অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখিনীতে: অনিমা কোতয়াল
১৪.
‘এটাই তাহলে রুদ্র আমের?’
স্তব্ধ কন্ঠে বলে উঠল তমাল। গুলশান থানায় পৌঁছনোর পরেই ওদের সামনে হাজির করা হয়েছে রুদ্রর ছবি আর স্কেচ। হ্যাঁ ছবিও পাওয়া গেছে। আজিজ যাওয়ার আগে ফারুককে বলে গিয়েছিল ভালোভাবে গোটা অফিসটা খুঁজে দেখতে। অনেক খোঁজার পর অবশেষে উদ্ধার করা গেছে সেটা। বাদামি বোর্ডে পিন দিয়ে আটকে রেখেছে রুদ্রর ছবি। যা দেখে তুহিন, তমাল, ফারিয়া তিনজনই থমকেছে। ফারিয়া চোখের পলক অবধি ফেলছে না। তমালের মুখটা হা হয়ে আছে প্রায় হাফ ইঞ্চি। চেহারায় প্রকাশ না পেলেও তুহিনও যথেষ্ট চমকেছে।
উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, অপূর্ব বাদামি চোখের গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঘন কালো ভ্রু জোড়া, খাড়া নাক, পাতলা পুরুষালি ঠোঁট যেটার রঙ একসময় হয়তো মৃদু গোলাপি মতন ছিল; সিগারেটের কৃপায় তাতে সামান্য কালচে ভাব এসেছে, সুগঠিত শক্ত চোয়াল, মাথাভর্তি অগোছালো চুল আর গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। প্রথম দর্শনে যে কারো দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম এই পুরুষ। যে চেহারা থেকে এমন সৌন্দর্যের আলো ঠিকরে পড়ে, সে কি-না এক ভয়ানক অন্ধকার জগতের রাজপুত্র! কয়েক সেকেন্ড কোন কথা বের হলোনা কারো মুখ থেকে। সবার আগে তুহিন-ই সামলে ফেলল নিজেকে। সামান্য গলা ঝেড়ে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুদ্র?’
হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকালেন ইন্সপেক্টর আজিজ। হাসলেন। বোর্ডে লাগিয়ে রাখা রুদ্রর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অবাক হচ্ছেন? সবাই হতো। ওকে প্রথম যে দেখতো, সে এমনই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো। কেউ বিশ্বাসই করতে চাইতোনা এই ছেলে নির্বিকারভাবে এতো নির্মম আর নৃশংস হ-ত্যাকা-ণ্ড ঘটাতে পারে। একটা নির্দয়, হৃদয়হীন, অমানুষের এরকম চেহারা কারোরই কাম্য নয়।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আপনিও কিন্তু খুব সুন্দর স্যার। তবে আপনার কাছে সৌন্দর্যের সাথে সাথে আদর্শও আছে, যেটা রুদ্রর ছিলোনা।’
তুহিন কিছু বলল না। তার প্রতি করা প্রশংসার জন্যে কোনরকম সৌজন্যতাও দেখালোনা ইন্সপেক্টরকে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে গভীরভাবে রুদ্রর ছবি দেখতে দেখতে ভেবে চলেছে। ফারিয়া এখনো অবাক হয়ে দেখছে রুদ্রকে। ফারিয়ার দৃষ্টির এই মুগ্ধতা তমাল-ই সবার আগে লক্ষ্য করল। কিছুটা বিরক্ত হল সে। ফারিয়ার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এলো। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সুন্দর ছেলে দেখলেই গিলে খেতে ইচ্ছে করে তাইনা? এতোদিন তুহিন স্যারের পেছনে পড়ে ছিলেন। এখন কী এই স-ন্ত্রা-সীর পেছনে পড়বেন না-কি?’
ফারিয়ার ঘোর কাটল। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল তমালে কটুক্তি। তবে এখন কিছু বলল না।
তুহিন বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে দ্য সোসাল সিস্টেম গ্রুপের ফাইলগুলো পড়ল। সব। কিছুক্ষণ পড়ার পর তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অফিসে ফোন করো। ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর মালিক ফিরেছেন কি-না দেখো। যদি না ফেরেতো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ করা শুরু করো। দরকারে ছবি ছেপে দাও খবরের কাগজে। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে, আর করা যাবেনা।’
হঠাৎই কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তুহিন। তমাল দ্রুত ফোন বের করে একটু দূরে চলে গেল কথা বলতে। তুহিন এবার ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ফারিয়া, শেখকে ফরেনসিকের যেকোন আপডেট সাথেসাথে তোমাকে জানানোর কথা বলে এসেছো তো?’
‘ ইয়েস স্যার, দেওয়ার কথা। তবুও আমি স্যারকে একটা কল করে দেখছি।’
ফারিয়াও এবার কল করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। তুহিন ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুদ্রর পর আপনার আর কাউকে সন্দেহ হয়নি?’
‘অন্যকোন দল ছাড়া নয়।’ সোজাভাবে বলল ইন্সপেক্টর। ‘কিন্তু যদি সত্যিই খুনগুলো একজন করে থাকে তাহলে আপনি ভুল পথে এগোচ্ছেন। সে রুদ্র না।’
তুহিন জবাব দিলোনা। এই লোকের সেই এক ঘ্যানঘ্যান ওর ভালো লাগছেনা। এনার সাথে তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চায়না ও। একটা চেয়ারে বসে দু হাতে মাথা চেপে বসে রইল চুপচাপ। তমাল এসে বলল, ‘স্যার, ঐ লোকটাকে পাওয়া গেছে ফোনে। রংপুর গিয়েছিল। ভাগ্নির বিয়েতে। আজ রাতে ফিরবে সে। কাল সকালে অফিসে ডেকেছি।’
কোন উত্তর এলোনা তুহিনের কাছ থেকে। ফারিয়া এসে বলল, ‘মহিউদ্দিন স্যার বললেন এখনো তেমন কিছু পান নি, স্যার। পেলে সঙ্গেসঙ্গে জানাবেন।’
এবারেও জবাব দিলোনা তুহিন। সেভাবেই মাথা চেপে ধরে চুপচাপ বসে আছে। এই কেসের কুল-কিনারা কোথায়? কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। এতো বড় একটা আন্ডারওয়ার্ল্ডের দল, একটা বাড়ি, এতোগুলো মানুষ। কোথায় এরা? কী ঘটেছিল এদের সাথে? এদের উধাও হওয়ার সাথে বাকি সাতটা খু-নের আদোও কোন সম্পর্ক আছে? থাকলেও সেটা কী? নাকি সত্যিই ভুল পথে হাঁটছে সে। ওর বিদ্যা বলে যেকোন খু-নে সবার আগে মোটিভ খুঁজে বের করা জরুরি। তাহলে খুনির কাছে পৌঁছনো অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। দুটো দিন হয়ে যাচ্ছে অথচ খুনি তো দূরে থাক, খুনের কারণটা অবধি বুঝতে পারছেনা ও। কেন হল পরপর এই সাতটা খু-ন? প্রতিশোধ? ক্ষমতা? টাকা? কী কারণ হতে পারে? শায়লা বলেছিলেন খু-নি সাজ্জাদের কাছে শুধুমাত্র কারো ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল। অর্থাৎ কারো কাছে পৌঁছাতে চাইছে খুনি? কার কাছে? আর কেন? মাথাটা টনটন করে উঠলো তুহিনের। মোবাইলের মেসেজের টোনে ঘোর কাটল। নিরুৎসুক ভঙ্গিতে চেইক করে দেখল, ইরার মেসেজ। মেসেজটা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল,
‘খুব বেশি প্রেশার যাচ্ছে নিশ্চয়ই? অতো ভেবো না। মাথা ঠান্ডা রাখো। তুমি পারবে । ইউ আর মাই সুপারহিরো। ইউ ক্যান ডু এনিথিং সুইটহার্ট। সবকিছু ভালো হবে।’
হাসল তুহিন। সব চাপ, ক্লান্তি, বিরক্তি যেন নিমেষেই কেটে গেল। ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখেই লিখল, ‘এবার সবকিছু ভালো হতে বাধ্য। ভালোবাসি ইরাবতী।’
মেসেজটা পাঠিয়ে হাঁফ ছাড়ল তুহিন। এরপর আবার ভাবনার সমুদ্রে ডুব দিল। তমাল একটু সংকোচ করে বলল, ‘স্যার, আজতো আর কিছু করার নেই। আমরা কী তবে আজ ফিরে যাচ্ছি?’
তুহিন উত্তর দিলোনা। একটু চুপ থাকল। আরও কিছুক্ষণ ভাবল। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে ঝট করে তাকাল ইন্সপেক্টর আজিজের দিকে। বলল, ‘আমের ভিলায় যাব আমি।’
ইন্সপেক্টর হকচকিয়ে বলল, ‘আমের ভিলা? কিন্তু আপনাকে তো আমি বলেছি, আমের ভিলা এখন ফাঁকা। তালা দেওয়া আছে।’
‘ মনে আছে ইন্সপেক্টর। স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয় আমার। তালা ভাঙার ব্যবস্থার কোন অভাব নেই ডিপার্টমেন্টে।’
‘কিন্তু বাড়ির মালিকের পার্মিশন ছাড়া কারো ফাঁকা বাড়িতে এভাবে_’
‘যদি রহস্যময় সাত-সাতটা খু-ন হয়ে যায়। আর সন্দেহভাজন যদি সেই বাড়ির-ই একজন সদস্য হয়। তাহলে নিশ্চয়ই পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা বিভাগের কোন ইনভেস্টিগেটর গিয়ে ফাঁকা বাড়িটা সার্চ করতে পারে।’ শক্ত গলায় বলল তুহিন।
‘কিন্তু..’ আবার সেই অস্থিরতা আর চিন্তার ভাজ ইন্সপেক্টরের কপালে।
তুহিন সেটা লক্ষ্য করতে করতেই বলল, ‘আপনি রাজি না হলে আমায় এখন হেড অফিসে কল করে পার্মিশন নিতে হবে। ব্যপারটা একই হবে, শুধু সময়টা আধঘন্টা পিছিয়ে যাবে। বিশেষ কোন লাভ আছে কী তাতে?’
দমে গেলেন ইন্সপেক্টর। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বললেন, ‘ঠিক আছে, চলুন।’
তমালকে রুদ্রর ছবি আর স্কেচটাও সাথে নিতে বলল তুহিন। তারপর ইন্সপেক্টর আজিজকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তমাল আর ফারিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগে ল্যাপটপ রাখতে রাখতে ফারিয়া বলল, ‘তখন ওভাবে তাকিয়ে ছিলাম কারণ আমি ভাবতে পারিনি রুদ্র দেখতে এরকম হবে। তাই চমকে গিয়েছিলাম। আমি ক্যারেক্টারলেস নই যে সুন্দর ছেলে দেখলেই গিলে খাবো।’
কথাটা বলে বেরিয়ে গেল ফারিয়া। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে রইল তমাল। এর আগেও ফারিয়াকে জ্বালাতন করেছে সে। কিন্তু এতো শান্ত উত্তর কোনদিন পায়নি। আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছে হয়তো। হঠাৎই রেগে গিয়েছিল কেন জানি। ঐধরণের কথা বলা উচিৎ হয়নি। ক্ষমা চেয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
–
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সূর্য ডুব দিয়েছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশটা ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে।আমের ভিলার সামনে তুহিনদের গাড়িটা এসে থামল। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকেই গাড়ি থেকে নামল চারজন। তুহিন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল বাড়িটাকে। কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়ির সমস্ত রং যেন কেউ শুষে নিয়েছে। গেটের কাছে কোন পাহারা অবধি নেই। এই কী তবে সেই প্রভাবশালী রাশেদ আমেরের স্বপ্নের আমের ভিলা?
সময় নষ্ট না করে ভেতরের দিকে এগোতে নিচ্ছিল ওরা। আচমকাই সামনে এসে বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলো এক মহিলা। ভয়ে চিৎকার করে তুহিনকে আকড়ে ধরল ফারিয়া। হঠাৎই এভাবে সামনে এসে পড়াতে সবাই ভয় পেয়ে উঠেছিল। এমনকি তুহিনও।
তুহিন ভালো করে তাকিয়ে দেখল এক বৃদ্ধা মহিলা। কাঁচাপাকা জট পাকানো এলোমেলো চুল। সাদা শাড়িটা ময়লা হয়ে হলদে হয়ে গেছে। কালো ব্লাউজটাও দু জায়গায় ছেড়া। ফ্যাকাশে মুখটা কী ভয়ানক! মহিলাটি বিকৃত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ বাড়িতে ঢুকছিস তোরা? ঢুকিস না, ঢুকিস না। বিষ আছে, বিষ। বিষ ঢুকেছে এই বাড়িতে। লুকিয়ে আছে। হি হি হি। কেউ বাঁচবেনা, কেউ বাঁচবেনা। এই বিষে মরে যাবি, একদম মরে যাবি। সবাই মরে যাবি। যাস না, এই বিষের বাড়িতে যাস না।’
একই প্রলাপ বকতে বকতে সেখান থেকে চলে গেল মহিলাটা। তুহিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পাগলির যাওয়ার দিকে। ফারিয়া এখনো আকড়ে ধরে রেখেছে ওকে। তুহিন আস্তে করে বলল, ‘ভয় পেয়ো না ফারিয়া। পাগল ছিল।’
ফারিয়া ঝট করেই তুহিনকে ছেড়ে দিল। প্রচন্ড সংকোচে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণ করা এই বেহায়াপনার জন্যে নিজেই লজ্জিত হল মেয়েটা। এতো নির্লজ্জ কবে থেকে হল ও? মিনমিনে গলায় বলল, ‘স্যরি স্যার।’
তুহিন কিছু বলল না। ফারিয়ার কাজে ও নিজেও বিরক্ত। প্রথমে গেইটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে যেতে হল ওদের। বাগানের দিকে একবার চোখ বুলালো তুহিন। অর্ধেকর বেশি গাছ মরে গেছে, ফুলের চিহ্নমাত্র নেই। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।
বাড়ির দরজার তালাটাও ভাঙতে হলো ওদের। আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকল চারজন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তারওপর প্রচন্ড অন্ধকার ভেতরে। মুখে পেন্সিল টর্চটা নিয়ে; পেছন থেকে নিজের ‘বেরেটা এম নাইন’ পি-স্ত-লটা বের করল তুহিন। বাকিদেরও ইশারা করল যার যার পি-স্ত-ল নিয়ে সতর্ক থাকতে। সবাই ওর কথামতো বের করে নিল পি-স্ত-ল, মুখে ধরা পেন্সিল টর্চ। বাড়ি তালা মারা ছিল, তারমানে এই নয় যে ওরা নিরাপদ। পেছনে আরেকটা দরজা আছে। আর বাইরে থেকে দেয়াল টপকেও ঢোকা যায়। কাজেই সাবধান থাকতে হবে। পি-স্ত-লের ট্রিগারে হাত রেখে ডানে শরীর বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে প্রতিটা রুমে ঢুকছে ওরা। ডিফেন্সিভ পজিশন।একেকজন একেকটা রুম সার্চ করছে। ইন্সপেক্টরকে বলা হয়েছে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কারণ ইন্সপেক্টরকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেনা তুহিন। সেটা মুখে না বলে পাহারার কথা বলেই করিডরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাকে। এরমধ্যেই একটা ঘরে ঢুকর তুহিন। চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝল এটা রাশেদ আমেরের ঘর। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে খুঁজেও বিশেষ কিছু পেলোনা। এদিকে ধুলোয় অবস্থা বেশ খারাপ। কিছু নাড়লেই ধুলো উড়ে ঢুকছে নাকে। কিছু একটা চিন্তা করে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গেল ও। রাশেদ আমেরের ব্যবহার করা একটা চিরুনী দেখতে পেল সেখানে। পেন্সিল টর্চটা ভালোভাবে ধরে খেয়াল করল দুই-তিনটে গুড়ো চুল রয়েছে সেখানে। কিছু না ভেবেই চিরুনিটা এভিডেন্স ব্যাগে ভরে ফেলল তুহিন। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল তমাল, ফারিয়া ফিরে এসেছে। টর্চটা মুখ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে বলল, ‘ কিছু পেয়েছো?’
তমাল বলল, ‘ না স্যার, তেমন অস্বাভাবিক কিছু পাইনি আমরা।’
‘ রুদ্রর ঘরটা পেয়েছো?’
‘ জ্বি স্যার। কিন্তু কিছু পাইনি। তবে সব জায়গা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নিয়েছি, অন্যান্য ঘর থেকেও টুকিটাকি কিছু ভরে নিয়েছি ব্যাগে।’ বলল ফারিয়া।
‘ গুড। কিন্তু রুদ্রর ঘরে কিছু পেলেনা? হেয়ার ব্রাশ বা ওর ব্যবহার করা কিছু। কিছুই না?’
‘ না স্যার। প্রায় ফাঁকা ছিল ঘরটা। এমনকি পোশাকগুলো ভালোভাবে দেখেছি।’
কিছু বলল না তুহিন। তারমানে ঘরটা হঠাৎই ফাঁকা হয়নি? কী হচ্ছে কী? সব মিলেও মিলতে চাইছেনা। কী হয়েছিল এই আমের ভিলায়? কেন সবাই চলে যেতে বাধ্য হলো? মাথা ঝাঁকিয়ে উল্টাপাল্টা ভাবনা আপাতত বাদ দিল তুহিন। এটার জন্যে রাত আছে। এখন কাজের কাজ করতে হবে। আশেপাশে আরও একবার তাকিয়ে দেখল। পূর্ব দিকটা চোখে পড়তেই বলল, ‘ওদিকে কোন ঘর আছে মনে হচ্ছে?’
‘ হ্যাঁ আছে।’ কথা বলল আজিজ। এতক্ষণ শুধু দেখছিল এদের কাজ।
তুহিন অপেক্ষা না করে আবার পি-স্ত-লটা ঠিকভাবে ধরে এগিয়ে গেল সেদিকে। পূর্ব দিকে যেতেই বড় একটা ঘর পাওয়া গেল। তুহিন একই কৌশলে ঢুকে গেল ভেতরে। পেছনে পেছনে বাকিরাও এলো।
মুখে ধরে রাখা পেন্সিল টর্চটা সামনে পড়তেই থমকে গেল তুহিন। একটা বেটে, কালো, টাকমাথা ওয়ালা লোক। ব্যস্ত হাতে খুঁজছিল কিছু একটা। তুহিনকে দেখে লোকটাও থমকেছে। বিস্ফোরিত হয়ে গেছে চোখজোড়া। হাতে ধরা টর্চটা পড়ে গেল অসাবধানতাবশত। কিছু না ভেবেই গু-লি চালাতে যাচ্ছিল লোকটা। কিন্তু তার আগেই তুহিন বুঝে ফেলল ওর মতিগতি। সাথেসাথেই ওর বেরেটা এম নাইন থেকে বেরিয়ে এলো একটা বুলেট। যেটা সোজা গিয়ে লাগল লোকটার পি-স্ত-লধরা হাতে। পড়ে গেল পিস্তল। সাথে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ ধ্বনি। ব্যাথায় গাল কুঁচকে গেছে লোকটার। এক সেকেন্ডও দেরী করেনি তুহিন। অনেকটা মানকি স্টাইলে লাফ দিয়ে পিস্তলটা হাতিয়ে নিল। লোকটার বের হওয়ার আর উপায় নেই। কারণ দরজা একটাই। আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বাকি তিনজন।
হঠাৎই ফ্লোরে ঢলে পড়ে গেল লোকটা। অবাক হল তুহিন। কী হল? হাতে গুলি লাগায় তো জ্ঞান হারাবার কথা নয়। ভান করছে না তো ব্যাটা? পুরো ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটল যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বাকি তিনজন। কিন্তু এতক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেদের। ইন্সপেক্টর বলল, ‘আমি দেখব?’
তুহিন বলল, ‘ না, আমি যাচ্ছি।’
পি-স্ত-লটা লোকটার দিকে ধরে রেখেই আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তুহিন। সাবধানে হাঁটু ভেঙ্গে বসল তার পাশে। চেক করার পর স্তব্ধ হল তুহিন। পাঁচসেকেন্ড মূর্তির মতো বসে রইল। মা-রা গেছে লোকটা! কিন্তু হাতে গু-লি লেগে তো ম-র-বেনা। তাহলে? এক সেকেন্ডেই কীভা_ প-টাশি-য়াম সা-য়ানা-ইড! শীট! তমাল বলল, ‘কী হয়েছে স্যার?’
‘মুখের মধ্যে সম্ভবত প-টাশি-য়াম সা-য়া-নাইড ভর্তি বল রাখা ছিল। ধরা পড়লেই সেটা ফাটিয়ে ফেলার হুকুম ছিল হয়তো। ও ধরা পড়লে অনেক ভেতরের খবর বেরিয়ে আসতো।’
ব্যপারটা বুঝতে সময় লাগল না কারোরই। ইন্সপেক্টর আজিজ বলল, ‘ আমি থানায়_’
সে কথা শেষ করার আগেই তুহিন বলল, ‘ না, বডিটা গোয়েন্দা বিভাগের ফরেন্সিকে যাবে। তমাল, অফিসে ফোন লাগাও।’
তমাল তাই করল। আজিজ আর কিছু বলল না। অফিসে কল করে আবার কাজে লেগে পড়ল ওরা। লাশটা পড়ে রইল ওখানেই। একে নিয়ে আপাতত ভাবা বাদ দিয়েছে তুহিন। কেন এসেছিল? কী উদ্দেশ্য ছিল সেসব এখন ভেবে কোন লাভ নেই। পরে ভাবা যাবে। ঘরের প্রতিটা বই, ফাইল, কাগজ চেক করল তুহিন। কিন্তু এমন কিছুই পেলোনা যেটা এই কেসের জন্যে প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিটা চেক যেন তুহিনের হতাশার মাত্রা বাড়িয়ে তুলছিল।
এবার একটা লম্বা টেবিলটার ওপরে চোখ পড়ল তুহিনের। পুরো টেবিলটাই ফাঁকা। কিন্তু বড় চেয়ারটার সামনের দিকে দুটো বইয়ের মতো কিছু একটা রাখা। তুহিন সেখানে গেল। টর্চটা ভালোভাবে ধরে রেখে দেখল, ওপরে রাখা ছিল একটা ডায়েরি। খুলে দেখল সেটা। ভেতরে তেমন কিছুই নেই, কয়েকটা নাম্বার আর হিসেব ছাড়া। আরেকটা যা পেল তাতে আবার অবাক হল তুহিন। একটা ফটো অ্যালবাম। প্রথম কভারটা উল্টে ফেলতেই তুহিন দেখল একজন মধ্যবয়স্ক লোকের ছবি। চাপ দাড়ি, ব্যাক ব্রাশ করে রাখা ঘন কালো চুল, কী অসাধারণ জৌলুস চেহারায়। কী আশ্চর্য তেজ! আপনাআপনি ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘রাশেদ বাবা?’
কেন জানি আমের না বেরিয়ে বাবাটাই বের হল তুহিনের মুখ থেকে। এগিয়ে এলেন ইন্সপেক্টর আজিজ। ছবিটা একবার দেখে বললেন, ‘ হ্যাঁ, ইনিই রাশেদ আমের।’
‘ এই লোকটা রুদ্রর বাবা? চেহারাতো তাই বলে কিন্তু বয়স_’ অবাক কন্ঠে বলল তমাল।
হেসে ফেলল আজিজ। বলল, ‘ ওনার বয়স এমনিতে প্রায় পঞ্চান্ন। কিন্তু দেখে মনে হয় না। পয়তাল্লিশেই যেন আটকে গিয়েছিল লোকটা।’
তুহিন কিছু না বলে অ্যালবামের পাতা উল্টালো। আজিজ পরিচয় বলছে সবার। একজন অল্প বয়সী রমনীর ছবি। বেশ সুন্দরী। আজিজ না বললেও তুহিন বুঝল এটা রাশেদের স্ত্রী ছিলেন। রুদ্রর এতো সুন্দর হওয়ার রহস্য ভেদ হল এবার। আরেকবার উল্টে রুদ্রর একটা ছবি দেখতে পেল সে। প্রায় দশ বছর বয়সের একটা ছবি। দেখেই বুঝেছে এটা রুদ্র। হাসছে ছেলেটা। কী প্রাণচ্ছ্বল, নিষ্পাপ হাসি। যেন সদ্য ফোটা কোন ফুল। সত্যিই ছেলেটা তখন নিষ্পাপই ছিলো, একদম সদ্য ফোটা ফুলের মতো। কেন জানিনা তুহিনও হাসল ছবিটা দেখে। পরেরটাও রুদ্রর ছবি। তবে যুবক বয়সের। কুহুর ছবিটা সামনে আসতেই ফারিয়া বলে উঠল, ‘বাহ! খুব মিষ্টি তো।’
‘ হ্যাঁ, ভীষণ মিষ্টি।’ বলে আবার পাতা উল্টালো তুহিন। জ্যোতির ছবিটা দেখে তিনজনই অবাক হল। এমন সুন্দরী, আকর্ষণীয় একটা মেয়ে সারাক্ষণ প্রেম নিবেদন করে বেড়াতো, সবটা উজাড় করে দিতে চাইতো। অথচ রুদ্র পাত্তাও দিতো না? অদ্ভুত! উচ্ছ্বাসের ছবিটা আসতেই কয়েক সেকেন্ড মৌন রইল ওরা সবাই। এরপর জাফর আমেরের ছবিও পেল।
এসবের মধ্যেই ইন্সপেক্টরের কল চলে এলো। সে তুহিনকে বলে করিডরে চলে গেল কথা বলতে। আরেকবার অ্যালবামের পাতা উল্টতেই শেষ ছবিটা এলো। দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তুহিনের। ছবিটা নষ্ট হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে না কার। তবে এটা যে একটা মেয়ের ছবি সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু উপরিভাগ নষ্ট হয়ে গেছে বলে মুখ চেনা যাচ্ছেনা। সব ছবি ভালো ছিল শুধু এটাই নষ্ট হয়ে গেল? আশ্চর্য! ছবিটা বের করে নষ্ট অংশটা নাকের কাছে নিয়ে শুকলো তুহিন। কেমন চা চা গন্ধ মনে হচ্ছে। দাগটাও চায়ের দাগের মতো। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেনা কিছুতেই। তমাল আর ফারিয়াকে দেখাল, ওরাও কিছু বলতে পারল না। ঠোঁট চেপে ওখানকার ধুলো মাখা একটা চেয়ারেই বসে পড়ল তুহিন। ওই অ্যালবামে রাশেদ ওর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর একটা করে ছবি রাখতো, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এই ছবিটা কার? এটা কী জ্যোতি না-কি কুহু? ওরা ছাড়া আর কে ছিল রাশেদ আমেরের প্রিয় পাত্রি? কে এই মেয়ে!
#চলবে…