অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ২০.(বর্ধিতাংশ)

0
3

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২০.(বর্ধিতাংশ)

-“মেয়েটা আপনার স্যারের মেয়ে, তাই তো?ʼʼ

মুস্তাকিন মৃদু মাথা নাড়ল।

ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “দেখুন অফিসার! আপনি নিজেই যেখানে উপস্থিত সেখানে পুলিশ কেইসে যাবার আগে আপনার সাথে আলাপ করে নিচ্ছি। মেয়েটার কথায় পরে আসছি। ওর বাবার শরীরে ভালো মাত্রার বুপ্রেনরফিন ড্রাগ ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়েছে। সাথে যে চোরাই-আঘাতের চিহ্নগুলো রয়েছে দেহে, পর্ববর্তীতে সেসব স্থানে টিউমার এবং তা থেকে ক্যন্সারের সৃষ্টি অবধি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বুঝতে পারছেন, কেমন চোরাই মারের শিকার হয়েছেন লোকটা? কিন্তু এসব কারা করেছে, কেন করেছে? এই প্রশ্ন উঠলেই চিকিৎসকবাদী কেইস ফাইল করা আমাদের কর্তব্য। সেটা আপনার জন্য ঠেকে রইল। এরকম একটা কেইসে আমরা এভাবে চুপ থাকিনা। কিন্তু যেখানে স্বয়ং আপনি.. তবুও থানায় জানাতে..ʼʼ

মুস্তাকিন ব্যস্ত হয়ে উঠল, “বুঝতে পেরেছি। ওসবের আর দরকার নেই। অন্তূ…মানে মেয়েটার কী অবস্থা, সেটা বলুন, ডক্টর!ʼʼ

-“গভীর ক্ষত মানসিকতায়। কোনো ঘটনা তাকে আঘাত করেছে, যা তার জন্য একযোগে নেয়া বোধহয় কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা বোকা নই, অফিসার। ওর কন্ডিশন যেটুকুই দেখেছি, এবং গেট আপ যা ছিল এখানে আসার পর, আই থিংক ওকে রেপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরনে বোরকা ছিল, তাও অক্ষত নয়, আবার ওর বাবার এই হাল…আপনারা কি কিছু লুকোতে চাচ্ছেন? একটা মেয়ের জন্য ব্যাপারটা মরণসম প্রেশার-ইমপেক্টেড তার মানসিকতার ওপর। আপনারা ব্যাপারটাকে ফ্যান্টাসি হিসেবে নিচ্ছেন যেন! কোনোরকম পদক্ষেপ নেই, আমি বুঝতে পারছি না বিষয়টা। এ নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না তো? ব্যাপারটা ব্যাপক গোলমেলে। মানে…ʼʼ

মুস্তাকিন থামালো, “রিল্যাক্স, ডাক্তার সাহেব। আসলে আমি নিজেও পুরোটা জানিনা। হয়েছে অনেক কিছু তা আমিও জানি, তবে.. অন্তূর এক্সাক্ট অবস্থাটা জানতে চাচ্ছি। আমিও জানিনা কী হয়েছে! ওর কী অবস্থা?ʼʼ

-“মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে বারবার। ম্যান্টালি প্রেশার ফিল করছে অতিরিক্ত। যে কারণে বিভিন্ন ধরণের হ্যালুসিনেশন ক্রিয়েট হচ্ছে ওর সামনে। ইল্যুশন আসছে মস্তিষ্কে। সি নিড’স মেন্টালি সাপোর্ট এন্ড লটস অফ রেস্ট।ʼʼ


নির্বাচনের সকালে ঘুম ভাঙল দশটায়। এখনও অবধি বাইরে সব ঠিকঠাক। দলের কাউকে কোনো কেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে রাখেনি হামজা। কারচুপির বদনাম ছাড়া বিপুল ভোটে জিততে চায় সে। শুরুতে ক্যারিয়ারটা সর্বোচ্চ দাগমুক্ত রাখতে হবে। সামনের ধাপগুলো মানুষের আস্থা নিয়ে এগোতে হবে।

ঝন্টু সাহেব নির্বাচনে নেই। মাজহারের শরীর এখন পুরোপুরি ভালো না, তবে টুকটাক চলাচল করতে পারছে। সবকিছুর বদলা হিসেবে আজ ভোটকেন্দ্রগুলোতে খুব খারাপ কিছু ঘটার চান্স রয়েই যায়। আবার সারাদিন না হোক, ভোট গণনা অথবা ঘোষনার পরেও ঝামেলা হতে পারে।

তুলি এসে বসল হামজার পাশে, “ভাই! কোয়েলের দুধ ফুরিয়ে গেছে, একটু কাউকে পাঠা দুধ এনে দিতে।ʼʼ

হামজার সাথে তুলির সম্পর্ক ভালো না। আগে ছিল, এখন নেই। এখন দুজন দুজনের সাথে কথা বলতেও আঁটকে যায়। সীমান্ত মন্ডলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করার পরিণামে দুই ভাই-বোনের এই দূরত্ব। সীমান্তর এত মারধর সহ্য করেও তুলি ও বাড়িতে রয়ে গেছিল, হামজা আনতে যায়নি, আসলেও বলে না চলে যেতে। হামজা তুলির কাছে বাচ্চাদের মতো অনুরোধ করেছিল, সীমান্তকে ভুলে যেতে। এরপরেও তুলির এই পদক্ষেপ হামজাকে বহুদূরে টেনে এনেছে।

জয় উঠে এসে ঝারি মারল একটা, “কাঁদছে কেন মেয়ে? দুধ ফুরিয়ে যাবার পর বলার কারণ কী? সেই সময়টুকু কি দুধের পাতিল গুলিয়ে খাওয়ানোর পরিকল্পনা থাকে? এইসব বালবেটিরা বাচ্চা মানুষ করছে!ʼʼ

তুলি কিছু বলল না। সে ব্যতিক্রম কিছু আশা করে না জয়ের কাছে। সাদা ধবধবে লুঙ্গি পরনে, যেটা দেখলে হামজা প্রায়ই বলে, ‘তুই কি লালন ফকিরের ভক্ত? ওরা এমন কাফনের কাপড়ের মতো লুঙ্গি পরে।ʼ

হামজা তখনও বসেছিল সোফাতে। চিন্তিত মুখ, উদ্বেগে ভ্রু কুঁচকে আছে। সোফাতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে কপালে আঙুল নাড়ছিল। জয় কথা বলল না। হামজা সেদিনের পর আজ প্রায় দু’দিন কথা বলে না জয়ের সাথে। এরকম বেহুদা কাজ যে জয় এই প্রথম করেছে, এমন নয়। বন্ধুত্বকে শত্রুতায় পরিণত করার হাত দক্ষ তার। তাও আবার অহেতুক সব কারণে এসব উল্টাপাল্টা কাজ করে বেড়ায়।

রুমে গিয়ে লুঙ্গির ওপর খয়েরীরঙা একটা শার্ট পরে বেরিয়ে গেল বাইরে। গোয়ালার ফার্ম বাড়ি থেকে কিছুদূর হেঁটে। আজও নিচতলার ওয়ার্কশপে কাজ চলছে। রাস্তায় লোকজনের চলাচল দেখল। কেউ ভোট দিয়ে আসছে, কেউ যাচ্ছে। একটা অন্যরকম আমেজ দেখা গেল রাস্তায়, পোস্টারগুলো এখনও সেঁটে রাখা, অথবা ঝুলছে ওপরের তারে।

যাওয়ার সময় সাথে রাহাত ছিল। জয় হাঁটার সময় হাতে লুঙ্গি উঁচিয়ে ধরে হাঁটে। লম্বা ছিপছিপে জোয়ান শরীরে লুঙ্গিতে অন্যরকম অভিজাত্য ফুটে ওঠে তার শরীরে।পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল, বেল্ট খোলা। হাতে একটা রুপোর বালা।

আশপাশের লোকেরা যারা হামজাকে ভোট দিয়ে ফিরছিল, হাত উঁচু কোরে বৃদ্ধা আঙুলের টিকা দেখিয়ে ঘাঁড় নেড়ে হাসল। রাস্তার উঠতি বয়সী ছেলেরা সালাম ঠুকল। দৌঁড়ে এলো কেউ কেউ হ্যান্ডশেক করবার জন্য।

ডেইরি ফার্মের পেছনে মাজহারদের আস্তানা। সেখানে ঢুকতেই নাক কুঁচকে ফেলল রাহাত, “ভাই! কোনে ঢুকতেছেন? বাইরে খাঁড়াইয়া দুধওয়ালা বেডারে ডাইকা আনি। গন্ধ লাগতেছে।ʼʼ

জয় গুন গুন করে গান গাইছিল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, জন্ম দিয়েছ তুমি মা, তাই তোমায় ভালোবাসি—

গোয়ালের মাঝ দিয়ে গান গাইতে গাইতে দিব্যি হেঁটে এগিয়ে গেল ভেতরের দিকে। রাহাত বুঝল না, জয় ভেতরে কেন যাচ্ছে!

গোয়ালাকে পাঁচ লিটার দুধ ভরে রাখতে বলে, লুঙ্গিতে কাছা মারতে মারতে এগিয়ে গেল ডেইরিফার্মের চারপাশে দেয়া উঁচু দেয়ালের দিকে। তখনও গান গাইছে, “জয় বাংলা, বাংলার জয়, হবে হবে হবে হবে জয়…
জয় আমির আর বাংলার জয়..ʼʼ থেমে গেল, “আরে শালার!ʼʼ আবার গান ধরল, “জয় বাংলা, বাংলার জয়…ʼʼ

লুঙ্গির কাছা পেছনে গুজে একলাফে চড়ে গেল প্রাচীরের ওপর। অল্প একটু মাথা বের কোরে দেখল, ওপাশের মাঠে এক গোল মিটিং বসেছে। জয়ের ভাবনা ভুল হবার নয়। সেখানে মাজহার শুধু চেয়ারে, স্ক্র্যাচে ভর করে বসে আছে। পলাশকে ওখানে দেখে হাসি পেল জয়ের। এই দুনিয়ায় জাদু বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা মানুষের রূপ পরিবর্তনের ব্যাপারটা। ম্যাজিকের মতো এক লহমায় নিজের পুরো ধারা বদলে আসল রূপে চলে আসতে মানবজাতি সময় নেয়না।

এতদিন পলাশ স্বীকার করতো না যে তার মাজহারের সাথে সম্পর্ক ভালো, আবার তলে তলে হামজা ও জয়কে হাতে রেখেছিল নিজের শক্তি, কিছু গোপন ব্যাপার ও পার্টনারশিপ বহাল রাখতে। আরও একজন পিঠ এপাশ কোরে ঘাসের ওপর বসে আছে সেই মিটিংয়ে। তাকে দেখে জয়ের হো হো কোরে হাসি এলো। জোকারদের মুখোশ নেহায়েত মুখোশ। অথচ মানুষ যে মুখোশ পরে ভালো মানুষদের ধোকা দিয়ে তাদের সাথ মিশে থাকে, এটা বোধহয় খুব সস্তা তবে শক্ত মুখোশ!

জয়ের এই বিষয়ে গর্ব আছে নিজের ওপর, সে অন্তত নিজের নোংরামিগুলো সারাদিন সদিচ্ছায় স্বীকার কোরে বেড়ানোর বাহাদুরীটুকু আছে। সে কোনোদিন কারো কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে চায় না, মিথ্যা রূপ প্রকাশ কোরে মানুষকে ধোঁকা দেয়াকে সস্তা, ছোটোলোকি কারবার মনে হয় তার। সে খারাপ, এটা তার বুক উঁচিয়ে বলার যে প্রবণতাটা আছে, নিজের সেই গুণটাকে সে ভালোবাসে।

দুধটা রাহাতের হাতে দিয়ে জয় ভোটকেন্দ্রের দিকে গেল। রাহাতের কাছ থেকে ছোট্ট একটা ড্যাগার নিলো প্রয়োজনে প্রতিরক্ষার জন্য। পেছন থেকে ডাকল, শোন!

-“কন ভাই।ʼʼ

“বড় সাহেবকে গিয়ে বলবি, দ্রুত যেন তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। আমাদের অনুপস্থিতিতে নাটক জমাতে পারে প্রতিদ্বন্দীরা। সেইগুলা দেখা লাগবে তো। ইট’স এন্টারটেইনমেন্ট।ʼʼ


নিঃশব্দ শীতের রাত। দেড়টা পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটার আওয়াজ কানে লাগছে। রাবেয়া বোধহয় তাহাজ্জুদের নামাজে বসেছেন।নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন আমজাদ সাহেব। পিঠে থেতলে মারা হয়েছে, শুতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অন্তূ পায়ের কাছে বসে রইল চুপচাপ হাটুতে থুতনে ঠেকিয়ে। দুনিয়াটাকে পর মনে হয় তার খুব। মাথাটা শূন্য। জীবন এক নিষ্ঠুর খেলোয়াড় বুঝি!

অন্তিক যেদিন বিয়ে কোরে আনলো, আমজাদ সাহেব ভৎসনা করেছিলেন তাকে। অন্তিক যবর ত্যাড়া ছেলে। বিশেষ কোরে তাকে তুচ্ছজ্ঞান করলে সে সইতে পারতো না ছোট থেকেই। সেদিন উনার তাচ্ছিল্যটুকু গভীরে লেগেছিল, অথচ সে বাপের সেইসকল কথার পেছনের ভালোবাসার শাসনটুকুকে এড়িয়ে গিয়েছিল। জিদের বশে এমন বহু সত্য মানুষ কোরে এড়িয়ে যায়। অন্তিকের মাথায় ভূত চাপলো, সে প্রমাণ করে দেখাবে, সে রোজগার জানে, নিজের বউকে নিজে পালন করতে পারে। কিন্তু গয়নাগুলো মার্জিয়া এনে দিয়েছিল বাপের বাড়ি থেকে। মার্জিয়া অন্তিকের চেয়েও বেশি জেদি। অন্তূ নিশ্চিত, পুরোটা অন্তিকের না, বরং বেশির ভাগ উৎসাহ মার্জিয়ার। কারণ সেদিনের অপমান মার্জিয়াকে ঘিরেই করা হয়েছিল।

সেই গয়না বন্ধক রেখে পলাশের কাছে সুদের চুক্তিতে টাকা নিলো অন্তিক। কিন্তু পলাশ কোনো যেনতেন মহাজন নয়, একেবারে নরক থেকে উঠে আসা এক অভিশাপ। সুদের টাকা দেবার জন্য যে আয়টা দোকানে হওয়ার কথা, তা পলাশের ছেলেরা প্রতিদিন টুকটাক কোরে চাঁদা তুলেই খেয়ে ফেলতো। দোকানে ভাঁটা পড়তে শুরু করল। অন্তিকের নিজের ব্যবসা খাঁড়া করা তো দূর, পুঁজিই ফুরিয়ে যেতে লাগল। বাড়িতে কানাকড়ি আসার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ দোকানের মাল দিনদিন কমে আসল পুঁজি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল। অথচ তখনই পলাশের পুরো আসল টাকা, আর সপ্তাহের হিসাবে নির্দিষ্ট টাকার সুদ জমে জমে পাহাড় হচ্ছিল। অন্তিক লজ্জার মরণে এ কথা বাড়িতে বলার সাহস পায়নি। যতদিনে সে বুঝতে পেরেছিল নিজের ভুল, ততদিনে আব্বুর সামনে এসে দাঁড়ানোর মুখ সে হারিয়ে ফেলেছিল। যে আব্বুকে টক্কর দিতে এতকিছু, সেই টক্করের খেলায় যখন তার ধ্বংস নেমে এলো, সে আর আব্বুর সামনে এসে দাঁড়াতে পারেনি। দিনদিন মৃত হয়ে উঠছিল।

মার্জিয়া জেদি মেয়ে। তাকে সুখ দেয়ার ক্ষমতা ছিল না অন্তিকের। সে ঋণে ডুবে প্রায় মৃত। আবার মার্জিয়ার বাপের বাড়ির গয়নাও সে খেয়ে ফেলেছে, সে চাইলেও বউকে শাসন করতে পারেনি। বা সেই মানসিকতাই হয়ত ছিল না। শিক্ষিত ছেলেটা একটা সন্ত্রাস মহাজনের কাছে এভাবে শোষিত হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল খুব খারাপভাবে।

মার্জিয়া সব জেনে শুধু গজরাতে পেরেছে। সে এ বাড়ির লোকেদের দায়ী করতো সে এই অবস্থার জন্য। অন্তূ এবং ওর বাবা-মাকে এজন্য সহ্যই করতে পারেনি কোনোদিন।

অন্তূর গাল বেয়ে টসটসে গরম জল গড়িয়ে পড়ল। সেই কান্নায় আওয়াজ অথবা মুখের অঙ্গভঙ্গি নেই। এতকিছু হয়ে গেছে, অথচ কোনোদিন আন্দাজ করার সূযোগ পায়নি। ভালোবাসলে মূল্য চুকাতে হয়। আমজাদ সাহেব বাপ হিসেবে, সন্তানকে ভালোবাসার দায়ে এই মূল্য চুকালেন। কিন্তু সে? সে কীসের দানে বলি হলো পলাশের হাতে? বোন হিসেবে? এরকম তো কথা ছিল না! তাহলে বড়ভাইকে গোপনে ভালোবাসার দায়! ছোটবেলার সেইসব সুন্দর খুনশুটির দায়? কীসের দায় চুকিয়েছে অন্তূ?

দূর থেকে বোমাবাজির আওয়াজ আসছে। অন্তূ বুঝে আলতো কোরে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। নিশ্চয়ই জিতে গেছে হামজা! এই মাঝরাতেও তার উল্লাস যাপিত হচ্ছে! একের পর এক বোমা-আতশবাজি ফুটছে। বিকট আওয়াজে যেন ছাদের ওপর এসে পড়ছিল সেগুলো। কয়েকটা গুলিও ফুটলো। আমজাদ সাহেব নড়েচড়ে উঠলেন, তবে কড়া ওষুধের প্রভাবে ঘুম ভাঙল না পুরো। তার খানিক বাদেই সেই মাঝরাতে বাড়ির সামনে দিয়ে বিশাল রবে মিছিল চলে গেল। এই উল্লাস ত্রাসের রাজত্ব শুরু হবার উল্লাস!

শেষ রাতের দিকে থামলো উল্লাস। তবুও দূর থেকে ধুমধাম গানের আওয়াজ ভেসে আসছিল। পুরো দিনাজপুর মেতে উঠেছিল যেন উৎসবে! ভোজন চলছে, নাচানাচি হচ্ছে, এমন একটা আমেজ ঘরের ভেতর থেকেও টের পাচ্ছিল।

কাঁদার পরে মানুষ খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তার ওপর মানসিক চাপ। রাবেয়া জায়নামাজে শুয়ে পড়লেন। অন্তূ বসেছিল ওভাবেই। এটা চলে আসছে এমনভাবেই। সে অসুস্থ হলে আমজাদ সাহেব ঘরে আসতেন না, বসে থাকতেন অন্তূর ঘরে সারারাত। রাবেয়া পাশে ঘুমিয়ে নিতো। আমজাদ সাহেব অসুস্থ হলে অন্তূকে বসে থাকে সেভাবেই।

একদম নিরব হয়ে গেছে পরিবেশ। তার ওপর ঠান্ডা আবহাওয়া, শীতের রাত। এমন এক ভৌতিক মুহুর্তে দরজায় করাঘাত পড়ল। করাঘাত যেন চাপা হাতে পড়ছে, হাত শব্দ বাঁচাতে চাইছে, সংকোচে জমে গেছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ ও ইতস্তত কোরে খুলতে উঠে গেলেন রাবেয়া। অন্তূর মস্তিষ্ক আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠল।সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সাহসগুলো এক বেলায় দুমড়ে রেখে দিয়েছে পলাশ ও জয় মিলে! প্যানিক কাটেনি। এখনও মনে হচ্ছে, এবার তার সাথে আবার কোনো নারকীয় ঘটনা ঘটবে।

ধীর- স্থির পায়ে এক লম্বা পুরুষ ঘরে পা রাখল। তার পায়ে প্রাণ নেই, চোখের দৃষ্টিতে চঞ্চলতা নেই। নজর থেমে আছে বিছানায় শুয়ে থাকা লম্বাটে অসুস্থ শরীরটার দিকে। নিস্তরিৎ পায়ে এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। অন্তূ তাকিয়ে দেখল না। শক্ত হয়ে বসল। এতক্ষণের আতঙ্ক দূর হয়ে, এক বুক ঘেন্না তার শিরদার বেয়ে নেমে যাচ্ছিল।

পুরুষ অবয়ব ধপ কোরে বসে পড়ল আমজাদ সাহেবের পায়ের কাছে। আস্তে আস্তে হাত এগিয়ে দিলো উনার পায়ের ওপর। বহুদিন পর এই ঘরে প্রবেশ তার, আমজাদ সাহেবের এত কাছে আসা। ঝুঁকে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ে আমজাদ সাহেবের পায়ের ওপর বিছানো কম্বলে। অন্তূ উঠে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।

চলবে…

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here