#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৮.
সকাল নয়টার দিকে ঘুম ভাঙে অন্তূর। এ বাড়িতে অভিভাবক একমাত্র হামজা। বাড়ির বড়ও সে-ই। তার কত কাজ! সকালে উঠে কোথাও গেছে হালকা কিছু খেয়ে।
রিমি ও তরু রান্না-বান্না করে। অন্তূর জ্বর কম তখন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। উঠে দাঁড়াতেই চারদিকটা ঘুরে উঠল। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল বিছানায় বসে।
মেঝের ওপর পড়ে আছে জয়। হু হু করে এসির বাতাস ঘুরছে বদ্ধ ঘরে। মদের বোতলটা পড়ে আছে জয়ের মাথার কাছে। তরল গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে।
সেদিন একবার রাতে খানিক সময়ের জন্য বেলকনিতে বসেছিল জয়। অন্তূর কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চেয়েছিল। অন্তূ দেয়নি। তরুকে দিয়ে পাঠিয়ে পরে যখন রুমে এলো, তখন জয় বলল, “তোমার বাড়ির লোকেরা কোথায় গেছে?ʼʼ
-“জানিয়ে যায়নি।ʼʼ
এ নিয়ে জয় আর কথা বাড়ায়নি অবশ্য। অন্তূ ঘরে দু একটা কাজ করে বেলকনির পর্দা ধরে দাঁড়ায়। জয় একমনে সিগারেটের ধোঁয়া গিলছে বসে। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের ও বাড়িতে কেউ থাকেনা?ʼʼ
-“একজন কেয়ার-টেকার আর তার বউ থাকে।ʼʼ
-“আপনি এখানে কেন থাকেন?ʼʼ
-“অভ্যাস। ছোটবেলা থেকে আছি, আর যেতে চাইলেও হামজা ভাই ছাড়বে না।ʼʼ
-“কবে এসেছেন এ বাড়িতে?ʼʼ
-“আমি তখন ছোট, দশ-এগারো বছর বয়সী হবো। সেই থেকে আছি এখানে। এটাই আমার ঠিকানা। ও বাড়ির মালিকানাও পেয়েছি বড় হয়ে। কেন জিজ্ঞেস করছ?ʼʼ
অন্তূ চুপ রইল। জয় চোখ তুলে তাকিয়েছিল, “কেন? যাবে তুমি?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“যেতে চাইলে বলবে। নিয়ে যাব। তোমারও হক আছে শ্বশুরবাড়ি যাবার। এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে কোনো?ʼʼ
-“এমন ভাব করছেন কেন, যেন আমি বললেই সব কবুল?ʼʼ
বদমাশের মতো হাসল জয়, “তা কিছু বিষয় তা-ই। যেতে ইচ্ছে করলে বোলো। ঘুরিয়ে আনব। শ্বশুরবাড়ি দেখলে না এখন অবধি।ʼʼ
অন্তূ মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। জয় বলল, “নামাজ পড়বে নাকি তুমি?ʼʼ
-“কেন? খিদে পেয়েছে?ʼʼ স্পষ্ট ঘৃণা আল তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে অন্তূর মুখে।
এতক্ষণের শান্ত জয় ধপ করে জ্বলে উঠল, “তোমার খোঁজ আমি শুধু খিদে পেলেই নিই?ʼʼ
-“তা নয়? তাই তো জানি আমি।ʼʼ
জয় উঠে দাঁড়াল, “কথাটা কোন লাইনে যাচ্ছে বুঝতে পারছো? স্বামী আমি তোমার।ʼʼ কথাটা বলতে বোধহয় একটু বাঁধল জয়ের। এইসব কথা ভদ্র পুরুষদের জন্য, সে তো তেমন না।
-“তাই নাকি? আপনি তা মানেন?ʼʼ
-“মানামানি পরে, আগে জানার কথা হোক। পুরা জেলা জানে, আমজাদ মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করেছি আমি। জয় আমিরের বউ সে।ʼʼ
-“আমিও কি তা-ই জানি?ʼʼ
-“কথাটার লাইন ধর্ষণের দিকে নিতে চাচ্ছ, ঠিক বলেছি?ʼʼ
-“ভুল বলার অভ্যাস নেই আপনার। ঠিক ধরেছেন।ʼʼ
-“হ রে শালী। আমারই উচিত হয়নি তোকে এত ভালোভাবে বিয়ে করে ঘরে তোলা। বিয়ের আগে খালি বদনাম করেছি, বাস্তবে তো ভেতর ফাঁপা। ছুঁইওনি। কামডা ঠিক করি নাই। কোনো একদিন ধরে রেইপ-টেইপ করে তারপর বিয়ে করলে…..কিন্তু রেইপ বিষয়টাতে এক প্রকার ফোবিয়া আছে আমার। নয়ত রোজ চাকরের মতো ট্রিট করলে তবে তোর আজকের কথা সহ্য হতো। বদনাম খারাপ লাগেনা আমার, কিন্তু অপবাদ ভালো লাগেনা। সর সামনে থেকে।ʼʼ
-“রেইপ বিষয়টাতে ফোবিয়া আছে?ʼʼ অন্তূ উপহাস করে।
গম্ভীর হলো জয়, “হু।ʼʼ লম্বা করে সিগারেটে টান দিয়ে হেসে ফেলল চট করে, “বিশ্বাস হচ্ছে না, না? খুব বেশি জবরদস্তি করি বলে মনে হয় তোমার তাই তো? সেটা রেইপ? বউকে? হাহহাআহ! তোমার আমাকে সহ্য হয়না, সেক্ষেত্রে আমার নরমাল টাচ-ও ব্যাড-টাচ মনেহয়। এটাকে রিলেটিভিটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।ʼʼ
আজ এসব ভাবনায় আসতেই ইচ্ছে করল, বোতলটা তুলে জয়ের মাথায় আঘাত করতে। কিন্তু করা যাবেনা। প্রশ্ন অনেক, তা সব জয়ের কাছে। আবার ভাবে, সে এসবের মাঝে নিজেকে জড়াচ্ছে কেন? এসব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলে হয়না? পরক্ষণে মনে পড়ে, তার ভবিষ্যত পেশা এসব নিয়েই তো! সে একজন ভবিষ্যত আইনজীবী। ঝামেলাকে তার রক্তকণিকার মতো রন্ধ্রে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে চিরকাল।
অন্তূ কীসের এক শক্তিতে যেন জ্বলে উঠল, উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণ মনটা গুমটে মেরে ছিল, কারণ বোঝা যাচ্ছিল না। এবার স্পষ্ট হলো। তাকে তো বড়ঘরে যেতে হবে। বাচ্চারা কী করছে? সরিয়ে নেয়নি তো আবার? শরীরটা ছটফট করে উঠল উত্তেজনায়। বাচ্চারা খেয়েছে?
লম্বা বারান্দার কাছে রিমি জাপটে ধরে, “আপনি যাবেন না। মেয়র সাহেব এখনও বাড়িতে। ওয়ার্কশপেই আছে। জয় ভাইয়া ঘরে। আমাকে বিশ্বাসঘাতক বানাবেন না। আমি আপনাকে গোপনে সাহায্য করতে চেয়েছি। সেই ওয়াদা ভুলে যাচ্ছেন আপনি, আরমিণ!ʼʼ
অন্তূ ঘরে ফিরে চুপ করে বসে থাকে। সাড়ে নয়টার পর জয়ের ঘুম ভাঙল। বাইরে কাজ থাকলে তাকে ডাকতে হয়না কখনও, সময়মতো ঠিক ঘুম ভেঙে যায়। তাকে একবার কার্যালয়ে যেতে হবে। মিটিং আছে। অন্তূকে দেখে হাসল, “ফিলিং বেটার, ঘরওয়ালি?ʼʼ
অন্তূ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল শুধু। জয় হাত-মুখ ধুয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পোশাক পরতে পরতে অন্তূকে বলে, “ভার্সিটিতে যাবে আজ আমার সাথে?ʼʼ
অন্তূর মনটা নেচে উঠল। তা লুকিয়ে আস্তে করে বলল, “শর্ত কী?ʼʼ
-“শর্ত?ʼʼ হো হো করে হেসে ওঠে জয়, “যা চাই দেবে? তো দাও, একটা চুমুই দাও নাহয়। ঠোঁটে না দিলেও চলবে, প্রথমেই অভার-ডোজ হয়ে যাবে তোমার। গালেই দাও। নো চিন্তা। চুমুগতভাবে কিন্তু জয় আমিরের গোটা শরীরটাই ভার্জিন। ওয়ান্না কিস মি? গাল এগিয়ে দেব?ʼʼ
অন্তূ কথা ঘোরায়, “সবসময় নিজের নাম জপার কী আছে? জয় আমির, জয় আমির!ʼʼ
জয় হাসল, “আমার নাম জয়, উপাধি আমির। ইজ ইক্যুয়্যাল টু— জয় ইবনে জাভেদ আমির।ʼʼ
-“আমিরʼ কিন্তু জামায়াতের প্রধান প্রতিনিধিদেরও বলা হয়! শুনেছি আপনি যুদ্ধাপরাধীর ছেলে! আপনার পরিবার শিবিরের কর্মী ছিল?ʼʼ
জয়ের মুখটা দগ্ধ হয়ে উঠল। ঠিক যেমন খড়ের গাদায় জলন্ত মশাল পড়লে আগুন জ্বলে ওঠে, সেটাও ছাইচাপা, নীলচে আগুন। তা খেয়াল করল অন্তূ আয়নায়। জয়ের দৃষ্টিতে খু-ন চেপেছে। দাঁতের মাড়ি পিষে বলল, “আমির আমার বাপ-দাদাদের বংশ উপাধি। পদবীর হিসেব আসছে কেন? বেশি বোঝা শিখেছ? খুব বেশি, হ্যাঁ? জামায়াত শিবির?ʼʼ পেছন ফিরল তো চোখে যেন ফুটন্ত আগুন, “আর একবার তোকে বড়ঘরে যেতে দেখলে কেটে টুকরো করে ফেলব, শালীর মেয়ে। আর বাচ্চাগুলোকে লোহার চুল্লিতে গলিয়ে তোর দলাদলী বের করব। পরবর্তিতে মাফ পাবিনা, সে তুই যে-ই হ।ʼʼ
অন্তূ কিচ্ছু বলল না। তার ভার্সিটি যাবার চান্স মিস করা যাবেনা, কোনোভাবেই না। থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে সেই কবে!
ভার্সিটিতে তারা দুজন পা রাখতেই বোধহয় উৎসব শুরু হয়ে গেল। কত কত দিন পরে যেন অন্তূ আবার চিরচেনা এই শিক্ষাপ্রাঙ্গনে পা রেখেছে। খুশি ও বিষাদ একসাথে চাপলে কেমন অদ্ভূত অনুভূতি হয়। সকলে হাঁ করে দেখছে, হাসছে, ইশারায় বোঝাচ্ছে, খুব মানিয়েছে। আসলেই মানিয়েছে। জয়ের উচ্চতার সাথে অন্তূর কাধ মিলেছে। খানিক চাপা শ্যামলা জয় আমিরের ফর্সা বউ, ভালো মানায় বাহ্যিকভাবে দুজনকে।
কত শুভেচ্ছা যে পেল ওরা। অন্তূ খালি দেখল, বাঙালি তেল মারতে কত দক্ষ! জয় কোনো দেবদূত—সবার অভিব্যক্তি তা-ই বলছে। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই এদের ডিএনএ-তে এক্সট্রা কিছু তেল জমা করে দেয়! যাতে সমাজের নোংরা লোকদের বিরুদ্ধাচারণ না করে বরং সেঁধে সেঁধে তেল মারতে পারে! অন্তূ তা পারলে আজ সে কিছুই হারাতো না। আফশোস! সে পারেনা।
সবাই এসে হাত মেলাচ্ছে জয়ের সাথে, জয়ের একটু হাতের ছোঁয়া পেতে কত উদগ্রীব তারা। অন্তূর মনে হলো, জয় যেন আরও ক্ষমতাসীন হয়ে উঠেছে দেশের এই হাঙ্গামায়। তা-ই তো হবার কথা! মজলুমরা যত এদের জুলুমের শিকার হয়ে দূর্বল হয়ে পড়বে, এরা অপেক্ষাকৃত তত দাপটে দেশ ঝলসাতে অগ্রসর হবে। এটাই তো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র! ল অফ রিলেটিভিটি! জয় এই সূত্রটায় চরম বিশ্বাসী।
অন্তূর এই দেশের কুকুরসম জনতার প্রতি আক্রোশ জন্মালো। এরা কুকুরের চেয়েও ভালো লেজ নাড়ানো প্রজন্ম। যারা আরামপ্রিয়। পরিবার ও নিজেকে নিরাপদে রাখতে ড্রেনের পানিকেও পবিত্র বলে ঠোঁট এলিয়ে হাসে। এরা প্রতিবাদ-পরবর্তি পরিণাম চিন্তা করে হিঃস্র হায়েনাকে গবাদি পশুর মতো উপকারী বলে স্বীকার করে নেয়।
জয় অন্তূর দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বলে, “এত সম্মান আগে পেয়েছ কখনও? যত অপদার্থ তুমি ভাবো আমায়, আমি ঠিক ততটাই পদার্থ। তোমার দেখার দৃষ্টিকোণ খারাপ, ঘরওয়ালি!ʼʼ
-“সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা থাকবে, এই দৃষ্টিকোণ যেন আজীবনেও এক ফোঁটা না বদলায়। চিরদিন এই দৃষ্টিতেই দুনিয়া দেখে মরতে চাই।ʼʼ
জয় বিরবির করল, “শালীর মুখ তো মুখ না, এসএজির রাইফেল। মিঠা কথা জানো না, শালি? মিথ্যা হলেও চলবে! তোর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে মরণ কবুল, বউ!ʼʼ
-“তুমি মিঠা কথা শুনতে চাও কেন শালা, যখন জানো আমার মুখে তা বেরোবে না। তবে যদি মরণ কবুল হয়, তো শেষবার একবার বলব। কবে মরতে চান। আমি প্রস্তুত হই মিঠা কথা বলতে!ʼʼ
জয় অবাক হয়ে তাকায়। গর্বিতভাবে বলে, “এজ হাসব্যান্ড, সো হিজ ওয়াইফ! সাব্বাস! কোন সম্বন্ধির ছাওয়াল কয়, আমাদের জুটি ভালো না? তার মাকে….. আসসালামু আলাইকুম।ʼʼ
শহীদ মিনার চত্বরে এসে হু হা করে হেসে ওঠে জয়। ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। এখানে কতবার অন্তূকে হেনস্থা করেছে! র্যাগ দিয়েছে। সেই মেয়ে আজ তার ঘরওয়ালী।
ক্লাস শেষে সেদিন অন্তূ জয়ের সাথেই বাড়ি ফিরেছিল। ফেরার পথে নতুন বর্ষের বই কিনে নিয়ে এলো গাদাধরে। জয় কোম্পানি আইন–বইটা হাতে নাড়েচাড়ে আর বলে, “কী বাল পড়ে সব! এসব পড়ে কোনো লাভ আছে? এই বয়সে আমরা বিক্রিয়া করতে গিয়ে সাইন্স-ল্যাবরেটরি ব্লাস্ট করে এসেছি, ওরা ব্যবসা আইন পড়ছে। দেশের কি অধঃপতন এমনি এমনি হলো? যাই হোক, জয় বাংলা। মামা, বইটা বউয়ের জন্য প্যাক করে দ্যান।ʼʼ
তারা অনেকক্ষণ রোদের তেজে ঘর্মাক্ত দেহে দাঁড়িয়ে ছিল ব্রিজের ওপর। এরপর জয়ের কত সব আস্তানায় ঘুরেছে জয় অন্তূকে নিয়ে। জোর করেই। ব্রিজের নিচের ছোট খুপড়িগুলো, টোস্ট বিস্কুট খেতে টঙের দোকান, গরমের মধ্যে বাচ্চাদের সাথে মাঠে নেমে ক্রিকেট খেলে শার্ট ভিজিয়ে এলো। তা খুলে অন্তূর হাতে দিয়ে শুধু গেঞ্জি পরে বাকিপথ পার। একগাদা লাল আইসক্রিম কিনে তা খেতে খেতে হেসে লুটিয়ে পড়ছিল বাচ্চাদের সাথে।
অন্তূ অবাক হয়। এরাও বাচ্চা, ওরাও। তবু এই বৈষম্য কেন? কীসের আক্রোশ! শহরের সব কুকুর, বিড়াল জয়কে চেনে যেন। দেখা হলেই লেজ নেড়ে পিছে হাঁটা শুরু করল। ওরা জয়ের হাতের বিস্কুট-রুটি-কেক সব খায়।
—
আজও কোথাও বেরোনোর আছে বোধহয় দুই ভাইয়ের। তারা কোনও কিছুর খোঁজে যাবে। সফল হয়ে ফিরবে আজ। গোসল করে দুজন কীসের এক আলোচনায় বসেছিল। সেখানে কারও উপস্থিতি নট-এলাউড। এরপর হামজা বেরিয়ে গেছে কোথাও। জয় ঘুমিয়ে পড়ল।
এই ফাঁকে অন্তূ যায় একবার নিচের তলার বড়ঘরে। বাকি সব ঠিক আছে। মেয়েগুলো আর নেই, মদের কেস অর্ধেকের বেশি চলে গেছে। যা আছে, তা সম্ভবত নিজেদের জন্য রাখা।
বাচ্চাদের খোরাক হিসেবে যা পানি এবং খাবার-দাবার দেয়া হয়, সেটাও অমানুষিকভাবে। যাতে ওরা মরবেও না, বাঁচাও হবে কঠিন। অন্তূর নিজ বিচক্ষণতায় এতে একটা আন্দাজ করে, এদের যদি মারা হবেও, তবে সেটা পরে। এবং খুব একটা শাস্তি দেবার নয়। কারণ ওরা এখনও কিছু করেনি। ছোট মানুষ। ওদের বড়জোর দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দিতে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু এই যে শাস্তিগুলো ওদের দেয়া হচ্ছে, এটা কোনো উদ্দেশ্যমাফিক। এরা কাউকে খুঁজছে, কাউকে কাবু করতে চাইছে। বরশির আগায় যে টোপ দেয়া হয় মাছ শিকার করতে, বাচ্চাগুলো আপাতত সেই টোপ হিসেবে কাজ করছে।
দিনের আলো প্রবেশের ছোট্ট কোনো ছিদ্রও নেই সেখানে। সিঁড়ির ওপারের লম্বা বারান্দাও ঘুটঘুটে অন্ধকারচ্ছন্ন। সেখান থেকে আলো আসার জো নেই। অন্তূ তবু দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে আব্দুল আহাদের শুকনো মুখখানার দিকে আধো-অন্ধকারে। সে আছরের নামাজ আদায় করছে। তার পেছনে জামায়াত দাঁড়িয়েছে। পুঁচকে একটা সমাবেশ। তো স্বৈচারাররা ভয় পাবেনা কেন? এই সমাবেশকে এভাবে চলতে দিলে এই পুঁচকে সমাবেশ কি একদিন বিশালাকায় তাগড়া শিবির-যুবকের সমাবেশে পরিণত হবেনা? হবে তো! ভয় পাওয়া জায়েজ!
অন্তূ নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। রুকু থেকে যখন সিনা চওড়া করে আব্দুল আহাদ সোজা হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক যেন সিনাটা দশ মাইল প্রসস্থ পাহাড়ি ঢালের ন্যায় শক্ত, অটল। যে বুকে বুলেট লাগলে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে তাজা গরম রক্ত, তবু মাথা নোয়াবার নয়।
কেউ আসছে। হেঁটে আসছে এদিকেই। অন্তূর হৃদযন্ত্র অতি-সক্রিয় হয়ে উঠল। মেরুদণ্ড বেঁয়ে এক প্রকার আতঙ্কিত শিহরণ নিচে নামছে। হামজা আসছে! এরপর?
অন্তূ ফিরে তাকায় না। শরীরের সংবেদি পেশিগুলো অসাড় হয়ে আছে। পা থমকে দাঁড়িয়ে রইল।
কেউ হেঁটে এসে পেছনেই খুব কাছে দাঁড়ায় নির্লজ্জের মতো। শরীরের গন্ধটা অন্তূর চেনা। চোখদুটো শক্ত করে বুজে প্রস্তুত হয় সে পরিস্থিতি সামলাতে। বাচ্চারা তখনও নামাজ পড়ছে। ছোটগুলো ভয় পাচ্ছে, নামাজে হাত বেঁধেই আড়চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি ফেলছে জয়ের দিকে।
জয় কিচ্ছু বলল না মুখে। অন্তূর হাতটা চেপে ধরল, তাতে মনে হলো অন্তূর হাতের রগগুলো মটমট করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। পশুর মতো ভোঁতা রাগে গজরাতে গজরাতে টেনে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা আঁটকায়। তখন মাগরিবের আজানের সময় হয়ে এসেছে প্রায়।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই—বড়ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই আরও দুজন ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অন্তূ। জয় কেবল চোখের ইশারা করতেই ওরা দ্রুত সিঁড়ির দরজা আঁটকে দেয়। অর্থাৎ এখানে অন্য লোকেরাও আসে। তবে বাগানের পথ দিয়ে।
জয় দেয়ালে কনুই ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল কপালে ঘঁষছিল। বারবার ঠোঁট ভেজাচ্ছে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ ভালোই শিখেছে আজকাল। আজ আর অশ্রাব্য ভাষায় বকে উঠল না।
অন্তূ সামনে এসে দাঁড়ায়, “ওদের কেন আঁটকে রেখেছেন?ʼʼ
-“তা জেনে তোমার কাজ নেই। এসব থেকে দূরে থাকো।ʼʼ
-“আমি জানতে চাইছি, কেন ওদের আঁটকে রাখা হয়েছে? ওই পাঞ্জাবী পরা ছোট্ট ছেলেটা কে?ʼʼ
-“মাদ্রাসার ছাত্র।ʼʼ নির্বিকার জবাব দিচ্ছিল জয় একের পর এক।
-“ওর বুকে কোরআন ছিল।ʼʼ
জয় ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট বাঁকায়, “হু, হাফেজ ও।ʼʼ
-“ওদের আঁটকে কেন রেখেছেন?ʼʼ অন্তূ গর্জন করে উঠল।
-“নতুন তো না কিছু! এর আগে শোনোনি কখনও মাদ্রাসার ছাত্রদের আঁটক অথবা হ-ত্যা-র ঘটনা? আস্তে কথা বলো। থাপড়ে কান-টান দিয়ে রক্ত বের করে দেব একদম। গলার সাউন্ড আস্তৃ হয়না, না?ʼʼ
-“কেন করা হয় এসব?ʼʼ
-“জামায়াত শিবিরের ছেলে ওরা। দেশদ্রোহী, শালারা জঙ্গির দল। আর একটা প্রশ্নও করবে না।ʼʼ
-“ওদেরকে আপনারা কেন আঁটকে রেখেছেন?ʼʼ
-“উপরমহলের হুকুম।ʼʼ
-“উপরমহল? কোন উপরমহল? আপনি কে?ʼʼ
-“জয় আমির!ʼʼ
অন্তূর স্বর ধীরে ধীরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। বহুদিন পর তার এই রূপ। কিছুদিন বেশ শান্ত ছিল।
-“আপনার আব্বু জাভেদ আমির যুদ্ধাপরাধী ছিলেন?ʼʼ
-“দাদু জলিল আমির মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।ʼʼ
-“আর?ʼʼ অন্তূ অবাক হয়ে যায়।
জয় ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে কপাল কুঁচকায়, এরপর আলতো হাসে, “আচ্ছা। তো ফ্যামিলি হিস্ট্রি জানতে চাও? আগে বলবে না? তোমার হক আছে তো। কিছুই জানো না তেমন শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে।ʼʼ
-“মুক্তিযোদ্ধার ছেলে যুদ্ধাপরাধী?ʼʼ
-“কোনো সংবিধান এমন নেই যে, মুক্তিযোদ্ধার ছেলে যুদ্ধাপরাধী হতে পারবে না। ছোটচাচা জয়নাল আমির রাজাকার ছিলেন। তো?…ʼʼ ঘাঁড় বাঁকা করে তাকায় জয়।
-“সোজা ভাষায় বলুন, পুরো পরিবারটাই কসাই ছিল।ʼʼ
দুপাশে মাথা নাড়ে জয়, “নাহ। তা আবার ছিল নাকি? আমার সাত-পুরুষের কেউ কোনোকালে মাংসের ব্যবসা করে নাই। আমার দাদুভাই ছিলেন মশলা ব্যবসায়ী। সেই আমলে বিদেশের সাথে মশলার কারবার-টারবার করতো। আমার বাপ-চাচার ছিল কাঁচামালের ব্যবসা। আমি অবশ্য বেকার। তবে তুমি যদি কোনোদিন সংসার-টংসার করতে আন্তরিকভাবে রাজী হও, তাইলে একটা কাম-কাজ শুরু করতে পারি। মেয়েলোক আবার বেকার ব্যাটাছেলে পছন্দ করেনা।ʼʼ
-“কথা ঘোরানো শেখাবেন আমায়? খুব দক্ষ আপনি বিষয়টাতে।ʼʼ
জয় গম্ভীর হলো, “তুমি এসব থেকে দূরে থাকো, আরমিণ। তোমার প্রতিবাদী চিন্তাভাবনা আজ তোমাকে এত দুর্ভোগে এনেছে। সহ্য করে যে, বেঁচে থাকে সে।ʼʼ
-“চিরকাল?ʼʼ
জয় তাকায়। অন্তূ তাচ্ছিল্য হাসে, “চিরকাল বেঁচে থাকে? যারা সহ্য করে তারা অমর হয়ে যায়? আর জীবনে মরে না?ʼʼ
-“স্বাভাবিক মৃত্যু আর সংগ্রামীদের মৃত্যু একরকম হয়না। পঁচে মরার শখ কেন হয়েছে?ʼʼ
-“সহ্য করে আজ বেঁচে থেকে আগামীতে যদি মৃত্যুর হাতে ধরা দিতেই হয়, তো আজ মরব। আজ মরব তো এখন মরব। কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই না। সহ্য করে, চুপ থেকে, প্রতিবাদ না করে যদি গড় আয়ু হিসেবে বড়জোর ষাট বছরের বেশি না বাঁচা না যায়, তবে আমার বুকের ভেতরে যে আগুন জ্বলছে সেই আগুনে আপনাদের ঝলসে মারতে শুধু ষাট সেকেন্ড বাঁচতে চাই। এর বেশি একটা শ্বাসও ফেলব না এই নারকীয় দুনিয়ায়। এই অপরাধের সাম্রাজ্যে কয়েকযুগ বেঁচে থেকে শোষিতদের হাতে শোষন হবার চেয়ে কবরের মাটি অসীম শান্তিদায়ক। রক্তমাখা শরীরে আমি ওই মাটিতে মিশতে চাই।ʼʼ
জয় অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থাকে অন্তূর ক্ষিপ্ত মুখখানার দিকে। পরে বলে, “আর একবার ওই ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তোমার এই ইচ্ছেটা পূরণ করে দেব, ঘরওয়ালি। পা দুটো কেটে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে এডমিট করে রেখে আসব। বাঁচার ইচ্ছে না থাকলে কাউকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক না।ʼʼ
-“তার আগে আপনাকে আমি জাহান্নামের রাস্তা অবধি এগিয়ে দিয়ে আসব, জয় আমির। আপনাকে অনেক সুযোগ দিয়েছি। মানছি আপনাদের রাজত্ব চলছে। তবু মানুষই তো আপনারা! মেরে মরলে আর কী! আমার তো আর পিছুটান নেই কিছুর।ʼʼ
জয় দেয়াল থেকে সরে এসে ঝাঁকি মেরে অন্তূকে দুহাতের বাঁধনে পুরে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ধরে। দাঁত চেপে চাপা গলায় বলে, “চুপ। এত কথা কস ক্যা তুই, শালী! চুপ থাক।ʼʼ
-“কেন বাঁচাতে চান আমায়? আপনার মতো জানোয়ারের সহায়তায় বেঁচে থাকার কোনো লালসা তো আমার নেই।ʼʼ
জয় কথা বলেনা কিছুক্ষণ। তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। টুপ করে অন্তূর গলায় একটা চুমু খেয়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি ঘষে অন্তূর গলায়। ছিটকে যাবে তাই চেপে ধরে রাখে অন্তূকে। কিছুক্ষণ পর অন্তূর মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে, “যা হচ্ছে দেখে যা, আরমিণ। তোর কিছু করার নেই বিশেষ। বড়জোর আমাকে মেনে নিতে পারিস। আমি খুব একটা খারাপ না, অন্তত তোর জন্য।ʼʼ
অন্তূ মুখটা শক্ত করে অন্যদিকে ফিরতে চায়, “আবার একবার জন্মাই যদি; প্রার্থনা থাকবে, সেবারেও যেন এই আপনাকে না ভুলি। আর আমার ঘৃণায় যাতে একরত্তি পরিমাণ কমতি না আসে সেকালেও।ʼʼ
জয় গা দুলিয়ে আওয়াজ কোরে হাসে, “আমিন আমিন। তোমার আল্লাহ কবুল করুন এই ফরিয়াদ।ʼʼ
-“আপনি নাস্তিক?ʼʼ
-“না নাহ। ঠিক তা না। কিন্তু আমার মতোন পাপীদের তোমার আল্লাহ উপাসক হিসেবে মানেন কি-না তা তো জানা নেই…ʼʼ
মাঝেমধ্যেই যখন ভদ্রলোকের মতো কথা বলে জয়, তখন খুব নিখুঁত লাগে শিক্ষিত হিসেবে। অন্তূ রুষ্ট চোখে অবুঝের মতো চেয়ে থাকে।
দরজায় করাঘাত পড়ে। জয় শীতল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তূ তাকায়। তার অস্থির চোখদুটো একবার শান্ত জয়কে দেখে আবার দরজার দিকে চায়। দরজার ওপাশ থেকে হামজা এবার ডেকে ওঠে, “জয়!ʼʼ
চলবে…
[ফাও পর্ব হিসেবে পড়ুন। আপনাদের এত এত অনুরোধ ফেলতে পারলাম না, দিয়েই দিলাম অবশেষে। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। ঈদ মোবারক সবাইকে।]