অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
২০.
ভোরের কুয়াশা কেটে গেছে অনেক্ষণ। তেজহীন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ ক্ষেতজুড়ে। হলুদ শর্ষে ফুলের ওপর সোনালী রোদের আলো চমৎকার লাগছে। ক্ষেতের মাঝখানের সরু পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে রুদ্র-প্রিয়তা। পেছন পেছন আসছে নিজেদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বলে দাবী করা সেই আটজন। তারা রুদ্র আর প্রিয়তাকে খুব ভালোভাবে সাবধান করে দিয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে কোনরকম চালাকি না করার। পালানোর চেষ্টা করলেই সোজা গু-লি করে দেবে। প্রিয়তা রুদ্রর ডান হাত নিজের দুহাতে আকড়ে ধরে রেখেছে। গুটিয়ে হাঁটছে ও। গায়ে আবার জড়িয়ে নিয়েছে রুদ্রর সেই জ্যাকেট। রুদ্রর মুখে যখন শুনেছে এরা কেউ পুলিশের লোক নয় তখন থেকে চুপ করেই আছে। দেখে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। হয়তো এতো অসহায়ত্ত্বের মধ্যে রুদ্র নামক এই ভয়ংকর লোকটার ওপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই ওর কাছে।
অথচ রুদ্র নির্বিকার। চোখে-মুখে চিন্তিত হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। শান্ত ভঙ্গিতে চুপচাপ সেদিকেই হেঁটে যাচ্ছে যেদিকে তাকে যেতে বলা হচ্ছে। প্রিয়তা অবাক হচ্ছে এই লোকটার উদাসীনতায়। এরা যদি পুলিশের লোক না হয় তাহলে রুদ্রকে নিয়ে গিয়ে মে-রে ফেলবে ওরা। এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। এই কথাটা প্রিয়তা বুঝতে পারছে অথচ রুদ্র বুঝতে পারছেনা?
কিন্তু রুদ্র জানে সে মোটেও চিন্তামুক্ত নয়, আর না সে শান্ত আছে। দ্রুত চিন্তা চলছে রুদ্রর মস্তিষ্কে, ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে আছে ও। বাইরে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রেখেছে। কারো বোঝার ক্ষমতা নেই ওর ভেতরে কী চলছে। এই গুনটা হয়তো রাশেদের কাছ থেকে জেনেটিক্যালি পেয়েছে রুদ্র। রুদ্র জানে ওকে জামাই আদর করতে নিয়ে যাচ্ছেনা এরা। ওকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে সার্চ করা হবে। তাতে পেনড্রাইভটা না পেরে যেকোনভাবে টর্চার করে প্রথমে পেনড্রাইভটা কেড়ে নেবে। এরপর ওর মৃ-ত্যু অবধারিত। কিন্তু এরা কারা? ব্লাক হোলের লোক? নাকি অন্যকোন দল? এদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচবে কীকরে? এই মুহূর্তে ওর হাতে কোন অ-স্ত্র নেই। কিন্তু ওর প্রতিদ্বন্দ্বিদের প্রত্যেকের হাতে ব-ন্দু-ক। তারওপর সাথে এক্সট্রা ঝামেলা হিসেবে প্রিয়তা মেয়েটাতো আছেই। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। নানারকম চিন্তাভাবনা করতে করতে মাটির কাঁচা রাস্তাটাতে এসে পৌঁছালো ওরা। ওখানে খালি একটা জিপ রাখা আছে। রুদ্র বুঝলো এটা ওদেরই জিপ। আটজনের মধ্যে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা লোকটাই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। লোকটা স্বাস্থ্যবান, লম্বা, মাথায় টুপি পরা। কালো পোশাক পড়া লোকটা প্রিয়তাকে জিপের পেছনে উঠে বসার জন্যে ইশারা করল। প্রিয়তা ভীত দৃষ্টিতে একবার তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র চোখের ইশারায় ওদের কথা মানতে বলল প্রিয়তাকে। প্রিয়তার তাই করল। প্রিয়তা উঠে বসার পর রুদ্র উঠতে নিলেই ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা বলল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো খোকা? তোমাকে ফন্ট সিটে এসে বসতে হবে। চলে এসো।’
রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো। ভ্রু কুঁচকে রেখেই তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ছলছল চোখে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সে দৃষ্টি স্পষ্ট অনুরোধ করছে ওকে এদের মাঝে একা ফেলে রুদ্রকে সামনে না বসতে। রুদ্র কঠিন স্বরে বলল, ‘দেখুন, আপনারা পুলিশের লোক। তাই কোনরকম প্রতিবাদ না করে আপনাদের কথামতো আমরা কাজ করছি। আপনাদের সহযোগিতা করার জন্যে। তারমানে এই নয় যে আপনারা যা ইচ্ছা বলবেন, আর আমরা তাই করব। আপনি ভাবলেন কীকরে আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে একা, এভাবে, এদের মাঝে পেছনে বসতে দেব?’
কালো শার্ট পরা লোকটা শব্দ করে হাসল। বাকি সবাইও তাল মেলালো সেই হাসিতে। যেন রুদ্র দারুণ কোন কৌতুক করেছে। লোকটা এগিয়ে এসে রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চুপচাপ যেটা বলছি সেটা করো। বেশি প্যাঁচাল পছন্দ না আমাদের।’
রুদ্র লোকটার চোখে চোখ রাখল। স্থির, কঠোর দৃষ্টি। রুদ্রর চোখের গভীর তীক্ষ্মতায় খানিকটা চমকে উঠল কালো পোশাক পড়া ব্যাক্তিটি। কিন্তু সাথেসাথেই সামলে নিল নিজেকে। প্যান্টের পেছনের হোলস্টার থেকে পি-স্ত-লটা বের করে বলল, ‘আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক নই। আর তুমি সত্যি সত্যি দ্বীপ না-কি রুদ্র আমের সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। না হলে তোমাকে এখানেই মে-রে পেনড্রাইভটা নিয়ে চলে যেতাম। যদিও আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে তুমিই রুদ্র। কিন্তু সাথে থাকা এই মেয়েটার জন্যে এখনো শতভাগ নিশ্চিত হতে পারছিনা।’
প্রিয়তা চোখ বড়বড় করে তাকাল। কিন্তু রুদ্র এদের কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব করে বলল, ‘পেনড্রাইভ? কীসের পেনড্রাইভ? আর আপনারা পুলিশের লোক নন? তাহলে আমরা আপনাদের সাথে কেন যাচ্ছি? ফাজলামি করছেন আমাদের সাথে? আপনাদের কী মনে হয়? আপনাদের এসব নাটক দেখার জন্যে আমরা হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে আছি? আজাইরা, সময় নষ্ট। লতা নেমে এসো তো। ফালতু লোকজন।’
প্রিয়তা নামতেই যাচ্ছিল, একজন লোক হাত দিয়ে বাঁধা দিল ওকে। মেয়েটা কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছেনা তাই চুপ করে আছে। কালো শার্টের লোকটা নিজের পি-স্ত-ল রুদ্রর কপালে ঠেকালো। অতঃপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘একদম বেশি লাফিয়ো না বাছা। আমাদের কথামতো না চলতে পারলে এখানেই খেল খতম করে দেব।’
ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলল, ‘ভালো বাচ্চার মতো যা বলছে সেটা করে ফেলো। তুমিও জানো এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তোমার কাছে।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। ও জানে সত্যিই এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আপাতত ওকে এদের কথামতোই চলতে হবে। তাই আর ঝামেলা না করে বলল, ‘বেশ! আমি বসছি। কিন্তু ওর গায়ে কেউ হাত লাগানোর সাহস করবেন না।’
লোকগুলো প্রিয়তার দিকে আবারও একবার দৃষ্টি বুলালো। একদম গুটিয়ে বসে আছে মেয়েটা। দুচোখে আতঙ্ক, ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। কালো পোশাক পরা লোকটা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো প্রিয়তাকে। তারপর নিজের থুতনি চুলকে বলল, ‘মেয়েটা সুন্দরী। কিন্তু ওর সাথে কোনরকম কিছু করার ইচ্ছে বা সময় কোনটাই এখন আমাদের নেই। তবে ওর গায়ে হাত লাগাবো কি-না সেটা নির্ভর করছে তুমি কতটা ভালো ছেলে হয়ে থাকছো তার ওপর।’
রুদ্র আর কিছু বলল না। প্রিয়তার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল ওকে। তারপর চুপচাপ উঠে বসল জীপের ফ্রন্টসিটে। একটা লোক এসে খুব শক্ত করে বেঁধে দিল ওর হাত। তবে পেছন মোড়া করে নয়। সামনেই বেঁধেছে। বাকিরাও আর দেরী না করে উঠে বসল গাড়িতে। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটা গাড়ি স্টার্ট করল।
মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িটা। গাড়ির গতি মাঝারি। পাশে খোলা ক্ষেত থাকায় প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া আসছে। রুদ্রর গায়ে কোন গরম কাপড় না থাকায় শীত লাগছে প্রচুর। এতো ঠান্ডায় কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছেনা ওর। তারওপর হাতের ব্যাথাটা বেড়েছে। ভার হয়ে আছে বাঁ হাতের বাহু। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও সম্ভব নয় এখন। কিছু একটা করতে হবে এবং সেটা দ্রুত। প্রায় পাঁচমিনিটের নিরবতার পর রুদ্র ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী হাইওয়ের দিকে যাচ্ছে?’
‘ হ্যাঁ।’ নির্বিকারভাবে জবাব দিল লোকটা।
‘ আপনারা কারা?’
‘ কিছুক্ষণ পরে এমনিতেই তোমাকে মে-রে ফেলা হবে। বাঁচা তোমার পক্ষে অসম্ভব। আর মৃ-ত্যুপথযাত্রীর কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে নেই। তাই বলছি, আমরা ডার্ক নাইটের লোক।’
রুদ্র আবার চুপ হয়ে গেল। মস্তিষ্কে জোর দিতে শুরু করল। ডার্ক নাইট! সর্বনাশ! হাইওয়ে ওঠার আগেই এদের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রিয়তা। মেয়েটাকে এদের মাঝে একা ফেলে যাওয়া সম্ভব না। এমন কিছু করতে হবে যাতে দুজনেই পালাতে পারে, কিন্তু কীভাবে? নিজের হাতের বাঁধনের দিকে খুব গভীরভাবে একবার তাকাল রুদ্র। ঠোঁটে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি। আপাতত আর কিছু বলার ভাবার প্রয়োজন মনে করল না রুদ্র। যা ভাবার ও ভেবে নিয়েছে।
দু মিনিটের মধ্যেই কালো শার্ট পরা লোকটার ফোনে কল এলো। ফোন রিসিভ করে কিছু বলল না লোকটা। কেবল ওপাশের ব্যক্তির কথাগুলো শুনে গেলো গা ছাড়া ভাবে। শেষে ‘ আচ্ছা’ বলে ফোনটা রেখে দিল। ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গাড়িটা থামিয়ে দাও বস। মনে হয় আর এগোনোর কোন প্রয়োজন নেই।’
হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল যেন রুদ্রর। সময় হয়ে গেছে! যা করার এখনই করতে হবে। জিপটা থামতেই লাফিয়ে নেমে এলো কালো পোশাক পড়া লোকটা। এগিয়ে এসে জিপের ওপর এক হাতের ভর দিয়ে তাকাল সামনের সিটে বসে থাকা রুদ্রর দিকে। রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল লোকটা তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রুদ্রর চোখে চোখ পড়তেই লোকটা হিংস্র এক হাসি হেসে বলল, ‘নাইস টু মিট ইউ মিস্টার রুদ্র আমের।’
রুদ্র চোখ সরালোনা। বিন্দুমাত্র বিচলিত হলোনা। কারণ জিপ থামার সাথেসাথে ও বুঝে গিয়েছিল ও ধরা পড়ে গেছে। নিজের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়েছে ও ইতিমধ্যে। কিন্তু প্রিয়তার অবস্থা নাজেহাল। কেঁদে ফেলার মতো চেহারা করে আছে মেয়েটা।
ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটাও নেমে গেল জিপ থেকে। মুখে বিকৃত হাসি। রুদ্রর দিকে একবার ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে লোকটা বলল, ‘সেটাতো আগেই মোটামুটি বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু শিওর কীকরে হলে?’
কালো শার্ট পরা লোকটা বলল, ‘ছবি পাঠিয়েছে একটু আগেই। এই সেই রুদ্র আমের। পেনড্রাইভটা ওর কাছেই আছে। সার্চ করে পেনড্রাইভটা বের করে নিতে বলেছে। পেনড্রাইভটা হাতে পেলে এই জঙ্গলেই একে খু-ন করে লা’শ পুতে ফেলার অর্ডার দিয়েছে বস।’
অপর লোকটা ঘাড় বাঁকা করে ঝুঁকে তাকাল প্রিয়তার দিকে। তারপর বলল, ‘রাশেদ আমের দলে আজকাল মেয়েছেলেও নিচ্ছেন নাকি? এমন সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের মে-রে ফেলতে ইচ্ছে হয়? কী আর করার? ডিউটি ইজ ডিউটি।’
কথাটা বলে ইশারা করল লোকটা। দুজন লোক প্রিয়তাকেও টেনে নামাল জিপ থেকে। প্রিয়তা কেঁদে ফেলেছে ইতিমধ্যে। জিপ থেকে নামানোর পর অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। এক অজানা কারণেই রুদ্রর ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মেয়েটা। রুদ্রকে টেনে নামাতে হলোনা। নিজেই চুপচাপ নেমে এলো। রুদ্রর নির্বিকার চলন দেখে হাসল সেই দুজন। কালো পোশাক পড়া লোকটা বলল, ‘এটাই রুদ্র আমের। কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত মৃ-ত্যু আছে জেনেও সে নির্বিকার থাকতে। প্রশংসনীয়!’
রুদ্র কিছু বলল না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকদুটোর দিকে। কালো শার্ট পরা লোকটা হাত ধরে টেনে জিপের পাশে একটা গাছে সাথে দাঁড় করিয়ে দিল রুদ্রকে। পাশে এনে দাঁড় করালো প্রিয়তাকেও। প্রিয়তা তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। কিন্তু রুদ্র তাকায়নি। কালো শার্ট আবার নিজের দলের দুজন লোককে ইশারা করর। রুদ্রকে পুরোটা সার্চ করতে হবে। দুজন এগিয়ে গেল রুদ্রর দিকে। কিন্তু রুদ্র কোনরকম বাঁধা দিলোনা। বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। মাথা থেকে পা অবধি পুরোটা খোঁজার পরেও কিছুই পাওয়া গেলোনা রুদ্রর কাছে। ভ্রু কুঁচকে গেল কালো শার্ট পরা লোকটার। নিজেই এবার এগিয়ে এলো রুদ্রর কাছে। হাতের পি’স্ত’লটা জিপের বুটের ওপর রাখল। নিজের দুহাত দিয়ে খুব ভালোভাবে আরেকবার খুঁজলো। পেনড্রাইভটা না পেয়ে পেছন ঘুরে সেই প্রথম লোকটার উদ্দেশ্যে না বোধক মাথা নাড়ল। লোকটা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ‘পেনড্রাইভটা নেওয়ার পর রুদ্র এখানো এই জঙ্গল থেকে বের হতে পারেনি। অর্থাৎ পেনড্রাইভ ওদের কাছেই আছে। মেয়েটাকে চেক করো। ওর কাছে থাকতে পারে।’
প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেঁদে চলেছে ও। অসহায় মুখ করে বারবার তাকাচ্ছে রুদ্রর দিকে। কিন্তু রুদ্র এবারও ফিরেও তাকাল না প্রিয়তার দিকে। ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে রইল ওভাবেই। কালো শার্ট পরা লোকটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে এস্র বলল, ‘চুপচাপ পেনড্রাইভটা বের করে দাও। নয়তো নিজের হাতে আমাকে এই জঘন্য কাজটা করতে হবে।’
প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে গেল। কান্নামাখা গলায় বলল, ‘কীসের পেনড্রাইভ? আমার কাছে কিছু নেই। আমি এসবের কিছু জানিনা। আমি এই লোকটাকে চিনিও না। প্লিজ আসবেন না এদিকে।’
কিন্তু লোকটা প্রিয়তার কথা আমলে নিলোনা। এগিয়ে এসে প্রিয়তার গায়ের জ্যাকেটে হাত দিতেই প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে কেঁদে ফেলল। রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়া দিল নিজের হাত। খুব সাবলীলভাবে হাতে বাঁধা দড়িটা খসে পড়ল নিচে। যেন এতক্ষণ খোলাই ছিল। মুক্ত হওয়ার সাথেসাথেই এক ঝটকায় বুটের ওপর রাখা পি-স্ত-লটা নিয়ে সোজা কালো পোশাক পড়া লোকটার মাথা বরাবর গু-লি ছুড়লো রুদ্র। আকস্মিক এই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। কিন্তু রুদ্র ততক্ষণে আরও দুজনের মাথায় গু-লি করে দিয়েছে।
‘জিপের পেছনে গিয়ে লুকোও। ফাস্ট!’
রুদ্রর আদেশে প্রিয়তা দৌড়ে লুকিয়ে পড়ল জিপের পেছনে। বাকিরা নিজের পি-স্ত-ল তুলতে তুলতে নি’হ’ত একজনের কাছ থেকে আরেকটা পিস্তল তুলে নিয়েছে রুদ্র। জিপের পেছনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পেছাতে পেছাতে দুহাতে দুটো পি-স্ত-ল দিয়ে আরও চারটা গু’লি ছুড়ে দিল। চারটার মধ্যে তিনটে বু-লে-টই নিজের লক্ষ্য ভেদ করতে সক্ষম হল। ওপাশ থেকে ছুটে আসা তিনটে বু-লে-টের দুটো মিস হলেও তৃতীয় বু-লে-টটা রুদ্র কানের কাছ দিয়ে গেল একদম। আরেকটু হলে সোজা রুদ্রর মাথায় লাগতো। জিপের পেছনে লুকিয়ে পড়ল রুদ্র। প্রতিপক্ষের দুজন এখনো জীবিত। আরও দু মিনিট চলল পি-স্ত-ল যুদ্ধ। জয়টা রুদ্র আমেরের-ই হল।
এতক্ষণের অশান্ত পরিবেশটা হঠাৎ অতিরিক্ত শান্ত হয়ে গেল। একদম নিঃশব্দ। একটা পাতা পড়লেও যেন আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাবে এখন। পি-স্ত-লের ট্রিগারে আঙুল রেখেই জিপের আড়াল থেকে খুব সাবধানে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল রুদ্র। হ্যাঁ সবগুলোই শেষ। হাঁফ ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল রুদ্র। নিশ্চিন্তে আড়মোড়া ভাঙল। যেন ঘুম থেকে উঠেছে। নিজের হাতে যে এইমাত্র আটটা খু-ন করে ফেলল, সে ব্যপারটা যেন জলভাত।
লম্বা একটা হাই তুলে পাশে তাকাতেই চমকে উঠল রুদ্র। হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইল। প্রিয়তা নেই! গেল কোথায় মেয়েটা? তখনই ওর চোখ পড়ল নিচের দিকে। নিচে তাকিয়ে যা দেখল তাতে রুদ্র বোকা বনে গেল একপ্রকার। প্রিয়তা মাটিতে আসাম করে বসে আছে, জিপের সাথে হেলান দিয়ে। চোখ বন্ধ করে কানের ওপর দু হাত দিয়ে রেখেছে। এমন অবস্থাতেও কী অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ভয়ে বোধ হয় জমে গেছে মেয়েটা। প্রিয়তার এই অবস্থা দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে রুদ্রর। জীবনে বোধ হয় এরকম পরিস্থিতিতে কোনদিন পড়তে হয়নি ওকে। আতঙ্কে কেমন বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে আছে। অনেক বছর পর মন থেকে হাসি পেলো রুদ্রর। কিন্তু হাসল না। দুই আঙুলে নাক ঘষে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। গলা ঝেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘উঠে দাঁড়াও। এখানে তোমাকে মারার জন্যে দাঁড়িয়ে নেই কেউ।’
প্রিয়তা চোখ খুলে তাকাল। ঘাড় ঘুরিয়ে রুদ্রকে সম্পূর্ণ অক্ষত আর নিশ্চিন্ত দেখে মুখে হাসি ফুটলো ওর। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে আনন্দিত কন্ঠে বলল, ‘ওরা চলে গেছে?’
রুদ্র বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রিয়তার দিকে। তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, ওরাতো হাতে পি-স্ত-ল নিয়ে, দল বেঁধে আমার সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে এসছিল তাইনা? খেলাধুলো শেষ। ওরা ওদের বাড়ি চলে গেছে, এবার আমি আমার বাড়ি চলে যাবো। এতক্ষণ তো এখানে সার্কাস চলছিল। ইডিয়ট!’
শেষ শব্দটা বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল রুদ্র। প্রিয়তা গাল ফোলালো। দৃষ্টি জিপের সামনে পড়তেই থমকে গেল প্রিয়তা। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, ‘আপনি এদের সবাইকেও মে-রে ফেললেন? এই আপনি কী আসলেই মানুষ? কীভাবে সম্ভব!’
এবার সত্যি সত্যি প্রিয়তাকে ঠাটিয়ে আরও একটা চড় মারতে ইচ্ছে করল রুদ্রর। কিন্তু এবারও খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ঠিক বলেছো, এদের মে-রে ফেলাটা মোটেও উচিত হয়নি। এদের সামনে গিয়ে দুহাত তুলে বলা উচিৎ ছিল, এইতো খোকারা আমি এখানে। আমাকে আরামসে শু-ট করে দিয়ে বাড়ি চলে যাও। মজার না ব্যপারটা?’
প্রিয়তা বলার মতো কিছু খুঁজে পেলোনা। খানিকটা ইতস্তত করে মুখের ওপর পরা চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল, ‘সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সবাই আপনার প্রাণের পেছনেই কেন পড়েছে শুনি? নিশ্চয়ই আপনিও ভালো মানুষ নন।’
রেগে গেল রুদ্র। একটানে প্রিয়তাকে নিজের কাছে টেনে বলল, ‘একদমই ভালো মানুষ নই। যদি এদের মতো তোমারও আমার হাতে ম-রা-র ইচ্ছে না থাকে, তাহলে একদম চুপ থাকো।’
কথাটা বলে প্রায় ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো প্রিয়তাকে। একেই হাতের তীব্র ব্যথা, তারওপর এই মেয়ের বাড়তি বকবক। বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হচ্ছে একে।
চারপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলাল রুদ্র। তারপর গিয়ে জিপের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। প্রিয়তা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুদ্র জিপে চাবি লাগিয়ে দশ সেকেন্ড চুপচাপ বসে রইল। এবার সত্যি মেজাজ বিগড়ে গেল ওর। ধমকের সুরে বলল, ‘এই মেয়ে! হা করে তাকিয়ে আছো কেন? উঠে এসো!’
প্রিয়তা চমকে গেল রুদ্রর ধমকে। থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, ‘এইটাতে করে যাবো আমরা?’
রুদ্র স্টেয়ারিং এর ওপর কুনুই রেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল প্রিয়তার দিকে। বলল, ‘তোমাকে নেওয়ার জন্যে কী হেলিকপ্টার আসবে? নাকি জঙ্গলের মধ্যেই সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখছো? সেটা হলে তুমি থাকো, আমি গেলাম। আমায় বাড়ি ফিরতে হবে।’
কথাটা বলে গাড়ি স্টার্ট দিতে গেলেই প্রিয়তা দৌড়ে এসে ফ্রন্টসিটে বসল। ভয়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে একেবারে। মনে মনে হাসল রুদ্র। তবে মুখে গাম্ভীর্য ধরে রেখেই গাড়ি স্টার্ট দিল। প্রিয়তা গোমড়া মুখ করে তাকাল রুদ্রর দিকে। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই জিজ্ঞেস করল, ‘এই! আপনার না হাত বাঁধা ছিল? আপনি খুললেন কীকরে?’
রুদ্র সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই হাসল। উত্তর দিলোনা। কিন্তু মনে পড়ে গেল নিজের ছোটবেলা। যতবার স্কুল থেকে কিংবা এলাকা থেকে রুদ্রর নামে নালিশ আসতো, ততবার হাত-পা বেঁধে রুদ্রকে মারতেন রাশেদ। কিন্তু নিজের হাতে কোনদিন বাঁধন খুলে দিতেননা। রুদ্রকে হুকুম করতেন নিজে নিজে খোলার জন্যে। প্রথমদিকের ঘটনা, কোন এক অপরাধের কারণে হাত-পা বেঁধে ভীষণ মেরেছিলেন রুদ্রকে রাশেদ। মারা থামালেও বাঁধন খুলে দেননি। নিজের হাতে খুলতে না পেরে টানা একদিন না খেয়ে ওভাবেই পড়ে ছিল দশ বছর বয়সী রুদ্র। পরেরবার থেকে রাশেদ নিজের হাতে খুলে না দিলেও মুখে মুখে বলে দিতেন বাঁধন খোলার পদ্ধতি। রুদ্র প্রথমে ব্যর্থ হতো। কিন্তু পরবর্তীতে একসময় সময় নিয়ে হলেও খুলতে পারতো সবরকমের বাঁধন। কিন্তু সেই সময় নেওয়াটা পছন্দ হতোনা রাশেদের। তাই নতুন নিয়ম বানালেন। যতক্ষণ রুদ্র না খুলতে পারবে ততক্ষণ মারা হবে ওকে। যেমন কথা তেমন কাজ। পরেরবার থেকে এই নিয়মই চলল। তীব্র মার খেয়ে জ্বর উঠে যেতো রুদ্রর। একপর্যায়ে ব্যপারটা রুদ্রর কাছে জেদে পরিণত হলো। আস্তে আস্তে কম সময় নিল। মার খাওয়ার পরিমাণও কমলো। এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে কবে যে রুদ্র বাঁধন খোলায় দক্ষ হয়ে উঠেছিল সেটা রুদ্র নিজেও বুঝতে পারেনি। আজ যেকোন রকম রশির বাঁধন রুদ্রর হাতের খেলনা বৈ কিছুই নয়।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়লো প্রিয়তা, ‘আচ্ছা, ওরা কী খুঁজছিল? আর ওটা কী সত্যিই আপনার কাছে আছে? থাকলে ওরা পেলোনা কেন?’
রুদ্র এবারেও জবাব দিলোনা। নিজের মতো করে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে গেল হাইওয়ের দিকে। প্রিয়তাও এবার চুপ রইল। বুঝল এই রোবট এখন কথা বলতে মোটেও ইচ্ছুক না। অর্থাৎ কথা বলবে না।
–
দুপুর আড়াইটার মতো বাজে। নিজের জিপে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে রুদ্র। প্রিয়তাকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।
জঙ্গলের দিক থেকে হাইওয়েতে ওঠার পরেই রুদ্র প্রিয়তাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিল। কিন্তু তখন প্রিয়তা অসহায় মুখ করে বলে, ‘আমার কাছেতো টাকা নেই। ব্যাগটা ঐ লোকগুলোর সাথে ধস্তাধস্তির সময় জঙ্গলে পড়ে গেছে। যাব কীকরে?’
কোন উপায় না দেখে রুদ্র নিজেই প্রিয়তাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জিপ চালিয়ে প্রথমে যায় একটা গ্যারেজে। রুদ্র যে হোটেলে উঠেছিল সে হোটেল থেকে দশ কিলোমিটার দূরে গ্যারেজটা। রুদ্র জানতো ঐ হোটেল থেকেই ওকে কিডন্যাপ করা হবে। কিডন্যাপড হওয়ার জন্যেই তো এসেছিল ও সেখানে। তাই গতপরশু হোটেলে ওঠার আগে এই গ্যারেজে এসছিল। গ্যারেজটা ওর পরিচিত এবং বিশ্বস্ত লোকের। এখানে ও ওর ফোন, টাকা, কার্ড, জিপ আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে গিয়েছিল। কারণ ও জানতো হোটেল থেকে ওর সাথেসাথে ওর জিনিসপত্রও তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। গ্যারেজের মালিকের কাছ থেকে নিজের সব জিনিস বুঝে নিয়ে ডার্ক নাইটের জিপটা ওখানেই রেখে আসে রুদ্র। তারপর উচ্ছ্বাসকে কল করে জানায় ও ঠিক আছে। আজকেই ফিরবে। লোক পাঠানোর প্রয়োজন নেই। এরপর নিজের জিপে করে একটা ক্লিনিকে পৌঁছলো। প্রিয়তা ওর সাথেই ছিল। ক্লিনিকে গিয়ে হাতের ড্রেসিং করে ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে নেয় রুদ্র। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে যায় দুজন। দুজনেরই প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। খিদের জ্বালায় প্রিয়তাও আর ‘খাবো না’ নামক ভদ্রতা দেখাতে পারেনি। রুদ্র পরিমিত খেলেও প্রিয়তার খাওয়া দেখে চোখ কপালে উঠে রুদ্রর। এই মেয়ে এতো খায়! শরীর দেখেতো বোঝা যায় না। খাবারগুলো যায় কোথায়? মনে মনে কথাটা চিন্তা করলেও মুখে কিছুই বলেনি রুদ্র। পুরো সময়টা প্রিয়তাও প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলেনি। কারণ প্রথমেই হুমকি দিয়ে রেখেছে রুদ্র, বেশি কথা বললে আবার জঙ্গলে রেখে আসবে।
খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে দু প্যাকেট সিগারেট আর একটা লাইটার কেনে রুদ্র। কাল থেকেই ভয়ানক সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছিল ওর। রুদ্রকে সিগারেট টানতে দেখে প্রিয়তা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রুদ্রর সে হুমকির কথা মনে পড়তেই চুপ হয়ে যায় বোধ হয়। রুদ্র প্রিয়তার কাছ থেকে ওর বাসার ঠিকানা নিয়ে সোজা জিপ ঘোরায় প্রিয়তার বাসার উদ্দেশ্যে। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যায় ওরা। জিপ থামতেই প্রিয়তা দ্রুত নেমে যাচ্ছিল জিপ থেকে। কিন্তু রুদ্র ওর হাত ধরে ফেলে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রুদ্র চোখের ইশারায় নিজের জ্যাকেটটা দেখায়। যেটা প্রিয়তা নিজের গায়ে জড়িয়ে আছে। বুঝতে পেরে দ্রুত জ্যাকেট খুলতে আরম্ভ করল প্রিয়তা। যেন রুদ্রর সামনে থেকে সরতে পারলেই বাঁচে। সেই ফাঁকে বিল্ডিংটা দেখতে দেখতে রুদ্র বলে, ‘এই বিল্ডিংটা তোমাদের?’
প্রিয়তা জ্যাকেট খুলতে খুলতে বলে, ‘ না। গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভাড়া থাকি আমরা। আমি আর আমার এক বান্ধবী।
বলে জ্যাকেটটা এগিয়ে দেয় রুদ্রর হাতে। রুদ্র কোন কথা না বলে জ্যাকেটটা নেয়। প্রিয়তা আর দাঁড়ায় না। দ্রুত নেমে দৌড়ে চলে যায় বিল্ডিং এর ভেতর। যেন সিংহের গুহা থেকে ছাড়া পেল। রুদ্র নিজের অজান্তেই সেদিকে তাকিয়ে ছিল বেশ অনেকটা সময়। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। ঢাকা ফিরতে হবে ওকে। এদিকের কাজ শেষ।
পাহাড়ের মাঝ দিয়ে তৈরী হওয়া চওড়া ঢালু রাস্তা দিয়ে মাঝারি গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রুদ্রর জিপ। দুপুর, তাই এখন আর তেমন শীত করছে না রুদ্রর। হাতের ব্যথাটাও কম মনে হচ্ছে। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুলের মাঝে ধরে রাখা আছে জ্বলন্ত সিগারেট। হঠাৎ প্রিয়তার কথা মনে পড়ল ওর। সেই কালো গভীর চোখ, ঘন পাপড়ি, মায়া মাখানো ভীত দৃষ্টি আর অদ্ভুত কিছু কথা। নিজের অজান্তেই খানিকটা হাসল রুদ্র। কাল রাত থেকে মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখার বিশেষ কারণ ছিল ওর। প্রথমে মেয়েটাকে নিয়ে কোন আগ্রহ ছিলোনা রুদ্রর। কিন্তু যখন প্রিয়তা ওর হাত বেঁধে দিচ্ছিল, তখন খুব সাবধানে পেনড্রাইভটা প্রিয়তার গায়ে থাকা নিজের জ্যাকেটটার ভেতরে রেখে দিয়েছিল ও। এরপর থেকেই প্রিয়তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ পেনড্রাইভটা ওর কাছে ছিল। তাইতো এক মুহুর্তের জন্যেও প্রিয়তাকে চোখের আড়াল করেনি রুদ্র। এমনকি রাতে ঘুমোনোর সময় ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে যাতে পালাতে চেষ্টা করলেও রুদ্র টের পেয়ে যায়। আর এইজন্যই ঐ লোকগুলোকে বারবার বলছিল প্রিয়তার গায়ে যাতে হাত না লাগায়। এছাড়া আর কোন বিশেষ কারণ ছিলোনা।
কিন্তু এখন রুদ্রর কেমন ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই যা এতক্ষণ ছিল। বারবার সেই অপরূপ সুন্দর চোখদুটোর কথা মনে পড়ছে। হয়তো এতো লম্বা সময় মেয়েটা ওর সঙ্গে ছিল বলেই এমন হচ্ছে। এ ছাড়া আর কিছু না। কিছু হওয়া উচিত না। কিন্তু সত্যিই কী কারণ শুধুমাত্র এটুকুই? আরেকটা ব্যপার মাথায় ঘুরছে রুদ্রর। ডার্ক নাইট হোক বা ব্লাক হোল, ওরা জেনে গেছে রুদ্রর সঙ্গে একটা মেয়ে ছিল। ওরা প্রিয়তাকে খুঁজবে। আজ রাতের মধ্যে খুঁজে পেয়ে গেলেও ব্যপারটা অবাক করার মতো কিছুই হবেনা। প্রিয়তাকে খুঁজে পেলে ওরা বিশেষ কিছু জানতে না পারলেও ওকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে মনে হচ্ছেনা। কারণ প্রিয়তা কী জানে আর কতটা জানে সে বিষয়ে ওরাও নিশ্চিত না। সুতরাং কোনরকম রিস্ক নেবেনা ওরা। রুদ্রর মনটা অস্থির হয়ে উঠছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রিয়তার নিষ্পাপ মুখটা। জেনেশুনে মেয়েটাকে এভাবে মৃ-ত্যুর মুখে ফেলে যাওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে? মেয়েটাতো নির্দোষ। অজান্তেই ফেঁসে গেছে এই অন্ধকার জগতের হিংস্রতায়। কী করা উচিত এখন? গাড়ি ঘোরাবে? নাকি নিজের মতো করে ফিরে যাবে গুলশান?
#চলবে…
#অন্তর্নিহিত_কালকূট