অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ২৫.

0
2

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৫.

থুতু ছুঁড়ে দিয়ে মহিলা চুল ধরে টেনে তুলল অন্তূকে। অন্তূর শরীরের এক পাশ থেকে ওড়নাটা পড়ে গেল। চোখদুটো বুজে জোরে করে ডেকে উঠল অন্তূ, “আব্বু!ʼʼ টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু পড়ল মাটিতে।

অন্তূ খারাপ মেয়ে। তার শরীরে ওড়না তুলে দেবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না কেউ।

মহিলা বলল, “লাংয়ের সাথে বিছানায় যাইতে মন চায়, বিয়ে কইরা তার বাড়িত যাইতে মন চায় না? এতক্ষণ তাও যা ভাবনায় আছিলাম, তুই তো তার চাইতেও বেশি শয়তান মাইয়া! আমার মাইয়া হইলে জিন্দা কবর দিয়া থুইতাম। মাইয়ারে বয়স চৌদ্দ হইতেই বিয়া দিয়া দিছি। তোর মতোন বে-শ্যা পুষি নাই কলেজে পড়াইয়া।ʼʼ

অন্তূ তার তপ্ত চোখদুটো তুলে তাকাল, “আমি কিচ্ছু করিনি, অপবাদ দিচ্ছেন চাচি আপনি।ʼʼ

ওড়নাটা তুলে বুকে জড়িয়ে নিলো।

“হ, কিছু করোস নাই। খালি লাংয়ের সাথে বিছানায় শুইছিস। তাই তো কই বিয়া করবার চায় না, ভাস্সিটিত পড়বার চায়, হুহহ? সেইদিন মা খাওয়াইছে, আইজ ঘরে স্বয়ং ব্যাটাছেলে ঢুকাই দিয়া বাইরে গেছে গা! এতই যহন রঙ মনে তাইলে আবার বিয়া করবার চাও না ক্যা তারে?ʼʼ

অন্তূর সহ্যক্ষমতা ছড়ালো, চিৎকার করে উঠল ও, “আর একবার কেউ আমার বাপ-মায়ের দিকে নির্দেশ করে কথা বললে পড়ে থাকা ইট তুলে তার মাথাটা দুই খন্ড করতে আমার হাতে বাঁধবে না।ʼʼ

জনতাদের একজন বিরবির করে বকে উঠল, “মা-গীর তেজ এখনও কমেনি? ঘরে বেটাছেলে ঢুকানো মাইয়ার মুখে…ʼʼ

অন্তূর কানে এলো কথাটা, জবাব দিলো, “জি না, তেজ একটুও কমেনি। কী করবেন আপনি? আমার মুখে কী? মেরে ফেলবেন? আপনারা না পরিকল্পনা করছিলেন, বেত মারার? শুরু করুন। আপানদের ভাষ্যমতে পাপ যখন করেছি, শাস্তি আমার পাওয়া উচিত। শরীয়ত অনুযায়ী শাস্তি দেয়া শুরু করুন। কোনো নাটকীয় শাস্তির জন্য প্রস্তুত নই আমি। আপনাদের আন্দাজ করা পাপের শাস্তি কখনও বিয়ে হতে পারে না। বেত্রাঘাত করুন।ʼʼ

মৌলবি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন জয়কে, “তোমার কী মতামত?ʼʼ

জয় অন্তূর ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “হুহ? আমার? আমার মত…আমার আর কী মত? আপনারা বললে বিয়ে করব! না করার কিছু নেই।ʼʼ শেষে আস্তে করে চিবিয়ে বলল, “আফটার অল শালী সুন্দরী, আমার বদনাম তার গায়ে আমার নামের।ʼʼ

অন্তূ চোখ দিয়ে অনুরোধ করে ওঠে, “প্লিজ! এমন করবেন না। আমি সত্যি বলছি অনেকদূর চলে যাব। আর কোনোদিন অসম্মান করব না আপনার, আপনি ‘নাʼ বলুন…ʼʼ

জয় অনড় চোখে চেয়ে থাকল। তার কিছুই করার নেই। সে যা চেয়েছে, তাই হয়েছে‐অন্তূর মুখে থুতু পড়েছে। এখন কী হচ্ছে বা হবে তা নিয়ে তার কোনো লাভ-লোকসান নেই।

কাজী আনতে গেল হামজার দুটো ছেলে। অন্তূ বুঝল, বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণ হিসেবে তার চরিত্রের সাফাই গাইলে কেউ শুনবে না। তাকে অপরাধ মেনে নিতে হবে বাঁচতে হলে।

সে মৌলবীকে বলল, “হুজুর। আমি পাপ করেছি।ʼʼ জিহ্বায় আটকাচ্ছিল কথাখানা।

একটু থেমে মিনতি করল, “আপনি তার শাস্তি দিন আমায়। বিয়ে পড়ানোটা কি শরীয়তের শাস্তি হবে, বলুন? আমার কথা বুঝতে পারছেন আপনি?ʼʼ অন্তূর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে, বারবার ঝাঁকুনি খাচ্ছে।

-“আমায় বেত্রাঘাত করে মেরে ফেলুন, আমায় ফাঁসি দিয়ে দিন, অথবা আমায় এক বোতল বিষ….হুজুর। আমি যা করেছি, তার শাস্তি আপনি আমায় আশিটা না বরং তার দ্বিগুণ একশো ষাটটা মারুন। আপনি জয় আমিরের আঘাতগুলোও আমাকে দিন। ওই লোকটার ভাগে যে বেত্রাঘাত আছে, সেগুলোও আমায় মারুন। জয় আমিরের কোনো দোষ নেই।ʼʼ

মৌলবির সামনে মিনতি করাটা বেক্কলে কাজ হচ্ছে। অন্তূ হামজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রবল আত্মসম্মানী অন্তূ অনুরোধ করে উঠল, “মেয়র সাহেব! আপনি কি ভাইয়ের শরীরের আঘাতের চিন্তা করছেন? নিতে হবে না। সে কিচ্ছু করেনি। সব পাপ, দোষ আমার। আমি করেছি পাপ, আমার শাস্তি পাওয়া উচিত, দরকার। আমি যদি ওর আঘাতগুলো নিই..? এখানে আমায় শূলে চড়িয়ে পাঁচ খন্ড করা হলেও তা মঞ্জুর। আমায় মেরে ফেলুন। বদনাম ধুয়ে যাবে। আব্বু আসার আগে মেরে ফেলুন।ʼʼ

হামজা স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, “পাগলামী করছো, আরমিণ! বদনাম যখন হয়ে গেছে। সত্য-মিথ্যার ধার সমাজ ধারবে না। তোমার শরীরে ট্যাট্টু ছেপে গেছে।ʼʼ

-“কীসের ট্যাট্টু, মেয়রসাহেব!ʼʼ

-“বদনাম অথবা জয়..ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ে, “ট্যাট্টু মোছা যায় না, না?ʼʼ

-“যায় না।ʼʼ

-“আমি যদি ত্বক পুড়িয়ে ভস্ম করে দিই, অথবা উপড়ে তুলে ফেলি শরীরের চামড়া?ʼʼ

-“তাতে বাঁচতে পারবে? তোমার শরীরে দশটা আঘাতও সইবে না। দোর্রা আশিটা বেত একসাথে বেঁধে আশিটা আঘাত করে মারা হয়। তুমি দু-চারটাতে প্রাণ হারাবে। কলঙ্ককে সাথে নিয়েই মরবে। এড়িয়ে যাওয়ার পথ নেই।ʼʼ

অন্তূর দিকে ঝুঁকে নিচু আওয়াজে বলল “বেঁচে থাকলে নিজের কাছে সান্ত্বণা থাকবে, তুমি পাপটা করো নি। আমি তোমাকে বুদ্ধিমতি বলেই জানি। কিছুক্ষণ আগেও তোমার শীতলতায় লোকে অবাক হয়েছে, এত ভেঙে পড়ছো কেন?রিল্যাক্স। প্রস্তুত হও! পাটোয়ারী বাড়ি তোমার অপেক্ষায়।ʼʼ

অন্তূ আস্তে কোরে পিছিয়ে এলো কয়েক কদম। কিছু ভাবছে সে। কিছু জবাব মিলছে। হামজাকে তার বড্ড ভয় করছে। পলাশ এবং জয়ের চেয়েও বেশি ভয়। হামজা দেহে বাস করা ক্যান্সার কোষের মতো। নীরব ঘাতক।

চারদিকে গুঞ্জন থামেনি। যেহেতু মেয়ে বিয়ে করতে চাইছে না, তার মানে বিয়ে দেওয়াটাই ওর শাস্তি। চমৎকার যুক্তি সমাজের।

বসে রইল অন্তূ সিঁড়িতে। আজান পড়ছে। স্বভাববশত ওড়না তুলে মাথায় দিলো। আজ আর দৌড়ে গিয়ে ওযু করে নামাজ পড়তে বসল হলো না। চরিত্রহীনদের নামাজ পড়ার দরকার নেই। আব্বুর টুপিটা খুঁজে দেয়া হল না। আব্বু এ সময় আছরের নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়, অন্তূ গেটটা আটকে নামাজে বসে। অন্তূ নির্বাক চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

জয় একটা চেয়ারে বসে পড়ল। পরনে এখনও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। হাঁটুর নিচে ঘন পশম। পা দুলাচ্ছে বসে। দেখতে ক্লান্ত লাগছে। সে এত কিছু ভাবেনি, এখনও ভাবছে না। চিরদিন লাগামহীনের মতো অপরাধ করেছে, কোথাও এমন দ্বিধা-দ্বন্দ ভরা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কেউ প্রতিবাদ করেনি কখনও। সব গুলিয়ে যায় অন্তূর সামনে। সবকিছুর বাজি পাল্টায়, এমনকি তার লাগামছাড়া অপরাধেরও। অন্তূর ওপর রাগটা তরতর বাড়ছে, জেদ উঠছে।

অন্তূ মাটির কাছে অনুরোধ করে, ‘ফাঁক হয়ে যা। আমাকে এই মুহুর্তে জায়গা দে তোর গর্ভে। নাকি তুই-ও ভুল বুঝছিস আমায়? আমাকে কি তোরও বলাৎকার মেয়ে মনে হচ্ছে, মাটি? তুই কথা বলিস না? তোর বুকে দাঁড়িয়ে মানবসন্তান এত কিছু ঘটায়, তোর ধৈর্য্যে কুলায় সবটা? তোর বুকে ভার অনুভূত হয়না?

মাটি জবাব দেয় না। অন্তূ চেয়ে থাকে মাটির দিকে।

নামাজ শেষে কাজীকে সাথে নিয়ে লোকজন ফিরল। হামজাও সবার সাথে নামাজ পড়ে ফিরল। সকলে যে যার স্থান নিয়ে আলোচনা শুরু হলো ছোট্ট একটা।

পাড়ার প্রবীণরা হামজাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তো তুমি কী বলো? বিয়ে পড়ানো শুরু করা যাক?ʼʼ

হামজাকে বলার সুযোগ দিলো না অন্তূ। চিৎকার করে উঠল, “বললাম না বিয়ে হবে না? আমাকে এখানে কেটে শত টুকরো করলেও কোনো রকম বিয়ের আয়োজন হবে না এখানে। আমি যা করেছি, তার জন্য বিকল্প যেকোনো শাস্তি দিন আমায়, আমি তৈরি আছি।ʼʼ

-“কিন্তু আমরা চাইতেছি না তোমারে জিন্দা মাটিতে পুঁততে।তারচে..ʼʼ

-“কিন্তু আমি তো চাইছি, আমাকে পোঁতা হোক, বেত্রাঘাতের সাঁজা দেয়া হোক! আপনাদের ব্যথা লাগছে কেন? মার পড়বে আমার শরীরে। তাছাড়াও আমার মতো চরিত্রহীনের জন্য এত মানবিকতা দেখালে বরং আপনারা কিন্তু গুনাহগার হবেন আল্লাহর কাছে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে আঘাত করা শুরু করুন।ʼʼ

লোকজন ফাঁপড়ে পড়ে গেল। অদ্ভুত চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল। এখনও মেয়েটার কথার যুক্তি, ভাষার বিন্যস্ততা, চোখের প্রতিবাদ এক বিন্দু কমেনি। যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে জয়ের অপরাজেয় মস্তিষ্কেও বিস্ময় খেলে গেল। চোখ সরাল না অন্তূর ওপর থেকে। অন্তূর মুখে ঘাম জমেছে, বুকটা ওঠানামা করছে, চোখদুটো কাতর অথচ অগ্ন্যুৎপাতের গলিত লাভা যেন ঠলকে পড়ছে।

সন্ধ্যা হবার অল্প অল্প বাকি। আমজাদ সাহেব হেঁটে এগিয়ে আসছেন। রাবেয়া উনার ডানবাহু ধরে এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে ক্রমশ। অন্তিকের লম্বা মাথাটা দেখতে পাওয়া গেল উনাদের পেছনেই। অন্তূ যেন ফুরিয়ে গেল এক লহমায়, সমস্ত জীবনীশক্তি ত্যাগ করে এক দলা মাটির স্তূপে পরিণত হয় মেয়েটা। এই কথাগুলো এই লোক কীভাবে আব্বুর কানে তুলবে? আব্বুর কেমন লাগবে শুনতে অন্তূর ব্যাপারে এমন সব কথা?

আমজাদ সাহেব অবাক হলেন বাড়ির সামনে ভিড় দেখে। অন্তূর অবস্থা দেখে সৌম্য মুখখানা অস্থির হলো। একে একে লোক আমজাদ সাহেবকে নিজেদের মনমতো করে রসাত্মক কাহিনি জানাতে শুরু করে।

-“মাইয়া তোমার অকাম তো করছে, মাগার সেই লাংয়ের লগে বিয়াত্ বসবার চায় না।ʼʼ কেউ আবার বলে, ‘আমজেদ! মাইয়ারে ব্যবসায় দিছো নাকি? ব্যবসা যারা করে, হেরা বিয়ে করবার চায় না।ʼʼ

কথাগুলো সহ্য করতে পারে না অন্তিক। তেড়ে যায় মারতে ক্ষ্যাপা পাগলের মতো। লোকটাকে দুটো ঘুষি মেরে নাক দিয়ে রক্ত বের করে আনলো। লোকের মেজাজে বিরূপ প্রভাব পড়ল এতে। পাপীর ভাইয়ের এই আস্পর্ধা তারা ভালোভাবে নেবে কেন?

আমজাদ সাহেব থামালেন ছেলেকে। অনেকক্ষণ যাবৎ শুনলেন দাঁড়িয়ে পাড়ার ও সমাজের প্রতিটা স্বাধীন নাগরিকের নিজস্ব মূল্যবান মন্তব্যগুলো। কেউ জয়কে বলছে না। জয় পুরুষ, জয় হামজার ভাই, হুমায়ুন পাটোয়ারীর ভাগ্নে, এই অঞ্চলের অভিজাত পরিবার, আমির পরিবারের একমাত্র উত্তরসূরী। জয়কে বলতে নেই।

মাগরিবের আজান শোনা যায় চারদিকে। মাথা থেকে পড়ে যাওয়া ওড়নাটা আর তুলে মাথা ঢাকে না অন্তূ। দেহ ব্যবসায়ী মেয়েরা তা করে নাকি? তার পর্দা পলাশ নিজের শক্তিশালী হাতে খুলেছে তা আর অন্তিক চাইলেই উঠে পড়বে নাকি?

আমজাদ সাহেব ধীরে হেঁটে এসে বসেন অন্তূর পাশে। বেশ খানিকক্ষণ কেউ কথা বলে না। শ্বাস ফেলে না কেউ-ই। অন্তূর ভেতরে মৃত্যুর নেশা জাগে। আর মৃত্যুর আগে পাশে বসা আব্বুর চেহারাখানা একবার দেখতে চায় সে।

-“বিয়ে দিতে চায় ওরা তোকে, অন্তূ। করে নে বিয়ে।ʼʼ নির্মল কণ্ঠস্বর আমজাদ সাহেবের।

অন্তূ হেসে ওঠে, “মেরে ফেলো আব্বু, আমায়। তোমার হাতে মরণ আমি ধন্যবাদান্তে গ্রহন করব। দাফন করে ফেলো। মিটিয়ে দাও আমার নাম।ʼʼ

-“বিয়ে করে নে, অন্তূ।ʼʼ

-“আমায় তুমি মেরে ফেলো।ʼʼ

-“অন্তূ বিয়েটা ক…ʼʼ

-“আমায় মেরে ফেলো, আব্বু।ʼʼ

-“বিয়ে করে নে, অন্তূ…ʼʼ

অন্তূ চেঁচিয়ে উঠল, “মেরে ফেলো তুমি আমায়। নিজহাতে মারো। এমনিতেও তো বেঁচে নেই, তবুও আমায় মারতে এত দ্বিধা! অথচ যখন বেঁচে ছিলাম, কেউ বাঁচানোর ছিল না এই আসমান-জমিনে। তুমিই বা কেন সহমর্মিতা দেখাচ্ছ, আব্বু? মরা মেয়েকে মুক্তি দাও। তার আত্মাটা আঁটকে আছে, খুব ছটফটাচ্ছে ছাড়া পেতে।ʼʼ

এতক্ষণে অন্তূ তার হৃদয়ের ক্ষরণ টের পেল। অন্তূদের কান্না বিশেষ মানুষেরা ছাড়া কেউ দেখতে পায় না। সে কখনও রাবেয়ার সামনেও কাঁদে না। রাবেয়ার গুনগুনানি তার কানে আসছে। এক ধারে বসে হু হু করে কাঁদছেন।

আমজাদ সাহেব অন্তূর হাতটা নিজের হাতের ওপর রেখে বললেন, “কোন অপরাধে মারি তোকে বলতো, অন্তূ? আমার মতো দূর্বল, হাতকাটা বাপের ঘরে জন্মানোর অপরাধে? তোকে মেরে নিজেকে জবাব কী দেব, আমি? শিখিয়ে দে। যে পাপ তুই করতে পারিস না, সেই না করা পাপের শাস্তি দেবার উপায় বল।ʼʼ

-“পাপ করেছি, আব্বু! চুপ থাকতে না পারার পাপ। ভেতরের ঘেন্নাকে ভেতরে চেপে মিথ্যা তোষামদ না করতে না পারার পাপ। তোমার শেখানো আদর্শ আজ খুব ভারী পড়ছে আব্বু আমার ওপর। এত পাপের পরেও পাপ নেই বলছো?ʼʼ

-“পাপ করলে তোকে আমি মেরে ফেলতাম। করিসনি তুই, তাই বাঁচিয়ে রাখছি, আর তার বদলে এক নিকৃষ্ট মৃত্যু দিচ্ছি তোকে। গ্রহণ কর।ʼʼ

-“কী আশ্চর্য, আব্বু! মৃত্যুটা মৃত্যু হোক, এরকম নরকবাস দিচ্ছ কেন?ʼ

-“এটা নীতি, অন্তূ। অপরাধ না করা মানুষেরা আজকাল কঠোর সাঁজা ভোগ করে। অবশ্য তাদেরও অপরাধ আছে। তাদের অপরাধ—তারা অপরাধ করেনি। তুই নিজে যখন জানবি তুই পবিত্র, এটা ভেবে বেঁচে থাকাটা কি বাহাদুরী না? আর যে অপরাধ করিসনি, তা মেনে নিয়ে ভীরুর মতো মরে যাওয়া কি তোর জন্য ধিক্কারজনক না?ʼʼ

অন্তূ কথা বলে না। আব্বুর কথাগুলো খুব নিষ্ঠুর।

-“বীরেরা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালায় না, অন্তূ। তুই পালাতে চাইছিস। তুই মরে গিয়ে প্রমাণ করতে চাইছিস–তোর ভেতরে জীবনের সম্মুখীন হবার শক্তি নেই। বিয়ে করে নে, অন্তূ।ʼʼ

অন্তূর বাঁধ ভাঙে। কান্নারা ছিটকে আসে, “আমায় তুমি আর এ কথা বোলো না, আব্বু। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার ব্যথা লাগছে।ʼʼ

-“আমার লাগছে না, অন্তূ। কী করি বলতো?ʼʼ

-“তুমি খুব নিষ্ঠুর, আব্বু!ʼʼ

-“তোকেও হতে হবে, অন্তূ। বানাতে তো তা-ই চেয়েছি ছোট থেকে। সেসব প্রয়োগ কর।ʼʼ

-“তুমি এত কঠোর হয়োনা আব্বু আমার ওপর। আমায় জিবীত পুড়য়ে ভস্ম করে দাও। আচ্ছা, তুমি যা বলছো, তা তুমি সহ্য করতে পারবে?ʼʼ

অন্তূর দিকে এতক্ষণে প্রথমবার তাকান আমজাদ সাহেব, “না পারলেই বা কী?ʼʼ

অন্তূ মাড়ি আঁটকে চোখ বোজে। আব্বুর চোখে তাকানোর ভয়াবহ কাজ সে করতে পারবে না। চোখ বুজে কেমন করে যেন ডেকে ওঠে, “আব্বু!ʼʼ

-“ডাকছিস কেন, অন্তূ? হাতবাঁধা বাপদের তোদের মতো অন্তূরা ডাকবে না।ʼʼ

-“দোষ তো তোমার। জানো না, আমি তোমায় ছাড়া কত নিরুপায়! তবু একা রেখে গেলে? দেখেছ আমি বলতাম তুমি ছাড়া এক মুহুর্ত টিকবো না আমি। প্রমাণ হলো তো! তুমি স্বার্থপর কেন, আব্বু?ʼʼ

-“নিয়তির দোষ দিবি না? প্রকৃতি আর নিয়তি দেখ ঠিক জিতে গেল অপরাধ কোরে। তুই ওদের দোষ দিলি না। দোষ দিচ্ছিস আমার।ʼʼ কেমন করে যেন হাসলেন আমজাদ সাহেব।

-“তুমি আমায় মেরে কেন ফেলছো না?ʼʼ

-“মারছি না তো কী করছি? এইতো বেশ কয়েকবার মরতে বললাম। আবার বলছি—বিয়ে করে নে, অন্তূ।ʼʼ

অন্তূ চেপে ধরে আব্বুর কম্পিত হাত, শক্ত করে মুঠো করে ধরে রাখে, ছাড়ে না। মাথাটা নুইয়ে হু হু করে কাঁদে বাপের কাছে। এতক্ষণ তার সাথে যা যা অন্যায়-অবিচার হয়েছে সবকিছুর নীরব নালিশ জানায়। বাপ একবারও জিজ্ঞেস করে না, তুই কী করেছিস, অন্তূ? সন্দেহ শব্দটা অচল এখানে, এখানে কথা জবানে নয়, চোখে হয়। এই সম্পর্কটা অগাধ আশ্বাসের, ভিত্তিটা নিগূঢ় বিশ্বাসের।

-“অন্তূ, তোকে কাঁদতে দেখতে ভালো লাগে। না আমার। ছোটবেলা থেকে কাঁদতে শেখাইনি তোকে।ʼʼ

অন্তূ চোখ মুছল, “কাঁদছি না। ও কথা আর বলবে না। তুমি শুধু হাতটা ধরে থাকো আমার। ছাড়বেনা কিন্তু।ʼʼ

-“আমি বলব। যতক্ষণ তুই ‘হ্যাঁ’ না বলবি, আমি বলব।ʼʼ

অন্তূ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। ভয় এবং ভরসাহীনতা পেয়ে বসে এই মুহূর্তে অন্তূকে। সে ভুলে যায়, এটা তার আব্বু। আব্বুর হাতে চেপে রাখা হাতটা শিথিল হয় তার, এই অসহায়ত্ব অন্তূর সইতে পারে না। ওমনি আরও শক্ত বন্ধনে চেপে ধরেন আমজাদ সাহেব হাতটা।

গাঢ় চোখে চেয়ে বলেন, “লোকেরা কী বলেছে, ভুলে যাচ্ছিস? ব্যবসা যারা করে, তারা বিয়ে করতে চায়না।ʼʼ

অন্তূর চোখের পাতা ও থুতনি থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমজাদ সাহেবের ভেতরের আগুন জ্বলছে। সেই আগুন স্পর্শ করে অন্তূকে। সে সজল চোখে চেয়ে থাকে মেহেদীরঙা চাপদাঁড়ি ভূষিত এক মহাপুরুষের দিকে। তার চোখে মহাপুরুষই বটে! সে জীবনে এমনই এক মহাপুরুষ চেয়েছিল। তবে চাওয়া আর পাওয়ার একটা জটিল শত্রুতা আছে। অতএব এ দুটো একত্রে মেলে না কভু। বরাবর পিছলে যায় দুটো পরস্পর থেকে।

আমজাদ সাহেব যত্ন করে ওড়নাটা তুলে অন্তূর মাথায় দিলেন। আলতো হেসে বললেন, “হুমায়ুন আহমেদ কী বলেছিলেন জানিস,

~ কখনও তোমার মুখটা বন্ধ রাখতে হবে, গর্বিত মাথাটা নত করতে হবে, স্বীকার করে নিতে হবে যে তুমি ভুল। এর অর্থ এই নয় যে, তুমি পরাজিত। এর অর্থ তুমি পরিণত এবং শেষবেলা বিজয়ের হাসিটা হাসার জন্য ত্যাগ স্বীকারে তুমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।ʼʼ

কাজী সাহেব কাবিননামা লিখলেন,
‘জাভেদ আমিরের একমাত্র পুত্র জয় আমিরের সঙ্গে—

থামলেন কাজী সাহবে। জয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “দেনমোহর কত বাঁধবো, বাপ?ʼʼ

-“কোটিখানেক বাঁধেন, আমি কি কোনোদিন ছেড়ে দেব নাকি?ʼʼ

কাজী সাহেব বললেন, “ছেড়ে দেয়ার সময় দেনমোহর আদায়ের হুকুম নেই। নিয়ম হলো, দেনমোহর পুরো মিটিয়ে তবে স্ত্রীর কাছে যেতে পারবে, বাবা।ʼʼ

-“তাইলে এক টাকাও বাঁধার দরকার নাই।ʼʼ

দ্রুত ঘাঁড় নাডে জয়। কবীর আর রাহাত ফিক করে হেসে ফেলল। হামজা বলে, “বাঁধেন লাক্ষ দশেক। পরিশোধ করেই কাছে যাবে।ʼʼ

উপস্থিত জনতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কত উদার পাটোয়ারী পরিবার! এত উদার কেন এরা? একটা মেয়ের জীবনে আর কী চাই? সবই তো দিচ্ছে পাটোয়ারী পরিবার! অথচ ঘরে তুলছে চরিত্রহীন এক মেয়েকে!

কবুল বলার আগ মুহুর্তে অন্তূ আব্বুর দিকে তাকায় আমজাদ সাহেব মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রাবেয়া, চোখের পানি ছলছল করছে, কিন্তু পড়ছে না। পাশে অন্তিক। তার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব ছাড়াও আরও কিছু। অপলক অন্তূকে দেখছে।

জয়কে কবুল বলতে বলা হলে সে বেহায়ার মতো ঘোষনা করে কবুল পড়ল। যেভাবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষন দেয়। ছেলেরা একসাথে ধ্বনি দিয়ে উঠল, “জয় বাংলা! জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!ʼʼ

মুখে মিষ্টি তুলে দিলো হামজা। মানুষ খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ পড়ে, জয় মুখে মিষ্টি নেবার আগে ‘বিসমিল্লাহʼ বলার বদলে স্লোগান দিলো—’জয় বাংলা।ʼ এরপর গালে মিষ্টি ঢুকালো। ছেলেরা তার সাথে সমস্বরে স্লোগান দিলো, “জয় বাংলা!ʼʼ

বিয়ের আসর নয়, রাজনীতির মঞ্চ এটা। বিশাল এক সম্মেলন চলছে যেন।

কাজী সাহেব কয়েক বার ‘কবুলʼ বলতে বললেও অন্তূ শুনতে পায় না। আব্বুর দিক থেকে চোখ ফেরে না তার। আব্বু কিছু বলুক, কিছু করুক, একবার চোখ তুলে দেখুক অন্তূকে বলি হবার আগে! তাকালেন না আমজাদ সাহেব।

কবুল বলতে ঠোঁট নাড়াতে গিয়ে আবার থামে। আমজাদ সাহেব ধীর পায়ে ভেতরে পা বাড়ালেন। তিনি বসে থাকলে ওই অন্তূ জীবনেও কবুল পড়বে না। পাগলিটাকে কীভাবে বোঝাবেন–উনার কিছু করার নেই! স্বয়ং নিজহাতে বোধহয় খু-ন করে এলেন অন্তূকে। সেই লাশ দেখতে ভালো লাগছিল না। হাতটা মেলে ধরলেন চোখের সামনে। উনার মনে হলো, র-ক্ত লেগে আছে তাতে। অন্তূর কলিজা চুইয়ে পড়া র-ক্ত।

আস্তে করে শুনতে পেলেন, পেছনে অন্তূ প্রাণহীন স্বরে বলছে, ‘কবুল।ʼ কাজী সাহেব আলহামদুলিল্লাহ বললেও অন্তূ বলেনি।

হুড়মুড়িয়ে বসে পড়লেন আমজাদ সাহেব মেঝের ওপর দরজার কপাট আঁকড়ে ধরে। অন্তূ আজ ফুরিয়ে গেছে, বাপের মান রাখতে, নিজেকে একবার গজিয়ে তোলার প্রয়াসে অন্তূ আত্মহত্যা করেছে। অন্তূ জয় আমিরকে ‘কবুলʼ করেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here