#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৮.
হামজা নীরবতা ভাঙল, “তোর বাচ্চা না, কার বাচ্চা?ʼʼ
সীমান্ত একটু নড়েচড়ে ওঠে এবার। ঢোক গিলল কয়েকটা, ঠোঁট চাটলো জিভ দিয়ে। মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “আমি তুলিকে তালাক দিতে চাইনি, ভাই। আর না আমি ওকে পাঠিয়েছি এ বাড়িতে। ও নিজে চলে এসেছে এখানে, ডিভোর্স ও চায়…ʼʼ সীমান্তর কথায় জড়তা।
হামজা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। গলা উঁচিয়ে ডাকল তুলিকে। বজ্রের মতো শোনা যায় কণ্ঠস্বর। তুলি যন্ত্রের মতো হেঁটে এসে বসে। তার মুখের সেই মেকি হাসি নেই, যেটা সবসময় অন্তূ খেয়াল করেছে। মনে হয়েছে, খুব ধৈর্য্যের সাথে তুলি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যেন। হামজা জিজ্ঞেস করল, “এবার বল, কী সমস্যা? মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারাবো খুব তাড়াতাড়ি। কী হয়েছে তোদের, সমস্যা কী?ʼʼ
তুলি চুপ থাকে। হামজা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। কেউ কোনো কথা বলল না। হামজা অপেক্ষা করে চুপচাপ। সীমান্তর চোখে-মুখের কাতর অস্থিরতা হামজার জহুরী চোখ এড়ায় না। অন্তূর দৃষ্টি সীমান্তর চোখে স্থির। ওর চোখে ভয়, আতঙ্ক।
-“কী হয়েছে, তুলি? থাপড়ে কথা বের করার স্বভাব কিন্তু পুরোনো আমার।ʼʼ
তুলি খানিক সময় নিয়ে বলে, “মেয়ে হবার পর শ্বশুর বাড়ি থেকে ও আমাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। রোজ ফ্ল্যাটে পার্টি হতো। সেখানকার মদ পরিবেশক অথবা বাইজি যাই বল, সেটাই ছিলাম আমি। দিনের পর দিন পর পুরুষের ছোঁয়া লেগেছে আমার গায়ে ওর সামনে। ও যেন তাতে আনন্দ অনুভব করতো। কারণ ওর আনা বন্ধুরা মদের সাথে আমার শরীর ছুঁয়ে যে আনন্দটা পেতো, সেটা হলো অতিথি সেবা। অতিথিকে ঘরে আনলে তাকে সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করাই তো ভদ্রলোকের নীতি। সেটাই করা হয়েছে। মদের সাথে আমি ফ্রি।ʼʼ
এ পর্যায়ে হুমায়ুন সাহেব উঠে চলে যান। শাহানা উশখুশ করছিলেন। অন্তূর শরীর অবশ লাগছিল। পা দুটোতে ঝিঝি ধরে যাচ্ছিল তুলির মুখের এসব গা শিউরে ওঠা কথা এত সাবলীলভাবে শুনে। এরা কি মানুষ? সাধারণ সমাজের সভ্যতা থেকে কতটা বিমুখ এরা! দুনিয়াতে কত কিছু ঘটে রোজ, অন্তূর মনে হতো সেসব শুধু সংবাদপত্রেই লেখা থাকে। জয়ের সাথে দেখা হবার পর থেকে সংবাদপত্রের খবরগুলোকে খুব সাধারণ মনে হয়, বরং মনে হয় বাস্তবতা এর চেয়েও কলুষিত।
তুলি আনমনে বলল, “এ বাচ্চা কার, আমি নিজেও জানিনা। মাতাল হয়ে বেহুশে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীর সামনে রাতের পর রাত ধ-র্ষি-তা হয়েছি। কার বা বাচ্চা, কীভাবে বলি?ʼʼ
অন্তূর শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। হাতের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। দু আঙুলে সজোরে কপাল চেপে ধরে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে। এরপর যা হবে তাও আশাতীত ছিল। হামজা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ মেঝের দিকে চেয়ে থাকল। সীমান্তর শরীরটা ঘেমে চুইয়ে পড়ছিল। চোখে-মুখে নিদারুণ কাঁকুতি। ভদ্রলোকের পোশাক ও চালচলনের মাঝেও চোখদুটো লাল। অর্থাৎ এখনও বোধহয় নেশার প্রভাব আছে শরীরে। নীরব ঘরটায় ওর হৃদস্পন্দন কানে ধরার মতো। হামজা ঝুঁকে পড়ে সেন্টার টেবিলের পা-দানি থেকে চাপ্পর তুলে নেয়। পশুর মাংস ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয় এই অস্ত্র। তুলি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। কোয়েল যেতে চাইছিল না। বারবার ডাকে, “বাবা, বাবা…মাম আমাকে নামাও, আমি বাবার কাছে বসব..ʼʼ
শাহানা অসুস্থ পায়ে উঠে চলে গেলেন তুলির পেছনে। অন্তূ ঠাঁই দাঁড়িয়ে। হামজা সীমান্তর শরীরে মোট চারটা কোপ বসায়। তার সাদা টি-শার্টের সামনের দিকটা নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। অন্তূ চোখ ফেরায় না। তার হাতের কব্জির ওপর ছিটে এসে লাগে গরম তরতরে তরল রক্ত। এভাবে সে কোরবানীর ঈদে বাড়ির সামনে কত কসাইকে গোটা গরু জবাই করে মাংস বানাতে দেখেছে। হামজাকে একজন দক্ষ কসাইয়ের মতো লাগে দেখতে। পুরো হাতে মুখে রক্ত, চাপ্পরের ধারালো প্রান্ত ঢেকে গেছে রক্তে। সোফা থেকে এলিয়ে পড়ে সীমান্তর দেহটা। পুরোপুরি পড়ে যাওয়ার আগে রক্তাক্ত চাপ্পরটা বগলে গুঁজে সীমান্তর দেহটাকে ভালোভাবে যত্ন করে সোফায় হেলান দিয়ে বসায়। ঘাঁড়ে দুটো কোপ লেগেছে। প্রথমটাতে মৃত্যু নিশ্চিত। তার পরের আঘাতগুলো করার সময় হামজার মুখে এক প্রকার তৃপ্তি খোঁজার আভাস পাওয়া যায়।
সোফায় বসে কোনো নম্বরে ডায়াল করে স্পিকার লাউড করে বেসিনের দিকে যায়। তৃপ্তি করে খাওয়ার পরে মানুষ যেমন হাত ধোঁয়, সেভাবে পানি গড়িয়ে হাত ধোঁয়, চাপ্পরে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে এনে ফোন কানে নিয়ে বলে, “কয়েকজন ছেলেকে পাঠা।ʼʼ
হামজা সোফায় মাথা এলিয় বসে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে অন্তূ। তার সীমান্তর মৃত্যুর জন্য খারাপ লাগছে না, খুব ভালো লাগছে। হামজার ভূমিকাটাও ভালো লাগছে আজ প্রথমবারের জন্য। স্বামী হিসেবে সীমান্ত যা করেছে, তার পেক্ষিতে ভিক্টিম হিসেবে তুলি ও তার বড় ভাই হিসেবে হামজা আজ যা করল, তা অন্তূর ভেতরে দারুণ এক শক্তি ও মুগ্ধতা কাজ করাচ্ছিল। এভাবে যদি এই জাতের সকল পুরুষ বলি হতো, এমন পুরুষের সংখ্যা ভয়ে হলেও বেশ কমে আসতো। খুব ভালো লাগছিল সীমান্তর ঘাঁড় বেয়ে জমাট বাঁধা রক্তের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া নতুন রক্তের প্রবাহ দেখতে। আর দু একবার জীবিত করে আরও দু তিনবার এভাবে মারলেও অন্তূ ঠিক একরকম তৃপ্তি পেত যেন। কিন্তু আফসোস এক জায়গায়, এভাবে অন্তূ জয়কে মারতে পারেনি। সম্মানহানী মানুষ হত্যার সমান। যেটা জয় করেছে, হামজা সেটাকে সাপোর্ট দিয়েছে। অন্তূর কি উচিত নয়, হামজা, জয়, পলাশকেও এরকমই এক প্রকার মৃত্যু দেয়া! অন্তূর লজ্জা লাগল। সে হামজার মতো শক্তিমান নয়! ধিক্কার জানালো নিজেকে। হামজা খুব ভালো। কী চমৎকার একটা বিচার করল নিজের বোনের ক্ষেত্রে। আর অন্তূ নিজের জন্য কিছু করতে পারেনি।
ছেলেরা এলে হামজা আদেশ করে, “রাতে এটাকে ভার্সিটির পুরোনো আমবাগানের ঝোপে ফেলে আসবি।ʼʼ
রিমি পেছনে এসে কখন চুপচাপ দাঁড়িয়েছে, টের পাওয়া যায়নি।
—
আছরের নামাজ পড়তে যাচ্ছিল লোকজন। জয় ফটকের সামনে দাঁড়ানো। রাস্তার ওপারে দোতলায় ভাড়াটে একটা মেয়ে আছে। বয়স পনেরো-ষোলো। জয়কে ফলো করে সুযোগ পেলেই। উড়ন্ত জয়কে দেখতে পাওয়া বেশ মুশকিল। আজ জয়কে দাঁড়াতে দেখে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কত ভালো ভালো ফরমাল পোশাকের ছেলেদের ওপর এমন আকর্ষণবোধ না করার জন্য অবশ্য আফসোসও হয় ওর। জয় ফোনে কথা বলছিল দাঁড়িয়ে। সাধারণ একটা শার্ট গায়ে। সাদা লুঙ্গি পরনে, তা মাটি ছুঁয়ে পরে সবসময়। ডান হাতে লুঙ্গি উঁচু করে ধরে দাঁড়ানোতে পায়ের চামড়ার বেল্টওয়ালা চটি দেখা যাচ্ছে। সেটার বেল্ট আঁটকায়না, খোলা। লম্বা শরীরে সাদা লুঙ্গি, শার্ট, চামড়ার স্যান্ডেল খুব মানায় জয়ের সাথে। তার চলাফেরাই এমন। ভদ্রলোকি পোশাকে নিজেকে সাজাবার যেন কোনো তাড়া নেই। এই পোশাকেও চমকপ্রদভাবে ভীষণ অভিজাত পুরুষ লাগে দেখতে। লুঙ্গি হাতে গুছিয়ে ধরে দুই ঠ্যাঙের মাঝে গুঁজে দাঁড়াচ্ছে বারবার, তবুও উঁচু করে পরছে না। মেয়েটার কাছে সবকিছুই আকর্ষণীয় লাগে।
অন্তূ বিষয়টা বারান্দা থেকে খেয়াল করে তাচ্ছিল্য করে হাসে। মানুষ সেই সকল আলুর মতো, যা খোসার ওপর থেকে দেখতে শতভাগ সতেজ এবং কাটলে পুরোটাই ফেলে দেবার অবস্থা বেরোয়। এমন আলু আম্মুকে কাটতে দেখলে অন্তূ ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো। ওপর থেকে আন্দাজ করার উপায় নেই, ভেতরটা এতটা কুৎসিত।
গাড়ি চলে যায় রাস্তা দিয়ে। পাড়ার কুকুরগুলোর সাথে জয়ের সম্পর্ক খুব ভালো। রুটি, চা, মাঝেমধ্যে কোল্ড ড্রিংসও টেস্ট করতে দেয় জয়। মাঝেমধ্যে কুকুরগুলোকে মদেও চুমুক দিতে হয় জয়ের বদৌলতে। বাড়িতে খাওয়া মাংসের হাড়গুলো জড়ো করে নিয়ে গিয়ে কুকুরকে দেয়। দারুণ পিরিত তার কুকুরের সাথে। জয়কে দেখে রাস্তার ওপর ঘুরঘুর করছিল আজও কুকুরগুলো, বাচ্চাকাচ্চাসহ।
কপালের ক্ষততে টান ধরে মাঝেমধ্যেই। গভীর ক্ষত শুকিয়ে গিয়েও জখম হয়ে আছে। সেখানে আঙুল চেপে ধরে রইল। যারা আক্রমণ করেছে সেদিন, মা-বাপ তুলে খাঁটি বাংলায় গালি ঝারছিল। তখনই শোঁ করে একটা বাইক চলে যায়। সজোরে ধাক্কা খায় একটা বাচ্চা কুকুর। জয় তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে বকে ওঠে বাইকওয়ালাকে, “এই শালির ছাওয়াল, বাইঞ্চোদ! ভ্যাড়াচ্চুদা শালা.. ধর শালারে..ধর..ʼʼ
ততক্ষণে বাইকওয়ালা আরও জোরে বাইক টেনে চলে গেছে। জয় দৌড়ে যায় কুকুরটার কাছে। মা কুকুরটা করুণ চোখে বাচ্চাকে দেখে এগিয়ে আসে। জয় তুলতে গেলে হাঁ করে কামড়াতে আসলেও জয় কোলে তুলে নিয়ে ফটকের ভেতরে নিয়ে এসে ঘাসের ওপর শোয়ায়। ছোট্ট কুকুরটায় পিঠের মাংস ছিঁড়ে গেছে রাস্তার ঘর্ষণে। অন্তূ দৌড়ে নেমে আসে দোতলা থেকে। জয় উত্তেজিত হয়ে বলে, “ঘরওয়ালি, কুত্তারে কি ডেটল-ফেটল বা স্যাভলন লিক্যুইড টাইপ কিছু দেয়া যায়?ʼʼ
-“প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সেটাই দিতে হবে। ভ্যাটেনারীর সরঞ্জাম তো আর নেই আমাদের কাছে।ʼʼ
-“তো নিয়া আসো! চেহারা দেখতেছ আমার? এমনি সময় তো তাকাও না!ʼʼ
অন্তূ চলে গেলে বিরবির করে বলে, “এজন্যেই মেয়েলোকের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে!ʼʼ
জয় যত্ন করে ডেটল লিক্যুইড লাগায়। অন্তূর কেমন ঘোর লেগে আসে চোখে। বড় কুকুরটা অস্থির হয়ে ঘুরঘুর করছে বাচ্চার পাশে। একবার জয়ের গা ঘেঁষছে, আবার মুখ ঠেকাচ্ছে বাচ্চার শরীরের সাথে। অন্তূর বুকে ব্যথা ওঠে। আব্বুর মুখটা বুকের মাংস খাবলে ধরে। জয় কোলের ওপর ছোট্ট কুকুরটাকে রেখে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। অন্তূ বসে পাশে। একটু দ্বিধা নিয়ে হাত বাড়াতে যায় কুকুরের দিকে। আবার গুটিয়ে নেয়। ভয় হয়, যদি কামড়ে দেয়! জয় বলে, “থাক, হাত দিও না। হাতে নোংরা লাগবে। ভয় পাচ্ছ যখন, তখন আর ন্যাকামি করতে হবে কেন? ওড়না ভালোভাবে মাথায় টেনে নাও, অর্ধেক চুল তো বের হয়েই আছে।ʼʼ
অন্তূ গাঢ় চোখে তাকিয়ে ব্যঙ্গ হেসে বলে, “শয়তানও বোধহয় আপনাকে দেখে ভাবে, যখন আপনাকেই তৈরি করা হবে, তখন তাকে বানানোর কী দরকার ছিল?ʼʼ
কুকুরের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে জয়, “ওরে শালি! আয় তাইলে আইজও লোক জড়ো করে খুলে ফেলি ওড়নাটা?ʼʼ
-“তা বোধহয় করবেন না। আজ তো আবার ওই একটা তথাকথিত পরিচয় আছে আমার! আপনার বউ। তো আমার ইজ্জত গেলে আগে যাবে আপনার। আর আপনাদের কাছে তো স্বার্থপরতাও লজ্জা পেয়ে যায়। আপনাদের বাড়ির মেয়ের ইজ্জত দামী। আর আমার বাপের মেয়ের ইজ্জত থুতুর বদলা নেবার উপাদান! এই দেখুন, এখন আমার আবার ইচ্ছে করছে, থুহ করে একদলা থুতু আপনার মুখে ছুঁড়ে মারতে। শ্যাহ! কী বলব বলুন, জয় আমির! গালে আমার একমুঠো আউশ চাল।ʼʼ
অন্তূ আর দাঁড়ায় না কথাগুলো বলে।
—
তুলি এবং শাহানাকে একসাথে ভর্তি করানো হবে হাসপাতালে। তুলির এবোর্শান, শাহানার চিকিৎসা।
খানমান পাতার সাথে কালোজিরে ভর্তা জয়ের খুব পছন্দের। সেটা ভেজে রেখে অন্তূ কোয়েলকে গোসল করাতে যায়। তুলির অসুস্থতা বেড়েছে খুব। গোসল করাতে করাতে বেশ আনমনা হয়ে পড়ছিল অন্তূ। আজ কয়টা দিন ধরে এত বেশি চাঁদনীর কথা মনে পড়ে। আঁখির লাশ, সালমার কান্না, সোহেলের মৃত্যু! অন্তূর পাগল পাগল লাগে। এত এত জটিলতা! কতরকমের কত কী বয়ে চলতে হচ্ছে, এবং স্বাভাবিকভাবে। জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াইটা কতটা সুখকর হবে? চাঁদনী কোথায় গেছে? কী হয়েছে ওদের? মুস্তাকিনের সাথে দেখা নেই কতদিন! সেই লোকই বা কী করছে?
রান্নাঘর থেকে শিল-নোড়ার আওয়াজ আসছিল। অন্তূ ব্যস্ত হয়ে বলল, “তরু, এটা আমার কাজ। তুমি কেন করছো? আমি বাটবো, তার আগে কোয়েলকে গোসল করিয়ে এলাম। ওঠো তুমি, আমি করছি।ʼʼ
ভাত উতলাচ্ছিল চুলোয়। আঁচ কমিয়ে দিল অন্তূ। তরু বলল, “অধিকার নেই, তাইনা?ʼʼ
-“এগুলো নাটকীয় ভাবনা। আমি নাটক এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। তুমি বোধহয় জানো, জয় আমিরের সাথে আমার তেমন সম্পর্ক না। তবে তথাকথিত সম্পর্কের জের ধরে এসেছি যখন এ বাড়িতে, কাজটাও আমারই। তুমি করছো, আমার ভালো লাগছে না বিষয়টা।ʼʼ
-“তুমি আমার সাথে যে ভালো আচরণটা করো, সেটা মন থেকে করো, নাকি লোক দেখানো?ʼʼ
অন্তূ মুচকি হাসল। অল্প একটু লবন তুলে পাটায় দিলো। তরু আজ প্রথমবার খেয়াল করল, অন্তূ হাসেও। খুব নিষ্পাপ হাসিও হাসতে জানে এই মেয়ে। তখন এত স্নিগ্ধ লাগে! অথচ সবসময় মুখটা কেমন গম্ভীর, আর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে। আজ নতুন এক অন্তূকে দেখে তাকিয়ে থাকে। অন্তূ হাসি ঠোঁটে রেখে বলে, “আব্বু কী বলতো জানো? আব্বু বলতো,
‘তুমি একটি সতন্ত্র আয়না হও
মানুষ তোমার সম্মুখে যে অঙ্গভঙ্গিতে এসে দাঁড়াবে,
তুমি ঠিক তার প্রতিবিম্ব হয়ে যাও।
লোকে যা করবে, সেটাই তুমি নিজের মাঝে দেখিয়ে দাও।ʼ
আমি কথাটা খুব মানি, তরু।
‘আমার সম্মুখে কেউ উষ্ণ, আমি গরম
সে ঠান্ডা, আমি শীতল
সে কঠিন, আমি নিষ্ঠুর
সে ব্যথিত, আমি ব্যথাতুর!ʼ
তুমি কখনও খারাপ আচরণ করোনি আমার সঙ্গে। তুমি কষ্টগুলোকে ভেতরে পুষে ধুঁকে ধুঁকে সঁয়েছ। তুমি ছিলে নীরব। তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করার প্রশ্নই ওঠেনা। বরং তুমি যদি চাও, আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি। তুমি আমার ছোট-বড় নও, সমবয়সীই হবে, রিমি ভাবীর মতো। বন্ধু হবে?ʼʼ
তরুর হাত থমকি গেল। অন্তূর মতো একগুঁয়ে, গম্ভীর মেয়ের কাছে বন্ধুত্বের প্রস্তাব আশাতীত লাগে তার কাছে। অন্তূকে প্রথমদিন থেকে খুব চাপা আর অদ্ভুত মেয়ে হিসেবে দেখেছে। আজ খুব অন্যরকম লাগল। ওকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্তূ হাসল, “হবে তোমার আমার ওপরে অনেক ক্ষোভ। কিন্তু আমি যদি বলি, আমি তোমার সবচেয়ে সবচেয়ে উপকারী মানুষটা! মানবে?ʼʼ
তরু জবাব দিলো না। অন্তূ ঠোঁট প্রসারিত করে প্রলম্বিত মুচকি হেসে বলল, “ধরো, তোমার দিকে একটা বিষধর সাপ এগিয়ে আসছিল তোমাকে বিষদাঁত ফোটাতে। তুমি তাকে সাদরে আহব্বান করছিলে, কারণ তোমার ধারণায় সে বিষধর নয়। মাঝখান থেকে আমি সাপটার লেজে পাড়া দিয়েছি। সাপ তখন কী করল বলো তো! তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে ছোবলটা আমায় মারল। বুঝতে পারছো আমার কথা? অজান্তেই জয় আমিরের লেজে পা রেখে তোমার ছোবলটা বোধহয় আমি খেয়েছি। একটা মানুষকে আমরা চেনার বাইরেও তাকে চেনা এবং জানার মতো বিস্তৃত ব্যাপার থাকতে পারে। ঠিক যেমন আমি যেটুকু জানিনা বা বুঝিনা, তুমি ঠিক সেটুকুই জানো জয় আমিরের ব্যাপারে। অপরদিকে তুমি যেটুকু জানো বা ধারণা নেই সেইটুকুই আমার জানা এবং দর্শনে জয় আমির।ʼʼ
অন্তূ ভাত মার ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তরু বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে অন্তূর দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “জয় ভাইয়া কী করেছে তোমার সাথে?ʼʼ
অন্তূ মনোযোগ সহকারে ভাতের মার ফেলতে ব্যস্ত। তরু উত্তরের আশায় চেয়ে থাকে।
—
হুমায়ুন সাহেব টিভিতে খবর দেখেন, আবার রোজ নিয়ম করে পত্রিকাও আসে বাড়িতে। হামজার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে। রিমি সেগুলো জড়ো করে পত্রিকার ঝুড়িতে রাখে। সেখান থেকে অন্তূ এনে পড়ে। রোজ রোজ সহিংসতা, খু-ন, ফাঁসি, বোমাবাজি, হামলা, অবিচার…২০১৫ এর ফেব্রুয়ারিটা এই করেই চলে গেল। ২০১৪ এর নির্বাচনের বছরপূর্তিতে দেশ এতটা উত্তাল হয়ে উঠছে কেন, তার জবাব আছে, তবে সেসব ব্যাখ্যা না করা ভালো। বিরোধী দলীয় চেয়ারপার্সন অবরুদ্ধ, মহাসচিব গোয়েন্দা দফতরে আঁটক। তাদের রুখতে প্রসাশনের সাথে সাথে রাজনৈতিক কর্মীরাও সমানতাল দিয়েছে। অন্তূ ভাবে এর মাঝে কি জয়, হামজা নেই? এরা বিরোধী দলকে থামাতে কিছু করছে না? গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেয়া, অবরোধ চলছে তো চলছেই।
প্রশাসনের চেয়ে এগিয়ে আছে রাজনীতিবিদরা। তারা প্রতিরোধে নেমেছে। কয়টাদিন জয়, হামজাকে দিন-রায এক করেও বাড়িতে পাওয়া যায়না। মিছিল যায়, অন্তূ তা ঘরে বসে শোনে। জয় ফুরুৎ করে আসে। গালে মুখে কয়েক মুঠো গিলে, পোশাকটা পরিবর্তন করে বেরিয়ে পড়ি ফের। কোথায় যায়, কী করে সেসবের খবর নেই। মহাব্যস্ত তারা। বিরোধী দলকে রুখতে তাদের পায়ের সুঁতো ছিঁড়েছে। এদে, কিছু না। এরা মরল, বাঁচল সবই এদের হাতে কামাই। শিকার সাধারণ মানুষ। রাস্তায় নিরাপত্তা নেই, চলাচলে শান্তি নেই, সারাক্ষণ আতঙ্কে রাস্তাঘাট জর্জরিত। এই বুঝি আগুন জ্বলে উঠল, লেগে গেল মারামারি। পুলিশ এলো, গোটাকয়েক লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে চলে গেল। তখনও রাস্তার মাঝে আগুন জ্বলছে, গাড়ি পুড়ছে, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি মিশছে বাতাসে।
ফের যেন ২০১৩ ফিরল ফিরল রব। চারদিকে হাহাকার, রক্ত, আর বন্দিত্ব। আবার সেই ২০১৩, আবার ফাঁসি, আবার গ্রেফতার…!
অন্তূ জয়ের রকিং চেয়ারটায় বসে রাতের পর রাত ভাবে, আর দোলে। তার চোখে ঘুম নেই। মাঝেমধ্যে আব্বু এলে কথা হয়। জয়, হামজা কত রাত বাড়ি ফেরে না। কোথাকার কোন বৈঠকে, সম্মেলনে পড়ে থাকে।
চলবে..
[আপনারা চাইলে রাতে আরেক পর্ব দিতে পারি। তবে সেরকম রিসপন্স পেলে। আজ সত্যিই খুব আরেক পর্ব দিতে ইচ্ছে করছে😑 আপনারা চাইলেই দেব ইনশা-আল্লাহ।]