অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৩৪.

0
3

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৩৪.

আমের ভিলা। সদর দরজা সামান্য খুলে হলরুমে উঁকি দিল উচ্ছ্বাস। আবছা অন্ধকার ঘরটায়। চারপাশে ভালোভাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দেখতে পেলো না কাউকে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। উচ্ছ্বাস নিশ্চিন্ত হলো। ফিরে এলো জিপের কাছে। নেশায় বুদ হয়ে সিটে পড়ে আছে রুদ্র। সময় নষ্ট করল না উচ্ছ্বাস। কাঁধের ওপর রুদ্রর হাত নিয়ে দাঁড় করাল ওকে। ভারসাম্য বজায় রেখে নিয়ে এলো বাড়ির ভেতর।
রুদ্রর এই অবস্থা সম্পর্কে আমের ভিলার কেউই অবগত নয়। একমাত্র উচ্ছ্বাস ব্যতিত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের এক অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে ছেলেটা। সারাদিন রুদ্রকে দেখে কারো বোঝার ক্ষমতা নেই, কী চলছে ওর মধ্যে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ফাউন্ডেশন সামলানো, দলের কাজ দেখা, সব ঠিক নিয়মমাফিক করে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সারাদিন সব কাজ সারার যখন রাত নামে; মনের সাথে সাথে শরীরটাও ভেঙ্গে পরে রুদ্রর। মধ্যরাতে বারে বসে বোতলের পর বোতল হুইস্কি শেষ করে। যা ভেতরের যন্ত্রণা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। আর ওর অর্ধচেতন দেহটাকে বার থেকে তুলে আনার কাজটা করতে হয় উচ্ছ্বাসকে। সবার অলক্ষ্যে। কেউ জানেও না; শক্ত হাতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী দল সামলানো ছেলেটা নিজেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জানতে দেয়নি কাউকে। গত বারোদিন যাবত এভাবেই চলছে। উচ্ছ্বাস এ নিয়ে কয়েকবার বলেছে, ‘কথা বল রাশেদ বাবার সাথে। নিয়ে আয় প্রিয়তাকে। নিষেধ করবেন না উনি। কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস এভাবে?’

জবাব দিতোনা রুদ্র। একবার শুধু বলেছিল, ‘ একটা সরল, নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন অধিকার নেই আমার। নিজেকে সামলে নিতে জানি আমি।’

অথৈ এই বারোদিনে সামলে নেওয়ার কোন লক্ষণই দেখতে পায়নি উচ্ছ্বাস। সকলের সামনে শক্ত, অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে; ভেতরে ভেতরে গুড়িয়ে যাওয়াকে বুঝি সামলে নেওয়া বলে? আর কেউ না জানলেও উচ্ছ্বাস জানে কী ভয়ানক দহনে দগ্ধ হচ্ছে রুদ্র। সব জেনেবুঝেও পাল্টা কিছু বলতে পারতো না। কীকরে বলবে? এই একই কারণে ও নিজেও তো আজ অবধি নাজিফাকে বলেনি নিজের মনের কথা। সেচ্ছায় এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে নিজেদের মধ্যে।

‘ কী হয়েছে ওর?’

থম মেরে দাঁড়িয়ে গেল উচ্ছ্বাস। বজ্র দৃঢ় কন্ঠস্বরটা যেন ফাঁকা হলরুমে বজ্রপাতের মতোই মনে হল। উচ্ছ্বাস ভয়ে ভয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কয়েক হাত পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন রাশেদ।
সবে রুদ্রকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল ও। দেখে ফেললেন রাশেদ বাবা! শুকনো এক ঢোক গিলল উচ্ছ্বাস। হাতে ধরে রাখা প্রায় অচেতন রুদ্রর দিকে তাকাল একবার। ভাষাহীন হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। রাশেদ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।’

উচ্ছ্বাস এবার খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে আজ। বুঝতে পারেনি। আসলে_’

এইটুকু বলেই থেমে গেল উচ্ছ্বাস। বাক্যটা সম্পূর্ণ করার জন্যে শত খুঁজেও কোন শব্দ পেলোনা। দৃঢ় পদক্ষেপে কয়েক পা এগিয়ে এলেন রাশেদ। গভীরভাবে অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন রুদ্রকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে তাকালেন উচ্ছ্বাসের দিকে। বললেন, ‘এই বুঝতে না পারাটা বারো দিন যাবত চলছে বোধ হয়।’

চকিতে তাকাল উচ্ছ্বাস। সঙ্গেসঙ্গেই নামিয়ে নিল চোখজোড়া। বুঝল, আর কিছু বলার নেই ওর। রাশেদ না জেনে আন্দাজে ঢিল ছোড়ার লোক নন। সব জানে সে। তাই নিশ্চুপ হয়ে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রায় আধ মিনিট কেউ কিছু বলল না। রাশেদ বললেন, ‘যাও এখন। ওকে বলো কাল ঘুম থেকে উঠে আমার সাথে দেখা করতে।’

‘ জি।’

মিনিমিনিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করল উচ্ছ্বাস। অতঃপর রুদ্রকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। পেছন তাকালে হয়তো দেখতে পেতো, অসহায় এক পিতার ব্যথিত দৃষ্টি।

উচ্ছ্বাস রুদ্রকে নিয়ে যখন করিডর পেরোলো; পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো জ্যোতি। বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের যাওয়ার দিকে। কয়েকদিন যাবত রুদ্রকে ঠিকভাবে দেখতেই পায়না ও। সকালে কফি দেওয়ার সময় কোনরকম দেখা সাক্ষাৎ হয়। চেষ্টা করেও আলাপ জমাতে পারেনা আজকাল। কী হয়েছে রুদ্রর? দলীয় কোন সমস্যা? না-কি সমস্যাটা ব্যক্তিগত? কথাটা ভাবতে ভাবতে ওদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলো রুদ্রর ঘরের উদ্দেশ্যে।

রুদ্রকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। মনোযোগ দিয়ে দেখল তেজস্বী এক রাজপুত্রের নিস্তেজ মুখ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে আসতে নিল। কিন্তু রুদ্রর গলার স্বর শুনে থেমে গেল ও। শোনার চেষ্টা করল, কী বলছে। রুদ্র বিড়বিড় করে বলছে, ‘সাদা রঙটাতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে প্রিয়। একদম স্নিগ্ধ পরীর মতো।’

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। কপাল কুঁচকে বলল, ‘শালা! প্রেম করবেনা, বিয়ে করবেনা। এদিকে শুয়ে শুয়ে বাসরের স্বপ্ন দেখছে। ভয়ানক ব্রহ্মচারী! “সাদা রঙে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে প্রিয়।” সিরিয়াসলি!’

কথাগুলো বলে রুদ্রকে আরেকবার ঠিকঠাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল উচ্ছ্বাস। বেরিয়ে এলো রুদ্রর ঘর ছেড়ে।
উচ্ছ্বাসকে ফিরে আসতে দেখে দরজার আড়াল থেকে দ্রুত সরে এলো জ্যোতি। রুদ্র ঠিকঠাকভাবে শুয়ে পড়েছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে মনে একটা খচখচানি বয়েই গেল ওর। রুদ্রর কথা শুনতে না পেলেও উচ্ছ্বাসের সব কথাই শুনেছে ও। কথাগুলোর আগামাথা না বুঝলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ানক অস্বস্তি অনুভব করল জ্যোতি।

সকালের একদম প্রথম শিফটে ক্লাস ছিল কুহুর। তাই বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে আসতে হয়েছে। ফাল্গুন মাস। শীত যাই যাই করলেও; সকালের দিকে এখনো ঠান্ডার রাজত্ব এরিয়ে যাওয়ার মতো নয়। তাই গায়ে পাতলা মতোন একটা নেভিব্লু সোয়েটার জড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম ক্লাসটা করে ক্যান্টিনে ঢুকতেই বেশ গরম লাগল ওর। খাবার অর্ডার করে সোয়েটারটা খুলে রাখল পাশের চেয়ারে। বোরিং লাগছে বেশ। রীতিও আসেনি আজ। বলেছে পরের ক্লাসে জয়েন করবে। আস্ত ফাঁকিবাজ মেয়ে একটা।
খেতে খেতে বারবার চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল কুহু। যেন নিজের অজান্তেই খুঁজছিল কাউকে। নিজের অজান্তে হতাশও হয়ছে বারবার। খাওয়া শেষে কফি নিয়ে সোজা চলে গেলো লাইব্রেরীতে। ওয়ান টাইম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতায় ডুবিয়ে ফেলল নিজেকে। হঠাৎ মাথায় কারো টোকা পড়তেই ভ্রু কুঁচকে চোখ তুলল কুহু। পাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখল নীরব। মন ভোলানো এক হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। গায়ে ছাই রঙের লেদার জ্যাকেট, ক্লিন সেভ, লং লেন্থে কাটা বাদামি চুলে বরাবরের মতোই অসাধারণ লাগছে ওকে। চকলেট বয়। কুহুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচাল নীরব। হেসে ফেলল কুহু।
কয়েকদিনে দুজনের সম্পর্কটা খুব সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। প্রায়ই গভীর রাত অবধি হোয়াটসঅ‍্যাপে অপ্রয়োজনীয় আলাপে ডুবে থাকে দুজন। সরাসরি দেখা বা কথা ক্যান্টিনে নয়তো লাইব্রেরীতেই হয়। প্রথম কয়েকদিন বেশ আড়ষ্ট হয়ে থাকত কুহু। একে সিনিয়র ভাই, তারওপর র‍্যাগিং এর ভয়ে কথা বলতো নীরবের সাথে। কিন্তু কথা বলতে বলতে এখন ওরও খুব ভালো লাগে নীরবকে। কেমন ছটফটে একটা ছেলে। চুপচাপ থাকতে পারেনা একদমই। যতক্ষণ পাশে থাকে কিছু না কিছু বলতেই থাকে। কুহু যতটা শান্ত, নীরব ততটাই চঞ্চল। কুহুর ভীষণ ভালো লাগে নীরবের কথা শুনতে।
কুহু ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করল, কী ব্যাপার?

আবারও ভুবন ভোলানো হাসি হাসল নীরব। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল কুহুর সোয়েটারটা। দু সেকেন্ড অবাক চোখে সোয়েটারটার দিকে তাকিয়ে রইল কুহু। মাথায় চাপড় মেরে আফসোসের ভঙ্গি করল। তারপর হেসে ফেলল। নীরবও হাসল। কুহু নিয়ে নিল নিজের সোয়েটার। এরপর ফোনটা হাতে তুলে মেসেজ করল নীরবকে। লিখল, ‘ আপনি ক্যান্টিনে গিয়েছিলেন?’

নীরব উত্তরে লিখল, ‘ হ্যাঁ। তোমাকে খুঁজতে। তোমাকে তো পেলাম না। কিন্তু তোমার সোয়েটারটা পেয়ে গেলাম।’

রিপ্লে দেখে কুহু খানিকটা অবাক চোখে তাকাল নীরবের দিকে। কুহুর চাহনীর অর্থ বুঝতে পেরে হাসল নীরব। আবার টাইপ করল, ‘ লাইব্রেরীতে জোরে কথা বলা যাবেনা। আর আমি বেশিক্ষণ ফিসফিস করতে পারিনা। ওটা মেয়েদের কাজ। তাই ভাবছি আজ এভাবেই কথা বলব।’

কুহু দুটো ঠোঁট দাঁতে চেপে ধরে মাথা ঝাঁকালো। নীরব লিখল, ‘তোমার বান্ধবী কোথায় আজ?’

‘ আসবে একটু পরে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি।’

‘ আমার মতো অলস। তবে ভালোই হয়। ওর না থাকা সুযোগটা আমি খুব ভালোভাবে নিতে পারি।’

কুহু হাসল। তারপর লিখল, ‘ব্রেকফাস্ট করেছেন?’

‘বাড়ি থেকে করে এসছি। একটা কথা ভাবছি জানো?’

‘ না বললে জানব কীকরে?’

হেসে ফেলল নীরব। লিখল, ‘ তা ঠিক। ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। কিন্তু বাইরে তোমাকে গার্ড দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই পালোয়ান। সবসময় তোমার সাথে কেন ঘোরে ওরা?’

কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠোঁট ফুলিয়ে লিখল, ‘জানিনা। বাবা আর ভাইয়া পাঠায়। আস্ত কালো হাতি দুটো। আমার ওদের একদমই পছন্দ না।’

কুহুর গাল ফোলানো দেখে নীরব ঠোঁট চেপে হাসল। এবার আর টাইপ করল না। খানিকটা এগিয়ে বসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমারও না।’

কুহু কিছু না লিখে বসে রইল চুপচাপ। পা দোলাচ্ছে টেবিলের নিচে। মিনিট খানেক পর নীরব বলল, ‘আচ্ছা, তোমার বাবার নামটাই জানা হয়নি। কুড়ি বছরের মেয়েকে এতো প্রটেকশনে রাখার কী আছে? হারিয়ে যাবে ভাবে নাকি?’

কুহু আবার টাইপ করল, ‘ আমার বাবার নাম রাশেদ আমের। ওদের কেনো পাঠায় তা আমিও জানিনা।’

মেসেজটা পড়েই চমকে উঠল নীরব। চোখ বড় বড় করে তাকাল কুহুর দিকে। প্রায় চেঁচিয়ে বলে বলল, ‘ বলো কী_’

কুহু থতমত খেয়ে গেল। লাইব্রেরীতে থাকা সবাই তাকাল একবার। নীরব নিজেও অপ্রস্তুত হল। বুঝতে পারল এটা লাইব্রেরী। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে কুহুর দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বলো কী! রাশেদ আমেরের মেয়ে তুমি? আমের ফাউন্ডেশনের ওউনার! শুনেছি ভয়ানক লোক উনি। তার ছেলে রুদ্র আমেরতো আরও ডেঞ্জারাস জিনিস। আমি কি-না ঐ বাড়ির মেয়েকে র‍্যাগ দিয়েছিলাম! কী সাংঘাতিক! ভাগ্যিস তুমি ওনাদের কিছু বলোনি।’

কুহু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে দেখছিল নীরবকে। নীরব থামতেই কুহু টাইপ করল, ‘তো? এখন থেকে কী আমায় ভয় পাবেন নাকি?’

নীরব আগের মতো ফিসফিস করেই বলল, ‘ নাহ! এখন আর ভয় পাওয়া সম্ভব না। অনেক এগিয়ে গেছি। ভ’য়া’ন’ক দুটো জিনিসকে সামলে এগোতে হবে, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা ফাউন্ডেশন ওউনারকে লোকে এতো ভয় কেনো পায় সেটাই বুঝিনা আমি। কী জ্বালা!’

কুহু নিঃশব্দে হাসল। গালে হাত দিয়ে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল নীরব। আচ্ছা, কুহু যদি শব্দ করে হাসতে পারতো? কতোটা মধুর, কতোটা মুগ্ধকর হতো সেই হাসির শব্দ? নীরব কী পাগল হয়ে যেতো?

রাশেদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে রুদ্র আমের। পৃথিবীতে এই একটা লোককেই ভয় পায় ও। তেমনই সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গাটাও তার জন্যেই বরাদ্দ। রাশেদের এক কথায় যেমন প্রাণ নিতে পারে, প্রাণ দিতেও পারে রুদ্র। সব করতে পারে এই মানুষটার জন্যে ও। সব।
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে বুঝেছে, গত বারোদিন প্রতি রাতেই যে রুদ্র প্রায় অচেতন হয়ে বাড়ি ফিরতো; সেকথা রাশেদের অজানা নয়। হয়তো আরও বেশিকিছু জানে সে। এই মানুষটার চোখে ফাঁকি দিয়ে কিছু করা প্রায় অসম্ভব ব্যপার। এ ঘরে আসত আসতে সবরকম প্রশ্নের জন্যে নিজেক তৈরী করে নিয়েছে রুদ্র। জবাবও সাজিয়ে নিয়েছ। মনে মনে সেগুলো আওড়ে নিল একবার। লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। এরপর দরজায় নক করে কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ এলো, ‘ভেতরে এসো।’

রাশেদের সামনে দাঁড়াতে এর আগে কোনদিন এতোটা আড়ষ্ট বোধ করেনি রুদ্র। অনুভব করল এই প্রথম ঘাবড়ে গিয়ে হাত ঘামছে ওর। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে একপ্রকার জোর করেই ঢুকলো সিংহের গুহায়।
বরাবরের মতোই নিজের ইজি চেয়ারটাতে গা ছেড়ে বসে আছেন রাশেদ। চোখ বন্ধ। ডান হাতের দু আঙ্গুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে দুই হাত দূরত্বে। দু হাত সামনে একত্রিত করে রাখল ও। চোখ বন্ধ রেখেই সিগারেটে লম্বা এক টান দিলেন রাশেদ। নাক দিয়ে ঘন ধোঁয়া ছাড়লেন। ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে বলেছিলাম রুদ্র, তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। যা ইচ্ছে করতে পারো তুমি। শুধু দুটো ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা ছিল আমার। এক, দলের প্রয়োজন ছাড়া অন্যের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা যাবেনা। দুই, নিজের ক্ষতি করা যাবেনা। এমন কিছু করা যাবেনা যাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলো তুমি। তোমাকে আঘাত করার জন্যে অন্যরা সুযোগ পেয়ে যাক। আর সঙ্গে এটাও বলেছিলাম, এই দুটো নিষেধ অমান্য করলে তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হব আমি। বলেছিলাম?’

একপলক রাশেদের দিকে তাকাল রুদ্র। চোখজোড়া এখনো বন্ধ। রুদ্র যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘জি।’

‘ আমার কথা রেখেছো তুমি?’

অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলল রুদ্র। একটা কথাও বলল না। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ সিগারেট টানলেন রাশেদ। এরপর বললেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে এসো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

চমকে তাকাল রুদ্র। কিছু বলার আগেই রাশেদ বললেন, ‘তুমি আমার ছেলে রুদ্র। একদিন বেশি চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া, চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পর তোমার অদ্ভুত পরিবর্তন, বনানীর ফ্লাটে ঘনঘন যাতায়াত, রাত্রিযাপন, এরপর হঠাৎই মধ্যরাতে চরম মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরতে শুরু করা। তোমার কী মনে হয়? এতোগুলো অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করে গেছো তুমি আর আমি কোন খোঁজ নেই নি? তোমার শরীরে আমারই রক্ত বইছে রুদ্র। তোমাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনি আমি।’

মুখে একটা কথাও এলোনা রুদ্রর। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল নিজের বাবার দিকে। কিন্তু ঘটনায গুরুত্ব বুঝতে পেরে দ্রুত সামলে ফেলল নিজেকে। ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু বাবা..’

‘ মেয়েটা অপছন্দ করতো তোমাকে? থাকতে চায়নি? তোমার প্রতি কোনরকম দুর্বলতা প্রকাশ করেনি?’ রুদ্রর কথা থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন রাশেদ।

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল রুদ্র। বলল, ‘ও অবুঝ বাবা। ওর কোন ধারণাই নেই ঠিক কীরকম জীবন যাপন করি আমি। চোখের সামনে কয়েকটা লোককে কাবু করতে দেখেই আমাকে হিরো ভেবে নিয়েছে ও। ফ্যান্টাসির মধ্যে আছে। ও শুধু জানে আমি ক্রি-মি-না-ল। কিন্তু কোন লেভেলের ক্রিমিনাল সেটা ধারণা করাও ওর পক্ষে অসম্ভব। আগে-পিছে কিছু না ভেবেই থাকতে চাইছে আমার সাথে। জাস্ট হটকারি সিদ্ধান্ত এটা।’

‘ এতোকিছু জানার তো প্রয়োজন নেই ওর। এই বাড়ির মেয়েরা আমাদের ডার্ক সাইট থেকে অনেক দূরে। এসবের সাথে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। সেভাবেই থাকবে ও। ঠিক যেভাবে কুহু মা আছে, জ্যোতি আছে।’

অধৈর্য হয়ে উঠল রুদ্র। রাশেদও কী উচ্ছ্বাসের মতো আবেগে ভাসছেন নাকি! কীকরে বলছেন এসব? অথচ এই রাশেদই ওকে শক্ত হতে শিখিয়েছে। মানসিক শক্তি বাড়িয়ে প্রিয় জিনিগুলোও ত্যাগ করতে শিখিয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেইতো চলছে এসব প্রক্রিয়া। ওরই চোখের সামনে ওর প্রিয় খেলনা, পোশাক, জুতো, পছন্দের সবকিছু ওরই হাত দিয়ে নষ্ট করিয়েছেন রাশেদ। রুদ্রর কান্না, কষ্ট কোনকিছুকেই পাত্তা দেয়নি সে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ওর মায়ের দেওয়া প্রিয় লকেটটা ওর হাত দিয়েই দু টুকরো করিয়েছিলেন রাশেদ। কারণ একটাই ছিল। ঐ লকেটটা এক মুহূর্তের জন্যেও ছাড়তোনা রুদ্র। সবসময় আগলে রাখতো নিজের কাছে। ওর অবুঝ কান্নাকেও সেদিন কানে তোলেননি রাশেদ। চরম নিষ্ঠুরতার সাথে একটা বাচ্চাকে দিয়ে তারই সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা দ্বি-খন্ডিত করিয়েছেন। সহ্য ক্ষমতা বাড়িয়েছে। চোখের জল শুকিয়ে দিয়েছে। মন থেকে মুছে ফেলেছেন সবরকম দয়ামায়া। পাথর বানিয়েছেন ওকে। আজ সেই রাশেদ এসব বলছে!
রুদ্র বলল, ‘এই নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু হওয়ার পর প্রতি সেকেন্ড আমার মাথায় মৃ-ত্যু ঝুলে থাকবে। যেকোন সময় শেষ হয়ে যাব আমি। বিষয়টা আপনার অজানা নয় বাবা। এরকম অবধারিত অকাল বৈধব্য দিতে পারবেন আপনি একটা নির্দোষ মেয়েকে? আমের ভিলায়, আপনার চোখের সামনে আপনার পুত্রবধু বিধবা হয়ে ঘুরে বেরাবে সেটা সহ্য হবে আপনার?’

‘ সেরকম হলে ওর আবার বিয়ে দেব আমি। এখন থেকে ও আমারই মেয়ে। ওর চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা।’

রুদ্র হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর বাবার দিকে। বোকা বনে গেছে ও। বিশ্বাস করতে পারছেনা ব্যপারটা। কোনরকমে বলল, ‘ বাবা_’

সিগারেট ধরা হাতটা তুলে ইশারায় থামিয়ে দিলেন রাশেদ। হাত বাড়িয়ে অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ‘এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। এরমধ্যে ওকে আমি আমার বাড়ির বউ করে ঘরে তুলতে চাই। কীভাবে কী করবে, সেটা তোমার ব্যপার। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ও যেন আমের ভিলায় থাকে। আমার বৌমা হয়ে। আর এটা আমার অর্ডার।’

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

[ অনেকে মেসেজ করেছেন পেইজে/প্রোফাইলে যে গল্প নিউজফিডে যাচ্ছেনা। রীচ প্রবলেম হচ্ছে। তাই যারা যারা গল্প পড়ছেন সবাই কষ্ট করে একটু রেসপন্স করবেন। আর নিউজফিডে দ্রুত পাওয়ার জন্যে পেইজ সি ফার্স্ট করে রাখুন। ভালোবাসা সবার জন্যে ❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here