#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৫০.
রাজন আজগর তার টাকার পাহাড়ের একাংশ দিয়ে বিশাল একটা ভবন তৈরি করেছে ঢাকা শহরে। ভবনটি একুশ তলা। প্রতিটা ফ্লোর ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। আবাসিক একটা ফ্লোর ছিল আঠারো তলায়। সেখানেই তাকে মারা হয়েছে, খুব নৃশংসভাবে। পুরো সাত ঘন্টা পর তার লাশের হদিস পাওয়া গেছে। সেটা পেয়েছে একজন সার্ভেন্ট। সে সকালের ড্রিংক দিতে এসেছিল।
পলাশ সোফাতে গেড়ে বসে থাকে। কাকার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। সে যখন ছোট, তখন তার বাপ ক্রশফায়ারে মারা গেল। মা-টা পাগল ছিল। পলাশকে অমানুষিক অত্যাচার করতো। যখন-তখন পশুর মতো মারা, খেতে না দেয়া, ভাঙচুর করতো মহিলা। পড়ালেখা থেকে শুরু করে সবটুকু ঠাঁয় সে কাকার কাছেই পেয়েছে। পলাশ জীবনে প্রথম খুনটা তার মাকে করেছিল।
একদিন সকালে পলাশ ঘুমিয়ে আছে। তার মা তাকে ঘুম থেকে ডেকে জাগানোর বদলে অন্যভাবে জাগিয়ে তুলল। চামচের দণ্ড গরম করে এনে পলাশের শরীরে ঠেকিয়ে দিলো। উপরের চামড়া পুড়ে শরীরের মাংস ঝলছে গেল। পলাশ খুব কাঁদছিল, যদিও সে জানতো তার মা কান্নার আওয়াজ পছন্দ করেনা। এরপর তার মা এলো বাথরুম পরিষ্কার করার দাহ্য-রাসায়নিক নিয়ে। সেদিন পলাশ তার পাগল মাকে মেরে ফেলেছিল। তখন সে স্কুল-ছাত্র
তার চোখে নারী মানে অমানুষ, ঠিক তার মায়ের মতো। পরে জেনেছে তার মাকে পাগল বানিয়েছিল, তার বাপ-চাচা মিলে। কড়া ড্রাগ দিয়ে দু’ভাই ওর মাকে নিয়ে ফূর্তি করেছে বছরের পর বছর।
তবু কাকাকে সে কিছু বলেনি। মায়ের অত্যাচারগুলো ছাড়া আর কোনো কিছুই তার স্মৃতিতে ছিল না। তার মনে হয়েছে, তার মায়ের সাথে ওরকম আচরণ করা ভুল না। ততদিনে যে সেও স্যাডিস্ট হয়ে গেছে, তা বোঝেনি। পাগল বোঝেনা, সে পাগল।
রূপকথার কান্না পাচ্ছিল। হাজার হোক বাবা। বিয়ের আগ অবধি বাবা তাকে, সেও বাবাকে ভালোবাসতো। পলাশের সাথে বিয়ে না হলে হয়ত আজও তেমনই থাকতো।
পলাশ যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল, তখনই খবর এলো, হোটেল এবং সবগুলো ডেরায় আইনরক্ষাকারী বাহিনী গোটা ফোর্স নিয়ে ঢুকেছে। পলাশ বুঝল না, একসাথে এতকিছু হচ্ছে কী করে? কে করছে? কিছুক্ষণের মাঝে যে ফোর্স বাড়িতে ঢুকে পড়বে তা নিয়ে মোটেও সন্দেহ নেই পলাশের। রূপকথার হাতটা ধরে দ্রুত রুমে নিয়ে যায়। তাড়া দেয়, “দ্রুত বের হ। বের হতে হবে এক্ষুনি।ʼʼ
‘“আমি তোমার সাথে কোথাও যাব না। অপরাধ করো তুমি, তোমাকে ধরা হবে। আমি বাবার কাছে যাব। তুমি পালিয়ে বাঁচো।ʼʼ
পলাশের চোখের মণি লাল হয়ে উঠল। অথচ ভয় পেল না রূপকথা। বারবার কল আসছে ম্যানেজারের। দলছূট হয়েছে ওদিকে, সেটা নিশ্চিত। দেশের বাইরে লিগ্যালি যাওয়া সম্ভব নয় এ অবস্থায়। কোথাও আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ক’দিন পর বর্ডার পার হতে হবে। ওপারে বার্মা( মায়ানমার ) পৌঁছাতে পারলেই হলো। সেখানে তার ব্যাকআপের অভাব নেই।
পলাশের হোটেলে একটা ফ্লোর শুধু মদ আর অনৈতিক নেশাদ্রব্যে ভরা। সেটা পুলিশ জব্দ করল। ম্যানেজারকে বাড়িতে গিয়ে ধরা হয়েছে। হোটেলে সকাল সকাল মেয়েলোক নিয়ে কত কাস্টমার ঘুমাচ্ছিল। তারা সবাই পুলিশের জিম্মায়। কতগুলো থানায় পলাশের পেইড-এজেন্ট আছে, তার হিসেব পলাশ নিজেও রাখেনা। সেসব অন্যকেউ সামলাতো। অথচ সেইসকল কিনে রাখা লোকদের পার করে এতবড় ফোর্স উদয় করতে পারে কারা, তা বুঝতে পলাশের খুব বেশি সময় লাগল না।
তার লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সেটা পলাশ শেষরাতের দিকে জানতে পেরেছিল। কিন্তু কাকাকে কে মেরেছে? সে-ই? নাকি অন্যকেউ?
—
অন্তূ এসব খবর পেল ওয়ার্কশপের ছেলেদের কাছে। রতন দোতলায় উঠে অন্তূকে ডেকে বলল, “ভাবী। আজ কোথাও বের হইয়েন না। অনুরোধ লাগে।ʼʼ
-“কেন? বিশেষ কিছু হয়েছে?ʼʼ
গাইগুই করছিল রতন। অন্তূ বলল, “নিঃসংকোচে বলুন রতন ভাই।ʼʼ
-“ভাই মানা করছে। আপনারে পাহাড়া দিতে কইছে।ʼʼ
‘“আমাকে?ʼʼ
-“হ। বিশেষ কইরা আপনারে। গোটা বাড়িডাও।ʼʼ
-“কেন, তা কিছ বলেনি?ʼʼ
রতন জয় আমিরের বউয়ের সম্মুখে একটু থতমত খেয়ে যায়। মেয়ে মানুষ, অথচ কথাবার্তার ভাঁজ কেমন জানি, কড়া।
-“ভাবী। আপনে বাইর হইয়েন না। প্লিজ!ʼʼ
অন্তূ অবাক হলো, “এমনভাবে বলছেন কেন? আমি কি খুব অবাধ্য, এমনটাই জানেন আপনারা?ʼʼ
রতন কথা বলে না। কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অন্তূ ভ্রু নাচায়। রতন মেকি হাসে, “না মানে, আমর জানি, ভাইয়ের কথা আপনে শোনেন না। ভাইরে মানেন না আপনে। সরি ভাবী। মানে…ʼʼ
অন্তূ কপাল চেপে ধরে মুচকি হেসে ফেলল, “আপনারা ভয় পান, আমাকে?ʼʼ
-“হ। না মানে, না। ভয় না…ʼʼ
-“আমি কি খুব অসভ্য?ʼʼ
-“ছিঃ কী কন? তা কইছি নাকি? আল্লাহ মাফ করুক। ওমন কথা কমু নাকি? ও ছিঃ। আপনে খুব ভালো।ʼʼ
-“কী করে বুঝলেন?ʼʼ
-“এই লাইনে আছি বইলা কি অমানুষ হইয়া গেছি? মানুষ চেনার ক্ষ্যামতা আছে আমাগো। আমি খালি কইছি, ভাই আপনারে খুব মান্যি করে। মানে আগে কুনুদিন কাউর সামনে থামতে দেহি নাই জয় ভাইরে। আপনে…ʼʼ
-“আচ্ছা আচ্ছা! সেসব যাক। আপনার ভাইয়ের নম্বরটা দেবেন তো।ʼʼ
অন্তূর ফোন জয় নিয়ে নিয়েছে। তুলির ফোন এনে নম্বর তুলল। রতনকে বলল, “আজ যেহেতু আমরা সব বন্দি। চলূন পিকনিক করি! আমি রান্না করব। দুপুরে সবাই খেতে চলে আসবেন, কেমন!ʼʼ
অবাক এবং খুশিতে একাকার হয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে যায় রতন। অন্তূ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে। কয় বছর আগের কথা? অন্তূ কতই না ডানপিটে আর চঞ্চল ছিল। আজকাল মানুষ নাকি তাকে ভারী মনে করে। ভয় পায়! জয় নেই, আজ সে রোজা রাখেনি।
প্রথম দুই তিনবার কল রিসিভই হলো না। পরে রিসিভ করেই জয় ঝারি মারল একটা, “বালডা আমার, এখন কল করেছিস ক্যান? দাওয়াত খাইতে আসছি, আমি? কী দরকার তোর? ফোন রাখ।ʼʼ ধমক মারল একটা।
অন্তূ শান্ত স্বরে বলে, “আমি। আমি কথা বলছি।ʼʼ
জয় বোধহয় অবাক হলো, “ঘরওয়ালি! আপনি কল করছেন আমায়?ʼʼ
অন্তূ সেইসব আন্তরিক প্যাঁচালে সাঁয় না দিয়ে বলল,
“কোথায় আপনি?ʼʼ
-“আপনার টেনশন হচ্ছে?ʼʼ
-“কথা বাড়াবেন না। জবাব দিন।ʼʼ
-“রাজধানীতে আছি। ফিরব আজই। চিন্তি কোরো না। ঠিক আছি আমি।ʼʼ
-“আমি চিন্তা করিনা আপনার।ʼʼ
জয় হাসল। অন্তূ বলল, “রাজন আজগর মারা গেছে, শুনলাম।ʼʼ
অলস কণ্ঠে বলল জয়, “হ, আমিও শুনলাম।ʼʼ
রতন এসে দাঁড়াল। অন্তূর কিছু লাগবে কিনা তা জানতে এসেছে সে।
-“আমি বের কেন হবো না? আজ বিশেষ কীসের রেস্ট্রিকশন রেখেছেন?ʼʼ
-“পলাশের ব্যবসায় রেড মারছে বেয়াই বাড়ির লোকজন।ʼʼ
-“তাতে আমাদের কী?ʼʼ
-“আমাদের? আমি-তুমি মিলে আমাদের নাকি?ʼʼ
-“আপনার রসিকতা বিরক্ত লাগছে।ʼʼ
-“লাগেনা কখন? সেদিন পলাশ একটা দাবি করেছে।ʼʼ
-“কী দাবি?ʼʼ
-“তোমাকে পলাশের লাগবে। এতকাল তো পাটোয়ারী বাড়ির ভীত ভেঙে তোমার গায়ে টোকা লাগাতে পারে নাই। তার ওপর পার্টনারশীপের একটা ধর্ম আছে না! কিন্তু পুরাতন মেলা হিসাব রয়ে গেছে। জানো মনেহয় সেসব। আমরা-পলাশরা ভুলিনা, কিছুদিন চুপ করে থাকি। তারপর খপ করে ধরি। ওরও কিছুদিন হয়ে গেছিল। তো সেদিন ফাইনালি বলল, তোমাকে লাগবেই। এতদিন ভার্সিটি গেলে ধরে-টরে ফেলতো। যাও নাই, পারে নাই।ʼʼ
অন্তূর নিঃশ্বাসের গতি বাড়ল, “এরপর?ʼʼ
-“এরপর কী? আমার ওপর কৃতজ্ঞতা আসতেছে না?ʼʼ
অন্তূ ইশারায় রতনকে চলে যেতে বলে। রতন বাধ্যর মতো আদেশ পালন করল অন্তূর। জয় বলল, “আমার মনে হলো, তোমাকে পলাশের কাছে দিতে চাইলে তুমি রাজী হতে না কোনোভাবেই। হতে?ʼʼ
-“হতাম না।ʼʼ
‘“এই তো! আর কী? এজন্যই একটু লাড়াচাড়া দিছি। এইটা বুঝতে পলাশের দেরি লাগবে না, যে আমিই দিছি বেয়াইবাড়িতে লাড়াচাড়া। ব্যবসা হারায়ে পাগল শালা আরও পাগল হবে এবার। ফেরোয়ার হয়ে ঘুরবে। বিপদ চারদিকে। বাড়ির আশপাশে তিন-চার রকমের শত্রু ঘুরছে। বের হবেনা বাড়ি থেকে, খবরদার। আমি আসি। বসে কথা বলবোনে। ব্যস্ত আছি, এত কথা বলার পরিস্থিতি নাই।ʼʼ
অন্তূ কল রেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। পলাশ তাকে বলেছিল, তাকে পলাশ ছাড়বে না। অথচ এ বাড়িতে আসার পর বাইরের সবকিছু ভুলেই বসেছে। বাড়ির ভেতরেই একের পর এক যা ঘটে চলেছে! মুস্তাকিন মহান কোথায়?
আচ্ছা! সে কি স্বার্থপরের মতো ভাবছে? এই জয় আমির শুধু তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দু-একটা পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সে কি আসলেই কৃতজ্ঞতা বোধ করছে লোকটার প্রতি? আর সব অপরাধ? অন্তূ গা ঝারা মারে। সে স্বার্থপর, তবে এমন স্বার্থপর নয়। এখনও বাচ্চাগুলো প্রায় দু’দিন না খাওয়া। অন্তূ অস্থিরতা ও ক্লান্তিতে সোফাতে বসে পড়ল। কী হচ্ছে চারদিকে। সংকট কি কাটবে না? ঝড় ঘনিয়ে আসছে। আম্মুকে কল দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল, খোঁজখবর নিলো। তারা ভালো আছে ওখানে। অন্তূ জানতো, এই শহর ছাড়লে ভালো থাকবে ওরা।
—
ঝন্টু সাহেবের স্টোররুমটা কতটা নিরাপদ, তা জানা নেই পলাশের। তবু মানুষগুলো নিরাপদ। মাজহার সিগারেট ফুঁকছে একটা বস্তার ওপর বসে। সরু আলো অন্ধকার দূর করেনি ঘরের। পলাশ একটা কাঠের খণ্ডে তবলা বাজাচ্ছিল আঙুল দিয়ে। যেন সে খুব আরামে, নিশ্চিন্তে আছে।
ঝন্টু সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ও পলাশ! তোমার কথা মতোন এতকাল চুপ করে আছি। এইবার যখন নিজের পেছনে ঘা লাগছে, তখন ওই দুই শালার চেংরার পিছে লাগবার চাও? আগেই কইছিলাম ব্যবসা গুটাও, দুইডারে খতম করে দাও। আমি আমার বাড়ির মেয়ে এক শুয়োরের কাছে বিয়ে দিছি। রাক্ষস, নটকির পো।ʼʼ
পলাশ চোখদুটো বুজে রেখেই বলল, “মামা, কথা কম বলুন। মেজাজ গরম করবেন না।ʼʼ
মাজহার সিগারেট ফেলে আরেকটা ধরালো। একের পর টেনে যাচ্ছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ সহজ কাজ নয়। আপন মনেই বলল, “শালার হাসপাতালের সেই দিনগুলা ভুলছি আমি? নেহাত বোন জামাই না হইলে কবে বানচোতটারে পুঁতে ফেলতাম। রিমিরে ওই বেজন্মার কাছে বিয়ে দেয়া ভুল হইছিল সেইকালে। আমার একেকটা আঘাত আর ব্যথার শোধ না তুলে পলাশ ভাই তোমার হাতি দিব না দুইডারে। তুমি দিনের পর দিন থামায়ে রাখছো। নয়ত কবে দুইটারে জবাই করে ফেলতাম। খালি তুমি….নয়ত…ʼʼ
-“নয়ত কী করতি?ʼʼ পলাশ চোখ খুলে তাকায়। জ্বলজ্বলে মণির দুপাশে শিরায় শিরায় রক্ত জমেছে।
মাজহার রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাকায়, “আব্বা বসে আছে। কিছু বলতেও পারতেছি না। শোনো পলাশ ভাই! একবার ওই বাড়িত ঢুকলে সবগুলা মাগী-মিনসের পেছন মেরে তবেই ফিরব।ʼʼ
পলাশ হাসল। সাধারণের চেয়ে বেশি ভয়ানক দেখালো তার ফ্যাসফ্যাসে হাসি। আধো-অন্ধকারেও চোখদুটো জ্বলছে সাপের মতো। বলল, “জয়ের বউ মেইন ফ্যাক্ট রে, মাজু। ওই চেংরী যেদিন থেকে কাহিনিতে এন্টার করছে, শালার বাজিই পাল্টে গেছে। জয় আর জয় নাই। আমার সাথে কী কী না করছে, তবু কিচ্ছু কইনাই। ক্যান বল তো!ʼʼ হেসে উঠল জোরে করে পলাশ।
মাজহার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। তার কালো চেহারা আরও কালো হয়ে উঠেছে। সে সহ্যই করতে পারেনা জয়-হামজার কথা। আজ ওই দুই শুয়োরের বাচ্চা রাস্তায় না এলে তারা থাকতো জেলার রাজনীতিতে জমজমাট। অথচ দশটা বছর ধরে তারা মন্দায় পড়ে আছে। বাপ-চাচার নাম লুটপাট হয়ে গেছে। এক এক করে কাকা-বাপ সব গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের রাজনীতি থেকে।
পলাশ বলল, “রাজনীতিবিদগুলারে আমার ঠিক ততটা দরকাল, যতটা মনে কর ঠিকমতো হাঁটতে গেলে শক্ত মাটি দরকার হয় পায়ের তলায়। ওরা ছাড়া তো গতি নাই। দেশের টেরোরিজমে ওরাই শক্তি-ওরাই মুক্তি। জেল থেকে বাঁচাবে, ব্যবসায় নিরাপত্তা দেবে, পুলিশ-প্রশাসনকে কুত্তার মতোন চালাবে, বর্ডার পার করবে….ওরা ছাড়া গতি আছে? হাতে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার ইগোর চেয়ে বড় কিছু নাই। ওইডা চটকাইছে জয় প্রথম ওর বউয়ের জন্য। অথচ আমি আজ পর্যন্ত চুপচাপ। কিচ্ছু করিনাই সেই মেয়ের। নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকে।ʼʼ
সিগারেটটা কেঁড়ে নিলো মাজহারের থেকে। দুটো লম্বা টান দিয়ে বলল, “একটা মাগীর কাছে হার মেনে গেল। সেই মাগীরে ছাড়ব? না ওই দুইটারে? ক। দিন খারাপ চলছে, চলতে চলতে নতুন দিন আসবে না? ওরা যাবে কোথায়?ভাবে না এসব?ʼʼ
মাজহারের খারাপ লাগল না পলাশের কথা শুনে। পলাশের মতো সন্ত্রাসরা রাজনীতিবিদদের টিস্যুর মতো হাতে রাখে, এই স্বীকারক্তিতেও খারাপ লাগল না। কারণ তারা তো আর রাজনীতিতেই নেই। সব ডাউন। নাম-খ্যাতি-ক্ষমতা সব গেছে। মানুষের নীতি এটা। যা নিজের কাছে নেই, অথচ থাকলে লাভ ছিল। এরকম জিনিসের ক্ষতি সাধনে মানুষ সুখ পায়। ব্যাপারটা ওরকম—আমার নেই, তোর থাকবে কেন? অথবা হয় আমার হ, নয়ত ধ্বংস হ। মাজহারের মনে এখন তাই চলছে। যে ক্ষমতা তাদের নেই, সেই ক্ষমতার নামে বদনাম শুনতেই আরও সান্ত্বণা লাগছিল।
পলাশ চোখ বুজে দেয়ালে পিঠ হেলান দিয়ে বসে থাকে। পরিকল্পনা সাজায়। রূপকথাকে পুরোনো বাড়িতে রেখে এসেছে। পোস্ট-মর্টাম শেষে কাকার লাশ আসতে দু’দিন দেরি হবে। শুধু জয়-হামজা না। তার নিজের লোক বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যাকে সে আইন সামাল দিতে মিথ্যা পরিচয়ে বসিয়ে রেখেছিল। রক্ত ফুটছে ভেতরে। বাই এনি চান্স, সে ধরা পড়লে তার ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। সে একটা প্রতিজ্ঞা করল, কারাবরণ অথবা ফাঁসির আগে সে সবগুলোকে অন্তত তার পাগলামী দেখাতে চায় একবার। এরপর সব শাস্তি মঞ্জুর। তবে তার আগে প্রতিশোধ। যারা তার এত সাধের ত্রাসের সাম্রাজ্যে ফাঁটল ধরিয়েছে, তারা বেঁচে থাকতে দেশ ছেড়ে পালাবে না সে।
হোটেল থেকে শুরু করে প্রতিটা ডেরায় সিল পড়েছে। সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তও হয়ে গেছে বোধহয় এতক্ষণে। হন্য হয়ে পুলিশ খুঁজছে তাকে। তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে কাকার খুনের জন্য। জয়ের এই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সে পণ্ড না করে দেশের সীমান্তের ওপারে পা রাখবেনা।
—
ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ খুব কানে লাগে। নিঃশব্দ রাত।
রাত তিনটা বাজছে। অন্তূ জায়নামাজের ওপর ঘাঁড়ের নিচে মাথা রেখে শুয়ে থাকল অনেকক্ষণ। জয় উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। খুব ক্লান্ত সে। ঘরে ঢোকার পর থেকে ঘরের ভেতরে একটা উৎকট গন্ধ বদ্ধ হয়ে আছে। সে শুয়েছে মিনিট দশেক হবে। রুমে এসেছে তার অল্প কিছুক্ষণ আগে।
অন্তূর ধারণা, কাউকে টর্চার করে ঘরে ফিরছে সে। রাজধানী থেকে ফিরেছে রাত এগারোটার দিকে। অথচ বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি একবারের জন্যও। মাঝরাতে গোসল করার অভ্যাস পুরোনো। ঝটপট গোসল করে এসে শুয়ে পড়ল। রাত বাড়ছে, সাথে অন্তূর ভাবনারাও।
আজ ওরা কাউকে জিম্মি করে নিয়ে ফিরেছে, এটা অন্তূর ধারণা। একজন নয়, একাধিক ছিল তারা। অন্তূ উঠে দাঁড়াল। তার মন টিকছে না। বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে হয়ত এখনও। অন্তূর মুখে খাবার রোচে না, গলা দিয়ে নামেনা। খিদেও লাগেনা।
সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, জয় উপুড় হয়ে বালিশের ওপর মুখ গুঁজে জড়ানো কণ্ঠে বলল, “আরমিণ! বাইরে যাবি না।ʼʼ
অন্তূ কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকল সে-কথা শুনে। তারপর তা অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
এ সময় বাগানে যাওয়া সম্ভব নয়। লোহার গেইটটা দিয়েই ঢোকানো হয়েছে লোকগুলোকে।
লম্বা বারান্দার সিঁড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। অন্তূ দু তিনবার টানল, ব্যর্থ চেষ্টা তালা ভাঙার। আব্দুল আহাদ সাধারণত ভিতরে বসে কোরআন তেলওয়াত করে। কী যে সুন্দর শুনতে লাগে! অন্তূ এই দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনতে পায়। খিদেতে হয়ত চুপ করে আছে বাচ্চাগুলো! অন্তূর বুক পুড়ছিল। সে নিজেও কিছু খায়নি। রান্না করেছে, সকলকে খাইয়েছে, কিন্তু নিজের পেটে খিদের অনুভূতি টের পায়না আজকাল বিশেষ।
দরজায় হেলান দিয়ে বসল অন্তূ। রুমে যেতে ইচ্ছে করছেনা। ঘুম আসবে না কোনোভাবেই। চোখদুটো বুজতেই আব্বুর মুখটা ভেসে ওঠে। চমকে তাকায়। অন্তূর মনে হলো, আব্বুর গায়ের গন্ধ পেল খুব কাছে। কয়েকফোঁটা নোনাজল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে। ক্লান্ত হয়ে উঠেছে রুহুটা। আর চলছে না। প্রগাঢ় অন্ধকারে বসে থাকে অন্তূ। ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া চারপাশ নিস্তদ্ধ। কোথাও আলো নেই, নেই জনমানব। বাচ্চাগুলো কুটুরিতে বন্দি। আজ বুঝি আরও কিছু এসেছে!
অন্তূ টের পায়, আমজাদ সাহেব এসে বসলেন পাশে। অন্তূ কাধটা হেলিয়ে দিয়ে কল্পনা করে, সে আব্বুর কাধে মাথা রেখেছে। আমজাদ সাহেব বললেন, “শক্ত হ, অন্তূ। বি স্ট্রং। তীর সম্মুখে। এ নৌকা ভিড়বে না। চলন্ত নৌকা থেকে ঝাঁপ দিবি। একটু গড়িয়ে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হবি। পরক্ষণে গা ঝেরে উঠে তোকে তীরের গভিরে দৌড়াতে হবে। তুই তৈরি। অন্তূ?ʼʼ
তখনই লৌহ কপাটের ওপারে, ভেতর থেকে এক পৌরুষ কণ্ঠস্বরে সুতীব্র সুর ভেসে আসে কিছু শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত হয়ে,
সেদিন আর রবে না হাহাকার, অন্যায়, জুলুম, অবিচার
থাকবে না অনাচার, দূর্নীতি, কদাচার..
সকলেই শান্তিতে থাকবে।
সেদিন সবাই খোদায়ী বিধান পেয়ে দুঃখ-বেদনা ভুলবে….
অন্তূর গা’টা শিউরে ওঠে। সে ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজায় হাত রাখে। তার ভেতরে কাঁপুনি উঠেছে। উত্তেজনায় বুক টলছে! এ কীসের সুর, নীরব যুদ্ধের দামামা! কোনো পুরুষের সাধারণ স্বরের গাওয়া এক সংগীতে এত বিদ্রোহ থাকতে পারে? এত সুকরুণ, তবু যেন রণ-ঝংকার বাজছে। কণ্ঠস্বরটা চেনার চেষ্টা করে অন্তূ। সেই অস্ত্রের মতো ঝনঝনে স্বর ফের সুর টানে,
কোনো একদিন….. এদেশের আকাশে….
কালিমার পতাকা দুলবে
সেই দিন আর নয় বেশি দূরে, কিছু পথ গেলে মিলবে…
অন্তূর শরীরটা ঝাঁকি মেরে ওঠে। মনেমনে বলে ওঠে, “ওরে টান! কে আপনি যুবক! এত বিরোধ-অগ্নি!ʼʼ কখনও আবার বলে ওঠে, “মাশাল্লাহ!ʼʼ
অন্তূ চাতকের মতো পিপাসার্ত হয়ে চেয়ে থাকে অন্ধকারেই সেই দরজার পানে। মাথাটা ঠেকায় সেখানে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কীসের অশ্রু! সাহসের? অথবা পথহারা পথিকের পথ পাবার আশংকা!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]