অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৪০.

0
3

[সতর্কতা: পুরো পর্বটি প্রাপ্ত মনষ্কদের জন্য।]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪০.

বিকেলের নরম রোদ দোতলার সিঁড়িঘরের জানালা পেরিয়ে চাঁদনীর মুখে পড়ছিল। কী যে মোহিণী লাগছিল দেখতে। অন্তূর কপালটা সন্তর্পণে কুঁচকে যায়। পা থেকে মাথা অবধি স্থির নজর ঘুরিয়ে দেখে বিস্ময়ে। ভ্রমের মতো লাগছিল।

আকাশী রঙা জামদানী শাড়ির পাড়টা সোনালী। দু-হাতে সোনালী রুলি বালা চাঁদনীর। বিশাল একটা খোঁপা করেছে ঘাঁড়ের ওপর। খোঁপাতে স্বর্ণালী মোড়ক। অন্তূ আন্দাজ করতে চায়, এটা ঠিক কতটা অভিজাত্যের পরিচয়! পরিমেয়, দুর্বোধ হাসি চাঁদনীর ঠোঁটে। ঊনিশ শতকের কোনো উচ্চ জমিদার বংশের ঠাকুরাইন/গিন্নি দাঁড়িয়ে আছে যেন তার সম্মুখে। দুটো দাসী সাথে। চাঁদনীর এই রূপ অন্তূর ভেতরে হাজারও সংশয় তৈরী করে। শাড়ির বিশাল আঁচলটা পিঠ পেঁচিয়ে এনে বাঁ হাতের তালুতে ধরেছে।

অন্তূর সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক নজর এড়িয়ে চাঁদনী অদ্ভুতভাবে মুচকি হাসে, “তুমি কিন্তু এখনও আমায় ভেতরে আসতে বলোনি।ʼʼ রহস্যে ভিজে উঠছিল চাঁদনীর মুখখানা।

অন্তূ নজর নামায়, “আসুন।ʼʼ

চলনের ভঙ্গিমাই অন্যরকম চাঁদনীর। সেদিনের মতো স্লান নয় মুখশ্রী, হালকা প্রসাধনী আর অভিজাত্যে মেতে আছে চেহারাটা। রিমি চিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকে। চাঁদনী সোফার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কিন্তু বসতেও বলোনি, অন্তূ!ʼʼ চাঁদনীর চোখে-মুখে রহস্যের ঘনঘটা।

সোফায় বসে এদিক-ওদিক তাকাল চাঁদনী, “সকলে বাড়ি ফিরবে কবে?ʼʼ যেন সে সব জানে।

রিমি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে। সে চিনতে পারছে না মেয়েটিকে। এত ঐশ্বর্যপূর্ণ রূপ, নারীটি কে? আরমিণ পরিচিত বলেই মনে হচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণের পর্যবেক্ষণ ও নীরবতা কাটিয়ে অন্তূ স্থির গলায় প্রশ্ন করল, “কে আপনি?ʼʼ

হেসে ফেলল চাঁদনী, “তুমি চেনো আমায়।ʼʼ

-“ছদ্মবেশ! কিন্তু কোনটা ছদ্মবেশ? এটা অথবা ওটা?ʼʼ

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে চাঁদনী মসৃণ হাসে, “তোমার কাছে কোনটাকে আসল আর কোনটা ছদ্মবেশ মনে হচ্ছে?ʼʼ

-“ধারণা নেই। কে আপনি?ʼʼ অন্তূর তির্যক নজর পলকহীন চেয়ে থাকে চাঁদনীর হাস্যবদনে।

-“নাশতার ব্যবস্থাও কিন্তু করোনি তুমি।ʼʼ

রিমির দিকে তাকাল অন্তূ, “নাশতা চলে আসবে।ʼʼ অন্তূর রাশভারী, গম্ভীর অভিব্যক্তি। নজর বুলায় চাঁদনীর ভূষনে, মুখে দৃষ্টি স্থির করে প্রশ্ন করে, “…..আপনি কে?ʼʼ

সুস্থির নজরে তাকায় চাঁদনী। খানিকক্ষণ চেয়েই থাকে অন্তূর দিকে। পরে বিন্যস্ত শব্দে উচ্চারণ করে, “রাজন আজগরের মেয়ে, রূপকথা আজগর আমি।ʼʼ

রিমি অবাক হলো। রাজন আজগরের মেয়ে এটা? এখানে কী করছে? আরমিণই বা চিনলো কী করে? অন্তূর নাকের পাটা ফুলে ওঠে, ভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়ে আলগোছে, “অর্থাৎ আপনি পলাশ আজগরের চাচাতো বোন?ʼʼ

-“বউ। পলাশ আজগরের বিয়ে করা বউ।ʼʼ স্থির কণ্ঠে বলে চাঁদনী। মুখে স্মিত হাসি।

অন্তূর বুকের স্পন্দন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে একটু। এক মুহুর্ত দম আঁটকে চেয়ে থাকে। রিমি ওদের কথোপকথনের অধিকাংশই বুঝতে পারছিল না। অথচ কিছু একটা আগ্রহ পাচ্ছিল। সে উঠল না নাশতার ব্যবস্থা করতে। বসে থাকল।

চাঁদনী অন্তূর নজর তাক করেই চেয়ে আছে। তার গোলাপী ঠোঁটে জুড়ে মৃদুমন্দ হাসি। হাসি বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “ঘেন্না লাগছে আমায়?ʼʼ

-“না। এখনও লাগছে না। যেহেতু পুরোটা জানিনি।ʼʼ

অন্তূর চিন্তাধারায় ধন্য হবার মতো হাসল রূপকথা, “সেদিন আমার সাথে কথা বলে তোমার আমার ওপর অনেক রকমের সন্দেহ কাজ করেছিল, ঠিক বলেছি?ʼʼ

অন্তূ নির্বিকার জবাব দেয়, “ঠিক বলেছেন।ʼʼ

-“চাঁদনীর চেহারার ঝলক দেখে সে যে ওই বাড়ির বউ, এতে সন্দেহ হয়েছিল, ঠিক বলেছি?ʼʼ

-“ঠিক বলেছেন।ʼʼ

-“চাঁদনীকে এসএসসি পাশ একটা সাধারণ মেয়ে মনে হয়নি। ঠিক বলেছি?ʼʼ

-“ঠিক বলেছেন।ʼʼ

“চাঁদনীর কথাবার্তা ওর অবস্থানের সাথে না মেলায় খুব সংশয় জেগেছিল ভেতরে। ঠিক বলেছি?ʼʼ

-“ঠিক বলেছেন।ʼʼ মুখস্ত পড়ার মতো কথা বলছিল অন্তূ।

রূপকথা হাসল, “তবে আমার কিন্তু সেই এক দেখায় তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল, সন্দেহ-টন্দেহ কিছু হয়নি। জানো?ʼʼ

-“না, আজ জানলাম।ʼʼ একরোখা তবে শান্ত কণ্ঠে বলল অন্তূ, “তাহলে সালমা খালা কি পলাশের মা?

রূপকথার হাসি বাড়ল, “বোকা অন্তূ! এজন্য বলা হয়, মানুষের বয়স যত বেশি হয়, যে যতদিন বেশি বাঁচে, তার অভিজ্ঞতা তত বেশি। কারণ মানুষ মরণের এক মুহুর্ত খানিক আগেও অসম্ভব এক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। তুমি যা জানবে, সেটাকে কখনোই চূড়ান্ত ভাবা উচিত নয়। তুমি যতক্ষণ বেঁচে আছো, প্রস্তুত থাকবে সম্পূর্ণ নতুন সব অভিজ্ঞতার জন্য, যার কোনো ধারণাও ছিল না আগে তোমার। পৃথিবী বৈচিত্র্যময়।ʼʼ

অন্তূ কথা বলল না। রূপকথা এবার শব্দ করে হাসল, “সালমা খালা যদি পলাশের মা হয়, আঁখি পলাশের বোন, সোহান পলাশের ভাই, তাহলে সোহেল কে?ʼʼ

অন্তূর ভেতরে অস্বস্তি প্রকট হয়ে উঠলেও চোখদুটো নির্লিপ্ত হয়ে চেয়ে রইল, “কে?ʼʼ

-“পলাশের চাকর। যাকে সে ওই বাড়িতেই খুন করেছে। সোহেলের বউকে দরকার পড়ল একসময় পলাশের। ছেলেটা রাজি ছিল না। সে আসলে জানতো না, খিদে পেলে বাঘ নিজের পাছার চামড়া কেটে খায়, আর পলাশ তো নোংরা কুকুর। নিজের লোকের বউকে ছাড়ার মতো নাকি সে? বেচারা মরল, বউটাও গেল।ʼʼ রূপকথা যেন খুব প্রফুল্ল এসব বলে।

-“আর..ʼʼ

-“আঁখি?…. হ্যাঁ, মেয়েটার ওপর বেশ মায়া জন্মে গেছিল আমার। যদিও মৃত্যুর আগে আমি ওকে দেখিনি।ʼʼ

অন্তূর ঘাঁড়ে মোচড় মেরে উঠছিল অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায়। গাঢ় স্বরে বলল, “সোহান?ʼʼ

-“এ গল্পে সোহান বলতে কারও অস্তিত্ব নেই, শুধুই বিভ্রান্তিকর একটা নামমাত্র, গল্প তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।ʼʼ ধীরে ধীরে রূপকথার হাসি কমে আসছিল, “সোহানের ব্যপারে তুমি কী জানো?ʼʼ

-“চাঁদনীর দেবর। জয় ওকে রাজনৈতিক দ্বন্দে খুব অত্যাচার করেছিল। সেইসব আঘাত ক্যান্সারে পরিণত হয়। ওর চিকিৎসার জন্য সামলা খালা জমি বন্ধক রেখেছিল। কোনো হিন্দুর কাছে সম্ভবত। …. এটাও বানোয়াট গল্প, তাই তো?ʼʼ

রূপকথা চুপ রইল ক্ষণকাল, এরপর বলল, “আঁখির নাম আঁখি না। একটা সুন্দর আছে ওই সুন্দর মেয়েটার, মনে নেই আমার। ওর ভাই সোহান না হলেও ভাইও ছিল একটা। যার কাহিনি সোহানের কাহিনির মতোই, তবে সত্যি।ʼʼ

অন্তূ মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত বোধ করছিল। পিঠে ব্যথায় সোজা হয়ে বসা দায়, তার ওপর চাপা বিস্ময়ে শিরদাড়া টনটন করছিল। কিছুক্ষণ মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে থেকে বলল, “সালমা কে?ʼʼ

-“রূপকথা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়, তুমি কখনও পতিতালয়ে যাওনি, না? ঘুরে দেখতেও যাওনি!ʼʼ

-“যাইনি।ʼʼ

-“ওখানে একটা সর্দারণী থাকে। যে মেয়েদের বেচা-কেনা করে, কাস্টমার ধরে, মহল্লার সব মেয়ের দেখভাল করে, লেনদেন করে, মেয়ে যোগাড় করে..এইসব। সালমা আমার বাবার দাসী। বাবার রেড লাইট আবাসিক হোটেলের সর্দারণী সে।ʼʼ

অন্তূ চোখ বুজে গায় শ্বাস ফেলল, “সে আয়া ছিল আমাদের ভার্সিটির।ʼʼ

-“সরি টু সে। কোনো ধরণই সবার ওপর খাটেনা। ক্ষেত্রবিশেষ যেকোনো সূত্র নির্দিষ্ট কিছু তত্ত্বের জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়। ঠিক তেমনই ভার্সিটির সব মেয়েই যেমন তোমার মতোন না, আবার সব মেয়ে ওইসব বেশ্যাদের মতোও না। সালমা খালার কাছে হলে থাকা মেয়েদের একটা জোট ছিল। যারা সেচ্ছায়, কোনো বিনিময় ছাড়াই দেহ বিলাতে আগ্রহী। যুবতী বয়স যাকে বলে আর কী! তাদের শরীরে জ্বলন কিছু কিছু পুরুষের চেয়েও বেশি। খারাপ লাগছে আমার কথা শুনতে?ʼʼ

অন্তূ চোখ বুজেই বলল, “না।…..এজন্য সে আয়ার কাজ করতো ভার্সিটিতে?ʼʼ

-“বাবার দাসী। বোঝোনি কথাটা? যেভাবে কাজে লাগাবে, লাগতে হবে তাকে। বাবার কাছে আসার আগে নব্বই দশকের যাত্রাপালার নাচনেওয়ালী ছিল। ওখান থেকে বাবা তুলে এনেছিল।ʼʼ

অন্তূ কেমন করে যেন চেয়ে রইল। রূপকথা কিছু একটা বুঝে স্লান হাসল, “আমাদের অভিনয় নিয়ে ভাবছো? খুব নিখুঁত ছিল তাই না?ʼʼ

-“আপনারটা বেশ কাঁচা ছিল। বাকিদেরটা ঠিকঠাক।ʼʼ

এবার রূপকথার অভিব্যক্তি খুব রহস্যময় দেখাল। চোখ চঞ্চল হয়ে উঠল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল বারবার। অন্তূ কপালে আঙুল চেপে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করল, “কেন করেছেন, এসব?ʼʼ

-“পতিভক্ত স্ত্রী, আমি। তার আদেশ এবং চাওয়া আমার ওপর অবশ্য পালনীয়। সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর আমি তার জন্য এটুক করতে পারব না? জমিটা একটা হিন্দুর ছিল। হিন্দু সেটা বন্ধক রেখে পলাশের কাছে টাকা নিয়েছিল চড়া সুদে। সেই টাকা শোধ করেনি, জমি পলাশের। লোকটা লোকজন ধরা শুরু করল। কিন্তু পলাশ সেখানে তার একটা আবাসিক হোটেল বানাবে ভেবেই হিন্দুকে টাকা ধার দিয়েছিল। হিন্দু কান্নাকাটি করলেই ছেড়ে দেবে সে? কিন্তু সবখানে জোর-জবরদস্তি করতে নেই। রেপুটেশন বলতে একটা কথা আছে। সুতরাং গল্প বানাতে হলো। এর মাঝে আঁখি মানে ওই মেয়েটার মার্ডার হয়ে গেল। সব গুলিয়ে একটা জোরাতালির গল্প বানাতে হয়েছিল। সেখানে অভিনয় করেছিলাম আমরা কয়েকজন। খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। কতগুলো দিন সারাদিন ওই টিনের ঘরে থাকতে হয়েছে। রাত গভির হলে তবে বাড়ি ফিরতে পেরেছি।ʼʼ

অন্তূ শ্বাস আঁটকে বসে ছিল। দুনিয়াটা আসলেই বৈচিত্র্যময়। একটুও ভুল বলেনি রূপকথা। তার পিঠের ব্যথা কমে গিয়ে মাথা ব্যথা প্রকট হচ্ছিল। হুট করে রূপকথা বলল, “সেদিন রূপটপে তোমার কান্না, চিৎকার খুব করুণ ছিল।ʼʼ

অন্তূ পাথর হয়ে গেল যেন। রূপকথা অন্তূকে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। মেয়েটা হাসে বেশি, অথচ সেগুলো হাসি নয়, অন্যকিছু। বলল, “এবার আমাকে খুব ঘেন্না লাগছে, তাই না?ʼʼ

-“না। পুরোটা শুনিনি এখনও।ʼʼ মূর্তির মতো কঠিন অন্তূর মুখের অবয়ব।

রূপকথা অবাক হলো, ভ্রু জড়িয়ে ফেলল। অন্তূ বলল, ওখানেই ছিলেন আপনি?

-“তোমার বাবাকে সেবাও করেছিলাম, তিনি অবশ্য তখন বেহুশ ছিলেন। মেরে জ্ঞানহারা করে ফেলে রাখা হয়েছিল।ʼʼ

অন্তূর বুকটা ছলাৎ করে ওঠে। কোথা থেকে যেন কঠিন এক দলা যন্ত্রণা এসে বোধহয় হৃদযন্ত্রের রক্ত সঞ্চালনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। নিষ্পলক চেয়ে রইল রৃপকথার দিকে।

অন্তূ অনেকক্ষণ যাবৎ সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল চুপচাপ, নজর ছিল ছাদের দিকে। কাঁদেনি মেয়েটা, সমস্ত কলজে ছেঁড়া ব্যথাটুকু শোষণ করেছে নিজের মাঝে। নিজেকে আঁটকে রাখতে পারবেনা এই ভয়ে আজ অবধি আব্বুর কবরখানা জিয়ারতে যায়নি। কীসব আব্বুর সাথেকার পুরোনো স্মৃতি ভেতরটাকে ঝাজরা করে তুলছিল। অন্তূ জোরে শ্বাস নিয়ে এক লহমায় নিজের কাঠিন্যে ফিরে এলো, “কেন করেছেন, এসব?ʼʼ

দীর্ঘ নীরবতা। গুমোট এক সন্ধ্যা। পাঁচজন নারী সামনা-সামনি বসে আছে। শুধু ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ জানান দিচ্ছে, সময় প্রবাহমান, সময় থামেনা।

-“সবার বাবা আমজাদ সাহেবের মতোন হয়না, অন্তূ। কিছু বাবা রাজন আজগরের মতোও হয়।…আমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হলো খুব অল্প বয়সে। স্নাতক শেষ করে ফিরলাম দেশে। বাবা ঢাকা থেকে ফিরল। রাতে ডেকে বলল, ‘রূপ! মামণি…আপনারে আর আমার কাছে রাখতে চাচ্ছি না।ʼ

আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম, ‘আমি যাচ্ছি না কোথাও।ʼ

বাবা হাসতে হাসতে বলল, ‘কোথাও যেতে হবেনা। শুধু তোকে নিজের কাধ থেকে ঝারতে চাইছি।ʼʼ

এ পর্যায়ে মলিন হাসল রূপকথা, “জানতে পারলাম, পলাশ ভাইয়ার সাথে বাবা বাঁধতে চায় আমাকে। পালাতে চেয়েছিলাম আমি। লুকিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। বাবা কেন এমন চাইল, জানো? বাবার ধান্দা সামলানোর ক্ষেত্রে বড় চাচার ছেলে পলাশ বাবার চেয়েও বেশি দক্ষ। আর তাকে হাতে রাখতে, সম্পত্তি নিজের রক্তের কাছে রাখতে সে নিজের ঔরসজাত মেয়েকে বলি দিতে পারে বাবা শখের সাথে। এ অবস্থায় তুমি হলে কী করতে, অন্তূ?ʼʼ

-“বাবাহীন সন্তান আমি, এই পরিচিতিতে জীবন কাটিয়ে দিতাম।ʼʼ

-“ওটা তো জারজের পর্যায়ে চলে যেত। তুমি বাস্টার্ড বলে পরিচিত হতে।ʼʼ

-“আপনার বাবার মতো বাবাকে বাবা মানার চেয়ে কি ভালো নয়, আমি পিতৃপরিচয়হীন, অজন্মা হয়ে বাঁচব?ʼʼ

উদাস হয়ে পড়ল রূপকথা, “আমি পারিনি। বাবার স্বার্থপরতার কাছে মানসিকভাবে হেরে গেছিলাম।ʼʼ

-“এরপর?ʼʼ

-“এই, তুমি আমার বাসররাতের গল্প শুনবে?ʼʼ

অন্তূ জবাব দিলো না। রূপকথা সোফাতে শরীর এলিয়ে শাড়ির কুচি গুটিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসল, দৃষ্টি ছাঁদে নিবদ্ধ। এত সুন্দরী এই রূপকথা। তার ওপর এমন সাজসজ্জা। ঠিক যেন রাজকুমারী লাগছে। অথচ মুখটা স্লান এখন।

-“পলাশ ভাইয়াকে একটা বাংলো বানিয়ে দিয়েছিল, বাবা। সেখানে কাঁচা গোলাপের বাসর। বসে আছি আমি, মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। পলাশ এলো। হাতে অ্যালকোহলভর্তি হিপফ্লাস্ক। ফুলের ওপর ছেঁচড়ে আধশোয়া হয়ে পড়ল। দেরি করার সময় নেই তার। ঢকঢক করে খানিক গিলে একটানে আমার শাড়ির প্রান্ত ধরে টান দিলো। শাড়ির পাড় ছিঁড়ে পলাশের হাতে চলে গেছিল, জানো? খুব শক্ত হাত, বুঝলে?ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ তাকিয়ে রয় রূপকথার দিকে। মেয়েটা ছাদের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, “স্যাডিজম বোঝো? স্যাডিস্ট?ʼʼ

-“না।ʼʼ

-“ভয়াবহ মানসিক রোগ। সাধারণ পুরুষেরা নারীকে স্পর্শ করে এবং আদরের মাধ্যমে নিজেদের শারীরিক চাহিদা মেটায়। এই রোগে আক্রান্তরা কী করে জানো?ʼʼ

অন্তূ তাকিয়ে রইল।

-“ধর্ষকামী হয়। অর্থাৎ সাধারণভাবে নারীদেহ ভোগ করে এরা সন্তুষ্টি পায়না। নারী শারীরিক যন্ত্রণায় যত বেশি চিৎকার করে, এদের কানে সেই চিৎকারের আওয়াজ, নারীর দেহের ক্ষত এবং মুখের করুণ কাতরতা এদেরকে যৌন সুখ দেয়। অর্থাৎ, এরা নারী শরীরকে অমানুষিক আঘাতের মাধ্যমে সুখ পায়।ʼʼ

অন্তূর ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। এই তৃপ্তিটা অন্তূ সেদিন রূফটপে পলাশের মুখে দেখেছিল, যখন অন্তূ কাঁদছিল। অন্তূ অবাক হলো। জয় অসংখ্যবার বলেছে, পলাশ পাগল, ওর মানসিক সমস্যা আছে, ও শালা সাইকো। জয় আমির সাধারণভাবে কাঠিন সব সত্যি বলে, বোঝার উপায় থাকেনা। অন্তূ কপাল চেপে ধরল। রূপকথা বলল, “আমার শরীরে অনেক দগদগে দাগ আছে, দেখবে?ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এরপর কী হয়েছিল?ʼʼ

রূপকথা হাসল, “বাসর হলো। যা এতদিন অন্যসব মেয়েরা সঁয়েছে, তা আমি সইলাম। চাবুক দিয়ে পেটানো হলো আমাকে। আমার প্রতিটা আত্মচিৎকার পলাশের মুখে হাসি ফুটাচ্ছিল। একটা মজার কথা শুনবে, অন্তূ?ʼʼ

অন্তূ তাকায়। রূপকথা হাসল, “বাবা আমাদের বাসর ঘরের বাহিরে সোফায় বসে ড্রিংক করছিলেন। আমার চিৎকারে প্রতিটা ইটের গাঁথুনি কেঁপেছিল সেদিন। বাবা খুব শক্ত লোক, তাই না?ʼʼ

বাবারা এমন হয়? অবিশ্বাস্য! অন্তূর মনে হলো, তার সাথে কিছুই হয়নি। এই দুনিয়ার কোপানলে সে পড়েইনি। উহু! জয় এমন নয়। জয় ঘৃণ্য, তবে তুলনায় গেলে জয় অনেক সুস্থ্য। জিজ্ঞেস করল, “এরপর?ʼʼ

-“আমাকে উল্টো করে শক্ত করে খাটের সাথে বাঁধল পলাশ দড়ি দিয়ে।ʼʼ

অন্তূ আর শুনতে চাইল না। তার ভেতরে অদ্ভূত ধরণের এক হিংস্রতা কাজ করছে, সাথে ম্যান্টালি ডিপ প্রেশার ফিল করছিল, শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। রূপকথা থামল না, “সারা পিঠে কোনো মাংসাশী প্রাণীর মতো কামড়েছিল পলাশ। যেন সে খুবলে মাংস খেতে চায়। আমার চিৎকার কমে আসলে তার আঘাত জোরালো হচ্ছিল। সে চিৎকার শুনে, এবং আমার কান্নায় তৃপ্তি পাচ্ছিল।ʼʼ

অন্তূ হাত উঁচিয়ে ধরল। সে আর শুনতে চায়না। নিতে পারছে না। রূপকথা সোজা হয়ে বসল, “তোমার মনে প্রশ্ন আসছে না? বাবা কী করে সহ্য করছিল? বাবারা আবার এমন হয় নাকি?ʼʼ

অন্তূ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে আর নিতেই পারছে না। তার সামনে বাবা মানে আমজাদ সাহেব। এক ব্যক্তিত্ববান, গম্ভীর, কর্তব্যপরায়ন, নিখুঁত মানুষ। অস্থিরচিত্তে এদিক-ওদিক তাকাল। ঘেমে উঠেছে শরীরটা। তার মনে হচ্ছিল, সে কোনো ডার্ক ম্যাগাজিন পড়ছে, এসব বাস্তব হতে পারেনা। হাত পা ঘষতে ঘষতে বসে পড়ল। রূপকথা একদম স্বাভাবিক, চোখে-মুখে বরফের মতো শীতলতা। মনে হচ্ছে, সে খুবই রিল্যাক্সে আছে। অন্তূ বলল, “আপনার তথাকথিত বাবা অর্থাৎ রাজন আজগরও পাগল?ʼʼ

রূপকথা হেসে ফেলল, “পেডোফেলিয়া বোঝো?ʼʼ

-“বোঝান। আজ অনেককিছু বোঝার আছে আমার।ʼʼ

-“শিশু নির্যাতনের প্রবণতা। অর্থাৎ, যা পলাশ নারীর সাথে করে, বাবার তা ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে করার নেশা আছে। পলাশ সেক্সুয়াল স্যাডিস্ট। বাবা পেডোফিলিক স্যাডিস্ট। অর্থাৎ এরা মানুষকে অত্যাচারের মাধ্যমে তাদের আত্মচিৎকারের আওয়াজে তৃপ্তি পায়।ʼʼ

রিমি পাথরের মতো বসে ছিল। এতক্ষণ সে যেন শুধুই ঠাকুরঘরে সাজিয়ে রাখা মূর্তি। নিঃশ্বাসও ফেলেনি বোধহয়। এবার বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো একটা শ্বাস ফেলল। পুরো বংশটাই পাগলের কারখানার শ্রমিক! অন্তূ অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, “এসব হয়েছে আপনার সাথে, আর আপনি কী করেছেন?ʼʼ

-“করিনি বলছো! অনেক কিছু করেছি। আমি যা করেছি, তা নিতে পারবে তো? …আমি কী করেছি, তা জানো তুমি।ʼʼ

অন্তূ স্থির চেয়ে থাকল। রূপকথা বলল, “মানুষ ব্যথার কাছে খুব স্বার্থপর হয়ে যায়, অন্তূ। যেকোনোভাবে সে নিষ্কৃতি চায়। আমিও তাই চেয়েছি, তার জন্য এমন সব নোংরা কাজ করেছি, যার ক্ষমা নেই। পলাশ যা বলতো, শুনতে শুরু করলাম, শর্ত— সে আমার কাছে আসবেনা। হাজার রাত নিজের ঘরে বসে অন্য মেয়েদের মরণ চিৎকার শুনতে শুনতে আমি জানোয়ার হয়ে গেছি, অন্তূ। কিচ্ছু মনে হয়না। শুধু মনে হয়, আমার সাথে তো হচ্ছেনা, আমি তো বেঁচে গেছি। শরীরের ব্যথাগুলো আর ওইসব নারকীয় রাত মনে পড়লে আমি আরেক পলাশ হয়ে যাই। নিজেকে ওই জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে সব কবুল।ʼʼ

অন্তূ আন্দাজ করে ফেলল অনেককিছুই। রূপকথা বলল, “পলাশকে সুস্থ করার জন্য চেষ্টাও করেছিলাম, জানো? নিজের রূপে, এবং দেহে আকৃষ্ট করতে চাইতাম, যেমনটা স্বাভাবিক পুরুষেরা হয়। বাবা ঢাকায় থাকতো। বাড়ি ফাঁকা। ওর চোখে পাগলামির নেশা দেখলে নিজেকে বাঁচাতে ওর কাছে গিয়ে ঘেষতাম, চুমু খেতাম, স্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দিনশেষে আরেকবার ওর পাগলামির শিকার হতে হতো। এমনও হয়েছে গতরাতে বেহুশ করে ফেলে রেখেছে আমাকে। আমি উঠতে পারছি না। নিজেই ডাক্তার এনে চিকিৎসা করিয়েছে। কাঁচা ঘা। তার ওপর সেই রাতে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটা পাগলের সাথে দিনের পর থাকতে থাকতে, আর এইসব দেখতে দেখতে আমিও পাগল আর হিংস্র হয়ে উঠলাম। নিজের জায়গায় অন্য যেকোনো মেয়েকে ছেড়ে দিতে মন চাইতো, তবুও নিজেকে বাঁচানোর লোভ সংবরণ করতে পারিনি।ʼʼ

রিমির চোখ ভিজে উঠেছিল, হাত-পা তড়তড় করে কাঁপছে। এবার টুপ করে পানি পড়ল কোলের ওপর। একটা মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের মুখে যা শুনছিল, সহ্য সীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল সব।

অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনি সেদিন ওই বাড়িতেই ছিলেন, যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?ʼʼ

-“রুফটপের পাশের ঘরেই ছিলাম।ʼʼ আনমনা হয়ে উঠেছিল রূপকথা।

-“আর আঁখি?….ʼʼ

-“আঁখি না ওর নাম। ওই মেয়েকে যা করা হয়েছে, এই বাড়িতে করা হয়েছে। পলাশও ভাগ পেয়েছিল, শেষে। এখানে এসে।ʼʼ

অন্তূর শরীরটা অসাড়ল হয়ে উঠল। তাদের কথা মাঝে বারবার নিস্তব্ধতা নেমে আসছিল, আবার শুরু হচ্ছিল। দাসী মহিলা দুটো স্বাভাবিক। খুব পরিচিত ঘটনাই বলছে রূপকথা।

অন্তূ চট করে একটা হিসেব মেলালো, দামী হিসেব। শাহানার জরায়ুতে টিউমার। সে জানে, এ অবস্থায় স্বামীসঙ্গে যায় না মহিলারা, পারেনা। ডাক্তারের নিষেধ থাকে, তাছাড়া সহ্য না করতে পারার একটা বিষয় থাকে। হুমায়ুন পাটোয়ারীর হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা মনে পড়ল অন্তূর। শরীরটা ঝিনিঝিন করে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।

চলবে..

[টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন। আর দেরি করার জন্য ক্ষমা-টমা চাইতে পারব না। এমন যদি হতো, এবার শেষ, আর হবেনা, তো শেষবার ক্ষমা চেয়ে পাপমুক্ত হতাম। আমার এই জীবনে শুধরানোর পরিকল্পনা নেই, সুতরাং ওসব মাফ-টাফ চেয়ে লাভ নেই।🤦‍♀️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here