#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪২.
ঘড়িতে রাত বারোটা। শেয়াল আর ঝিঝি পোকার ডাক কবরস্থানের এই নিশুতি নীরবতায় গা ছমছমে একটা পরীবেশ তৈরি করেছে। জয় খাদেমকে খুঁজে পেল না। শরীরের ব্যথাগুলো টনটন করছে। শরীরটা ছোট হয়ে গেছে, ক্ষত বেশি এই জীবনে। এমন কোনো স্থান কি বাকি আছে, যেখানে ক্ষতর দাগ নেই? জয় হুটহাট ভাবে, গায়ের ব্যথার কথা আরমিণ জানলে এখন বলতো? নিশ্চয়ই বলতো, “কর্ম অনুযায়ী ফল পেয়েছেন। আঘাত কেউ অকারণে করেনি নিশ্চয়ই আপনাকে।ʼʼ
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে এদিক-ওদিক তাকাল। এখানে না পেলে কোথায় খুঁজবে? মনে মনে ঠিক করল, দেখা হওয়া মাত্র কান-সারার ওপর কষে একটা ঘুঁষি মারবে। এখানে এলেও, আসলে যে এখানে আসার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়নি, এটা নিশ্চিত সে।
কবরস্থানের গেইটটা এত রাতেও খোলা। জয় সন্দেহমাফিক এগিয়ে গিয়ে আশানুরূপ দৃশ্যটাই দেখল। অন্তূ কবরস্থানের গেইটের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে অনুরোধ করছে খাদেদের কাছে, “চাচা, একটাবার আব্বুর কবরের কাছে যেতে দিন…আমি আব্বুর সাথে দুটো কথা বলেই চলে আসব। দোয়া এখানে দাঁড়িয়েই করব। কথা দিচ্ছি।ʼʼ
পেছন থেকে অন্তূকে চিনতে এক রত্তিও ভুল হলোনা জয়ের। দম ছাড়ল এবার। অবুঝের এই আবদারে খাদেম ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, “মা’রে! এত করে বলা লাগতো না আমারে। কিন্তু কবরের সীমানায় তোদের মায়ের জাতদের ঢুকতে নেই যে…ʼʼ
অন্তূ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। জয় গিয়ে সামনে বসল। অন্তূর মানসিক অবস্থা দিনদিন বিগড়ে অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চাচা! আজ চলুন নীতি ভাঙি। আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি ওকে। দু মিনিটে ফিরব।ʼʼ
খাদেমের নিষেধ শোনার লোক না জয়। অন্তূ লুটিয়ে পড়ে বাচ্চা শিশুর মতো আমজাদ সাহেবের কবরের ওপর। হু হু করে কেঁদে ওঠে। জয়ের কানে খুব লাগছিল কান্নাটা। কী যে করুণ সেই স্বর এই নির্জন রাতে বাপের কবরে পড়ে মেয়ের কান্না! নিয়ম মানেনা মায়া, না মানে রীতি! অন্তূকে টেনে উঠানো যাচ্ছিল না। জয় আপাতত ভুলে গেল সমস্ত হিংস্রতা, যা এতক্ষণে অন্তূর ওপর জন্মেছিল। হাঁটু মুড়ে সামনে বসে বলল, “আরমিণ! রাত হয়েছে। কখন এসেছ এখানে? কোথাও গেছিলে, তুমি। কোথায়— তা এখন জানতে চাইলাম না। এমন একটা পরিস্থিতি, পারছি না টেনে একটা থাপ্পর লাগাতে। আর কত জ্বালাবে আমায়? ওদিকে কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে। চলো, আবার আনবো তোমায়।ʼʼ
অন্তূ হাত ছড়িয়ে নিলো। জয় বসে থাকে চুপচাপ। শরীরটা ব্যথা। কী যে দৌড় ঝাঁপ গেছে শরীরটার ওপর! দুজন মিলে দোয়া করল কবরের পাশে দাঁড়িয়ে। জাভেদ আমিরের লাশ পাওয়া গেছিল না। জয়ের তা মনে পড়ল। এখানে তাঁর লাশ থাকলে সে কি আসতো জিয়ারত করতে? সে তো এসব শেখেইনি অন্তূর মতো! পাপী সে। তার প্রার্থনা রব কবুল করে?
রোডে পলাশের বাহিনীর সাথে দেখা হলো। তাঁদের পাঁয়তারায় স্পষ্ট, আজ পারলে জয়কেও ছাড়বে না। পিষে রেখে যাবে। হামজার ভয় পাবেনা আজ, অর্ডার আছে এমন। জয় মিটমাট করার চেষ্টা করল, পারল না যখন, পিস্তল বের করতে হলো। তাতেও ভয় পেত না বোধকরি! কিন্তু কিছু ডিল, কিছু স্বার্থ!
—
হুমায়ুন পাটোয়ারীর লা-শ পচন ধরেছে, তবু তদন্ত ফুরায়নি। হামজাকে বহুবার জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনার বাড়িতে কার এত বড় সাহস? এ বাড়ির পাহারা ও নিরাপত্তা…ʼʼ
বাড়িতে থৈ থৈ করছিল বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার লোক।জয়-হামজ চুপ। তাদের কাছে জবাব নেই, তবে ব্যখ্যা আছে। বিশ্বব্যাংকেও ডাকাতি হয়, অর্থাৎ সেরকম ডাকাতও আছে। হবে হামজাদের বাড়ি খুব ক্ষমতায় ঘেরা। কিন্তু সেই ক্ষমতার সাথে টক্কর দিতে পারা লোকটাই তো হয় প্রতিদ্বন্দী? এ আর অবাক হবার কী? প্রতিদ্বন্দী কি কখনও দূর্বল হয়? বাহিনী বিশাল ছিল। কিন্তু অন্তূ বলল, ওপরে শুধু একজন এসেছিল। নিচের ধস্তাধস্তিও সে শুনেছে।
এরপর? আর জবাব নেই। জয় কোনো প্রশ্ন করল না। সে তার বউকে যেন মুখস্ত করে রেখেছে। সারাদিন আইনী কর্মকর্তাদের আনাগোনা। মেয়রকে টপকে অন্তূকে তারা প্রশ্ন করতে কমই সুযোগ পেল। তার ওপর অন্তূ কথা বলছিল না। সে পারমাণবিক বোমার মতো। ওকে প্রশ্ন করতে দিলে, ঢাকনা খুলে যাবে। মেয়র নামক ব্যাক-আপটা অতটাও শক্ত নয়, সেই ঝাপটাকে ঠেকাতে পারবে না। হামজা সচেতন।
হামজার বাপ মরেছে। মা মৃত্যুসজ্জায়। অথচ সে নির্লিপ্ত। তার কোনো হুটোপাটা নেই। মানুষ যখন অমানুষিকতার উচু পর্যায়ে চলে যায়, দুনিয়ার পার্থিব ‘মায়াʼ ব্যাপারটা বুঝি ঘোলা হয়ে আসে।
—
সময় পেয়ে জয় শান্ত স্বরে অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গেছিলে?ʼʼ
-“আব্বুর কবরখানা জেয়ারত করতে।ʼʼ
জয় শান্ত চোখে তাকাল, “আমি, জয় আমির। বুঝে চুপ থাকা লোককে তুচ্ছজ্ঞান করতে নেই, আরমিণ। সাতাশে জন্মাইনি আমি। পূর্ণ দশমাস পেটে থেকে জন্মেছিলাম।ʼʼ
-“আমি কোথায় গেছিলাম, সেটা তেমন জরুরী কিছু না। তবু যদি জানতে চান, আমার একটা শর্ত আছে। সুযোগ লুফে নেয়া ভালো।ʼʼ
-“কী শর্ত?ʼʼ
-“আপনাদের ওই গোপন ঘরের চাবি কার কাছে থাকে? এটা জানতে চাই।ʼʼ
-“গণ্ডির বাইরে মৃত্যু থাকে, আরমিণ! তা পার কোরো না। তোমায় মারতে আমার খুব বেশি কষ্ট হবেনা।ʼʼ
-“ঠিক আছে, তাহলে বাদ দিন।ʼʼ
-“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।ʼʼ
-“আমিও তো শর্ত দিলাম। চাবি চাইছি না তো, শুধু জানতে চাইছি চাবি থাকে কোথায়?ʼʼ
-“বিশেষ কিছুই নেই ওই ঘরে। তুমি কখনও যাওনি, তাই এত কৌতূহল। যা জিজ্ঞেস করছি, জবাব দাও, নয়ত একটানে কণ্ঠনালী ছিঁড়ে আনবো। ধৈর্য্য নেই আমার।ʼʼ
অন্তূ চুপ। জয় অধৈর্য্য হয়ে এগিয়ে আসতেই অন্তূ চট করে হাতে কাঁচের লম্বা ভারী পারফিউমের কৌটা তুলে নিলো। জয় হতবাক হয়ে যায়। অন্তূ বলল, “মৃ-ত্যুটা বিষয় না, কিন্তু কারও ক্ষমতার দাপট দেখাটা অন্যায়। ক্ষমতার দাপট নিয়ে কাছে আসলে জান না নিয়ে ছাড়ব না।ʼʼ
জয় বাউচি কেটে অন্তূর বাহুর নিচে হাত গলিয়ে সোজা অন্তূর চুলের মুঠি চেপে ধরল। মেয়েরা কাত এই এক জায়গায়। হাত শিথিল হতেই কাঁচের কৌটা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলল জয়। বলল, “দুঃসাহস কতখানি তোর কলিজায়, আরমিণ? একদিন কলজেটা বের করে ওজন করে দেখব।ʼʼ
-“আল্লাহ আপনার ইচ্ছা পূরণ করুন।ʼʼ
-“কোথায় গেছিলে?ʼʼ
-“চাবি কোথায়?ʼʼ
-“কোথায় গেছিলে?ʼʼ
-“চাবি…ʼʼ উচ্চারণ করতে পারে না অন্তূ। একটা গাঢ় চুমু খেয়ে বসে জয়। অন্তূ কষে দুটো আঘাত করল বুকের ওপর, জয় নিরুদ্বেগ। লম্বা সময় পর অন্তূকে ছেড়ে বলল, “এর চেয়েও খারাপ কিছু করি, তার আগে প্রশ্নের উত্তর দাও। যে লোকটা এসেছিল, ওর সাথে কী কথা হয়েছে তোমার? আমরা না থাকা অবস্থায় বাড়িতে কী কী হয়েছে? অনেক কিছু হয়েছে। লোকটার ব্যাপারে বল্। খুব দরকার আমার। বছরের পর বছর ধরে যাকে খুঁজছি, সে বাড়িতে এসে ঘুরে গেছে। বল বল, কী জানিস ওর ব্যাপারে? সাহায্য কেন করেছিস?ʼʼ জয়কে অন্তর্যামী মনে হলো।
-“কিছুই জানিনা। কথা হয়নি, তবে আমি সাহায্য করেছিলাম আপনার মামাকে নরকে পাঠাতে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা তো নেই আপনার! এবার বলুন, চাবি কোথায় রাখা হয়?ʼʼ
-“এত জেদ তোর? এত জেদ কেন তোর? এত সাহস কোথায় পাস, বান্দির বাচ্চা?ʼʼ অন্তূকে বিছানায় ফেলে বুকের ওপর উঠে বসল জয়। গলা চিপে ধরে অশ্রাব্য ভাষায় আরও দুটো গালি দিয়ে বলল, “তুই কী চাস? বাড়িটা জাহান্নাম হয়ে গেছে যেদিন থেকে এসেছিস। এত কীসের তেজ, তোর?ʼʼ
অন্তূর মুখে রক্ত জমে লালচে হয়ে উঠল মুখটা, শ্বাস আঁটকে গেছে, চোখের শিরা লাল হয়ে উঠেছে, তবুও সামান্য ‘উহʼ শব্দ করল না বা কোনোরকম দূর্বলতা প্রকাশ করল না। ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগল জয়। অন্তূকে আঘাত করা আর মূর্তি ভাঙা একই কথা। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ক্ষিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “শালি, তোর চাবি চাই, না?ʼʼ
অন্তূ ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। জয় বলে উঠল, “তোর পা-ছা যদি তুই দড়ি ছিঁড়ে কুত্তা দিয়ে মারা দিস, তো আমি কতক্ষণ লাঠি নিয়ে বসে থাকব?ʼʼ
খাটের এক কোণায় মশা-নাশক অ্যারোসোলের ভর্তি লোহার কৌটা রাখা থাকে। আকস্মিক অন্তূ সেটা তুলে ঠিক জয়ের মুখ বরাবর কষে ছুঁড়ে মারল। থুতনিতে লাগতেই গাঢ় এক জখম তৈরি হয়। জয় হাত সামনে এনে দেখল, র-ক্ত ঝরছে থুতনি থেকে। অন্তূ তাকিয়ে দেখছে তা। তার মুখে তৃপ্তি, চোখদুটো গমগম করছে জলন্ত শিখার মতো, “তোকে বসে থাকতে বলিনি তো। তোর ভালোমানুষি তোর কাছে রাখ। তোকে কে বলেছে, আমায় বাঁচাতে লাঠি নিয়ে বসে থাকতে? তুই যা করেছিস, সে তুই ভুল করেই কর, আর জিদে অথবা ক্ষমতায়, তা যদি আমি অন্তূ কোনোদিন ভুলে যাই, আমি এক বাপের সন্তান না। অথচ আমার বাপ একটাই—আমজাদ আলী প্রামাণিক।ʼʼ
—
দু’দিন বাদে শাহানা মরে গেলেন। সীমান্তর লা-শ পাওয়া গেছে। প্রথম সন্দেহ হামজা পাটোয়ারী। এবার আবার দু’দল করে ইন্টেরোগেশনে আসে। একদল ওর বাপ-মায়ের জন্য, আর একদল সীমান্তর জন্য। রোজ রাজধানী থেকে কল আসে, তদন্তকারীরা বাধ্য হয়ে চলে যায়। উপরমহলের কথা না শুনলে চলে বুঝি প্রসাশনের?
পরিস্থিতি সবার জন্য কেয়ামতের সম। অন্তূকে পলাশ ছিঁড়ে খাবে, হামজা কী করবে তা বোঝা যাচ্ছেনা, জয় কী করছে তা ঘোলা ঘোলা। জয়ের পেছনে কত কেইস ফাইলে জমা হয়ে আছে। এসব সন্দেহ তার ওপর হামজার সমান এসে পড়ছে। অথচ সে দিব্যি ঘুরছে, খাচ্ছে, ভার্সিটি যাচ্ছে, কার্যালয়ে বসছে, কবুরতকে দানা খাওয়াচ্ছে, অন্তূর সাথে সাথে সেধে সেধে ঝগড়া করছে। তার দিন যেন ভালোই কাটছে। আজকাল খুব সিগারেট টানতে দেখা যায় তাকে।
হামজা বেশিদিন এভাবে টিকতে পারবেনা, তা তার বাড়ির পিঁপড়ের দলও জানে। কতদিন তাকে প্রোটেক্ট করবে উপরমহল? যতদিন স্বার্থ আছে? পূরা না করতে পারলে তারাই হামজাকে উড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবে নাকি? তার মাথার ওপর ফাঁসির দড়ি রঙ্গ করে নাচছে।
তবুও পৌরসভার উন্নতি করে চলেছে সে। রাস্তাঘাট তৈরি করছে, সরকারী প্রাইমারী স্কুলগুলোতে বেঞ্চি বানিয়ে দিচ্ছে নতুন। সরকার যা বাজেট দিচ্ছে, তার পুরোটা সেসব কাজে লাগাচ্ছে না, সেটা আলাদা বিষয়। জন্মনিবদ্ধনের একটা সামান্য কাগজ সাইন করাতেও হাজার টাকা নিচ্ছে, রাস্তাগুলো বছর না ঘুরতেই পিচ উঠে গর্ত তৈরি হবে, সেসব আলাদা বিষয়। তবে সে শীতে কম্বল দেয়, গরমে টিউবয়েল বসায়, ভাতার কার্ড দেয়। আর জয় ছাত্র সংসদ দেখছে।
তবুও কেন যে বদনাম খড়ের গাদায় আগুনের মতো ধিক ধিক করে বাড়ছিল চারদিক। এটা রাজনীতিবিদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বদনাম না হয়ে পলিটিক্স করা যায়না।
—
এ বাড়িটা স্বাভাবিক না। বাড়ির প্রতিটা ইটও অস্বাভাবিক। কাল এ বাড়ির বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান। গোটা এলাকার লোক খাবে। সে-রাতে অন্তূকে ডাকা হলো। হামজা প্রশ্ন করল, “আম্মাকে তুমি আঘাত করেছিলে?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ
-“আর আব্বুকে?ʼʼ
-“ওই লোকটা।ʼʼ
-“চিনতে পারোনি তাকে?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“লম্বা ছিল?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ
-“আর?ʼʼ
-“আর কিছু দেখতে পাইনি। মুখ বাঁধা ছিল।ʼʼ
-“তবুও সাহায্য করলে?ʼʼ
-“আমি সাহায্য করেছি, তা কী করে বলছেন, আপনি?ʼʼ
-“তুমিও বোকা না, আরমিণ। আর আমিও হামজা পাটোয়ারী।ʼʼ
-“তাহলে তো সব ধারণাই আছে আপনার। আর জিজ্ঞেস করছেন কেন?ʼʼ
-“তবে তোমার ধারণা নেই নিজের অবস্থা সম্বন্ধে।ʼʼ
-“না না, আছে। আছে বলেই তো কিছু মনে হয়না। দেখুন, মানুষের দূর্বল ক্ষেত্র দুটো—শরীরের ব্যথা আর সবশেষে প্রাণটা। কিন্তু মেয়েদের দূর্বল ক্ষেত্র তিনটা—ইজ্জত, শরীরের ব্যথা আর সবশেষে মৃত্যু। বাহ্যিকভাবে আমার সম্মান নেই, তা রাখেননি আপনারা, ঠিক। কিন্তূ আসলে তো আছে। আর সেটা রক্ষা করতে আমার কোনোমতো শ্বাস চলাই যথেষ্ট। আজ আর আমি বোধহয় সেই পলাশের রূফটপের অন্তূ রইনি, মেয়র সাহেব। আর রইল, মরণ! ওটা তো শখে শখে কবুল। এটা কোনো জীবন হলো? ছিহঃ!ʼʼ
হামজা জয়কে বলল, “তোর বউয়ের পড়ালেখাটা বন্ধ করে দে। এত না পড়লেও চলবে। যথেষ্ট শিক্ষিত হলো, এখন সংসার সামলাক, সংসারে কাজও বাড়বে। একটা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে নে।ʼʼ
অন্তূর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। হামজা ভয়ানক সে জানে, কিন্তু শান্ত মানুষের ভয়াবহতা ঠিক কতটা ভয়ানক হতে পারে? পড়ালেখা না করা, জয়ের সংসারে জয়ের বাচ্চা পালন করা, এর চেয়ে বড় দূর্বলতা নেই তো, নাহ নেই আর কিছু অন্তূর! হামজা ঠিক তা-ই পয়েন্ট করেছে। অন্তূ আজ সত্যিই ভয় পেয়ে গেল আরেকবার হামজাকে। কঠিন ভয়। চোখে-মুখেও সেই ভয় ফুটে উঠল। সে পাগলের মতো পেছন থেকে ডেকে উঠল, “মেয়র সাহেব! পড়ালেখা বন্ধ করে আপনি আমায় আঁটকে রাখতে পারবেন বলে মনে করেন?ʼʼ
হামজা পেছন ফিরে সুমিষ্ট হাসে, “শুধু তোমায় বাঁচিয়ে রেখে আমি শেষ অবধি অনেক কিছুই করব, আরমিণ! চোখ দুটোর যত্ন নাও, দেখতে হবে সেসব।ʼʼ
—
বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। কাঁচের সমোরহ চারদিকে। সুস্থ চোখে অভিজাত্যের কমতি চোখে পড়ার অবকাশ নেই। দেয়ালগুলো অবশ্য রোজ আওয়াজহীন চিৎকারে বলতে চায়, আমি অমুকের র-ক্তের বদলে আদায় করা টাকায় কেনা, অথবা কোনো আসবাব হয়ত অভিমান করে স্বীকার করেনা, ওটা কেনার টাকা পলাশ কারও বউ ছিনিয়ে নেবার ভয় দেখিয়ে আদায় করে নিয়েছে, মেঝের টাইলসগুলোও অবশ্য বলেনা মুখে—আমার মূল্য অমুক মুদি দোকানদারের সারাদিনের পরিশ্রমের টাকা চাঁদাবাজিতে খোঁয়া যাওয়া পয়সায় কেনা। ওরা জড় বস্তু, ওরা এসব কেন বলবে?
পলাশ হেলে-দুলে ঢুকল হলরুমে। তার কানে এসব চিৎকার মধুর ঠেকে। আজ মদ-টদ খেয়ে আসেনি। সোফায় বসে চেঁচাল, “রূপ?..রূপ! নিচে আয়।ʼʼ
রূপকথা এসে জিজ্ঞেস করল, “কিছু লাগবে, তোমার?
-“হু, পাশে বস।ʼʼ
রূপকথা জানে, পলাশের কী লাগবে। কিছু প্রশ্নের উত্তর।পলাশ রূপকথার ঘাঁড়ে মুখ থুবরে আধশোয়া হয়ে বলল, “পাটোয়ারীদের বাড়িতে গেছিলি কেন রে? একা একা ভালো লাগেনা বাড়িতে, তাই তো?ʼʼ
রূপকথা চোখ বুঁজল, “আমায় মেরে ফেলো না কেন? তোমার নিষ্ঠুরতা আজকাল ব্যথাও দেয়না আমায়।ʼʼ
-“ধুর। মারব কেন? ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি তোকে। এতদিনের ভালোবাসায় কেউ একেবারে মারে?ʼʼ
-“ঠিকই বলেছ। রোজ মারতে হলে একেবারে মারা উচিত নয়।ʼʼ
-“কিন্তু তুই আমায় মারতে চাস। এটা জেনে কষ্ট পেলাম। আমি তো খারাপ না।ʼʼ
-“না। আমি মারতে চাই না তোমায়। কিন্তু তুমি যাদের ওপর অন্যায় করো, তারা যদি তোমায় মারে, আমি তাদের বাঁধা দেবার পাপটুকু করতে চাই না।ʼʼ
পলাশ অবাক হবার ভান করে, “এই সাহস কোথায় পেয়েছিস, রূপ? আগে ছিল না। তুই বদলেছিস অনেক।ʼʼ
পলাশের চুলের মাঝে হাত গলায় রূপকথা, “ব্যথার ওপর ব্যথা দিলে আর ব্যথা লাগেনা। আমার মনেহয় তাই হয়েছে। আমার মনেহয় ধৈর্য্য ফুরিয়ে গেছে, অথবা পাগল হয়ে গেছি।ʼʼ
কী সুন্দর দেখতে লোকটা! চোখ, নাক, চুলের বাহার! সুদর্শন স্বামী রূপকথার। তার সাথে খুব মানায় পলাশকে। লোকটা হাসলে খুব সুন্দর দেখায়, নাকটা কুঁচকে চোখদুটো ছোট হয়ে যায়। রূপকথা চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। অদচ মনটা বিষে জেরে আছে। মানুষ মনের কথা শোনে, কে বলে? মনকে লুকিয়ে উপরি রঙে নিজেকে রঙ দিয়ে বছরের পর বছর কেটে যায় এই দুনিয়ায়। তাদের সম্পর্কটা অবর্ণনীয়।
-“জয়ের বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলি কিছুক্ষণ? চোখ দিয়ে কিছু ইনপুট করেছে তোর ভেতরে?ʼʼ
রূপকথা হাসল, “ওকে তুমি ভয় পাও?ʼʼ
-“না। ও আমাকে ভয় পায়না, এটার জন্য দুঃখ পাই আমি।ʼʼ
-“ঠিকই। ভয়ানক মানুষদের যারা ভয় পায়না, তাদের চেয়ে ভয়ানক নেই।ʼʼ
-“তুই কি ওর মতো হতে চাচ্ছিস?ʼʼ সোজা হয়ে বসে রূপকথার পেট জড়িয়ে ধরে পলাশ। এই সুন্দর শরীরে হাজারও শুকনো ক্ষত।
-“চাইলেই কি সম্ভব? আমি তো তোমার শিকার। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে মনুষ্যত্বহীন কুকুরে পরিণত হয়েছি। আমি নোংরা। আমি কেন ওর মতো হতে যাব।ʼʼ
-“তুই প্রতিবাদ করছিস, রূপ। আগে করতি না।ʼʼ
-“না, করছি না। সে সাধ্যি আমার নেই। তবে আজকাল আশা রাখি, খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হবো আমি।ʼʼ
-“না। হবিনা। আমি এত দূর্বল না। গোড়া থেকে উপড়ে ফেলব একদম সবকটাকে। তুই চিন্তা করিস না, তুই মুক্তি পাবি না।ʼʼ
আবারও এক নারকীয় রাত। অনেকদিন পরেই। আজ মেয়ে আনেনি পলাশ। মানসিক বিশেষজ্ঞ একবার বলেছিলেন, “অধিকাংশ সাইকো খুব লজিক্যাল এবং কুল হয়। বদমেজাজও এক প্রকার সাইকোপ্যাথ, তবে সেটা হালকা, ভয়ানক নয়। কিন্তু যত শান্ত, তত মারাত্মক।ʼʼ
তবুও আজ রূপকথার সুখ সুখ লাগল। সে কীসের যেন আশা করে আজকাল। কেন যেন মনে হয়, এসবের দিন ঘনিয়ে আসছে। সব বদলাবে। এই অবরুদ্ধ রাত কাটবে। স্বপ্ন দেখাও এক প্রকার সুখ।
—
জয় রোজ অন্তূকে অত্যাচার করে, বিভিন্ন প্রশ্ন করে, কোনো কাজ হয়না। মাঝেমধ্যেই জয়কে সর্বজান্তা মনে হয়। মানুষের আন্দাজশক্তি কতটা প্রখর হতে পারে!? জয় যেমন সেদিন চট করে বলল, “পলাশের বউ এসেছিল বাড়িতে?ʼʼ
অন্তূ চুপ। জয় বলল, “এসে কী কী বলে গেছে?ʼʼ
-“আপনি তো সব জানেন, আপনার সব ধারণা শতভাগ মিলে যায়। এত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা নিয়েও…আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। অতীত-টতীত ভুলিনি, সেটা আলাদা বিষয়। সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো, আমি জানি, আপনি সব জানেন। আমার এমন কোনো প্রশ্নই নেই, যার উত্তর আপনার কাছে নেই। জিজ্ঞেস করলে বলবেন সেসব?ʼʼ নরম করে বলল অন্তূ।
-“না।ʼʼ
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চলুন, কিছুটা ডিসকাস করা যাক।ʼʼ
জয় কথা না বলে সিগারেট জ্বালিয়ে দিয়াশলাই রেখে বলল, “তুমি স্বার্থপর, ঘরওয়ালি।ʼʼ
-“নিঃসন্দেহে।ʼʼ মাথা দুলিয়ে হাসল অন্তূ।
জয় তাকায়। অন্তূর চোখে একটুও গ্লানি নেই, আত্মগরিমায় পরিপূর্ণ চোখদুটো। যেখানে বারবার জয়ের মরণ হয়। জয় আজকাল গম্ভীর হয়ে পড়েছে, দুষ্টু সত্ত্বার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেসব ভেঙে আজ হেসে ফেলে গান গেয়ে উঠল,
দুই নয়নে তোমায় দেখে
নেশা কাটে না…. দেখার আশা মেটেনা,
হাজার নয়ন দাও না আমায়, লক্ষ নয়ন দাও না…
এক হৃদয়ে…
আর গাইল না, চট করে থেমে গেল। অন্তূ নির্লিপ্ত। জয় কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে মন্ত্রপুতের মতো চোখের ভাব করে বলল, “আমার কাছে যদি একটা মন থাকতো না! পাক্কা তোর ওপর পিছলা খেত, আরমিণ!ʼʼ
অন্তূ নির্বিকার মুখে চোখ ফেরায়, “আল্লাহ বাঁচিয়েছে, ভাগ্যিস নেই।ʼʼ
জয়ের মুচকি হাসির দমক বাড়ল, “ভাগ্যিস নেই।ʼʼ গা দুলিয়ে হাসল অপলক চেয়ে থেকে।
অন্তূ প্রসঙ্গ বদলায়, “আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা। এত কিছুর পরেও কিন্তু মুস্তাকিন মহান এ বাড়িতে এলো না। এত সব তদন্ত সংস্থার মেলা হলো বাড়িতে, পিবিআই ডিপার্টমেন্টের কত কর্মকর্তা এলো-গেল। অথচ সে আসেনি একবারও। বিয়ের পর তাকে একবার দেখিওনি। বিষয়টা ঘাপলা লাগেনা, আপনার?ʼʼ
-“না, লাগেনা।ʼʼ লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটুকু গিলে ফেলল।
অন্তূ অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারল না হতবিহ্বলতায়। জয় জিনে আঁছড় করা লোকের মতো গটগট করে বলল, “তুমি সেদিন মুস্তাকিনের সাথে দেখা করতেই বের হয়েছিলে বাড়ি থেকে। তার বাড়িতে দেখলে, পিবিআই অফিসে দেখলে, কোথাও পেলেনা। এরপর পলাশের ছেলেদের তাড়াও খেয়েছিলে রাস্তায়… এরপর আরও কোথাও গেছিলে, বলছো না… সেটা কোথায়?ʼʼ
অন্তূ হতবুদ্ধি হয়ে গেল, “আপনার ঘাঁড়ে জিন চালান করা আছে?ʼʼ
-“সবটা আন্দাজ।ʼʼ
-“এত নিখুঁত?ʼʼ
জয় হাসল, তো গাল ভর্তি ধোঁয়া বাতাসে মিশলো। হাসি চওড়া করে বলল, “অভিজ্ঞতা বেশি আমার, বারবারই তো বলি। তুমি এই যে ছুটছো, কৌতূহলের পেছনে, একদিন তুমি আমার চেয়েও বেশি ভয়ানক হয়ে উঠবে, ঘরওয়ালি। আমি বুঝি তোমাকে।ʼʼ
-“আমিও বুঝি আপনাকে।ʼʼ
-“আমি জানি। তাই তো দূরত্ব মেটেনা।ʼʼ
-“না মিটুক কখনোই।ʼʼ
জয় অন্তূর দিকে চোখ তুলে অস্পষ্ট হাসে, “না মিটুক।ʼʼ
—
সকাল সকাল জয়ের ফোন বাজছে। অন্তূ রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো। অথচ জয় তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। উপুড় হয়ে ঘুমায় জয়। অন্তূ দু’বার ডাকল, “জয়? জয় আমির! আপনার ফোন বাজছে। গরম খুন্তির সেঁক দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হবে? নাকি মরে-টরে গেলেন?ʼʼ
-“না। জীবিত।ʼʼ চোখ খুলল জয়।
ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে আবার ফিরিয়ে দিলো অন্তূকে, “তোমার ভাবী। কতা কও।ʼʼ
ভ্রু জড়ায় অন্তূ, “নম্বর কোথায় পেলেন?ʼʼ
-“সেদিন তোমায় খুঁজতে গিয়ে নিয়েছিলাম।ʼʼ
মার্জিয়া কথা বলতে পারছিল না। কণ্ঠস্বর দিয়ে রীতিমত ফুপড়ি উঠছে। অন্তূ স্পিকার লাউডে দিয়ে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে, ভাবী?ʼʼ
-“তোমার ভাই…তোমার ভাইয়ের গাড়ি….অন্তূ, কারা জানি তোমার ভাইয়ের গাড়ি পিষে দিয়ে গেছে, অন্তূ।ʼʼ
কেউ একজন কেঁড়ে নিলো ফোন। ভালোভাবে বলল, “অন্তূ! তোর ভাইয়ের নাড়ি-ভুড়ি সব রাস্তায় রাস্তায়। কোম্পানির গাড়ি ছানাবড়া হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে ছাই। অন্তিক খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে, অন্তূ।ʼʼ
জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল। অন্তূ মেঝের ওপর বসে পড়ার আগে হামজার শান্ত, জমাট বরফের মতো শীতল মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। অন্তূর চোখ পরিষ্কার তো! নাহ, ঘোলাটে জলে ভরে উঠেছে। হামজা চোখ পরিস্কার রাখতে বলেছিল।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]