অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৪৭.

0
2

[প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য]]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪৭.

পায়ের ব্যাণ্ডেজ দিকে তাকিয়ে থেকেও অন্তূ নিজের রুম, পা, ব্যাণ্ডেজ, আশপাশের কিছুই যেন দেখছিল না। চোখের সামনে পর্দা পড়েছে। আলো-আঁধারির ভিড়ে হলদে বাতির টিমটিমে আলোর পর্দা। রিমি জ্বর মেপে গেছে—১০৩° ফারেনহাইট। মাঝেমধ্যেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বরের তোপ বাড়ছে। চোখদুটোতে বিঁষের মতো জ্বালা ধরেছে।

সেসব গায়ে লাগছিল না অন্তূর। সে যেন অচেতন এখনও। কীভাবে রুমে এসেছে, তা ঠিকমতো মনে পড়ছে না। রিমি ধরে এনেছিল, এটুকু মনে আছে আবছা করে।

ওরা পানি চাইছিল। অন্তূ তো পানি নিয়ে যায়নি! সে সামনে বসে পড়েছিল আস্তে করে। দেহটা থরথরিয়ে কাঁপছিল। ওদের চোখে-মুখের সেই কাতর-আতঙ্কিত চাহনি! অন্তূর শরীরটা নেতিয়ে পড়তে চায়। জিজ্ঞেস করতে জিহ্বা সরে না—তোমরা কারা? এখানে কেন?

অনেকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমরা কি মাদ্রাসায় পড়ো? হাফেজিয়া মাদ্রাসায়?ʼʼ

একজন মাথা নাড়ে, সায় দেয়। অন্তূ আবার চুপ। সে এ বাড়িতে এসেছে মাস কয়েক হলো। প্রথমবার এদের কান্নার আওয়াজ পেয়েছিল বিয়ের পর জয় আমির যেদিন রাজধানী থেকে ফিরল, সেই শেষরাতে। এরপর বহুবার শুনেছে, এদিকে আসা-যাওয়াও দেখেছে ওদের। সেদিন এদের ধরে আনা হয়েছে। ঢাকা থেকে ফিরে। রাজধানী থেকে অর্ডার পেয়ে এসব করছে এরা?

-“তোমাদের কবে আনা হয়েছে এখানে?ʼʼ

-“কয়েকদিন আগে।ʼʼ

অন্তূ ভাবে, তাহলে তখন কাদের কান্নার আওয়াজ অল্প-সল্প উপরতলায় যেত? এদের আগেও আরও আনা হয়েছিল? আজ প্রায় দু সপ্তাহ যাবৎ জয়-হামজার পায়ের সুঁতো ছিঁড়েছে। রাত-দিনের ঠিক নেই, ছুটছে ওরা। অন্তূ উঠে দাঁড়াতে চায়। পা টলছে, অসহ্য যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে এসেছে পা-টা। শক্তি নেই চলার।

চুপচাপ বসে থাকে শ্বাস আঁটকে। বাচ্চাদের মুখে আতঙ্ক কমেছে। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কারা?ʼʼ

বয়স পনেরোর মতো একটা ছেলে। দৃষ্টি অস্তমিত তবু দৃঢ় স্বরে জানায়, “শিবিরের ছেলে আমরা।ʼʼ কথাটা বলতে পেরে যেন সে খুব গর্বিত।

-“নাম কী তোমার?ʼʼ

-“আব্দুল আহাদ।ʼʼ

-“তুমি হাফেজ?ʼʼ

-“হ্যাঁ।ʼʼ

-“কয় পারার?ʼʼ

-“কোরআন কয় পারা?ʼʼ

অন্তূ চেয়ে দেখে আব্দুল আহাদের দিকে। প্রথম থেকে ওকে লক্ষ্য করছে অন্তূ। চোখে ভয় নেই আর সবার মতো। সে-ই যেন সবার জন্যই চিন্তিত। অন্তূ বলে, “ত্রিশ পারা।ʼʼ

-“আমি সেই ত্রিশ পারা কোরআনের হাফেজ।ʼʼ

-“তোমাদের কেন ধরে আনা হয়েছে, জানো?ʼʼ

-“জানব না কেন?ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

-“ওরা ভয় পায় আমাদের।ʼʼ

-“ওরা ভয় পায়? কীসের ভয়?ʼʼ অন্তূ একটু অবাক হয়।

-“আমরা বড় হলে একেকটা শিবিরের ছেলে হবো, ওদের বিরোধী দলের কর্মী ভারী হবে। কিন্তু আমাদের মারলে আমাদের আমিররা দূর্বল হয়ে পড়বে।ʼʼ

-“তারা দূর্বল হচ্ছেনা?ʼʼ

-“কারাগারে পুড়ে দেয়, ফাঁসি দিয়ে দেয়, গুম করে দেয়। ট্রাক ভরে তুলে নিয়ে যাইয়ে গুলি করে মেরে র-ক্ত ধুয়ে ফেলে। দূর্বল হয়না আবার? এত কিছু করছে, কী-ই বা করতে পারছে?ʼʼ

অন্তূ চুপ করে বসে থাকে। আব্দুল-আহাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছে তার। দাড়ি-গোফের রেখা দেখা দিয়েছে, তবু মুখটা কচি। সেই কচি মুখে এতসব ভারী কথা! ধর্মবিশ্বাসের শক্তি? সৃষ্টিকর্তার প্রণিত বাণী বুকে ধারণের শক্তি? অন্তূ ভাবে।

সবাই তো ভালো হয়না। টুপি-দাড়ি পরা সবাই ভালো না, নামাজী সবাই ভালো না, হাফেজও সব ভালো না। কিন্তু বাকিগুলো? অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের মাঝে একশো-তে কয়টা ভালো আছে? বর্বর, মূর্খ, অসভ্য, জানোয়ার একেকটা। কিন্তু এদের মাঝে যদি নব্বইজনকেও খারাপ ধরা হলো, বাকি দশটা? এরা কি দশজনও নৈতিকতা জানেনা? যত যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ–সব এরা করে বেড়াচ্ছে? তার চেয়ে বড় কথা, যারা এখনও পাপ করেইনি, তাদের জান নিয়ে খেলাপাতি খেলার অধিকার কে দিলো স্বৈচারারদের? ওরা নাবালক শিশুরা কী পাপ করতে পারে? হাজারও মায়ের বুক খালি করে, ছোট ছোট মানুষগুলোর বুকের তাজা র-ক্ত মাটিতে মিশিয়ে দেশের অপরাধমুক্ত করে ফেলছে ওরা? তাহলে দেশে যা সব ঘটছে তা এদের মরা-আত্মারা উঠে এসে করছে? বাকিরা বেহেশতের দূত! হবে তা-ই।
পলাশরা কারা? রাজনরা কারা? এরাই যদি সব পাপের ভাগী এবং শাস্তির দাবীদার হয়?

অন্তূ ভাবনা ছেড়ে উঠতে চায়। আব্দুল আহাদ চোখ নত করে রেখেছে। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “তুমি মরতে ভয় পাও না?ʼʼ

-“ভয় পেলে কি মরণ মাফ?ʼʼ

অন্তূ এ কথার কী জবাব দেবে! জিজ্ঞেস করে, “এসব কে শিখিয়েছে তোমাদের?ʼʼ

-“কে শেখায়? মাঝরাতে যখন অল্প সময়ের জন্য ঘুমাতে যাই, খবর আসে কারা যেন মাদ্রাসা ঘিরেছে, পালা পালা ধরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ওরাও তো মরবে। তার পরের পালা নাহয় আমাদের। ভয় করে লাভ কী?ʼʼ

-“সবাইকে এখানেই আনা হয়েছিল?ʼʼ

-“এরা ছাড়া আর কি লোক নাই? কতলোক ওদের।ʼʼ

সহপাঠিদের চিৎকার আর অসহায়ত্ব এইটুকু মানুষগুলোর মাঝে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছে। এই আগুনে কি কোনো একদিন পুড়ে মরে যাবেনা দেশের ক্ষমতাধর স্বৈরাচার? মানুষের দীর্ঘশ্বাস, অবিচার, অধিকারহীনতা, রাহাজানি, হাহাকার—কতদিন?

অন্তূ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের সমস্ত স্নায়ু যেন একসাথে তীব্র উদ্দীপনায় ফেটে পড়েছিল। এখনও চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আব্দুল আহাদ এগিয়ে আসে। অন্তূ চমকায়।

-“দেখি, পা দেখি।ʼʼ

অন্তূ তাকায় আব্দুল আহাদের মুখে দিকে। চোখের দৃষ্টি নত, মুখটা গম্ভীর। তার জুব্বার প্রান্ত ছেঁড়া, ঝুলছিল। তা টান দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে অন্তূর পায়ে বেঁধে দেয়। অন্তূ পায়ে হাত দেয়া থেকে বাঁধা দিলে বলে, “আমি তো ছোট আপনার। কিছু হবেনা। বেঁধে দিই। রক্ত পড়ছে।ʼʼ

বাঁধা শেষ হলে বলল, “এই অসময়ে কেন এসেছেন জানিনা। আপনি কে তাও জানিনা। ও একটু পানি খেতে চাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। পানি আনেন নি?ʼʼ

অন্তূর বুকে শূল বিঁধল বোধহয়। ‘পানি আনেন নি?ʼ বাক্যটা ফলার মতো বেঁধে বুকে।

অন্তূ ঝারা মেরে উঠে পড়ে। আব্দুল আহাদ ওকে ধরতে হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নেয়। অন্তূ নিজে চেপে ধরে ওর হাতটা, ওর হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছোটভাই তো তুমি আমার। হাত ধরলে কী?ʼʼ

মলিন হেসে বেরিয়ে আসে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বড়ঘর পার হতেই অন্তূর দম বেরিয়ে যাচ্ছিল। পা দুটো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

অন্তূ যখন দোতলায় ফিরে বড় বড় জগ ভরে পানি নিচ্ছিল, রিমি হায় হায় করতে এগিয়ে আসে, “কী করছেন, আরমিণ? পাগল হয়ে গেছেন? ওদের একবেলার বেশি পানি বা খাবার দেবার হুকুম নেই।ʼʼ

-“কার হুকুম নেই? আপনার নরকের দেবতা, স্বামীদেবের? তা না-ই থাকতে পারে, আপনিও পতিভক্তা নেউটা মেয়ে হতে পারেন। কিন্তু জানেন তো, আমি খুব পাপীষ্ঠা, আর স্বামীর অবাধ্য, অভিশপ্তা একজন স্ত্রী। আমার এসব মানার কথা নয়।ʼʼ

-“আপনি বুঝতে পারছেন না। প্লিজ…ʼʼ

-“এ বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাই না। যদি আজ বাঁধা দেন, তো সুযোগ পেলে আপনাকেও ছাড়ব না। আর আমার বিশ্বাস, সুযোগ আমি পাবোই।ʼʼ

অন্তূকে তখন ঠিক মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাগছিল, যেন তাকে বশ করা হয়েছে। জয় একগাদা বিস্কুট, কেক ইত্যাদি খাবার-দাবার এনে রাখে ঘরে। অন্তূ সেইসব এবং পানি ও টর্চ নিয়ে খুঁড়িয়ে নিচতলায় পৌঁছায়।

ওরা খেতে চায়না, শুধু ওদের পানি চাই। বুক চৌচির পিপাসায়। অন্তূ খাওয়ায় ওদের। ওদের হাত বাঁধা নেই। তবু সম্ভব নয় ঘুটঘুটে অন্ধকারে উঠে এসে সুইচ খুঁজে বাতি জ্বালায়। অন্তূ বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। পায়ের ব্যথায় মাথা ফাঁকা হয়ে আসছিল।

বড়ঘরের বাইরে বিস্তৃত ফ্ল্যাট। নোনা ধরেছে ইটের গায়ে। কোথাও খানিক আলোর দিশা নেই। খসখসে ঢালাই মেঝে হল-গ্রাউন্ডটাতে। তাতে পায়ের চামড়া খসে আসছিল যেন। এক পা ফেলতে পারছিল না। যেদিকে তাকায়, অন্ধকারের সমুদ্র ঢেউ খেলছে। রাত শেষের দিকে। দুর্গের মতো দরজা-জানলাবিহীন কুটুরি। টর্চের আলো সামনের দিকে সরু হয়ে পড়ছিল, তাতে আরও গা ছমছম করা পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

কারও পায়ের শব্দ পায় অন্তূ। থমকে দাঁড়ায়। তার পেছনে কেউ হাঁটছে। তার সাথে পা মিলিয়ে। চোখ বুজে শরীরের শিরশিরানি অনুভব করল। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হয়না। কেউ খুব কাছে আসছে, এগিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে। এরপর ফিসফিস করে অন্তূকে বলে, “আপা। আমি, আব্দুল আহাদ। ভয় পাবেন না।ʼʼ

অন্তূ আব্দুল আহাদের হাতটা চেপে ধরে শ্বাস ছাড়ে। বলে, “তোমাদের কোন পথ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল?ʼʼ

-“তাতে কী?ʼʼ

-“শুনি।ʼʼ

-“চোখে পটি বাঁধা ছিল। মুখে কাপড় গোঁজা ছিল। গভীর রাতে আনা হয়েছিল এটুকু আন্দাজ আছে। আপনি এখানে কেন আসছেন আজ বারবার?ʼʼ

-“তোমার খারাপ লাগছে?ʼʼ

গম্ভীর হয়ে রইল আব্দুল আহাদ, জবাব দিলো না। দুজন মিলে ঘুরে ঘুরে দেখে পুরো ফ্লোরটা। এক কক্ষে সারি সারি মদের বোতল সাজানো কেসে ভরা। উটকো গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া দায়। একটুও পা দেবার জায়গা নেই মেঝের কোথাও। আব্দুল আহাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও ভৌতিক ঠেকছিল নিস্তব্ধ বদ্ধতায় অন্তূর কাছে।

এত মদ! এগুলো পলাশের হোটেলের মনোরঞ্জনের মাল, এখানে রাখা আছে। টর্চের আলো সরু হয়ে পড়ে। সেভাবেই অন্তূ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘরটা দেখে ফিরে আসতে উদ্যত হয়ে আবার ঘুরে তাকায় চট করে। আব্দুল আহাদ শুধায়, “কী?ʼʼ
অন্তূ মেঝেতে রাস্তা খোঁজে। মদের বোতলের কেইসগুলো গিজগিজ করছে। ঘরের পশ্চিম কোণায় দরজা একটা। লোহার দরজা। অন্তূ নিঃশব্দে কেইস সরাতে চায়। ঠুকঠাক শব্দ তবু হচ্ছিল। অন্তূ আব্দুল আহাদকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে এগিয়ে যায়। লোহার ভারি দরজা চাপানো। অন্তূ তা খুলে ফেলে আস্তে করে।

ঠিক যেন বেকারীর কারখানার মতো। অস্তমিয সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে ভেতরটা। কড়া পাওয়ারের হলদে লাইট। অন্ধকারে লাইটের আলোতে গুমটে মারা অবরুদ্ধ ঘরটাকে দেখে অন্তূর আনন্দই হলো। সে জীবিত চোখে নরক দেখে নিলো। বেকারী কারখানার তুন্দুরিগুলো যেমন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো জ্বলে, ঠিক তেমন তিমির অন্ধকারে হলদে আলো সেরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। সেখানে মহিলাদের এক ঝাঁক নজরে আসছে।

তারা অবাক হয়ে অন্তূকে দেখে। শুয়ে, বসে, হেলান দিয়ে আছে তারা, একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে বসে আছে তারা। তাদের সবার শরীরে এক টুকরো করে সাদা কাপড়। যেমনটা মেয়েরা গোসল করে তোয়ালে জড়ায় শরীরে, ঠিক সেভাবে দেহের উপরিভাগ ঢেকে রেখেছে যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এরাও পলাশের হোটেলের মাল সবগুলো।

অন্তূ শরীরটার ঝিনঝিন করে ঝাঁকি মেরে ওঠে। ভাগ্যিস আব্দুল আহাদ আসেনি, সে দেখতো এই নারকীয় পরিবেশ! অন্তূ বাকহারা হয়ে চেয়ে থাকে। সে টেরই পেয়েছিল না— ওই বাচ্চাগুলো ছাড়াও এই বদ্ধ কুটুরিতে আরও প্রাণের অস্তিত্ব আছে।

অন্তূ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবার চেষ্টা করে—এইসব লেওয়াজের কারণেই কি পলাশ ও হামজা-জয় একে অপরের দলকে এত সমীহ করে চলে? গাঢ় কারবার-বন্ধন। এজন্য যত যা-ই হোক, যেমন আগুনই দপ দপ করে জ্বলে উঠুক, মোটেই তারা একে অপরের দলকে হিট করেনা! সন্ত্রাসবাদ, রাজনীতিবিদ, স্বৈচারার, নরহত্যাকারীরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে চারদিকে। দাউদাউ করে জ্বলছে নরকের আগুন, সেই আগুনের আঁচ জনতাদের সবার গায়ে সবসময় না লাগলেও লেগে যায় কদাচিৎ।

অন্তূ জ্বরের ঘোরে বেশি ভাবতে পারেনা। অবচেতনায় লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে থাকে।


জয় এলো রাত বারোটার দিকে। তার চোখ-মুখ ক্লান্ত হলেও কীসের এক খুশির রেখা ঝকমক করছে। পরনে সিলভার রঙা ডেনিম, হাইবুটের সাথে গটগট শব্দ তুলে রুমে ঢুকল। এত অভিজাত ভদ্রলোকের মতো লাগেনি কখনও। খোচা খোচা দাড়ি অল্প বেড়েছে, ফেঞ্চকাট চুলে খুব অসভ্য-ভদ্রলোকের মতো দেখায় তাকে।

রুমে ঢুকে প্রথমে অন্তূর দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, “আমার একদিনের বিরহ বইতে পারোনি? জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছো? তোমার আমার প্রেম আমি আজও বুঝিনি…ʼʼ সুর করে গাইল শেষটুকু।

কথা শেষ না করতেই যখন অন্তূর পায়ের দিকে চোখ গেল। এত জোরে ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে হো হো করে, অন্তূ চোখ খুলে তাকাল। হাসির তোরে নুইয়ে পড়তে চায় জয়। পুরুষ মানুষ হাসলে গলাটা দারাজ হয়ে ওঠে কেমন। প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরতে পরতে বলে, “আমাকে কি তোমরা নিজের ওপর থেকে কনফিডেন্স কমাতে দেবে না, হ্যাঁ? শালা যা ভাববো তা হয়ে বসে থাকে, যা আন্দাজ করি, তা আলবাৎ ঘটে যায়, খালি ভাবার দরকার, মিস নাই।ʼʼ

সাদা লুঙ্গিটা পরে জ্যাকেটটা খুলে ছুঁড়ে উড়িয়ে দিলো।
প্রচুর গরম লাগছে। দরজাটা লক করে এসি অন করে অন্তূর সামনে এসে মেঝেতে উবু হয়ে বসে হাঁটু ভাঁজ করে। কপালে ও গলায় হাত রেখে আস্তে করে বলে, “তোহ ঘরওয়ালি! অনুভূতি কেমন নিষিদ্ধ জায়গায় পা রেখে?ʼʼ

অন্তূ চোখ খোলেনা। জয় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, অগোছালো চুলগুলো হাতের ছোঁয়ায় গুছিয়ে দেয় আলগোছে। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে নিচু আওয়াজে জিজ্ঞেস করে, “এত জ্বর বাঁধালে কী করে? ওষুধ খেয়েছ?ʼʼ

অন্তূর চোখের কোণা দিয়ে পানি পড়ছিল। চোখ জ্বলছে, জ্বর এলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। জয় তা আঙুলের ডগায় মুছে সেই পানিটুকু মনোযোগ সহকারে দেখতে দেখতে বলল, “পা কেটেছে কীসে? ইস্পাত খণ্ডে? কতখানি কেটেছে?ʼʼ

-“ওদের কেন ধরে এনেছেন?ʼʼ তিরতির করে কাঁপছে অন্তূর কণ্ঠস্বর।

জয় উঠে বাথরুমে গিয়ে বালতি ভরা পানি ও মগ এনে মেঝেতে রাখে। অন্তূকে পাঁজাকোলে কোরে তুলে বিছানার একপাশ থেকে অপর পাশে নিয়ে যায়। হাঁটার সময় আবার নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্তূর মুখটা তার বুকে গোঁজা। মুচকি হাসে আনমনে। খুব সুখ সুখ লাগছে। হাজারো পাপের মাঝে কখনও-সখনও পাপকে অবহেলা করতে সে গান গায়, গিটার বাজায় আরও কত কী করে! আজাকাল সেসব বাদ দিয়ে অন্তূকে জ্বালায়।

আড়াআড়ি শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তার আনব?ʼʼ

-“এসেছিল।ʼʼ

-“কী বলেছে? ওষুধ দেয় নাই?ʼʼ

-“দিয়েছে।ʼʼ

-“খাওনি কেন?ʼʼ

অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালল জয়। জ্বর খানিক নামলো কিনা বোঝা গেল না। তবে কপাল ও মাথাটা ঠান্ডা হলো।

জয় লুঙ্গির ওপর গলায় এক লাল টকটকে গামছা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। কী সব হোটেলের খাবার কিনে আনে। অন্তূকে খাওয়াতে চায়। সেই রুচি বা মানসিকতা নেই অন্তূর। জোর করে ওষুধ খাওয়ায়। সাথে একটা ছোট্ট স্লিপিং ড্রাগও। সারারাত অচেতন ঘুমালো অন্তূ। তার হুশ নেই।

জয় চেয়ার টেনে নিয়ে বিছানার পাশে বসে চেয়ে থাকে অন্তূর দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কিউব মেলায় আনমনে। বিশাল ট্রমায় পড়ে গেছে মেয়েটা। তেজী মুখখানা একদম কুঁচকে গেছে।

শেষরাতের দিকে নিচতলার বড়ঘরে যায় একবার। সব ঠিকঠাক। খালি পানির জগ ভরে রেখে গেছে বাচ্চাগুলোর সামনে। জয় হাসল তা দেখে। বাচ্চারা ভয় পায় জয়কে দেখে। সেখান থেকে বেরিয়ে যখন মদের ঘরে গেল, মাথাটা গরম হলো। সব এলোমেলো করে সাজানো। অন্তূ অতসব বোঝেনি। মদের কেস সাজানো হয়েছে এখানে ক্রম অনুসারে। সে তো চেনেনা। হুইস্কি, রাম, জিন, বিয়ার, ওয়াইন, ভোদকা ইত্যাদি মাফিক সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। মহিলাদের ঘরে ঢুকবার পথ পেছন দিকে। ওই রাস্তা দিয়ে বাগানের রাস্তা চলে গেছে লোহার ফটক পেরিয়ে। এদিক দিয়ে ঢুকেতে হয় ওই কক্ষে। অন্তূ জানেনা।

মহিলাদের কামরায় আওয়াজ যেতেই ওরা থরথর করে কেঁপে ওঠে। ঢালাই মেঝেতে চামড়ার স্যান্ডেলের আওয়াজ, সাথে খোলা বেল্ট ঘেঁষে আসছে। এই আওয়াজ চেনে তারা। জয় আমির সাদা লুঙ্গির কুচি উঁচিয়ে ধরে এগিয়ে আসছে। লোকটা কিচ্ছু বলবেনা, তাকাবেও না। তবু জয়কে ওদের চরম ভয়। ঘেন্না করে ভীষণ, ঠিক ডাস্টবিনে, আবর্জনার মতো।

মানুষ হয়ত ড্রেনের পানিকেও অতটা ঘেন্না করেনা, যতটা ঘেন্না জয় ওদের করে। ওরা সব একসাথে জড়োসরো হয়ে দাঁড়ায়। জয় নাক কুঁচকে দেখে চারদিকটা। একটাবারও ওদের অর্ধবস্ত্রে অনাবৃত দেহটার দিকে তাকাল না। তার রুচি ভালো। যারা শরীর ঢেকেঢুকে রাখে, সম্মানবোধ আছে, তাদের প্রতি তার আগ্রহ আসে। যারা খুলেই রেখেছে, তাদের আবার দেখার কী আছে? সস্তা দেহ, সস্তা মেয়েলোক। এইসব ধারণায় বিশ্বাসী জয় আমির পলাশের কাছে দারুণ খাতিরের লোক।

মাঝেমধ্যেই হোটেলরুমে জয়কে মেয়ে নিয়ে ঢুকতে দেখে অভ্যস্ত মেয়েরা। অথচ শখ মিটলেই কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবার এই নোংরা স্বভাবের জন্য ওর কাছে কোনো মেয়ে যেতে চাইতো না। বিয়ের পর ধীরে ধীরে যাওয়া বন্ধ তার। তার রেস্ট্রিকশন বহুত। প্রথমত কড়া নিষেধ হলো, তাকে কোনোভাবেই চুমু খাওয়া যাবেনা। এছাড়াও জড়িয়ে ধরা যাবেনা, গা ঘেঁষা যাবেনা, নির্লজ্জের মতো অঙ্গভঙ্গি দেখানো যাবেনা। মেয়েলোকের বেহায়াপনা আর ঢঙে জয়ের গা জ্বলুনি রোগ আছে। সে নিজে যা করবে, সেটুকুই।

এই নিয়ে পলাশ খুব হাসিমজা করতো। একবার একটা মেয়ে জয়কে খুশি করার লক্ষ্যে অথবা টাকা হালাল করার উদ্দেশ্যে বোধহয় ওকে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছিল। এক থাপ্পড়ে কান দিয়ে রক্ত বের করে রুম থেকে বের করে দেবার রেকর্ড আছে জয়ের। এসবে হোটেলে ভীষণ হাসাহাসিও লেগে যেত। মেয়েরা জয়কে ভীষণ ভয় পায়। যারা একটু লজ্জা পায়, সংকোচ থাকে ভেতরে, নতুন আসে, তাদের দেয়া হতো জয়ের সাথে।

অন্যদিকে তাকিয়ে জয় জিজ্ঞেস করল, “কেউ এসেছিল তোদের কাছে?ʼʼ

-“এক মাগী আইছিল কেডা জানি….. দেইখা গেল আমারে সকলরে..ʼʼ

আর রেহাই হলো না। জয় ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে কণ্ঠনালিটা চিপে ধরল দুই আঙুলে, “আমার বউ সে। তোদের মতো স্লাট না। বল কে ছিল, বল বল বল… আমার বউ ওটা। কথা বল, শালী খা-ন-কির চেংরী। বল কে ছিল যেন? স্পিক আপ—ʼʼ

‘আপনার পত্নী।ʼ কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে গালে রক্ত উঠে যাবার উপক্রম হলো মেয়েটার।

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মদের কেসগুলো ফের সাজালো। দুটো রামের বোতল নিলো নিজের জন্য। আগামীকাল মদ ও মহিলাগুলো পৌঁছে যাবে পলাশের বাপের হোটেলে, রাজধানীতে। বড়ঘর পেরিয়ে আসার সময় পানির জগগুলো নিয়ে এলো। হামজা দেখলে পাছে রেগে যাবে। জয়কে দূর্বল ভাববে, বউয়ের খাতিরে দূর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। বউকে লাই দেয়া পুরুষের জন্য খুব একটা ভালো কথা না।

অন্তূ তখনও ঘুমাচ্ছে। খানিক বাদে ফজরের আজান হবে। খুব গরম লাগছিল বড়ঘর থেকে ফেরার পর। হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে যেতেই দেখল, তরু খাবার বাড়ছে। মেয়েটার অভ্যাস কাটেনি, অথচ কথা বলেনা। জয় নিঃশব্দে খাবারটা নিলো। ভাত একটু কমিয়ে রাখল। খিদে নেই খুব একটা। তরুকেও কিছু বলল না। তাকে সকলেই ঘেন্না করে, তরু খালি করতো না, এখন সেও করে। তাকে ঘেন্না করা এক প্রকার বিধান। মেয়েটা বিধান লঙ্ঘনে ছিল, এতদিনে লাইনে এসেছে। চুপচাপ চলে এলো ঘরে। আজ মনটা ভার লাগছে খুব।

অল্প খাবারের মাঝেও পুরোটা খেতে পারল না। বমি আসছে। ঘুম নেই চোখে। বোতল খুলে নিয়ে বসল। শরীরটা ঝিমিয়ে আসছে। লুঙ্গি গুটিয়ে চেয়ারের ওপর গা-হাত-পা ছড়িয়ে বসে তাকিয়ে থাকল অন্তূর ঘুমন্ত মুখটার দিকে। নেশা হয়, অথচ মাতাল হয়না সে। মদও ভালো লাগছে না। জীবনটা ঘনিয়ে আসছে, বেশিদিন নেই। তাতে খুশি খুশি লাগে আবার দুঃখ ঘিরে ধরে।

আরমিণ যা করছে, তা ঠিক। অন্তূর চরিত্র এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনার সাথে খুব যায়। তবু সাবধানতার মার নেই। জেদ বেশি মেয়েটার। জয় তাকিয়েই রইল। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা। মুচকি হাসে সে। তার বহুত বৃদ্ধা ভক্ত আছে। তারা থুতনি ধরে জয়কে কমবার বলেনি, “বউখান তোর সুন্দরী হইবো লো ছেঁড়া।ʼʼ

মিথ্যা বলেনি। বউ তার চরম সুন্দরী, সাথে চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও কাড়াক! ফর্সা মুখের নিচে থুতনি থেকে গলা ছড়িয়ে অন্তূর বুকের জায়গাতে মাতাল হাওয়া লাগল জয়ের গায়ে, যা সে মদে পাচ্ছিল না।

ইচ্ছে করল বিছানায় গিয়ে কাছে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়তে। গেল না। জাগ্রত থাকলে তো কাছে যাওয়া পছন্দ না তার বউয়ের। মাঝেমধ্যেই যখন রাতে ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করেছে, জোর করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হার মানলেও তা হতো ধর্মের দোহাই দিয়ে। স্বামী নারাজ হলেই লানত, এইসব দোহাই! অচেতন অবস্থায় কাছে যাওয়াটা সুযোগ নেয়া হয়। জয়ের সে অভ্যাস নেই। সে মানুষের সামনে ছিনিয়ে নেয় অথবা জিতে নেয়।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। যদি মনে হয়, আমি টেনে লম্বা করছি লেখা, তো বলবেন। অনেকের নাকি তাই মনে হচ্ছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here