#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৪.
অন্তূদের বাড়ির গলিটা ঢালাই রাস্তা, দুপাশে সারি সারি বাড়ি। তরু চুপচাপ হাঁটছিল। অন্তূ বলল, “তোমার কি খারাপ লাগছে?ʼʼ
-“আগে বললে কী হতো যে বাপের বাড়ি আসছো?ʼʼ
অন্তূ মুচকি হাসল। হাসিটা মিথ্যা। অন্তূর চোখে-মুখে নিদারুণ এক অস্থিরতা। এই গলিটা! এই সেই গলি, সেই পাড়া। আজ পাড়ার লোকেরা দেখছে সে ননদের সাথে বাপের বাড়ি আসছে। অন্তূকে দেখে এক মাঝবয়সী মহিলা থামলেন, “কী রে চেংরী! ভাই মরল, দেখলাম না তো তোরে! আসিস নাই?ʼʼ
অন্তূ কিছু না বলে কেবল মুচকি হাসল, হাঁটা থামালো না। তার শরীরে বোরকা নেই। সেলোয়ার-কামিজ। চওড়া ওড়না শরীরে জড়ানো। তবুও নিজেকে নগ্ন লাগে, মনেহয় শরীরটা খোলা। বোরকা ছাড়ার পর হাতে গুণে দু একবার বাইরে বেরোনো হয়েছে।
নীরবতা ভেঙে কঠিন এক প্রশ্ন করে তরু, “হ্যাভ ইউ বিন রেপড বাই জয়, আরমিণ?ʼʼ
আশ্চর্যজনকভাবে অন্তূ হাসল, “যদি বলি তার চেয়েও বড় কিছু, মানবে?ʼʼ
তরু তাকিয়ে রইল। অন্তূ বলল, “ধর্ষিতা হয়ে বদনাম হলে সান্ত্বণা থাকে। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ কতটুকু সয়, তরু?ʼʼ
তরু কথা বলতে পারল না। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি তোমার মায়া হারিয়েছ তার প্রতি?ʼʼ
-“জানিনা। তবে সামনে যেতে কেমন গা গুলিয়ে আসে আজকাল, অপ্রস্তুতবোধ করি। কেন—তা ভেবেছি। উত্তর পাইনি। আর কতদূর?ʼʼ
-“সামনেই।ʼʼ
বাড়িটা আর বাড়ি নেই। পুরোনো মর্গের মতো গা ছমছমে, নিস্তব্ধ যেন, প্রাণের অভাব। হু হু করে কান্নার আওয়াজ আসছে। অসময়ে রাবেয়া নামাজে বসেছেন। অন্তূ রান্নাঘর দেখল, মনে হলো কমপক্ষে দু’দিন কোনো রান্না হয়নি। ঘরবাড়ি মাকড়সার জালের দখলে। জানালাগুলো কতদিন ধরে বন্ধ। কাপড়চোপড় ছিটিয়ে আছে।
আমজাদ সাহেবের ঘরটার দিকে চোখ যেতেই অন্তূর বুকটা সজোরে ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল। পুরো শরীরটা ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। অন্তূ পা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই। চোখ ফেটে পানি এসেছে, তা ততক্ষণ টের পেল না, যতক্ষণ না ঝরঝর করে ঝরে পড়ল সেগুলো। সাহস হয়না অন্তূর ওই ঘরে ঢোকার। বোঝা গেল, রাবেয়া ওই ঘরে যান না। হয়ত শূন্যতা সহ্য হয়না!
অন্তূ আস্তে করে ওখানেই মেঝের ওপর বসে। চেয়ে থাকে ঘরটার দিকে। সেই ফতোয়া, শার্ট ঝুলছে আলনায়, ওই তো জায়নামাজটা। টুপি কোথায়? টুপিটা রোজ হারাতো। অন্তূকেই তা খুঁজে দিতে হতো মসজিদে যাবার আগে। আব্বুর মশারীটাও বাঁধা হয়না কতকাল! অন্তূ নিজেকে সামলাতে পারেনা। কতদিন, কতকাল নাকি প্রথমবার এত জোরে, চিৎকার করে কেঁদে ওঠে অন্তূ। ইটের দেয়ালে কাঁপন ওঠে সেই কান্নায়। সব তার পাপ। তার কর্মের ফল। এই অবধি যা সব হারিয়েছে সবই নিজের দোষে।
হুড়মুড়িয়ে সেখানে আসেন রাবেয়া। মার্জিয়া কাছে আসেনা, দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। তরু এসে ধরে অন্তূকে।
বিকেল হয়ে আসছিল। অথচ অন্তূ যাবার নাম নেয়না। তরু বলতে পারছিল না। তার জিভ সরে না অন্তূকে বলতে, ‘চলো, ফিরতে হবে।ʼ
মার্জিয়ার পেট উঁচু হয়েছে খানিক। রাবেয়া চেয়ারে বসা। মার্জিয়া বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলে অন্তূ আলগোছে মেঝের ওপর ঠেসে বসে। থরথরে গলায় ডাকে, “ভাবী?ʼʼ
মার্জিয়া তাকায়, নিষ্প্রভ দৃষ্টি তার। বদমেজাজ বা কড়মড়ে দৃষ্টি নেই আর।
-“আমি কি ক্ষমা চাইব আপনার কাছে?ʼʼ
-“তাতে তোমার ভাই সামনে এসে দাঁড়াবে আমার সামনে, অন্তূ?ʼʼ ঠিক ছোট্ট বাচ্চার মতো অবুঝ শোনায় মার্জিয়ার কথাটা।
কঠিন ভালোবাসার স্বামী মার্জিয়ার। বয়স কত হবে? পঁচিশ? ভরা জীবন-যৌবন, পেটে প্রথম সন্তান। সে নাকি বিধবা। মানা যায়?
-“আপনি আম্মাকে নিয়ে কুষ্টিয়া চলে যান।ʼʼ
মার্জিয়া চুপ করে থাকে। অন্তূ বলে, “ওখানে ব্যবস্থা আছে? আম্মুর থাকার জায়গা হবে?ʼʼ অন্তূ ডাকে, “ভাবী, ডাক্তারের কাছে যাবেন? আমার হাতে সময় নেই। আপনারা গতকাল সকালের গাড়িতে কুষ্টিয়া রওনা হবেন। আমি টুকটাক জিনিস বেঁধে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি খান না কতদিন? আমার পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি, পাব চিরকাল, পেতে থাকব। ও নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু বাচ্চাটাকে কষ্ট দেবেন না।ʼʼ
অন্তূ পায়ে হাত রাখে। মার্জিয়া চমকে ওঠে। অন্তূর দ্বারা এমন কাজ অবিশ্বাস্য। অথচ আজ চট করে ফেলেছে। অন্তূ হাত সরায়না, দু’হাতে মার্জিয়ার পা ছুঁয়ে বলে, “ওই ছোট্ট জানটাকে ভালো রাখবেন ভাবী? আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে, শুধু আপনার স্বামী ছাড়া একদিন আপনাকে সবকিছু দিয়ে ভরিয়ে দেব আমি। আমার ওয়াদা রইল আপনার কাছে। আপনার ছেলে থেকে শুরু করে আপনার লাইফটাইম রিসপন্সিবলিটি আমার। শুধু কিছুটা সময় দিন আমায়। আর নয়ত মেরে ফেলুন। কিন্তু আমি মরলে উকিল হবে কে? বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কথা হলো, উকিল হওয়া। আব্বু রোজ তাগাদা দেয়, ধমকে যায় এসে। আমার নামের আগে অ্যাডভোকেট লাগাতে হবে তো। এইজন্য মরতে পারছি না। আপনি এটুকু সুযোগ দিন আমায়, কেমন?ʼʼ
মার্জিয়ার চোখ ভরে উঠলেও পানি গড়ায় না। কোনো কথাও বলেনা সেই বদমেজাজী মার্জিয়া।
অন্তূ রান্নাঘরে যায়। রান্না বসায় চুলোয়। তরু কী ভেবে কী করল কে জানে? সে আন্দাজ করে করে অধিকাংশ প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে ফেলল বড় বড় কয়েকটা ব্যাগে। অন্তূ রান্না করছিল। তরু থালাবাসনগুলো ধুয়ে ফেলল। রাবেয়ার সাথে অনেকক্ষণ বসে কথা বলল। মার্জিয়াকে সান্ত্বণা দিলো।
সন্ধ্যার পর দুজন যায় বাসের টিকেট কাটতে। টাকা দিলেন রাবেয়া। জয়ের কাছ থেকে আনা বিশ টাকার অবশিষ্ট দশ টাকা তাদের এবারের গাড়িভাড়া গেল।
সব ঋণমুক্ত। রাবেয়ার কাছে জমি বিক্রির বেশ কিছু টাকা এখনও গচ্ছিত আছে। তা নিয়ে মার্জিয়ার মায়ের বাড়িতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। অন্তূ নিজহাতে জোর করে মার্জিয়াকে খাওয়ালো। রাবেয়াকে খাইয়ে দেবার সময় অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইলেন রাবেয়া, “মা হয়ে গেছিস আমার?ʼʼ
-“মা কি মেয়ের স্বামী-ছেলে-সুখ কেড়ে নেয়, আম্মু? অভিশাপ বলো অভিশাপ।ʼʼ
রাবেয়া অন্তূকে জড়িয়ে ধরে এত কাঁদলেন, তা দেখে তরু কখন যে শব্দ করে কেঁদে ফেলল, খুব লজ্জা পেয়েছিল মেয়েটা পরে। অথচ কেন যে বুক ফাটছিল! অন্তূ বলল, “আম্মা! রোজ নামাজে দোয়া কোরো তো তোমার অভিশাপের জন্য! একা থাকবো, বুঝতেই পারছ! কবে দেখা হবে জানিনা। তবে হবে আবার ইনশা-আল্লাহ। ফৌন করব আমি রোজ।ʼʼ
আমজাদ সাহেবের একটা জিনিসও নিতে দিলো না অন্তূ। স মাঝেমধ্যে আসবে তো আব্বুর ঘরে। ঘরটাতে তিনটা তালা মারল। কেউ যদি হামলা করেও, ওই ঘরে আগুন না লাগা অবধি কোনো ক্ষতি যাতে না হয়। নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে হাসল অল্প, “ভুলে গেছিস আমায়? অনেক পর হয়ে গেছি আমি। যদি কখনও ফিরে আসি স্থায়ীভাবে, আবার তোর বিছানায় গা ছেড়ে ঘুমাবো, ইনশা-আল্লাহ।ʼʼ
নিজের বই-খাতা সব বেঁধে সাথে নিলো। পথে তরু জিজ্ঞেস করল, “এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?ʼʼ
-“তালা-চাবির দোকানে।ʼʼ
-“তালা কিনবে? তালা তো মারলে, আর নেই? উনারা তো সকালে বের হবেন!ʼʼ
-“একটা চাবির নকল বানাবো।ʼʼ
-“মানে?ʼʼ
-“রিমি ভাবী গতরাতে একটা চাবি দিয়েছে।ʼʼ
তরু চেয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আস্তে করে বলল, “স্টোররুমের চাবি, তাই না?ʼʼ
-“গিয়েছ কখনও সেখানে?ʼʼ
-“গোডাউন তো ওটা। লোহা-ইস্পাত ইত্যাদি থাকে। আমি যাইনি কখনও।ʼʼ
অন্তূ মোড়ে এসে রাস্তা পার হবার জন্য তরুর হাতটা চেপে ধরল। আজ খুব দক্ষ পথচারীর মতো সে-ই কাউকে হাত ধরে রাস্তা পার করল। তরু জিজ্ঞেস করে, “আমায় নিয়ে এসব করছো, ভয় করছে না? ভরসা করো?ʼʼ
অন্তূ আনমনে হাসে, “অ-ভরসার কিছু তোমার চোখে কোনোদিন দেখিনি আমি, তরুনীধি। আমার একটা বোন থাকলে তোমার মতো হতো।ʼʼ
—
জয় সকাল সকাল বেরিয়েছিল ক্লাবে। পৌরসভায় যাবার আগে হামজা কল করে খানিক ঝারল বাড়ি ফেরার জন্য। সে ফিরল দুজনকে সাথে করে। তাদের টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে আসছে, “আয়। আজও নিশ্চয়ই আমার শালীরা আমার পছন্দের কোনো মাছই রান্না করে রেখেছে। তোরা খেয়ে যাবি, আয়।ʼʼ
ব্রাশ তখনও হাতে। ব্রাশ করতে করতে সকালে শহর ঘুরে আসা পুরোনো স্বভাব তার। টানতে টানতে এনে ডাইনিং রুমে ওদের দাঁড় করিয়ে ডাকে, “ভাবীই? আরমেইণ! খেতে দে। তরু কইরে? কই রে তোরা সব। এ যা বস টেবিলে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।ʼʼ
বাথরুমে ঢুকে মুখে-চোখে পানি দিতে গিয়ে লুঙ্গির তলা ভিজে গেল। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে একটু রোগা লাগল। শুকিয়ে গেছে শরীরটা। এমনিতেই ছিমছাম, লম্বু গড়ন দেহের, তার ওপর আরও শুকনো লাগছিল। আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “হরি রে হরি। সবাইক বানাইলা মোটা-তাজা, আমারে বানাইলা খড়ি!ʼʼ
হামজা, জয়, ছেলেদুটো সব একসাথে বসে হুড়পাড় করে খেল। হামজা বলল, “তোকে একবার থানায় ডাকা হয়েছে।গিয়ে দেখা করে আসিস।ʼʼ
-“ধ্যাৎ! আমি একা যাইতে পারব না।ʼʼ
-“তো চল, কিছু লোক ভাড়া করে নিয়ে যাই! ষাঁড়!ʼʼ
বাঁকা চোখে তাকায় জয়, হুমকি দেয়, “আমি যদি এখন ঝোল ফেলে তোমার সাদা পাঞ্জাবী নষ্ট করে দিই?ʼʼ
না চাইতেও হেসে ফেলল হামজা। স্নেহভরে খানিকক্ষণ জয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত তোর? বড় হবি না?ʼʼ
প্লেটে একটা মাছ তুলে দিয়ে সেটার কাঁটা বেছে দিয়ে বলল, -“এবার খা। যদি আসল সমস্যা কাঁটা বাছাই হয়, তাইলে সমস্যা শেষ। এবার মাছ খা।ʼʼ
জয় খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে হামজার দিকে। চট করে বলে, “আজ কী বার?ʼʼ
-“মঙ্গলবার।ʼʼ
-“মঙ্গলবারে মাছ খাইনা আমি।ʼʼ
হামজা হাসে। দুম করে একটা মারে জয়ের পিঠে। উঠতে উঠতে বলে, “আজ দুই-তিনটা বোতল আনিস। ছাদে বসব রাতে।ʼʼ
ত্যাড়ার মতো বলে জয়, “পারব না।ʼʼ
-“লাত্থিটা ঠিক ঘাঁড় বরাবর মারবো।ʼʼ
-“মুখ খারাপ করায়েন না, ভাই।ʼʼ গম্ভীর হয়ে বলে জয়।
হামজা জয়ের কপালের দাগে হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করে, “ব্যথা আছে?ʼʼ
-“ওভাবেই একটু হাত বুলাও তো। ভালোই লাগতেছে।ʼʼ
নিচে হট্টোগোল শোনা যাচ্ছিল। জয় এগিয়ে গিয়ে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী রে, মিনাজ? কী সমস্যা?ʼʼ
-“ভাই, চাঁদা নিতে আইছে কারা জানি।ʼʼ
-“ওয়ার্কশপে চাঁদা? তাও আবার এই ওয়ার্কশপে? কিডারে আইছে, পাগলে থাপাইছে নাকি তারে?ʼʼ
-“চিনিনা, ভাই। চাঁদা চাইতেছে।ʼʼ
-“চাঁদা ওর শ্যাঁটার মধ্যে ভরে দিচ্ছি, আমি। আসতেছি দাঁড়া।ʼʼ
ধুপধুপ করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে যায় জয়। হামজা পিছে পিছে যায়।
—
রাত পৌনে একটায় বাড়ি ফিরে আর খেল না, জয়। অন্তৃ জিজ্ঞেস করে, “এখন নিশ্চয়ই গিলতে বসবেন?ʼʼ
-“ছাদে যাব। ভাই বসে আছে।ʼʼ
-“মদের বোতলের কর্ক খোলে কীভাবে?ʼʼ
-“এক শট মারবে নাকি, ঘরওয়ালি?ʼʼ
-“না। হারাম।ʼʼ
-“খেয়ে-টেয়ে ইস্তেগফার পড়ে তওবা করে নিও।ʼʼ ঠোঁট বেঁকিয়ে চোখ টিপ মারে জয়। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “সাথে কিছু স্ন্যাক্স টাইপের কিছু নেবেন?ʼʼ
জয় ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আসে অন্তূর দিকে। অন্তূ যতটা পিঠ বাঁকালো, ঠিক ততটা ঝুঁকে এক ইঞ্চ দূরত্ব রেখে ফিসফিস করে বলে, “চোরের বাণী মিষ্টি হয়, ভক্তিতে ভরপুর হয়, ঘরওয়ালি। এনিথিং রং?ʼʼ
অন্তূ ছিটকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনাদের বিরোধীতা করার সাধ্যি আর কোথায়, আমার? তার চেয়ে বরং মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা ভালো না?ʼʼ
-“বাড়ি ফাঁকা তোমাদের। ওরা আবার মেনে নিয়ে কোথায় গেল?ʼʼ
অন্তূ একদৃষ্টে তাকিয়ে হাসে, “আপনি খুব শেয়ানা, জয় আমির।ʼʼ
জয় কপাল উঁচিয়ে বলে, “আর তুমি?ʼʼ
-“গর্দভ।ʼʼ
দুপাশে মাথা নেড়ে অন্তূর কথার বিরোধীতা করে বলে, “কোথায় গেছে, ওরা?ʼʼ
-“আমাকে বলেনি। শুধু বলল, দূরে কোথাও চলে যাবে, যেখানে আমার মতো মেয়ের মুখ না দেখতে হয়।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে উঠল। আচমকা হাসি থামায়। অন্তূর গলাটা ঘর্মাক্ত হালকা। ওড়নাটা বুকের ওপর পড়ে থাকলেও গলার নিচ থেকে বুক অবধি উন্মুক্ত। চিকন একটা স্বর্ণের চেইন, মসৃণ গলাটাকে নেশাদ্রব্যের মতো করে তুলেছে। সেই নেশায় জয়ের নিঃশ্বাস ভারী হলো। ঠোঁট ফাঁক করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে। নজর সরিয়ে অন্তূর হাত থেকে বোতলদুটো নিয়ে চটপটে পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
অন্তূ চিন্তিত মুখে পায়চারী করছিল ঘরে। খানিক বাদেই জয়কে ফিরে আসতে দেখে চমকে উঠল। অস্বাভাবিক লাগছিল জয়কে দেখতে। এদিক-ওদিক পাখির মতো তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করে, “আমি কাছে আসি, তা তুমি চাও না, না?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ অকপট স্বীকারক্তি।
-“আমি কি তোমার চাওয়ার ধার ধারি? এসব ম্যানার্স আমার সাথে পোষায়?ʼʼ হাঁপানোর মতো শ্বাস ফেলে জয়। চোখে-মুখে আবেদন।
অন্তূ আতঙ্কিত চোখে পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। আচমকা হাতটা চেপে ধরে টেনে আনে জয় ওকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে আদেশ করে, “শার্টটা খুলে দাও।ʼʼ জয়ের রোজকার এই অভ্যাস। ঘরে ঢুকে প্রথমে বলবে, ‘শার্টটা খুলে দাও।ʼ অন্তূ কোনোদিন মানেনা সেই কথা। কিন্তু আজকের বলাটা আলাদা শোনায়। মাতাল হয়ে ফিরলে সে যে অন্তূর কাছে আসার চেষ্টা করেনা, এমন নয়। কিন্তু খেলে খায় অতিরিক্ত, জবরদস্তি করার বিশেষ শক্তি থাকেনা ভেতরে, ঘুমে ঢলে পড়ে।
অন্তূর মনে হলো, আজ বুঝি নিস্তার নেই। জয় আবার বলে, “শার্টটা খোলো, কুইক।ʼʼ
অন্তূ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জয় আকস্মিক অন্তূর খোলা ঘাঁড়ের ওপর মুখ থুবরে পড়ে। দুটো চুমু খায় সেখানে। অন্তূর চুলের পেছনে হাত দেয়, আলতো করে আঙুল নাড়ায় সেখানে। গায়ের অনেকটা ভার অন্তূর ওপর ছেড়ে দিয়ে বলে, “শরীর ভালো লাগছে না, মনটাও। আজ হয় অভার-ডোজ অ্যালকোহল নয় তুমি। মনটা তোমাকেই বেশি টানছে, ঘরওয়ালি।ʼʼ
জয়ের আজকের ছোঁয়া নমনীয়, অথচ অন্তূর শরীরে যেন বিঁষ প্রবাহিত হয়ে শিরা-উপশিরায় পৌঁছে যাচ্ছিল। হুট করে ভাবে, সে তো বিবাহিতা মেয়ে। জয়-ই হোক, জয় যদি এই জয় না হয়ে একটা স্বামী জয় হতো, সে কি এই সুন্দর স্পর্শগুলোকে অনুভব করতো না, সায় দিতো না? ততক্ষণে ঘেন্নারা অন্তূর লোমকূপগুলোতে খোঁচা দেয়, শিউরে ওঠে তীব্র আক্রোশ আর বৈরাগে।
বোতলের কর্কটা কেমন এক কায়দায় যেন জয় একহাতে খুলে ফেলে। একটা শব্দ হয়, বুদবুদ আকারে অনেকটা কোমল পানীয় মেঝেতে ছিটকে পড়ে ছোট হুইস্কির বোতলটা থেকে। অন্তূ সেটা কেড়ে নেয়। বোতলগুলোর মাঝে কোনোটাতে ডায়াজিপাম ড্রাগ মেশানো আছে। রিমি মিশিয়ে আবার কর্ক আঁটকেছে। আজ আর পরিকল্পনা সফল হবেনা বোধহয়। জয় মুখ তুলে চায়, অসভ্যর মতো হাসে, “তুমি কি চাচ্ছ ইনডাইরেক্টলি? মদ না তুমি, তুমি না মদ?ʼʼ হা হা করে হাসে।
অন্তূ জয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “কোনোটাই না। বসুন বিছানায়। চোখ-মুখ বসে গেছে, আপনার। রাতে আজকাল কোথাও থাকছেন, সকালে ফিরছেন। কী হয়েছে?ʼʼ
লম্বা শরীরটা অল্প কুঁজো করে লুঙ্গি উঁচিয়ে ধরে খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে ধুপ করে শুয়ে পড়ে, অর্ধেকটা পা ঝুলে থাকে মেঝের দিকে। চোখ বুজে বলে, “এভাবে কথা বলোনি কখনও আমার সাথে তুমি।ʼʼ
-“কী করব? ঘেন্না লাগে যে!ʼʼ
হাসে জয়, “জায়েজ।ʼʼ
যখন হাসে, তখন সারাক্ষণ ঠোঁটে হাসি থাকে। বিরক্ত হয় অন্তূ। সোফায় বসতে যাচ্ছিল। জয় বলে ওঠে, “এখানেই বসো। ধরব না তোমায়। তুমি অনুমতি দিলে হোটেলে যাই? আধাঘন্টার মধ্যে ফিরব, ততক্ষণ বই-টই পড়ো একটা। চট করে এক পাক মেরে আসি, খিদে পেয়েছে।ʼʼ
অন্তূ খাটের কাছে এসেও দু কদম পিছায়, মুখ দিয়ে ছিটকে বের হয়, “ছিহ!ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে ওঠে, “আমাকে কি হাফ-লেডিস মনে হয়, তোমার?ʼʼ
-“তো, রোজ আমায় না পেয়ে হোটেলে যান? আপনি লম্পট, নোংরা, চরিত্রহীন, ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ।ʼʼ
জয় উঠে বসে অন্তূর হাত ধরে টেনে বিছানায় পাশে বসতে ইশারা করে জয়, “বসো।ʼʼ
অন্তূ বসে চুপচাপ, জয়ের হাতটা সরিয়ে দেয় আস্তে করে। জয় পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় অন্তূর চোখের দিকে, জিজ্ঞেস করে, “একটা ছেলে পূর্ণ যৌবন পায় কত বছরে, জানো?ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়না। জয় বলে, “কম-বেশি পনেরো বছরে।আমার জন্ম ১৯৮৭। সেই হিসেবে এখন বয়স সাতাশ পার। অর্থাৎ যৌবন প্রাপ্তির পর একযুগ কাটিয়ে এসেছি। শুকনো শুকনো কাটাতে বলছো? পুরুষের দ্বারা সম্ভব? সম্ভব, সন্ন্যাসীদের দ্বারা। শুনেছি তাঁরাও নাকি পাগল হয়ে যায়।ʼʼ
অন্তূর বিরক্ত লাগছিল এসব শুনতে। তবু চুপ করে চেয়ে রইল। জয় বলল, “বিয়ে করলাম এইতো পরশুদিন। সেদিন নারীসঙ্গ হালাল হলো। তাও আবার দেনমোহর বাকি।ʼʼ হেসে ফেলল জয়, “বিশ বছরের ওপারে কোনো ম্যাংগো পুরুষকে চরিত্রবান ভাবলে হয় তুমি মূর্খ নয়ত কঠিন বোকা। চরিত্র শুধু মেয়েলোকের কাছে নষ্ট করতে হয়না, মোরওভার, বহুত উপায় আছে। আমি কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র।ʼʼ
অন্তূ কথা বলছিল না। জয় আচমকা অন্তূকে চমকে দিয়ে ওর কোলের ওপর মাথা রেখে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে পড়ল। অন্তূর হাতটা টেনে চুলে রেখে চোখ বুজল। অন্তূ মনে হলো, তাকে কয়েক গ্রাম বিঁষ টুপ করে গিলে ফেলে যেন সেটা হজম করে নিতে হলো। চোখ বুজে ভারী শ্বাস ফেলল।
জয় খানিকক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকে ওভাবেই। হঠাৎ-ই আনমনে বলল, “আমি প্রথম সিগারেটে টান দিয়েছি কবে, জানো? তেরো বছর বয়সে। সাল–২০০০। গলা জ্বলতো খুব। প্রথম খুন করেছি পনেরো বছর বয়সে। সাল—২০০২। প্রথম মেয়েলোকের কাছে গেছি আঠারো বছর বয়সে।
সাল–২০০৫। তুমি তখন কোথায় ছিলে? কবে এসেছ, তুমি? তুমি এলে এই তো সেদিন। ততদিনে আমি বহুত কিছু পার হয়ে এসেছি।ʼʼ
অন্তূ চেয়ে রইল জয়ের বন্ধ চোখ-জোড়ার দিকে। ভ্রুর নিচে অনেকটা জায়গা, চোখের পাতার ওপরে। চটা পড়া ভ্রু। ডাগর ডাগর চোখ জয়ের, গভীর, খাঁদে পড়া। আচমকা সেই চোখ খুলে অন্তূর চোখের মণি বরাবর তাকালো জয়। অন্তূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটুও নড়চড় আসেনা, জয় তা দেখে হাসে, “২০০৭ এর এক সম্মেলনে মারামারি করতে গিয়ে বিরোধী দলের দুটো লোক মার্ডার হয়ে গেছিল। কিছুদিন পর আমাকে নিয়ে গিয়ে….লেপ-তোষক সেলাই করার সুঁচ দেখেছ?ʼʼ
-“দেখেছি।ʼʼ
-“সেই সুঁচ সারা শরীরে ফুটিয়েছিল। পিঠে একটা বিশাল ক্ষত আছে। ওখানে চাপ্পর দিয়ে কুপিয়ে লবন লাগিয়েছিল। সেগুলো এখন সারাদেহে…ʼʼ
-“ইশপেশাল ট্যাট্টু, তাই তো?ʼʼ
জয় হো হো করে হাসল, “এই না হলে আমার ঘর-ওয়ালি।ʼʼ
-“এখন প্লিজ চুপ করুন। এসব শুনতে বিরক্ত লাগছে। অন্য কথা বলুন, আর নয়ত ঘুমান। আমার পরিবারে কেউ কোনোকালে কসাই ছিল না, এসব শুনতে ভালো লাগার কথা না আমার।ʼʼ
-“কষ্ট লাগছে না, তোমার?ʼʼ ঠোঁট কামড়ে হাসে জয়।
-“না। ওরা কোনো খারাপ কিছু করেনি। আপনি দুটো প্রাণ নিয়েছেন, সেই হিসেবে ওরাই মহান। অন্তত আপনার প্রাণটা দিয়েছে, যার মূল্য অমূল্য। আপনি কিন্তু দুটো প্রাণ নিয়েছেন, শুধুই অহেতুক ক্ষমতার লড়াই, যার কোনো ভিত্তি নেই। কেবল ওই সকল স্বৈরাচার, পুঁজিবাদী, সুবিধাবাদী লোকদের পা চাটতে গিয়ে এইসব করেন আপনারা। ভাগ দেয় ওরা আপনাদের? যা তো সব ওরাই ভোগ করে, আপনারা কুকুরের মতো লেজ নাড়িয়ে বেড়ান মাঝ থেকে। আবার এই পার্টির হয়ে মারামারি করার মূর্খতাকে আজকের যুবসমাজ বাহাদুরী হিসেবেও নিয়েছে, কে বোঝাবে ওরা যে আসলে ওইসকল নেতাদের পা চাটা জিভ বের করা কুকুর।ʼʼ
জয় অনেকক্ষণ চেয়ে রইল, “কোনো আপোষ না, না? একটুও আপোষ না, কোথাও না?ʼʼ
-“অন্তত অন্যায়ের সাথে না।ʼʼ
চট করে উঠে বসে জয়। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, “ঘরওয়ালি! আপনি মারাত্মক এক উকিল হবেন, আই স্যোয়ার! তবে ভালো উকিলদের কিন্তু জানের ঝুঁকিও ভালো থাকে। তখন হয়ত আমি থাকব না! আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।ʼʼ
অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আপনার খারাপ হবার গল্প নিশ্চয়ই বেশ ট্র্যাজেডিক?ʼʼ
-“আমার খারাপ হবার কোনো গল্প নেই। ওসব সিন্যামাটিক চিন্তা বাদ দাও। অতীত কোনোদিন মানুষকে খারাপ বানায় না, বড়োজোর বিদ্রোহী বানায়। লোকে আমায় খারাপ বলে, যদিও আমি আমার মধ্যে কোনো খারাপ দেখিনা। আমার খারাপ হবার পেছনে কোনো কারণ নেই। আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ, কারণ আমি খারাপ। কারণহীন কারণে আমি খারাপ।ʼʼ
অন্তূ হতাশ শ্বাস ফেলে। ‘যতবার বোঝার চেষ্টা করবে, ততবার ব্যর্থ হবে।ʼ এরকম একটা অদৃশ্য ব্যানার ঝুলিয়ে রেখেছে যেন জয় নিজের চারপাশে। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “ড্রয়ারে এইসব ড্রাগ কীসের? কী করেন এগুলো দিয়ে?ʼʼ
চলবে..
[পুরো পর্ব জুড়ে জয় আমিরের কিস্সা আজ। আপনারা বিরক্ত হলে দোষ নেই আমার। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]