অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ২১.

0
1

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২১.

আমজাদ সাহেব চুপচাপ চেয়ে ছিলেন। অন্তিক উনার অসুস্থ হাতদুটো জড়িয়ে ধরে হাতের ওপর কপাল ঠেকিয়ে বসে রইল। ছেলেদের কান্না টের পাওয়া যায় না।

অন্তিক খুব জেদি ছিল, ছোট বেলায় আমজাদ সাহেব শাসন করার জন্য মারলে সে আর ভাত খেত না। কোনোভাবেই কেউ খাওয়াতে পারত না, যতক্ষণ না আমজাদ সাহেব আবার আদর করে খাওয়াবেন। খাওয়ার আগে ঠিক এভাবেই আব্বুকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে কাঁদতো।

কিন্তু সেদিন রাতে আমজাদ সাহেব কিছুই বললেন না। অন্তিকের ভেতরের যন্ত্রণা বাড়ছিল এতে। এরপর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বসে রইল। সকাল হলো, সে পা আর ছাড়েনি। কতবার কতভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে আব্বুর আঘাতগুলো, পাগলের মতো প্রলাপ বকছিল। মার্জিয়াও এসে বসল একটু বেলা বাড়লে। জেদি মেয়েটার মুখেও রা নেই। অপরাধীর মতো মুখ কোরে বসে ছিল।

বেলা এগারোটার দিকে মুস্তাকিন এলো। আমজাদ সাহেবকে সালাম কোরে এসে দাঁড়াল, রাবেয়া চেয়ার এনে দিলেন। বসল না সে চেয়ারে, যে মাদুরটা পাতা ছিল, তাতে সবার সাথে পা গুটিয়ে বসে পড়ল। চেয়ারে বসে আছেন আমজাদ সাহেব। হুট কোরে অন্তূ কেন যেন একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা তুলে বসল, “আঁখির কেইসটা কতদূর এগোলো, অফিসার?ʼʼ

-“কেইস টানার জন্য দড়ি লাগে, সেটার প্রান্ত হারিয়ে ফেলেছি। থেমে আছে, বলা চলে বন্ধ হয়ে গেছে।ʼʼ

-“আপনি বলেছিলেন ওরা নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?ʼʼ

-“হ্যাঁ। আমি গিয়ে পাইনি। আপনি গিয়েছিলেন না?ʼʼ

-“আমিও পাইনি।ʼʼ

-“তাহলে যে জিজ্ঞেস করছেন?ʼʼ

অন্তূ কথা বলল না। তার মুখে পর্দা নেই, শুধু মাথায় ওড়না দেয়া। অন্তূ যতক্ষণ চুপ রইল আর কেউ কথা বলল না। সে নিজেই সময় নিয়ে বলল, “এর মাঝে তিনদিন অলরেডি কেটে গেছে, আজ চতুর্থ দিন। ওরা এই দু’দিনে কোনো মুভমেন্ট দেখায়নি। ব্যাপারটা জটিল। অন্তিক এখন বাড়িতে। যদিও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আসলে কীসের জন্য কী হচ্ছে, তা ধারণা করতে গেলে মাথায় প্যাচ লেগে যাচ্ছে। ওরা এবার বাড়ি চলে আসলে পুরো পরিবার শুদ্ধ টুকরো টুকরো কোরে কেটে রেখে যাবে, হয়ত। তাই আমি চাচ্ছিলাম, থানায় একটা ছোট্ট রিপোর্ট কোরে সাধারণ শালিসের মাধ্যমে পলাশের কাছে কিছুদিন সময় চেয়ে নিতে। যাতে কুড়িগ্রামের জমিটা বিক্রির জন্য আর খানিকটা সময় পাই।ʼʼ

মুস্তাকিন একটু ভেবে বলল, “থানায় এ নিয়ে আলাপ করাটা কতটা ঠিক হবে, বলতে পারছি না। পলাশ ব্যাপারটা কেমনভাবে নেবে জানা নেই। আর খবর পেয়েছি, রাজন আজগর দিনাজপুর নেই।ʼʼ

-“ওদের বিরুদ্ধে এমনকি কারও বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ করব না আমি, শুধু অন্তিকের ঋণের বিষয়টা জানাবো, এবং পলাশ আজগরের সাথে একটা আলোচনার মাধ্যমে আইনতভাবে খানিক সময় আমরা চেয়ে নিতে চাই।ʼʼ

মুস্তাকিন মাথা নাড়ল। কিছুসময় চুপ থেকে বলল, “আপনি কি ভরসা হারিয়েছেন আমার ওপর, অন্তূ?ʼʼ নির্লিপ্ত শোনালো মুস্তাকিনের স্বর।

-“ভরসার প্রশ্ন উঠছে না, অফিসার! তাছাড়াও আপনার ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আপনি খুন-খারাবীর প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন। আমাদের ব্যাপারটা তা নয়।ʼʼ

আজ মুস্তাকিন অন্তূর জলদগম্ভীর, শীতল বুদ্ধিমতি রূপটা আরেকবার পর্যবেক্ষণ করল। যার কথার ভার, চোখের শান্ত চাহনির ঝাঁজাল তেজস্ক্রিয়তা এবং মানসিক কাঠিন্য খুব নজরে আসছিল। অথচ এই মেয়েটাও কেমন মরিচা ধরা পাতলা লৌহখণ্ডের ন্যায় ক্ষয় হয়ে গেছিল সেদিন। মানসিকতায় শক্তির ওপর আঘাত ঠিক ইট-বালু-সিমেন্টের কাঁচা গড়নে পানির মতো কাজ করে। যত পানি দেবে, তত মজবুত হবে যেন।

অন্তূর পরীক্ষা আছে আজ। সে বের হবার সময় অন্তিক ডাকল। বহুত দিন পর অন্তিক ডাকল। অন্তূ ভাবান্তরহীন ভাবে ফিরে তাকাল।

-“এই অবস্থায় একা যাবি না। চল আমি সাথে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসি।ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল, “ধুর! বেঁচা গরুর দাঁত ধরে টানছিস কেন? তাতে কি গরু আর ফিরবে মালিকের কাছে? আমি সোল্ড আউট রে! পণ্যের মতো কম্পানি থেকে শহর-বাজারের শোরুমগুলোর মালিকদের কাছে সেম্পল হিসেবে দেখা হয়ে গেছি, এখন আর প্রোডাক্ট স্টকে নেই। অলরেডি সোল্ড। তুই আরাম কর। আমি চলে আসবো।ʼʼ

অন্তিক মাথা নত করল না, লজ্জাও পেল না। সে তাকিয়ে দেখল অন্তূর দাপুটে পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়া। অন্তূর কাছে সে গুরু ছিল, তবে নিচে নেমে গেছে কয়েক বছর আগে। ততদিনে ছোট্ট অন্তূ বড় হয়ে গেছে। সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

তার তো আরও বহু ভৎসনা প্রাপ্ত। বাপ-মা-বোন ক্ষমা না করলে তার ক্ষমা নেই। এরকম ছোট-খাটো কটুক্তিতে তার সুখ হচ্ছিল, অন্তূর কাছে মাথা আরও নত হয়ে আসছিল। মানুষ চিরকাল মোটেই নিজের আত্মগৌরব ধরে রাখতে সক্ষম হয় না। নিজের দোষে তা কখনও কখনও খুব জঘন্যভাবে মরা পাতার মতো ঝরে পড়ে। ঠিক যেমন সে, আজ নিতান্তই নর্দমার কীট। অবাঞ্চনীয় জেদের বশবর্তী হয়ে সর্বস্ব ধ্বংস করা এক অভিশাপ।


পরীক্ষা শেষ কোরে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে অন্তূ গেল থার্ড ইয়ারের ফর্ম ফিল-আপের জন্য। মনোয়ারা রেহমান ওকে দেখে মৃদু হাসলেন, “ভালো আছো?ʼʼ

মলিন হাসিটা লুকিয়ে সে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ, ম্যাম! আপনি ভালো?ʼʼ

মনোয়ারা মাথা নেড়ে বসতে বললেন। এক মুহুর্তের জন্য অন্তূর দিকে তাকিয়ে হুট করে যেন থমকালেন ভদ্রমহিলা। অন্তূর মুখ খোলা, পর্দা নেই তাতে। তবে সংগোপনে এড়িয়ে গেলেন এই ব্যাপারটা। মনোয়ারা কিচু বুঝলেন বোধহয়, “কিছু বলবে, অন্তূ? তোমার সাথে এমন ইতস্ততবোধ যায়না। আমি তোমাকে স্পষ্টভাষী হিসেবে দেখতে চাইবো।ʼʼ

আশ্বস্ত হয়ে বলল অন্তূ, “ম্যাম! আমাদের কমনরুমে যে সালমা খালা কাজ করতেন, উনার সম্বন্ধে কী কী জানা আছে আপনার?ʼʼ

সন্দিহান স্বর মনোয়ারার, “কেন জিজ্ঞেস করছো?ʼʼ

অন্তূ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। কিছু ভাবলো। একটু রহস্যমণ্ডিত লাগল ব্যাপারটা। এরপর আচমকা সহজ গলায় বলল, “জানিনা। আসলে উনার মেয়ের ওভাবে মৃত্যু…ʼʼ

-“উনার মেয়ে? আঁখি উনার মেয়ে ছিল?ʼʼ

অন্তূ অপ্রস্তুত হলো, “জি ম্যাম! উনার মেয়ে আঁখি।ʼʼ

-“ও আচ্ছা। তো তুমি কেন জিজ্ঞেস করছো সেসব ব্যপারে?ʼʼ
অন্তূ কথা খুঁজে পেল না আর। প্রসঙ্গ এড়াতে বলল, “আমাদের নতুন সাজেশন দেবার কথা ছিল না, ম্যাম?ʼʼ

বেরিয়ে আসার সময় ফের একবার ডাকলেন মনোয়ারা, “শোনো মেয়ে! এতক্ষণ অনধিকার চর্চা হবে বলে জিজ্ঞেস করিনি, তবে না করে পারলাম না। তোমায় দেখে ঠিক লাগছে না। আমার অভিজ্ঞতাকে বোধহয় ফাঁকি দিতে পারেনি তোমার চতুর চোখ।ʼʼ

অন্তূ হাসল, “সুযোগ পেলে পরে কখনও সরল চোখে তাকাবেন, ম্যাম। পড়ে নেবেন সবটা, আজ জোর করবেন না। আমার জন্য দোয়া করবেন।ʼʼ

একটা সরু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। জীবন তার সাথে বেশ গভীর নিষ্ঠুর খেলায় মত্ত হয়েছে। জিতবে কে? জীবনের সাথে নাকি জেতা যায় না, হার নিশ্চিত জেনেও সে কি একবার লড়বে? হারার জন্য লড়াটা বোকামি হবে না? আবার না লড়ে জিতে যাওয়াটাও কি ছোটলোকি হবে না?

ভাবনা শেষ হলো শহীদ মিনারের সম্মুখে এসে। মেরুদণ্ড বেঁয়ে এক শঙ্কিত হাওয়া মস্তিষ্কের নিউরণ কোষে আনদোলন তুলল যেন। জয়…জয়…জয় আমির! এই পথটা তার বহু হেনস্থার সাক্ষী! আজ দেখা হবে? না হবার চান্স বেশি। গতকাল নির্বাচনে জেতার উৎসব করে এখন হয়ত ঘুমাচ্ছে!

অন্তূ হাসল, এরা সুখী, কারণ এরা খারাপ। অন্তূ অবাক হলো, আশ্চর্য! সে নিজেও তো খারাপ, তবুও তার জীবনে এত ঝঞ্ঝাট কীসের? নাকি নিয়তির কাছে তার খারাপ মানসিকতার খবর পৌঁছায়নি? নিয়তি নিজেও জানেনা অন্তূ কতটা স্বার্থপর, হিংস্র আর কূটিল। আবার সময়সাপেক্ষে খুব দূর্বলও, এই বিষয়টাকে অবশ্য ঘৃণা করৈ অন্তূ। দূর্বল কেন সে? পুরোপুরি খারাপ হতে হবে তাকে, গোটাটা আপাদমস্তক, প্রতিটা শিরার প্রবাহধারায় খারাপের তরল ঢুকাতে হবে। পলাশ ভালো আছে, জয় ভালো আছে, এ সমাজে এমন সব জয়-পলাশেরা এক ডাকে সুখী মানুষ। সেও সুখে থাকবে, শুধু একবার খারাপ হয়ে গেলেই তার সুখ আর ঠেকবে না কোথাও। নিজেকে এ পর্যায়ে পাগল মনে হলো অন্তূর।

সেই রাস্তা। জয়-হামজার ক্লাবের রাস্তা। ক্লাবটাকে বেলুন, ফুল বিভিন্ন ধরণের সরঞ্জামে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। একগাদা চেয়ার জড়ো করা পাশের মাঠটায়। বেশ কিছু ডেকচি, প্লেট, শামিয়ানা ইত্যাদিও দেখতে পেল। উৎসব বেশ জমজমাট পালিত হয়েছে। অন্তূর বুকটা আবার একটু কাঁপলো। ক্লাবের সামনে কেউ নেই। দুপুর গড়ানো সময়। সবগুলো নাচানাচি-লাফালাফি কোরে হয়ত বিশ্রাম নিচ্ছে এখন?

ঘরবাড়ি ওভাবেই পড়ে আছে, শুধু মানুষগুলো নেই। চাঁদনীর কথা অন্তূর মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। মেয়েটাকে একদিনেই কেন জানি মনে ধরে গিয়েছিল। আর সালমা খালা? উনার কান্নাজড়িত মুখটার কথা মনে পড়লে বুক ভার হয় অন্তূর। অন্তূর চাঁদনীকে দরকার। ওর বিশ্বাস মেয়েটা অনেককিছু জানে। অন্তূ এটাও ভেবে বের করেছে এই দু’দিনে, এসব তাদের পরিবারের সাথে শুধুই ঋণের টাকার দায়ে বোধহয় হয়নি। কিছু একটা ঘটছে, ঘটেছে, চলছে পিঠপিছে। যা আন্দাজের বাইরে।

কী হতো, যদি না জয় সেদিন ওকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা না করতো! ভাবতেই বিষিয়ে উঠল ভেতরে ভবনাটা। এক জানোয়ারের সাপেক্ষে আরেক জানোয়ারকে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছে যেন পাগল মনটা! তবু সে কৃতজ্ঞ ওই নোংরা লোকটার কাছে। অন্তত নিশ্চিত সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষার খাতিরে।

টিনের বেড়া কেটে বানানো দরজাটা চাপানো ছিল। তা চেপে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই কেমন ক্যারক্যার শব্দ করে উঠল। অন্তূ সাবধান হলো। কোনোমতো ভেতরে মুখ দিতেই একটা বিশ্রী গন্ধ এসে সুরসুর কোরে নাকের গভীর প্রবেশ করল। বমি এসে গেল অন্তূর। ওড়না তুলে নাকে চেপে ধরল। এই ক’দিনে একটা বসত বাড়িতে এমন দুর্গন্ধের উৎস কী? কিছু মরে পড়ে আছে নাকি?

ঘরগুলো ফাঁকা। জিনিসপত্র কিছুই নেই। যত এগিয়ে যাচ্ছিল, গন্ধটা আরও প্রকট হয়ে নাকে আসছিল। মাটির রান্নাঘরে ইঁদুর মাটি তুলে ছোট ছোট পাহাড় বানিয়েছে। চাঁদনী যে ঘরে তাকে বসিয়েছিল সেখানেও উঁকি দিলো একবার। ফাঁকা সেসব। অথচ গন্ধের উৎসটা আসছে আসলে ওই বিল্ডিং থেকে। যেটা অন্তূ এর আগের বার এসেও দেখেছিল। ওভাবেই পড়ে আছে। শুধু ছাদ হয়েছে, নিচে মাটি, জানালা-দরজা কিছুই নেই।

কৌতূহল দমাতে না পেরে সেখানে উঠে গেল অন্তূ। ইটের ওপর ইট রেখে সিঁড়ি তৈরি করা। যেটা আগে ছিল বলে মনে পড়ল না। বালু বিছানো মেঝে। দুটো পাশাপাশি ঘর। একঘরে উঁকি দিয়ে ফাঁকা পেল। ওপর ঘরে যেতেই একদম পেট গুলিয়ে এলো অন্তূর। শক্ত করে ওড়না চাপল নাকে। অবাক হয়ে দেখল ঘরটা।

একটা মাদুর, দু-তিনটা চটের বস্তা, চাটাই, পিড়ি ইত্যাদি বিছানো। তার ওপর ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেকগুলো কাঁচের বোতল, ক্যান। বোতলগুলো অ্যালকোহলের। মোড়কের মতো কাগজ ছড়িয়ে আছে পুরো ঘর জুড়ে। তাতে নিশ্চয়ই নেশাদ্রব্য ছিল? একটা জিনিস, যা অনেকগুলো এখানে-ওখানে পড়ে আছে, তা দেখে প্রথমে বুঝতে পারছিল না অন্তূ, এগোলো আসলে কী? একটু পরেই মাথায় এলো, এ তো কলকি। গাঁজার কলকি বা স্টিক তৈরির তিনকোণা আকৃতির মোড়ক। এসবের গন্ধও আসছে, তবে এমন বিশ্রী আর তীব্র যেন নয়, যা নাকে আসছিল। এই ঘরের ফাঁকা জানালায় চাটাই বেঁধে দেয়ায় ঘরের ভেতরে দিকটা অন্ধকার প্রায়। অন্তূ আরও কিছুটা এগিয়ে গেল।

গা গুলিয়ে এলো ওর। মাংস পঁচার গন্ধ নাকি খুব বিশ্রী হয়, অন্তূর মনে হচ্ছিল এরকম নোংরা দুর্গন্ধ তার নাকে আগে প্রবেশ করেনি কখনও। সে আরেকটু ঝুঁকল। বেকারীগুলোতে যে পাতার ওপরে কোরে বিস্কুট, রুটি সেঁকতে দেয়া হয় তুন্ডুরীতে, সেই পাতা। তার ওপর ঘন, শুকনো সাদা-লালচের মিশ্রণে কেমন ক্রিম জাতীয় পদার্থ লেপ্টে আছে। সাদা পদার্থগুলো আলাদা হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। অন্তূ বুঝতে পারছিল না জিনিসটা কী আসলে? কী লেগে আছে লোহার পাতাগুলোর ওপর। খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। কী ধরণের পদার্থ? কোনো ক্রিম অথবা রাসায়নিক দ্রব্য? হুট কোরে জট খুলল যেন। ঘন অফ-হোয়াইট রঙা ক্রিম জাতীয় পদার্থ কী তা বুঝতে পেরে ঘেন্নায় গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। পায়ের পাতা শিরশির কোরে উঠল। পুরুষের বীর্য! অন্তূ কয়েক কদম পিছিয়ে এসে কেঁপে উঠল। একটু ধাতস্ত হতেই ভাবনায় এলো, তাহলে এই পদার্থটির সাথে রক্ত কেন? পরে বুঝতে পারল, ওখানে পড়ে শুকিয়ে আছে রক্ত-পুঁজ এবং বীর্য—মানবদেহের বর্জ্য পদার্থের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নোংরা তিনটি পদার্থই এখানে পড়ে আছে। অন্তূর শরীরের পশমগুলো তখনও দাঁড়িয়ে আছে, লোভকূপগুলো শিউরে আছে। পেটে মোচড় দিয়ে আসছিল। এখানে কী হয়? মদ-জুয়ার আসর বসে, তা তো বোঝা গেল নাহয়! তবে এগুলো কী? কেন? কী ঘটে এখানে? নাকি সে-ই বেশি ভাবছে?

হতে পারে, কারও ক্ষত ড্রেসিং করা হয়েছে এখানে? বদরক্ত ও পুঁজ ফেলা হয়েছে! তাহলে বীর্যর মতো এমন একটা অবাঞ্ছিত পদার্থ এমন একটা জায়গায় খোলাভাবে? এই পদার্থ কি এভাবে পড়ে থাকার মতো কিছু? কী ধরণের নোংরামি হয় এই পরিত্যক্ত ঘরখানায়?

সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো, আছরের আজান পড়ছিল। হাত-ঠান্ডা হয়ে এসেছে, কেমন ঘোর লেগে গেছিল। সাধারণ স্বাভাবিক জীবনটা কবে থেকে যেন এমন উদ্ভট সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার অভ্যাস গড়ে নিলো!

এই ভয়টাও ভেতরে কাজ করছিল না, যে পাশেই ক্লাবঘর, কেউ দেখে ফেলবে তাকে। খানিক হেঁটে তবে রাস্তায় উঠতে হয়। বাড়িটার চারপাশে কোনো বসতি নেই। অন্তূ ভেবে পাচ্ছিল না, এখানে আসলে হয় কী? আর বাড়ির লোকগুলোই বা গেল কোথায়? কেউ জোর কোরে উঠিয়ে দিয়েছে? কারা উঠিয়ে দিয়েছে? ক্লাবের মালিকেরা?

পাশের বাড়িতেই ঢুকল সে, দ্বিধা-সংকোচ ঠেলে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল, “ওই বাড়ির লোকেরা কোথায় গেছে?ʼʼ

বাড়ির মহিলা বললেন, “হুট কোরে একদিন আইছিল, পরে আবার চলে গেছে হয়ত। কারও সাথে তেমন সম্বন্ধ ছিল না ওদের, যতদিন ছিল এখানে।ʼʼ

অন্তূর চোখ-মুখ কুঁচকে উঠল, “মানে? হুট কোরে এসেছিল মানে? সালমা খালা এখানকার বাসিন্দা না?ʼʼ

-“ও মা! তা হবে কেন? কয়েকমাস আগেই তো আইছিল এইখানে।ʼʼ

অন্তূ বূঝতে পারছিল না কিছুই। সালমা খালাকে কমনরুমের আয়া হিসেবে সে এডমিশন নেয়ার পর থেকে দেখছে, অর্থাৎ সে-ই দেখছে প্রায় দুবছর যাবৎ। এসেছে তারও আগে। আর জায়গা বিক্রি, ওসব ঝামেলা…অন্তূর অসহ্য লাগছিল ভাবতে।

সামলালো নিজেকে, “আচ্ছা, বুঝেছি। ওরা কবে গেছে এখান থেকে বলতে পারবেন? আর সোহেল ভাইয়া কি বিদেশ চলে যাবার পরে ওরা গেছে এখান থেকে?ʼʼ

মহিলা বিরক্ত হলেন, “বললাম তো, ওরা কারও সাথে মিশতো না এইদিকের। কেডা বিদেশ গেছে, কি দেশে আছে তা কেমনে বলব? খালি ওই বাড়িতে থাকতো ওরা, এই জানি!ʼʼ

-“আর আঁখির লাশ? মানে লাশ মাটি হবার পরপরই চলে গেছে ওরা? নাকি তার আগে?ʼʼ

-“সেসব অত জানি না। খালি জানি এখন আর থাকে না ওরা।ʼʼ মহিলা ক্যাটক্যাট করে উঠল।

অন্তূর ইচ্ছে করছিল নিজের মাথার ওপর রাস্তার একটা ভাঙা ইট তুলে ধারাম কোরে বাড়ি মারতে। মাথাটা জং ধরে আসছে। তার মানে কি আঁখির লাশ আসেইনি বাড়িতে? মুস্তাকিন বলেছিল, এসেছে, তাহলে নিশ্চয়ই এসেছে। হয়ত পরিবারের কাছেও পৌঁছেছে, তবে পরিবারটা এখান থেকে যেখানে উঠে গেছে সেখানে। তাহলে নিশ্চয় পুলিশ ফোর্স জানে চাঁদনীর ঠিকানা?

অন্তূর মাথায় আরেকটা প্যাঁচ খুলে গেল, নিশ্চয়ই জমিজমার ক্যাচাল মিটমাট হয়ে গেছে? আর চাঁদনী বলেছিল, ওরা এখানে আর থাকবে না। জমি ফেরত পেলেও তারা অন্যত্র চলে যাবে এই এলাকা ছেড়ে। আর এমন অবস্থায় যে কেউ-ই তাই করতো। এত বড় দাম চুকানোর পর কে এই জাহান্নামে পড়ে থাকে? অন্তূর খেয়াল এলো, সালমা খালাকেও আর ভার্সটিতে দেখা যায় না, কিন্তু কবে থেকে তা ঠিক মনে আসছিল না।

অর্থাৎ, সে ভেতরে যেসব দেখল, সব এই জায়গার নতুন মালিকের কারসাজি? তার কি জানানো উচিত এ ব্যাপারে পুলিশকে? নিশ্চয়ই জানাবে? অন্তূর হুট কোরে একটা বিষয় মাথায় এলো, সে যে অসহ্য গন্ধটা পাচ্ছিল, সেটা কি ওই রক্ত-পুঁজ থেকে আসছিল? রক্ত-পুঁজ অথবা বীর্য—কোনোটা থেকেই ওমন নাড়ি-ভুঁড়ি উগড়ে আসা দুর্গন্ধ আসে না। আর এইরকম একটা রহস্যমণ্ডিত বাড়ি এমন বিনা কোনো নিরাপত্তায় হেলায় ফেলে রাখা হয়েছে।

জমিটা এক হিন্দু লোক কিনেছে। সেই লোক এখানে কোনো অনৈতিক কাজ করছে না তো? কিন্তু এখন চাঁদনীরা কোথায় আছে? সোহেল কি আবার বউ-মাকে ফেলে বিদেশ চলে গেছে? আর আঁখির ছোট ভাই সোহান ক্যান্সারে মরেছিল। সেটাও এক রহস্য। চাঁদনীকে জিজ্ঞেস করেও সেদিন উত্তর পায়নি। খুব সংনমিতভাবে এড়িতে গেছিল চাঁদনী বিষয়টা। সে দারুণ চাপা এবং অদ্ভুত। অন্তূর অনেক, অনেককিছু জানার ছিল চাদনীর কাছে। কিন্তু কোথায় পাবে ওদের? কোনো খোঁজ জানা নেই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here