#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৭.
অন্তূর কাছে এ বাড়িতে আপাতত সবচেয়ে রহস্যমণ্ডিত মানুষ তুলিকে মনেহয়। সেদিন বলা কথাগুলো কেন যেন অন্তূকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি সত্যি হিসেবে। অন্তূর শাণিত চিন্তাধারায় কথাগুলো খুব অগোছালো আর বানোয়াটের মতো লেগেছিল। হামজাকে কিছু বলেনা, তুলি নিজের বাপকে কিছু বলেনা, জয়কে বললে টেনে হিঁচড়ে যেখানে পায়ের কাছে এনে ফেলবে, জয়কেও বলেনি! কারণটা খুব অপরিপক্ক লেগেছে। পালিয়ে বিয়ে করেছে। সেটা মেনে নেবার পরেও এই দ্বিধা! তার ওপর আবার হামজা নিজেই জোয়ান, তাগড়া পুরুষ। সে এই আধুনিক যুগের পুরুষ তার ওপর যে ফেরেস্তার মতো নৈতিকতা তার! সেখানে তুলির কথাগুলোতে অসংখ্য অসঙ্গতি ছাড়া বিশেষ কিছু পায়নি অন্তূ। আঘাতের দাগগুলো দেখালে সীমান্তর নামে কেইস হবে দশটা। তার ওপর সেই লোকই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে! অন্তূ একটুও বিভ্রন্ত নয়, তার হবু উকিল মাথাটা মোটেই মানতে পারেনা, আর না মেলাতে!
শাহানার অপারেশনের ডেইট ফিক্সড হয়েছে। তার আগে ওনাকে কিছুদিন মেডিসিনের ওপর রেখে ব্যথাটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সকাল সকাল হুমায়ুন দোতলার ব্যাকইয়ার্ডের খোলা জায়গায় বসেন। শাহানা এই শরীরেও স্বামীর জন্য বড়া এবং চা করে নিয়ে গিয়ে পাশে বসে রইলেন। দুজনের মাঝে কখনও ঝামেলা হতে দেখা যায়নি। পরস্পরের সবকিছুর ভাগিদার যেন দুজন। পাপ, দুঃখ, সুখ..সব। হুমায়ুন সাহেবের আজ ক’দিন পানের খুব নেশা জেগেছে। অন্তূকে ডাকলেন, “আরমিণ….আম্মা শুনতেছ?ʼʼ
-“জি, মামা। কিছু দরকার?ʼʼ
-“দুটো পান বানায়ে আন তো, আম্মা!ʼʼ
অন্তূ পান বানাতে পারেনা তেমন। তবুও চুন, সুপারি, জর্দা, খড়—সব দিয়ে দুটো পান বানিয়ে এনে দিলো। রান্নাঘরে রিমি খাটছে। এই মেয়েটাকে অন্তূর কেন জানি খুব ভালো লাগে। বলাবাহুল্য, অন্তূ বেশ খিটখিটে মেজাজের। কখনও কখনও তার মনের ভাবের সাথে মুখের আচরণের মিল পড়েনা। এটা হয় যখন সে কাউকে ঘেন্না করে। কারও প্রতি ঘেন্না জন্মালে তার সাথে আচরণে কপটতা চলে আসে। আবার ওর কথাবার্তাও খুব বিঁষঢালা টাইপের। যে যেমন, তার সাথে তেমন। কিন্তু রিমিকে ভালো লাগে ওর। বাপের বাড়িতে এত সমৃদ্ধি থাকার পরেও এ বাড়িতে সাধারণ বউয়ের মতো সারাদিন চারদিক সামলে চলে। কিন্তু হামজার সাথে সম্পর্কের সমীকরণটা খুব জট পাকানো। সব কাজ করছে, বউয়ের কর্তব্য পালন করছে চুপচাপ, কিন্তু সেখানে আন্তরিকতার বড্ড অভাব। প্রথমে মনে হতো, বাপের বাড়ির লোকের সাথে বিরোধিতার কারণেই বোধহয় হামজার ওপর ক্ষিপ্ত রিমি। কিন্তু এখন বিষয়টা আরও জটিল লাগে।
জয় বাড়িতে নেই আজ দু’দিন। কী কাজে বেরিয়েছে কোথায়! অন্তূ সারাদিন এ বাড়িতে টইটই করে ঘোরে। মনটা কী সব যে বলে যায়! তার মধ্যে বেশি যে কথাটা বলে—এ বাড়িতে তার আশেপাশে গা ঘেঁষে এমন বহুত ভয়ানক ব্যাপার আছে, যা তার খালিচোখে ধরা পড়ছে না। তবে যা চোখে লাগালে সেসব দেখা যাবে, সেটাই বা কী? সেদিন ঝাড়ু হাতে নিয়ে পুরো বাড়ি ঝাড়তে লাগল। কাজের মহিলাটা পিছে পিছে ঘুরেছিল ঝাড়ু কেড়ে নেবার জন্য। শেষ অবধি একটা ধমকও মেরেছে আ না পেরে, “আপনি আছেন বলে ব্যাপারটা এমন তো নয়, আমি কাজ করলে তা পাপের পর্যায়ে পড়ে। আরও কাজ তো আছে, সেগুলো করুন।ʼʼ
এ বাড়ির নকশাটাই অদ্ভুত। অন্তূ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এসব বড় বাড়ির নকশা তার কাছে অদ্ভুত লাগাটাই স্বাভাবিক। এদের কত রকমের ঘর, কত রকমের ইউনিট থাকে সব। বিশাল ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে লিভিং রুমের বাঁ দিকে পড়ে থাকা ঘর। ওটার পাশ দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে যে সরু রাস্তাটা গেছে, ওটাকে একটা চিকন বারান্দার মতোই লাগে। বাইরে থেকে বোঝা যায়না, দোতলা সাধারণ এই বাড়িটার ভেতরটা বেশ বিস্তৃত। অন্তূ সেদিকে এগিয়ে যেতেই সরু বারান্দার শেষ পর্যায়ে একটা কাঠের দরজা। কী সে কারুকাজ! এত ঝলমলে কারুকাজ দোতলার সদর দরজায়ও নেই। অন্তূ সেদিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে রিমির গম্ভীর ডাক শুনে থেমে গিয়েছিল।
-“এদিকে কী করছেন? এদিকটা পরিষ্কার। এখানে ঝাড়ু দেবার কিছু নেই।ʼʼ
অন্তূর পর্যবেক্ষক দৃষ্টি জড়িয়ে যায়, “আপনি কি কিছু লুকোচ্ছেন, রিমি?ʼʼ
-“কী লুকোচ্ছি?ʼʼ
-“সেটা আপনি বললে জানতে পারব।ʼʼ
-“আপনি যখন এটা বুঝছেন যে লুকোচ্ছি, তখন এটাও বোঝা উচিত যে কী লুকোচ্ছি! আমি জানি, লুকোচ্ছি না।ʼʼ
অন্তূ মৃদু হেসে উঠল, “এখানে আমি আবার আসব, তাও আপনি জানেন। চুপ থাকার সিস্টেম নেই আমার ভেতরে। জয় আমিরের মতো কথা শিখেছি, তাই না?ʼʼ
রিমি আনমনে হাসল, “আপনি সাধারণ মেয়ে, আরমিণ। হাত খালি আপনার, মেয়ে মানুষ আপনি। সাধারণভাবে বাঁচার চেষ্টা করলে বরং দীর্ঘজীবী হবেন। নয়ত ফুরিয়ে যাবেন।ʼʼ
-“চিরজীবী হতে পারব কীসে?ʼʼ
“সেটা তো হওয়া যায়না।ʼʼ
-“তাহলে আর দীর্ঘজীবন দিয়ে করব কী? আজ চুপচাপ বেঁচে থেকে যদি চিরদিন এভাবেই বেঁচে না থাকা যায়, বরং একদিন মৃত্যুর হাতে ধরা দিতেই হয়, তো কেননা আজ মরি! কিছু করে মরি? শোনেননি! কাল করবে তো আজ, আজ করবে তো এক্ষুনি। জীবনে মৃত্যু যখন অবধারিতই তো তা আজ হোক, আজ তো এখন!ʼʼ
রিমি সেদিন বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে বলেছিল, “জয়ের সাথে বিয়েটা স্বাভাবিক ছিল না, তাই না? কী করে আপনার মতো মেয়ে এই আগুনে এসে পড়ল বলুন তো?ʼʼ
অন্তূ মলিন হেসেছিল। কোনো জবাব দেয়নি।
—
কুড়িগ্রামের সেই জমি সাফ করতে গিয়ে অন্তূর চাচাতো ভাইকে বেশ ঘা লাগাতে হয়েছিল। সে স্থানীয় মাস্তান টেনে এনেছিল। তাদের সাথে একচোট ঝামেলা করতে হলো। ওখানে জয়ের দাপট কিছু ফিকে পড়ে গেছিল। তবুও শেষ অবধি রেজিস্ট্রি হলো। চার কাঠার বেশি জমি। পজিশন ভালো। তবুও অন্তূ যত আশা করেছিল, সেটা হয়নি। লাক্ষ বিশেক টাকার মতো এসেছে। অন্তূ জানে, জয় বিয়ে তোলার আগেই পলাশকে টাকা মিটিয়ে দিয়েছে। কারণ পলাশ আর ঝামেলা করতে আসেনি। বাকি টাকার খোঁজটা করার সুযোগ পায়নি।
রাত এগারোটা বাজলো দিনাজপুর পৌঁছাতে। পলাশ এ-সময় হোটেলে থাকে। টিপটাপ ছয়তলা হোটেল এপার্টমেন্ট। জয়কে দেখে পলাশ হাসল, “ভালো?ʼʼ
জয় মুখ কুঁচকে বলল, “আপনার কী অবস্থা? গন্ধ লাগতেছে নাকে, কী বালের পারফিউম মারেন গায়ে! এয়ার ফ্রেশনার মারেন, বালডা।ʼʼ
পলাশ হাই তুলে বলল, “ঘুম পাইতেছে রে। থাকবি এইখানে? চল রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি।ʼʼ
-“না। শ্বশুরের চেংরার ঋণ শোধ করতে আইছি।ʼʼ
পলাশ হো হো করে হাসল, “তুইও শেষ পর্যন্ত…শ্যাহ, বেটাছেলে মাইনষের জীবনডাই এরম। শান্তি নাই রে, খুব বেদনা।ʼʼ
-“ভাই, নাটক কইরেন না তো। আর কথায় কথায় হাসবেন না। জার্নি করে আসতেছি। কিছুই সহ্য হচ্ছে না গায়ে।ʼʼ
-“তুই আমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করিস, জয়। তবুও আমি কিছুই বলি না। এইটা আমার ভালোবাসা না?ʼʼ
-“স্বার্থ। আমি আপনার কাছে আসি, এইটা আমার স্বার্থ, আপনি এতকিছুর পরেও সব ভুলে চুপ থাকেন, এইটা আপনার স্বার্থ। ধান্দা চালানোর স্বার্থ। ভণ্ডামি কথাবার্তা ভাল্লাগতেছে না। কামের কথায় আসি।ʼʼ
পলাশ গি দুলিয়ে হেসে মাথা নাড়ল, “হু, আসি।ʼʼ
-“সেদিন আমার সম্বন্ধির বাড়ি গেছিলেন আবার?ʼʼ
-“যাওয়াটা কি অস্বাভাবিক? সেদিন তোর বউ বড় মুখে সময় নিলো আমার কাছে। তবুও এতগুলা দিন চুপ করে আছি। আমি দিনদিন ভালো হয়ে যাচ্ছি রে জয়।ʼʼ
-“গিয়ে কী করছেন?ʼʼ
-“তোর সম্বন্ধির বউ মনেহয় পোয়াতি, ঠিক না?ʼʼ কী যে নোংরা হয়ে উঠল এতক্ষণে পলাশের চাহনি।
জয় নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। পলাশ হাসছে, ভয়ানক হাসি, সেই হাসিতে কী যে হিংস্রতা খেলে যায়! দুজন লোক এসে কিছু স্ন্যাক্স আর হালকা ড্রিংক দিয়ে গেল। পলাশ বলল, “কত টাকা এনেছিস?ʼʼ
-“দাবী কত আপনার?ʼʼ
-“বেশি না। যা হয় তাই। কিন্তু গহনা ফেরত দিতে পারব না। তার বদলে তুই টাকা কেটে রাখ। গহনা খরচা হয়ে গেছে।ʼʼ
-“আরমিণের ভাবীর গহনা। ওইগুলা দেন। আমি কথা দিছি, নিজহাতে আপনারে টাকা পরিশোধ করে গয়না নিয়ে যাব। গয়না আরমিণের ভাবীর মায়ের বাড়ির। টাকা পাবেন, টাকা নেন।ʼʼ
পলাশ গম্ভীর হয়ে সোফায় দু হাত এলিয়ে বলল, “ইললিগেল কিছু করছি না। টাইম আপ। অর্থাৎ গহনা আমার। নিয়ম অনুসারে গহনা বিনা কথায় আমার। কিন্তু টাকা আমি গহনার দামের বেশি দিয়েছিলাম, বিধায় গহনার মূল্য মাইনাস করে তুই টাকা দিবি আমায়।ʼʼ
-“আজ আপনি জায়েজ, আমি না-জায়েজ, যান। টাকা পুরোটা নেন। খানিকটা বেশিই নেন। তবুও গহনা চাই। আমি কথা দিছি সেই কবে। এমনিতেই বহুদিন পার করছি বাটপারি করে।ʼʼ
পলাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তোর-আমার এতদিনের সম্পর্কে একটা মেয়ে আজ দিয়ে দু’বার ধাক্কা কষলো। খেয়াল করেছিস ব্যাপারটা?ʼʼ
জয় হাসল, “খালি আমার-আপনার না। ও আমার সাথে আরও অনেকের, অনেকের সাথে আরও অনেককে নড়িয়ে চড়িয়ে রেখে দিয়েছে। তবুও ওর মনেহয় ও কিছুই করেনি, ওর হাত শক্ত হয়নি। সামথিং হ্যাভ স্পেশাল ইন হার, ইস’নট দ্যাট?
পলাশ ঠোঁট কামড়ে হাসল, “আই অলসো একনোলেজড! বাট আ’ম ওয়ার্ন ইউ, ইউ’ল হোল্ড হার ডাউন অ্যা বিট। মেয়ে মানুষের ওড়াউড়ি দেখার অভ্যাস নেই আমার। ইউ নো ওয়েল, মেয়েলোকে কী পরিমাণ চুলকানি আছে আমার। হাউএভার, যদি এমন বেপরোয়া হয়; আই ইভেন ডোন্ট নোও, হাউ লং আ’ল বি এবল টু সাপ্রেইস টু মাইসেল্ফ অফ কাটিং হার স্কোয়ান্ড্যার..!
জয় ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেলো। হাতের কব্জি দিয়ে বাচ্চাদের মতো মুখটা মুছে বলল, “আপনি আরমিণের বাপের বাড়ি থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখুন, তাতেই চলবে। বাকিটা আমি সামলে নেব।ʼʼ
—
রাবেয়ার কণ্ঠে অভিমান, “মনে পড়েনা তোর আমাকে?ʼʼ
অন্তূ মৃদু হাসে, “মনে পড়ে। ভেতরে অনেক কথা আর ঝীবনের প্রতি ক্ষোভ জমেছে, আম্মু। আব্বু চলে গেল আমায় রেখে। বলার মতো কেউ নেই। তোমাকে বললে বোকার মতো চেয়ে থেকে শুনবে, বুঝবে না বিশেষ। তবুও দরকার তোমাকে। সামনে বসিয়ে কথাগুলো বলার পর যে, গালে-মুখে হাত বুলিয়ে চুল বাঁধতে বসবে, ওই আদরটুকু দরকার আমার। কিন্তু আসতে পারছি কই?ʼʼ
-“খুব কাজ নাকি রে ওইবাড়ি?ʼʼ
মলিন হাসল অন্তূ, বুঝতে দিলো না রাবেয়াকে, “অ-নেএ-ক কাজ, আম্মু। আম্মু, শরীর ভালো তোমার?ʼʼ
-“তোরে খুব দেখতে মন চায়, অন্তূ! একটুও ভালো লাগেনা বাড়িতে। তোর বাপ চলে গেল, তুইও ফেলে চলে গেলি, অন্তূ। আমারে জ্বালানোর মানুষ দুইটা নাই। কী করি ক তো সারিদিন? ফরমায়েশ খাটবো কার আর? কারা ধমকাবে আমারে? আমার দম আঁটকায়ে আসে রে, অন্তূ!ʼʼ
-“আরেকবার ডাকো তো অন্তূ বলে! এ বাড়িতে কেউ ডাকেনা এই নামে। তখন বুঝি এই ডাক যে কারও মুখের নয়, আমার লোকদের ডাক এটা। আরেকবার ডাকো..ʼʼ
-“তুই ভালো আছিস তো, অন্তূ!ʼʼ
-“খারাপ আছি নাকি? বড় দোতলা বাড়ি, অভাব-অনটন নেই, চিন্তাভাবনা নেই—বেশ চলছে, আম্মু।ʼʼ
-“সত্যিই বলতেছিস?ʼʼ
অন্তূর মনে হলো, তার বোকাসোকা, সরলা বাঙালি আম্মুটা বেশ বুঝমতির মতো কথা বলছে। শ্বশুরবাড়ির ঘানি টানা মেয়ের মায়েরা বুঝি মেয়ের কণ্ঠেই বহুত কিছু বুঝে ফেলার বিশেষত্ব ধারণ করে? অন্তূর এক দেহে বহু সত্ত্বার বাস। তার মাঝ থেকে এই মুহুর্তে কোমল, বাচ্চা সত্ত্বাটা খুব ধাক্কাধাক্কি করছিল। মনটা হাহাকার করে উঠছিল—এভাবে আব্বু কেন কল দেয়না! গম্ভীর কণ্ঠে কেন জিজ্ঞেস করেনা, “কবে আসবি এ বাড়িতে? আসা লাগেনা তোর মাকে দেখতে? তোর মা দেখতে চাইছে তোকে।ʼʼ
নিজের কথা বলবে না। চাপা স্বভাবের মানুষদের ভালোবাসা অন্যরকম সুন্দর হয়। অন্তূর গলি ধরে আসে। রাবেয়া ডেকে ওঠেন, “অন্তূ!ʼʼ
অন্তূর বুকটা ধুক করে ওঠে, “কী হয়েছে, আম্মা!ʼʼ
রাবেয়া চুপ থাকেন। অন্তূ বোঝে, কোনো বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছেন রাবেয়া। সে অভয় দেয়, “কী হয়েছে, আম্মু? কিছু বলবে? কী সমস্যা?ʼʼ
অবশেষে বলেন রাবেয়া, তুই না বলছিলি, পলাশরে টাকা দিয়ে এরপর কনে সাজবি…
-“হ্যাঁ, তো…ʼʼ গর্জে ওঠে অন্তূ। পর-মুহুর্তে জলের মতো শান্ত কণ্ঠে বলে, “পলাশ গিয়েছিল নাকি বাড়িতে?ʼʼ দৃঢ় বিশ্বাস নিজের ধারণায় অন্তূর।
রাবেয়া চুপ ওপাশে। অথচ অন্তূর ধারালো মস্তিষ্কের আন্দাজের সাথে রাবেয়ার অস্পষ্ট ফুঁপানো কান্না দুয়ে-দুয়ে চার মিলে যায়। অন্তূ হাসে মৃদু, আম্মু! টাকা দিয়ে দেয়া হয়েছে। ও এমনিই গিয়েছিল, হয়ত শয়তানী করতে। গিয়ে বলেছে নিশ্চয়ই, টাকা পায়নি? মিথ্যা বলেছে। আর যাবেনা। নিশ্চিন্ত থাকো। জয় আমিরকে বলে সেই ব্যবস্থা করব আমি।ʼʼ
রাবেয়া এরপর অন্তূর খোঁজ খবর জিজ্ঞেস করছিলেন, বিভিন্ন ধরণের কথা বলছিলেন অন্তূর সাথে। সেসব আর কানে যায়না অন্তূর। মাথাটা আওলে ওঠে। দ্রুত বলল, “পরে কথা বলব, আম্মু, এখন রাখি। মামা শ্বশুর ডাকছেন আমায়।ʼʼ
অন্তূ হিসেব মিলিয়ে নেয়—জয় মিথ্যা কথা বলেছিল। একটুও অবাক হবার মতো বিষয় নয়। বরং নিজের ওপর অবাক হলো, জয়ের কথা মেনে নিশ্চিন্তে থাকার কথা ভেবে। আক্রোশে মাথার চুল টেনে ধরে অন্তূ। না জানি পলাশ বাড়িতে গিয়ে কী করে। এসেছে! সে সময় নিশ্চয়ই অন্তিক বাড়িতে ছিল না!
যন্ত্রণা ওকে কত দূর্বল করে তুলেছে। ও কেবলমাত্র আব্বুর ক্ষেত্রে দূর্বল। সেখানেই বারবার আঘাত করা হয়েছে! পলাশের রুফটপে, সেদিন মানুষের সম্মুখে, হাসপাতালে, খাটিয়ার পাশে, জয় যেদিন কাছে এলো সেদিনও…ঘেন্নায় অন্তূর কান্না থেমে মুখটা কুঁচকে যায়। নিজেকে আবর্জনার চেয়েও বেশি ময়লা লাগে। সেদিনের মানসিক দূর্বলতা ওকে এতটা নিচে নামিয়েছিল, ভাবতেই গা শিরশির করে ওঠে। ছিহ! বারবার হাত দুটো নিশপিশ করে—সেদিন জয়ের রক্তাক্ত ক্ষততে একটা আঘাত কেন করেনি জয়কে? কতগুলো ছুরি গচ্ছিত রেখেছে নিজের কাছে, তার একটা জয়ের দেহে চালাতে পারেনি কেন? এরপর থেকে জয়কে রাতে মন ভরে মদ খেতে দেয় অন্তূ। বেশি খেলে সোফাতেই ঢলে পড়ে, এরপর নিশ্চিন্তে ঘুমানোর চেষ্টা করে সে।
জয় বাড়ির ফিরল রাত দুটোর দিকে। হুমায়ুন সাহেব দরজা খুলে দিলেন। দু চারটা কড়া কথাও শোনালেন। বিপক্ষ হলো শাহানা, “চুপ করো, তুমি। কী করছে এমন? একসময় নিজেই ঠিক হয়ে যাবে। বয়স কত হইছে ওর? ও আরমিণ? ঘরে তোলো তো জয়কে!ʼʼ
অন্তূ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ঘৃণায় চোখ বুজে গায় শ্বাস ফেলে অন্তূ। প্রশ্ন করে বাতাসকে, এই সকল নোংরা নারীগুলোকে তৈরী করতে নিশ্চয়ই কোনো নর্দমার মাটিই ব্যবহার করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা!
জয় ঝারা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে, “কী বালের আদিক্ষেতা দেখাচ্ছ? ছাড়োহ..ʼʼ
বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি নিয়ে এসে বিছানায় বসে অন্তূকে ডাকে, “ঘরওয়ালি! এক গ্লাস তেঁতুলের শরবত বানিয়ে আনো। দু ঢোক গিলেই শালার হ্যাংঅভার কাজ করতেছে!ʼʼ
অন্তূ সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়ছিলেন?ʼʼ
-“যা বললাম, তা করো আগে। পরে ইন্টারভিউ নেবে।ʼʼ
-“আমি যা বললাম, সেটার জবাব দিন।ʼʼ অন্তূর হুংকারে বদ্ধ চার দেয়াল গুঙরে উঠল যেন।
জয় মাথা তুলল, “তুমি কি চাচ্ছ আমি উঠি? এক ধাক্কায় দোতলা থেকে সরাসরি বেহেশতে পৌঁছে যাবে। নিষেধ করেছি না, চেঁচাবে না। কানে কোনো সমস্যা নেই আমার!ʼʼ
অন্তূ মুহুর্তের মাঝে মোটা কাঁচের ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে মারে জয়ের দিকে। ফুলদানিটা জয়ের কপালের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষততে লাগে। গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে, লুটিয়ে পড়ে জয় মেঝেতে।
পরক্ষণেই অন্তূর গা’টা শিরশিরিয়ে কেঁপে ওঠে, সে টের পায় সে হ্যালুসিনেট করছে। তীব্র ইচ্ছে বিভ্রম হয়ে চোখে ধরা দিচ্ছে। অসীম ধৈর্য্যের সাথে জিজ্ঞেস করে, “আপনার গালে জিহ্বা কয়টা?ʼʼ
-“আল্লাহর রহমতে একটাই। তোমার কয়টা, দেখি হাঁ করো তো!ʼʼ পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ে জয়।
-“কোথা থেকে আসছেন?ʼʼ
-“কত কাজই তো থাকে আমার। প্রতিদিন তো আর ঘরে বসে থাকিনা। আজ আর বিশেষ কী!ʼʼ
অন্তূ দাঁতে দাঁত ঘষে, “আই আস্ক টু ইউ এগেইন, হোয়ার ডিড ইউ গো? এবার মিথ্যা বললে, আল্লাহর কসম, আমি আপনার জিহ্বাটা টেনে আলাদা করে ফেলব কণ্ঠনালী থেকে।ʼʼ
জয় ভ্রু কুঁচকে উঠে বসে কিছুক্ষণ অবুঝের মতো চেয়ে থাকে অন্তূর দিকে। পরক্ষণেই ক্ষুধার্ত পশুর মতো উঠে দাঁড়িয়ে থাবা দিয়ে ধরে অন্তূকে, “বান্দির বাচ্চা! তোর কলিজা বের করে ওজন করে দেখব..আর একবার আওয়াজ করবি তো..ʼʼ
-“তোর মতো জানোয়ারেরা পারে কী? বাটপারি, চুরি-চামাড়ি, অবিচার, আত্মসাৎ করে লোকজনের মুখ খোলার আগে তাদের কলিজাটা বের করে মুখ বন্ধ করা! এই তো! আর কিছু পারলে তবে নাহয় করতি। আমার সাথেও নাহয় তাই করবি!ʼʼ
জয় অন্তূর গাল চিপে ধরল, “ভয় পাসনা কেন তুই আমাকে? আমি তোকে ছাড় বেশি দেই, নাকি তোরই ভয় কম? ভয় পাসনা তুই আমাকে?ʼʼ
-“তোর মতো রাস্তার ছেলেকে ভয় পাওয়ার আগে আমার শরীরটা শেয়াল-কুত্তায় ছিঁড়ে খাক। যে কথা রাখতে পারিস না, তার আশ্বাস কেন দিস? একটা ছুতো রেখেই দিয়েছিস, পলাশ জানোয়ারের আবার আমাদের বাড়িতে যাবার? প্রতিদিন কতলোকে মরে, দাফন হয়ে যায়, অথচ পলাশ অথবা তোদের মতো বেজন্মাদের হায়াৎ লম্বা।ʼʼ
জয় আস্তে করে ছেড়ে দেয় অন্তূকে। শান্ত স্বরে বলে, “বেজন্মা না, আমি। আমার থেকে ছাড় পাওয়া বন্ধ হলে কুকুরের মতোই ছিঁড়ে খাওয়া হবে তোমার পরিবারকে। এটা ভুললে চলবে না।ʼʼ
অন্তূ দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ে। চোখের পানি ছাপিয়ে কড়া কণ্ঠে বলে, “মেরে ফেলছেন না কেন? শুধু জান ছাড়া আর কিছুই তো বাকি রাখেননি! কী আছে আর আমার, আমার পরিবারের…! দুনিয়াটা আপনাদের। আমরা তো সব মাটির পোকা। আপনারা হাঁটছেন, পিষে মুচড়ে যাচ্ছি আমরা। এবার নাহয় কবর দিয়ে দিন। না সইতে পারছি, আর কিছু করতেও পারছি না। এটা বড় যন্ত্রণার।ʼʼ অন্তূ মাথাটা দেয়ালে এলিয়ে দেয়।
জয় চেয়ে থাকে অন্তূর মলিন মুখশ্রীতে। এখন শান্ত, অথচ মিনিট খানেক আগে বাঘিনীর মতো গর্জন করছিল। বহুরূপিণী। জয় চোখ ফেরায় না। অন্তূ ছাদের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে চলে, “র-ক্তের ভাইকে ক্ষমা করিনি। যদিও ও যা করেছে ইচ্ছে করে করেনি। অথচ আপনি, পলাশ, হামজা পাটোয়ারী যা করছেন, সব পরিকল্পনামাফিক, নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে। কিছুই ছাড়লেন না! আর কত, জয় আমির? পলাশকে প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে না, ও দূরে আছে। অথচ আপনি রোজ সামনে আসেন, এক ঘরে, এক ছাদের নিচে। আমার-আপনার সম্পর্কের নামটাও কী জঘন্য! চ্যাহ! সহ্যের সীমা মাপার ফিতা দরকার। আমি একটু বেশই ধৈর্য্যশীল, তাই না?ʼʼ
জয় চুপচাপ চেয়ে থাকে। অন্তূর চোখের কোণা পেরিয়ে একফোটা জল গড়াতে যাচ্ছিল, অন্তূ সেই নোনাপানিটুকু আঙুলে মুড়ে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যেন কোনো অপবিত্র, নোংরা কিছু চোখে বিঁধে ছিল।
জয় কপালে হাত চালিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে। বেড-সাইড টিবিলের ওপর থেকে হ্যান্ড প্রেসিং বলটা তুলে হাতের মুঠোয় চাপতে থাকে বারবার। অন্তূ চোখ বুজে বসে থাকে মেঝেতে। অস্পষ্ট স্বরে বিরবির করে, “আব্বুকে মেরে ফেললেন আপনি! অথচ কায়দা এত নিখুঁত, দোষ দেয়া যায়না আপনাকে। ঠিক আজরাইলের মতো। মানুষ মরলে কেউ আজরাইলকে দোষ দেয়না। দোষ হয় রোগ অথবা মৃত্যুর কারণের। বোকা মানুষ জাতি ভুলে বসে, রুহুটা নিয়ে গেছে সৃষ্টিকর্তার দূত। আমার পর্দা কেড়ে নিলেন! উহু, বিনা কারণে নয়। কারণ আছে অবশ্যই! জানেন? একবার থুতু দিয়েছিলাম আমি আপনাকে। অন্যকেউ হলে কী করতো? হয়ত একবারের বদলে দুবার, আচ্ছা তিনবার থুতু দিতো আমার মুখে। কিন্তু যেখানে কথা জয় আমিরের… আপনার ওপর মুগ্ধতা জমানোর একটা বাক্স কিনতে চাইছি। আপনি এত চমৎকার কেন? আর পাঁচটা মানুষের সাথে আপনার বিকৃত মস্তিষ্কের জিদেগুলোর একটুও মিল নেই। পুরোই ডিফরেন্ট!ʼʼ
—
অন্তূ নিয়ম করে বাগানে যায় আজকাল। ওই লোহার লাল গেইটটা! অন্তূ রোজ যায় একবার করে। ফেরার সময় এক পুরুষকে ঢুকতে দেখা গেল। হাতে কয়েকটা ব্যাগ। অন্তূর দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। লোকটাকে উঠে যাবার সুযোগ দিয়ে নিজে ওয়ার্কশপের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে পরে উঠে এলো দোতলায়।
পরে জানা গেল, এটাই তুলির স্বামী। হুমায়ুন সাহেব ডেকেছেন। হামজা এসে বসল। কোয়েল দৌড়ে এসে আব্বুর গলা জড়িয়ে ধরে কোলে চড়ে বসে। এক ব্যাগ চকলেট ও বিভিন্ন খাবার-দাবার ধরিয়ে দিলো সীমান্ত। হাস্যজ্জ্বল চেহারা। কথাবার্তা কী সুন্দর করে বলছে কোয়েলের সাথে। বুকের সাথে জাপটে ধরে বসে আছে মেয়েকে।
অন্তূর ফের সন্দেহ হয়—এই লোক এত খারাপ? আসলেই? মারধর, নেশা-ভাং, ডিভোর্স!
বৈঠকে জয় নেই। ক্লাবে গেছিল সকালে। গতকাল এক মিছিল শেষে হানহানি হয়েছে। কার নাকি বুক ফুঁড়ে গুলি চলে গেছে। বেশ কয়েকজন আহত বিরোধীপক্ষের হামলায়। এসব অবশ্য হামজার পার্টির সাথে হয়নি। হয়েছে সংসদ সদস্য মহোদয়ের বাড়ির সামনে। সেখান থেকে জয় যাবে ভার্সিটিতে। সুতরাং সে এই বৈঠকে নেই বরাবরের মতো।
তরু চা বানিয়ে দিলে, অন্তূ তা ট্রে-তে তুলে, নাশতা সাজিয়ে এনে সোফার সেন্টার-টেবিলে রাখে। কথা তুলল হামজা, সরাসরি বলল, “দেখ সীমান্ত, সংসারে ঝামেলা সবার হয়। কিন্তু ডিভোর্সের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না! আমি অবুঝ নাকি ঘটনা বেশি জটিল? তোর এরকম সিদ্ধান্তের বিশেষ উপযুক্ত কারণ খুঁজে আজ দু’দিন এত হাঙ্গামার মাঝেও বেশ হয়রান আমি।ʼʼ
সীমান্ত চুপচাপ বসে রইল। আর কোনো মেয়েলোক নেই বৈঠকে। অথচ অন্তূ দাঁড়িয়ে রইল ট্রে হাতে নিয়ে। হামজা বলতে পারল না সরাসরি, বারবার আড়চোখে তাকালো, অন্তূ সেসব অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে রয়। শাহানা কাশতে কাশতে এসে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙে হুমায়ুন বেশ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। শাহানা বেশ কোমল স্বরে বললেন, “তুমি জানো সীমান্ত? তুমি আবার বাপ হইযে যাইতেছ, এই সময় এইসব….ʼʼ
-“ওটা আমার বাচ্চা না।ʼʼ
ঘরটা থমকে যায় সীমান্তর ছোট্ট একটা বাক্যে। অন্তূ কিঞ্চিৎ ভ্রু জড়িয়ে ফেলে। বসার ঘরে থাকা পুরোনো ঘড়ির পেণ্ডুলাম ঢং-ঢং করে বেজে উঠে জানান দেয়—বিকেল ০৪:০০ বাজছে।
চলবে..
[টাইপিং মিসটেক থাকলে ক্ষমা করবেন। আজকের পর্ব অতিরিক্ত খাপছাড়া, এলোমেলো লাগতে পারে। আমার নিজেরই পছন্দ হয়না এই পর্ব। একটু মানিয়ে নিন। এডিট করব বলে দিতে দেরি করি। অথচ যেমন লেখা ছিল, ওমনই দিয়ে দিলাম🙂❤️]