অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৫২.

0
2

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫২.

অন্তূ নির্বাক হয়ে চেয়ে ছিল অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করেছিল, “মুমতাহিণার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?ʼʼ

-“আমার ছোট বোন।ʼʼ সঃক্ষিপ্ত জবাব দিলো মরসালীন।

অন্তূ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত হলো। এরপর জিজ্ঞেস করল, “মুমতাহিণার ভাইকে তো শুনেছি মেরে ফেলা হয়েছে!ʼʼ

মুরসালীন নিশ্চুপ মেঝের দিকে চেয়ে থাকে। দৃঢ়, সু-স্থির চোখদুটোয় অবাধ অটলতা। অন্তূ শরীরের ভার ছেড়ে একটা লৌহখণ্ডের ওপর বসে। ওদের গোঙানির আওয়াজ অবরুদ্ধ কুটুরির দেয়ালে কাঁপন ধরাতে চাইছে। স্পটলাইটের তীব্র হলদে আলোতে মাথা ধরে যাবার যোগাড়। এরা ঘন্টার পর ঘন্টা পার করছে। ঘুমানো অসম্ভব এই আলোর তলে।

-“আপনি চিনতেন আমায় সেই রাতের আগে?ʼʼ

-“না।ʼʼ

-“তবু প্রথম দেখায় কোনো বিরূপ আচরণ করেননি।ʼʼ

-“আপনি করেননি বিধায়। তাছাড়া পাটোয়ারী বাড়ির কোনো সদস্যের সঙ্গেই আপনার সম্পর্ক বিশেষ ভালো নয়। তাদের ওপর আপনার মায়া বা ভালোবাসা থাকবে এমনটা আশা করিনি আমি। আর দুঃখিত আমি, সেদিন কিছুটা ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলাম। এবং সেক্ষেত্রে দু একবার ‘তুমিʼ সম্বোধন করেছিলাম আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য।ʼʼ

অন্তূ ভাবে, লোকটা কে? ভেতরের খবর জানে বেশ! অন্তূর চোখে মানুষ চেনার বিশেষ ক্ষমতা আছে তো অল্প-সল্প। সে চট করে মানুষ বিচার করে ফেলতে পারে। শুধু পারেনা অভিব্যক্তি লুকোতে। তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখানোর নির্বোধ স্বভাবটা খুব দৃষ্টিকটুই বটে।

মানুষের অভিব্যক্তি ও চোখের দৃষ্টি কথা বলে। সেই কথা বোঝে সে। সেদিন তার হাতে অস্ত্র ছিল। তবু অজ্ঞাত পুরুষটিকে সে আঘাত করেনি। সেই নির্দেশ তার মস্তিষ্ক তাকে দেয়নি। ভরসা অথবা এরকম দ্বিধা সে আজ অবধি তিনটে পুরুষে করতে পেরেছে সে।

আব্বু, আগুন্তুক আর….তৃতীয়জনের কথা ভাবতে সংকোচে কুঁচকে এলো ভেতরটা—জয় আমির। অপ্রিয় এক অন্যতম ঘৃণ্য ব্যক্তিত্ব। তাকে সে ভরসা করে নাকি আশা রাখে, সেটা জানা নেই। প্রথম দুজন তার ভরসার মান পুরোদমে রেখেছে। তাদের দ্বারা এ অবধি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি সে। অথচ তৃতীয়জনের পাপ-পূণ্যের তুল্যরাশি অসংজ্ঞায়িত। পরিমাপ করলে পাপ এবং ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে প্রথম চালেই।

-“আপনারা হামলা করেছিলেন বিয়ের গাড়িতে?ʼʼ

জবাব দিলো না মুরসালীন। অন্তূ বুঝল, ঘটনা সত্যি। জয়ের সাথে সাথে অন্তূর ভেতরে সল্পভাষী এই পুরুষটাকে নিয়েও কিছু কৌতূহল জন্মে গেল।

লোহার গেইটের ওদিক থেকে ধাতব আওয়াজ ভেসে আসছিল। মুরসালীন সতর্ক করল, “আপনি ভেতরে যান। নিজেকে বিপদে ফেলবেন না এখানে আসার খাতিরে। আপনার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমাদের। আল্লাহ পাক সহায় হলে আমরা যেভাবেই হোক দিন কাটিয়ে নেব। আপনি আর আসবেন না এখানে।ʼʼ

কথাগুলো মুরসালীন সম্পূর্ণটা ঢালাই মেঝের দিকে দৃষ্টি অবনত করে বলেছিল। একবারও অন্তূর দিকে ফিরে তাকায়নি। অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরের একরাশ আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছিল তার কণ্ঠস্বর থেকে। চেহারাটা মুরসালীনের আরবীয়দের মতো অনেকটা। সবুজাভ চোখের মণি। কালচে-বাদামি চাপদাড়িতে সুপুরুষ বটে।

আবারও বলল মুরসালীন, “ওরা ভেতরে আসবে এখনই। আপনি বেরিয়ে যান। থাকবেন না এখানে।ʼʼ

অন্তূ খেয়াল করল, মুরসালীনের বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে টসটসে ক্ষত। পুরো শরীরটা বিদ্ধস্ত। চোখে ক্লান্তি-কাতরতা আছে, তবে উদ্বেগ নেই।

মুরসালীন আব্দুল আহাদকে বলল, “তুমি এগিয়ে যাও উনার সঙ্গে। সিঁড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। একা ফিরতে পারবে তো অন্ধকারে?ʼʼ

-“জি ভাই, পারব। আপা, আসেন আমার সাথে।ʼʼ

অন্তূর কানে তখনও ওদের ভোঁতা গোঙানি লেগে ছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করছে ওরা।

তুলির ঘরের সামনে দিয়ে ফেরার সময় দেখতে পেল, তুলি কোয়েলের মাথায় পানি ঢালছে। অনেকক্ষণ সেখানে বসেছিল অন্তূ। জ্বরে গা পুড়ছে ছোট্ট মেয়েটার। তরুরও জ্বর। অথচ মেয়েটা অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের। অন্তূ শিয়রে বসে অনেকক্ষণ ধরে কপাল টিপে দিলো তরুর। মাথায় পানি দিতে চাইলে রাজী হলো না। অন্তূর নিজের রুম থেকে একটা ওষুধ নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়ে এলো।


রাতে ফিরে খাবার খেয়ে হামজা বড়ঘরে এবং জয় রুমে এলো। অন্তূ তখন বিছানা ঝারছিল। জয় শরীরে ঠান্ডার প্রকোপ নিয়ে লম্বা একটা গোসলে গেল। গায়ে পানি ঢালছিল আর গান গাইছিল গলা ছেড়ে,

কেমন আছেন বেয়ান সাব,
বুকে বড় জ্বালা।
কীসের জ্বালা বেয়ান সাব,
নয়া প্রেমের জ্বালা।
এই জ্বালাতে মরে নাই কোন শালী-শালা…

গোসল করে এসে বলল, “ঘরওয়ালি, খাবার রুমে আনো।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ আনলো। জয় বেহায়ার মতো আবদার করে, “খাইয়ে দাও।ʼʼ

অন্তূ বেশ নরম সুরে বলল, “আপনি খেয়ে নিন। আমি পড়তে বসব।ʼʼ

জয় আস্তে করে বলে, “হাত কাটা।ʼʼ

অন্তূ দেখল, জয়েল হাতে ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। আশ্চর্য লাগে তার। একটা মানুষ মাসে কয়বার আহত হয়? অন্তূ ধারণা করল, মুরসালীনের কপালটা বোধহয় জয় ফাটিয়েছে। বিয়ের দিন আঘাত পেয়ে কপালের পাশে বিশাল জখম হয়েছিল, তার শোধ!

অন্তূ খাওয়াতে বসল, প্রথমবার। জয় তাকিয়ে ছিল। এক পর্যায়ে বলল, “পাখির আহার করাচ্ছ, শালী? তোমার হাতের চার বারের খাবার আমি একবার মুখে ঢুকাই।ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল। জয় অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, “হাসছো, তুমি? তুমি?ʼʼ

অন্তূ বড় এক লোকমা তুলে দিলো জয়ের গালে। তারপর কত শান্ত আর বয়স্ক মেয়ের মতো বলল, “আপনি আমায় হাসতে দেখেননি, না? দেখার কথাও নয়। সামনে এলেই পশুর মতো আচরণ নিয়ে এসেছেন। তখন হাসি পাবার নয়। আমি মেজাজ খারাপ নিয়ে হাসতে পারার মতো ভারী বুদ্ধিমতি নই।ʼʼ

-“আজ কি ভালো আচরণ করতেছি?ʼʼ

-“সঁয়ে গেছে।ʼʼ মনোযোগ পুরোটা তার ভাতের প্লেটে।

জয় অপলক অন্তূকে দেখল শুধু। প্রকাশ্যে ঠিক যেমন নিখুঁত অবহেলা, নীরবেও অন্তূর অবহেলা তেমনই নিখুঁত। টের পাওয়া যায় কিন্তু অভিযোগ করা যায়না। তবু আগে কখনও এত শান্তিপূর্ণ মুহুর্ত আসেনি তাদের মাঝে। অন্তূকে সে অন্তত প্রথমবার হাসতে দেখল আজ। মলিন হাসি তবু দেখতে সুন্দর।

-“আমার মনেহয় তুমি জন্মেছিলেই গোমরামুখো হয়ে।ʼʼ

-“না তো।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ

-“তা-ই।ʼʼ

জয় মাথা দোলায় দু’দিকে, “উহু।ʼʼ

অন্তূ মৃদু বিরোধ জানায়, “হাসতে ভুলেছি কিছুকাল হলো। তার আগে ক্ষেত্রবিশেষ খুব চঞ্চল আর সরল মেয়ে ছিলাম। এটা স্বীকার করছি, আমি বরাবরই একটু….ʼʼ

-“মারাত্মক কড়া।ʼʼ

অন্তূ হাসল মৃদু। দু’পাশে মাথা নাড়ল, “আমি মায়া করতে, প্রতিদান দিতে, সম্পর্ক রক্ষা করতেও জানি, আমি অন্তর দিয়ে খুব তীব্র ভালোবাসতেও জানি। কলিজায় টান লাগলে খুব অসহায়ের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে জানি, আবার আঘাতকারীকে এতটা জ্বালাতন দিতেও জানি, যে লোকে তখন আমাকেই স্বার্থপর ভেবে বসবে। এটা বুঝবেন হয়ত পরে। যারা যেমন আচরণের যোগ্য আমি তাদের সামনে কেবল তেমন। শুধু একটু বোকা। বোকামিটা কী জানেন?ʼʼ

-“হু?ʼʼ জয় খুব মনোযোগী শ্রোতা, সে পলকও ফেলছে না। অন্তূ তাকায় না তার দিকে। নিচের দিকে তাকিয়ে প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করতে করতে কথা বলছে।

-“নিজের ভেতরের আক্রোশগুলো লুকিয়ে বুদ্ধিমানদের মতো মিথ্যা তোষামোদ করতে পারিনা। তেল মেরে মন জয় করতে জানিনা। আমার ওপর আঘাত এলে তা সহ্য করে চুপ থাকতে পারিনা। তাতে করে শত্রুর সংখ্যা বয়সের তুলনায় কয় গুণ বেশি হয়ে গেছে। স্টুপিড!ʼʼ

জয় শুধু চেয়ে রইল। তাদের বন্ধনটা রণতরীর ন্যায় ভাসমান, জলন্ত। আজ অন্তূকে অন্যরকম অদ্ভুত লাগল।এইদিন জয়ের প্রথমবার মনে হয়েছিল, এই মেয়েটার কাছে তার পাপ সীমা ছাড়িয়েছে। বুকে এক প্রকার অস্থিরতা ডানা ঝাপটেছিল প্রথমবার জয়ের। অন্তূর সুকরুণ ভাষাগুলো তাকে উপলব্ধি করিয়েছিল, সে কারও আসামী। প্রথমবার এমনটা হলো।

-“সরল ছিলে না কোনোদিনই। প্রচুর অহংকার তোমার ভেতরে।ʼʼ

-“না। ওগুলো আমার নির্বুদ্ধিতা। আমি নিজের কষ্ট ও দূর্বলতাকে পুঁজি করে মানুষের সহানুভূতি কামাতে আগ্রহী নই কখনোই। ব্যক্তিগত দুঃখকে মুখে করে ঘুরে নিজেকে অসহায় দেখাতে পারিনা। তাই আমার মিছেমিছি কাঠিন্য আর অসভ্যতাই সবসময় নজরে আসে। আবেগ কখনও মুখোরিত হয়না।ʼʼ

বিস্ময়ে জয়ের হৃদযন্ত্র থেমে রইল। অন্তূ যেন জয়কেই বর্ণনা করল এতক্ষণ। এত গাঢ় মিল আর বৈশিষ্ট্যগত সাদৃশ্য নিয়েও তারা দুজন দুজনের থেকে কত দূরে! কত বিরোধ তাদের মাঝে! অথচ গঠনগত দিকটা এক সুঁতোয় গিঁট দেয়া! প্রতিটা বৈশিষ্ট্যে অন্তূ জয়ের মাফিক। শুধু মেয়েটার শক্তি নেই জয়ের মতো, তাই বুঝি এত দুর্ভোগ! জয়েরও তো ছিলনা এককালে! দুজনের মাঝে নিজেকে লুকোনোর পদ্ধতিতে কেবল অল্প ফারাক আছে। জয়ের হাতিয়ার রসিকতা, অন্তূর গাম্ভীর্য।

জয় খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নাড়ল, “মানছি।ʼʼ জয় আরেক লোকমা খাবার চিবিয়ে শেষ করে বলল, “মেয়েদের এত গাম্ভীর্য ভালো না।ʼʼ

-“কী ভালো তবে? ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদা, শুধুই স্বামীর সেবা করা, স্বামী তার যেমনই হোক! আর কুকুর-বেড়ালের মতো বছরে বছরে শুধু বাচ্চা জন্ম দেয়া? স্বামী যা-ই করে বেড়াক, দুমুঠো ভাত পেলেই হলো! মারধরগুলো নীরবে সহ্য করে চিহ্ন লুকোতে শাড়ির আঁচল বাড়িয়ে পরা? জাহেলি যুগের মেয়ে না আমি।ʼʼ

জয় সন্তুষ্ট হাসে। একসময় হাসিটা প্রসারিত হতে হতে সুবিশাল হয়ে ওঠে। আস্তে করে উচ্চারণ করে, “অস্থির চিন্তাধারা, মাইরি! ড্যাম ড্যাম!ʼʼ শব্দ করে হেসে ফেলল, “ঘরওয়ালি, তুমি মাল্টিপুল পার্সোনালিটিতে চলে গেছ। নিজের এক সত্ত্বা তোমাকে ধিক্কার দিলে আরেক সত্ত্বা তার প্রতিবাদ করে। নিজের সাথে খুব তর্ক হয়, তাইনা? এটা খারাপ না বটে।ʼʼ

-“আপনারও আছে রোগটা।ʼʼ

-“তুমি কী করে জানলে?ʼʼ মুখ ফসকে বলে ফেলল জয় অবাক হয়ে।

অন্তূ হাসল, “আপনার এক সত্ত্বা বলে, আপনি পাপ করেছেন, যা করছেন তা ঠিক নয়। আরেক সত্ত্বা তার বিরোধিতা করে পয়েন্ট কাটিয়ে দেয়। যেটাকে আপনি বলেন, ‘জয় আমির কখনোই নিজের কর্ম নিয়ে আফশোস করেনা।ʼʼ

জয় বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। অন্তূ নিজে থেকেই আলতো হাসে, “আমার নব্বই শতাংশ পড়া ও আত্মস্থ করা বই আপনি, জয় আমির। এতগুলো দিন শুধু বোকামিই করিনি, কিছু ন্যাকামিও করেছি। যেটাকে হিপোক্রাইসি বলা হয়।ʼʼচোখ মারল অন্তূ, “তার বদলে অবশ্য স্থায়ী বিনিময় শোধ করেছি কিছু।ʼʼ

জয় আবোল-তাবোল বলল যেন, “আমার মনে হয় তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছ, ঘরওয়ালি। না বাসলেও, ভালো বাসবে, একটু দিন গেলে।ʼʼ

অন্তূ গভীর চোখে চেয়ে মসৃণ, স্মিত হাসল, “সূর্য পশ্চিমে উদিত হয়ে পূর্বে অস্তমিত হতেই পারে।ʼʼ

জয় হো হো করে হেসে ফেলল, “হতেই পারে।ʼʼ

-“তা হলে তো হলোই। সূত্রানুযায়ী আমিও আপনাকে ভালো বাসতেই পারি।ʼʼ

জয়ের হাসি ঠোঁটেই রইল, শুধু সেটার জ্যোতি নিভে অন্ধকার হয়ে এলো হাসিটা। অন্তূ খাবার এগিয়ে নিয়ে গেলে জয় মানা করল, “আর খাবো না।ʼʼ

-“আর কিছুটা আছে। নিন।ʼʼ

-“খেতে ইচ্ছে করছে না আর। জোর কোরো না, ঘরওয়ালি।ʼʼ

সে উদাস পায়ে উঠে দাঁড়ায়। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া গিলতে থাকে। অন্তূ প্লেট রেখে এক গ্লাস পানি এনে ধরিয়ে দেয়। জয় আনমনে ছিল, চমকে উঠে গ্লাস নেয়। জয় আচমকাই জিজ্ঞেস করে, “আমায় অনেকেই ঘৃণা করে। কোনোদিন কারণ জিজ্ঞেস করিনি। তোমায় করছি।ʼʼ

মুখে কিছু না বলে শুধুই মুচকি হাসল। সেখানে কত জবাব শব্দহীন পড়ে আছে। সেসব চেপে বশল, “আমি কৃতজ্ঞ আপনার ওপর। ধন্যবাদ।ʼʼ

জয় বিভ্রান্ত হলো কিনা বোঝা গেল না। নারীর ছলনায় জয় আমিরের মতো পুরুষেরা কেমন প্রভাবিত হয়, তা তার অভিব্যক্তিতে অন্তত ধরা গেল না।

অন্তূ বলল, “কাল সকালে একটু ওই বাড়িতে যেতে চাইছি। কয়েক ঘন্টা থাকব। একটা ছেলেকে সঙ্গে দেবেন। একা যেতে ভয় লাগে। চারদিকে যা চলছে।ʼʼ

এবার জয় অবাক অথবা সন্তুষ্ট হয়ে তাকায়। তার ওপর অন্তূর এই ভরসা ভীষণ দুর্লভ! পরক্ষণেই নিজেকে বকে উঠল।


সকাল হতে হতে তুলির মেয়ের শরীর একেবারে নেতিয়ে পড়ল জ্বরের তোপে। তরুকে নিয়ে যেতে চাওয়া হলো। অথচ চাপা স্বভাবের মেয়েটা সকাল সকাল উঠে কাজবাজ করা শুরু করেছে। সে যাবেনা। প্যারাসিটামল খেয়ে সে নাকি খুব চাঙ্গাবোধ করছে।

তুলি রিমিকে সাথে নিয়ে মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। হামজা সঙ্গে দুজন ছেলেকে পাঠালো। তারা দূরে দূরে থাকবে, লক্ষ্য রাখবে ওদের।

পৌরসভায় নতুন বাজেট বরাদ্দের কাজ চলছে। হামজা ওদিকেও বেশ ব্যস্ত। সকালে তাকে কার্যালয়ে চলে যেতে হলো। জয় তখনও ঘুমাচ্ছে। খানিক পর উঠে সেও কোথায় বেরিয়ে পড়বে। পলাশের খোঁজ পেয়েছে। পলাশ নাকি চেষ্টা করছে, জয়ের নামে থানায় চাপা পড়ে থাকা পুরোনো অভিযোগের ফাইল তাজা করতে।

অন্তূ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোদের তেজে মুখটা ঘেমে লাল হয়ে ওঠে। অথচ ঠোঁটে স্মিত হাসি। জয় আমিরের চোখের বিভ্রান্তি এত শান্তিদায়ক!

ব্যবচ্ছেদ

অফ-হোয়াইট রঙা দেয়ালের ডানপাশে একটি বর্ষপঞ্জিকা ঝুলছে। পাতাটা আগের মাসের। আজ সবে মাস বদলেছে। পঞ্জিকার পাতা উল্টানো হয়নি। সালটা ঠিক আছে—২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ।

মাহেজাবিন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ধীর পায়ে উঠে গিয়ে পাতাটা উল্টে দিলো পঞ্জিকার। গতপরশু জুন মাসের ২৯ তারিখ, জয় আমিরের ৩১তম জন্মদিন ছিল। আজ জুলাইয়ের ০১ তারিখ যাচ্ছে।

বিকেল হয়ে আসছে। জানালা বাইরে তাকিয়ে দেখলেন মিস ক্যাথারিন। মাহেজাবিন কাহিনির মাঝে চট করে থেমেছে, এরপর উঠে গেছে পঞ্জিকা ঠিক করতে। এই মেয়েটা এত অদ্ভুত চলনের! বুঝতে পারেন না তিনি।

মাহেজাবিন ফিরে এসে সোফাতে বসল ফের। তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন সম্মুখে বসে থাকা ছাব্বিশ বর্ষীয়া নারীটির পানে।

অতি-হালকা এক ধরণের নীল রঙ যেটাকে বলা হয় ক্যাডেট-ব্লু কালার। সেই রঙা খাদি কাপড়ের শাড়ি পরনে। বাঁ-হাতে জোড়া স্বর্ণের চুড়ি। গলায় চিকন সোনালী চেইন। কুঁকড়ানো লম্বা চুলগুলো ঘাঁড়ের ওপর হাতে খোঁপা করা। কোনো প্রসাধনী নেই, তবু যেন কোনো অভিজাত কুমারীকা! কাজের চাপে নিজের বিশেষ যত্ন ছাড়াও এত অলংকারহীন ঐতিহ্য আর গাম্ভীর্য! রোজ মুগ্ধ হলেও সেদিকে তাকিয়েও মিস ক্যাথারিন বিরক্ত হলেন আজ।

মাহেজাবিন চেয়ে আছে জানলার বাহিরে। শাড়ির বিশাল আঁচলটা বিছিয়ে আছে মেঝেতে। পা দুটো মেলে দেবার মতো বসে আছে। সোফার হাতলে হাত মেলে রেখেছে।রাজ্যের ভাবুকতা কাজলহীন চোখদুটোয়। উদাস-উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিজোড়া প্রকৃতিতে বিছিয়ে আছে।

চট করে কাহিনির মাঝে থেমেছে, আর শুরু করছে না। তিনি বৈকালিক প্রার্থনা ভুলে শুনছেন কাহিনি। তাতেও বেশ বিরক্তই হচ্ছিলেন বটে। আজ এই মেয়েকে দেখে কে বলবে, সে একসময় এত হুটমেজাজি ছিল? সমুদ্রের মতো গভীরতা, নিশ্চুপ চলন, বিনয়ী ভঙ্গিমা, শব্দহীন পদক্ষেপ আজ তার। সেসব কি পূর্বের সেই হুটহাট ক্ষেপে ওঠা অভিজ্ঞতারই প্রাপ্তি?

কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই মাহেজাবিন হাত উঁচিয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল, “ক্ষমা চাইছি, মাদাম। একটু বিরতি প্রয়োজন আমার। এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তা মিটিয়ে বরং আপনার প্রশ্নের উত্তর দেই!ʼʼ

তখনও দৃষ্টি জানালার বাহিরেই। ওভাবেই মাহেজাবিন ডাকল, “লতা? দু-কাপ চা করে দে!ʼʼ

এরপর জানালা থেকে নজর ফেরালো, মুচকি হেসে বলল, “আপনার প্রশ্ন করুন এবার।ʼʼ

-“অনেক প্রশ্ন করেছি এ যাবৎ। কোনোটারই উত্তর না দিয়ে একরোখার মতো গল্প বলে গেছ।ʼʼ

-“অসন্তুষ্ট হবেন না। এবার কিন্তু আমি নিজেই প্রশ্ন করতে বলছি।ʼʼ

-“ঠিক আছে, সব পরে হবে। আগে এটা বলো, তুমি মাইন্ড-ট্যাঙ্গল ইন্টার‌্যাক্ট প্লে করেছ ওদের সঙ্গে?ʼʼ ভ্রু জড়িয়ে ফেললেন মিস ক্যাথারিন।

-“তা বলছেন কেন?ʼʼ

-“মনে হলো।ʼʼ

-“না। সেসব পারিনা আমি।ʼʼ

-“ইশ্বরের দোহাই, মিথ্যে বলবে না। জয় আমির এ পর্যায়ে তোমার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছিল।ʼʼ

-“তাতে কী প্রমাণিত হয়?ʼʼ

-“তুমি তো এটাই চাইতে—তার জীবনের প্রতি মোহ জন্মাক।ʼʼ

-“তার সাথে শুধুই লড়াই চলেছে আমার। সেটাও আমার খালি হাতের। এত গভীরভাবে ভাবছেন কেন?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন হাসলেন, “সংসারত্যাগ কি অ-ভাবুকেরা করে? তোমার রুক্ষ্ণ আচরণ জয় আমিরকে তোমার দিকে মনোযোগী করেছিল, আর সেই মনোযোগ তোমাকে নিয়ে তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে, আর তা থেকে তোমার প্রতি সে… কারণ তুমি ছিলে সবার থেকে ব্যতিক্রম তার দৃষ্টিকোণে… তার সম্মুখে তুমিই প্রথম কেউ, যে তাকে সমীহ না করে ধিক্কার জানিয়েছে বারবার। বিয়ের পরে কি এ কাজটা ইচ্ছাকৃত একবারও করোনি?ʼʼ

মাহেজাবিন অদ্ভুতভাবে সূক্ষ্ণ হাসল, “তা কেন মনে হলো?ʼʼ

-“বলো, সত্যি কিনা!ʼʼ

-“কিছুটা।ʼʼ

-“আই বিলিভ দ্যাট, তুমি জয় আমিরকে কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত ক্ষেপিয়ে তুলেছ। এবং জেদ ধরে সেটাকে তামাশার পর্যায়ে নিয়ে গেছ।ʼʼ

সোফাত হাতল থেকে হাত তুলে, “ভুল বলছেন, মাদাম। শুধু তাকে প্রশ্রয় দেইনি, ভয় পাইনি পরিণতি অথবা পরিস্থিতিকে বিশেষ। এটা কাজ করেছিল বেশ। সকলেই ভয় পেত, আমি চেষ্টা করেছি নিরুদ্বেগ থাকার। এটা ওদের জন্য চিন্তার ছিল। আর তাতে আমার বেশ সাময়িক ভোগান্তিও হয়েছিল।ʼʼ

-“এটা কার্যকর ছিল। তাহলে স্বীকার করছো না কেন?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন থেমে গেলেন। মাহেজাবিন মুচকি হাসল। তিনি চট করে বললেন, “আচ্ছা! জয় আমির ভালোবেসেছে তোমায়?ʼʼ

-“জিজ্ঞেস করিনি কখনও।ʼʼ

-“তুমি কোনগুলোকে নিজের বোকামি বলো?ʼʼ

‘“আজ কিছুকেই না। তখন মাঝেমধ্যে মনে হতো, হয়ত বোকামি করছি।ʼʼ

-“তা কেন?ʼʼ

অন্তূ শুধু হাসল মুচকি, কথা বলল না। মিস ক্যাথারিন বললেন, “তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করো।ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠেনা। মৃত্যু অবধারিত সত্য। তার জন্য দায়ী যদি কেউ থেকে থাকেন সেটা তো সৃষ্টিকর্তা! সেই মহান সত্ত্বাকে দায় দেওয়া?….আসতাগফিরুল্লাহ! আল্লাহ পাক মাফ করুন আমায়।ʼʼ

-“তখন কেন ভাবতে?ʼʼ

-“তখন আমি অন্তূ ছিলাম, কারও কারও আরমিণ ছিলাম। আজ তা নই!ʼʼ

-“প্রতীকী কথা ভীষণ বলো, তুমি। উফফ! বুঝতে বেগ পেতে হয়।ʼʼ হেসে ফেললেন মিস ক্যাথারিন।

ফের গম্ভীর হলেন তিনি, “আর অন্তিকের মৃত্যু। সেটার জন্য কাকে দায়ী করো? নিজেকে মনেহয় না?ʼʼ

-“কখনোই না। আপনার তা মনে হয়?ʼʼ

-“তুমি হামজা-জয়ের প্রকাশ্য বিরোধিতা না করলে এমন হতো না। আমি মানি তা। এখানে স্টুপিডের মতো কাজ করেছ তুমি।ʼʼ

-“এবার নিয়ে পুরো কাহিনিতে কথাটা শতবার বলেছেন। অথচ এটা ভুলে যান ওদের কাছে মানুষ খুন করার জন্য সবকিছুর প্রয়োজন হলেও। কারণের প্রয়োজন কখনোই ছিল না। এরকম হাজার অন্তিককে রোজ মেরে আসতো। তাদের সকলের কয়টা করে আমার মতো বোন ছিল?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন ভ্রু কুঞ্চিত করে চেয়ে রইলেন।

অন্তূ রহস্য জড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “আমি অ্যাডভোকেট মাহেজাবিন আমির। রোজ কতশত অপরাধীর বিরুদ্ধে কেইস লড়ে ফিরছি। তার পরিণাম কী হবে, তা ভেবে কি আদালতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ফন্দি আঁটবো যে, কীভাবে পরে লুকিয়ে প্লান-প্রোগ্রাম করে নিরপরাধকে মুক্তি এবং অপরাধীকে ছক এঁকে ফাঁসি দেয়া যায়? আদালতে চুপ থাকি, নয়ত আমার বাপ-ভাই মরে যাবে। আর চুপচাপ হজম করলে তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে। অমর হয়ে যাবে ওরা!ʼʼ কথার মারপ্যাচে উপহাস করে উঠল মাহেজাবিন।

এরপর বলল, “ইন্টেলিজেন্ট সবাই পরিবার বাঁচাক, আমার পেশা এবং নেশা কেবল তা নয় এক জীবনে। স্বাধীনভাবে চলে যতদিন দুনিয়ায় টেকা যায়, যথেষ্ট।ʼʼ

মিস ক্যাথারিন একটু লজ্জা পেলেন। অন্তূ নরম হাসিমুখে বলল, “আমাকে কথা বলে, শত লোকের সম্মুখে যুক্তি দিয়ে তর্ক করে কেইস ডিসমিস করতে হয়, মাদাম। আর সেটা অপরাধীর বিরুদ্ধে, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে উঁচু আওয়াজে করতে হয়। সেখানে অপরাধীদের পুরো গ্যাঙ উপস্থিত থাকে। আজ যেমন ক্ষতির ভয় না করেও দিব্যি অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য আওয়াজ তুলি, তখনও তুলেছি। এরপর যা হয়েছে, সেটা হয়েছে রং টাইমিংয়ের জন্য। তখন যা-ই করতাম, ধারাবাহিকভাবে হিতে বিপরীত অর্থাৎ আমার খারাপই হতো। আজ তেমন হয়না, অন্তত তেমন খারাপ হয়না। হিড়িক বোঝেন? ক্ষতিগ্রস্ত হবারও একটা হিড়িক থাকে, যখন যার পালা, তখন শুধু তারই। একে তকদীরও বলা যায়!ʼʼ

-“কৌশল খাটাতে পারতে। বুদ্ধিমানেরা নীরবে চাল চালে। তুমি বারবার ধরা পড়ে গেছ। কারণ তুমি সতর্ক ছিলেনা।ʼʼ

মাহজাবিন শাড়ির আঁচল তুলে হাতের কব্জিতে রেখে শীতল হাসল, “আমি কি ঢাকঢোল পেটাতাম? ক্ষেত্রটাই এমন ছিল যে, সেখানে কোনো গোপনীয়তার সুযোগ ছিল না। ওরা ছিল মাত্রাতিরিক্ত চতুর। এখানে বসে যতটা সহজে সতর্কতার কথা বলছেন…আচ্ছা আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি এখন যে, আপনি ওখানে থাকলে আমি যা করেছি সেইসব বোকামি না করে তার বদলে আপনি কী কী কৌশল খাটাতে পারতেন?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন জবাব দিতে পারলেন না। চুপচাপ চেয়ে রইলেন অন্তূর দিকে। অন্তূ সোফাতে হেলান দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মিস ক্যাথারিনকে ইশারা করল কাপ তুলে নিতে।

কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “কৌশল খাটানোরও বিশেষ জায়গা থাকে, মিস ক্যাথারিন।ʼʼ

মিস ক্যাথারিন তাকালেন। মাহেজাবিন বলল, “ধরুন, আপনার সম্মুখে কাউকে খুন করা হচ্ছে। আপনি বাঁধা না দিয়ে মনে মনে বুদ্ধি আঁটছেন, কারণ আপনি বুদ্ধিমান, ঠান্ডা মাথার খূনি। কারণ আপনার ভয়, এখন কথা বললে আমারও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ততক্ষণে লোকটাকে মারা শেষ—ওটা আপনার বুদ্ধির লাভ? বাচ্চাগুলো না খেয়ে ছটফট করতো, চাবি নেই আমার কাছে, আপনি কী কৌশল খাটাতেন?

আমি কোনো মাফিয়া চক্র নই, যে থাপ্পড়ের বদলা কঠিনভাবে নিতে সেখানে হেসে পরে তার প্রতিশোধ নিতে গভীর প্লান বানাবো। আমি চিরকাল সাধারণ মেয়ে। খুব নির্বোধ। আর সবসময় শান্ত থাকাটা মানব মস্তিষ্কও প্রেফার করেনা। সে উদ্দীপনার আধার। আপনার মাঝে সেন্স থাকলে তা তখনই সেন্সিটিভিটিতে জ্বলে উঠবে, এটাকে সেন্স-রিফ্লেকশন বলে। যেমন আমার হতো। আমি চেয়েও জয়-হামজা-পলাশের সম্মুখে মিথ্যা তোষামোদ দেখাতে পারিনি। ভেতরের ঘৃণা ও সমগ্র পারিপাশ্বিক পরিস্থিতি আমায় অত সুস্থভাবে ভাবার সুযোগ দেয়নি কখনও। ভেতরের আক্রোশ বেড়িয়ে আসতো ঝটপটিয়ে।ʼʼ

-“অন্তিকে মৃত্যু? ওটা কি তোমার কারণে হয়নি?ʼʼপুনরায় বললেন মিস ক্যাথারিন।

মাহেজাবিন আবারও হাসল শুধু, “শুধু জেনে রাখুন, ‘নাʼ। তাছাড়া আমি মনে করি, ওটা কর্মফল এবং কাকতালীয় পরিণতি। অন্তিকের মতো অন্তিকেরা রোজ হাজারটা পিষে যাচ্ছে হামজা পাটোয়ারীর মতো রাজনৈতিককদের শুধু ইচ্ছাতে। তাদের সবার বোন আমি নই।ʼʼ

লতা এসে পা ঝেরে দাড়াল, “দিদিমণি, আর কিছু চাইবা না কইলাম। আমি সিনেমা দেখতেছি। এই নেও বিস্কুট।ʼʼ

মাহেজাবিন জবাব দিলো না কোনো। লতাও আশা করল না। সে তার ম্যাডামসাহেবার কাছে জবাব পেলেই অবাক হয়। তার ধারণা তার ম্যাডাম বাংলা জানেনা ঠিকমতো, তাই কথাও কয়না প্রয়োজন ছাড়া। কিন্তু আজ রাগ হলো। আজ তো বেশ কথা বলছে এই খ্রিষ্টান মহিলার সাথে!

মিস ক্যাথারিন বললেন, “সব স্থানে উকিলগিরি? নিজেকে খুব ডিফেন্স করতে জানো, দেখছি! দেখি এত যুক্তি শেষ অবধি তোমার জীবনকে কতটা যুক্তিযুক্ত অবস্থানে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।

মাহেজাবিন মুচকি হাসল, “আত্মরক্ষা ফরজ। আর যুক্তি হলো মনের বুঝ। ভুললে চলবেনা—জীবন তার পরিকল্পনা মাফিক প্রবাহিত হয়। আমরা কেবল জীবনের দাস। তার পেছনে নিরুপায় এগিয়ে চলি। জীবনের পরিকল্পনার সামনে যুক্তি খাটেনা। শুধু কাযকর্ম ব্যাখ্যা করার মাধ্যম হলো যুক্তি।ʼʼ

-“সেদিন ছেলেটাকে সঙ্গে কেন নিয়েছিলে ইচ্ছাকৃত? মন থেকে নাওনি তা আমি জানি।ʼʼ

মাহেজাবিন কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুব সহজ। সেদিন আমি নিজে থেকে লোক চেয়ে নিয়েছিলাম। তাতে কি আর আমার ওপর সন্দেহ আসবে, যে আমি অন্য কোনো কাজে যাচ্ছি। তাহলে তো লোক সঙ্গে নিতাম না। তাছাড়া…ʼʼ

মিস ক্যাথারিন কথা কেড়ে নিলেন, “তাছাড়া জয় আমিরের মনে হয়েছিল যে, তুমি তাকে ভরসা করছো। কৃতজ্ঞতা আর ভয়ে তার সাহায্য গ্রহণ মানে তো সব মেনে নেয়াই।ʼʼ

চলবে…

[পরের পর্ব থেকে আমরা খুব দ্রুত এগোবো অবরুদ্ধ নিশীথের অবরুদ্ধ খণ্ডাংশের দিকে। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here