অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
২৩.
রাতের শেষ প্রহর। ফাঁকা, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রুদ্রর জিপ। প্রিয়তা মাথা নিচু করে বসে আছে। মুখে আওয়াজ নেই। ভয়ানক সেই থাপ্পড়ের পর আর একটা শব্দ উচ্চারণ করারও সাহস হয়নি ওর। চাবি দেওয়া পুতুলের মতোই পালন করেছে রুদ্রর প্রতিটা আদেশ। ‘এবার যাওয়া যাক?’ নামক সেই বিড়ম্বনামূলক বাক্য ছুড়ে দেওয়ার পর রুদ্র ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিল প্রিয়তা আর মীরাকে। ব্যাগ গোছানোর জন্যে। প্রিয়তার ব্যাগটাও মীরাই গুছিয়ে দিয়েছে। কারণ চড়ের ধাক্কাটা সামলানোর জন্যে পাঁচ মিনিট যথেষ্ট ছিলোনা। সেই লা-শটা ওখানে ফেলে আসার মতো বোকামি করেনি রুদ্র। খুব সতর্কতার সাথে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছিল। মীরাকে যখন লাশটার সঙ্গে জিপের পেছনে বসতে বলল; বেচারির ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ঘোর আপত্তি করার একটা জোরদার পরিকল্পনাও করেছিল। কিন্তু রুদ্রর চোখ রাঙানি দেখে সে জোরদার পরিকল্পনাকে জোর করেই দাফন করে ফেলেছে। যতক্ষণ লা-শটা গাড়িতে ছিল; মীরা খানিক বাদে বাদেই চোখ বড় বড় দেখছিল ওটাকে। ভয়ে বারবার ঢোক গিলেছে। মনে মনে যত দোয়া জানতো সব পড়ে ফেলেছে। মাঝরাস্তায় একটা ঝোপের মধ্যে খুব সাবধানে লাশটা ফেলে দিয়ে এসছে রুদ্র। অন্যসবার দৃষ্টির অলক্ষ্যে। মীরা হতবাক হয়ে দেখছিল শুধু। এরকম ঘটনার কথা শুধু মুভি বা থ্রিলার উপন্যাসেই শুনেছে। বাস্তবটাও এমন হয়! মীরাকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে বিদায় দেওয়ার সময় প্রিয়তা আর মীরা একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। যেন এ জীবনে আর দ্বিতীয়বার দেখা হবেনা। রুদ্রর ইচ্ছে করেছিল দুটোর মাথাই দেয়ালে ঠুকে দিতে। যত্তসব মেলোড্রামা।
মীরাকে নিরাপদে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি ঘুরিয়েছে রুদ্র। রাস্তা ফাঁকা পাওয়ায় গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। তীব্র বেগে আসা ঠান্ডা বাতাস আর মাঘের কনকনে শীতে চোখ খুলে রাখা দায় হলো রুদ্রর। ক্লান্তি তীব্র বেগে এসে ভর করেছে শরীরে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছনো প্রয়োজন। এসবের মধ্যেই প্রয়োজনীয় দুটো কল সেরে নিল রুদ্র। আড়চোখে একবার তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা দু’হাতের তালু ঘষে ঘষে নিজেকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছে। ঘাড় কাত করে একবার রুদ্রর গম্ভীর মুখের দিকে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্রকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। এখন কিছু জিজ্ঞেস করলে রেগে যাবে বলে মনে হচ্ছেনা। কিছু কথা জিজ্ঞেস করাই যায়। রেগে গেলে না হয় আবার চুপ হয়ে যাবে। নানারকম চিন্তাভাবনা করে প্রশ্নগুলো আপনমনে গুছিয়ে নিল প্রিয়তা। হালকা করে গলা ঝেড়ে বলল, ‘ আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
ঠান্ডার কারণে কেমন অদ্ভুত ছন্দে কেঁপে উঠল প্রিয়তার কন্ঠস্বর। রুদ্র মনে মনে হাসল। যাক, মহারাণী কথা বলেছেন তবে। কেন জানিনা রুদ্রর মনে হলো এই কন্ঠস্বর শোনার জন্যেই ও এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। কেন মনে হল ও জানেনা, কিন্তু মনে হল। তবে মুখে বলল, ‘আমার পরিচিত গ্যারেজ আছে একটা। সকালে যেখান থেকে জিপটা আনলাম, ওখানেই বাকি রাতটা থাকব আমরা। একটু আগে ওখানেই কল করেছিলাম। জিপ চালিয়ে গুলশান যাওয়ার মতো এনার্জি নেই এখন আমার। একটু বিশ্রাম নেব। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যে হোটেলে ওঠার কোন প্রয়োজন নেই।’
প্রিয়তা দু সেকেন্ড কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি গুলশান থাকেন?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ রাতে যদি ওরা আবার আসে?’ কথাটা বলার সময় সামান্য গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল প্রিয়তার। যেন খুব ভয় পাচ্ছে।
রুদ্র এবারেও নির্বিকার হয়ে জবাব দিল, ‘আসবেনা। ওরা জানে এখন কিছু করে কোন লাভ হবেনা। বড়জোর ফলো করবে। কিন্তু সকাল অবধি থাকতে পারবেনা।’
‘ কেন?’ বেশ কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন করল প্রিয়তা। জড়তা কেটে যাচ্ছে ওর।
‘ কারণ তাতে কোন লাভ হবেনা।’
প্রিয়তা অপলক তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। লোকটা ক্রিমিনাল হলেও কী চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী! যেমন চলন, তেমন বাচনভঙ্গি। সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলার কোন জায়গায়ই নেই। ইশ্ লোকটা যদি ক্রিমিনাল না হতো? আচমকাই রুদ্র বলে উঠল, ‘এভাবে দেখো না প্রিয়তা। প্রথম দর্শন থেকেই তোমার চোখদুটোর ওপর আমার দুর্বলতা। একবার তোমাকে আমার ভালোলেগে গেলে কিন্তু মৃ’ত্যু ছাড়া আর মুক্তি পাবেনা। পরিস্থিতি আমার অনুকূলে আছে বলে মনে হচ্ছেনা।’
প্রিয়তা হকচকিয়ে গেল। চোখ সরিয়ে নিল দ্রুতগতিতে।গালদুটো লাল হয়ে উঠল ওর। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে দৃষ্টি ফেলল দূরের গভীর অন্ধকারে। লজ্জা পেল না-কি? মৃদু হাসল রুদ্র। ওর মনোযোগ এখনো ড্রাইভিং এ। কিন্তু প্রিয়তার লজ্জামাখা মুখখানা দেখতে বড্ড ইচ্ছে হলো ওর। অদ্ভুত ইচ্ছে! গতকাল রাত থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে হচ্ছে রুদ্রর। সমস্যা কোথায়? পাগল হয়ে যাচ্ছে না-কি?
–
হঠাৎই মেসেজ টোন বেজে ওঠায় চমকে উঠল কুহু। কাল ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবেনা। তাই সারারাত জেগে পড়াশোনা করার পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী পড়াশোনাই করছিল মেয়েটা। কিন্তু ব্যঘাত ঘটাল এই ম্যাসেজ টোন। ঘড়ি দেখে অবাক হল কুহু। এতোরাতে ওকে কে মেসেজ করবে? ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে একটা আননোন নাম্বার থেকে এসেছে মেসেজটা কুহু। ঠোঁট উল্টে দু সেকেন্ড ভাবল। মেসেজটা ওপেন করে বিস্মিত হল ও। মেসেজে লেখা আছে,
I’m so sorry Kuhu
~Nirob
মেসেজটার দিকে বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকাতে রইল কুহু। এরমধ্যেই পাশে শুয়ে থাকা জ্যোতি চোখ বন্ধ রেখেই জ্যোতি বলে উঠল, ‘কীরে? রাতবিরেতে প্রেমিক মেসেছ পাঠাচ্ছে বুঝি? সেদিন তাহলে ঠিকই বলেছিলাম?’
কুহু ভ্রু কুঁচকে তাকাল জ্যোতির দিকে। ফোনটা রেখে দিল সাইডে। বইখাতা সব বন্ধ করে গুছিয়ে রাখল। জ্যোতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল চুপচাপ। জ্যোতি হাসল। মেয়েটা একদমই বাচ্চার মতো। সরল, নিষ্পাপ। সবাইকেই ভালোবেসে আপন করে নেয়। শুধু মুখ ফুটে কথাটাই বলতে পারেনা।
–
গ্যারেজের সাথে জোড়া লাগানো একচালা একটা টিনের ঘর। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে রুদ্র আর প্রিয়তার। গ্যারেজের মালিক ওদের নিজের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু রুদ্র রাজি হয়নি। মাত্র কয়েকঘন্টা বিশ্রাম করবে। তাই শোয়ার একটা জায়গা হলেই চলবে। কারো বাড়িতে গিয়ে ঝামেলা করতে চায় না। ঘরটা টিনের হলেও বেশ বড়। নিচে ইট সিমেন্টের ফ্লোরিং করা। ফ্লোরে তোষক পাতা। সাথে লেপ আর বালিশ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। যাক, কয়েকঘন্টা শান্তিতে ঘুমানো যাবে। ঘরটার এক কোণে স্টিলের প্লেট, গ্লাস, জগ সব রাখা আছে। তবে কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। জ্বালিয়ে রাখা একটা হারিকেন ঝুলিয়ে রাখা আছে খুটির সাথে।
রুদ্র আর প্রিয়তা ঘরটাতে চোখ বুলাতে বুলাতেই গ্যারেজের মালিক সোনা মিঞা চলে এলো খাবার নিয়ে। তার বয়স বত্রিশ। তবে চুলে এখনই হালকা পাক ধরতে শুরু করেছে। সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা। তবে স্বাস্থ্য ভালো। তার ভালো নাম জানা নেই রুদ্রর। সবার মতো ও নিজেও সোনা মিঞা বলেই ডাকে। সোনা মিঞাকে দেখে রুদ্র বলল, ‘আমাদের এতেই চলে যাবে। শুধুশুধুই চিন্তা করছিলে তুমি।’
সোনা মিঞা দাঁত বের করে হাসল। তারপরেই চেহারায় ইতস্তত ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘ আসলে ভাই,আপনের তো এইসব জায়গায় ঘুমানের অব্বাশ নাই। আবার ভাবি আছে লগে।’
ভাবি ডাকটা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল প্রিয়তার। কিন্তু কিছু বলল না। রুদ্রও চুপ থাকল। সোনা মিঞা খাবারের প্যাকেটটা রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিল। খানিকটা লজ্জিত কন্ঠে বলল, ‘এতো রাইতে আর কিছু পাইলাম না ভাই। রুটি আর সবজি আছে।’
রুদ্র হালকা হেসে বলল, ‘এতেই চলবে।’
‘ আর ভাই, ঐযে কোণায় থালাবাডি সব আছে। জগে পানিও ভরা আছে। আসলে বেশিরভাগ দিনই রাইত এইহানে থাকা পড়েতো, সবকিছুই রাইখা দেই। কহন কোনডা লাইগা যায়।’
রুদ্র খাবারের প্যাকেটটা নিচে রাখতে রাখতে বলল, ‘ ভালো করেছো। এবার তুমি যেতে পারো। সকালে দেখা হবে।’
সোনা মিঞা আবার দাঁত বার করে হাসল। ‘ আইচ্ছা! যাই তাইলে ভাই? সাবধানে থাকবেন।’
সোনা মিঞাকে বিদায় দিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিল রুদ্র। তোষকের ওপর গিয়ে আসাম করে বসল। প্রিয়তা তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র একপলক দেখল ওকে। কেমন অসহায় অসহায় মুখ। এই মুহূর্তে অসহায়ই বটে। রুদ্র কিছুটা আওয়াজ করেই বলল, ‘এইযে ম্যাডাম! দয়া করে ওখান থেকে প্লেট আর জগ-গ্লাস নিয়ে আসুন। খেয়ে একটু ঘুমাবো আমি।’
হঠাৎ কথা বলাতে চমকে উঠেছিল প্রিয়তা। তবে কিছু বলল না। চুপচাপ গিয়ে থালা, জগ, গ্লাস সব নিয়ে এলো। খাবার সার্ভ করার কাজটাও ওকেই করতে হলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কোনদিকে তাকাল না রুদ্র। জ্যাকেকটা ছেড়ে লেপের নিচে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হল। প্রিয়তার দিকে চোখ পড়তেই দেখল দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। রুদ্র বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, ‘লিসেন, তোষক একটাই আছে। সুতরাং শেয়ার করা ছাড়া আর কোন অপশন নেই। তোষক আর লেপ দুটোই যথেষ্ট বড়। মাঝে প্রচুর ডিসটেন্স রেখে ঘুমাতে পারবে।’
কথাটা শুনেও প্রিয়তার দ্বিধা কেটেছে বলে মনে হলোনা। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ও। রুদ্র বলল, ‘ ভয় পেওনা। রে-প করবো না তোমাকে। এইমুহূর্তে সেরকম কিছু করার মুড বা এনার্জি; কোনটাই আমার নেই। সুতরাং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরো। আর হ্যাঁ, আসার আগে হারিকেনটা নিভিয়ে দিও।’
কথাটা বলে চোখ বন্ধ করে ফেলল রুদ্র। সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ওর, শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, মাথাটা ব্যাথা করছে, চোখের পাতা ভার হয়ে আসছে। আর চোখ মেলে রাখা সম্ভব আর হলোনা। গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেল রুদ্র। এক নারীর কোমল স্নেহের কথা মনে পড়ল, উষ্ণ আদরের কথা মনে পড়ল। উষ্ণ কোলে ওর মাথা তুলে নিয়েছে সে, পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর মাথা। মিষ্টি কন্ঠের মধুর গানে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। সে নারীটি রুদ্রর মা।
রাত সাড়ে চারটার দিকে ধুম জ্বর এলো রুদ্রর। প্রিয়তার ঘুম ভাঙল অস্ফুট স্বরে কারো ডাকার আওয়াজে। রুদ্র ঘুমানোর পর তোষকের এক কোণে গুটিয়ে শুয়ে পড়েছিল ও। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। তবে ঘুমটা তেমন গভীর ছিলোনা। পাশে তাকিয়ে দেখল ঘুমের ঘোরেই কিছু একটা বলছে রুদ্র। অস্ফুট স্বরে। প্রিয়তা উঠে বসল। দ্বিধা নিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেল রুদ্রর দিকে। এগিয়ে বুঝলো, রুদ্র স্বস্তি পাচ্ছেনা। কোন কারণে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা। প্রিয়তা নিজের অজান্তেই হাত রাখল রুদ্রর মায়ায়। কপালে হাতের ছোঁয়া পড়তেই চমকে উঠল প্রিয়তা। রুদ্রর যে জ্বর এসেছে সেটা বুঝতে আর বা-কি রইল না। ওর হাতের ব্যান্ডেজটার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। বিড়বিড় করে বলল, ‘হাতে এমন আঘাত নিয়ে, এই কনকনে শীতের রাতে এভাবে ছোটাছুটি করে বেড়ালে জ্বরের কী দোষ?’
কিছুক্ষণ রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল প্রিয়তা। হঠাৎ কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠল ও। উঠে গিয়ে হারিকেন জ্বালালো। একটা স্টিলের বাটিতে পানি ঢেলে আনল। নিজের ব্যাগ খুলে একটা রুমাল বের করে রুদ্রর মাথার কাছে বসল। সময় নষ্ট না করে রুদ্রর মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করল রুদ্রর কপালে। জ্বরটা সত্যিই খুব বেশি।
ভোর হয়ে আসছে। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়তা জলপট্টি দিতে দিতে অপলক তাকিয়ে আছে রুদ্রর মুখের দিকে। হারিকেনের আলোয় তেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা মুখটা। কিন্তু খানিক পরপরই রুদ্র বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। প্রিয়তা প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরে মনে হল রুদ্র হয়তো কিছু চাইছে। কিছু প্রয়োজন ওর। তাই রুদ্রর মুখের কাছে কান পাতল প্রিয়তা। কথা স্পষ্ট শোনার জন্যে। তবে তেমন কিছুই শুনতে পেলোনা। শুধু একটু বাদে বাদে অস্ফুট স্বরে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকছে রুদ্র। হঠাৎ ভীষণ মায়া হল প্রিয়তার। ওর মা নেই। তাই মা শব্দটার প্রতি ও বরাবরই দুর্বল। রুদ্রও হয়তো এখন ওর মাকে মিস করছে। রুদ্রর মা কী বেঁচে আছে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কপালে জলপট্টি রেখে দিয়েই রুদ্রর মাথাভর্তি চুলে আলতো করে হাত বোলালো প্রিয়তা। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখের দিকে। কে বলেছিল এই ছেলেটাকে স-ন্ত্রা-স জগতে যুক্ত হতে? ক্রিমিনাল হতে? না হলে এতক্ষণে নির্ঘাত এই ছেলের প্রেমে পড়ে যেতো। রুদ্রর পরিচয় নিয়ে অকারণেই প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে প্রিয়তার।
ঘুম ভেঙ্গে গেল রুদ্রর। কিন্তু মাথায় কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করে পরম শান্তিতে আবার চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছে হল। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল। কিন্তু সেটা করল না ও। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাল। চোখ মেলতেই দৃষ্টি পড়ল প্রিয়তার চোখে। যেই চোখ রুদ্রর পাথরের মতো হৃদয়কেও কিছুটা নাড়াতে পেরেছিল বোধ হয়। হারাকিনের হলদে আলোয় আরও গভীর, মোহনীয় লাগছে চোখজোড়া। রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই চোখের গভীরে। রুদ্রকে তাকাতে দেখে প্রিয়তা জলপট্টি সরিয়ে নিল। আলতো করে রুদ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এখন কেমন লাগছে আপনার?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। এখনো গভীরভাবে দেখছে ও প্রিয়তাকে। কিছুক্ষণের মৌনতার পর হঠাৎই একটানে প্রিয়তাকে নিজের বুকের ওপর ফেলল রুদ্র। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠল প্রিয়তা। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র ক্লান্ত কন্ঠে বলল, ‘পরিস্থিতি কিন্তু এখন সত্যিই আমার অনুকূলে নেই প্রিয়। মৃত্যুর আগে তোমাকে ছাড়া যাবে কি-না; এবার ভাবতে হচ্ছে।’
#চলবে…
[ কী মনে হয়? আমের সাহেবকে প্রেমরোগে ধরেছে তবে? ]
