অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৩২.

0
2

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৩২.

হোটেলের পাঁচশ চার নম্বর রুম। ফ্লোরে পরে আছে পলাশের নিথর শরীর। থানার ওসি সাহেব দাঁড়িয়ে আছে বডিটার ঠিক পাশে। দুজন হাবিলদার ছাড়া রুমের মধ্যে আর কাউকে এলাও করা হয়নি। ফারিয়া বডিটা দেখা মাত্র নাকমুখ কুঁচকে ফেলেছে। কী নিষ্ঠুরতা! তুহিন ভালোভাবে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল পলাশের মৃত শরীর। বিলাশবহুল হোটেল রুমটাতে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। বিছানা, টি-টেবিল, সোফা সব ঠিকঠাক আছে। ঘরের আসবাবপত্র খুব বেশি লন্ডভন্ড হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, ভিক্টিম নিজেকে প্রটেক্ট করার খুব বেশি সময় পায়নি। কিংবা শক্তি পায়নি।

সবাইকে জেরা করে যতটুকু জানতে পেরেছে, খু-নের সময় কেউ কিছুই টের পায়নি। সকালে রুম সার্ভিসের লোক রুমে নক করার পরেই প্রথম জানা যায় হোটেলে একটা মা-র্ডা-র হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই খু-নিকে দেখতে পায়নি কেউ। তমাল আর ফারিয়ার গোটা ঘরটা প্রাথমিকভাবে সার্চ করা শেষ। এবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ব্লা-ডমার্ক কালেক্ট করার অর্ডার দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল তুহিন। প্রত্যেকটা জিনিস দেখে নিল ভালোভাবে। এমনকি কমোডটাও। তবে বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না। উল্লেখযোগ্য কিছু না পেয়ে সে আবার ফিরে এলো লা-শের কাছে। আরও মনোযোগ দিয়ে দেখল বডিটা।
ওসি খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, এটাতো আপনার ডিভিশনের মধ্যে পড়েনা। আপনাকে কেন ডেকে পাঠানো হলো বুঝতে পারলাম না।’

তুহিন লাশটার দিকে তাকিয়ে থেকেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘ কারণ শেকড়টা আমার ডিভিশনে। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে ডালপালা এদিকে চলে এসছে। চিন্তা নেই। পরের কোন একটা কেইসে খু’নিকে বলে দেব; শেকড়টা এই ডিভিশনে রেখে, ডালপালা যাতে আমার ডিভিশনে পাঠিয়ে দেয়। শোধবোধ। নাকি সুদ চাই আপনার?’

ফিক করে হেসে ফেলল এক হাবিলদার। আরেকজন হাসতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। জেনেশুনে এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করার জন্যে মনে মনে মারাত্মক লজ্জা পেলো ওসি। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। তুহিন এক হাঁটু ভেঙ্গে বসল লা’শের সামনে। ওসিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘নামধাম সব জেনে নিয়েছেন?’

‘ ইয়েস স্যার। হোটেল রেজিস্ট্রি করা আছে। পলাশ মীর্জা নামে।’

কোন প্রতিক্রিয়া এলোনা তুহিনের কাছ থেকে। যেন মোটামুটি আন্দাজ করাই ছিল নামটা। ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ পলাশের র-ক্তা-ক্ত মুখটার দিকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে সে। সারা মুখ জুড়ে আবছা আবছা সাদা পাউডার জাতীয় কিছু। কী এগুলো? নিজের তর্জনী আঙুলে সামান্য পাউডার লাগিয়ে নাকের কাছে এনে ধরল তুহিন। অজান্তেই মুখ কুঁচকে গেল ওর। হেরোইন! ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল তুহিন। পলাশের শরীরের ভয়ানক ক্ষতগুলো পরীক্ষা করল আরো একবার।

ওসি বলল, ‘কল পাওয়ার সাথে সাথেই আমরা সবাইকে হোটেলে আটকে রেখেছি স্যার। কাউকে বের হতে দেইনি।’

তুহিন চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজের থুতনি চুলকে বলল, ‘ তাতে বিশেষ কোন উপকার হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা। খু-ন করে খু-নি সকাল অবধি হোটেলেই বসে ছিল বলে আপনার মনে হচ্ছে? এই আশায় যে কখন জানাজানি হবে, কখন পুলিশ এসে সবাইকে আটকে দেবে, তারপর সে পালাবে?’

তারপর একটু থেমে বলল, ‘তবে আটকে রেখে ভালো করেছেন। হোটেলটাতে উপস্থিত সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।’

মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ওসির। কিন্তু তুহিনের পরবর্তী কথায় স্বস্তি পেল। যাক, লোকটা একেবারেই অকাজের ভাবছে না তাকে। ব্যপারটাতে খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখেছি আমরা স্যার। রাত দুটোর দিকে ঘরে ঢুকেছিল পলাশ মীর্জা। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিলো দরজাটা খোলাই ছিল। প্রায় আড়াইটার দিকে কালো হুডি পড়া একটা লোক বেরিয়েছে ঐ ঘর থেকে। কিন্তু কোনভাবেই তার মুখ দেখতে পেলাম না। লম্বা হুডি আর মাস্কের আড়ালে ছিল সবসময়।’

তুহিন খানিকটা আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘তারপর? ঐ রুম থেকে বেরিয়ে কত নাম্বার রুমে ঢুকেছিল সে?’

‘এটাইতো আশ্চর্যের ব্যপার স্যার। ফিফথ্ ফ্লোরের সিঁড়ি অবধিই দেখা গেছে তাকে। না নামতে দেখা গেছে আর না উঠতে। যেন সিঁড়িতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে একেবারে।

বিরক্ত হলো তুহিন। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দিনদুপুরে নেশা করেছেন?’

জিভে কামড় দিলেন ওসি। লজ্জিত কন্ঠে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওসব আমি খাইনা স্যার।’

‘এটা সম্ভব?’

‘এটাইতো আশ্চর্যের ব্যপার স্যার। আমরাও খুব অবাক হয়েছি।’

চোখমুখ গম্ভীর হয়ে উঠল তুহিনের। সিঁড়ি অবধি যখন দেখা গেছে, এরপর নিশ্চয়ই বাকিটাও নেমেছে। সত্যি সত্যিই হাওয়ার মিলিয়ে যাওয়াতো সম্ভব না। ছদ্মবেশে নেমেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু পলাশের রুমে সে কখন ঢুকল আর কীভাবে?

এরমধ্যেই ওসি বলে উঠল, ‘ স্যার, আমরা রেজিস্ট্রার চেক করে দেখেছি। পাঁচতলায় যে কয়েকটা রুম বুক করা আছে তারমধ্যে থেকে কেউ ঘর ছাড়েনি। তবে বেরিয়েছেন দুজন।’

তুহিন ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘ আর বাকি ফ্লোরগুলো?’

‘ তাতো দেখিনি স্যার।’

‘ দেখা উচিত ছিল। খু’নি অন্য ফ্লোরেও উঠে থাকতে পারে। যদিও সম্ভাবনা কম। যাই হোক, আমি দেখছি।’

এরমধ্যেই তমাল আর ফারিয়ার কাজও হয়ে গেল। তুহিন উঠে দাঁড়িয়ে ফারিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, ‘শেখ গাড়ি আর লোক পাঠিয়েছে?’

‘ জ্বি স্যার! পাঠিয়েছে। আপনি বললেই এসে লা-শটা নিয়ে যাবে।’

‘ আসতে বলো। আর এভিডেন্সগুলো নিয়ে তুমিও চলে যাও। কাজ শুরু করে দিতে হবে এক্ষুনি। প্রতিটা সেকেন্ড এখন ইম্পর্টেন্ট।’

‘ রাইট স্যার!’

মহিউদ্দিনকে কল করার জন্যে কিছুটা সরে দাঁড়ালো ফারিয়া। তুহিন এবার তমালকে বলল, ‘হোটেলের প্রতিটা ঘরে যাও। সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। ঐ স্কেচটা দেখাও সকলকে। এই হোটেলেই যেহুতু উঠেছে। কেউনা কেউতো দেখে থাকবে ওকে।’

তমাল চলে যাচ্ছিল। তখনই তুহিন বলে উঠল, ‘ আর রুদ্রর ছবিটাও দেখাবে।’

তমাল অবাক চোখে তাকাল। সেটা দেখে তুহিন বলল, ‘ওকে পুরোপুরি সন্দেহের বাইরে ফেলে দেওয়ার মতো বিশেষ কিছু ঘটেনি এখনো।’

থতমত খেয়ে গেল তমাল। ইতস্তত করে বলল, ‘জ্বি স্যার।’

তমালকে ওর কাজ বুঝিয়ে নিচে গেল তুহিন। ওকে দেখেই প্রায় দৌড়ে এলো ম্যানেজার। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দুঃখিত স্যার। প্রচন্ড ইমার্জেন্সি এসে গিয়েছিল। তাই বেরোতে হয়েছে। কখন এসছেন?’

‘ অনেকক্ষণ।’

তার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে কাজের কথায় এলো তুহিন। বলল, ‘ আমি রেজিস্ট্রার দেখতে চাই। কাল রাতে কে কে রুম ছেড়েছে। আর এটাও জানা দরকার কে কে এক্সিট করেছে কিন্তু এখানো ইন্টার করেনি। কিন্তু তার আগে সিসিটিভি ফুটেজগুলো চেইক করব আমি।’

ম্যানেজার বিনয়ের হাসি হেসে বলল, ‘শিওর স্যার। চলুন।’

খুব মনোযোগ দিয়ে সিসিটিভি চেইক করল তুহিন। ওসি ঠিকই বলেছিল। দেড়টার দিকে পলাশের রুম থেকে বের হয় একটা লোক। এবং সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা যায়। কিন্তু ফোর্থ ফ্লোরে এসে পৌঁছয়না সে। এমনকি তাকে আর ফিরে আসতেও দেখা যায়নি। তুহিন দ্রুত অপারেটরকে বলল, ‘পাঁচশ চার নম্বর রুমের সামনে, রাত দেড়টার আগের ফুটেজগুলো দেখান। ফাস্ট!’

অপারেটর তাই করল। পলাশের রুমে ঢোকার আগের সময়গুলোর ফুটেজ চেক করল। ঠিক একটা পয়তাল্লিশে সেই লোকটা ঢুকেছে পলাশের রুমে। তুহিন আরও পেছনে গেল। ঠিক কোথা থেকে লোকটা পলাশের রুমে ঢুকেছে সেটা জানা প্রয়োজন। কিন্তু যা দেখল, তাতে আরও বেশি অবাক হল তুহিন। লোকটাকে ফিফথ ফ্লোরের করিডরে ওঠার পরেই কেবল দেখা গেছে। ফোর্থ ফ্লোরে ওঠার সিঁড়িতে কিংবা করিডরে তাল কোন অস্তিত্ব নেই। যেন এই দুটো সিঁড়ির মাঝখানে আবির্ভূত হয়ে ঐ লোক। অপারেটর লোকটা ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। গোটা ব্যপারটাই ভৌতিক মনে হচ্ছে তার কাছে। কপালের ঘামটা মুছে বড়সর ঢোক গিলল সে। ম্যানেজারের চোখও চারাগ গাছ। তুহিনের কপালেও মৃদু ঘাম জমেছে। ভয়ে নয়, হতাশা আর বিরক্তিতে। কিছু একটা ভেবে ও অপারেটরকে বলল, ‘আপনাদের সিসিটিভি সিঁড়ির ঠিক কতোটা কভার করে?’

চমকে উঠল অপারেটর। রুমাল দিয়ে মুছে নিল মুখের ঘাম। কোনরকমে বলল, ‘ফোর্থ ফ্লোরেরটা ফিফথ্ ফ্লোরের ওঠার প্রথম সিঁড়ির এইটটি পার্সেন্ট কভার করে। আর ফিফথ্ ফ্লোরেরটা ফোর্থ ফ্লোরে নামার প্রথম সিঁড়িটার স্যাভেনটি ফাইভ পার্সেন্ট।’

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। খুব সম্ভবত ঐ বাকি অংশগুলোতেই বেশ পরিবর্তন করেছে খু-নি। ঠিক ঐসময়গুলোতে ওঠানামা করা ব্যক্তিদের ফুটেজও চেক করল তুহিন। কিন্তু ঐ সময় মিলিয়ে কাউকেই নামতে দেখা গেলোনা। কী আশ্চর্য! সত্যিই কোন অশরিরীর কাজ না-কি এসব?
অপারেটর এই শীতেও দরদর করে ঘেমে চলেছে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিল তুহিন। এদিকে ম্যানেজারও ঘাবড়ে আছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। এদিকে অন্যভাবনায় মগ্ন তুহিন। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে চাবি ব্যবহার করেই ভেতরে ঢুকেছিলেন খুনি। চাবি কোথায় পেল সে? সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে রেজিস্ট্রারের দিকে হাঁটা দিল তুহিন।

রেজিস্ট্রার থেকে জানা গেল মাত্র একজনই ঘর ছেড়েছে। সেটিও কাল সন্ধ্যায়। তবে রাতে এক্সিট করে এখনো অবধি ইন্টার না করা রুমের সংখ্যা চারটা। নামগুলো শুনে সন্তুষ্ট হতে পারল না তুহিন। রুদ্রর নাম নেই ওখানে। রিসিপশনে বসা তরুণীকে ভালোভাবে লক্ষ্মীপুরের সম্ভাব্য খু-নির স্কেচটা দেখালো তুহিন। বলল, ‘দেখুনতো, যে চারজন বেরিয়েছে রাতে তারমধ্যে এই লোকটা ছিলো কি-না।’

মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল স্কেচটা। এরপর মাথা নেড়ে বলল, ‘না স্যার। এই লোক এই হোটেলে কোন রুম নেয়নি।’

ভ্রুকুটি করল তুহিন। সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘আর ইউ শিওর?’

‘ আই গ্যারান্টি ইট!’

বোকার মতো দু সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তুহিন। এরপর হঠাৎই কিছু একটা ভেবে দ্রুত রুদ্রর ছবিটা বের করল। তুলে ধরল মেয়েটার সামনে। বলল, ‘একে?’

মেয়েটা স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। দুচোখে মুগ্ধতা। বিরক্ত হলো তুহিন। বুঝল এই মেয়েও পিছলেছে। বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হবে একে। হাত দিয়ে টেবিলে পরপর দুবার আওয়াজ করল তুহিন। স্বপ্ন থেকে ফিরিয়ে আনল মেয়েটাকে। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘দেখেছেন একে?’

লজ্জিত হল মেয়েটা। ইতস্তত করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি স্যার। কিন্তু ইনিও কোন ঘর নেননি।’

তুহিনের মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হলো এবার। এটা কী মজা হচ্ছে নাকি? জায়গায় জায়গায় খু-নির চেহারা বদলে যাচ্ছে কীকরে? ম্যাজিক না-কি? খু-নের হিস্ট্রি, পলিটিক্স সব এক; অথচ জিওগ্রাফিটা চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে কীকরে? ভানুমতির খেল দেখাচ্ছে খু-নি?

জিজ্ঞাসাবাদ সেড়ে নেমে এলো তমাল। তুহিনের মুখ দেখেই ঘাবড়ে গেল ও। বোঝাই যাচ্ছে মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে লোকটার। এই অবস্থায় কথা বলার সাহস পেলনা ও। তুহিন ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তমালকে। ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরও রেগে গেল ও। ঝাঝালো কন্ঠে বলল, ‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো কেন? বলে ফেলো!’

নড়েচড়ে উঠল তমাল। আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, ‘স্কেচের লোকটাকে কেউ দেখেনি স্যার। আর না রুদ্রকে। দুজনের কেউই আসেনি এই হোটেলে। তাছাড়া, ওদের নাকি কাউকে দেখে কোন সন্দেহ অবধি হয়নি।’

বাহ! ষোল কলা পূর্ণ। ঠোঁট কামড়ে ধরে মেজাজ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল তুহিন। ঐ চারজনের নাম্বারে ডায়াল করে দুজনকে পাওয়া গেল। তারা এক্ষুনি আসছে হোটেলে। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে ধরে নেওয়া যাচ্ছে এরা খুনি নয়। বাকি রইল দুজন। রেজিস্ট্রার থেকে চারজনেরই সব ইনফরমেশন নিয়ে যাচাই করার, আর যে দুজন আসছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার দায়িত্ব তমালের ঘাড়ে দিলো তুহিন। অতঃপর ভয়ানক মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে।
সিঁড়ির ঐ সিসিটিভি আনকভারড জায়গাটাতেই বেশ বদলেছে খু-নি। সন্দেহ নেই তাতে। সময় না মেলার কারণ একটাই হতে পারে। খুব ধৈর্য্য ধরে ঐ জায়গায় বসে থেকে সময় নষ্ট করে গেছে লোকটা। যাতে কোনভাবেই ধরা না যায়, আসলে সে কে। ওয়েল প্লেইড! দাঁতে দাঁত চাপল তুহিন।খু-নির ওপর ভয়ানক রাগ হচ্ছে ওর। কেন জানি রুদ্রর চেহারাটাই বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। যাকে কোনদিন সামনাসামনি দেখেই নি তাকেই বহু জন্মের শত্রু বলে মনে হচ্ছে। রুদ্রকে ওর চাই। এই কেইসের দায়ে না হলেও বাকি অপরাধগুলোর সুত্র ধরে হলেও চাই। বাই হুক, অর বাই ক্রুক।

নিজের কেবিনে এসেছে তুহিন। চ্যায়ারটাতে হেলান দিয়ে টেবিলের ওপর দু’পা তুলে দিয়েছে। চোখ বুজে গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। একটা লোককে এমন নির্মমভাবে খু’ন করে; নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেল খু-নি। কিন্তু কেউ টের অবধি পেলোনা! রিডিকিউলাস!
অথচ খুনের খবরটা যখন ওদের কাছে এসে প‍ৌঁছেছে; ততক্ষণে খুনি পগারপার। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র শেখই ভরসা। দেখা যাক সে কোন চমকপ্রদ তথ্য দিতে পারে কি-না। তুহিনের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। মহিউদ্দিন শেখের কল। মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করল তুহিন। কৌতুকের স্বরে বলল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, খারাপ মানুষ সহজে মরেনা। আপনার কথাই ভাবছিলাম, আর আপনিই কল করলেন।’

‘ কম্প্লিমেন্টের জন্যে থ্যাংক ইউ। এবার কাজের কথা শোন।’

মহিউদ্দিনের গম্ভীর কন্ঠস্বরে সতর্ক হয়ে উঠল তুহিন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে নিশ্চই। কৌতুক ছেড়ে নিজেও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ বলুন।’

‘ তোমার ধারণা মোটামুটি ঠিক ছিল। মুখে হে-রো-ই-ন গুজে দিয়েছিল সবার আগে। এরপর বাকি কাজটা করতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি। আর বাকি যেসব স্যাম্বল পাঠিয়েছিলে তাতে উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।’

চোখ বুজে বসে রইল তুহিন। আজ ওর হতাশ হওয়া দিবস। তুহিনকে চুপ থাকতে দেখে মহিউদ্দিন হেসে ফেলল। বলল, ‘এতো হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ইন্টারেস্টিং খবর আছে।’

তুহিন নিরুৎসুক কন্ঠে বলল, ‘বলে ফেলুন।’

‘ গুলশানের দ্বিতীয় খু-ন আর মীরপুরের খু-নটার সাথে এই খু’নটার দারুণ মিল আছে। প্রায় একই রকমভাবে মারা হয়েছে।’

চমকে উঠল তুহিন। দ্রুত টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসল। অবাক কন্ঠে বলল, ‘হুবহু একরকম?’

‘ আরে নারে ভাই। এটা মা’র্ডা’র। পরীক্ষার খাতায় টুকে লেখা রচনা না যে হুবহু একরকম হবে। যতটা সম্ভব একইরকম। প্রথমে তীব্র নেশা করিয়েছে। তারপর_’

ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড বসে রইল তুহিন। দ্রুত চিন্তা চলছে মাথায়। মহিউদ্দিন বুঝল, এই ছেলে এখন চিন্তা করতে ব্যস্ত। ওর চিন্তায় কোনরকম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে কল কেটে দিল মহিউদ্দিন। তুহিন আস্তে করে নামিয়ে রাখল ফোনটা। টেবিলে রাখার আগেই মেসেজ টোন বেজে উঠল। ইরার মেসেজ। মেয়েটা লিখেছে, ‘রাতে ঘুমাও নি। খাবারটা ঠিকমতো খেয়ে নিও প্লিজ। ডিসটার্ব করার জন্যে স্যরি।’

মৃদু হাসল তুহিন। ছোট্ট একটা রিপ্লে লিখে টেবিলে রাখল। তখনই দরজায় নক করল তমাল, ‘স্যার আসব?’

‘এসো।’

তমাল কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তুহিন বলল, ‘অপ্রয়োজনীয় একটা শব্দও ব্যবহার না করে রিপোর্ট করে ফেলো।’

বাপরে! ভয়ানক চটে আছে। ঘাবড়ে গেল তমাল। গলা পরিস্কার করে বলল, ‘স্যার! চারজনের মধ্যে দুজনের সাথে সরাসরি কথা হয়েছে। তৃতীয়জন মহিলা। বয়স পয়ত্রিশ। কিন্তু চতুর্থজনের ইনফরমেশনগুলো নকল স্যার। ব্যাটা জালি মাল। তবে চিন্তা নেই, খোঁজ চলছে। এখন একটু সময় বেশি লাগবে এই যা।’

ঠোঁট বাকিয়ে হাসল তুহিন। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘মীর্জার কী খবর?’

‘শওকত মীর্জা এখন দুবাই আছে। আর আপনি ঠিক বলেছেন। এই পলাশ মীর্জা ঐ শওকত মীর্জারই ছোট ভাই। শুনেছি শওকতের ছেলেও বাংলাদেশে আছে। কিন্তু কোথায় আছে সেটা জানিনা।’

চেয়ারে হেলান দিল তুহিন। মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘দেশে থাকলে পরবর্তী টার্গেট ঐ হবে। এতে আর কোন সন্দেহ আছে বলে মনে হচ্ছেনা। খোঁজ নিয়ে দেখো, বাছাধন কোথায় আছে। আমার মনে হচ্ছে মরার আগেই যদি ওকে আমরা পেয়ে যাই। তাহলে খু’নিকে পাওয়া কঠিন হবেনা। তবে শেখ দুটো ফাইল পাঠিয়েছে। আপাতত ওগুলো একটু চেক করো।’

‘ ওকে স্যার।’

তুহিনের সামনের চেয়ারে ল্যাপটপ খুলে বসল তমাল।

তুহিন চোখ বন্ধ করে ফেলল। দু আঙুলে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে আবার মগ্ন হয়ে গেল গভীর চিন্তায়। ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোলা হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে নটা খু-ন হয়ে গেছে। অথচ সম্ভাব্য খু-নিদের কারো সঙ্গে কারো চেহারা মিলছে না। তাহলে ধরে নেওয়া যাক, চেহারা বদলাচ্ছে খুনি। মেকআপ করে, ছদ্মবেশ নিয়ে। কিন্তু সেটা কে? রুদ্র? তিনটে গ্রুপের সমস্ত ফাইল ঘেটে যা দাঁড়িয়েছে; তাতে দুজন ছাড়া বাকি যারা খু-ন হয়েছে তাদের মা-রা-র প্রপার রিজন একমাত্র ওর কাছেই আছে। অথচ ওর সাথে আবার লক্ষ্মীপুরের খু-নির ডিএনএ ম্যাচ করছেনা। কিন্তু সব খুনের এক এবং একমাত্র কারণ রাশেদ আমেরের ঐ নতুন প্রজেক্ট। সেটাও অস্বীকার করা যাচ্ছেনা। আবার মহিউদ্দিন বলছে বাকি খুনগুলো আলাদাভাবে হলেও তিনটে খু-নের ধরণ এক। সবটা মিলে কী হচ্ছে? জগাখিচুড়ি!

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here