রর দিকে তাক করা। বিনা সংকোচে করিমের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো রুদ্র। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল করিমের ধুসর রঙের চোখদুটোর দিকে। ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুঁটিয়ে বলল, ‘আমাকে ডাকলেই পারতেন। অযথা কষ্ট করে, আমার জ্ঞানহীন দেহটাকে এই জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে আসতে, আপনার খোকাদের ভীষণ কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই?’

এরপর চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘কী খোকারা? কষ্ট হয়েছে খুব?’

হাসল করিম। মাথাটা সামান্য দুলিয়ে বলল, ‘তোমাকে যখন অজ্ঞান অবস্থায় প্রথম দেখলাম; অবাক হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল ভুল লোক তুলে নিয়ে এসছে ওরা। তুমি আর যাই হও ক্রি-মি-নাল হতে পারোনা। তোমার চেহারা তোমার পেশাকে সমর্থন করেনা। রাশেদ আমের এক উজ্জ্বল রত্নকে জন্ম দিয়েছে। মানতেই হচ্ছে। এদিক দিয়ে তার কাছে আমি পরাজিত।’

‘ আপনি সবদিক দিয়েই তার কাছে পরাজিত।’ স্থির কন্ঠে বলল রুদ্র। করিম তাজওয়ারের সামনে রাখা ছিল প্লেটভর্তি স্যান্ডউইচ ছিল। অনুমতির কোন তোয়াক্কা না করে এক স্যান্ডউইচ হাতে নিল রুদ্র। আয়েশি ভঙ্গিতে কামড় বসাল তাতে।

করিম আবার হাসল। রুদ্রর কথায় কর্ণপাত না করে বলল, ‘তবে আমি ভাবতাম যে তোমাকে নিয়ে সবসময় বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলা হয় । কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় শত্রু গুহে বন্দি দেখলে। তোমার দিকে এখন মোট এগারোজন ব-ন্দু-ক তাক করে আছে। কিন্তু তোমার চোখে-মুখে বিচলিত হওয়ার কোন লক্ষণই নেই। বরং নিশ্চিন্তে খাবার খাচ্ছো। তোমার সাহস নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার আর। তবে তোমার বুদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।’

কিছুক্ষণ পরে আর থাকবেনা। কথাটা আপন মনেই ভাবল রুদ্র। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। স্যান্ডউইচ চিবুতে চিবুতে শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল করিম তাজওয়ারের ধুসর চোখদুটোর দিকে। করিম খানিকটা ঝুঁকে বলল, ‘টুম্পার কথা জিজ্ঞেস করলে না?’

রুদ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল করিমের দিকে। টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল ছোট্ট ছু-রিটা। করিমের ধূসর চোখদুটো কেঁপে উঠল। সকল প্রহরীরা সতর্ক হয়ে ভালোভাবে তাক করল ব-ন্দু-ক। কিন্তু রুদ্র সেটা ব্যবহার করে স্যান্ডউইচে সস্ মাখাতে শুরু করল। খুবই অদ্ভুত ভঙ্গিতে। অনায়াসে বলল, ‘রাত কাটানোর পরে আমি কখনই কোন মেয়েকে মনে রাখিনা।’

ধাতস্থ হল করিম। বলল, ‘ বুঝলাম। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছেনা তোমাকে এখানে কীকরে নিয়ে এলাম?’

রুদ্র সময় নিয়ে স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষ করল। এরমাঝে আশেপাশে কয়েকবার তাকিয়ে পরিবেশ বুঝছিল করিম। খাওয়া শেষে টেবিল থেকে একটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছলো রুদ্র। পাশ থেকে ফ্লাক্সটা হাতে নিল। টেবিল থেকে খালি একটা মগ তুলে সেটাতে কফি ঢালল।
করিম গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওকে। রুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটা ওরই। নিজের বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে মানুষ যেভাবে খাবার খায়। নির্বিকার থাকে। সেভাবেই সবটা করছে সে। রুদ্র কফির মগে প্রথম চুমুক দিয়ে অবশেষে বলল, ‘যেটা আমি খুব ভালো করেই জানি, সেটা জানতে চাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠেনা তাজওয়ার। আপনার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে এখানে তুলে নিয়ে এসছেন। কিন্তু আমি যদি বলি আমি সেচ্ছায় আপনার এখানে এসেছি। বিশ্বাস করবেন?’

করিম তাজওয়ারের ভ্রু জোড়া এবার খানিকটা কুঁচকে গেল। চোখে-মুখে সেই হাসিটা আর নেই। রুদ্র মগে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বলল, ‘আপনারা খুবই ভালোভাবে জানতেন রাশেদ আমেরের একমাত্র ছেলে রুদ্র আমের চট্টগ্রাম আসছে। কেনো? সেটাও অনুমান করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই? কিন্তু যেহুতু সে একাই আসছে সেহেতু আপনাদের জন্যে এটা ছিল বিশাল বড় সুযোগ। এতোগুলো দিন যাকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্যে ছটফট করছেন; তাকে এভাবে পাওয়াটা ঠিক মেঘ না চাইতেই জলের মতো, তাইনা?’

করিমের চোখদুটো এবার কৌতুক হারিয়েছে। এখন সেখানে আছে কেবল নিষ্ঠুরতা আর হিংসা। সে যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘বুঝেছিলে তাহলে?’

রুদ্র করিমের কথার জবাব না দিয়ে নিজের কথা চালিয়ে গেল। ‘আপনার ধারণা ছিল নারীর নেশা প্রবল নেশা। সে নেশা ভালো ভালো বুদ্ধিমান লোককেও বোকা বানিয়ে দেয়। আপনার ধারণা যে একেবারেই মিথ্যে ছিল তা কিন্তু না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এ নিয়মটা খাটেনা তাজওয়ার। সোলার সিস্টেমে কী বলা হয় জানেন? রুদ্র চোখ দেখে শত্রু চিনতে পারে। আর এইজন্যই আপনার পাঠানো চারজনের তিনজনই নির্মমভাবে আমার হাতে প্রা-ণ দিয়েছে। আরেকজনকে মে-রে-ছেন স্বয়ং রাশেদ আমের।’

হিংস্র, কঠোর চোখে তাকিয়ে রইল করিম রুদ্রর দিকে। পারলে নিজ দৃষ্টি দিয়ে এক্ষুনি ভস্ম করে দেবে ওকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শুধু কী তাই? গত দুইমাসে আমাকে বরবাদ করে দিয়েছো তুমি। আমার তিন তিনটে প্রজেক্ট শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দিয়েছো।’

‘ আপনার প্রজেক্টগুলো আমাদের জন্যে ভীষণ ক্ষতিকর ছিল তাজওয়ার।’

এইটুকু বলে ‘আহ’ শব্দ করে নিচে ঝুকে গেল রুদ্র। ব-ন্দু-ক ধরা হাতগুলো নড়েচড়ে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাথা তুলল রুদ্র। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ ঘর পরিষ্কার করেন না নাকি? এতো পোকামাকড় কেন? যাই হোক, আমার লাগেজটাও নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে। একটা জ্যাকেট দিনতো। শীত করছে।’

করিম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল রুদ্রর দিকে। অতঃপর ইশারা করল একজন প্রহরীকে। তার ইশারায় রুদ্রর লাগেজ থেকে কালো একটা জ্যাকেট বের করা হল। সেটা ভালোভাবে চেক করে দেওয়া হল রুদ্রকে। রুদ্র জ্যাকেটটা পরতে পরতে বলল, ‘যেটা বলছিলাম। আপনি ভেবেছিলেন সুন্দরী একটা মেয়েকে আমার বিছানায় পাঠাতে পারলেই আমাকে কাবু করে ফেলা সম্ভব। কারণ আপনি জানতেন আমার বেডে প্রায়ই সুন্দরী মেয়েদের আনাগোনা চলে। কিন্তু আপনি এটা জানেন না যে আজ পর্যন্ত কোন নারী রুদ্র আমেরকে কাবু করতে পারেনি। তার শরীরের স্পর্শ অনেকে পেয়েছে, কিন্তু হৃদয়ের স্পর্শ কেউ পায়নি। আর না ভবিষ্যতে পাবে। যেখানে মুগ্ধতা বলে শব্দ আমার জীবনে নেই সেখানে বোকা বনার প্রশ্নই উঠছে না। কেউ কোনদিন রুদ্রর প্রিয় হয়ে উঠতে পারবেনা। আমি শুরুতেই জানতাম টুম্পার উদ্দেশ্য কী। এটাও জানতাম ও আপনারই পাঠানো। সত্যি বলতে আমি ওর জন্যেই বারে গিয়েছিলাম। এবং ঐ ড্রিংকের মধ্যে যে আমাকে কয়েকঘন্টার জন্যে গভীর নিদ্রায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা ছিল, সেটাও জানতাম। জেনেশুনেই সানন্দে সেটা গ্রহন করেছি আমি।’

করিম স্তব্ধ হয়ে গেল রুদ্রর কথায়। পাশের দুজনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি জানতে?’

রুদ্রর ঠোঁটে ধূর্ত হাসি। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা রেখে খানিকটা আলসেমি ঝেড়ে বলল, ‘সবটাই জানতাম।’

করিম তাজওয়ারে ডানপাশের টাকমাথার লোকটা বলল, ‘জেনেশুনেও মৃত্যুফাঁদে পা দিলে?’

‘ দিলাম।’

‘ যদি হোটেল রুমেই অজ্ঞান অবস্থায় গু-লি করে মেরে ফেলতাম তোমাকে?’ বলল করিম তাজওয়ার।

‘ মা-র-তেন না। আমায় এতো সহজ মৃ-ত্যু দেওয়ার ইচ্ছে আপনার ঠিক নেই।’

‘ তোমার বুদ্ধি নিয়েও আমার সন্দেহটা দূর হয়ে গেছে রুদ্র। সত্যিই রাশেদের জন্ম দেওয়া অমূল্য রত্ন তুমি। কিন্তু অতিরিক্ত কোনকিছুই ভালো না।’

করিম চোখের ইশারা করতেই সঙ্গে সঙ্গে দুজন লোক এসে রুদ্রর দু-হাত ধরে পেছন মোড়া করে বেঁধে ফেলল। খুব শক্ত করে। বাঁধা দিলোনা রুদ্র। এমনকি নড়লোও না। করিম ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তোমার অতিরিক্ত সাহসের কারণেই এবার ম-রতে হচ্ছে তোমাকে। আর ঠিক ধরেছো তুমি। তোমাকে সহজ মৃত্যু দেবোনা আমি। ঠিক যেভাবে আমার গুপ্তচরগুলোকে মে-রে-ছিলে, সেরকমই নির্মম মৃত্যু হবে তোমার। প্রথমে তোমার হাত-পায়ের রগগুলো কা/টা হবে। এরপর তোমার মুখ আর নাক বন্ধ করে তোমার শ্বাস আটকে দেওয়া হবে। এরপর?’ হিংস্র পশুর মতো হয়ে উঠলো করিমের মুখ। ফ্যাশফ্যাশে হয়ে উঠল কন্ঠস্বর। ‘এরপর জ্যান্ত পোড়ানো হবে তোমাকে। রাত ন’টায় সাজ্জাদ আসবে। সেই করবে কাজটা।’

রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘দেখতে পাচ্ছি ভীষণই ভয়ানক মৃ-ত্যু হতে চলেছে আমার।’

সপ্রশংস হাসি হাসল করিম। বলল, ‘আরেকটা জানিস আবিষ্কার করলাম।’

রুদ্র নিরাসক্ত কন্ঠে বলল, ‘সেটা কী?’

‘ভয় তুমি পাওনি রুদ্র। তুমি চিনতেনা আমার জঙ্গলের এই ডেরাটা। তাই আমাদের ফাঁদে ইচ্ছাকৃতভাবে পা দিয়েছো, এখানে পৌঁছানোর জন্যে। ঐ পেনড্রাইভটা হাতাতেই এখানে এসেছো রুদ্র। তাইনা?’

‘ আপনিও ভীষণ বুদ্ধিমান তাজওয়ার।’ হেসে বলল রুদ্র। করিম তাজওয়ারও হাসলেন। হিংস্র হাসি।

*

রাত সাড়ে আটটা বাজে। একটা চেয়ারে দু-হাত পেছনমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে রুদ্র। ঘরটা ফাঁকা। একঘেয়েমি লাগছে রুদ্র। তাই বিভিন্ন ভাবনা নিয়ে এলো মাথায়। সময়কে ব্যস্ত করা প্রয়োজন।
হঠাৎ রুদ্রর মানসপটে ভেসে উঠল তেরোদিন আগের কথা। সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎই বৈঠক ঘরে ডাক আসে ওদের। জরুরি মিটিং! সময়মতো সেখানে উপস্থিত হয় দ্য সোলার সিস্টেম গ্রুপের অন্যতম পাঁচ সদস্য। রাশেদ আমের, রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর আমের এবং ইকবাল। প্রথমেই কোন কথা হয়না। সিগারেটে গভীর টান দিতে দিতে ভাবনায় মগ্ন থাকে রাশেদ আমের। বাকিরাও চুপচাপ অপেক্ষা করে তার বক্তব্য শুরু করার। অপেক্ষার অবসান ঘটে বেশ লম্বা সময় পর। পরপর তিনটা সিগারেট শেষ করে; চতুর্থ সিগারেটটা জ্বালিয়ে রাশেদ আমের বললেন, ‘গত পরশু ভারত থেকে চোরাই পথে একটা পেনড্রাইভ আসার কথা ছিল আমের মিলসে। কিন্তু সেটা এখনো এসে পৌঁছয়নি। মাঝরাস্তাতেই আচমকা আ-ক্র-মণ করেছে কোন এক দল। নিয়ে গেছে পেনড্রাইভটা। সঙ্গে কোটি টাকার ডিল। সোলার সিস্টেমের জন্যে এটা কতবড় ক্ষতির বিষয় সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?’

জাফর বলল, ‘পারছি ভাইজান! ভয়ানক লস হয়ে গেছে আমাদের। আফ্রিকার সবচেয়ে লেটেস্ট কালেকশনটাই আসছিল আমাদের হাতে। অলরেডি কিছু এডভান্স করে ফেলেছি। তারচেয়েও বড় কথা এই ডিলটা দেশে আমাদের আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুঁটি আরও শক্ত করতো।’

রাশেদ গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘ঠিক সেভাবেই ডিলটা না হওয়া আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমাদের খুঁটি নড়বড়ে করে দিতেও বেশি সময় নেবেনা। আমাদের স্পাই ইনফরমেশন অনুযায়ী পেনড্রাইভটা চুরি করেছে ব্লাক হোল। এবং সেটা নিয়ে প্রথমে ঢাকা আসে। এবং ঢাকা থেকে ডিরেক্ট চট্টগ্রাম নিয়ে যায়।’

জাফর পুনরায় বলল, ‘কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে। পেনড্রাইভটা কবে আসছে, কোন পথ দিয়ে আসছে, কখন আসছে এগুলো সোলার সিস্টেমের টপ সিক্রেট ছিল। অন্যকারো জানা কিন্তু সহজ ব্যপার নয়।’

ইকবাল দু আঙ্গুলে কপালটা চুলকে বলল, ‘হতেই পারে যে সবুজ, স্বপন, তপু কিংবা খোকনের মধ্যে কেউ একজন ফাঁস করে দিয়েছিল।’

‘সম্ভব না। এসব ইনফরমেশন ওদের সঙ্গে কোনভাবেই শেয়ার করা হতোনা।’ আপত্তি জানিয়ে বলল জাফর।

দ্বিমত পোষণ করে উচ্ছ্বাস বলল, ‘কিন্তু হতেই পারে ওরা অন্যকোন পন্থায় ইনফরমেশন চুরি করেছে। আর সেটা পাচার করে দিয়েছে ব্লাক হোলের কাছে।’

রাশেদ আমের নাকমুখ দিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন, ‘ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছে, কে ঘটিয়েছে, সেটা নিয়ে পরেও গবেষণা করা যাবে। এখন যে ক্ষতিটা হতে চলেছে সেটা কীকরে আটকানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করাটা বেশি জরুরি।’

উচ্ছ্বাস বলল, ‘তারজন্যে সোলার সিস্টেমের কাউকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। ঢুকতে হবে ব্লাক হোলের ডেরায়। ইনফরমেশন বলছে জঙ্গলের মধ্যেই আছে ওদের ডেরা। একটা বড়সর পুরনো বাংলো। সেখানে ঢুকতে হবে। পেনড্রাইভটা ওদের কবজা থেকে নিয়ে, আবার সেখান থেকে ফিরে আসতে হবে।’

কথাটা বলে টেবিলের ওপর পরে থাকা একটা ম্যাপ বের করল উচ্ছ্বাস। চট্টগ্রামের সেই বাংলোর ম্যাপ। সেটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে রেখে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় ইশারা করে বলল, ‘পুরো বাংলোর চারপাশেতো গার্ড থাকেই। এইসব জায়গাতেও গার্ড থাকার চান্সেস শতভাগ। আর তাজওয়ার নিশ্চয়ই পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে বসে থাকবেন রুদ্রকে দেওয়ার জন্যে। মাত্র একজন লোকের পক্ষে এতোজন গার্ডের চোখে ফাঁকি দিয়ে ঢোকা, পেনড্রাইভ নেওয়া, তারপর বের হওয়া এককথায় অসম্ভব। এটা করতে যাওয়া আর সু-ই-সা-ইড এটেম করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’

মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠল সবার বৈঠক ঘরটা। হতাশ কন্ঠে ইকবাল বলল, ‘তাহলে একটাই উপায় দেখতে পাচ্ছি। দলীয়ভাবে আক্রমণ।’

অসম্মতি প্রকাশ করলেন রাশেদ, ‘না, তাতে পেনড্রাইভটা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা শূণ্যে নেমে আসবে।’

‘তবে?’ জাফরের কন্ঠে উদ্বেগ।

‘আমি যাব।’ এতক্ষণ চুপ ছিল রুদ্র। সকলের কথা কানে গেলেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল না। গম্ভীরভাবে ভাবছিল কিছু একটা। ওর বলা এই দুটো শব্দ বজ্রপাতের মতোই আছড়ে পড়ল ঘরটাতে। জাফর স্তম্ভিত কন্ঠে বলল, ‘কী!’

রুদ্র পুনরাবৃত্তি করল, ‘আমি যাব চট্টগ্রাম।’

ইকবাল প্রায় উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘পাগল হয়ে গেছো তুমি?’

উচ্ছ্বাস টেবিলে দুহাত রেখে বলল, ‘ও সুস্থ ছিল কবে? চিরকাল পাগলামিই করে এসেছে। কিন্তু এবার সেসব হচ্ছেনা। ও ভুলেও একা চট্টগ্রাম যাচ্ছেনা। প্রয়োজনে আমিও যাব সাথে।’

‘কাজটা সফলভাবে করতে হলে একাই যেতে হবে আমাকে।’ জেদি কন্ঠে বলল রুদ্র।

উচ্ছ্বাস সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তুই বললেইতো সব হবেনা। এইবার কোনভাবেই তুই একা যাচ্ছিস না। সব জায়গায় তোর একরোখামি চলবেনা।’

নিজের সিদ্ধান্তে অটল রুদ্র বলল, ‘আমি যাচ্ছি। দ্যাটস্ ফাইনাল।’

একসঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন জাফর এবং ইকবাল। বাঁধা দিলেন রাশেদ আমের। হাতের সিগারেটটা সিলিংয়ের দিকে উঁচু করে ধরে বললেন, ‘ও যদি যেতে চায় ওকে যেতে দেওয়া উচিত।’

উচ্ছ্বাস, জাফর, ইকবাল তিনজনই হতবাক হল। রাশেদ আমেরের মাথাটাও কী নষ্ট হয়ে গেল! উনি জানেন উনি কী বলছেন? নিজের ছেলেকে নিশ্চিত মৃ-ত্যু-র মুখে পাঠাচ্ছেন! নিজেকে কোনমতে সামলে উচ্ছ্বাস বলল, ‘কিন্তু রাশেদ বাবা_’

‘আমি যা বলেছি, ভেবে চিন্তেই বলেছি।’ কঠোর ধ্বনিতে বললেন রাশেদ। এরপর বাকিরা আর কিছু বলতে পারল না। রাশেদ যেখানে সম্মত, সেখানে বাকিদের কিছু বলা মানে বিলাসিতা। রাশেদ রুদ্রর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে বললেন, ‘কী পরিকল্পনা তোমার?’

সোজা হয়ে বসল রুদ্র। ম্যাপটা টেনে নিল নিজের দিকে। সেটাতে কিছুক্ষণ সুক্ষ্ম দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, ‘ঐ বাংলোতে আমার ঢোকার ব্যবস্থা তাজওয়ার নিজেই করে দেবে। আর পেনড্রাইভ নিয়ে বের হওয়ার ব্যবস্থা _’ একবার চোখ বুলালো ম্যাপটাতে। ‘আমি নিজেই করব।’

হালকা আওয়াজ পেয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র।দরজায় দুজন পাহারায় আছে। সেটা দেখে হাসি পেল রুদ্রর। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় বেঁধে রেখেও করিম তাজওয়ার নিরাপদ বোধ করছেন না? এই সাহস নিয়ে একটা গ্যাং চালাচ্ছে? সাহসের সাথে বুদ্ধিরও যথেষ্ট অভাব। নয়তো একটা মেয়েকে ওর ঘরে পাঠিয়ে ওকে জব্দ করার কথা ভাবতো না। ‘কেউ কোনদিন রুদ্রর প্রিয় হতে পারবেনা’। কথাটা আপনমনেই দ্বিতীয়বার আওড়ালো রুদ্র।

এরমধ্যেই রুমে এসে উপস্থিত হলো করিম তাজওয়ার। সাথে আরও তিনজন ব-ন্দু-কধারী প্রহরী। করিম তাজওয়ার রুদ্রর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল। ধুসর চোখজোড়া রুদ্রর ওপর ফেলে বলল, ‘কেমন অনুভব করছো রুদ্র?’

‘ ভালো, এতক্ষণ বসে বসে বিশ্রাম অনেকদিন নেওয়া হয়নি। আপনার বাকি দুই সাঙ্গোপাঙ্গো কই?’

‘ ওরা শহরের দিকে গেছে। সাজ্জাদ আসছে। আর আধঘন্টা পরে তোমার মৃ-ত্যুদ-ণ্ড শুরু হবে। তৈরী আছো?’

রুদ্র চোখে হাসল। করিম নিজের পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে বলল, ‘পনেরোদিন। আজ থেকে পনেরোদিন আগে ভারত থেকে চোরাপথে এই পেইনড্রাইভটা নিয়ে আসা হচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাশেদ আমেরের কাছে পৌঁছনো। কয়েক কোটি টাকার একটা প্রজেক্টের ব্যাপার। কিন্তু পথেই ওদের ওপর হা-ম-লা করা হয়। ওদের মেরে পে-ন-ড্রাইভটা হাতিয়ে নেই আমরা। আর তুমি এটা উদ্ধার করতেই নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছো। বাবার এক কথায় মরতে চলে এলে! আরেকটা কথা মানতে হচ্ছে, তুমি যতবড় জানোয়ারই হও পিতৃপ্রেমের আদর্শ তুমি।’

রুদ্র কিছু বলল না। ওর মাথায় অন্যচিন্তা চলছে। করিম কৌতুক হেসে বলল, ‘রাশেদ আমের ভীষণ দুঃখ পাবে যখন কালকে ও তোমার ভয়ানক মৃ-ত্যু সংবাদ শুনবে। তবে চিন্তা নেই। তোমার মৃ-তদেহ আমি নিরাপদে_’

কথাটা শেষ করার আগেই তীক্ষ্ম আর্তনাদ বের হল করিমের মুখ দিয়ে। পেটে লাথি মেরেছে রুদ্র। কেউ কিছু করার আগেই পেছন থেকে হাত সামনে এনে করিমকে ঘুরিয়ে ফেলল রুদ্র। নিজের সঙ্গে চেপে ধরে একটা ছু-ড়ি ধরল ওর গলায়। ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটল যে উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। রুদ্র করিমের কানে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমার পোষা কুত্তাগুলোকে ব-ন্দু-কগুলো নামিয়ে ঘরের এক কোণে রাখতে বলো তাজওয়ার। এরপর ওদের ঘরের অন্যপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াতে বলো। নইলে তোমার গ-লা কা/টতে আমি দু’বার ভাবব না।’

করিম ভয় পেয়েছে। বিষ্ফোরিত হয়ে গেছে চোখ দুটো। প্রয়োজনে গ-লা কা/টতে রুদ্র দু সেকেন্ড নেবেনা সেটা সে জানে। সঙ্গেসঙ্গেই সবগুলোকে ইশারা করল ব-ন্দু-ক এক কোণে ফেলে রাখতে। দলনেতার আদেশ পেয়ে পাঁচজনই ব-ন্দু-ক রেখে দিল ঘরের পূর্বপাশে। এরপর দ্রুত পশ্চিমপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রুদ্র করিমের হাত থেকে কেড়ে নিল পেনড্রাইভটা। ছুড়িটা এখনো গলায় ধরা। করিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ভুল করছো রুদ্র। এভাবে বের হতে পারবেনা তুমি এখান থেকে।’

করিমের কথায় কর্ণপাত করল না রুদ্র। তার কোমরের হোলস্টার থেকে পি-স্ত-লটা বের করে তারই পেটে চেপে ধরল। অপর হাতে প্যান্টের ভেতর জুতোর সাথে আটকে রেখে দিল ছুড়িটা। করিমকে নিয়ে পাঁচজন প্রহরির দিকে তাকিয়ে থেকেই রুম থেকে বের হল। এক হাতে করিমকে ধরে রেখেই ওপর হাতে দরজাটা বন্ধ করে ফেলল দ্রুত। এক হাতে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবেনা ও করিমকে। কিন্তু দেরী হয়ে গেল। ঝাড়া দিতেই রুদ্রর হাত ফসকে গেল করিম। দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করল কিন্তু ধরে ফেলল রুদ্র। করিম রুদ্রকে একটা ঘুষি মারতে গেলে রুদ্র সাথেসাথেই পি-স্ত-লের বাট দিয়ে প্রচন্ড জোরে আ-ঘা-ত করল করিমের মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল করিম। রুদ্রর ইচ্ছে করছিল এর মাথার খু-লিটা উড়িয়ে রেখে যেতে। কিন্তু রাশেদের কঠোর নির্দেশ ছিল, বাধ্য না হলে কাউকে প্রাণে মারা যাবেনা। হাতে সময় খুব কম। দরজা প্রচন্ড জোরে জোরে ধাক্কাচ্ছে ঐ পাঁচজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙ্গে ফেলবে। সবাই এসে পড়বে। জ্যাকেটটা খুলে কোমরে বেঁধে নিল রুদ্র। সোজা ডান দিকে ছুটলো। এখানে আসার আগে এই জায়গাটার ম্যাপ একপ্রকার মুখস্থ করে এসেছে ও। এদিক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলেই বের হওয়ার একটা দরজা আছে। দরজা খুললেই একটা গ্যারেজ। তার সাথেই দ্বিতীয় গেইট। পুলিশ অ‍্যাটাক হলে পালানোর জন্যেই তৈরী করা হয়েছে ঐ গোপন পথ। হিসেবমতো ওখানে চারজনের বেশি গার্ড থাকবেনা। ওখান দিয়েই পালাতে হবে ওকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে দরজার কাছে যেতেই থমকে গেল রুদ্র। দরজায় দু’জন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। দেখলেই গু-লি ছুড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রুদ্র অপেক্ষা করলোনা। খরচ করে ফেলল দুটো বু-লে-ট। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দুজন প্রহরী। রুদ্র দরজা খুলে বাঁ দিকে গেল। ততক্ষণে সবার কানে পৌঁছে গেছে খবরটা। এখন শুধু আসার অপেক্ষা। কয়েকজন ছাঁদ থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। রুদ্রর বাঁ হাত কিছুটা মাংস থেতলে দিয়ে বেরিয়ে গেল একটা বু-লে-ট। বাকিগুলো মিস হল ওর অসাধারণ কৌশলের কারণে। গুলি লাগা সত্ত্বেও থামলোনা রুদ্র। দ্বিতীয় গেইটের কাছেও একই কাজ করল। খরচ করল আরও দুটো বু-লে-ট। বেরিয়ে এলো চট্টগ্রামের জঙ্গলের মধ্যকার এই নিরব বাংলোটার ভেতর থেকে।

আশেপাশে কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। রুদ্র ভাবল, এখন কোন একটা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে হাতটা বেঁধে নিতে হবে। ক্ষত গভীর না। কিন্তু রক্ত ঝড়ছে। জ্বলে যাচ্ছে জায়গাটা। কিন্তু বাঁধবে কী দিয়ে? বেশি চিন্তা না করে সজোরে দৌড়ে জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল রুদ্র। ওরাও এক্ষুনি আসবে পেছন পেছন। খুঁজবে রুদ্রকে। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়নোর পর একটা গাছ ধরে দাঁড়াল রুদ্র। পেছন ফিরে তাকালো। না, এখনো এদিকে আসছেনা। সৌভাগ্যবশত তখন খাওয়ার টেবিলেই ছু-ড়িটা সরিয়ে ফেলেছিল রুদ্র। ছু-ড়ি তোলা, স্যান্ডউইচে সস লাগানো, কফি খাওয়া ইচ্ছে করেই এতোগুলো মুভমেন্ট করছিল রুদ্র। এরমধ্যেই কায়দা করে ছুরিটা নিজের কোলে ফেলেছিল। খুব বেগ পেতে হয়েছিল কাজটা করতে। যে কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আর পোকার নাম করে তখন ঝুঁকেছিল পেছনে প্যান্টের সাথে ছুড়িটা আটকে রাখার জন্যে। ওকে বেঁধে রেখে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁধন খুলে ফেলেছিল রুদ্র। এটা রুদ্রর খুব অস্বাভাবিক প্রতিভা। ওর পরিকল্পনা ছিল করিম এলেই তার গলায় ছু-ড়ি ধরে আগে ঐ প্রেইনড্রাইভের কাছে যাবে। তারপর ওটা নিয়ে পালাবে। কাজটা অসম্ভব রিস্কি ছিল। কিন্তু করিম বোকামি করে নিজেই পেইনড্রাইভটা নিয়ে চলে এলো। ভেবেছিল নিরস্ত্র অবস্থায় এতোজন ব-ন্দু-কধারীর সামনে রুদ্র কিছুই করতে পারবেনা। তার এই বোকামির জন্যেই কাজ সেড়ে এতো সহজে বেরিয়ে আসতে পেরেছে রুদ্র।

এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা বিপদজ্জনক। এগোতে হবে। জায়গাটা ছেড়ে এগোতেই নিচ্ছিল। হঠাৎ উষ্ণ হাতের দৃঢ় টান অনুভব করল রুদ্র। সেই টান গাছের আড়ালে নিয়ে এলো ওকে। রুদ্র কিছু বলার আগেই দুটো হাত ঠেলে গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে ধরল ওকে। নরম এক হাত মুখ চেপে ধরল রুদ্র। মিষ্টি চাপা গলায় বলল, ‘শশ্, নড়বেন না প্লিজ। ওরা দেখে ফেলবে আমাকে।’

নারী কন্ঠ শুনে রুদ্র অবাক হল। বিস্মিত চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আবছা অন্ধকারে একটা নারী অবয়ব দেখতে পাচ্ছে ও। মেয়েটা ওর কাঁধ পর্যন্ত। একহাতে রুদ্রর ডান হাত ধরে, আরেক হাতে চেপে ধরেছে রুদ্রর মুখ। আবছা যেটুকু আলো আসছে; মেয়েটার ঘন পাপড়িযুক্ত গভীর চোখজোড়া দৃশ্যমান হচ্ছে তাতে। সে চোখে একরাশ ভয়। রুদ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সেই গভীর চোখে। একচুলও নড়ছেনা। মেয়েটা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখল একবার। কয়েকটা ছেলে ছুটে চলে গেল সোজা। ওদের মতে এদিকে খোঁজা শেষ হয়তো। স্বস্তির শ্বাস ফেলল মেয়েটা। হাত নামিয়ে নিল রুদ্রর মুখ থেকে। ‘এবার চলুন’ বলে মেয়েটা ওখান থেকে বেরোতে নিলে এবার রুদ্র বাঁধা দিল। কোমর চেপে ধরল মেয়েটার। একটানে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। মেয়েটা হতবাক চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর ভ্রু দুটো এখনো কোঁচকানো। চোখদুটো স্থির। মেয়েটা ফিসফিসিয়েই বলল, ‘আপনি ছাড়ুন আমাকে। ভয় পাবেন না। বিপদ কেটে গেছে। ওরা এখনই এদিকে আসবেনা বোধ হয়।’

রুদ্র যেন শুনলোই না মেয়েটার কথা। এক ঝটকায় ঘুরিয়ে চেপে ধরল গাছের সাথে। অবস্থানের পরিবর্তন হল দুজনের। রুদ্র শক্ত গলায় বলল, ‘তোমার বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু আমার না।’

বলতে বলতে তুলে ধরল নিজের হাতের পি-স্ত-লটা। সেটা দেখে বিস্ফোরিত হয়ে উঠল মেয়েটার সুন্দর গভীর চোখ। চিৎকার করতে নিলেই এক হাতে শক্ত করে মেয়েটারমুখ চেপে ধরল রুদ্র। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘চুপ! একটা আওয়াজ করলে এখানেই মেরে ফেলব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।’

গুটিয়ে গেল মেয়েটা। রুদ্র মেয়েটার মুখ থেকে হাত নামিয়ে গাছের আড়াল দিয়ে পি-স্ত-ল তাক করল কিছুটা দূরে আসা লোকগুলোর দিকে । মেয়েটা ভয়ে জমে আছে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রর মুখ‍ের দিকে। একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওর। বিড়বিড় করে বলছে, ‘কতগুলো গুন্ডার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেকটা গুন্ডার হাতে এসে পড়লাম অবশেষে? সকাল সকাল কার মুখ দেখেছিলাম কে জানে? একটার পর একটা ঝামেলা। আজ অথবা ম-র-ণ নিশ্চিত। আমার আর ধুমকেতু দেখা হলোনা।’

রুদ্র শুনতে পেল কথাগুলো। এরমধ্যেই কান ফাটা গু-লির আওয়াজ এলো। মেয়েটা ভয় পেয়ে জাপটে ধরল রুদ্রকে। রুদ্র নিজের অজান্তেই একহাতে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। আরও দুটো গু-লির শব্দ। এরপর সব শান্ত হয়ে গেল।
কিন্তু মেয়েটার ভয় কমেনি বোধ হয়। গায়ের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রুদ্রকে। রুদ্র পি-স্ত-লটা প্যান্টে গুজে রাখতে রাখতে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘বিপদ কেটে গেছে। এবার ছাড়তে পারো আমাকে।’

মেয়েটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল রুদ্রকে। চোখেমুখে তীব্র লজ্জা আর সংকোচ। কিন্তু রুদ্রর হাত এখনো খামচে ধরে রেখেছে। চারশাশে একবার অসহায়, ভীত দৃষ্টি বুলালো মেয়েটা। রুদ্র মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল। অসহায় গলায় বলল, ‘ওরা কী আমাকে মে-রে ফেলতে এসেছিল?’

বিরক্তি নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল রুদ্র। একে হাতের অসহ্য যন্ত্রণা। তারওপর এই মেয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘না, আমাকে মা-রতে এসছিল। একটু হলে আমার ওপরে যাওয়ার টিকেট কেটে ফেলছিলে তুমি।’

মেয়েটা অবাক হল। ওর এখানে কী দোষ? মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘আমি কী করলাম? আমি বলেছি আপনাকে মারতে আসতে?’

রুদ্র ধমক দিয়ে বলল, ‘ চুপ! রাতের বেলায় এই জঙ্গলের মধ্যে কী ভুতেদের সাথে আড্ডা দিতে এসছিলে?’

মেয়েটা সঙ্গেসঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল। ভয়ে ভয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ঐ ছেলেগুলো আমাকে তুলে নিয়ে এসছিলো এখানে। আরেকটু হলে_’

এতটুকু বলেই চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। বাক্য শষ করার মতো শব্দ পেলোনা বোধ হয়। রুদ্র মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকালো এবার। আবছা অন্ধকারে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে দেখল কুর্তিটার হাতা এক পাশ ছেঁড়া। আর বিশেষ কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা অন্ধকারের জন্যে। কিন্তু মাঘের এই শীতে প্রচন্ড কাঁপছে মেয়েটা। রুদ্র বুঝতে পারল ব্যাপারটা। কোমর থেকে জ্যাকেটটা খুলে এগিয়ে দিল মেয়েটার দিকে।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী নাম তোমার?’

মেয়েটা জ্যাকেটটা নিয়ে কম্পিত গলায় বলল, ‘প্রিয়-প্রিয়তা। আমার নাম প্রিয়তা।’

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here