অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৩৯.

0
3

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩৯.

সারারাত বাইরে থেকে সকাল এগারোটায় জয় বাড়ি ফিরল একবার। পরনে কালো পাঞ্জাবী, ডান হাতে ঘড়ি, বাঁ হাতে রূপোর রিস্টলেট ঝুলছে কব্জির ওপর। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। পরিপাটি পরিচ্ছদ। কিন্তু চুলগুলো এলোমেলো, চোখদুটো রক্তলাল। সারারাত নির্ঘুম থাকার ফল। মুখটা গাম্ভীর্য্যে ছেয়ে আছে, যেটা পাঞ্জাবী গায়ে চড়ালে আপনা-আপনি চলে আসে তার চেহারায়। তখন দেখতে পাক্কা রাজনীতিবিদ লাগে।

রিমি খাবার বেড়ে দিলে পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে বসে পড়ল। গপাগপ খেতে শুরু করার কথা এখন। কিন্তু তা করছে না জয়। রিমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “আপনার ভাই কোথায়?ʼʼ

-“কাজে আছে।ʼʼ

রিমি চুপচাপ চলে যাচ্ছিল। জয় ডাকল, “ভাবী?ʼʼ

-“কিছু দরকার?ʼʼ

-“হাত কাটা আমার। খাইয়ে দেন। কাটছে তো কাটছে, শালা ডান হাতটাই! নাকি চামচ দিয়ে চালাব?ʼʼ

ডানহাতের পুরো তালুটা ব্যান্ডেজে জড়ানো। রিমি নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “আর নাটক করবেন না তো। এমনিতেই আপনাকে দেখলে গা জ্বলে আমার, তার ওপর যদি ঢং করেন।ʼʼ

এগিয়ে এসে প্লেটটা ঝারি মেরে কেড়ে নিয়ে খাবার মাখাতে শুরু করে। জয় অল্প হাসল নিঃশব্দে। খাবার মুখে নিয়ে থু থু করে ফেলে দিলো, “সেই বালের মাছই দিছেন? হাজারবার কইছি, মাছ পছন্দ না আমার। মাছ আমি খাই না। আর কিছু নাই? তা দিয়ে ভাত দেন।ʼʼ

রিমি ধমকে উঠল, “এত আহ্লাদ কীসের আপনার? যা দিচ্ছি, তাই দিয়ে খেয়ে উঠুন। আপনার মতো দামড়াকে খাওয়ানো ছাড়াও আরও কাজ থাকে আমার।ʼʼ

-“আর কিছুই রান্না করেন নাই?ʼʼ

তরু আজ আর ডিম ভাজতে গেল না। তার চোখে-মুখে কীসের যেন ক্ষোভ দেখা যায় জয়ের জন্য। এই ঘৃণাটা জয় অন্তূর চোখে দেখেছে। তা দেখে মুচকি হাসল জয়। আরমিণ বাড়িতে পা রাখার পর পরিবেশ বদলেছে, চেনা পরিবেশ অচেনা হয়েছে।

তার কবুতরগুলোকে সময় দেয়া হচ্ছে না আজকাল। ছাদে দানা ছিটিয়ে, পানি দিয়ে খোপগুলো দেখল। নতুন ডিম ফুটলে খুব খুশি লাগে!

জয় জীবনে যতবার এলার্ম সেট করেছে, কিছু না কিছু কাণ্ড ঘটেছে। শেষরাতে এসে ঘুমানোর পর সকাল সকাল এলার্ম বাজলে ফোন তুলে ঝাটাকসে এক আঁছাড়, ফোন ভেঙে ছয় টুকরো। এভাবে কয়েকটা ফোন ভাঙল। একদিন এই দুঃখে সে একটা তরতাজা মোরগ কিনে এনেছিল। সে শুনেছে, মোরগ রোজ ভোরে চেঁচায়, তাতে ঘুম ভাঙে। এভাবে দু-তিনদিন মোরগটা চেঁচালো। কিন্তু সহ্য করা যাচ্ছিল না আর।

একদিন সকাল চারটার দিকে এসে ঘরে এসে শুয়েছিল জয়। মোরগ তার খানিক বাদেই আল্লাহর নামে গলা ফেঁড়ে ডাকাডাকি শুরু করল। একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে গিয়ে মোরগটাকে জবাই করে নিচে এসে রিমির হাতে মোরগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আজ মোরগের ঝোল খাবো দুপুরে। ভালো করে কষিয়ে রান্না করবেন।ʼʼ

কিন্তু কবুতর ভোরে চেঁচায় না। সে নিত্য নতুন জাতের কবুতর এনে ছাদ ভরে ফেলেছে।

অন্তূ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। জয় ঘরে আসতে আসতে ডাকল, “ময়নার মা, ঘরে আছো? ও ময়নার মা?ʼʼ

অন্তূ নাক কুঁচকায়, হোয়াট ইজ ময়নার মা? জয় ঢুকল, আর অন্তূ তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। জয় বিছানার চাদর ফেলে তোষক টেনে তুলে কাঠের ক্লেটগুলো উঠিয়ে ফেলল। টাকা অথবা অস্ত্র থাকার কথা। নেই। এক ঝটকায় মাথায় রক্ত উঠে গেল। কপালে আঙুল চেপে ধরে ডাকল, “আরমিণ! আরমিণ….ʼʼ

রিমি বসার ঘরের সিলিং ফ্যান পরিস্কার করাচ্ছে এক ছোট ছেলেকে দিয়ে। অন্তূ ঘরে ঢুকল, “জি!ʼʼ

-“টাকা কোথায়?ʼʼ

-“টাকা? ওগুলো টাকা ছিল না। কাগজ ছিল, টাকার মতো দেখতে। মূর্খ নাকি আপনি? জাল টাকা কি টাকা?ʼʼ

জয় দাঁত কিড়মিড় করল, “ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না। টাকাগুলো কোথায়?ʼʼ

-“পুড়িয়ে দিয়েছি।ʼʼ

-“পুড়িয়ে দিয়েছিস?ʼʼ

-“হ্যাঁ, পুড়িয়ে দিয়েছি।ʼʼ

জয় থাবা দিয়ে ধরল অন্তূকে। গায়ের ওড়না টান দিয়ে খুলে অন্তূর গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস টেনে বলল, “খানকির মেয়ে, আরেকবার বল, ‘টাকা পুড়িয়ে দিয়েছিস।ʼʼ

অন্তূ জয়ের পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে দক্ষিণ দিকের জানালার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “এবার আর বলব না, চল দেখাই তোকে। তোদের কালো বাজারীর মাল আমি পুড়িয়ে দিয়েছি। যা দেশের-দশের ক্ষতি করে, তা বিছানার নিচে রেখে আমি চোখ বুজে ঘুমাতে পারি না।ʼʼ

ওড়নার ফাঁস শক্ত করে জয়। অন্তূও ঠিক একইভাবে জয়ের বুকের ত্বক খামচে ধরে চিবিয়ে বলল, “আমি ব্যথা পাচ্ছি, ওড়নার প্যাঁচ শিথিল করুন।ʼʼ

-“তোর এত সাহস ক্যান মাগীর বাচ্চা, হ্যাঁ? ভয় লাগে না তোর আমাকে?ʼʼ

-“আপনাকে ভয়? কোনো তো কারণ থাকা চাই কাউকে ভয় পাবার? আপনার মতো কাপুরুষকে ভয় পেয়ে আমি আমার নারীসত্ত্বাকে কলঙ্কিত করতে দুনিয়াতে জন্মাইনি, জয় আমির।ʼʼ

জয় এতই জোরে ফাঁস আঁটকে ধরল, অন্তূর চোখ উল্টে আসার উপক্রম হলো। অথচ অন্তূ দমল না। জয় নিজেই হার মেনে হাত শিথিল করে গাল চিপে ধরল, “মনডা চাইতেছে ঠ্যাঙ বরাবর টান মেরে ছিঁড়ে দুইভাগ করে ফেলি। তোর সাথে কী করা উচিত, বুঝেই উঠতে পারতেছি না আমি। হয়রান লাগে খুব।ʼʼ

অন্তূ বলল, আমি ব্যথা পাচ্ছি। ছেড়ে দিন আমাকে। আমি আবলা নারী না। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করার মতো ক্যাপাসিটি আপাতত অন্তত নেই আমার মাঝে।ʼʼ

-“তুই টাকা পোড়াইছিস ক্যান, শুয়োরের বাচ্চা? সত্যি কথা বল, কোথায় রাখছিস টাকা। বাইরে লোক দাঁড়ায়ে আছে কিন্তু। এইখানেই জ’বা”ই করে মেঝেতে দা”ফ’ন করে রেখে যাব একদম।ʼʼ

অন্তূ নরম হলো, “কোথায় যাবেন ওই টাকা নিয়ে?ʼʼ

জয় তাতে একটু বিভ্রান্ত হলো, “কোথায় টাকা?ʼʼ

-“জালটাকা দিয়ে কী করেন আপনারা? আপনারা না দেশপ্রেমিক?ʼʼ

জয় আবার নিয়ন্ত্রণ হারাল। কিন্তু অন্তূকে ধরার আগেই অন্তূ জয়কে ধাক্কা মেরে জানালার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “দেখতে পাচ্ছেন? কালো ছাইয়ের স্তূপ, দিয়াশলাইয়ের বাক্স, আপনার আধখাওয়া মদের বোতল! পুড়িয়ে দিয়েছি। কাল যখন ইনশাআল্লাহ আইনজীবী হবো, নিজের ভেতরটা যখন আমার কাছে কৈফিয়র চাইবে–আমি একসময় আমার সামনে দিয়ে আমার দেশের নিরীহ জনতাদের অধিকার নষ্ট হতে দেখেছি, দেশের ক্ষতি হতে দেখেছি, কিন্তু কিছুই করিনি, নিজের কাছে বড় ছোট হয়ে যাব। এই গ্লানিটুকু যাতে না বইতে হয়, ব্যাস পুড়িয়ে দিলাম।ʼʼ

জয় ওড়না ছেড়ে দিয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল, “এ চেংরী, তুই কি পাগল রে! পাগলামী শুরু করছিস? শালা আমিই তো ভু/দা/ই হয়ে গেছি রে। তুই আজ কয়দিন করছিসটা কী? সিরিয়াসলি, এত ধৈর্য্যশীল না আমি। ওই…ওই তুই…. বাপ, তুই কী মনে করিস, আমায়?ʼʼ

জয় মাথার চুল টেনে ধরে বিছানায় বসে পড়ল। বিশ্বাস করা শক্ত, একটা মেয়ে ওর সাথে কী কী করে যাচ্ছে! ওকে হার মানতে হচ্ছে মেয়েটার জেদ আর সাহসের কাছে। পলাশকে কী বলবে? এর মধ্যে মাজহারদের ভাগ ছিল। নতুন শত্রুতা তৈরি হবে ফের। ওদেরকে বোমা মেরেও বিশ্বাস করানো যাবে না যে, কোনো মেয়েলোক জয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে এতদূর পৌঁছাতে পারে।

-“আর অস্ত্র! সেইসবের কী করছিস, চুদির বোইন? তোরে আমি…ʼʼ

অন্তূ শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী করবেন অস্ত্র দিয়ে?ʼʼ

অথচ জয় এক মুহুর্তের মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা ঠেকালো অন্তূর থুতনির নিচে, “একদম পুঁতে ফেলব ওইগুলার কিছু হইলে! দাম তোরে বিক্রি করে মেটাবো, শালি! আমি বের হব। তাড়াতাড়ি ক অস্ত্র কই, খা-ন-কি-র বাচ্চা!ʼʼ

-“আমার আম্মু সেরকম না। নিজের পরিচয় আমার ওপরে চাপানোর চেষ্টা করবেন না।ʼʼ

জয়ের নিজেকে পাগল পাগল লাগল এক মুহুর্ত। বন্দুকের নলকে কণ্ঠনালির ওপর রেখে অন্তূ যা করছে, তা জয়কে হতবিহ্বল করে তুলল।

কিন্তু পরিস্থিতি স্মরণে আসতেই জয় নিয়ন্ত্রণ হারালো, অধৈর্য্য পশুর মতো অন্তূকে ছেঁচড়ে নিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি মারল অন্তূর পিঠটা। দুম করে আওয়াজ হলো একটা। অন্তূ কোনোভাবেই তাগড়া জয়ের শরীরের শক্তির সাথে পেরে উঠল না, ঠিক যেমন সেদিন রাতে পারেনি নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে। মেরুদণ্ডের হাড় মচমচ করে উঠল।

তবু বলল না, অস্ত্র কোথায়। ব্যথাগুলো আর অনুভূত হচ্ছে না। আব্বুর মুখটা খুব মনে পড়ছে। আব্বু অন্তূকে সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিখিয়ে শেষ অবধি মরণ দিয়ে গেছে নিজ হাতে।

জয়ের কল বাজল। জয় অন্তূকে চেপে ধরে রেখে অন্য হাতে ইন-কামিং কল রিসিভ করে বলল, “আসতেছি। দাঁড়ান নিচে। আর যেন কল না আসে আমার কাছে।ʼʼ

ফোন বিছানায় ছুঁড়ে মেরে অন্তূকে বলল, “ওই এইদিক তাকা। আমায় ভো–দা–ই মনে হয় তোর, হ্যাঁ? ভয় লাগে না একটুও? তোর কি মনে হয়, আমি দূর্বল তোর ওপর? ছাড় দেই বেশি, এইজন্য?ʼʼ

-“কোনটাকে ছাড় দেয়া বলছেন? আমি শুনতে চাই।ʼʼ

-“এত কথা বলিস কেন তুই?ʼʼ

-“কথা আমি কম বলি। কিন্তু বলি তিক্ত কথা। যা শুনতে ভালো লাগে না। তা এমনিতেই বেশি মনে হয়।ʼʼ

-“আরমিণ! তোর লইয়্যার-স্পিচ আমাকে শোনাবি না। কসম জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে আনবো। নিচে গাড়ি দাঁড়ায়ে আছে, রাজধানীতে যাওয়া লাগবে রাতের মধ্যে। টাকার জন্য আপাতত কিছু বলতেছি না। অস্ত্র লাগবে, এক্ষুনি লাগবে। বুঝতেছিস তুই?ʼʼ

-“কেন লাগবে অস্ত্র?ʼʼ

-“তাতে তোর যায়-আসা যাবে না। তোরে আইনজীবী হিসেবে ঘরে আনি নাই।

-“তা ঠিক। কিন্তু আমার ভেতরে তো সেরকমই কিছুর বসবাস। চোখ ও হাত অক্ষত থাকতে স’ন্ত্রা’সীদের হাতে মরণ-খেলনা তুলে দিতে পারি না।ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ অন্তূর চোখের দিকে চেয়ে থেকে চট করে হেসে ফেলল, “তাইলে চোখ আর হাত দুইটা আলাদা করে দেই তোমার সুন্দর দেহ থেকে?ʼʼ

-“করতে পারেন। আমারও দায়ভার কমে যেত!ʼʼ

-“ঘেন্নাই যখন করিস তখন আমার জিনিসে হাত লাগাস ক্যান? তোরে বলছি না, আমার কাজ থেকে দূরে থাকবি? তুই চাস না, তোর কাছে আসি না, দূরে থাকি। তোরে খাওয়া, পড়া, কীসের অভাবে রাখছি? আমি যাই করে বেড়াই তাতে তোর কী?ʼʼ

অন্তূ কিচ্ছু বলল না। পিঠটা অসহ্য ব্যথায় ভেঙে আসছে। খানিক বাদে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিল জয়। সামনের মানুষটার চোখে ভয় বা উদ্বেগ না দেখলে অত্যাচারের শক্তিটা ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। তার জেদের সামনে কখনও কেউ দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু অন্তূর একগুঁয়েমি আর চোখের তেজে কোনো দূর্বলতা খুঁজে পায় না জয়।

জয় ফ্যান চালিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে পিস্তল রেখে ধপ করে বসে বিছানায়। পাঞ্জাবীর বোতামগুলো আলগা করল। কপালের কিনারা বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে। চুলগুলো চপচপ করছে ঘামে ভিজে। ড্রয়ার খুলে রিমোট বের করে এয়ারকন্ডিশনার অন করে দিলো। দরজা- জানালা সব খোলা।

অন্তূ আস্তে কোরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। হাত, গাল, পিঠ বলছে, ‘অন্তূ একটু কেঁদে নে।ʼ অন্তূ তাদেরকে বলল, ‘আমার কেউ নেই রে। একা একা কাঁদতে নেই, কান্না দেখার লোক না থাকলে। আমার কান্না শুনে ব্যথিত হবার কেউ নেই আমার কাছে। কিন্তু তা দেখে আমার দূর্বল বুঝে হেসে ওঠার লোক অনেক।ʼʼ

-“অস্ত্রগুলো কোথায় রেখেছিস, আরমিণ?ʼʼ

-“না দিলে কি মেরে ফেলবেন?ʼʼ অন্তূর গলার স্বর বসে গেছে।

জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল জয়, “বুঝতে পারছি না।ʼʼ আঙুল দিয়ে কপাল চিপে ঘাম ফেলল।

-“ভেবে বলুন, না দিলে কী করবেন?ʼʼ

-“এসিড মেরে জ্বালিয়ে দেব, তোকে।ʼʼ

ক্লান্ত স্বরে বলল অন্তূ, “তাই করুন তাহলে। আমারও বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না। খুব বিরক্ত হয়ে গেছি। ধুর, এটা কোনো জীবন হলো?ʼʼ

-“তবুও বলবি না, ওগুলো কোথায়?ʼʼ

-“নিজের মুখে অন্তত না। মুখ আমার কাছে কৈফিয়র চাইবে।ʼʼ

জয় শব্দ করে শ্বাস ফেলল, “তোমার দুঃসাহসের পরিণাম তোমার পরিবারের ওপর গড়াতে খুব কষ্ট হবে আমার, ঘরওয়ালি।ʼʼ

অন্তূর ভেতরটা আঁৎকে উঠল। তা চেপে হাসল সামান্য, “লাভ কী হবে তাতে, এই বিরোধিতার সীমা বাড়া ছাড়া? আব্বু বলতো, বাঁকা লোহাতে বেশি জোরে আঘাত করলে তা সোজা হবার বদলে উল্টো দিকে বেঁকে যায়। সেটাতে আপনি যো জোরে আঘাত করবেন, তা সোজা হবার মাত্রা ছাড়িয়ে তত বিপরীতে বাঁক নেবে।ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল অন্তূর মুখের দিকে। অন্তূ নিজের বাঁ হাতের তালুর দিকে চেয়ে আছে। জয় জিজ্ঞেস করল, “কেমন মৃত্যু চাও, তুমি?ʼʼ

অন্তূ যেন সম্বিত পেল, “হু?ʼʼ মুচকি হাসল, “আপনার খুশিমতো, যা দেবেন, সব মঞ্জুর!ʼʼ

জয় চোখ বুঁজে শক্ত ঢোক গিলল, “অস্ত্রগুলো কোথায় রেখেছ?ʼʼ

অন্তূ সেই একই প্রশ্ন করে, “কী করবেন আপনারা অস্ত্র দিয়ে?ʼʼ

জয় হার মানল, “রাজধানীতে সম্মেলন আছে। লাগবে ওগুলো। বের করে দাও।ʼʼ

অন্তূ ক্ষণকাল চুপ থেকে বলল, “রাজনীতি কাকে বলে?ʼʼ

-“বুঝি না, আমি। অস্ত্রগুলো বের করে দাও।ʼʼ

-“বিরোধী দলের করোটি উড়াতে খুব দরকার, তাই তো? বুঝি আমি। রাজনীতির জন্মলগ্নে তাদ মূলনীতি ছিল, জনসেবা। সেসব এখন পুরোনো হয়েছে। এখনকার মূলনীতি হলো, গদিতে বসা। আর গদিতে বসতে হবে বিরোধী দলের আগের করা শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে। কে কী করেছিল, কে বিরুদ্ধে কথা বলছে, কে প্রতিবাদ করছে.. এটা গণতন্ত্র! কিন্তু পাঁচবছর ফুরোলেই গদি ছেড়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দিতে হবে, এমন কোনো সংবিধানও নেই। এই পাঁচ বছরে যা করা হলো গদিতে থেকে, গদি থেকে নামলে বাঁচার উপায় আর থাকে না। সুতরাং পরেরবারের নির্বাচনে যে করেই হোক গদিতে থাকতে হবে, অন্তত বেঁচে থাকার জন্য। নয়ত বোরকা, শাড়ি, গাউন পরে বিদেশ পালাতে হবে।ʼʼ

জয় চুপ করে বসে ছিল। সে বেশ মনোযোগী শ্রোতা। কাজুবাদামের পাত্রটা তুলে নিলো। কয়েকটা চিবোতে চিবোতে বলল, কেউ একজন বলেছিলেন, রাজনীতি নিয়ে কোনোকিছুর ব্যাখ্যা করছেন তো আপনি হেরে যাচ্ছেন। রাজনীতি অব্যাখ্যাত। শের-ই-বাংলা বলেছিলেন, লাঙল যার, জমি তার। লাঙল ছাড়া যাবে না।ʼʼ

অন্তূ হাসল, অথচ আপনারা জমির মালিক নন। লাঙলচাষী কেবল। যারা অন্ধ। হাতরে হাতরে চিরকাল রোদে পুড়ে, কাদায় নেমে গতর খাটিয়ে লাঙল চষে যাবেন, কিন্তু ভাই, জমির মালিক মহাজন।

শিক্ষিত আপনি। এটুকু বুঝতেই চলতো, আপনারা হাতিয়ার। দিনশেষে একটা রাষ্ট্র, একটা সমাজ, একটা পরিবার, একটা ব্যক্তি, একটা জীবন ও একটা পরকাল নষ্ট। অথচ কোনো এক মহাজন গদিতে বসে তার দক্ষ হাতে একসঙ্গে এতকিছু ধ্বংস করে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে।

আপনারা ওই দলকে মারতে যাবেন, ওরা আপনাদের মারতে আসবে। এতে প্রধানদের দলীয় বিরোধ বজায় থাকবে। মাঝের ক্ষতি আপনার, বিরোধী কর্মীর, জনগণের। হাসিল মহাজনের।

জয় একবারও দৃষ্টি ফেরায়নি, যতক্ষণ অন্তূ কথা বলেছে। মনোযোগ দিয়ে শুনল কথাগুলো। অন্তূ থামলে বলল, “এমনও হতে পারে, আগে আমার ওপর হামলা হয়েছে, তার পর আমি শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাতে যাচ্ছি!ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল, “এমনও হতে পারে, তার আগে আপনি হামলা করেছিলে, এরপর তারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এখন আপনি, এরপর আবার তারা, এরপর আপনি….চমৎকার চক্র না? আমার তো বেশ লাগছে। এটাই এতক্ষণ বুঝিয়েছি, আপনি বোঝেননি। যেই দলই নির্বাচন জিততে চাউক না কেন, উদ্দেশ্য তো সেই একাটাই— ক্ষমতা প্রাপ্তি, আর সেই ক্ষমতায় বিরোধীদের কাছ থেকে আগের করে রাখা আক্রমণের প্রতিশোধ তোলা।ʼʼ

-“আমার বিষয়টা আলাদাও হতে পারে।ʼʼ

-“আপনি নিজেকে ডিফেন্স করার চেষ্টা করছেন, জয় আমির! যেটা আপনার সাথে একদম মানায় না।ʼʼ

জয় হাসল, “এত সততা দিয়ে কী করলে জীবনে?ʼʼ

-“আপনার অনুশোচনা হয় না?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “অনুশোচনা হলে পাপীরা বাঁচে না আর, ঘরওয়ালি। হয় বুক পেতে দেয়, নয়ত আত্মহত্যা করে। আমার কিছুদিন বেঁচে থাকা দরকার।ʼʼ

-“সেই লোভও বিশেষ একটা নেই আপনার! তা জানি আমি। শুধুই নিজেকে ক্ষয় করতে ছুটে চলেছেন। ফিরে আসার পথ নেই?ʼʼ

-“ইচ্ছেও নেই। অভ্যাস হয়ে গেছে।ʼʼ

অন্তূর পিঠে অসহ্য ব্যথা অনুভব হচ্ছিল। পাঁজরের হাড়ে টাস ধরে আসছিল। জয় কিছুক্ষণ অন্তূর দিকে চেয়ে থাকল ভ্রু কুঁচকে। কী আন্দাজ চট করে উঠে গিয়ে আলমারী খুলল! আলমারীর ড্রয়ারের নিচে ফাঁকা চেম্বারগুলোতে অস্ত্রগুলো গাদা করে রাখা। এত সামনে অস্ত্রগুলো রেখেছে অন্তূ, পাল্লা খুললেই দেখা যাবে। অল্প-সল্প বিরক্ত হলো জয় নিজের ওপর। তার আচরণ তার কাছে অসহ্য ঠেকছে।

অস্ত্রগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে এনে অন্তূর সামনে দাঁড়ায় জয়, “প্রথমে বললেই হতো, আলমারীতে আছে।ʼʼ

অন্তূ তাকিয়েও দেখল না জয়কে। জয় আস্তে করে বলল, “আমি না থাকলে তোমাকে বাঁচানোর কেউ থাকবে না।ʼʼ

অন্তূ পিঠ চেপে ধরে দাঁড়াল জয়ের সামনে, “ওষুধ খেয়ে রোগ সারানোর চেয়ে, রোগ না হওয়াটাই কি বেশি ভালো না? একই পদার্থে রোগ তৈরি ও সারানোর উপাদান থাকলে তা ক্ষতিকর হিসেবেই গণ্য হবে।ʼʼ

জয় খুব কাছে এগিয়ে এলো অন্তূর। নরম হাতে থুতনি ছুঁয়ে দিলো অন্তূর, যেখানে পিস্তলের মুজেল ঠেসেছিল। অন্তূ চোখ বুঁজে নাক কুঁচকে ফেলে মুখ সরাতে চায়, যেন কোনো বর্জ্য-নোংরা তার চোয়াল ছুঁয়েছে।

জয় ধরে ফেলল, ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, “বাই এনি চান্স, আর ফিরে নাও আসতে পারি। আদারওয়াইজ, ফিরতে দু’দিন দেরি হবে। চোখের ঘৃণাটুকু বাঁচিয়ে রেখো। খরচা যেন না হয়। এই ঘৃণা যেন কখনও অন্যকারও জন্য না আসে তোমার চোখে। এর ওপর শুধু আমার হক আছে।ʼʼ

অন্তূ নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল।

-“একটা চুমু খাই?ʼʼ জয় অন্তূকে বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, “নাʼ বলবে না। তুমি চাও না বুঝে আমি কিন্তু কাছে আসি না। আজ যখন মুখে চেয়েছি, ‘নাʼ শুনতে ভালো লাগবে না। ‘নাʼ বললে যদি জোর করি, চুমুতে ফিল আসবে না।ʼʼ

অন্তূ নির্বিকার। জয় টের পায় অন্তূর দুইচোখের স্পষ্ট আক্রোশ। নিশ্চিত আঘাত করবে। গম্ভীর মুখে ঝারা মেরে ছেড়ে দেয় অন্তূকে। পাঞ্জাবী খুলে শার্ট পরে বিছানার ওপর থেকে পিস্তল তুলে হোলস্টারে গুঁজে নেয়। অস্ত্রের ব্যাগ হাতে তুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, “আসি, খেয়াল রেখো নিজের। বদদোয়া করতে ভুলে গেলে কিন্তু ফিরে এসে থাপড়াবো ধরে। প্রতিবেলা বদদোয়া চাই।ʼʼ

অন্তূ পিঠ চেপে ধরে ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে। ওভাবেই কতক্ষণ পড়ে ছিল পিঠের ব্যথায় অচেতনের মতো। আব্বু এসে বসেছে পাশে। অন্তূর আর কষ্ট হচ্ছে না। এবার কান্না পাচ্ছে। কান্না শোনার মানুষ এসেছে। অন্তূর ব্যথাগুলো অবশ হয়ে আসছে।


শাহানার জরায়ুতে টিউমার। সেটার অপারেশন হামজা ঢাকায় করাতে চায়। ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ চলছে। অন্তূ অসুখটা জানতে পেরেছে ক’দিন হলো।

তুলিকে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো। তরু সাথে গেছে। কবীর পুরুষের দায়িত্ব পালন করছে। শাহানা এবং হুমায়ুন সাহেব দুপুরের দিকে বেরিয়ে গেলেন তুলির কাছে। বাড়িতে তখন রিমি আর অন্তূ। রিমির সাথে বসে কথা বলতে খারাপ লাগে না অন্তূর। অনেক কথা বলা যায়। রিমি অবাক হয়ে শোনে, কখনও স্তব্ধ হয়ে যায়। কখনও দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দেয়। অন্তূর কথা শুনতে তার ভালো লাগে। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে।

ঘড়িতে তখন তিনটা বেজে আঠারো মিনিট। দোতলার সদর দরজায় করাঘাত পড়ল। কলিং বেল থাকা সত্ত্বেও কেউ হাত দ্বারা দরজায় আঘাত করছে। দরজা খুলল অন্তূ। বুকের ভেতরটা এক মুহুর্ত ঢিপঢিপ করে উঠল। বিস্ময়কর দৃশ্য! সে কতদিন খুঁজেছে চাঁদনীকে। আজ চাঁদনী তার দুয়ারে।

কিন্তু অদ্ভুত রূপে। অন্তূ মেলাতে পারল না বিষয়টা। চাঁদনী দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে দুজন মহিলা।

চলবে…

[টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here