#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২৩.
পুলিশ এলো। স্থানীয় মানুষজন অভ্যস্ত এতে। মানুষজন গাজিপুরকে যখন শিল্প এলাকা বলা হয়, এটাও তবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক এলাকা বটে। পুলিশের আনাগোনা চলতে থাকে।
জয়কে নিয়ে থানা পুলিশের ওসি বেলাল আহমেদ ঢুকলেন পরিত্যক্ত বাড়িটাতে। এখানে নাকি কিছুদিন আগেও লোক বাস করতো। তাদের ব্যপারে বিশেষ জানাশোনা নেই কারও। এখন আর তারা থাকেনা, কবে গেছে সেটাও জানা নেই কারও।
অসহ্য দুর্গন্ধ ঘরটাতে। লাশপঁচা গন্ধ। এখনও সেই সকল নেশাদ্রব্যের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে চটের বস্তা এবং মাদুরের ওপর। সকলে নাকে চেপে ধরে ভেতরে ঢুকল শুধু জয় বাদে।
কনস্টেবলেরা ঘরের এক কোণে ছাঁদের নিচে ভেতরের কার্নিশের ওপর থেকে মোড়ানো মানবদেহের মতো বস্তুটা নামাতে শুরু করল। বেলাল সাহেব গেলেন বেকারী কারখানার সেই পাতাগুলোর কাছে। তিনি দেখে যতটুকু বুঝলেন, রক্ত-পুঁজ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে, কারও দেহের পুরোনো ক্ষত ড্রেসিং করা হয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটা বেলাল সাহেবকে হয়রান করে তুলল, সেটা হলো ইষৎ আঠালো ধরণের অফ-হোয়াইট পদার্থটি। হুট করে উনার মাথায় জিনিসটা দেখে যা এলো, তার কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পেলেন না।
কবীর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে অবাক হয়ে জয়কে জিজ্ঞেস করে, “ভাই, ওটা কী? না মানে আমি যা দেখছি, আপনিও কি তাই দেখছেন?ʼʼ
-“তুই কী দেখছিস? আমি তো একটা সুন্দর মেয়ে দেখতে পাচ্ছি, যাকে আমার এই মুহুর্তে বিয়ে করে ফেলা উচিত।ʼʼ
এই মুহুর্তে রসিকতা জয়ের কাছে আশা করা যায়। কবীর কিছুক্ষণ চুপ রইল। ফরেনসিকের কেউ আসবে বোধহয়। বেলাল সাহেব বাইরে অপেক্ষা করছেন। জয়, কবীর এবং কনস্টেবল ঘরের ভেতরে। কবীর কৌতূহল দমাতে না পেরে ফের জিজ্ঞেস করে, “ভাই, এই মার্ডারটা কে করছে? আপনি? আপনি কী করে জানলেন এখানে লা-শ আছে? না মানে আপনি… ভাই, খু-নটা আপনি করছেন?ʼʼ
-“না। প্রশ্ন একটা একটা করে কর। সব জমাট বেঁধে যাচ্চে মাতার ভেতরে।ʼʼ
কবীর চুপ রইল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না, পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “তাইলে কে করছে, তা জানেন?ʼʼ
-“এতক্ষণ জানতাম না, এখন জানতে পারলাম।ʼʼ
আমার মনে হয় আপনে আগেও জানতেন।
জয় হাসল, তাই নাকি?
-“মানে?ʼʼ বেশ জোরে বলে ফেলেছিল, দ্রুত গলা নামিয়ে বলল কবীর, “মানে, বুঝিনি। আপনি আবার কী করতেছেন, ভাই? হামজা ভাই আপনারে দেখে রাখতে বলছে, এবার কিছু হইলে আমায় ছাড়বে না।ʼʼ
-“কানের গোড়ায় প্যানপ্যান না করে ওই জিনিসটা অল্প একটু আঙুলের আগায় তুলে আন। প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। সাইন্সে মাস্টার্স কমপ্লিট করার কিছু তো ফায়দা হোক!ʼʼ
কবীর হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জয় বিরক্ত হলো, “ওমনে ভ্যাবলার মতো চাইয়া আছো ক্যান, বাল! নিজের ঢোল নিজে নাই পিটাইলে ও ঢোলে মরচে ধরে যাবে, তাও কোনো দুলাভাই বাজাবে না। আজকাল মানুষ প্রশংসা করতে চায় না মাইনষের। আর….ওয়েট! আমি মাস্টার্স পাশ করি নাই? করছি তো! যা অল্প একটু তুলে আন।ʼʼ
-“ওয়াক থুহ! ছিহ! এসব ছোট কাজ করাবেন আমায় দিয়ে?ʼʼ
-“বিনা তেলের অমলেট! পজিটিভ ভাবতে শেখ, যে বালডা ভাবছিস, তা না ওইটা, আমি নিশ্চিত। আরেকটু নিশ্চিত হই, আন যা।ʼʼ
কবীর চোখ বুজে পদার্থটি তুলে এনে সামনে ধরল।সর্বপ্রথম কবীরের হাতটা টেনে জয় নাকের কাছে নেয়। কবীর নাক কুঁচকে চোখ বুজে ফেলল। জয় হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে বলল, “ওসি মারাইছে! একটা সাধারণ বিষয়কে ঘুরায়ে-পেঁচায়ে ভেবে সমাধান বের কইরবার পারে না, সেই শালাও থানার ওসি হয়ে বসে আছে। তো আমরা ভালো হব কোন দুঃখে? এই হাবুলদের জন্যেই তো ভালো হওয়া হয় নাই আমার। তুই নাহয় ঘাস খাওয়া গরু, ও তো ওসি। ও ক্যান উল্টাপাল্টা ভেবে বাইরে যাইয়া দাঁড়ায়ে রইল?ʼʼ
আশ্বাস পেয়ে স্বাভাবিক হলো কবীর, “ভাই, কী এইটা? মানে দেখতে তো আজেবাজে জিনিসের মতোনই লাগতেছে অনেকটা!ʼʼ
পদার্থটি দু আঙুলে ঘষে চেয়ে থেকে বলল, “মেলাটোনিন লিক্যুইড।ʼʼ
-“কী কাম এইডার? এইডা এইখানে কী করতেছে?ʼʼ
-“লুডু খেলতেছিল বসে, খেলবি তুই?ʼʼ বিরক্ত মুখে চেয়ে থেকে আবার বলল, “এক ধরণের হরমোন লিক্যুইড। ওই শালা পাগল পলাশ! ওরে কি আমি শখ কইরা পাগল কই? শালার ভিত্রে যতগুলা মানসিক রোগ আছে, অতগুলা দুনিয়াত আবিষ্কারও হয়নাই। শালার ঘুমের সমস্যা আছে। ব্রেইন থেইকা ঠিকমতো হরমোন বয়না। পার্টিকুলারলি যহন অকাম করে, তারপর একেবারে চাট্টি-বাট্টি গোল হইয়ে যায়। খু-ন কইরা আলোর সামনে গেলে পাগল হইয়া যায় পুরা। এই লোকটারে মারার পর, নিশ্চিত এইখানে বইসা এই হরমোন লিক্যুইড পুশ করছে। কয়েক বোতল গিলছে, এরপর যাইয়া মরার মতো ঘুম পাড়ছে।ʼʼ
-“পলাশ মারছে এই লোকটাকে?ʼʼ
বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল জয়, “হ, এইবার সিওর আমি। ওই পাগল ছাড়া কারও এরম ধরণের মেন্টাল কেইস নাই। আমার শালটা আন, জ্বর-ঠান্ডা লাগলে তরু ঘ্যানঘ্যান করে। এবার একটু সমাজ সেবার নাটক করি, কী আর করার!ʼʼ
কবীরের কেন জানি বিশ্বাস হলো না জয়ের কথাগুলো। সে পুরুষ মানুষ। পলাশ যদি মেলাটোনিন হরমোন লিক্যুইড ব্যবহারই করে তো ওখানে পড়ে থাকার তো কথা না। কিন্তু জয়কে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
শাল এনে দিলে জয় তা পেঁচিয়ে নিলো শরীরে। দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। সমাজের অনৈতিকতার বিচারে সে খুব তৎপর, তাকে দেখতে এমনই লাগছিল। একজন নীতিবান, বিপ্লবী ছাত্রনেতার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল পুরোটা সময়, অথচ একটুও আগ্রহ পাচ্ছিল না পুলিশদের বোকামি দেখতে।
ইনক্যুয়েরি শেষ হতে মাঝরাত হলো। ফরেনসিক স্পেশালিষ্ট জিনিসটাকে মেলাটোনিন হরমোন লিক্যুইড বলে শনাক্ত করলেন। বেলাল সাহেব জিহ্বা কামড়ালেন। তিনি সিমেন ভেবেছিলেন, তা জয়ের কাছে বলে হাসলেনও একদফা। তার বদলে জয় মুখে হেসে, মনে মনে দুটো খাঁটি বাংলা গালি দিলো ওসি সাহেবকে।
বাড়ির মালিক সেই হিন্দুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। কেউ জানেনা এই বেওয়ারিশ জমিটা আসলেই কার, সবার জানামতে কোনো সনাতনধর্মী লোকের। যে এখানে বসবাস করে না, কিনেছে সালমা বেগমের কাছে, পরে আর ফেরত দেয়নি। সালমা বেগম উঠে চলে গেছেন এখান থেকে। এই কাহিনিই জানানো হয়েছে মানুষকে। অর্থাৎ একেক স্থানের লোক এই কাহিনিটাকে একেক রকমভাবে জানে। আসল কাহিনি কোনটা, অথবা তাদের জানাগুলোর মাঝে আদতেও আসল কাহিনি আছে কিনা, সে ব্যাপারেও ধারণা নেই কারও। এলাকার লোক জানে পড়ে ছিল এই জমি বছরের পর বছর। এরপর একদিন সালমা বেগম কিনেছেন, থাকতে শুরু করেছিলেন কিছুদিন আগে। অন্য এলাকা বিশেষ করে ভার্সিটি এলাকার লোক আরও অন্যরকম কিছু জানে। কারণ, তাদের ভার্সিটিতে সালমা বেগম আয়া হিসেবে বহু আগে থেকে কাজ করতেন, ভার্সিটি এরিয়ার ধারণা তিনি হয়ত এখানেই থাকেন শুরু থেকে। এবং এই জমির প্যাঁচাকলে মেয়েটিকে খুব নৃশংসভাবে হারিয়েছেন।
খুনটা কমপক্ষে চারদিন আগে হয়েছে। ওভাবেই সাদা বস্তায় মুড়িয়ে কার্নিশে তুলে রাখা হয়েছে। এখানে শুধু হিন্দু লোকটাকে পাওয়া গেলেই কেইসটা সলভ হয়ে যাবে না। হতে পারে উনি বহুদিন আসেননি এখানে, তার এই পরিত্যক্ত জমিতে কোনো বদমাইশদের আড্ডা জমে বসেছিল। ওসির নজর ক্লাবের ছেলেদের ওপর পড়ল, তবে চেপে গেলেন তিনি। করলেও গোপনে তদন্ত করতে হবে এদের সন্দেহ করে। প্রকাশ্যে করা যাবে না। হামজা-জয় চতুরতার লেভেল ছাড়িয়ে এতদূর গেছে, তারা প্রকাশ্যে অনৈতিকতা করে বেড়াবে, অথচ ধরার ফাঁক থাকবে না।
ক্লু একটাই, রক্ত-পুঁজ। এগুলো কার? কাকে ড্রেসিং করা হয়েছিল? মৃতদেহের নয়। কারণ, মৃতদেহে কোনো ক্ষত নেই। তাকে ড্রাগ দিয়ে মারা হয়েছে।
নতুন মেয়র হামজা পাটোয়ারী। মাঝ দিয়ে হামজা বাবা হুমায়ুন পাটোয়ারীকে ঘরে বসিয়ে ওয়ার্কশপের কাজের ভার দিয়েছেন। নতুন একজনকে পৌরসভার কাউন্সিলর বানিয়ে নিজের হাতে রেখেছে। পুলিশরা আজকাল পুলিশ নয়, তারা কাঠের আসবাব। তাদেরকে ঘরের যেকোনো স্থানে, যেকোনোভাবে, যেকোনো ভূমিকায় সাজিয়ে রাখতে পারে রাজনীতিবিদ এবং সন্ত্রাসশ্রেণীরা।
—
অন্তূর পরীক্ষা ছিল আরেকটা। ভার্সিটি চত্বরে গুঞ্জন।।পরে জানতে পারল, তার দেখা লাশটি ছিল সোহেলের। অর্থাৎ আঁখির বড় ভাইয়ের। অন্তূ নিশ্চিত, পলাশ সোহেলকে মেরে ফেলেছে। ওরা তো বাড়ি ছেড়ে উঠেই গেছে, তবু কেন মেরেছে? ঙ
অন্তূর দেখা পদার্থটি নাকি হরমোন লিক্যুইড। এ ব্যাপারেও অন্তূর সংশয় রয়ে গেল।
আজকাল নিজেকে সাধারণ মেয়ে মনে হয় না তার, সে বহুত অযাচিত বিষয়ের সাক্ষী, সহজ বাংলায় সে এক রহস্যবিদ হয়ে উঠেছে। এই ভাবনাতেও হাসি পেল অন্তূর। হুট করে জীবনের ধারাবাহিকতা বদলে গেছে। এর শুরু কোথায়? যেদিন জয়ের সাথে দেখা হলো, সেখান থেকে বোধহয়।
—
পাড়ার লোকে জানে, আমজাদ সাহেবের জমি নিয়ে ভাইয়ের সাথে ঝামেলার চলছে। আজ তিনি যাবেন তার একটা সমাধান করতে। কথাটা রাবেয়া বলে এসেছেন প্রতিবেশিদের। তারা যেহেতু এই ভয়াবহ সংকটাপণ্ন অবস্থায় পুরো একটা দিন থাকবেন না বাড়িতে, প্রতিবেশি সকলকে একটু নজর রাখতে বলে এসেছেন, বাড়ির ওপর। মেয়েটা একা থাকবে, কোথা থেকে কী মুসিবত এসে হামলে পড়বে, আল্লাহ ছাড়া কেউ থাকবে না রক্ষা করার!
আমজাদ সাহেব মানসিকভাবে কেমন আছেন, তা তার গাম্ভীর্য ছেঁদ করে বুঝে ওঠার উপায় নেই। শারীরিকভাবে চলার মতো। শরীরে বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমাট বাঁধা। কড়া ডোজের ব্যথার ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিক উনার শরীরের সমস্ত জীবনীশক্তি শুষে শুধু খোসাটা ছেড়ে দিয়েছে যেন। ডাক্তার রিলিজ করার সময় বলেছিলেন, এইসব স্থানে একসময় জমাট বাঁধা রক্তের দানাগুলো টিউমারে পরিণত হতে পারে। রক্ত-চাপ অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে উনার। রোজ দুবেলা ‘ওমলেসি ৪০ মি.গ্রা’ এর টেবলেট খেতে হচ্ছে। সাথে ঘুমের ওষুধ। অর্থাৎ, অল্প খানিক আর বাড়লে ব্রেইনে স্ট্রাক এট্যাক হতে সময় নেবে না। অন্তূ নিজহাতে ওষুধ খাইয়ে, বেশ কিছুক্ষণ আব্বুর সাথে কথা বলে রুমে এসেছিল সুই নিতে। উনার পাঞ্জাবীর কলারে একটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে।
তখন অন্তিক এলো রুমে। বহুবছর পর এলো। অন্তূ সহজভাবে নিতে পারল না ব্যাপারটাকে। বিছানায় বসতেই প্রশ্ন ছুঁড়ল, “অন্তিক! মানুষ দেনার দায়ে পড়লে কুকুর হয়ে যায়?ʼʼ
অন্তিক নির্লজ্জের মতো হাসল, “বউ যদি বাপের বাড়ি থেকে এক পোটলা গয়না এনে দিয়ে বলে, নাও, এগুলো দিয়ে ব্যবসা করবে। যাতে তোমার বাপ না বলতে পারে, তুমি অপয়া, বউ খেতে দেবার মুরোদ নেই। তাহলে বোধহয় হয়।ʼʼ
-“তাতে ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলে পুরুষ? আমি বুঝতে পারছি না, আজই বা কী এমন বদলেছে যে তুই বদলে গেছিস? এই তো দুদিন আগেও কথা বলতি না, হুট করে কী নতুন নাটক শুরু করেছিস? অবশ্য লাইফে বিনোদনের দরকার আছে, দে তুই একটু বিনোদন দে।ʼʼ
-“আব্বু, তোমার মেয়ের মূখের ভাষা এত কঠোর কেন?ʼʼ
আমজাদ সাহেব কথা বললেন না।
অন্তিক বালিশ টেনে নিয়ে অস্থায়ীভাবে শুয়ে পড়ল। পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে বলল, “ওই যে একটা কথা আছে না? মেহনত করো চুপচাপ, এরপর আওয়াজ করে লোককে জানাও নিজের সফলতার কথা।ʼʼ
হো হো করে হেসে উঠল অন্তিক, “আমি সেটাই এপ্লাই করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একবার সফল হলে আব্বুর কাছে যে অপরাধ করেছি, সফল হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলব, আব্বু আমি ততটাও অপদার্থ না, যতটা তুমি ভেবেছিলে।
কিন্তু শালা কপালের পাল্টিবাজী দেখেছিস? পলাশের ছেলেদের চাঁদা দিতে আরও ঘর থেকে নিয়ে যেতে হয়েছে। পুঁজি খেয়েছে, আমাকে খেয়েছে, মার্জিয়া আরও কত কী এনে দিয়েছে সেসব বিক্রি করে নিয়ে গিয়ে দিয়েছি, অথচ ওদের ক্ষুধা মেটেনি। আমার এইসব ব্যর্থতা, হতাশা তোরা কেউ না জানলেও মেয়েটা জানতো সব, সহ্যও করতো। আর এই কৃতজ্ঞতায় ওর সব অসভ্যতামি সহ্য করে গেছি। এই পরিণতি নিয়ে আব্বুর সামনে দাঁড়াতে পারিনি। লজ্জায় দু’বার মরার চেষ্টা করলাম, তাতে তোদের ওপর মার্জিয়ার ক্ষোভ আরও বাড়ল। মেয়েটা বহুত ত্যাগ করেছে এই সংসারে এসে। আমার অবস্থা দেখে, সেসব একসাথে সইতে সইতে কবে যে এমন জাহিল নারী হয়ে উঠেছিল! মাঝেমধ্যে মনে হতো, ওর মানসিক অবস্থা বিগড়ে গেছে আবার ওই হাল দেখে। আমার ওই অবস্থার জন্য আব্বুকে দায়ী করতো ও। আব্বু নাকি কঠোর, গম্ভীর। তাই ওনার সামনে দাঁড়িয়ে আমি সত্যি বলতে পারি না। বোনের গহনা এনে দিয়েছিল ব্যবসা করার জন্য। ওর বোনের শশুরবাড়ি থেকে তালাক দেবার কথা বলছিল গহনা ফেরত দিতে না পারলে।ʼʼ
অন্তূ এতক্ষণে নির্লিপ্ততা ভেঙে তাকালো অন্তিকের দিকে। এই নিয়ে একদিন উল্টা-পাল্টা ঝামেলা হয়েছিল মার্জিয়ার সাথে। মার্জিয়া কথা শুনিয়েছিল অন্তূকে। অন্তিক কিচ্ছু বলেনি সেদিন।
বেশ কিছুক্ষণ আপন মনে প্যাঁচাল পেরে উঠে বসল অন্তিক। ঝুঁকে বসে বলল, “আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি রে, অন্তূ! আমার কোনো কিছুতেই কোনো রিয়েক্শন আসেনা, না লজ্জা, না সম্মান, না কোনো হেলদোল। যা হচ্ছে, সব কেমন তুচ্ছ লাগে আমার জীবনের খেলার কাছে। বোনকে পুরুষ দিয়ে ছুঁইয়ে দিয়েছি, বাপের মন ভেঙেছি, পড়ালেখা ছেড়েছি, সব ছেড়েছুঁড়ে যে মেয়েটাকে ঘরে আনলাম, তাকে অবধি ধ্বংস করে ছেড়েছি। আমি আত্মহত্যা করলেও কি পাপ হতো, মহাপাপ? হতো রে অন্তূ?ʼʼ
-“না হতো না। আত্মহত্যাতে কোনো পাপ নেই, ওটা একটা সাহসের বিষয়। কঠিন সাহস না থাকলে কেউ এই দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে না। তুই আর আমি একসাথে সুইসাইড করব, কেমন? একা মরলে মজা পাব না, তুই সঙ্গে থাকলে মরতে ভালো লাগবে।ʼʼ
অন্তূকে দেখল অন্তিক। কেউ কেউ অতিরিক্ত যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে আর কেউ বা অন্তূর মতো নিষ্ঠুরতায় ঢেকে ফেলে নিজেকে।
সকাল আটটার পর বেরিয়ে গেল সকলে। আমজাদ সাহেব অন্তূকে বললেন, “দরজা আঁটকে পড়তে বস। বিকেলেই ফিরে আসব আমরা।ʼʼ
যতদূর দেখা গেল, গলির মাথা অবধি চেয়ে দেখল অন্তূ আব্বুর ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য।
পড়ায় মনোযোগ পেল না। কেমন এক অস্থিরতা ঘিরে ধরছে। ঘুরে ফিরেই পলাশের রুফটপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নফল নামাজে বসতে ইচ্ছে করল অন্তূর।
গোসলের পানি শরীরে ঢালার সময় প্রতিটা পানির ফোঁটা তাকে সতর্ক করতে চাইছিল যেন। অদ্ভুত এক আশঙ্কাজনক আতঙ্কে ছটফট করছিল ভেতরটা। কোনোকিছুতেই মন টিকছে না। আশপাশটা ঠিক তেমন গুমোট হয়ে আছে, কালবৈশাখী ধেয়ে আগে পরিবেশে যেমন থমথমে অসহ্য তপ্ত নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।
ধুপ করে একটা শব্দ হলো কোথাও। ট্যাপের পানির আওয়াজে তা প্রকট হলো না কানে, তবে কানে এলো ঠিকই। শরীরে এক প্রকার কম্পন টের পেল অন্তূ। গোসলটাকে তার বিষাক্ত লাগছে। কীসের গোসল করছে আল্লাহ জানে! গোসলের পানি শরীরে এমন জ্বালা ধরায়?
গেইটে ধুমধাম আওয়াজ হচ্ছে। করাঘাতগুলো ধীরে ধীরে শক্ত ও ভারী হয়ে উঠছিল। অন্তূ সম্বিত পেয়ে দ্রুত শরীর মুছে শুকনো কাপড় পরতে লাগল। কারা এসেছে? ওদিকে গেইট ধাক্কানোর মাত্রা ক্রমশ বিকট হয়ে উঠছে। অন্তূ কোনোরকম মাথায় গামছা পেঁচিয়ে তার ওপরই ওড়নাটা দেহে পেঁচিয়ে নেয় ব্যস্ত হাতে।
চলবে…
[বিশাল এক পর্ব! ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। রিচেইক করিনি।]