#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৬.
হামজা বের হবার সময় অন্তূ ড্রয়িং রুমে ছিল। আজ একটা জিনিস খেয়াল করল, হামজার ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুলে ঠেলে ওঠা সেলাইয়ের দাগ। খুব বেশি। যেন আঙুল কেটে পড়ে যাবার থেকে রক্ষা করতে কোনো সময় তাতে সেলাই দেয়া হয়েছিল।
জয় বেরিয়ে গেলে অন্তূ রিমির ঘরে গেছিল। ওরা দুজন আজ রাতে ফিরবে বলে মনে হয়না।
রিমি তখন উদ্ভ্রান্তের মতো বসা। অন্তূকে পেতেই গরগর করে সব বলে বোধহয় নিজের ওপরে চাপা মারি বোঝাটা নামায়। অন্তূ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। নিচ থেকে লোহার ধাতব শব্দ আসছে ভেসে। নীরবতা ভেঙে অন্তূ প্রথম যে কথাটা চট করে বলল, “তাহলে তুলি আপু কে?ʼʼ
রিমি আরেকবার হতবাক হয়ে তাকায়। ব্যাপারটা তার মাথাতেই আসেনি। সে হামজার মুখে কথাটা শুনে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল, আর কিছু ভাবার ফুরসৎ পায়নি। অথচ আজকাল অন্তূকে বিশেষ অবাক হতে দেখা যায়না, সে যেন সে-সবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে।
অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আপনি হামজা সাহেবকে ভালোবাসেন। কেন?ʼʼ
রিমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “মাঝেমধ্যেই আমাদের বাড়িতে এই গোমড়ামুখো বিশালাকায় লোকটা যেত। দোতলার সিড়ি থেকে বসার ঘর দেখা যায়। কেন যে দাঁড়িয়ে দেখতাম লোকটাকে। একটা কথা বেশি বলেনা, এদিক-ওদিক তাকায় না। এত শান্ত মানুষ, রাগ হতো কেন জানি। অথচ কোনো কারণ ছিল না, জানেন! আমি কী করে জানব যে, লোকটা বেশ জানে, তাকে এক পুঁচকে মেয়ে ভ্রু কুঁচকে দেখে। আবার এটাও জানে, কী করে চট করে চোখ তুলে একনজর দেখে সেই মেয়েকে কঠিন লজ্জায় ফেলে দেয়া যায়? দিলো। আমি কাচুমাচু হয়ে গেলাম। ভূত দেখলে যেমন পা ভারী হয়, ওরকম আঠার মতো লেগে রইল পা জোড়া। মাঝেমধ্যেই যেত। যখন ঝন্টুবাবাদের বাসায় যেত, আমি বাহানা করে যেতাম।
অথচ একদিন এই গভীর জলের মাছ লোকটা কী করল জানেন? কানাঘুষা শুনলাম, লোকটা প্রস্তাব দিয়েছে। বাড়িশুদ্ধ কেউ রাজী না এতবড়, গম্ভীর লোকের সাথে আমার বিয়ে দিতে। ঝন্টুবাবা আর মাজহার ভাই দিয়ে দিলো। আমি ‘নাʼ করিনি। কেন করিনি, কে জানে!
ছোট বয়সে বউ হয়ে আসার পর থেকে লোকটার স্পর্শ, কথা, চোখের চাহনি আর তার ঘরণীর কাজ করতে করতে কবে যে কঠিনভাবে আঁটকে গেলাম। জানেন? কোনোদিন বলেনি আমায় কিছু করতে। অথচ তখন বয়স ছোট ছিল। একটা তাগড়া পুরুষ, যে আমার স্বামী। তার তোয়ালেটা, লুঙ্গিটা এগিয়ে দেয়ার মাঝে যে শিহরণ আছে, তাতে বুক কাঁপতো। আমায় বলতো, খাইয়ে দিতে। আমার ছোট্ট হাতের লোকমা লোকটার মুখে তুলে দেবার সময় শিরা-উপশিরার যে আন্দোলন, ও আপনি বুঝবেন না, আরমিণ। লোকটা বাইরে গেলে অপেক্ষা করা, মুরগীর বাচ্চার মতো তার বিশাল বুকের কোটরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা, তার পছন্দের রান্নাটা করা, তার ছোট ছোট ধমক…ʼʼ
রিমি হু হু করে কেঁদে ওঠে। অন্তূর খুব হাসফাস লাগছিল। অস্থির সে কতরকমই তো হয়েছে, এরকম অস্থিরতা নয় সেগুলো। বিষাক্ত অস্থিরতা। সে বুঝবে না এগুলো, রিমি বলল। ঠিকই তো। এসব সে কেন বুঝবে? জয় আর তার মাঝে হতে পারে বিয়ের খোৎবা পড়ে শরীয়ত মতে বিয়ে তো হয়েছিল, জয়ের খিদে পেলে কাছেও টেনে নেয় জোর-জবরদস্তি করে। তবে এইসব তো নেই তাদের মাঝে!
অন্তূ রিমিকে কান্নারত রেখে উঠে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়ায়। ইশার নামাজ পড়ে মুসল্লিরা বেরোচ্ছে মসজিদ থেকে। অন্তূ উদাস চোখে চেয়ে থাকে আলো-আঁধারির গোধূলিতে। জয়কে নিয়ে তার কেবল কৌতূহল আছে, আর আছে মহাবিশ্বের মতো বিস্তৃত এক বিশ্ব ঘেন্না। লোকটা ভালোবাসতে জানে কি-না, জানেনা অন্তূ। কারণ সে সুযোগ দেয়নি। তবুও জানে, জয় অন্তূর ওপর শুরু থেকেই উদার। নয়ত অন্তূর গোটা বংশ নির্বংশ করতে বাঁধা কোথায় জয়ের।
সুযোগ দেয়া উচিত। একটু মায়ায় পড়া উচিত জয়ের, অনেকটা পড়লেও দোষ নেই। একবার জয়ের বেঁচে থাকার, জগৎ সংসারে নিজেকে নিযুক্ত করার অথবা স্নেহ-ভালোবাসার হাহাকারে ভিজে ওঠা উচিত। সে জয়কে আবিষ্কার করতে চায়। তারপর বিচার করতে চায়।
তুলির ঘরে গিয়ে অন্তূ তুলিকে জিজ্ঞেস করে,“আপনার সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক কী?ʼʼ
তুলি হাসে, “বের করে দেবে আমায়?ʼʼ
-“ইচ্ছে, অধিকার কোনোটাই নেই। জানতে চাই।ʼʼ
-“জেনে কী?ʼʼ
-“না জেনেও কিছু নয়। তবু জানা ভালো।ʼʼ
-“আব্বুর অবৈধ মেয়ে।ʼʼ
অন্তূ চোখ বোজে। এটা বাড়ি না ডাস্টবিন? সবার ভেতরে দোষ। আর সব এক বাড়িতে জোট বেঁধেছে। অন্তূর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, আপনার নিজের মাকে চেনেন? তবু হামজা আপনাকে ভালোবাসে, উল্লেখযোগ্য ভালোবাসা না যদিও। এজন্যই কি আপনার এভাবে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে আসা নিয়েও এ বাড়ির কারও মাঝে কোনো হেলদোল ছিল না? এমনকি আপনার বাপেরও?
অন্তূর মনেহয়, সে নরকে এসে পড়েছে। যার অবস্থান সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূর। সমাজে বা মানুষের ভেতর ভেতর বহুত দৃষ্টিকটু-শ্রুতিকটু ঘটনারা অবাধে ঘটে যায়, কানাকানি হলে বদনাম নয়ত ওটাই সভ্যতার নামে চালিয়ে দেয়া হয়, এই তো?
বাড়িটাতে সবাই একসাথে বাস করে। অথচ মনেহয় এটা কোনো হোস্টেলের হল যেন। একসাথে থাকা ছাড়া আর পরস্পরের মাঝে তেমন কোনো মেলবন্ধন থাকার নয়। অন্তূ অবাক হতো, আজকাল সব কিছুর যোগসূত্র খুঁজে পায়। তরু শাহানার বোনের মেয়ে, তুলির মা হুমায়ুন সাহেবের উপ-স্ত্রী, হামজা কোথাকার কে, আর জয়? একমাত্র জয় আর হুমায়ুন পাটোয়ারী এ বাড়ির কেউ না কেউ।
রাত এগারোটার পর ওয়ার্কশপ বন্ধ হয়ে যায়। অন্তূ বারান্দা থেকে দেখে সব আলো নিভিয়ে সশব্দে সাটার ডাউন করে যে যার মতো বিদায় নিচ্ছে কর্মচারীরা।
মাঝরাত হয়ে আসে। অন্তূ নামাজ পড়ে। এদিক-ওদিক পায়াচারী করে। রাত একটার দিকে চাবিটা বের করে নিয়ে রিমির কাছে যায়। রিমির মানসিকতা বিদ্ধস্ত। তা সত্ত্বেও অন্তূ বলে, “চলুন, ঘরটা দেখে আসি।ʼʼ
-“খুব একটা ভালো লাগবে না আপনার ওখানে গিয়ে?ʼʼ
-“খুব খারাপ কিছু?ʼʼ
-“ভালোও না।ʼʼ
-“তাহলে তো যাওয়াই যায়।ʼʼ
-“বুঝবেন না কিছু। কৌতূহলবশে জিজ্ঞেস করবেন জয় ভাইয়াকে, এরপর হাঙ্গামা হবে আবার। আবার ঝামেলা হবে।ʼʼ
-“হবেনা। আমি আর নাক গলাবো না। শুধু দেখব। দরকার পড়লে আপনি বুঝিয়ে দেবেন।ʼʼ
-“আমি নিজেও জানিনা কিছুই।ʼʼ
তরু-তুলির ঘরের দরজা আঁটকানো। শুয়েছে ওরা। দুজন যায় চুপচাপ। রিমি লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তে স্টোররুমের ডান পাশে দাঁড়ায়। উদাস স্বরে অন্তূকে বলে, “আপনি যান। আমার ভালো লাগেনা ওখানে যেতে। আপনারও লাগবে না।ʼʼ
অন্তূর বুকে ধুকপুকানি ওঠে। হাতে শুধু একটা দিয়াশলাই। টর্চ আনেনি। কী বা দেখবে! খুব খারাপ কিছু? দেখে কী করবে? কী থাকতে পারে? কোনো অনৈতিক ব্যবসার জিনিস, বা অন্য কী? জয় বলে, ওখানে ইস্পাত, লোহা ইত্যাদি থাকে। গোডাউন ওটা। লোহা গলানোর কাজ হয়।
এই সরু বারান্দাটা গা ছমছমে। ঠিক পুরোনো ভূত-বাংলোর নির্জন করিডোরের মতোন। লাইট জ্বালাতেই অন্তূ চমকে উঠল। আজব! লাল টকটকে র-ক্তের মতো লাইট এই বারান্দায়। অন্তূ কোনোদিন জ্বালিয়ে দেখেনি। ভয়ও হচ্ছিল, সেখানে কোনো পাহারা নেই তো? না থাকার কী? হামজা-জয় ঝানু লোক।
আঁধারে লাল আলো আরও রহস্যময়তা তৈরি করছিল। অকারণেই। অন্তূ সেই দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কান পাতে। ওপাশে কারও আওয়াজ নেই। হয়ত পাহারা নেই। কেউ তো আসেনা এদিকে। এ বাড়ির দোতলাতেই কেউ আসেনা। বাড়ির লোকেরাও একেকটা অস্বাভাবিক মানুষ।
তালাটা খোলার সাথে সাথে অন্তূর বুকটাও ধুপ করে ওঠে। আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে সে। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কবরের মতো অন্ধকার। আন্দাজ করা যায়না, সামনে আদৌ কী আছে। হাত বাড়ায়। টের পাবার চেষ্টা করে, তার সামনে কিছু আছে কিনা। আশ্চর্য, পেছনের লাল আলো এক রত্তিও এই দরজার ওপারের অন্ধকার কাটাতে সাহায্য করছে না। অন্তূর এত বুক কাঁপছে কেন, সে বোঝেনা। নিজেকে ধমক দেয় একটা। সামনে কালগর্ভের মতো অন্ধকার।
বদ্ধ বাতাসে কেমন এক গুমটে ভোঁতা আওয়াজ কানে বাজে, সেটা খুব বিশ্রী লাগছিল। কমপক্ষে তিন-চার মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে অন্তূ অন্ধকারটাকে চোখে সহনীয় করার উদ্দেশ্য। কিছু স্পষ্ট হলোনা, তবে অন্ধকার চোখে সয়ে গেল।
সামনে দু-কদম সমতল ভেবে পা রাখতেই পা ছিটকে যায়। চাপা এক আর্তনাদে আশপাশের কিছু চেপে ধরার চেষ্টা করে। ধরেও ফেলে কিছু একটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুক দ্রিমদ্রিম করে ঢোল বাজাচ্ছে যেন। বুকে হাত রেখে ওকে থামানো দরকার, নয়ত স্পন্দিত হতে হতে বেরিয়ে না আসে। যে তার গতি বেড়েছে!
পায়ের অনুভবে টের পায় সে কোনো সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে, এবং হাতে ধরে আছে দুপাশের হাতল। অন্তূ অবাক হয়। এটা সে কোথায় নামছে? পাতালে? কবরখানা?
তখনই মাথায় আসে, সে দোতলা থেকে আসছে। তাহলে এই সিঁড়ি নেমে কোথায় যায়? দোতলা থেকে নামলে নিশ্চয়ই নিচতলায় যায়? নিচতলায় ওয়ার্কশপ! সে তাহলে যাচ্ছে কোথায়? ওয়ার্কশপে? তার মানে অহেতুক সন্দেহ করে এত নাটক! অন্তূর রাগ হয় নিজের ওপর এক মুহুর্ত। দৌড়ে ফিরে যেতে পা টানে।
তখনই মনে হয়, তার মস্তিষ্ক তার সাথে খেলছে। সে ভয় পাচ্ছে, চরম ভয়। এবং মস্তিষ্ক তাকে সহজভাবে ভুলিয়ে দ্রুত বিষয়টাকে কাটাতে চাইছে।
গায়ে এক ধরণের শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল। এটা অজানা ভয়ও হতে পারে। আসলেই সহজভাবে চিন্তা করলে, দোতলা থেকে এই সিঁড়ি যদি নিচে নেমে যায়, অর্থাৎ এটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেছে। এটা নিচতলার গুপ্ত সিঁড়ি। বাড়ির সামনের যে সিঁড়ি দিয়ে উপর-তলায় আসা হয়, সেটা মূখ্য। এটা গৌণ একটা রাস্তা। বাগানের সেই লোহার গেইটের কথা মনে পড়ল। তাহলে ওটা কী? ওটার পেছনে কী আছে?
এক সিঁড়ি পিছিয়ে সে দুপাশের দেয়াল হাতিয়ে বাতির সুইচ পেল। ঢালাই সিঁড়ি। দুপাশে সিমেন্টের বস্তা থেকে শুরু করে দালান বাড়ি তোলার সময় যেমন বাড়ির এখানে-ওখানে কত বাঁশ, ঢালাইয়ের যন্ত্রপাতি, চটের বস্তা ইত্যাদি ধুলো জড়ানো পড়ে থাকে, সেসব। অন্তূ তবু নেমে যায়। কোনো আগ্রহ পাচ্ছিল না। এখানেও সুইচ আছে। আলো জ্বালায়।
কিন্তু সিঁড়ি পার করে অন্তূ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়। একটা বিশাল এপার্টমেন্ট ইউনিট! এটা ওয়ার্কশপ নয়! দোতলার মতো সেম পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা গ্রাউন্ড ফ্লোর। তা কেবল ইটে গাঁথা। পুরো কাঠামো তৈরী, তবে প্লাস্টার-রঙ কিছু নেই। ফেলে রাখা হয়েছে। অন্তূর শরীরটা ঝাঁকি মেরে মেরে উঠছিল। লাইটে অল্প একটু আলোকিত হয়েছে। বাকিটা সেইরকম কবরস্থানের মতো নিস্তব্ধ, অবরুদ্ধ। রাত বাড়ছে প্রকৃতিতে।
অন্তূ আচমকা বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো চমকে ছিটকে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়ায় একদম। বাচ্চা কাঁদছে! একজন নয় অনেকে যেন! ভৌতিক সেই স্বর। এত করুণ! শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর। এই অবরুদ্ধ ইটের গাঁথুনির গোপন এপার্টমেন্টে ছোট মানুষের কান্নার আওয়াজ! অন্তূ পাগলের মতো এগিয়ে যায়। গা ঘেমে ভিজে উঠেছে। চুলের খোঁপা খুলে কোঁকড়ানো লম্বা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে যাওয়ায় আরও গরম লাগছিল। খটাং করে একটা আওয়াজ হয় তার পা কিছুতে বেঁধে।
কান্না থেমে যায়। অন্তূ থমকায়। আর আসছে না কান্নার আওয়াজ। একটা রুমে উঁকি দেয়। দিয়াশলাই জ্বালায়। রুমে কিছুই নেই। বালির মেঝে, ইটের দেয়াল। অবাক করা বিষয় হলো, জানালা নেই রুমের। অন্তূর মনে হচ্ছিল পেছনে বুঝি কেউ আছে। সে একা নয়। এত আঁধার! সে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটছিল। সাহস সবটুকু কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে যেন। শরীরে জোর পাওয়া যাচ্ছিল না আর। মৃত্যুপুরীতে এসেছে সে, পুনরায় এই ভাবনা মানসিকতাকে পুরো সম্মোহনগ্রস্থ করে রেখেছে।
একেকটা রুম পেরিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে কোথাও গভীরে। বিস্তৃত বিশাল এপার্টমেন্ট। পরের রুমটায় উঁকি দেয়। দিয়াশলাইয়ের আলোয় এ রুমের সুইচ পেল। আলো জ্বালাতেই দু-কদম পেছায়। বিশাল কক্ষ। কমপক্ষে বিশ হাত দৈর্ঘ্য ও পনেরো-ষোলো হাত প্রস্থবিশিষ্ট ঘরে বিশাল বিশাল লোহার খণ্ড, দণ্ড, কীসব মেশিন পাতি, বীম। সারি সারি সব সাজানো। যেন লোহার খনিতে চলে এসেছে সে।
আবার আসছিল সেই কান্নার আওয়াজ। অথচ কেউ নেই কোথাও। পশমগুলো অবাধ্যের মতো খাঁড়া হয়ে আছে, পা জড়িয়ে আসা আড়ষ্টতা।
অন্তূ তটস্থ হয়ে ওঠে। বাচ্চা কাঁদছে। আবার! বিশাল এই কক্ষটিতে পনেরো ওয়াটের একটি মাত্র হলদে বাতি জ্বলছে, একাংশ আলোকিত তাতে, তাও সামান্য। অন্তূর শরীরের লোমকূপে কাঁপ ওঠে। তবু সে গভীরে হারায়। এগিয়ে যায় সামনের দিকে। দুপাশের লৌহখণ্ডের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। কক্ষের শেষটায় ফাঁকা।
মোটা মোটা ইস্পাতের ধাতব খণ্ডের ভিড়ে এদিক-ওদিক তাকায় অন্তূ। এক কর্নারে একটা যেন কাটা হাত পড়ে আছে। অন্তূ বিশ্বাস হয়না, বোধহয় চোখে ভুল দেখল। ছিটকে পিছিয়ে যায়। মানুষের কাটা হাত। কোনো ভুল নেই। অন্তূ এগিয়ে যায়। হাতটা হাতে তুলে নেবার সাহস হয়না। আজ তার সব সাহস তলানিতে জমেছে। কেটে নেবার স্থান থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত, ছিঁড়ে আসা শিরা-উপশিরা, থকথকে কষানিগুলো শুকিয়ে গেছে। পুরুষের হাত। হাতের কব্জিতে ঘড়ি। আঙুলগুলো থেতলানো। তাতে রূপার আংটি এখনও আছেই। অন্তূর বমি আসে, চোখদুটো ঘোলা হয়ে ওঠে। সে কল্পনা করে, জীবন্ত অবস্থায় এই বিশালাকায় লোহার পাতের ওপর কারও হাত রেখে হাতুরি দিয়ে আঙুলের অস্থি-সন্ধিগুলো ছুটিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে হাতটাকে থেতলানো হয়েছে। লোকটা কতটা চিৎকার করেছিল? করেনি বোধহয়। কাপড় গুঁজে দেয়া যায় মুখে অথবা এই বদ্ধ ঘর ছেড়ে আওয়াজ দোতলায় কেন উঠবে?
অন্তূ উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায়না। সে মার্ডার তো দেখেছে। হামজা সীমান্তকে মেরেছে, আগুন্তুক হুমায়ুন পাটোয়ারীকে মেরেছে! তখন কষ্ট হয়নি। কারণ কী? ওই দুই ভিক্টিমের পাপ গাঢ় ছিল তাই? এই কাটা হাতের মালিকের পাপ থাকতে পারেনা?
অন্তূ ওঠে কোনোমতো। কয়েক পা এগোতেই বিকট দূর্গন্ধে মাথাটা ঘুরে আসে। এত বিশ্রী গন্ধ কীসের? অন্তূ হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। লোহা গলানোর বিশাল বিশাল অনেকগুলি চুল্লি। বাইরে থেকে ওয়ার্কশপকে এতটাও বড় লাগেনা, যতটা এখানকার যোগান। তা বড়, তবে এতটা না বোধহয়। আশপাশে বিভিন্ন ধরণের ফ্রেম ও যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। ফ্রেমগুলো অস্ত্রের। ধাতব গলন ঢেলে লৌহ-অস্ত্র বানানো হয় সে-সবে।
তার পাশেই গলিত মাংসপিণ্ড। মানুষের দেহ। থকথকে জেলির মতো পড়ে আছে। মানব দেহের আকার নেই সে-সবে। অন্তূ শক্ত করে নাক চেপে ধরে ওড়নায়, তাতে শ্বাস আঁটকে আসে। তবু গলিত মাংস পঁচার গন্ধ নাকে মুখে ঢুকছে। মানুষের দেহ পুড়ে, ঝলসে, কুঁকড়ে উঠেছে। তাতে ছত্রাক বাসা বেঁধেছে, আরও ক্ষয় হচ্ছে, দূর্গন্ধ হচ্ছে।
লোহা গলানো হয় প্রায় ১৬০০° সেন্ট্রিগেড তাপমাত্রায়। মানবদেহের সহনশীলতা কতই বা—কমবেশি ৪৫° সেন্ট্রিগেড!
সেই চুল্লিতে মানুষের শরীর ঝলসানো হয়েছে। গলিত লোহার লাভা ঢালার জন্য হাতলবিশিষ্ট পাত্র। যা লোহার দণ্ডে চেপে ধরে গলিত ধাতু ঢালা হয় ধাঁচে। ঝলসানো মাংস পঁচেছে এখানে থেকে। আচ্ছ! এখানে কি কর্মচারীরা আসেনা? শুধু জয় আর হামজা আসে?
আন্দাজ করা যায় এখনও কক্ষের অর্ধেকটার বেশি বাকি। পুরোটা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে। অন্তূ সুইচ খোঁজে।
তার শরীর ঘেমে চুপচুপে হয়ে উঠেছে। হৃদযন্ত্রের ধরাস-ধরাস আওয়াজটা কঠিন অস্থিরতার জানান দিচ্ছে। অন্তূর দেয়াল ঘেঁষে বসতে চায়। পারেনা। পাশেই মানুষের ঝলসানো মাংস, হাড়, চুল, কাটা হাত, জাহান্নামের মতো আগুন জ্বলার চুল্লি পড়ে আছে, ফায়ার পাইপগুলো কালশিটে ধরা। মেটাল বার্নার মেশিন এখানে কেন, অন্তূ বুঝল না। বড় কোনো কারবারের গোডাউন হিসেবেও এটা ব্যবহৃত হয় হয়ত।
অন্তূ চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। নিস্তব্ধ চারপাশ, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা নেই এই বদ্ধ ধাতব বেষ্টনীর মাঝে। দম ঘুটছিল খুব। আবারও আচমকাই অন্তূর মনে হলো, সে ছাড়াও আরও কেউ শ্বাস ফেলছে। কেউ নয়, কারা বুঝি। অনেকের শ্বাসের আওয়াজ। আঁটকে থাকা শ্বাসের আওয়াজ। কারা বোধহয় দেখছে ওকে। জ্বলজ্বলে চোখে। কিন্তু তাকে দেখে চুপটি করে আছে। শ্বাস আঁটকে তাকে লক্ষ্য করছে অনেক জোড়া চোখ। অন্তূর দেহটা নেতিয়ে পড়তে চায়।
আবার অস্ফূট স্বরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে অন্তূর শরীরটা ঝনঝন করে ওঠে। একবার গলা চিড়ে আওয়াজ বেরিয়েই যেন থেমে গেল। কেউ বুঝি চুপ করালো! মুখ চেপে ধরে!
বিশাল এক গুমোট আলো-বাতাসহীন কক্ষ। টিমটিম করে হলদে আলো জ্বলছে। এই কান্নার আওয়াজ সে বহুবার শুনেছে হয়ত। রুমের বারান্দায় দাঁড়ালে মাঝেমধ্যে এই আওয়াজই কি কানে যেত? জয় তখনই ওকে ভেতরে ডেকেছে, যেকোনো বাহানায় থাকতে দেয়নি বারান্দায় আর।
অন্তূ অন্ধকারে এগিয়ে যেতে যেতে প্রথমত একটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোহার পেরেক পায়ের নগ্ন তালু ভেদ করে বিঁধল। কমপক্ষে এক ইঞ্চ। অন্তূর মাথার চাঁদি ঘুরে ওঠে। তীক্ষ্ণ আর্তনাদে কুঁজো হয়ে পড়ে অন্তূ। দাঁতে দাঁত আঁটকে একটানে লোহাটা টেনে বের করে। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। যেন ট্যাপের পানি ছাড়া হলো। আবার পা চালায়। বিভিন্ন সব যন্ত্রে অথবা কীসে পায়ের ত্বক ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যায়। সে থামেনা। পুরো শরীরে বিঁষ ছড়ানো অস্থিরতা, যন্ত্রণা!
অনেকটা এগিয়ে গিয়ে তিন-চারটা কাঠি একসাথে জ্বালায়। বেশ কিছুটা আগুনের বহরে সাদার সমরোহ চোখে ভেসে ওঠে। ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কাঠির আগুন আঙুলে এসে লাগায় কাঠি ছেড়ে দেয় অন্তূ। এগিয়ে গিয়ে সুইচ দাবায়। আরেকটা হলদে বাল্ব জ্বলে ওঠে। মৃদু আলো। সামান্য একাংশ আলোকিত হয় তাতে কেবল। সামনে এক সারি সাদা। অন্তূ চুপচাপ চেয়ে থাকে শুধু সামনের দিকে।
পালা ধরা মানুষ। তারা সব ছোট মানুষ। পাঁচ বছর থেকে শুরু করে বয়স সর্বোচ্চ বছর পনেরোর বেশি নয় একটারও বয়স। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী সবগুলোর। মাথায় টুপি। পাঁচ-কলির, কওমি মাদ্রাসার টুপি পরা। জরা-জীর্ণ হয়ে আছে সবগুলো। অন্তূকে দেখেই তারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে আরও জড়িয়ে বসে। এখানেও বড়গুলো ছোট কয়েকজনের মুখ চেপে ধরে আছে। কাঁদতে দিচ্ছে না। চোখে-মুখে কীসের ভয়। পিপাসা-ক্ষুধা, আতঙ্ক, কাতরতা। সে কী নিদারুণ অসহায়ত্ব। ছোট্ট ছোট্ট মানুষ ওরা। এই মৃত্যুপুরীতে কী করছে?
তারা বিস্ফোরিত চোখে দেখে। রোজ যে নারীটি তাদের চব্বিশ ঘন্টায় একবার খাবার দিতে আসে, সে নয়। এ তো অন্যকেউ! কে এ? রাণী গোলাপি লম্বা কামিজের সাথে চওড়া একটা হালকা গোলাপি ওড়না জড়ানো শরীরে। হাতে দিয়াশলাই। ঘামে ভেজা মুখটা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল না ভেতরটা। অথচ চেহারাটা প্রথম দেখায় ‘সুন্দরী, সুন্দরীʼ বলে ওঠার মতো। চোখদুটো গভীর, ঘন পাপড়ির অলস ঝাপটানিতে আত্মবিশ্বাস, অল্প বিস্ময়, কিছুটা হতাশা! ওরা আরও জড়িয়ে বসে, আরও জড়োসরো হয়ে। ছোটগুলোর চোখের পানি শুকায়নি। অনবরতই কাঁদে ওরা। বড় যারা একটু, ছোটরা ওদের জাপটে ধরে বসে আছে। মুরগীর বাচ্চাগুলোর মতো ওদের পাখার নিচে আশ্রয় চায় বোধহয়।
কবরখানার চেয়েও ভয়ানক এই অবরুদ্ধ কুটুরিতে, যে তিমির আঁধার, তাতে আঁটকে আছে এরা। কেউ কাউকে দেখেতেও পায়না বুঝি! দিনেও আলোও আসেনা সেখানে।
ছোট্ট এক পুঁচকে। মাথার এলোমেলো টুপিটা ঠিক করে কোনোমতো অন্তূকে বলে, “একটু পানি দিবে? পানি…পিপাসা… আমি একটু পানি খাব…ʼʼ
অন্তূর বুকের ভেতরটা এক মোচড়ে উলোট-পালোট হয়ে ওঠে। ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে। ওরা পানি চায়, ওরা পিপাসার্ত। ওরা ছোট্ট ছোট্ট মানুষ।
চলবে…