অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১.

0
4

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১.

জানুয়ারির হিম-শীতল রাত্রিতেও কপাল বেয়ে সরু ঘাম নামছে শায়লার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। হাত-পা বাঁধা না থাকা সত্ত্বেও নড়ার সামর্থ্য নেই তার। সম্মুখে বসে থাকা ব্যক্তির হাতে এম.টি.নাইন; তীক্ষ দৃষ্টি তাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, বিন্দুমাত্র নড়লেই বু-লে-ট তার শরীর ছেদ করবে।

বনানীর আবাসিক এলাকার মোটামুটি উন্নত এই ফ্ল্যাটে আজ একাই ছিল শায়লা। স্বামীর অপেক্ষা করতে করতে সবে কিছুটা তন্দ্রা ভাব এসেছিল চোখে। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ। ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা। স্বামী এসেছে ভেবে শাড়ি ঠিক করে দ্রুত দরজা খোলার উদ্দেশ্যে ছোটে শায়লা। পতিভক্তিতে নয়, পতিভয়ে। দরজা খুলতে দেরী হলেই হয়তো শক্ত হাতের ভয়ানক থাপ্পড় পড়বে গালে। মাতাল হয়েই এসেছে তাতো নিশ্চিত। সে ছাড়া আর কেউ আসেনা এই ফ্ল্যাটে। তাও সপ্তাহে দু-একবারই আসে। সেই দু-একটা রাতই বড্ড নরকীয় মনে হয় শায়লার। মাতাল অবস্থায় এসে মারধর করা আর নিজের দৈহিক চাহিদা মেটানো ব্যতীত বিশেষ কিছুই করেনা তার স্বামী। স্বামী সোহাগ নামক ব্যপারটার সাথে পরিচিত নয় মেয়েটা। কিন্তু ডোর হোল দিয়ে চেক করে দেখে তার স্বামী নয় বরং অন্য কেউ। অপরিচিত লোক দেখে ঘাবড়ে যায় শায়লা। কী করবে বুঝতে পারেনা কিছুক্ষণ। আবার বেজে ওঠে কলিং বেল।শায়লা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন ছোড়ে, ‘কে?’

দরজার ওপাশ থেকে থমথমে, গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে ওঠে, ‘আপনার স্বামীর গু-লি লেগেছে, গুরুতর আহত। বোধ হয় বাঁচবে না। দরজা খুলুন দ্রুত!’

হঠাৎ এমন কথা শুনে চিন্তাশক্তি লোপ পায় শায়লার। কিছু চিন্তা না করেই দরজা খুলে দেয়। দেখে স্থির পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে আছে সুঠাম দেহি এক যুবক। লম্বা; মাথায় লম্বা করে হুডি দেওয়া। অর্ধেকের মতো চেহারা ঢেকে আছে হুডির আড়ালে। পরনের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন যাবত এক পোশাকেই ঘুরছে লোকটা। শায়লা ব্যস্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলায়। অস্থির গলায় বলে, ‘ক-কোথায় উনি?’

শায়লাকে ঠেলে সোজা ভেতরে চলে আসে লোকটা। চিৎকার করার আগেই শক্ত করে মুখ চেপে ধরে। গলায় পি-স্ত-ল ঠেসে চাপা গলায় বলে, ‘বাঁচতে চাইলে একদম চুপ করে থাকুন। এখানে আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি আমি। আপনার কিছু হবেনা। তবে সেটা ততক্ষণ; যতক্ষণ আপনি আমার কথাগুলো সব চুপচাপ শুনবেন। শুনবেন তো?’

পিস্তল দেখামাত্র কলিজা শুকিয়ে গেছে শায়লার। প্রাণের ভয়ে দ্রুত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। শায়লার ফোনটা নিজের দখলে নিয়ে নেয় সেই যুবক। গভীর তীক্ষ্ম চোখের শীতল দৃষ্টিতে ফ্লোরে বসে থাকার হুকুম দেয়। কড়া নির্দেশ দেয় একটাও শব্দ না করার। সোফায় বসে লোকটা, এরপর কেবল কেউ আসার অপেক্ষা!

লিফ্টের দরজাটা খুলতেই পিটপিটে চোখে একবার বাইরে তাকাল সাজ্জাদ। যখন বুঝল নিজের ফ্লোরে চলে এসেছে, বেরিয়ে এলো। আজকে নিজের তিন নম্বর বউয়ের কাছে আসার তেমন কোন ইচ্ছে ছিলোনা তার। কিন্তু রাতে ভরপেট মদ গেলার পর যে মেয়েটার সাথে রাত কাটানোর কথা ছিল; সে শেষ মুহূর্তে আসতে পারবেনা বলে জানিয়েছে। এতো রাতে কোন কলগার্ল পাবেনা আর। আজকাল আগে থেকে বলে না রাখলে পাওয়া মুশকিল। এখন সেই প্রয়োজন মেটাতেই আজ বউয়ের কাছে আসা। তাইতো আসার আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, সে আসছে। আসতে আসতে সেই কল গার্লকে অকথ্য ভাষায় কিছু গা-লিও দিয়েছে। নেশায় পা দুটো মৃদু টলছে সাজ্জাদের। টলমলে পায়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে গেল নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপল। সে নিজেও জানেনা, আজ এখানে আসাটা তার জীবনের কতবড় ভুল ছিল। এই ভুলের জন্যে হয়তো আফসোস করারও অবকাশটুকু পাবেনা সে।

দ্বিতীয় কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠল শায়লা। আগন্তুকের স্থির চোখদুটো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল রহস্যময় বাঁকা হাসি। শিকার এসে গেছে! শায়লা তাকালো তার দিকে। হুডি নামিয়ে ফেলেছে সে। তর্জনী আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করল আগন্তুক। উঠে গিয়ে শায়লার সামনে ডান হাঁটু ভেঙ্গে বসল। চাপা আওয়াজে বলল, ‘কোনরকম চালাকি করার চেষ্টাও করবেন না। তাহলে দুজনেই মরবেন। দরজাটা খুলে দিন।’

শায়লা কম্পমান শরীরে, ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। আরও একবার বেল বাজতেই যুবক উঠে দাঁড়াল। দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল দেয়াল ঘেষে। চোখের ইশারায় শায়লাকে আদেশ করল দরজাটা খোলার জন্যে। শায়লা একটা ঢোক গিলে কোনমতে উঠে গেল দরজার কাছে। কম্পমান হাতে দরজাটা খুলল। দরজা খুলতেই জঘন্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিতে দিতে ভেতরে ঢুকল সাজ্জাদ। ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলল, ‘কোন নাগর ঢুকাইছিস ঘরে? খুলতে এতো দেরী হল কেন?’

ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শায়না।

‘কথা বলস না কেন?’ সাজ্জাদ রেগে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। যেই চড়টা মারবে বলে হাত ওপরে তোলে; ঠিক তখনই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। সে শব্দে থেমে গেল সাজ্জাদ। ঝট করে পেছনে তাকিয়ে দেখল এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে দরজায় হেলান দিয়ে। লোকটাকে চিনতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে শায়লার দিকে একপলক তাকিয়ে রাগে জ্বলে উঠল সাজ্জাদ। সত্যিই তাহলে নাগর জুটিয়ে রেখেছে! তেড়ে গিয়ে শায়লার চুলের মুঠি ধরল সে। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল শায়লা। সাজ্জাদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘শালী! শরীরে এতো জ্বালা তোর? আমি আসিনা বলে ঘরে ব্যাটামানুষ এনে ঢুকাইছিস? আমি আসমু শুইন্নাও ভাগাস নাই? এতো সাহস?’

‘ওনাকে ছাড়।’ থমথমে, ঠান্ডা গলায় কথাটা শুনে তীব্র ক্রোধে আগন্তুকের দিকে তাকাল সাজ্জাদ। কিন্তু তাকিয়ে থমকে গেল সে। নেশা কেটে গেল নিমেষেই। যুবকের হাতে পি-স্ত-ল! যা বোঝার বুঝে গেল সাজ্জাদ। দ্রুত পেছন থেকে পি-স্ত-ল বের করতে নিল। ঠিক তখনই আগন্তুক একটা ফ্লাওয়ার ভাস ছুড়ে মারল সাজ্জাদের হাতে। পি-স্ত-ল পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই যুবক ঝড়ের গতিতে সেটাকে নিজের অধিনস্ত করে নিল। সাজ্জাদ তেড়ে আসতে নিলে আগন্তুক পি-স্ত-লের বাট দিয়ে তীব্র আঘাত করল তার কানে। কান ধরে, আর্তনাদ করে বসে পড়ল সে। সাজ্জাদের পি-স্ত-লের ম্যাগাজিনটা রিলিজ করে সাইডে ফেলে দিল আগন্তুক। কান বেয়ে র-ক্ত গড়িয়ে পড়ছে সাজ্জাদের। যুবকটি এগিয়ে গিয়ে কলার ধরে টেনে দাঁড় করাল তাকে। শায়লাকে উদ্দেশ্যে করে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘খু-ন সহ্য না হলে ভেতরে চলে যান।’

শায়লা এক মুহূর্তও দেরী করল না। দৌড়ে পালাল ভেতরের ঘরে। আপনি বাঁচলে তবেই বাপের নাম। এদিকে ‘খু-ন’ শুনেই র-ক্ত হিম হয়ে গেছে সাজ্জাদের। ওর হাতে পি-স্ত-ল নেই। এমন সুঠাম দেহি যুবকের সাথে কখনই খালি হাতে পারবেনা ও। মৃ-ত্যু নিশ্চিত! সাজ্জাদকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় ফেলল আগন্তুক। সাজ্জাদ কাঁপা গলায় বলল, ‘ক-কে আপনে? আমা- আমাকে মে-রে আপনার কী ল-লাভ?’

সাজ্জাদের পাশ দিয়ে সোফার ওপর নিজের বাঁ পা রাখল আগন্তুক। বলল, ‘ আমি কে সেটা এতক্ষণে তোর বুঝে যাওয়া উচিত ছিল। আর তোকে মে-রে আমার কী লাভ? কোন লাভ নেই। মা-রতেও চাইছিনা। শুধু একটা প্রশ্ন করব। ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে দিলে ছেড়ে দেব। মা-র-ব না।’

‘ কী প্র-প্রশ্ন?’

একটা নাম বলল আগন্তুক। শেষে যুক্ত করল, ‘ এখন কোথায় আছে ও?’

নামটা শোনামাত্র পিলে চমকে উঠল সাজ্জাদের। জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। বুঝে ফেলল, কে এই যুবক। অনিয়মিত শ্বাস নিতে নিতে বলল, ‘আমি জানিনা।’

অচেনা যুবক কৃত্রিম হাসল। আচমকা পি-স্ত-লের বাঁট দিয়ে সজোরে আ-ঘা-ত করল সাজ্জাদের ঠোঁটে। তীব্র ব্যাথায় আবারও চেঁচিয়ে উঠল মাতাল সাজ্জাদ। ঠোঁট দিয়ে গলগল করে র-ক্ত বেরিয়ে এলো। এমনিই মাতাল ছিল। এমন মার খেয়ে মাথা নুইয়ে পড়ল তার। আগন্তুক পি-স্ত”লটা ওর গলায় ঠেকিয়ে মাথাটা তুলে ধরে বলল, ‘এতো ওয়াফাদারী ভালো না। প্রয়োজনে তোকে সরিয়ে ফেলতে ওরা দু-বারও ভাববে না। অথচ তুই ওদের জন্যে আমার হাতে নিজের প্রাণ দিবি? বোকামো হবে না?’

সাজ্জাদ ক্লান্ত চোখে তাকাল। মাথা ঝাঁকালো যুবক। অর্থাৎ সে বুঝে গেছে, সাজ্জাদ বলবে না। পি-স্ত-লটা লোড করে সাজ্জাদের দিকে তাক করতেই সাজ্জাদ একপ্রকার চিৎকার করে বলে উঠল, ‘দুবাই, দু-বাই চলে গেছে। এখন দুবাইতেই আছে।’

‘দুবাইয়ের কোথায়?’

‘তা জানিনা।’

পি-স্ত-লটা মাথায় ঠেসে ধরতেই সাজ্জাদ ব্যথা মিশ্রিত কন্ঠে প্রায় কেঁদে দিয়ে বলল, ‘সত্যিই জানিনা আমি। বিশ্বাস করেন। যোগাযোগ নাই আমার লগে। কিন্তু সুজনের সাথে কথা হয় ওনার।’

লোকটা মিথ্যা বলছেনা সেটা নিশ্চিত। কিছু একটা ভাবল লোকটা। সাজ্জাদকে বলল, ‘এখন কোথায় সুজন?’

‘ ল-লক্ষ্মীবাজার।’

নাক-কান চেপে ব্যথা সহ্য করে বলল সাজ্জাদ। তীব্র শীতেও ঘামে ভিজে প্রায় স্নান করে ফেলেছে। তার সাথে সারা মুখে-শরীরে বেয়ে পড়া র-ক্ততো আছেই। সাজ্জাদকে দিয়ে নিজের মোবাইলে অ‍্যাড্রেসটা টাইপ করিয়ে নিল আগন্তুক।

হঠাৎ গু-লি চলার আওয়াজে কেঁপে উঠল শায়লা। এতক্ষণ ভয়ে জড়োসরো হয়ে, পাশের রুমের মারধরের আওয়াজ শুনছিল সে। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা তার এখন। গু-লির আওয়াজে আর বসতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে উঁকি দিল বসার ঘরে। দেখল ওর স্বামীর মৃ-ত শরীর পড়ে আছে সোফায়। চোখ দুটো খোলা, স্থির। কপালের ঠিক মাঝ বরাবর গু-লির গভীর ক্ষত। সোফা র-ক্তে ভিজে গেছে। চিৎকার করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলল শায়লা। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আগন্তুক শায়লাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো দৃঢ় চলনে। বলল, ‘কোন কষ্ট পায়নি। সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই চাননা আপনার সাত বছর বয়সী ছেলে, যে এখন নিজের নানীর কাছে আছে, সেও এভাবে ম-রু-ক। শুনেছি রোজ স্কুলে যায়। তাই না?’

আঁতকে উঠল শায়লা। কিছু বলার আগেই সেই যুবক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা-র-ব না। কিন্তু আমার চেহারাটা আপনার একটুও মনে নেই। আর যদি ভুল করেও মনে পড়ে, তো নিজের ছেলেকে ভুলে যেতে হবে। মনে থাকবে?’

শায়লা বুঝল এই আগন্তুক কী চায়। দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল কেবল। আগন্তুক মৃদ্যু হাসল। পি-স্ত-লটা পকেটে রেখে প্রস্থান করল। সে জানে, শায়লা একান্তই বাধ্য না হলে পুলিশকে ওর ব্যপারে কিচ্ছু বলবেনা। এই নরপশুর মৃত্যুতে স্ত্রীর বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। বরং সে খুশিই হয়েছে। এখন দ্রুত এই জায়গাটা ছাড়তে হবে। লোকজন চলে আসার আগেই। তার এখন অনেক কাজ বাকি। শেষ কাজ!

এদিকে শায়লা স্থির চোখে দেখছে স্বামীর মৃ-ত শরীর। চোখ বন্ধ করে অশ্রু বিসর্জন দিল সে। কষ্টের নয়, মুক্তির কান্না। দিন-রাত এই পিশাচের মৃ-ত্যু কামনা করে গেছে এতোদিন। আজ অবশেষে মুক্তি মিলল। সাজ্জাদের জন্যে যমদূত ওর জন্যে দেবদূত হয়ে এসেছে যেন। কিন্তু কে এই আগন্তুক? প্রচন্ড বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। সুদর্শন ঐ মুখটাও ছিল অনুভূতিহীন। লালচে চোখ আর এলোমেলোভাবে সদ্য গজানো খোঁচা দাড়ি স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল তার নির্ঘুম রাতের কথা। অনুভূতিহীন মুখটার পেছনে যেনো লুকিয়ে ছিল তার বিধ্বস্ত হওয়ার এক লোমহর্ষক গল্প।

কান থেকে টেলিফোনটা খট করে নামিয়ে রাখলেন গুলশান থানার ইন্সপেক্টর আজিজ রহমান। রাগে গজগজ করতে লাগল। একটা কেইস নিয়ে তৃতীয়বার কমিশনারের ঝাড়ি খেল আজ। রাগে, অপমানে কান লাল হয়ে উঠেছে। লম্বা ক্যারিয়ারে কোন কেস নিয়ে এতো নাকানি চুবানি খেতে হয়নি তাকে। তবে একজন খাইয়েছিল। বেশ ভালোভাবেই খাইয়েছিল। সে এক আলাদা অতীত। দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো অতীত। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে টেলিফোনটা তুলে নিল আজিজ। এসআই কে ডেকে পাঠাল তার রুমে। এরমধ্যেই পিওন এসে চায়ের কাপ রেখে দিয়ে গেল টেবিলে। বিরক্তিতে অস্থির হয়ে চায়ের চাপটা তুলে নিলো আজিজ। প্রথম চুমুক দিতে দিতেই এসআই ফারুক চলে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মে আই কাম ইন স্যার?’

আজিজ চোখ তুলে তাকাল। বলল, ‘আসুন।’

মাথা নিচু করে ভেতরে এলো ফারুক। ইন্সপেক্টর চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বলল, ‘কমিশনার সাহেবে ফোন করেছিলেন। কাল বনানীতে নাকি আরেকটা খু-ন হয়েছে। ওটা আমাদের এরিয়া না। কিন্তু তারই বিভাগের আলাদা আলাদা জায়গাতে দেখতে দেখতে ছয়টা খু-ন হয়ে গেল। অথচ কোন সমাধান নেই। এই নিয়েই ভীষণ চাপে আছে গোটা ডিপার্টমেন্ট। আমার এখানের তিনটা কেস এখনো ঝুলে আছে। নিজের প্রেশার রিলিজ করতে আমায় ঝেড়ে দিলো। তবে এখন মনে হচ্ছে আমরা একটু শান্তি পাব।’

ফারুক খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কীভাবে স্যার?’

‘বুঝলে না? খু-নগুলো খুবই মিস্ট্রিরিয়াস। যেটুকু তথ্য আমরা পাঠাতে পেরেছি তাতে বোঝা যাচ্ছে গভীর কোন ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। খুব গভীর!’

‘তবে কী এবার গোয়েন্দা বিভাগ থেকে দেখবে কেইসটা?’

‘সম্ভবত।’

‘তার মানে, কেসটা নিশ্চয়ই ওর হাতেই পড়বে?’ ফারুকের কন্ঠে কৌতূহল স্পষ্ট।

ইন্সপেক্টর আজিজ চেয়ারে হেলান দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বলল, ‘দেখা যাক।’

*

উত্তরার নীরব সেক্টরের ছোট্ট এক ফ্ল্যাট। বেশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল গোয়েন্দা বিভাগের ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। কাল অনেক রাত করে ফ্ল্যাটে ফিরেছে। অনেকদিন যাবত লেগে থাকার পরে অবশেষে একটা ক্রিটিক্যাল কেস সলভ হয়েছে। সেই খুশিতে অনেক পুরোনো বন্ধুদের সাথে ক্লাবে গিয়েছিল। হাল্কা ড্রিংকও করেছে। অনেকদিন পর ড্রিংক করাতে অল্পেই অবস্থা বেগতিক। ফ্ল্যাটে এসে সাথেসাথেই লুটিয়ে পড়েছে বিছানায়। ঘুমের ঘোরে কলিং বেলের আওয়াজটা ডিরেক্টর জেনারেলের কড়া নির্দেশনার মতো লাগল তুহিনের। যা একগাদা কাজের ভার চাপিয়ে দিচ্ছে ওর কাঁধে। কঠিন ভাষায় আদেশ করে যাচ্ছে পরবর্তী পদক্ষেপের। আর ও নিজেও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে প্রতিটা শব্দ। বার বার ‘ইয়েস স্যার’ ‘ইয়েস স্যার’ বলে নিজের একাগ্রতা জাহির করে চলেছে। কিন্তু কলিংবেল একটানা বাজতে থাকায় ধীরে ধীরে তুহিনের মস্তিষ্ক বুঝতে পারল এটা কলিং বেলের আওয়াজ। ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোর কাটতে কাটতে পুরোপুরি কেটে গেল। কিছু একটা ভেবে ঝট করেই উঠে বসল ও। ঘুম যেনো দৌঁড়ে পালালো। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে এগারোটা বাজে। সময়টা দেখেই চোখ বন্ধ করে একটা আফসোসের শ্বাস নিল তুহিন। মনে মনে বলল, অল দ্য বেস্ট তুহিন আহমেদ।

তাড়াতাড়ি উঠে টিশার্ট পরে নিল তুহিন। একপ্রকার দৌড়ে গেল দরজা খুলতে। দরজাটা খুলতেই দেখল বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইরা। বিরক্তিতে ভ্রুদয় কুঁচকে আছে ওর। একটু হাসার চেষ্টা করল তুহিন। কিন্তু হলোনা।
তুহিনকে দেখামাত্র ছোট ছোট করে তাকাল ইরা। লম্বা-চওড়া, হলুদ ফর্সা, এলোমেলো চুলের ছেলেটাকে দেখে নিল ভালোভাবে। তুহিন নিজের বোকা হাসিটা ধরে রেখেই প্রেয়সীর মন ভোলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তাতে বিশেষ কোন লাভ হলো না। ইরা নিজের হাতের ঘড়ির দিকে ইশারা করে বলল, ‘ক’টা বাজে?’

তুহিন বুঝল অবস্থা বেগতিক। মেয়েটা বেশ ক্ষেপেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। বলল, ‘সাড়ে এগারোটা। কেন? তোমার ঘড়ির ব্যাটরি শেষ? ওয়েট আজই লাগিয়ে দেব। ন-না না, নতুন ঘড়িই কিনে দেব।’

ইরা তুহিনকে দুহাতে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। নিজেও ভেতরে গিয়ে বিরক্তি ঝেড়ে বলল, ‘আজ আমাদের একসাথে ব্রেকফাস্ট করার কথা ছিল। সারাদিন ঘোরার কথা ছিল। আর তুমি? তুমি ঘুমিয়েই বারোটা বাজিয়ে দিলে? এরকম ছুটি তুমি রোজ পাও তুহিন?’

তুহিন অসহায় মুখ করে বলল, ‘স্যরি। কী করব বলো? কাল ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তবুও আমি এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু _’

‘কিন্তু এলার্মের শব্দ তোমার কানে ঢোকেনি। তাইনা?’

তুহিন মুখ কাচুমাচু করে ফেলল। বলল, ‘ভীষণ ক্লান্ত ছিলামতো। তাই হয়তো এরকমটা হল। কাল রাতে স্যারকে সব বুঝিয়ে তবেই না আসতে পেরেছি।’

ইরা এবার টলমলে চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘আর আমি? আমার কথাটাও তো মাঝেমাঝে ভাবতে পারো তুহিন? অনেকদিন পর আজ ফ্রি ছিলে তুমি। আমার কোন গুরুত্বই নেই তোমার জীবনে।’

তুহিনের খারাপ লাগল এবার। অপরাধবোধ হল। মেয়েটার মলিন মুখ ওর ভালো লাগেনা। তাই এগিয়ে গিয়ে ইরার দু গালে হাত রেখে বলল, ‘আমার মনে হয় কালকেও আমি ফ্রি থাকব। কাল যাব আমরা। ঠিকাছে?’

হাত সরিয়ে দিল ইরা। অভিমানী গলায় বলল, ‘কাল আবার তোমার কাজ থাকবে। আমি জানি। দেখো, আজই নতুন কেইসের কল চলে আসবে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে।’

তুহিন ভালোভাবে তাকালো ইরার দিকে। অভিমানী মুখটা কী মিষ্টি লাগছে! লাল থ্রিপিস পরেছে আজ। ফর্সা হওয়ায় লালটা বেশ মানায় ওকে। পেছন থেকে শক্ত করে ইরাকে জড়িয়ে ধরল তুহিন। আদুরে গলায় বলল, ‘ আজ তাহলে আমরা বাড়িতে সময় কাটাই? বাইরে অনেক নয়েস আর পলুউশন। প্রেম প্রেম ভাব আসেনা। তার চেয়ে এখানেই ভালো না? কেউ থাকবেনা। শুধু তুমি আর আমি। ‘

ইরা এবার ঠোঁট চেপে হাসল। কিন্তু তুহিনকে বুঝতে দিলোনা। তুহিনের হাতের ওপর হাত রেখে বলল, ‘আজ মাহমুদা খালা নেই যে? কোথায় গেছে?’

‘দু’দিনের ছুটি নিয়েছে।’

‘খাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই?’

‘উহুম।’

‘খিদে পায়নি?’

তুহিন আল্লাদি কন্ঠে বলল, ‘খুব পেয়েছে।’

ইরা এখনো রেগে থাকার অভিনয় করেই বলল, ‘ছাড়ো! আমি রান্না করছি। একসঙ্গে খাবো। ঢং ছেড়ে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’

ইরার কানের পিঠে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিল তুহিন। ইরা মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেল রান্নাঘরে। তুহিন সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। এরপর ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিতেই দেখল, কোমরে ওড়না বেঁধে রান্না করছে ইরা। হাতে খুন্তি। তুহিন ভাবল, যদি ইরা জানতে পারে কেন আজ উঠতে দেরী হয়েছে; ওকে আস্ত রাখবে না। ঐ খুন্তি দিয়েই মারবে। সেই দৃশ্য কল্পনা করতেই শুকনো ঢোক গিলল তুহিন। গোয়েন্দা বিভাগের সবচেয়ে সাহসী ইনভেস্টিগেটর নাকি এই সাধারণ এক রমনীকে এতো ভয় পায়। ভাবা যায়!

#চলবে…

[ রাত একটার মধ্যে আরেকটা পর্ব দেব। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here