অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৩১.

0
4

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৩১.

ফেনী। বিলাশবহুল এক হোটেলের বারে বসে আছে পলাশ মীর্জি। শূন্য করে চলেছে একের পর এক মদের বোতল। বেশ আমোদে আছে আজ সে। কলিজাটা একপ্রকার হাতে নিয়ে নিয়ে ঘুরছিলো এতোদিন। এই বুঝি বেঘোরে প্রাণটা গেল। তবে এখন সে নিশ্চিন্ত। দুবাই যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে আজ। কালকে ফ্লাইট। এরপর ওর টিকিটাও খুঁজে পাবেনা কেউ। না পুলিশ, আর না ‘সে’। শুধু আজকের রাতটা। রাতটুকু দরজা-জানালা লাগিয়ে নিরাপদে কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। তখন তাকে আর কে পায়? অতি সুখে এবার সরাসরি বোতলেই চুমুক বসিয়ে দিল পলাশ। ঢকঢক করে গলা দিয়ে নামাতে থাকল এই বিষাক্ত পানীয়।

সেলফোনটা বেজে উঠতেই ভীষণ বিরক্ত হলো পলাশ। অনেকদিন বাদে নিশ্চিন্তে বসে শান্তিতে নেশা করছিল। সেটাও করতে দেবেনা। যত্তসব জ্বালাতন। পলাশ কোনমতে রিসিভ করল কলটা। মাতাল কন্ঠে বলল, ‘ হ্যাঁ, বলো ভাই।’

ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠে ভেসে এলো, ‘কোথায় তুই?’

‘ফেনীতে। কাল দুবাই চলে আসছি। চিন্তা করোনা।’

‘ তোর আশেপাশে এতো আওয়াজ কেন? ঐ! তুই বারে? নেশা করছিস?’ ধমকে উঠল কলে থাকা ব্যক্তি।

হকচকিয়ে গেল পলাশ। চোখ পিটপিট করল। মাথা ঝাঁকিয়ে চেষ্টা করল স্বাভাবিক হওয়ার। কোনরকম ইতস্তত করে বলল, ‘ক-কই নাতো!’

রাগে ঝলসে উঠল লোকটা। বিশ্রী এক গালি ছেড়ে বলল, ‘তোকে না বলেছি বের হবিনা ঘর থেকে। ঘরেও দরজা-জানালা সব ভালোভাবে লাগিয়ে বসে থাকবি। সেসব ভেবেই দিনের বেলায় ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিলাম। একদিন মদ না গিললে মরে যেতি? শু*রের বাচ্চা!’

‘ আরে আমিতো_’

‘ চুপ! একদম চুপ! ওঠ। উঠে দাঁড়া। এক্ষুনি রুমে যাবি তুই। এমনিতেই ছেলেটার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছিনা। কোথায় গিয়ে ম-র-ছে কে জানে। এই আপদটাও ঘাড় জ্বালাচ্ছে। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিস তুই? এগারোজন। গোটা এগারোজনের মধ্যে মাত্র তিনজনই বেঁচে আছি আমরা। কেবল তিনজন। মানে বুঝিস? একটা সেকেন্ডের ভুল আমাদেরও শেষ করে দিতে পারে। আমাদের এক লোক ইতিমধ্যে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছে। ভাগ্যিস সায়ানাইড গিলেছিলো। নয়তো সব ফাঁস হয়ে যেতো? তারওপর ‘সে’। আমার দেখা জগতের সবচেয়ে হিংস্র ব্যক্তি ‘সে’। আর এই মুহূর্তে ওর না কোন পিছুটান আছে, আর না কোন বাঁধা। বাঁধহীন জোয়ার কিন্তু সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাধ বিচার করেনা।’

পলাশ কিছুটা হলেও ঘাবড়ালো। ঠোঁটটা জিভ নিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘চলে আসছিতো কাল। একটা রাতেরই ব্যপার।’

লোকটা গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ আয়। মরার ওপর খা-ড়ার ঘা হলো, এই কেইসটা এখন গোয়েন্দারা দেখছে। গোয়েন্দারা। তাও যে সে গোয়েন্দা নয়, তুহিন আহমেদ। ওর আগের রেকর্ড ধরে যদি হিসেব করি, আমাদের শেকড় থেকে তুলে না ফেলা অবধি ঐ ছেলে থামবে না। অন্তত ওর হিস্ট্রিতো তাই বলে।’

খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল পলাশ। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘এতো সহজ না-কি? বাকি কেইস আর এই কেইসের মধ্যে পার্থক্য আছে ভাইজান। ঐ দুই টাকার গোয়েন্দা আমাদের কিচ্ছু ছিড়তে পারবেনা।’

‘ মুখ বন্ধ রাখ! মনে রাখিস পেনড্রাইভটা এখনো পাইনি আমরা। ঐটা যদি কোনভাবে তুহিন আহমেদের হাতে পড়ে, শেষ হয়ে যাব আমরা। সামনে ইলেকশান। দেশে ফিরতেই হবে আমাকে। তার আগেই ‘ওকে’ দুনিয়া থেকে সরানো প্রয়োজন। কিন্তু কৌশলে। আমার মন বলছে, একবার যখন কেইসটা গোয়েন্দা বিভাগে গেছে; ওর’ মরণ ঐ তুহিন আহমেদের হাতেই লেখা আছে। কিন্তু সেটা আমি দেশে আসার আগে হলেই ভালো হয়। নয়তো যেভাবে পেছনে পড়েছে বে-জ-ন্মাটা!’

‘আসলেই বে-জ-ন্মা!’ বিকৃত মুখ করে বলল পলাশ।

‘ আমি দুবাই, আর ঐ হারামখোর ছেলে নিখোঁজ। পরে আছিস শুধু তুই। বুঝতে পারছিস ঘা-ড়ে কতবড় খা-ড়া ঝুলে আছে তোর? তাড়াতাড়ি রুমে যা! এখনই!’ তিক্ত কন্ঠে কথাগুলো বলে কল কাটল কলে থাকা ব্যক্তি।

মনের সুখে আরককিছুক্ষণ মদপান করল পলাশ। অতঃপর হেলতে দুলতে বেরিয়ে এলো বার থেকে। লিফট ব্যবহার করে উঠে এলো পাঁচ তলায়। টলতে টলতে নিজের রুমের সামনে পৌঁছলো পলাশ মীর্জা। কিন্তু দরজায় চাবি লাগাতে গিয়েই থমকে গেল। লক খোলা! খুলেই রেখে গিয়েছিল না-কি? অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না সেটা। অজানা এক আতঙ্কে শিরশির করে উঠল পলাশের শরীর। নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্কে ঠিকঠাক চিন্তা আসছেনা। মাথা ঝাঁকিয়ে মাতাল ভাবটা দূর করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে কেবল। দম বন্ধ লাগল পলাশের। ছুটে পালানোর প্রবল এক ইচ্ছা জাগল মনে।
কিন্তু কথায় আছে, মৃ’ত্যু থেকে কেউ পালাতে পারেনা। ঠিক তাই হল। বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি হানা দিল ওর মস্তিষ্কে। মন শায় দিলেও শরীরের প্রচন্ড ক্লান্তি আর মাতালভাব পালানোতে শায় দিলোনা। জোরপূর্বক সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলল মাথা থেকে। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, ও নিজেই লক করতে ভুলে গেছে। আর ‘ওই’ বা এতো তাড়াতাড়ি জানবে কীকরে ও কোথায়। ওর ভাই অযথাই ভয় দেখিয়েছে ওকে। সেকারণেই এমন হচ্ছে।

নিজেকে মারাত্মক সাহসী খেতাব দিয়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল পলাশ। ঘরটা অন্ধকার, শব্দহীন। দরজাটা ভালোকরে লক করে নিল পলাশ; যাতে কোনভাবেই বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে। দরজার লাগানোর সেই বিকট শব্দে নিজেই ঘাবড়ে গেল বেচারা। ঢোক গিলল ঘনঘন। কোনরকম টলতে টলতে গিয়ে লাইটের সুইচটা অন করল। পেছনে ঘুরতেই চমকে উঠল পলাশ। বিষ্ফোরিত হয়ে গেল চোখজোড়া। হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার জোগাড় হল। কালো হুডি পড়া লোকটাকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলোনা ওর। তীব্র আতঙ্কে জমে গেল বেচারা। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে কোনরকমে বলল, ‘তু-তুমি_’

আর কিছু বলার সুযোগ দিলোনা সেই আগন্তুক। এক মুঠো সাদা পাউডার মতো কিছু চেপে ধরল পলাশের নাকে-মুখে। শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করেও সুঠাম দেহি লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারল না পলাশ। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল ওর শরীর। বসে পড়ল ফ্লোরে। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে, ডাবল ভিশন হচ্ছে, গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে পলাশের। ফুঁপিয়ে উঠল পরপর দু’বার।
নিঃশব্দ, নিষ্ঠুর হাসি হাসল আগন্তুক। কারো নাম্বারে কল লাগালো। ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে রেখে দিল একপাশে। এরপর হোটেল রুমের এই চার দেয়াল সাক্ষী হল এক নিষ্ঠুর, ভয়ানক হ-ত্যা’কা-ণ্ডের। পলাশের একেকটা মৃত্যু চিৎকারে দ্বিগুন আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠছে ফোনের ওপাশের ব্যক্তি। অসহায়ত্ত্বের চিৎকার, সবটা জেনেও কিছুই করতে না পারার আর্তনাদ। অথচ কোন চিৎকারই গলাতে পারল না নিষ্ঠুর এই আগন্তুকের হৃদয়। বরং এই আর্তনাদ অমৃতের স্বাদ দিচ্ছে তাকে। ঠান্ডা করে দিচ্ছে ভেতরে জ্বলতে থাকা ভয়ানক অগ্নিকুণ্ডকে। হ-ত্যা নয়, যেন ন্যায় করছে নিজেরই কানে শোনা এমনই এক হৃদয় বিদারক চিৎকারের সঙ্গে।

‘গতকাল রাতে ঠান্ডাটা একটু বেশিই পরেছিল তাইনা স্যার? দু পেগ হলে একদম জমে যেতো!’

ঝোঁকের বশে কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠল তমাল। কোথায় কী বলল! ভীত চাহনীতে মাথা তুলে দেখল, চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তুহিন ওর দিকে। তমাল হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলোনা। বিকৃত হয়ে গেল মুখটা। তুহিন আবার ল্যাপটপে চোখ দিয়ে বলল, ‘রোজ খাও নাকি?’

‘ না, না স্যার। মাসে দু এক বারই হয়। এর বেশি না।’ এক নিঃশ্বাসে বলে থামল তমাল। পারলে এক্ষুনি ছুটে পালায়।

তুহিনও এ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন করল না। গতকাল রাত থেকে তিনটে গ্রুপের সমস্ত রিপোর্ট দেখছে তুহিন। তমালও ছিল সাথে। বাড়ি ফেরেনি দুজনের কেউই। তমালকে রাত তিনটের দিকে গেস্ট রুমে শুতে পাঠিয়ে দিলেও; নিজে যায়নি তুহিন। ভোরবেলা টেবিলের ওপরেই মাথা এলিয়ে খানিকটা ঘুমিয়েছিল। এইটুকুই ছিল বিশ্রাম। রাতজুড়ে একের পর এক ব্লাককফির মগ খালি করে গেছে কেবল।
একদম শুরু থেকে সবগুলো ফাইল লাইন বাই লাইন চেক করছে তুহিন। একটা পয়েন্টও ছাড়ছেনা। সেকারণেই এতো সময় লাগছে। কিন্তু এখনকার রিপোর্টগুলো পড়ে যা জানল তাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল তুহিনের। কী মর্মান্তিক! ঘুম আর ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে তুহিনকে। ঘাড়টা এবার বিছানা চাইছে। কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই এখন ওর হাতে। যেকোন মুহূর্তে আরেকটা খু-ন হবে। কিংবা হয়ে গেছে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুহিন আরেকটা ফোল্ডার ওপেন করল তুহিন । ফোল্ডারের কয়েকটা ফাইল পড়তেই চমকে উঠল। ঘুম, ক্লান্তি কেটে গেল নিমেষেই। সোজা হয়ে বসে আরও একবার ভালোকরে পড়ল ফাইলটা। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘গড!’

তমাল খেয়াল করল গোটা ব্যপারটা। খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ কী হয়েছে স্যার?’

দুই হাত একত্রিত করে থুতনির নিচে রাখল তুহিন। চোখ দুটো ল্যাপটপের মনিটরে স্থির হয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমি বলেছিলাম না তমাল, সাতটা লা’শ আমাদের হাতে এসেছে তার মানে এটা নয় যে খু’নও সাতটাই হয়েছে। সি।’

ল্যাপটপটা তমালের দিকে ঘুরিয়ে দিল তুহিন। তমাল দ্রুত চোখ বুলালো ফাইলটাতে। অবাক কন্ঠে বলল, ‘আট থেকে দশদিন আগে হয়েছে স্যার খু’নটা। চট্টগ্রাম!’

‘ কারেক্ট! মার্ডারটা কার হয়েছে দেখেছো?’

‘ হ্যাঁ স্যার!’ হতভম্ব গলায় বলল তমাল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘কিন্তু স্যার, আপনি কীকরে বুঝেছিলেন যে আরও খুন হয়েছে?’

তুহিন ল্যাপটপটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। আবার গভীর মনোযোগ দিয়ে মনিটরে তাকিয়ে বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছো? বাকি খু’নগুলোর মধ্যে ডিসটেন্স একদিন কিংবা বেশি হলে দু’দিন। কিন্তু কিশোরগঞ্জ আর বনানীতে হওয়া খুন দুটোর মধ্যে ডিসটেন্স ছিল এক সপ্তাহ। মানে সাত দিনের।’

তমাল মনে মনে একটা হিসেব কষল। চোখ বড় বড় করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর হিসেব মতো এই চট্টগ্রামের খু’নটাও ঐ সাতদিনের মধ্যেই পড়ছে, স্যার।’

‘আর আমি যদি খুব ভুল না হই; ঐ সাতদিনে শুধু এই একটা খু-ন হয়নি আরও খু-ন হয়েছে। যেহুতু কোন রিপোর্টে সেই খু-ন বা খুনগুলোর কথা উল্লেখ নেই। তার মানে একটাই। লাশ এখনো আমাদের হাতে পৌঁছায় নি। আর আমার সিক্সথ সেন্স বলছে; আজকের মধ্যেই আমরা নবম খু’নের খবর পাবো।’

ভাষাহীন চোখে তুহিনের দিকে তাকিয়ে রইল তমাল। কম্পিত কন্ঠে বলল, ‘আটকানোর কোন উপায় নেই স্যার?’

নিজের চেয়ারে হেলান দিল তুহিন। সিলিং এর দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘বোধ হয় দেরী হয়ে গেছে। কিন্তু_’

বাক্যটা শেষ না করেই আবার সোজা হয়ে বসল তুহিন। ল্যাপটপে নিয়ে আরও আধঘন্টার মতো ঘাটাঘাটি করল। কিন্তু এমন কিছুই পেলোনা যেটা থেকে বোঝা যায় পরবর্তী খু-ন কোথায় বা কার হতে চলেছে। যতটা জানতে পেরেছে ভিক্টিম অনেকেই হতে পারে। তিনটে গ্রুপেরই সদস্য সংখ্যার অভাব ছিলোনা। যারা যারা মারা গেছে সবাইকে বাদ দিলেও লোকসংখ্যার অভাব নেই। বিরক্তিতে মাথা ধরে আসছে ওর। এরকম অসহায় অবস্থায় এর আগে পড়েনি। ও জানে খু-ন হচ্ছে বা হবে। অথচ আটকানোর কোন উপায় ওর হাতে নেই। কীকরে থাকবে? কার খু-ন হবে, কোথায় খু-ন হবে কিচ্ছু জানেনা ও। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ডার্ক নাইট গ্রুপের লিডারের নামটা যেন কী?’

‘শওকত মীর্জা। পরিটিশিয়ান স্যার। নির্বাচন করবেন এবার।’

‘ঐ শওকত মীর্জা কোথায় আছে খোঁজ নাও। হয় ম-র-বে নয় মা-র-ছে লোকটা। আমি ডিজি স্যারের কাছে রিপোর্ট করে আসছি। তুমি এই ফাঁকে ব্রেকফাস্ট করে নাও।’

তমালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল তুহিন। তমাল তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার দিকে। হতাশ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘খেয়েও গেলোনা লোকটা। মনে হয়না দুপুরের আগে কিছু খাওয়ার চিন্তাভাবনা আছে। সারারাত জেগে ছিল। তারওপর খাবারের এমন অনিয়ম করলে চলে?’

কথাটা বলতে বলতে কারো নাম্বারে কল লাগাল তমাল। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলল, ‘হ্যালো ম্যাডাম?’

ডিজির রুম থেকে বের হয়ে বের করল তুহিন। শাফায়াত এর সাথে কথা বলার সময় ফোন ভাইব্রেট হয়েছিল। কেউ মেসেজ করেছে। মেসেজ ওপেন করে দেখল ইরার মেসেজ। লিখেছে, ‘আমি তোমার অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসো।’

ভ্রুকুটি করে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল তুহিন। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। ভাবল, মেয়েটা আবার এখানে কী করছে? দ্রুত পায়ে নিজের কেবিনে গেল তুহিন। তমালকে বলল, ‘ মীর্জা কোথায় আছে তার খোঁজ করতে থাকো। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।’

তমাল অতি ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ কোন সমস্যা নেই স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে যান। ধীরেসুস্থে আসুন। এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।’

চোখ ছোট ছোট করে তমালের দিকে তাকিয়ে রইল তুহিন। সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘তুমিই ডেকেছো ওকে, তাইনা?’

তমাল অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ আমি? কই নাতো। আমি কেন ডাকব? ম্যাডাম হয়তো নিজেই এসছেন। আমি ডাকিনি! আমার কাছে নাম্বারই নেই।’

তুহিন বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে বলল, ‘ আমি কখন বললাম তোমার ম্যাডাম এসছে?’

মুখ ছোট হয়ে গেল তমালের। বুঝল যে ধরা পড়ে গেছে ও। ঝাড়ি শোনার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত করে ফেলল নিজেকে। কিন্তু তুহিন কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল কেবিনে থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল তমাল। বাঁচা গেছে!

ইরাকে নিয়ে অফিসের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে তুহিন। নিচে নামতেই ইরা বায়না ধরেছিল, খিদে পেয়েছে, খাবে। তারপর বাকি কথা। অগত্যা, কোন কথা না বাড়িয়ে প্রেয়সীর আদেশই মান্য করল চতুর গোয়েন্দা। কর্ণারের একটা প্রাইভেট এরিয়া নিয়েছে নিজেদের জন্যে।

খেতে খেতে তুহিন বলল, ‘এরকম পাগলামীর কোন মানে হয় ইরা? এতো বেলা অবধি না খেয়ে ছিলে কেন?’

ইরা গাল ফুলিয়ে বলল, ‘আর তুমি যে সারারাত জেগে কাটালে তার বেলা?’

‘ আজব! আমি নিজের কাজ করছিলাম। আপনি কোন রাজকার্য উদ্ধার করছিলেন ম্যাডাম?’

ইরা মুচকি হাসল। তুহিনের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তোমার কথা ভাবছিলাম। সেটা রাজকার্যের চেয়ে কম কী?’

ব্যস! তুহিনের এতক্ষণের বিরক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কোঁচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হয়ে গেল। গালে হাত রেখে তাকাল ইরার দিকে। বিভোর দৃষ্টিতে ইরার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ম্যাডাম ইদানিং বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক কথাবার্তা বলছেন। এখন আমি যদি আপনার রোমান্টিক কথায় ইন্সপায়ার্ড হয়ে সো মাচ রোমান্টিক কিছু করে বসি, তখন কী হবে?’

ইরাও তুহিনের দিকে খানিকটা ঝুঁকল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কী আর হবে? তখন আর নয়-ছয় বলে বাহানা দিতে পারবেনা। বিয়ে করে ফেলতে হবে। আমার জন্যেতো ভালোই হয়।’

হেসে ফেলল তুহিন। ইরার কপালের চুলগুলো সযত্নে গুঁজে দিল কানের পিঠে। মুখটা এগিয়ে নিচ্ছিল ইরার গালের দিকে। এমন সময় অসহ্যকর আওয়াজে বেজে উঠল সেলফোনটা। মুখ দিয়ে ‘চ্যাহ’ টাইপ শব্দ করে সোজা হয়ে বসল তুহিন। বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে উঠল মনটা। তুহিনের মুখভঙ্গি দেখে হাসি পাচ্ছে ইরার। তুহিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে শাফায়াত হোসেইন বলল, ‘কোথায় তুমি?’

তুহিন ইতস্তত করে একবার তাকাল ইরার দিকে। নিজের কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, ‘একটু বেরিয়েছিলাম স্যার। আশেপাশেই আছি।’

‘ ইমিডিয়েটলি আমার কেবিনে এসো। কথা আছে। আর্জেন্ট।’

‘ ওকে স্যার। আমি দশ মিনিটে আসছি।’

ফোনটা কেটে হতাশ চোখে ইরার দিকে তাকাল তুহিন। তুহিনের অবস্থাটা বুঝতে পারল ইরা। নিজের মন খারাপ ভাবটা ভুল করেও প্রকাশ করল না সে। বরং হেসে ফেলল। হাত দিয়ে তুহিনের চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি যাও। আমি সিএনজি করে চলে যাব বাড়িতে।’

মুচকি হাসল তুহিন। এগিয়ে এসে চুমু খেলো ইরার গালে। বিল চুকিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। না জানি আবার নতুন কোন ঝামেলা এসে হাজির হয়েছে।

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

[ রি-চেইক করিনি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here