অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১৯.

0
3

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১৯.

মধ্যরাত। চারপাশটা শান্ত, নিরব। কনকনে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্যে প্রায় সবাই লেপ, কম্বলের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। একান্তই বাধ্য না হলে, তীব্র এই শীতে উষ্ণতাকে উপেক্ষা করে উঠবেনা কেউ।
ঘুম নেই রাশেদ আমেরের চোখে, আর না সে শুয়ে আছে। নিজের সেই ইজি চেয়ারটাতে গা ছেড়ে বসে আছেন। চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছেন একমনে। পরনে সাদা পাঞ্জাবী। ওপরে একটা কালো শাল জড়ানো। কপালে পড়া বার্ধক্যের রেখাদ্বয় আরও গভীর মনে হচ্ছে। ঘরটাও অন্ধকার করে রেখেছেন উনি। ড্রিম লাইটের লালচে কমলা আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। ছেড়ে দেওয়া শরীরটাকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে এলেন রাশেদ। শোনা গেল তার সেই গম্ভীর শক্তিশালী কন্ঠস্বর, ‘জাফর, ভেতরে আয়।’

দরজার ওপাশে থাকা জাফর অবাক হল। লোকটা কীকরে বুঝলো জাফর-ই এসেছে? যদিও এটা নতুন কিছুই না। কিন্তু রাশেদ আমের নামক মানুষটার অস্বাভাবিক সজাগ ইন্দ্রিয়, আর কিছু অদ্ভুত ক্ষমতার রহস্য আপন ছোট ভাই হয়েও আজ অবধি সমাধান করতে পারেনি জাফর। মানুষটা দুর্বোধ্য। কিছু মানুষ আছে, যারা সকলের চেয়ে আলাদা হয়। আমরা বুঝতে পারি তারা আলাদা; কিন্তু তাদের আলাদা হওয়ার কারণটা বিশ্লেষণ করতে পারিনা। সে কারণটা বিশ্লেষণ করা যায়না। জাফর দরজা ঠেলে ভেতরে এলো। এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘ভাইজান, ঘুমান নি এখানো?’

‘বস।’

জাফর বিছানার কোণে বসল। মিনিট খানেকের নিরবতা চলল অন্ধকার ঘরটায়। নিরবতা ভেঙ্গে রাশেদ বললেন, ‘এখনো জেগে আছিস যে? কিছু বলবি?’

জাফর এতক্ষণ রাশেদের প্রশ্নের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। কথা বলার সুযোগ পেয়ে আর অপেক্ষা করল না সে। বলল, ‘আমার মনে হচ্ছিলো আপনি জেগে আছেন। তাই দেখতে এলাম। শরীর ভালো আছে ভাইজান? আপনি তো প্রয়োজন না পড়লে রাত জাগেন না।’

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন রাশেদ। এতক্ষণ বন্ধ রাখা চোখদুটো খুলে তাকালেন জাফরের দিকে। এগিয়ে দিলেন সিগারেটের প্যাকেটটা। জাফর খানিকটা অপ্রস্তুত হল। ইতস্তত করে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল নিজের হাতে। একটা সিগারেট বের করতে করতে বলল, ‘রুদ্রর জন্যে চিন্তা হচ্ছে?’

রাশেদ চুপ থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন, ‘ মাছ ধরার জন্যে বরশিতে টোপ ফেলে কখনও কাউকে টোপের জন্যে চিন্তা করতে দেখেছিস? চিন্তা যদি করতেই হয়, তো মাছের জন্যে করে। অন্যকিছুর জন্যে নয়।’

কেঁপে উঠল জাফর। লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়েছিল সবে। ঠোঁটের মাঝে সদ্য জ্বালানো সিগারেটটা নিয়েই চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। এখন এখানে তৃতীয় কোন ব্যক্তি থাকলে রাশেদকে ‘জল্লাদ’ উপাধি দিতে বিন্দুমাত্র দেরী করতোনা। কিন্তু জাফর জানে রাশেদ কী এবং কেমন। রাশেদের মুখের কথাগুলো দিয়ে তাকে বিচার করা সম্ভব নয়। সে এক ভয়ানক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব, অন্তর্নিহিত সত্ত্বা। তাই চমকালেও নিজেকে সামলে নিতে বেশি সময় লাগল না জাফরের। দু আঙুল দিয়ে ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে বুক ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ল। বলল, ‘আমার মনে হয় কাঙ্ক্ষিত মাছটা চলে আসবে ভাইজান। কারণ টোপ হিসেবে রুদ্র আমের গেলে, মাছ বরশিতে আসতে বাধ্য। সঙ্গে টোপটাও অক্ষত থাকার সম্ভাবনা প্রবল।’

রাশেদ আমের হাসলেন। অ‍্যাশট্রেতে গুজে দিলেন শেষ হয়ে আসা সিগারেটের টুকরো। তারপর বললেন, ‘তোকে তো বলেছিলাম এই ফাঁকে সিঙ্গাপুর ঘুরে আয়। গেলিনা কেন?’

জাফর খানিকক্ষণ চুপ রইল। এরপর নিচু গলায় বলল, ‘আপনাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছা করছিল না ভাইজান। আমি জানি এ কয়েকদিন রাতে আপনি ঠিকভাবে ঘুমাতে পারবেন না।’

‘ তাই বলে সবসময় এখানে পড়ে থাকবি? বউ-ছেলের সাথেওতো মাঝেমাঝে দেখা করে আসা উচিত। তাইনা?’

‘ কথা হয় ওদের সাথে। আজকেও কথা বলেছি আমি।’ খানিকটা লজ্জিত কন্ঠে বলল জাফর।

রাশেদ ততক্ষণে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রাশেদ বললেন, ‘উচ্ছ্বাস এসছে?’

জাফর চুপ হয়ে গেল। ঐ ছেলে নিশ্চয়ই আজকে আবার বারে পড়ে আছে। রুদ্র নেই, কোন কাজ নেই। ঐ অলস, আরামপ্রিয় ছেলেটার জন্যে এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কী হতে পারে? কিন্তু রাশেদকে একথা বললে বেচারাকে এবার সত্যি সত্যিই এক সপ্তাহের জন্যে ঘরবন্দি করে রাখবে। জাফরের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রাশেদ নিজেই বললেন, ‘বুঝেছি। কালকে এলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিবি।’

জাফরের মায়া হল উচ্ছ্বাসের জন্যে। মুখখানা কাচুমাচু করে বলল, ‘আচ্ছা ভাইজান। তবে সময়টা এক সপ্তাহ না করে আরেকটু কম করলে ভালো হয়।’

‘তোর মনে হয় আরও কিছু বলার আছে?’ নিজের কালো চাপদাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল রাশেদ।

জাফর ভনিতা না করে সোজা কথা পাড়ল। ‘ ভাইজান, ব্লাক হোলকে আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেও ডার্ক নাইট কিন্তু আমাদের পেছনে পড়ে আছে বহুদিন হলো। এবং তারা ভীষণ চালাক। সরাসরি আঘাত করছে না, কিন্তু পেছন থেকে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। ওরা জানে যতদিন আপনি এই দলের মাথা থাকবেন আর রুদ্রর হাতে ক্ষমতা থাকবে, ততদিন সামনে থেকে আঘাত করা সম্ভব নয়।’

রাশেদ ঠোঁটে সামান্য রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘পেছন থেকেও পারবে না। তুই জানিস রুদ্রকে। ওর চোখে ধুলো দেওয়া অসম্ভব।’

জবাব দিলোনা জাফর। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তার। রুদ্র পেনড্রাইভটা সফলভাবে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে তো? নিরাপদে সুস্থভাবে গুলশান ফিরতে পারবে? পেনড্রাইভ আসুক বা না আসুক রুদ্র নিরাপদে আসলেই হল।

ছাদের দরজার একপাশে পানিভর্তি বালতি, আরেকপাশে ঝাটা; মাঝখানে অসহায়ভাবে বসে আছে উচ্ছ্বাস। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর টু কোয়ার্টার প্যান্ট। যার ষাট ভাগই পানিতে ভিজে গেছে। ওর বসে থাকার ধরনটাও ভীষণ অদ্ভুত। দুই হাটু ভাজ করে দুদিকে ছড়িয়ে; দুগালে দুহাত রেখে বসে আছে। এলোমেলো চুল, ঘুমে ঢলুঢলু চোখ। সব মিলিয়ে বেশ হাস্যকর দেখালেও সুন্দর লাগছে দেখতে। যাকে বলে হাস্যকর সুন্দর।

সেই ভোরবেলা থেকে গোটা আমের ভিলা নিজের হাতে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হয়েছে ওকে। সারারাত বার থেকে মদ গিলে এসছে, তারওপর চোখে একরাজ্যের ঘুম। কিন্তু এখন আবার ছাদটাও পরিষ্কার করতে হবে! ব্যপারটা মনে আসতেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে বনবাসী হতে ইচ্ছে করছে উচ্ছ্বাসের। হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সমস্যা হল এই বয়সে এভাবে কাঁদাও যাবেনা। প্রেসটিজ ইস্যু। কিন্তু এ কেমন অত্যাচার? ভেবেছিল সকাল সকাল বাড়ি এসে ঘরে গিয়ে শান্তির একটা ঘুম দেবে। কিন্তু হল কী?
বাড়ি ফিরে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছিল উচ্ছ্বাস। তখনই রাশেদ আমেরের ডাক পড়ল। বুঝে গেছিল ওর কপালে আজ ভয়ানক শনি আছে। রাশেদ বাবা টের পেয়ে গেছে যে ও সারারাত বাড়ি ছিলোনা। সেজন্যই ডাকছে। আর রাশেদ আমের যখন ডেকেছে, যেতে বাধ্য ও। উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে ঢোকে রাশেদ আমেরের ঘরে। গিয়ে দেখে রাশেদ বরাবরেই মতোই নিজের ইজি চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছেন। ও ভেতরে ঢুকতেই রাশেদ কোনরকম ভনিতা না করে, কোন কথা জিজ্ঞেস না করে একদম সরাসরি বলেন, ‘টেবিলে শরবত রাখা আছে। এক ঢোকে শেষ কর।’

উচ্ছ্বাস অসহায় মুখ করে তাকায় টেবিলের দিকে। দেখে খুব সুন্দরভাবে লেবুর শরবত করে রাখা আছে। ও জানে এটার স্বাদ জঘন্য হবে। কিন্তু রাশেদ বাবার আদেশ অমান্য করার সাহস, ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই ওর নেই। তাই কোনরকম কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ তুলে নেয় শরবতটা। কিন্তু শরবতটা মুখে দিতেই বুঝতে পারে ওর ধারণা ভুল ছিল। শরবতের স্বাদটা খারাপ ছিলো না। জঘন্যতম খারাপ ছিল। এক দানা চিনিও মেশানো হয়নি। শুধু প্রচুর পরিমাণে লেবু আর পানি, সাথে তেতো কিছু একটা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাশেদ আমেরের ধমকে সেই জঘন্য পানীয় বেচারাকে চোখ-মুখ খিচে একঢোকে শেষ করতে হয়েছে। শরবতটা শেষ করার সাথেসাথেই যেন সব উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইলো। গা গুলিয়ে বমি পেল। দ্রুতপদে ওয়াশরুমে গিয়ে গতরাতের সব ছাইপাশ উগলে দেওয়ার পরেই স্বস্তি পেল উচ্ছ্বাস। তবে এখানেই শাস্তিপর্বের ইতি ঘটেনি। আদেশ অমান্য করে, সারারাত বারে একা কাটানোর শাস্তিসরূপ গোটা আমের ভিলা নিজের হাতে পরিষ্কার করার দায়িত্ব উচ্ছ্বাসের হাতে তুলে দিয়েছেন রাশেদ। সেটাও সকাল আটটার মধ্যেই শেষ করতে হবে।

আটটা বাজতেই চলল। চরম বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল উচ্ছ্বাস। ঝাটা আর বালতিটা নিয়ে ছাদে গেল। চোখভর্তি অসহায়ত্ব নিয়ে তাকিয়ে রইল বিশাল ছাদটার দিকে। শরীরটা এখন আর নড়তেও চাইছেনা। কিন্তু সময় সল্পতার কথা মাথায় খেলতেই সব আলসেমি ঝেড়ে দ্রুত কাজে লেগে গেল। পরিষ্কার করতে করতে অসহায় মুখ করে একাই একাই বকে চলেছে উচ্ছ্বাস। বাচ্চাদের মতো অভিযোগের সুরে বলল, ‘এটা কোন কথা হল? একা একা বাড়িতে মন টিকছিলনা বলেইতো গিয়েছিলাম না-কি? এমনিতেই কাল নাজিফা একবার ঘুরেও তাকায়নি আমার দিকে। সেই দুঃখে মিনি দেবদাস হওয়ার অধিকারটাও কী আমার নেই? আশ্চর্য স্বৈরাচারী রাজ্যে বাস করছি ভাই। এই বাড়িতে দুঃখবিলাশ করাটাও পাপ। আগেরবার মৌখিক ওয়ার্নিং দিয়ে এবার সোজা লাল কার্ড? মাঝের হলুদ কার্ডটা কোথায় যাবে? সেটা দিলে কী হতো? সেটার সাথে এই অন্যায়টা কেন? এগুলোতো সরাসরি চিটিং। থাকবোই না আর এই বাড়িতে। এবার সত্যি সত্যিই বনবাসী হয়ে যাব।’

কথাগুলো একটানে বলে লম্বা শ্বাস নিতেই পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠের অট্টোহাসি শুনতে পেল উচ্ছ্বাস। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল কুহু আর জ্যোতি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে দুজন। হাসির শব্দটা জ্যোতির ছিল। কুহুও হাসছে, কিন্তু ওর হাসির শব্দ হয়না। কুহুর হাসিমুখটা দেখে উচ্ছ্বাসের ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেল। বোনের মুখে ফোটা ঐ নিষ্পাপ হাসিটা হয়তো সব ভাইকে এরকমই স্বস্তি দেয়। উচ্ছ্বাস মনে-প্রাণে কুহুকে নিজের বোন ভাবে। তবে স্বস্তিটাকে চেপে রাখল উচ্ছ্বাস। মুখ ফুলিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ হেসে নে, মন-প্রাণ খুলে হেসে নে। তোদেরই তো হাসার দিন। হাতি কাদায় পড়লে নাকি মশায়ও লাথি মারে। তোরাতো আস্ত দুটো মেয়ে।’

জ্যোতি কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, ‘বেশ হয়েছে। আরও বারে গিয়ে সারারাত মাতাল হয়ে পড়ে থাকো। তোমাকে যে এক সপ্তাহের জন্যে ঘরে আটকে রাখেনি, সেই ঢের।’

উচ্ছ্বাস ঝাটাটা একপাশে রেখে গাল ফুলিয়ে বলল, ‘রুদ্রর সাথে গেলেতো কিছুই বলেনা। একা গেলে কী সমস্যা সেটাই বুঝিনা। আমি কী বাচ্চা?’

কুহু হাসতে হাসতে হাতের ইশারায় কিছু বলল। উচ্ছ্বাস হতাশ কন্ঠে বলল, ‘দেখ বইন, তোর ঐ ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজ আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হয় লিখে দে, নয়তো জ্যোতি তুই বল এই মেয়ে নতুন কী বলে পঁচালো আমায়?’

জ্যোতি ঠোঁট চেপে একটু হেসে নিয়ে বলল, ‘ ও বলছে যে তোমার এই অবস্থাটার একটা সুন্দর ভিডিও করলে দারুণ হতো। নাজিফাকে ছোটখাটো একটা কমেডি ফিল্ম দেখানো যেতো।’

উচ্ছ্বাস চোখ পাকিয়ে তাকাল কুহুর দিকে। কুহু তখনও মিটমিটিয়ে হাসছে। উচ্ছ্বাস গিয়ে কুহুর কানটা হালকা করে টেনে ধরে বলল, ‘ফাজিল মেয়ে! দাঁড়া তোর সেকেন্ড ইয়ারটা শেষ হোক। রাশেদ বাবাকে বলে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি। বেশি পাকামি!’

জ্যোতি শাড়ির আঁচলের নিচটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে রেলিং এ হেলান দিল। সহাস্যে বলল, ‘কিন্তু মেয়েতো বড় হয়েছে, তারওপর সেই সুন্দরী। দেখা গেল নিজেই বর পছন্দ করে ফেলেছে অলরেডি।’

কুহু লজ্জায় একদম লজ্জাবতী লতার মতোই গুটিয়ে গেল বিয়ের কথা শুনে। ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে উঠল। চোখ নামিয়ে নিল সাথেসাথেই। তা দেখে জ্যোতি আর উচ্ছ্বাস দুজনেই হাসল। জ্যোতি গিয়ে কুহুর গালটা টেনে দিয়ে বলল, ‘লজ্জাবতী লতা আমার। ছুঁতেই নুইয়ে যায়।’

কুহু চোখ তুলে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল। ইশারায় বলল, ‘আমার বর তুমি আর ভাইয়া মিলেই পছন্দ করবে। আমার দুই ভাইয়ের পছন্দ না হলে আমি বিয়েই করব না।’

কুহুর কথাটা জ্যোতি বোঝালো উচ্ছ্বাসকে। শুনে হাসল উচ্ছ্বাস। স্নেহমাখা হাতটা কুহুর মাথায় বুলিয়ে বুকে জরিয়ে ধরে বলল, ‘মিষ্টি বোন আমার।’

জ্যোতি মনভরা তৃপ্তি নিয়ে দেখল এই দৃশ্য। কে বলেছে রক্তের সম্পর্ক থাকলেই কেবল আপন হয়? যদি তাই হতো, তবে ওর আর উচ্ছ্বাসের মতো বাইরের দুজন লোক এই বাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে পারতো না। আর না এই বাড়ির লোকগুলো ওদেরকে এতোটা আপন করতে পারতো। হঠাৎই উচ্ছ্বাসের মনে পড়ল আটটা বেজে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কুহুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ সর বোন, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। নইলে তোর হিটলার বাপ সত্যি সত্যিই এক সপ্তাহের জন্যে ঘরে আটকে রাখবে আমাকে। এক সপ্তাহ নাজিফাকে না দেখে থাকা অসম্ভব। আমি পারবোনা।’

জ্যোতি আর কুহু আবারও প্রাণখুলে হাসল উচ্ছ্বাসের অবস্থা দেখে। ইচ্ছে করছে বেচারাকে একটু সাহায্য করতে। কিন্তু রাশেদের কড়া আদেশ আছে, কোনরকম সাহায্য করা যাবেনা, করলে শাস্তি দ্বিগুণ। হঠাৎ কিছু ভেবে জ্যোতি বলল, ‘ উচ্ছ্বাস, রুদ্রর কোন খবর পেলে?’

উচ্ছ্বাসের হাত থামল। হাসি-মজা করে যে চিন্তাটা মনে চাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছিল সেটা এবার প্রকাশ পেল। উচ্ছ্বাসের চোখে-মুখে ফুটে উঠল স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। আজকের মধ্যে রুদ্র যদি ওদের সাথে যোগাযোগ না করে তবে বুঝে নিতে হবে রুদ্রর কোন বিপদ হয়ে কিংবা ও আর_। তখন দলের লোকেরা যাবে চট্টগ্রাম। রুদ্রর খোঁজে। এরকমটাই নির্দেশ দিয়ে গেছে রুদ্র। আজ যোগাযোগ করবেতো রুদ্র? নাকি_। কুহুও কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাসের চিন্তিত মুখ দেখে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। ওদের অবস্থাটা বুঝে উচ্ছ্বাস মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘না, তবে আজকের মধ্যে কল চলে আসবে। চিন্তা করিস না।’

কুহু এ জগত সম্পর্কে অজ্ঞাত তাই নিশ্চিত হলেও জ্যোতির চিন্তা কমল না। ও জানে রুদ্র সাক্ষাৎ মৃ-ত্যুর সঙ্গে খেলতে গেছে। উচ্ছ্বাস নিজেও চিন্তিত। না জানি এখন কোথায়, কেমন আছে রুদ্র।

শীতের সকাল। চারপাশের ঘন কুয়াশা ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে। উঁকি দিচ্ছে সূর্যের নরম আলো। ঠান্ডা শীতল আমেজ, পাখিদের বিরতিহীন কিচিরমিচির শব্দ। অর্ধনির্মিত বাড়ির ঘরটা এতক্ষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলেও এবার ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠল। বাইরে থেকে সূর্যের মৃদু আলো সরাসরি চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। ছোট্ট একটা অলস হাই তুলে চোখ পিটপিট করল। চারপাশে অবুঝ দৃষ্টি বুলালো একবার। কিন্তু এক অপরিচিত যুবকের বাহুবন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ দেখে চমকে উঠল মেয়েটা। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ধীরে ধীরে মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা। সব ঘটনাই আস্তে আস্তে চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠলো। কাল অস্বস্তিতে চোখ বন্ধ করে রাখতে রাখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠতে নিলেই বুঝতে পারল রুদ্র শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে। বিরক্তি নিয়ে রুদ্রর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাল প্রিয়তা। হঠাৎ স্থির হল ওর চোখজোড়া। আর বিরক্ত থাকতে পারল না। কোঁচকানো ভ্রুজোড়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠল। চোখে জমা হল সামান্য মুগ্ধতা। কালকে অন্ধকার আর নানারকম চিন্তায় এতকিছু মাথায় না আসলেও এই মুহূর্তে প্রিয়তা বুঝতে পারল ওর সঙ্গে থাকা এই পুরুষটি মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন। এই ছেলে কাল ওর চোখের সামনে অনায়াসে এতোগুলো মানুষের প্রা-ণ নিয়েছে! অথচ কী নিষ্পাপ মুখ। গভীরভাবে রুদ্রর মুখটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে কথাগুলো ভাবছিল প্রিয়তা। নিজের অজান্তেই এক হাতে ছুঁয়ে দিতে যাচ্ছিল রুদ্রর গাল। কিছু লোকের পায়ের শব্দ শুনে ও থমকে গেল ও। রুদ্র তখনও ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক এক করে আটজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরটাতে। ঢোকার সাথেসাথে আটজনই ওদের দিকে ব-ন্দু-ক তাক করল। প্রিয়তার চোখে আতঙ্ক দেখা গেল। যেন জমে গেছে হাত-পা। ততক্ষণে রুদ্রর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। চোখ খুলেই এই দৃশ্য দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হাত-পা জমে গেল রুদ্রর। কিন্তু নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্যেও কয়েক সেকেন্ডেই যথেষ্ট ছিল। প্রিয়তা ঐ অবস্থাতেই শক্ত করে আকড়ে ধরল রুদ্রকে। পুরো শরীর কাঁপছে মেয়েটার। তাদের একজন বলল, ‘এর সাথেতো মেয়েছেলেও আছে দেখছি।’

পরিস্থিতি বুঝে রুদ্র একহাতে আগলে নিল প্রিয়তাকে। আরেক হাতে পেছনের পি-স্ত-লে নিতে গিয়েও থেমে গেল। হিসেব মতো পিস্তলে তিনটে বু-লে-ট আছে। এরা আছে সশস্ত্র আটজন। এক্সট্রা ম্যাগাজিন ভরতে ভরতে এরা ওকে ঝাঝরা করে দেবে। সুতরাং পি-স্ত-ল বের করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবেনা। পুরো ব্যাপারটা মাত্র দু সেকেন্ডে চিন্তা করল রুদ্র। কাল রাতে ম্যাগাজিন চেঞ্জ করে না করে শোয়ার জন্যে মনে মনে এক ভয়ানক গালি দিল নিজেকে। প্রিয়তাকে একহাতে ধরে রেখেই আস্তে আস্তে উঠে বসল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখল সবাই স্বাভাবিক পোষাক পরা। তাহলে কী তাজওয়ারের লোক? এদিকে প্রিয়তা কেঁপেই চলেছে। রুদ্রর একদম বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ভদ্র ছেলেমেয়ের মতো উঠে দাঁড়াও দেখি দুজন।’

রুদ্র কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো। প্রিয়তাকেও ধরে দাঁড় করালো। প্রিয়তা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রুদ্রর হাত। রুদ্র ওদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আপনারা কারা?’

‘সেসব পরে বলছি। সাথে কোন অস্ত্র থাকলে ভালো ছেলের মতো আমার হাতে দিয়ে দাও দেখি।’ রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বাড়িয়ে দিল নিজের হাত।

রুদ্র পেছন থেকে পি-স্ত-লটা বের করে দিয়ে এগিয়ে দিল লোকটার হাতে। না দিলেও ওরা সার্চ করে ঠিক নিয়ে নিতো। অযথা নাটক বাড়ালোনা রুদ্র। তাছাড়া সার্চ করলে পেনড্রাইভটাও পেয়ে যেতো। এটা রক্ষা করাই ওর আসল উদ্দেশ্য। লোকটা এবার প্রিয়তার দিকে এগোতে গেলেই প্রিয়তাকে নিজের পেছনে আড়াল করল রুদ্র। ভদ্রভাবে বলল, ‘ওর কাছে কিছু নেই। ডোন্ট টাচ হার।’

লোকটা হাসল। হাসতে হাসতে তাকাল নিজের বাকি লোকগুলোর দিকে। তারাও হেসে দিয়েছে। লোকটা মুখে হাসি রেখেই বলল, ‘আমরা ক্রি-মি-নাল নই। খারাপ উদ্দেশ্যে নিয়ে কাউকে টাচ করব না। আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক।’

ভ্রু কোঁচকালো রুদ্র। সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। ঠোঁটে ফুটে উঠল অভিজ্ঞ হাসি। অনেকটা কৌতুক করে বলল, ‘এতোজন?’

লোকটা জবাব দিলোনা। পাশের কালো শার্ট পড়া একটা লোক বলল, ‘জঙ্গলের ভেতরের গোপন ঐ বাংলোতে আর তার আশেপাশে অনেকগুলো লা’শ পাওয়া গেছে। জঙ্গলে খুঁজতে গিয়ে কাঁদার ওপর পায়ের ছাপ পেয়েছি আমরা। সেটা সামনের ঐ রাস্তায় গিয়ে উঠেছে। সেখান থেকেই খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পৌঁছেছি। আর তোমাদের পেলাম। তাও আবার অ-স্ত্রসহ। তোমরা দুজন জঙ্গলের পাশে, এই নির্জন অর্ধেক হওয়া বাড়িতে কী করছিলে?’

রুদ্র এক মুহূর্ত দেরী না করে বলল, ‘আমরা বিয়ে করতে বেরিয়েছিলাম।’

প্রিয়তা চোখ বড়বড় করে তাকাল রুদ্রর দিকে। কী বলছে কী লোকটা? ধরা পড়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেল? রুদ্র বলল, ‘দুই বছরের সম্পর্ক আমাদের। কিন্তু আমি বেকার। তাই ওর বাড়ি থেকেতো মানছেইনা, উল্টে অন্যজায়গায় ওর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। তাই ওকে বলেছিলাম পালিয়ে বিয়ে করব। গতকাল রাতে দুজন পালিয়ে বেরিয়েও গিয়েছিলাম কিন্তু_’

‘কিন্তু?’ সন্দিহান কন্ঠে জানতে চাইলো কালো শার্ট পরা লোকটা। রুদ্র আবার বলতে শুরু করল, ‘কিন্তু রাস্তা থেকে কয়েকজন আমাদের দুজনকেই তুলে নিয়ে আসে ঐ জঙ্গলের ভেতরের বাংলোটাতে। আমাদের ব্যাগ, টাকাপয়সা, ওর গহনা সব রেখে দিল। ওদের কী উদ্দেশ্য ছিল আমরা জানিনা। কিন্তু হঠাৎই গো-লা-গু-লি শুরু হয়। ওরা কারা, কী করছিল, কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আমরা সাধারণ মানুষ। এসব কীকরে বুঝব? তবে মনে হচ্ছিলো দুই দলের মধ্যে ঝামেলা লেগেছে। আমরা কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়েছি ওখান থেকে। সেটা করতে গিয়ে গু-লিও খেয়েছি, দেখুন।’ নিজের বাঁ হাতের বাহু উঁচু করে দেখাল রুদ্র। ‘কিন্তু পথ ভুল করে আমরা এখানে চলে এসছি। রাতে কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না। তাই এখানে রাতটা কাটিয়ে দিতে হয়েছে। আর এই পি-স্ত-লটাও ওখানকারই একটা ডেডবডির কাছে পেয়েছি আমরা। আত্মরক্ষার জন্যে সাথে নিয়ে এসছি। এর বেশি কিছু না।’

ছয়টা ব-ন্দু-ক এখনো ওদের দিকে তাক করা। প্রথম লোকটা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল রুদ্রর কথা। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই বিশ্বাস করেছে কি-না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম?’

‘দ্বীপ, আমার নাম দ্বীপ। আর ওর নাম লতা।’

প্রিয়তা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কত অনায়াসে গড়গড় করে মিথ্যাগুলো বলে ফেলল। লোকটা খু’নি, হৃদয়হীন, চরিত্রহীন হওয়ার সাথেসাথেতো একটা আস্ত মিথ্যাবাদিও। এক অঙ্গে কত অপগুন!
প্রথম লোকটা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘তোমার কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এই মেয়েটা সাথে থাকায় পুরোপুরি অবিশ্বাসও করা যাচ্ছেনা। তাই আমাদের সাথে যেতে হবে তোমাদের। তোমাদের পরিবারের সাথে কথা বলে ব্যপারটা নিশ্চিত হব আমরা। এরপরে ঠিক করব তোমাদের ছাড়া যায় কি-না। নিয়ে এসো ওদের।’

প্রিয়তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ গাড় হল। লোকগুলোকে ডেকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রুদ্র ওর হাত চেপে ধরর। কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বোকামো করোনা। এরা একজনও স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক না। আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে ভুয়া পরিচয়ে এসছে। আমার থেকে এদের কাছে তুমি বেশি অনিরাপদ। তাই বলছি, চুপ থাকো। যদি বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকে তো।’

#চলবে…

[ রাতে আরেক পর্ব আসবে। রাত জাগার পাখি যারা আছেন তারা দুটোর পর পেইজে উঁকি দিয়ে যেতে পারেন। হ্যাপি রিডিং।]

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here