#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৩.
অন্তূ যখন উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে, জয় বাহু চেপে ধরল, “ঘরওয়ালি, ঘরওয়ালি! যাচ্চ কোতায়?ʼʼ
অন্তূ তাকাতেই চোখ বুজে মাথা ঝারা দিয়ে চোখ ঝাপটে ফের বলল, “কোথায় ছুটলে?ʼʼ
অন্তূ হতবাক হয়ে গেল। জয় জানায়, “এ বাড়ির বউয়েরা যখন-তখন বাপের বাড়ি যায়না। ভাবীকে দেখেছ একবারও বাপের বাড়ি যেতে?ʼʼ
-“পাগলামি করছেন, আপনি?ʼʼ অন্তূ কণ্ঠে বিস্ময়। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে।
-“না। পাগলামি করব কোন সুখে? আমি একটা ভালো জাতের মাতাল, পাগল না।ʼʼ
জয়ের রসিকতা সহ্য হলো না অন্তূর। ব্যাকুল হয়ে বলল, “অন্তিকের—ʼʼ
-“দেখার মতো না। দেখেই এসেছি রাতে—ʼʼ
অন্তূ তড়িতাহতের মতো ছিটকে তাকায়। জয় অপ্রস্তুত হবার নাটক করে যেন, ভ্রু উচিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে ঘাঁড় চুলকায়। অন্তূ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারেনা, পরে নিস্তেজ গলায় বলল, “কী অপরাধ করেছিল আপনাদের কাছে আমার ভাবীর গর্ভের সন্তান?ʼʼ
জয় দুপাশে মাথা নাড়ে, “চ্যাহ্! জন্মের আগে কেউ অপরাধ করেনা।ʼʼ
অন্তূ হাত ছড়ানোর চেষ্টা করল একবার, পরে থেমে গেল। দৃষ্টি সরালো না জয়ের মুখ থেকে। পাগলের মতো অল্প হাসল, “আমি করেছি অপরাধ! বলছেন না কেন?ʼʼ
জয় দরজাটা একহাতে আঁটকে দিয়ে অন্তূকে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে সিগারেট জ্বালালো। অন্তূ বিছানায় আঘাত করে হাত দিয়ে, “শিট! অপরাধ করলাম আমি, আর ওই বাচ্চাটা দুনিয়ায় এসে বাপকে দেখবে না। ড্যাম, ড্যাম, ড্যাম! ড্যাম অন মি।ʼʼ টুপ টুপ করে কয় ফোঁটা পানি পড়ে বিছানায়। আবার শুকিয়েও যায়না, অন্তূ জীবনে কেঁদেছে খুব কম, আমজাদ সাহেব পছন্দ করতেন না।
জয় বসল পাশে। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আমাকে যেতে দেবেন না ওই বাড়ি?ʼʼ
-“না। তোমার একটু রিল্যাক্স দরকার। কিছুদিনের দৌড়-ঝাঁপে ক্লান্ত, তুমি। হামজা ভাই এতক্ষণে চলে গেছে। গিয়ে বলেও দিয়েছে হয়ত, তুমি যাবেনা। অন্তিকের ওপর রাগ তোমার। ঠিক না?ʼʼ
অন্তূর মেঝের দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক গলায় বলে, “হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু ওর সন্তানের ওপর ছিল না, জানেন? তা সত্ত্বেও ওর সাথে আমি পাপ করে ফেলেছি। আমার ক্ষমা নেই।ʼʼ
জয় সিগারেটে টান দেয়, “ওসব কাটাছেঁড়া দেখতে পারবে না, তুমি।ʼʼ
-“আচ্ছা। দেখতে যাব না, ওসব।ʼʼ তোতাপাখিকে শেখানো বুলির মতো বলে অন্তূ।
জয় মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে সিগারেটের আগায় টোকা দিয়ে জমাট ছাই ফেলে মেঝেতে। হামজার কল আসছে বারবার, তারা দুজন মরা বাড়ি যাবে, কত কাজ পড়ে আছে তাদের। অন্তূ আস্তে করে উচ্চারণ করে, “কেন?ʼʼ
খানিক সময় নেয় জয়, তারপর বলে, “রাজনীতি পুরোটাই একটা নীতির ভাণ্ডার, ঘরওয়ালি। হোক তা দূর্নীতি অথবা সুনীতি। নীতি। তার মাঝে মেজর একটা নীতি কী জানো? জনগণকে কাবু রাখা। কিন্তু আমাদের দ্বারা কখনোই সম্ভব না জনগণের মন জিতে তাদের হাতে রাখা। তাহলে উপায়? কিন্তু হাতে তো রাখতে হবে!ʼʼ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ভয়। এটা কার্যকর। জনগণের মনে যতদিন আমাদের জন্য কলজে কাঁপা ভয় আছে, ততদিন আমরা আছি। ওটা পুঁজি আমাদের। তোমার ভেতরে তা নেই হয়ে যাচ্ছিল। বিদ্রোহী আর রাজ-প্রতিদ্বন্দীরা জানের ভয়হীন হয়। তাই বলে কি এদের কাবু করার জায়গা নেই? থাকে। এদের পরিবার..ʼʼ
একটু থেমে বলে, “আমি বলেছিলাম, তোমার পরিবারকে আঘাত করতে দুঃখ পাবো আমি। অন্তিককে আঘাত করার সময় খারাপ লেগেছিল আমার। তোমার ভাবী গর্ভবতী, অসহায় মা। জেদ কি ভালো কিছু বয়ে আনে, আরমিণ?ʼʼ ঠোঁট একপাশে বাঁকা করে ‘চ্যাহ চ্যাহʼ শব্দ করে মাথা দোলায় জয়।
অন্তূ মন্ত্রপুতের মতো দুপাশে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, “না। ভালো কিছু বয়ে আনেনা। খুব খারাপ অবধি যায়। আমি…আমি আমার অপরাধগুলো সব গুলিয়ে ফেলেছি, মনে করান তো পাপগুলো—মনে পড়েনা পাপ। তবে এত বড় বড় দাম যখন দিচ্ছি, কিছু তো করেছি। কী?ʼʼ
‐“তোমার ভয়হীনতা।ʼʼ হ্যান্ডপ্রেসিং বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ”হামজা ভাই আর আমার পথ একটা, গন্তব্য দুটো। বিষয়টা এমন—এক রাস্তার মিলিত মোড়ের ওপর লাগোয়া দুটো বাড়ি। আমি যাব একটাতে, হামজা ভাই অপরটায়। কিন্তু পথ তো একটাই, একই স্থানে। সেখানে তুমি একটা বেরিকেট। হয় সেটা সরিয়ে দিতে হবে নয়ত আধভাঙা করে পথ ক্লিয়ার করতে হবে। তোমার নিজস্ব দূর্বলতা নেই। কিন্তু তোমার ভাবী, মা…তাছাড়া অন্তিক আমার আর হামজা ভাইয়ের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করেছিল। রেপুটেনশ বলতে তো কিছু আছে নাকি? এসব কি ঠিক করেছে?ʼʼ
-“না। ঠিক করেনি।ʼʼ অন্তূ চোখ তুলে তাকায়, “এত হিংস্র মনে হয়নি কখনও আপনাকে।ʼʼ
-“তুমি আমায় চেনোই কতটুকু?ʼʼ জয় ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। আবার জিহ্বা বের করে ঠোঁট ভেজায়।
-“আমি মূর্খ, নির্বোধ। ঠিক বলিনি?ʼʼ
জয় হো হো হা হা করে হাসে। এই হাসিটা অবর্ণনীয়। আনমনে কেউ জোরে হাসলে ভৌতিক লাগে। জয় পারে। তার আনমনা চোখ, ঠোঁটে ফেঁড়ে গা দুলানো হাসি, এটা তার বৈশিষ্ট্য। পাখির মতো ঘাঁড় নেড়ে ওদিক-এদিক তাকায়। অস্থির-চঞ্চল জয় আমির।
সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর। গতরাতে এসে গোসল করেছিল সেই মাঝরাতে। খুন করে এসে গোসল করতে হয়? হামজার জন্যও গরম পানি করতে দেখছে রিমিকে। হামজাও গোসল করেছে? অন্তূ ভাবে। তার মাথায় আবোল-তাবোল ভাবনারা আসছে। কে যেন ডাকছে। সে স্পষ্ট শুনছে। নাম ধরে ডাকছে ওকে। সারা দিলেই বলছে, “মরে যা। যন্ত্রণা কমে যাবে। তোর মতো মেয়ের মরে যাওয়া খুব দরকার।ʼʼ
অন্তূ শুধায়, “মরলেই সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যাবে?ʼʼ
সে বলে, “পাক্কা। তোর বাঁচার হক-ই তো নেই। তুই তোর বাপকে খেয়েছিস, নিজের পর্দা, ক্যারিয়ার, পরিবার, সম্মান, শান্তি, অবশেষে ভাইটাকে, সাথে কিছু অমানুষ শত্রুও লেলিয়ে নিয়েছিস নিজের পেছনে। একটা বাচ্চার বাপকে তার জন্মের আগে খেয়ে বসে আছিস। তোকে বাঁচার হক কে দিয়ে রেখেছে?ʼʼ
-“তাহলে মরে যাওয়াই উচিত, আমার?ʼʼ
-“আলবাৎ তাই। জয়ের ড্রয়ারে অনেক রকমের মেডিসিন-ড্রাগস থাকে। কোনোটা অভার-ডোজ হলেই তুই মুক্ত। তোর মতো নির্বোধদের বাঁচতে নেই, অন্তূ। মুক্ত হ, ব্যথা কমিয়ে ফেল। এত যন্ত্রণা গিলে এমনিতেও সুস্থ থাকবি না।ʼʼ
সাদা পাঞ্জাবীর ওপর আলমারী খুলে নতুন আতরের শিশি বের করে পুরো শরীরে আতর লাগায় জয়। পাঞ্জাবীর কলার টেনে বোতাম আটকায়। হাতে থাকা শিকলের মতো রিস্টলেট খুলে কালো ঘড়ি পরে, গলার চেইনটা পাঞ্জাবীর গলার আড়ালে রাখে। মরা বাড়ি ভদ্র হয়ে যাওয়া উচিত।
অন্তূর নাকে আতরের ঘ্রাণ যেতেই পরিবেশ ভুলে অন্য টাইমলাইনে বিচরণ করতে শুরু করল। সে দেখতে পায়, সামনেই আমজাদ সাহেবের লাশ। চোখে সুরমা, গোলাপজল ছেটানো হচ্ছে, আতর, কর্পূর ইত্যাদির গন্ধ আসছে। চট করে আমজাদ সাহেবের মুখটা বদলে অন্তিক হয়ে যায়। অন্তূ কেঁপে ওঠে থরথর করে। তার জন্য হয়েছে সব। সে কী করে ফেলেছে! তার দুঃসাহস, তার লাগামহীন জবান, তার আপোষহীন চিত্ত— ফলসরূপ মার্জিয়ার শুকনো মুখ অন্তূর বুকে চিড় ধরায়। ওই ছোট্ট জানটা যখন দুনিয়ায় আসবে, বাবাকে পাবেনা, সে কি জিজ্ঞেস করবেনা, ‘কেন আমার বাবা নেই?ʼ মার্জিয়া কি বোঝাবে না, ‘তোর ফুপুকে জিজ্ঞেস কর।ʼ কী জবাব দেবে অন্তূ?
অন্তূর মনে হয়, সে বোধহয় তলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। সে কি চেতনা হারাচ্ছে? না, এত দূর্বল তো না সে! প্রতিবাদ! বিদ্রোহ, সত্যের সন্ধান, অন্যায়কে অন্যায় বলা, আপোষ না করে রুখে চলা—এসব কী দিলো তাকে? অভিজ্ঞতা! প্রকৃতি কিছু নিলে বিনামূল্যে নেয়না। এই তো অন্তূকে কতশত অভিজ্ঞতা দিলো, এসব কি টাকায় পাওয়া যায়? জয়ের অনেক অভিজ্ঞতা, তারও নিশ্চয়ই হারাতে হয়েছে?অন্তূ ভাবে, এরপর জয় পশু হয়ে গেছে। অন্তূও তাই হবে একদিন? চুপচাপ মানুষ মারতে হাত কাঁপবে না? মানুষকে গাড়ি চাপা দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে এসে রাতে সে চুপচাপ শান্তির ঘুম ঘুমাবে? জয়ের মতো?
অন্তূর আনন্দে বুক নেচে ওঠে। সে তো খালি শিখেছে, মুখ চালাতে। ক্ষমতা আসলে চোখের চাহনিতে, হাতের অস্ত্র চালনার দক্ষতায়, নীরবে উপড়ে ফেলায়। অন্তূ নিজেকে অভিশাপ দেয়, ‘পুড়ে মরে যা তুই। সেবার মনে হয়েছিল, এবার বুঝি কী না কী করে ফেলবি! তোর বাপ মরেছে, টাল হয়েছিস তুই, এবার দুনিয়াটা শাসন করে ফিরবি। তোর মতো মূর্খ আর জাহিরি লোকের তো মরে যাওয়া উচিত। মরে যা তুই।ʼ
নিজেকে দেয়া অভিশাপ অন্তূর খুব পছন্দ হয়। সে হালকা হাসে। সে কেবল চায়—জয়ের মতো বহুরূপী, আর হামজার মতো শীতল হতে। পাবরে? ওরা কথা বলেনা। ওদের মুখ অচল, হাত ও মাথা সচল।
অন্তূকে ঘরে আটকে রেখে জয় বেরিয়ে যায়। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে জয়কে। ঠিক যেন শ্যামা-রাজকুমার সাদা ভূষনে। খাঁটি বনেদি পুরুষ লাগছিল। অন্তূ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘বাদের প্রতি-বাদ করবি আর?ʼ
অন্তূর মনে হয়, আয়নার ভেতরের অন্তূ সাঁয় দিচ্ছে, ঘাঁড় নেড়ে বলছে, ‘আমৃত্যু করে যাব। তাতে এ জান থাক আর যাক। এ মাথা নোয়ানোর নয়, জুলুমকারীদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানোর নয়, মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার নয়…ʼ
দুম করে ভরা পানির বোতলটা তুলে ছুঁড়ে মারে কাঁচের ওপর। ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ। এখন আর ওই অন্তূকে দেখা যাচ্ছে না। অন্তূ জোরে জোরে শ্বাস ফেলে। সেই অন্তূকে বলে, ‘আর কখনও আমার কাছে এলে জ্যান্ত পুঁতে রাখব। এই তুই আর তোর নীতি যা কেঁড়ে নিয়েছিস আমার কাছে, সেসব আমার গেছে, তোর তো একফোঁটা আঁচড়ও লাগেনি গায়ে। সমাজ তোকে কিছুই বলেনা, তুই যে কত বেপরোয়া, তুই উজানের টানে বেতাল-উত্তাল সমুদ্রের বিক্ষিপ্ত আগুন জরা ঢেউ, তা কেউ দেখেনা। অথচ তোর মোহে, তোর নির্দেশনায় আমি নিঃস্ব, আমি কাঙাল, আমি পাগল, আমি বোকা!ʼʼ
অন্তূ চিৎকার করে চুল টেনে ধরে। ছুঁটে এসে হাতের কনুইতে লেগেছে এক টুকরো কাঁচ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোলে অন্তূ সুখের শ্বাস ফেলে। কার্যকর তো ভীষণ! মানসিক যন্ত্রণাকে ভুলতে শরীরের ব্যথা ভীষণ কার্যকর ঠেকল অন্তূর কাছে। ক্ষততে যে জ্বলুনি উঠেছে, তা মানসিক যন্ত্রণা থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনছিল। কোনো ব্যথাই অনুভূত হচ্ছে না। চোখ বুজে আসতেই একটা দুধের বাচ্চা এসে মাথায় হাত রাখে অন্তূর। দেখতে অনেকটা আমজাদ সাহেবের মতো, চোখদুটো অন্তিকের মতো। অন্তূ চমকে ওঠে।
হামজা সাদা পাঞ্জাবীর সাথে সাদা ধবধবে একটা টুপি হাতে নেয়। নাগরা জুতোটা পায়ে চড়াতে চড়াতে জয়কে বলে, “জানাজা কয়টায়?ʼʼ
-“দেরি হবে।ʼʼ
জয় চামড়ার স্যান্ডেলের বেল্ট লাগায় না জীবনে। ওভাবেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। কলার ধরে পেছনে টেনে আনে হামজা, “থাপড়ে মুখের নকশা বদলে দেব, শুয়োর। পা তোল।ʼʼ
বাঁ পা দিয়ে মোড়া টেনে এনে ডান পা মোড়ার ওপর রাখে জয়। হামজা ওর স্যান্ডেলের বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে কষে একটা চাপড় মারে পিঠে। পিঠ ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে যায় জয়।
—
হামজা ও জয় প্রধান প্রতিনিধিত্ব করল অন্তিকের লা-শ দাফনের। অন্তিক জয় ও হামজার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ করেছিল। শুধু এই কারণ হলে চলতো। এটাই তো শুধু কারণ না ওকে মারার। অন্তূর এত বাড়াবাড়ি মানা যাচ্ছিল না। বাড়িতে শত্রু ঢুকে ওর কারণে বাপ-মাকে মেরে বেরিয়ে গেছে। বাইরের একতলা বিল্ডিং জ্বালিয়ে গেছে, পার্টির দুটো ছেলে মরেছে, কয়েকজন চিকিৎসাধীন। অন্তূ খড়ের গাদায় লাগা আগুনের মতো ধিকধিক করে বাড়ছিল। জয়ের সাথে যা করে অন্তূ, সবই তো কানে যায় ওর। এমনকি স্বয়ং তাকেও তোয়াক্কা করেনা মেয়েটা।
সেদিন অন্তূ মুস্তাকিনের কাছে বের হবার পর রাস্তায় যখন পলাশের লোক অন্তূকে ধরতে এলো, মাজহার এসে ওকে রক্ষা করে বাড়ি নিয়ে গেছে। অন্তূ গিয়েছে, কথাবার্তা বলেছে, আবার সেটা স্বীকার না করে চাবি চায়। চোখে ভয় নেই, জানের মায়া নেই, থামার সম্ভাবনাও নেই। হামজা কত ধৈর্য্য ধরবে?
রাবেয়াকে হামজা বলল, “খালা মা। আরমিণ আসল না। পরে-পাছে এসে দেখা করে যাবে। আপনারা গেলেও পারেন, নিষেধ নাকি? যান না কেন?ʼʼ
রাবেয়া তখন শোকে বিহ্বল। মার্জিয়ার জ্ঞান থাকছিল না, বারবার দাঁত লেগে যাচ্ছিল। কথাটা শুনেও বিশ্বাস করল না মার্জিয়া। কথাও বলল না।
হামজা ও জয় লা-শ মাটি দিয়ে বাড়ি ফিরল মাঝরাতে।
—
-“সেদিন কোথায় গেছিলে?ʼʼ
হামজার প্রশ্নটা চরম শান্ত। জেনেশুনে প্রশ্ন করছে, তবুও মুখটা আন্তরিক। অন্তূ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, “ঝন্টু কাকার ছেলে মাজহার নিয়ে গেছিল।ʼʼ
-“তুমি গেলে?ʼʼ
-“তো কি মারামারি করার ছিল রাস্তায়? তাছাড়া সে উপকার করেছিল আমার। কৃতজ্ঞতা কাজ করছিল তখন।ʼʼ
হামজা মসৃণ হাসল। একহাতে সে জয়ের চুলে হাত বুলাচ্ছে। পায়ের ওপর পা তুলে বসা। কালচে খয়েরী ফতোয়ার সাথে সাদা পাজামা। অভিজাত দাম্ভিক চেহারা।ঘরে পরার কালো চামড়ার স্যান্ডেল। নেতাগিরি মানায় হামজার সাথে বেশ। অন্তূ মুচকি হাসে, ”আপনার হাসি সুন্দর, মেয়র সাহেব। যে কেউ বিভ্রান্ত হবে এতে।ʼʼ
জয় হামজার কোলে শুয়ে পা তুলে দিয়েছে সোফার মাথায় নকশার ওপর। সে টিভি দেখছে। ইংরেজি সিনেমা চলছে। হরর, সাই-ফাই মুভি—প্যান্ডোরাম। ভয়ানক সব সাউন্ড, দৃশ্য। সে চোখ বড় করে গিলছে।
অন্তূর কথা শুনে ঘাঁড় ফেরালো, “এএ চেংরী, এই! মুখ সামলে। তোর ভাসুর লাগে। মানিস বা না মানিস, খারাপ নজর দিবি না। আমি জীবিত এখনও।ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়না। অনুশোচনা বা আফশোস শব্দদুটো এ বাড়িতে বড়োই অকার্যকর। নিজের বাপ-মা মরায় যে মানুষের চোখে অল্প একটু কাতরতা পরিলক্ষিত হয়নি, শুধু ভেতরে পুড়েছে বোধহয়, তাদের কাছে আশা করতে নেই শোক। অন্তূও আজকাল চেষ্টা করে সেইরকম হতে।
হামজা বলল, “এরপর?ʼʼ
-“ঝন্টু সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, সীমান্তকে এই বাড়িতে বাড়িতে মারা হয়েছে কি-না?ʼʼ
-“হু?ʼʼ ভ্রু উঁচিয়ে মাথা নাড়ে হামজা।
-“আমি বললাম, ‘আমার সামনে।ʼʼ
-“বলে দিলে?ʼʼ হামজা হেসে ফেলল। গম্ভীর মানুষ হুটহাট হাসলে ভালো লাগে না ভয়ানক?
অন্তূ হাসল না, মুখের আকৃতির একটুও পরিবর্তন হলো না। সে বলল, “হ্যাঁ, বলে দিলাম। আব্বু কী বলতো জানেন? বলতো, ‘অন্তূ, সবচেয়ে সস্তা পাকস্থলী কোন প্রাণীর, বলতো?ʼ আমি ভাবতাম, সেই প্রাণীর পাকস্থলী বোধহয় বাজারে খুব অল্প দামে বিক্রি হয়। অনেক খুঁজেও না পেয়ে বলতাম, ‘তুমি বলো, আব্বু।ʼ আব্বু বলতো, ‘যাদের পাকস্থলী অন্যায়-সত্যকে হজম করে ফেলতে পারে ভেতরে।ʼ এরপর আমিও শিখলাম, আমার পাকস্থলীকে দামী বানাতে হলে অন্যায়-সত্যকে উগড়ে দিতে হবে। তবে এখন আমি ভয় পাই। আর এসব করব না।ʼʼ
-“ভয় পাও?ʼʼ দাঁতে জিহ্বা ঠেকায় হামজা।
অন্তূ হাসে, “পাই তো। আপনাকে পাই, জয় আমিরকে পাই। পাবো না কেন, বলুন? এইটুকু বয়সে শুধু কথা বলে যত বড় বড় পর্যায়ের শত্রু কামিয়েছি আমি, আপনারা এতদিনের রাজনৈতিক জীবনে কামাতে পেরেছেন? তাই সেসব বাদ। আমি ভালো হয়ে যাব। আর দু-একটা ভাই থাকলে নাহয় রিস্ক নিতাম। আর নেই। এবার বা কার পালা আসবে! তারচেয়ে চুপচাপ মেনে নেয়া কি ভালো না?ʼʼ
-“ওখানে তারপর কী হলো?ʼʼ
-ঝন্টু সাহেব বললেন, ‘তুমি সাক্ষী দেবে?ʼ আমি বললাম, ‘এরপর আমায় বাঁচাবেন আপনি?ʼ তিনি বললেন,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তুমি শুধু প্রত্যাক্ষদর্শী সাক্ষী নও। বরং ওই বাড়ির বউ-ও। আরও অনেককিছুই জানো ওই বাড়ির ব্যাপারে। সেইসব বলবে। এর বদলে ঝড়ঝাপটা আসবে, আমি সামলে নেব।ʼʼ
জয় এ পর্যায়ে চট করে বলে উঠল, “সম্বন্ধির নাতি আমার। আমার বউ সাক্ষী দিলেই ব্যাটাশ্শালা একেবারে আমার বালগুলো ছিঁড়ে বোঝা বেঁধে ফেলতো! শালা এবোর্টেড!ʼʼ
অন্তূ বলল, “আমি হেসে বললাম, ‘ওদের হাত থেকে নিজেদের সামলাতে পারছেন না, নিজের ভাগ্নিকে সামলাতে পারলেন না, এখন মরে গেছে, তবুও কোনো প্রমাণ পেলেন না। আমাকে সামলে নেবেন?ʼ ঝন্টু চাচা খুব অপমানিতবোধ করছিলেন বোধহয়, কিন্তু কিছু বললেন না। এতে খালি আমার একটা উপকার হলো, আরেকটা নতুন শত্রু জোগাড় হলো।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে ওঠে। হামজা হামজা কপালে হাত চেপে নিঃশব্দে হাসল। অন্তূ উদাস হবার ভান করে বলল, “নিজেকে আজকাল মাফিয়া হয়। ওদেরও মনেহয় একসাথে এত শত্রু পাড়ি দিতে হয়না। শুধুই আমার মুখের জন্য। শ্যাহ!ʼʼ
রিমি কিছু নাশতা আর শরবত দিয়ে বসল পাশের সোফায়। অন্তূ চুপচাপ চেয়ে থাকে জানালার বাইরে। আনমনা দৃষ্টি। চোখদুটো ঘোলা হয়ে আবার পরিষ্কার হয়। সে কেমন নাটকবাজ হয়ে যাচ্ছে। বুকে পাথর চেপে ঠোঁটে হাসা সহজ না। এটা তার জন্য সুবিধার হবে নাকি ক্ষতির?
—
হামজার বাড়ি ফিরতে রাত হয়। জয় বাড়ি ফিরেছে বিকেলে। গোসল করে বের হলে রিমি ঘরে খাবার দিয়ে এসেছে। অন্তূ তুলির ঘরে ঢুকল।
তুলি মরার মতো বিছানায় পড়ে থাকে। আজকাল কোয়েলের সবটুকু যত্নও তরুর। তার কাছে প্রায় রোজই ইন্টেরোগেশনে আসে তদন্ত সংস্থার লোকজন। তারা যখন তুলির সাথে হওয়া ঘটনা শুনল, এরপর থেকে সন্দেহ জোরালো হয়েছিল, যে ও অথবা এ বাড়ির লোকই সীমান্তর খুনটা করেছে। কিন্তু আজ ক’দিন দেখা যায় লোকজন আর আসেনা। গতরাতে শোনা গেল, হামজা তার এক পার্টির গুপ্ত কালপ্রিটকে সীমান্তর খুনি সাজিয়ে আইনের আওতায় দিয়ে দিয়েছে অলরেডি। আর ফাঁক নেই তাকে সন্দেহ করার। কালপ্রিট স্বীকার করেছে সে সীমান্তকে খুন করেছে, পুরোনো শত্রুতার জেরে। কেইস ডিসমিস।
ঝন্টু সাহেব ক্ষমতা হারানো এক দাঁড়কাক। মাজহার শুধু ফণা তোলা সাপের মতো ফুঁসে বেড়াচ্ছে চারদিকে। এখন কেইস চলছে, বাপ-মা মরার। হামজা খুব লড়ছে। নয়ত সন্দেহ করে বসবে পাবলিক। বাপ-মার খুন হলো, তবু থানা-কাচারিতে দৌড়াদৌড়ি নেই? সে দৌড়াচ্ছে। অথচ কালপ্রিটকে সে জীবন থাকতে পুলিশের হাওলা করবেনা। তাকে তার প্রয়োজন, জয়ের প্রয়োজন।
অন্তূ তরুকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় এসে বলল, আমার একটা উপকার করবে?
-“কেন করব তোমার উপকার?ʼʼ
গম্ভীর মুখে তরুকে একটুও মানায় না। অন্তূ হাসল মৃদু, “অকারণে।ʼʼ
তরু চুপ। সে চারদিকে দেখছে, জানছে। অন্তূ সেই লুব্রিকেন্ট, যে আসার এ বাড়ির বদ্ধ জানালার মরিচা ধরা সিটকিনিগুলো একে একে খুলতে শুরু করেছে। অন্তূ বলল, “আমার সাথে যাবে।ʼʼ
-“কোথায়?ʼʼ
-“আমি কোনো খারাপ বা ক্ষতিকর জায়গায় যেতে পারি বলে মনে করো, তুমি?ʼʼ
-“হেঁয়ালি করবেনা।ʼʼ
-“আচ্ছা, করব না।ʼʼ
তরু দাঁড়াল না, ভেতরে চলে গেল চুপচাপ। অন্তূ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। ঘাঁড় ফেরায় না। তরু বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললে, “দ্রুত তৈরি হবে। হাত-ধুয়ে নিই আমি।ʼʼ
আলতো হাসে অন্তূ। এই বারান্দা থেকে বাড়ির পেছন দেখা যায়। বিশাল ডোবা ওই সামনে, কালো কাদামাটিই বেশি তাতে পানির চেয়ে। হামজা ও জয়কে দেখে আন্দাজও করা যায়নি ওরা এত গভীর। ছিঁচকে রসিক আর অল্প-সল্প দাপুটেই লাগতো কেবল।
জয় খাচ্ছিল। কোয়েল বারবার প্লেটের ওপর হাত চালাচ্ছে, আমার চলকেত দিয়ে তারপর খাও। জয়, ও জয়, জয়ইইইই! জয়, আমার কথা শোনো..
জয় এতক্ষণে মাছের কাটা বেছে বেশ একটা মিশন কমপ্লিট টাইপের ভাব নিয়ে তাকাল কোয়েলের দিকে, “ক, সম্বন্ধির চেংরী, ক। কী সমস্যা, তোর? ওই ভাবী শালির মেয়েকে বলি, আমি বাঙালি তবে মাছে-ভাতে না। ও শালি! আমারে মাছ দিয়েন না, মাছের বালডা আমি বাছতে পারিনা, আমারে দিয়েন না। ভাতের নিচে পানি উঠে বন্যা হয়ে যাচ্চে, তবুও মাছের কাঁটা বাছা শ্যাষ হয়না।ʼʼ
কোয়েল জোরে করে খামচি দিয়ে ধরল জয়ের হাত, “আমার চলকেত দাও।ʼʼ
-“বাংলা ভাষার সাথে জোচ্চরি করছিস, বেইমান। তোর তো দেশদ্রোহীতার শাস্তি হওয়া উচিত। চলকেত কী? চকলেট। বল, মামা… ও থুক্কু; আমাকে তো আবার কেউ বালের দামটুকুও দেয়না। ক যে, জয়! চকলেট দাও, চকলেট।ʼʼ
অন্তূ রুমে ঢুকতে ঢুকতে শুধরে দিলো, “চকলেট কোনো বাংলা শব্দ না।ʼʼ
-“দ্যাহো! আরেক বেইমান হাজির। এ আবার দেশের সাথে না স্বয়ং ঘরের স্বামীর সাথে বেইমানী করা বেইমান।ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ এমনভাবে ইতস্তত করল, যেন সে বাড়িওয়ালার কাছে চুরি করার অনুমতি চাইবে। জয় বলল, “এমনি তো মুখটা হাওড়ার ব্রিজের মতো। এখন এমন লাউডগা সাপের মতো কুঁচকে যাবার কী হলো? কী সমস্যা?ʼʼ
-“আমার কিছু টাকা লাগবে।ʼʼ
অন্তূর টাকা চাওয়ার এই কঠিন সংকোচ দেখে জয়ের একটু হাসিই পেল, তাছাড়া আজ তার মনটাও ভালো। জিজ্ঞেস করল, “কী দরকার?ʼʼ
-“সব দরকার বলা যায়না। ফার্মেসির দোকান তো আছে আশেপাশে, না?ʼʼ
-“আমাকে বলো আমি এনে দিচ্ছি অথবা কাউকে দিয়ে আনিয়ে দিই।ʼʼ
-“তা যদি হতো, তো করতাম নিশ্চয়ই! টাকা দেবেন কি-না!ʼʼ
-“তোমারে টেকা-পয়সা দিয়ে পুষে আমার কী লাভ? লস প্রোজেক্ট মাল ঢালতেছি।ʼʼ
অন্তূ কথা বলল না। জয় সোফার ওপর উড়িয়ে ফেলে রাখা প্যান্টের দিকে ঈশারা করে বলে, “ওখান থেকে নাও।ʼʼ
মাত্র বিশটা টাকা অন্তূ বের করে নেয় হাতে, তবুও মনে হলো তার হাত কাঁপছিল, শিরশির করে কাঁপছিল, চোছে-মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল।
অন্তূ যখন রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, জয় মনোযোগসহকারে খাবার মাখাতে মাখাতে বলল, “বাপের বাড়ি যাচ্ছ।ʼʼ
অন্তূ পেছন ফিরল, অকপটে বলল, “হ্যাঁ।ʼʼ
জয় চোখ তুলে তাকায় না, অন্তূ বেরিয়ে যায় চুপচাপ।
জটিল এক সম্পর্ক-রেখার ওপর দৌড়ে কতদূর পৌঁছা যায়? মানুষের জীবন-পরিণতিতে নিশ্চিতভাবে মৃত্যু দাঁড়িয়ে, কিন্তু সম্পর্কগুলোর?
চলবে…
[টাইপিং মিসটেক থাকলে ক্ষমা করবেন।]