অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ২২.

0
2

(সতর্কতা: কিছু ভায়োলেন্স এবং অপ্রীতিকর ভাষা আছে)

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২২.

থানার গোলঘরে পলাশ যখন ঢুকছিল, অস্বাভাবিকভাবে অন্তূর গা’টা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। শীতের মৌসুম, তব গা ঘেমে উঠছিল। পলাশের ঠোঁটের ওই মিচকে হাসি, জ্বলজ্বলে চোখদুটো, তীরের ফলার মতো নাকের পাটা—ধারালো অস্ত্রের মতো বিদীর্ণকারী। এসব সময় নারীমনকে অন্তূ ঘেন্না করে। ভয়ে জড়িয়ে যাওয়া মানসিকতা! বারবার পলাশের সেই ছোঁয়াগুলো শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছিল। অন্তূ মনে মনে কৃতজ্ঞ জয় আমিরের ওপর।

পলাশ খুব শান্ত এবং ঠান্ডা একটা মানুষ। একটুও উত্তেজিত হয় না থানায় কথাবার্তা বলছিল খাঁটি শুদ্ধ ভাষায়। শিক্ষার প্রয়োগ করছিল। খুব গুছিয়ে আইনকে বিভ্রান্ত করার চাল। কিছুদিন সময় পাওয়া গেল পলাশের কাছে। ব্যাপারটা এমন প্রমাণিত হলো–অন্তূদের পরিবার ঋণ-খেলাপি করেছে, আর পলাশ নিতান্তই উদার। সে লিখিত সময় পেরিয়ে যাবার পরেও সময় দিচ্ছে।

বেরিয়ে যাওয়ার সময় চট করে এক পলক অন্তূর দিকে তাকিয়েছিল পলাশ। ওই সময়টুকুর মাঝে পলাশের ঠোঁট হেসেছে, খুব সূক্ষ্ম হাসি। এই হাসিটাই জয়ের ঠোঁটের কোণে বহুবার লক্ষ্য করেছে সে। পলাশের চোখ যেন বহুদিন ধরে খুঁজছে অন্তূকে।

অন্তিক পাশে পাশেই ছিল। মুস্তাকিন আগে আগে হাঁটছিল। থানার সদরঘরে বসে অন্তিক বলল, “আব্বু এখন মোটামুটি সুস্থ, মুস্তাকিন। তোমার সময় থাকলে আমরা কালই রওনা হব কুড়িগ্রাম। দেরি করার সাহস পাচ্ছি না।ʼʼ

-“আমার সময় হবে। কালই যাই একদফা। এমন নয় যে একদিন, একবেলা গেলেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে। দু- একদিন ঘোরাঘুরি করা লাগতে পারে।ʼʼ

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে আজ আর ইতস্তত বোধ করল না সে। অন্তূর দিকে প্যাকেট ইশারা করে বলল, “ক্যান আই?ʼʼ

অন্তূ সামান্য মাথা নাড়িয়ে অন্যদিকে ফিরল। সিগারেটে টান দিয়ে মুস্তাকিন বলল, “অন্তূকে একা রেখে যাবেন?ʼʼ

-“হ্যাঁ, একাই থাকতে হবে। ওর ভাবীকে গতকাল ওই বাড়িতে রেখে এসেছি। এখানে যেসব চলছে, এর মধ্যে অসুস্থ শরীরে আরও কষ্ট পেত।ʼʼ

অন্তূ অনেকক্ষণ ধরেই কিছু বলতে চাচ্ছিল। মুস্তাকিন তা বুঝে বলল, “কিছু বলবেন?ʼʼ

আঁখিদের ওই বাড়িতে যা দেখেছে, অন্তূ তা আপাতত চেপে গেল। শুধু বলল, “চাঁদনীর মানে ওই ভিক্টিম মেয়েটার ভাবী এবং মা এখন কোথায় থাকে, সেটা জানেন নিশ্চয়ই! বডি পাঠিয়েছিলেন! আমি দেখা করতে চাই ওদের সাথে।ʼʼ

মুস্তাকিন কিছুক্ষণ চেয়ে রইল অন্তূর দিকে, পরে বলল, “আমি পাঠাইনি বডি। থানা থেকে পাঠানো হয়েছিল। আমাদের ডিপার্টমেন্ট ভিক্টিম-বডি নিয়ে বিশেষ কাজ করে না। আমি জেনে আপনাকে জানাবো। তাছাড়া জরুরী নয় এই সময় ওদের সাথে দেখা করা।ʼʼ

মুস্তাকিন চলে গেল, থানার সদরঘর ফাঁকা তখন। অন্তূ উঠে এগিয়ে যেতেই অন্তিক ডাকল, “অন্তূ! মুখে ওড়না চেপে বাইরে বের হ।ʼʼ

অন্তিকের কণ্ঠস্বর রুষ্ঠ। মুস্তাকিনের ওভাবে তাকিয়ে থাকা সহ্য করতে পারেনি, তবুও খুব কষ্টে চুপ ছিল।

অন্তূ পেছন ফিরল না। সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “যাওয়ার সময় যেভাবে এসেছি, ওভাবেই যাব।ʼʼ

-“একটা ভুল করেছি জীবনে, তার জন্য তুই মূল্য চুকিয়েছিস, মানছি। কিন্তু তাই বলে এতটাও বোধহয় অপদার্থ পুরুষ হয়ে যাইনি, যে বোনকে রাস্তায় প্রদর্শন করাতে করাতে নিয়ে যাব। আসার সময় সাথে ছিলাম না আমি, তখনকারটা মাফ। এখন আছি। মুখ ঢেকে ফেল নয়ত তোকে থাপ্পড় মারার অধিকার হারাইনি আমি আমার এক ভুলের মাধ্যমে। আমার ভুলের জন্য তোকে যা পোহাতে হয়েছে, তার বদলে যেকোনৌ সাঁজা দে, চলবে। তাই বলেআমি তোকে তোর বেপর্দার ব্যাপারে শাসন করতে পারব না, এমনটা মোটেই নয়।।ʼʼ

বহুদিন পর অন্তিক পূরোনো অন্তিকের মতো কথা বলল। অন্তূ তাতে ফিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসে, “অনিচ্ছাকৃত পাপেরই যদি এত বড় মৃল্য চুকাতে হয়, তাহলে না জানি ইচ্ছাকৃত পাপ করলে কতটা মূল্য দিতে হবে।

-“ইচ্ছাকৃত পাপ করব না আমি কখনও।ʼʼ

-“করলেই বা কী? আর কিছু হারানোর নেই। এখন যা হারাবে, তা আর গায়ে লাগবে না। করতে পারিস।ʼʼ

অন্তিক কেমন করে হেসে উঠল, “তোর কথায় এত ধার কেন রে?ʼʼ

-“এই ধার কাজে লাগে না সময়মতো। অযথা!ʼʼ

-“মুখ ঢেকে ফেল, অন্তূ। তুই আমাকে ঘেন্না করতেই পারিস, তাতে আমি আমার কর্তব্য পালনে দ্বিধাবোধ করতে পারি না।ʼʼ

-“তুই জুয়ারুদের চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট, তা স্বীকার করতে তুই ভয় পেতেই পারিস, তাতে আমি তোকে ঘেন্না করতে একটুও দ্বিধাবোধ করব না।ʼʼ

অন্তূ বেপরোয়া পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। অন্তিক দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পা মেলালো। তখন অন্তূর মুখটা ওড়নায় আবৃত।

অন্তিক প্রশান্তিতে মুচকি হাসল। ছোটবেলা থেকে অন্তূ কঠোর এক ব্যক্তিত্বের মুখোশে নিজেকে আবৃত রেখে বেড়ে উঠেছে। বয়সের চেয়ে ব্যক্তিত্বের ওজন ভারী লাগে।

অনুশোচনাটুকু গিলে ফেলল অন্তিক। অন্তূ রাস্তা পার হতে শেখেনি। আব্বুর হাত ধরে পার হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না সে। অন্তিক সেদিন আলতো করে বোনের হাতটা চেপে ধরল। রাস্তা পার হতে হতে ধীর আওয়াজে বলল, “আমাকে ক্ষমা করার ইচ্ছে আছে তোর, অন্তূ? আমি পুরো জীবন অপেক্ষা করব, মাসুলও দেব সব রকমের। তোকে ঘেন্না কাটাতেও বলব না আমার ওপর থেকে, শুধু মুখ ফিরিয়ে থাকিস না।ʼʼ


ক্লাবঘরে একটা আয়োজন করা হয়েছে। হামজা খুব শীঘ্রই পৌরসভায় মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হবে। জয় আর কবীর মিলে বিরিয়ানী রান্না করেছে। জয় ভালো বিরিয়ানী রাঁধতে জানে। ছেলেদের খাওয়াতে হয় প্রায়ই!

মাজহারের হাতে গুলি খাওয়ার, লতিফকে হামজা লম্বা এক ছুটি দিয়েছিল। অসুস্থ শরীর, তার ওপর পরিবার থেকে এ অবস্থায় সায় থাকে না আবারও সেই প্রাণঘাতী কাজে পুনরায় যোগ দেয়াতে। হামজা তার পরিবারের খরচা বহুদিন চালিয়েছে, সম্পূর্ণ চিকিৎসা নিজের টাকায় করিয়েছে। এখন বেশ সুস্থ সে, বলা চলে পুরোপুরি ঠিকঠাক। দলের ছেলেদের ওপর হামজার অবদান অপরিসীম।

লতিফ খেতে খেতে বলল, “এত ভালো রান্না কই থেইকা শিখছো, জয়? মনে হচ্ছে বাড়ির মহিলাদের হাতের বিরিয়ানী খাচ্ছি।ʼʼ

হামজা বসেছে সোফায়। জয় শুয়েছে টান হয়ে হামজার কোলে মাথা রেখে। পা দুটো তুলে রেখেছে সেন্টার টেবিলের ওপর। ভিডিও গেইম খেলছে ফোনে।

জয় খুব দুঃখিত স্বরে বলল, “জীবনে বেশি বেশি চিল মারতে যাইয়া আর এসব বান্দরের পাল খাওয়াইতে পিকনিক এত করছি, রান্নার হাত গ্রীষ্মকালীন আমের মতো পাকা, ভাই! খান খান, খালি একটু দোয়া কইরেন আমার জন্য, যাতে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায় একটা। একা রাত কাটতে চায় না। খুব দুক্কে আছি। আর্জেন্ট বউ দরকার।ʼʼ

সকলে হেসে উঠল। জয় ফোনে চোখ রেখেই হঠাৎ-ই আনমনা হয়ে বলল, “আরমিণ আবার আসছিল এই বাড়িত্। আচ্ছা ওই ছেঁড়ির জীবনে দুঃখের কি খুব অভাব? দড়ি ছিঁড়ে মারা খেতে চারদিক যেচে পড়ে ঘুরে বেড়ায় দুঃখ জোগাড় করতে।ʼʼ

হামজা জিজ্ঞেস করল, “ওখানে কেন গেছিল?ʼʼ

জয় হাসল, “হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসে পড়ছিলাম, সোন্দরী চেংরিরা বোকা হয়। আসলে ওই শালী একটু বেশি সোন্দরী তো! মাথায় মাল কম! ছেঁড়ির ধান পোঁড়ে চুলায়, ওই শালি পানি ঢালে পা-ছা-য়। তাইলে কি হইলো? না জানি কীসব দৃশ্য দেইখা আসছে! কইলজের ওজন কতখানি হইলে এত কিছুর পরেও থামেনি? এ তোরা কেউ ওই ছেঁড়িরে যাইয়া কইয়া আসবি, ওর সাথে সামনে কী কী হইতে পারে।ʼʼ

-“তুই নিজে দেখেছিস ওকে?ʼʼ

-“হ। দুপুরে এইখানেই ঘুমাইছিলাম। বিকেলে উঠে পেছনের বারান্দায় দাঁড়াইতেই একনজর দেখা হয়ে গেল!ʼʼ

হামজা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল, “হতে পারে দেখেনি কিছু! দেখলেও বিশেষ কিছু দেখার কথা না। ওই বাড়ির মহিলাদের খুঁজতে গেছিল। এখনও কি সেসব পড়েই আছে ওখানে?ʼʼ

-“তাই তো থাকার কথা! ওসব দেখছে আমি নিশ্চিত, আর দেখলে শশুরবাড়িতে জানাবে এইটা ডাবল নিশ্চিত। তুমি খালি ভাবো, কতখানি সাহসের দরকার ওসব দেখেও চুপচাপ বেরিয়ে আসা।ʼʼ

লতিফ হেসে উঠল, “সাহসই যদি না থাকবো, তাইলে কি আর তোমার মুখে খাবলা ধইরা থুতু ছোঁড়ে! ওইডাতই তো বুঝা যায় মাইয়ার কলজে বারো হাত।ʼʼ

সকলের মাথায় বাজ পড়ল কথাটা শুনে। কিন্তু জয়ের মুখে অপমান নেই। সে খুব দুঃখের সাথে বলল, “হ। কামডা ভালো করে নাই। মাগার…ʼʼ জয় হেসে ফেলল।

হামজা জয়ের সেই হাসিটাই কেড়ে নিয়ে চট কোরে হেসে ফেলল লতিফের দিকে তাকিয়ে, “আপনি কী করে জানলেন এসব, লতিফ ভাই? আপনার তো জানার কথা না!ʼʼ

আধখাওয়া সিগারেটটা দু আঙুলে চেপে ধরে নেভালো, তাতে বোধহয় হাতের পুরু চামড়াতে অল্প খানিক সেঁক লাগলো। আবার তাকালো লতিফের দিকে, “ভাবছিলাম খাওয়া শেষ হলে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। আপনি নিজে থেকেই খুব ফাস্ট দেখছি!ʼʼ

সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে বলল, “এসব লাইনে বাটপারি করতে গেলে সতর্কতা খুব জরুরী। এখানে সবাই খেলোয়ার, সবার মাথাই ফুল স্পিডে ঘোরা কাটার মেশিনের মতো চলে। অল্প একটু ভুল হলেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। আপনার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।ʼʼ

হাস্যজ্জ্বল চোখে কথাগুলো বলে আরাম করে উঠে দাঁড়াল হামজা।

উঠে বসল জয়। ফোনটা পাশে রেখে হাতদুটো হাঁটুতে গেঁড়ে পিঠ বাঁকিয়ে বসল। চোখ হাসছে তার, শার্টের কলারের ওপর দিয়ে শিকল আকৃতির চেইনটা ঝুলে আছে নিচের দিকে। তাতে ইংরেজি হরফ ‘Jʼ এর লকেট। বাঁ হাতের রিস্টলেটটা কব্জি থেকে কনুইয়ের একটু ওপরে পড়ে রইল। পরনে সাদা ধবধবে লুঙ্গি, তার ওপর কালো জ্যাকেট পরেছে। পাড়া, ক্লাব এমনি চলাচলে তাকে কোনোসময় ফরমাল পোশাকে দেখা যায় না। লুঙ্গি, শার্ট, চামড়ার জুতোই চলে। গ্রাম্য মোড়লের মতো দেখতে লাগছে ওকে। পাশেই হামজা দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত, কালো শাল জড়ানো।

ঠোটের কোণে হাসি জমে থাকা অবস্থায় কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল জয় লতিফের দিকে। হামজা মিটিমিটি হাসছে। এই হাসি লতিফের ওপর ওর করা সবটুকু ন্যায়পরায়নতার হিসেব শুষছে। কোনোদিকে ফাঁক রেখেছিল না হামজা লতিফের ভরন-পোষনে। তার দাম সে আস্তে কোরে আদায় তো করে নেবে, এই হাসি দ্বারা সে লতিফের দ্বারা প্রতারিত হবার দুঃখটুকু ঢাকতে চাইল!

লতিফের আর খাওয়া উঠছে না। সে বুঝতে পারছে, আজ তাকে কেন আপ্যায়ন করে এখানে আনা হয়েছে।

জয় হায় হায় কোরে উঠল, “আরে আরে করতেছেন কী, লতিফ ভাই? আমি কি জানোয়ার নাকি যে খাওয়া অবস্থায় মারবো কাউকে, হোক সে যতবড় জোচ্চর আর বিশ্বাসঘাতক। খাওয়া শেষ করুন, আরামসে কথা বলি। এ কবীর…আমার জন্যও এক প্লেট আন তো, লতিফ ভাইয়ের সাথে বসে খাবো। যা।ʼʼ

লতিফ ছটফটিয়ে উঠল। হামজা শালটা ডান কাধে তুলে নিয়ে বলল, “আমি বাড়ি যাচ্ছি। এখানে এখন থাকা ঠিক হবে না। আফটাল অল নতুন মেয়র আমি। আমার কিছু নৈতিক দায়িত্ব আছে। আমার সামনে কোনো অকাম ঘটবে, আর আমি তাকিয়ে দেখব, কিছু তো করব না, এটা ঠিক না। দু’দিন আগে অনেক বিশ্বাস কোরে জনগণ ভোটে তুলেছে আমায়। কাজ ফুরোলে তুই দেরি করিস না ফিরতে। আজ রাতে দাবা খেলব আমি আর তুই। অনেকদিন খেলি না।ʼʼ

হামজা হেলেদুলে হেঁটে বেরিয়ে যায়।

জয় আরাম কোরে বসে গপাগপ বিরিয়ানী খেতে বসল। বিশাল বিশাল হাতে বিশাল বিশাল লোকমা। তার খাওয়ার ধরণ ভালো না। ভদ্রলোকেরা দেখলে এক শব্দে বলবে, অসভ্য, জঙলিদের মতো করে খায় জয়। গপগপ করে এক প্লেট বিরিয়ানী খুব রুচির সাথে মনোযোগ দিয়ে খেয়ে ঠান্ডার রাতে ঠান্ডা ঠান্ডা বোতল নিয়ে বসল। লতিফ কাকুতিভরা চোখে বসে আছে। হাত ধুয়ে জয় লতিফের প্লেটটাকে ইশারা করে বলল, “যাহ রেখে আয়। লতিফ ভাই আর খাবে না। ভাই, হাত ধুয়ে নেন, আমার প্লেটেই ধুয়ে ফেলেন, আমরা আমরাই তো! যা করেছেন করেছেন, আর তো এরপর করার সুযোগ পাবেন না! তাহলে আর কীসের কী? তখন আমরা ভাই ভাই! আসেন মদ খাই।ʼʼ

জোর করে মদ পান করালো লতিফকে। নাক-মুখ দিয়ে উঠে এলো তা। বিরিয়ানী উগরে এসে বুক জ্বলে ছারখার লতিফের। জয় গিলে যাচ্ছে ঢকঢক করে।

-“বিশ্বাস করো জয়..ʼʼ মিনতি করে ওঠে লতিফ। ওর চোখে-মুখের আকুলতা বোধহয় জয়কে খুব আনন্দিত করল।

সে মাথা নাড়ল দু’পাশে, “আমি অবিশ্বাস করি না কাউকে। আপনাকেও করার কিছু নেই। আপনি সত্যি বলবেন, আমি শুনব, বিশ্বাস করব। আপনি বলুন, লতিফ ভাই! আপনি কী কোরে জানলেন ওই মেয়েটা সেদিন পলাশের রুফটপে দাঁড়িয়ে আমার মুখে থুতু ছুঁড়েছিল? আর ওই মেয়েটাই কাল ওই পরিত্যক্ত বাড়িতে এসেছিল। এসব আপনি কীভাবে জানলেন?ʼʼ

আর বলার কিছু নেই লতিফের। তার রুহু কাঁপছে। জয় হাসল, “আপনারে হামজা ভাই আজ মাসের বেশি ছুটিতে রাখছে দলের যেকোনো কাম থেকে। ক্যান? কারণ আপনে নাকি আমারে বাঁচাইতে নিজে গুলি খাইছেন। বদলে হামজা আপনার চিকিৎসা করাইছে, সবধরণের এক্সট্রা নিরাপত্তা দিছে। আপনার জন্য মাজহারকে মেরে শত্রুতা বাড়াইযছে। আর আপনে সেই মাজহারের সাথে হাত মেলাইলেন? ছিঃ!
অবশ্য এর কারণ আছে।

সে আপনাকে ডেকে বোঝাইলো, হামজার পার্টিতে থাকলে এভাবেই জখম হত হবে আপনাকে।

অথচ আপনার জন্য যে মাজহারকে মেরে আমি আর হামজা সোসাইটির সকল সাইটে বদনামী এবং শত্রুতা কামিয়েছি এটুকু দেখলেন না আপনি? শ্যাহ! ইজ্জতই রইল না, শালা। মাজহারের সাথে আপনি মিলছেন গুলি খেয়ে, ওদিকে পলাশ খা-ন-কির বাচ্চা দ্বিমুখী পাগল শালা, শালার ছাওয়াল টাল, সাইকো! ভাবে যে আমরা কিছু বুঝিইনা, গু খাই। ও আমাদের হাতে রেখে আসলে মাজহারের সাথে কাজ করতেছে। সেদিন আবার ওই শালীর জন্য একদম সরাসরি একটা বিরোধীতা লেগে গেল। আর এই সংকটময় সময়ে আপনি দলের সাথে ঘাতকতা করতেছেন। কন এইডা কি ঠিক?ʼʼ

একটু থেমে ঘন ঘন মাথা নাড়ল জয়, “নট গুড, লতিফ ভাই! তার ওপর আবার থুতুর ব্যাপারটা আমার ছেলেদের সামনে বলে আমার ইজ্জতের এগারোটা বাজালেন!ʼʼ

লতিফ আহাজারী করল, “জয়! বিশ্বাস করো আমি যাইনি। মাজহার এসেছিল। আমি কিচ্ছু করিনি ওদের সাথে মিশে। খালি এইটুকু শুনেছি তুমি সেদিন ছিলা ওইখানে।ʼʼ

-“তা জানি আমি। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু ছোটবেলায় পড়ছিলাম, ছোট বালুকনা আর বিন্দু জল মহাদেশ আর মহাসাগর গড়ে। আজ ও আপনাকে জানাইছে, কাল আপনি ওকে জানাবেন, এই ধারাবাহিকতা চলতে দেয়া মূর্খতা হয়ে যাবে না? এজন্য কষ্ট করে এতদিন ধরে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম? তাছাড়া এসবও ইস্যু না। ইস্যু হলো, বিশ্বাসঘাতকদের নাকি আপনাদের সৃষ্টিকর্তাও ঘেন্না করে।ʼʼ

ব্যস্ততার সাথে কবীরকে বলল, “এইহ! শশুরবাড়িতে কল কর তো! বল, ক্লাবের পাশে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে কিছু অপ্রীতিকর মাল-মশলা পাইছি, ষাঁড়। তাড়াতাড়ি পোলিশ পাঠান।ʼʼ

ওসি সাহেব বোধহয় থানায় বসেই ঘুমাচ্ছিলেন। কল রিসিভ করলেন দেরি করে। জয় নিজেই ধরে লম্বা একটা সালাম দিয়ে খাঁটি শুদ্ধ ভাষায় বলল, “স্যার! আমাদের ক্লাবের পাশে একটা বাড়িতে কিছু অপ্রীতিকর জিনিস পেয়েছি। ড্রাগ, অ্যালকোহল জাতীয় জিনিস পড়ে আছে, আর সাথে একটা লাশও আছে মনেহয়, স্যার। ঘরের কার্নিশে কাফনে মুড়ানোর মতো কিছু একটা আছে, স্যার। বিশ্রী গন্ধ আসছে মানুষ পঁচার মতো। থাকা যাচ্ছে না এই ঘরে। আমার ধারণা, ওটা লা-শ-ই হবে।ʼʼ

ঘরের এক কোণে কিছু ব্যাটিং স্টিক ও হকিস্টিক, চাপ্পর-চাপাতি, লাঠি, ছুরি ইত্যাদি গাদা করা আছে। জয় হেলেদুলে হেঁটে গিয়ে রডের মাঝ থেকে একটা কালো কুচকুচে রড তুলে আনলো। দুই চুমুক মদ গিলে সোফার ওপর বসে পড়ল ধপ করে।

তখন ক্লাবঘরে চারজন ছেলে আছে। বাকিরা খেয়ে বিদেয় হয়েছে। লতিফকে ওরা শক্ত করে ধরল।

টেবিলের ওপর রাখা টিস্যুবক্স থেকে অনেকটা টিস্যু তুলে মুড়িয়ে যতটা যাবে না তার চেয়ে বেশিটা টিস্যু লতিফের মুখে গুজে দিলো জয়। লতিফের চোখে পানি, চোখদুটো বারবার অনুরোধ করছে ক্ষমা করে দিতে। জয়ের খুব সুখ লাগছে। ভিক্টিমের চোখে ভয় না দেখলে অত্যাচার করে মজা নেই।

শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাতের রডটা দিয়ে লতিফের হাঁটুর ঠিক অস্থি-সন্ধির ওপর আঘাত করল। গুঙরে উঠল লতিফ, অথচ আওয়াজ এলো না বাইরে। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। ছটফট করে উঠল মেঝেতে পড়ে। জয় লতিফের অপর পায়ে ঠিক একই স্থানে হাঁটুর জোড়সন্ধির ওপর কষে একটা রডের আঘাত লাগালো।

লতিফ অজ্ঞান হবার আগে জয় মুচকি হেসে আশ্বাস দিলো , “চিন্তা করবেন না, লতিফ ভাই। আমি আপনার ভালোর জন্যই এসব করতেছি। আপনার এই পা আর পৃথিবীর কোনো ডাক্তার জোড়া লাগাতে পারবে না। আপনি হেঁটে হেঁটে এর কাছ থেকে ওর কাছে বিশ্বাসঘাতকতা এবং অকৃতজ্ঞতার মতো পাপ করতে যেতে পারবেন না আর। আমরা তো নষ্ট মানুষ, পাপ নিয়েই বেঁচে আছি। কিন্তু এই যে আপনে আর পাপ করার সুযোগ পাবেন না, এই ব্যবস্থা করে আমি আজ একটা ভালো কাজ করলাম। তাছাড়াও আপনার পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি বহন করব, কথা দিচ্ছি।ʼʼ

কবীরকে বলল, “পুলিশ আব্বারা খুব তাড়াতাড়ি এসে পৌঁছাবে। তোরা লতিফ ভাইকে আব্দুর রহিম মেডিকেলে এডমিট করিয়ে আয়। জ্ঞান ফেরার পর সরিস না ওর কাছ থেকে, আবার জবানবন্দি দিলে ফেঁসে যাব। এত তাড়াতাড়ি মরা যাবে না আমার।ʼʼ

রাহাতের সাথে ছেলেগুলো লতিফকে গাড়িতে বসিয়ে চলে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রয়ে গেল কবীর।

জয় রড রেখে এসে সোফাতে বসল আরাম করে। শরীর ঘেমে উঠেছে। টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছল। কবীর আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করে, “ভাই, পলাশ কী করেছিল মেয়েটার সাথে? মানে…ʼʼ

-“আরেহ! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাডার জসিমউদ্দীন মানিক একশোটা ছাত্রীকে রে-প কোরে সেঞ্চুরি পার্টি করেছিল, সেই ইতিহাস ভুলে গেছিস? ওই হিসেবে পলাশ কিছুই করে নাই।ʼʼ

ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি গিলে ফের বলল, “ব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে আয় আমার জন্য একটা। শশুর আব্বাদের সামনে মদের গন্ধ নিয়ে যাওয়া ঠিক না।ʼʼ

জয় ঘষে ঘষে দাঁত মাজলো। একটু পারফিউম মারল শরীরে। কবীর জিজ্ঞেস করল, “ভাই, আপনে যে পুলিশ ডাকলেন, পলাশ ভাই জানলে কী হবে? মানে আপনে ছাড়া আর কেডা খবর দিতে পারে পুলিশরে? আসলেই তো লাশ এখনও ওই ঘরেই আছে।ʼʼ

-“আরমিণের দোষ দিয়ে দেব? কী কস? পলাশ পাগল কিন্তু জানে আরমিণ ওর বাড়িত গেছিল, ওসহ দেখছে। বলে দেই যে পুলিশরে ওই শালী খবর দিছে। যে বলিটা আগের বার দেয় নাই শালীরে, এবার দিয়ে দেবে। আমি এইচ-ডি ছায়াছবি দেখব এবার।ʼʼ

কবীর জানে, জয়ের কোনো কথাই আন্তরিক না আবার যেকোনো কথাই আন্তরিক। সে কখন সত্যি আর মিথ্যা বলে বোঝা যায় না। হাসতে হাসতে সত্যি আর আন্তরিক স্বরে মিথ্যা বলে। সে জিজ্ঞেস করল, “সত্যিই, ভাই?ʼʼ

-“না, মিথ্যা।ʼʼ

বিশ্বাস করল কবীর। কারণ জয় যেকোনো পরিস্থিতিতে রসিকতা করে ঠিকই, তবে মিথ্যা কথা বলেনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুট করে কিছূ মনে পড়েছে, এমন ব্যস্ত হয়ে বলল, “ভাই! ওই বাড়ির জমিন তো আপনাদের নামে এখন, তাই না? তাইলে পুলিশ যদি জিগায় যে আপনাদের বাড়িতে এরকম একটা ঘটনা কী করে ঘটল, মানে ফেঁসে যাবেন না?ʼʼ

জয় উঠে দাঁড়াল, “তোকে কে বলেছে জমি আমাদের?ʼʼ

-“না মানে…ওই যে শুনছিলাম, আপনারা নাকি বিচার-টিচার করলেন। আমি ভাবছি জমি আপনারা দখল করছেন শেষমেষ!ʼʼ

জয় গা দুলিয়ে বাচ্চাদের মতো হাসল, “রাজনীতি বুঝিস না রে পাগলা… জমি পলাশের। আজীবন ওই জমি পলাশের। কে জানি টাকা ধার নিছিল। শোধ করতে পারে নাই। তার বউ আর জমিডা ওর হয়ে গেছে।ʼʼ

-“তাইলে ওই মহিলারা থাকতো যে।ʼʼ

-“হ। ওসব গল্প বানানো হইছিল। এইখানে বেনিফিট পলাশ এবং আমাদের সমান। পলাশ তার জমি ফাঁকা করে ফেলল সামাজিক উপায়ে, খুব যুক্তিগতভাবে, আবার কেউ জানলোও না জমিটা পলাশের। আর আমি আর হামজা ভাই হিরো হয়ে গেলাম সেই সুবিচারগুলোর মাধ্যমে। লোকে ভালোবেসে ভোট দিলো সাহেবকে। এভাবে চলতে থাকলে সামনের সংসদ নির্বাচনে একটা আসন আমাদের। তবে জমির আসল মালিক পলাশ, এটা আর গোপন থাকবে না। হিন্দু-ফিন্দু বলে কিচ্ছু নেই, পুলিশ আসলেই এটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। বুজিচিস?ʼʼ

কবীর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এসব যখন ঘটেছে সে তখনও দলের বিশিষ্ট কোনো মেম্বার ছিলনা, সে এসবের কিছুই জানতো না। বেশ কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, আপনি যে হুট করে এসব করতেছেন, “পলাশ ভাই জানলে বা বুঝতে পারলে কী হবে, কিছু ভাবছেন?ʼʼ

বাইরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। জয় একহাতে লুঙ্গি উঁচিয়ে ধরে অপর হাতে টেবিলের ওপর থাকা ফোনটা তুলে নিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো, “না ভাবিনি। পরে ভাববো। তবে এখন থেকে নতুন করে খেলতে হবে আবার, অনেকদিন খেলি না। লোক আমাকে হালকা ভাবে নিচ্ছে রে আজকাল!ʼʼ

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here