অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৫৫.

0
1

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫৫.

মিস ক্যাথারিন সংসারত্যাগী, ধর্মভীরু ও নরম মনের সরল নারী। এসব হিংস্রতাকে খুব সহজে নিতে পারছিলেন না। একটু একটু করে বুঝতে পারছিলেন, তার সম্মুখে বসে থাকা নারীটি এমন শামুকি-খোলসে আবদ্ধ কেন? কী কী দেখে এই সময়ে এসেছে মাহেজাবিন, তা মেলাতে মেলাতে খেয়াল করলেন, মাহেজাবিন আনমনা হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী ভাবছো?ʼʼ

মাহেজাবিন চোখ তুলে তাকাল, “মাদাম, আপনি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমার অনুশোচনা আছে কিনা? সেদিন হয়েছিল। আজ অবধি পিছু ছাড়েনি তা।ʼʼ

-“তরুর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছো?ʼʼ

-“দায়ী তো আমিই।ʼʼ

-“নেভার, মাই চাইল্ড!ʼʼ

মাহেজাবিন মলিন হাসে, “পলাশ আমার ক্ষোভটা ওই নিষ্পাপ, নিরীহ মেয়েটার ওপর ঝেরেছে। জয় আমির অনেকবার প্রোটেক্ট করেছে আমায়। তাই পলাশ আমার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। আর তার সবটাই পরোক্ষভাবে তরু সঁয়েছে। সেদিন না আমি পলাশের ডেরায় যেতাম, না শেষ অবধি জয় আমিরের সাহায্য দরকার হতো, আর না তার জের ধরে এতগুলো দিন পর ওই নাজুক মেয়েটা..ʼʼ

-“ইটস ইওর মিস-কন্সেপশন, গার্ল! তুমি তরুর জন্য অতিরিক্ত ট্রমাটাইজ হয়েছ, যে কারণে নিজেকে অপরাধী ভেবে খানিকটা বোঝা কমাতে চাইছো। আমি শুধু ভাবছি, জয় আমির কী করেছিল এর পেক্ষিতে!ʼʼ

মাহেজাবিন ক্ষীণ হাসল, “তার কাছে আশা করছেন কিছু? আপনি কি অধর্ম করতে চান, মাদাম?ʼʼ

মাদাম মুচকি হেসে ফেললেন, “আশা তো তুমিও করেছ! ওর ওপর আশা না করা যায় নাকি?ʼʼ

মাহেজাবিন ভ্রু কুঁচকাল, “আপনি কি বশীভূত হয়ে পড়ছেন সেই খল-লোকটির দ্বারা, মাদাম?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন চুপচাপ চেয়ে থেকে কেবল মুচকি হেসে বললেন, “অধর্ম? না না, অধর্ম কেন বলছো? জয় আমিরকে এক শব্দে বর্ণনা করবার সাধ্যি আমার নেই। তথাপি সামথিং হ্যাজ ডিস্টিনিক্ট ফিচার ইন হিম, না? ক্যান ইউ ইগনোর দ্যাট? হি ইজ নট জাস্ট আ সিনার, বাট অলসো সামথিং মোর।ʼʼ

-“ইউ ক্যান’নট এভোয়েড হিজ ওফেন্স অলসো, মাদাম।ʼʼ

-“নন দ্য লেস!ʼʼ

-“হোয়াট!ʼʼ

মিস ক্যাথারিন তাকিয়ে রইলেন। মৃদুহাস্য চেহারা উনার। সরল-শুদ্ধ চাহনি।

তরুর লাশ নিয়ে যাবার পর অন্তূ সোফাতে বসেছিল। মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে তখন। তরুর মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। অন্তূ চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে পানি নেই। কিন্তু মস্তিষ্কের পীড়ায় নিঃশ্বাস গ্রহণও অসহ্য হয়ে উঠেছিল। চোখের স্মৃতি অন্তূকে কঠিন ভোগান্তিতে ফেলছিল।

পোস্ট-মর্টাম করতে দেয়নি জয়। যে যে পুলিশ বোঝাতে এসেছে, তাদের বাপ-মা একাকার করে বকে দিয়েছে। শেষে থানার ওসি এলেন। বললেন, “দেখো, আইনকে তাদের কাজ করতে দাও।ʼʼ

জয় শান্ত স্বরে বলল, “আপনার আইনরে বহু আগে থাপায়ে রাখছি, স্যার। আমার কাছে আইনের কথা না বললেই না? আমরা যদি বিচার না চাই? আমাদের কোনো অভিযোগ নাই। ও ধোনের কেইস ফাইল হইছে, হইছে। আর হাজারটা ফাইলের মতো ওইটাও জমা রাখেনগা। থানার আলমারিগুলো কীসের জন্য?ʼʼ

এরপরের কথা কাটাকাটির কাজটা হামজা করেছে। নয়ত একটা তাণ্ডব শুরু হয়ে যেত। জয়ের ভাষায় দোষ আছে। সে পোস্ট-মর্টাম তো দূর, কোনও তদন্তই করতে চায়না। রিপোর্ট অবধি লেখাতে রাজী নয়। পুলিশ তো আর তা শুনবেনা। আর কিছু না করুক, আনুষ্ঠানিকতা দেখাতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর জুড়ি মেলা ভার।

কবরে তরুর দেহ নামিয়ে যখন একমুঠো মাটি তুলে জয় তরুর ক্ষত-বিক্ষত মুখটার ওপর ফেলল, তা ঝরঝর করে পড়ল তরু বিচ্ছিন্ন দেহটার ওপর। জয়ের মনে হলো, এটা মাটি নয়, তরুর মায়ার মাঝে এক অন্তরায়, যা লাল ফুল, মাটি হয়ে ঝরছে। এই অন্তরালের পিছে তরু লুকিয়ে পড়ছে চির আরামে, স্বার্থপরের মতো। জয়ের রাগ হলো। সবাই স্বার্থপর! উফফ! কেন কেন? জয় কেন স্বার্থপর ছাড়া কাউকে পায়নি এই জনমে?

তার মায়ার মানুষ কেউ নেই কেন? কেউ কেন জয়কে কখনও মায়াভরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেনি, ‘খা বাপ। এই খাবারটা তোর পছন্দ, তোর জন্য বানিয়েছি!ʼ তরু বলতো, সে আজ চলে যাচ্ছে। কেউ বলেনি, ‘ও জয়! এত আঘাত কোত্থেকে পেয়েছিস? আর বাইরে যাবিনা খবরদার! এবার থেকে মারপিট করতে গেলে ঠ্যাং নুলা করে ঘরে বসিয়ে রাখব।ʼ
অনেক রাতে বাড়ি ফিরলে, কারও ভয় ছিল না। যে কেউ হয়ত, গম্ভীর স্বরে বলবে, ‘জয়, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? জয়ের মা, তোমার ছেলের চালচলন না বদলালে বলে দিলাম, আমার বাড়িতে ওই জানোয়ারের জায়গা হবেনা।ʼ

তরু বলতো, আস্তে আস্তে বলতো, ‘এসব না করলেই না? কাল থেকে কোথাও বের হবেন না। এই আঘাত না শুকানো অবধি কোথাও গেলে..ʼ
জয় জিজ্ঞেস করতো, ‘গেলে কী? তুই পুঁচকে আমার কী করবি রে?ʼ
তরু অভিমান আর ভয়ে চুপসে যেত। তবু চোখে কাতরতা। ওই চোখ বলতে চায়, ‘প্লিজ যাবেন না। আমার কষ্ট হয়। আপনি জানেন না, এইসব ঘা দেখে গিয়ে সারারাত ফুপড়ে কাঁদি আমি। আমার সহ্য হয়না আপনার ব্যথা! মারপিট করবেন না আর। এত শত্রু পয়দা করবেন না। ঠিকমতো নিজের খেয়াল রাখবেন।ʼ

জয়ের গোসলের গামছাটা, খাবারের প্লেটটা, নোংরা শার্টটা ধুয়ে দেয়া, জ্বরে পোড়া কপালটা টিপে দেয়া, তাতে সযত্নে জলপট্টি দেবার মায়ার নারীটাকে শেষবার দেখল জয়। আরামে শুয়ে আছে মেয়েটা। আর কোনো কষ্ট নেই ওর। আর জয়ের বিরহ সইতে হবেনা তরুকে, সারাদিন অক্লান্ত কাজ করতে হবেনা। জয়ের ফরমায়েশ খাটার দিন বুঝি ফুরোলো তরুর! জয় আর ধমকে ডেকে বলবে না, “এই! প্যান্টটা ধুয়ে দিসনি কেন? এখন কার বালডা পরে বাইরে যাব আমি?ʼʼ

সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে কত আরামে শুয়ে পড়ছে দেখো! জয়ের কপালের শিরা ফুলে উঠল ক্ষোভে! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, “স্বার্থপর, বান্দির বাচ্চা! চলে যাচ্ছিস? এই! তাকা! ভয় ভয় চোখে তাকা একবার। আমার দেখ চোখ লাল হয়ে আসছে। গলায় কিছু দলা হয়ে আছে। সত্যি বলছি, মাল খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকব, আর বাড়ি ফিরব না কিন্তু। শেষবার বলছি, তাকাবি কিনা বল! আস্তে করে বল, মন খারাপ আপনার? বল বল বল। আমার সহ্য ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করিস না তরু। আমি কাঁচা। হেরে যাব এই চ্যালেঞ্জে! তরু….আমার কেউ নেই। আমার ধমক শোনার কেউ নেই, বাড়িতে মাছ রান্না হলে আমায় আলাদা করে ডাবল ডিমের অমলেপ বানিয়ে এনে পাতে দেবার কেউ নেই তুই ছাড়া। আমি মাছ খেতে পারিনা। ডিমের অমলেট কে বানাবে আমার?ʼʼ

কবরস্থান থেকে ফেরার পথে জয়ের মনে একটা খটকা লাগল। সে আজ তরুর মুখে মাটি ফেলতে গিয়ে যে আহাজারিটা করে এলো, এটা যেন আগেও কোথাও ঠিক একইভাবে হয়েছে। কেউ একজন এভাবেই করেছে! চোখের সামনে একটা মুখ ভেসে উঠল। কান্নারত এক নারীর মুখ। হাসপাতালের মেঝেতে বসা। চোখদুটো ঝাপসা থাকায় টের পাচ্ছিল না প্রথমে। পরে স্পষ্ট হলো—আরমিণ কাঁদছে, আমজাদ সাহেব শুয়ে আছেন। জয় দূরে দাঁড়ানো ছিল সেদিন। দেখেছিল আরমিণকে কাঁদতে।


ইশার আজানের সময় কবরস্থান থেকে ফিরল পুরুষেরা। হামজা এসে বসল অন্তূর পাশে, একটু দূরে। মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে দু হাতে মুখ কপাল চেপে ধরে বসে রইল। তরুর মা বুক চাপড়ে কাঁদছিল তখন। অন্তূ ঠিক হামজার মতোই হাঁটুর ওপর ঝুঁকে বসল।

দুজন তখন পাশাপাশি বসা। একই ভঙ্গিতে। হামজা চিন্তিত, অন্তূ চাপা ক্ষোভ ও ঘৃণায় ভারাক্রান্ত।

অন্তূ খুব স্থির, শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল, “পাপের আগুন সর্বপ্রথম তার জন্মদাতাকে ভষ্ম করে, মেয়র সাহেব। আপনাদের পাপ আপনাদেরকে জ্বালিয়ে কাঠকয়লার ছাইয়ে পরিণত করবে। মুমতাহিণাও ঠিক এভাবেই তরুর মতো ছটফট করেছিল, আপনারা এগিয়ে যাননি পলাশের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে। প্রতিশোধ! কোনো কারণে ওর ভাইদের ওপর প্রতিশোধে এত নিচে নামা যায় যদি, যে ছোট্ট মেয়ে রেহাই না পায়। তরুই বা কেন পাবে! সেও তো পাপ করেছে, আপনাদের আশ্রয়ে থেকে বড় পাপ করেছে মেয়েটা। শাহানা পাটোয়ারীর স্বামী যখন জানোয়ারের মতো খাবলে খেতে যেত মেয়েটাকে, তিনি হয়ত দ্বারে বসে পাহারা দিতেন স্বামীকে?ʼʼ

জয় এসে বসেছিল তখন সোফার অপর পাশে। চুপচাপ দুই ভাই শুনল শুধু অন্তূর ধিক্কার, “আমার সম্মান, বাপ, ভাই, আমার বিধবা ভাবি, তার জন্মের আগে হওয়া অনাথ অনাগত সন্তান…কার কার দীর্ঘশ্বাস থেকে বাঁচবেন আপনারা? যে জয় আমির আমার সম্মানকে মানুষের মুখের থুতুর ফেলার সমগ্রীতে পরিণত করেছিল, আজ আপনার বাড়ির দুটো মেয়ে সত্যি সত্যি ভ্রষ্টা। আমি তো দূর্বল, যা-ই করেছি, তা বোকামি হয়েছে। অথচ উপরে যিনি খেলেন, সেই মহান সত্ত্বার ঘুটির চাল বড্ড নিখুঁত হয়। তিনি ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। আর তিনি ফিরিয়ে দিলে সীমাহীন দুর্ভোগ দেন।

কত মায়ের বুক খালি করা ধন আপনার কুটুরিতে খিদের জ্বালায়, পানির পিপাসায়, প্রাণের আকুতি নিয়ে ছটফট করে। তাদের যন্ত্রণা আর কাতরতার ভার বইতে পারবেন তো? সবে শুরু। এখনও সময় আছে, ফিরে আসুন। আপনার তো পরিবার নেই। তবু যে মানুষগুলোকে নিয়ে একটা পরিবারের মতো গড়েছিলেন, তারা একে একে সব বিদায় হচ্ছে নৃসংশভাবে। তারা কোথায় এখন? নরকের আগুনে বসে আপনাদের অপেক্ষা করছে না? তৈরি হন সেই মহাক্ষণের জন্য। তবে আফশোস কী জানেন? আপনাদের পাপের দাম এক জনমদুখী নিষ্পাপ মেয়ে পরিশোধ করে গেল খানিকটা। রবের বিচার কেন যে এমন হয়, বুঝিনা তাঁর খেলার চাল।ʼʼ

অন্তূ কাঁদেনি। বুকের আগুনে কাঁপছিল শরীরটা, সেই সাথে কম্পিত ঝংকার তোলা গলার আওয়াজ! হামজা-জয় কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। চুপচাপ বসে শুনেছিল দুই ভাই।


তরুর লাশ দাফন হয়েছিল বাদ মাগরিব। সকল আনুষ্ঠানিকতা, ইনভেস্টিগেটর, লোকাল পুলিশ, মানুষের ভিড়—ইত্যাদি সামলে পাটোয়ারী বাড়ি খালি হলো টানা আট-দশঘন্টা বাদে রাত দশটার দিকে।

জয় রুমে এলো সাড়ে এগারোটার দিকে। অন্তূ তখন বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসা। দৃষ্টি ছাদের দিকে। জয় ওয়্যারড্রোব, আলমারি, খাটের নিচ, বাথরুমের ফেইক-ছাদ তামাম ঘরে কিছু খুঁজে হন্য হলো। জয়কে দেখতে তখন মন্ত্রপুত পুতুলের মতো লাগছিল। যেন কেউ মন্ত্র দিয়ে বশ করে অথবা চাবি ঘুরিয়ে ছেড়ি দিয়েছে, জয় সেই ঘোরে পাগলের মতো কিছু খুঁজছে।

ঠুকঠাক আওয়াজ বাড়ছিল। জয় উদ্ভ্রান্তের মতো কিছু খুঁজে চলেছে। অন্তূ বলল, “কী খুঁজছেন? ঘর উলোট-পালোট না করে বলুন আমায়। কী হয়েছে?ʼʼ

জয় একবার ফিরে তাকিয়ে আবার খোঁজায় মনোযোগ দিয়ে বলল, “ঘরওয়ালি, আমার চাপ্পর পাচ্ছিনা। কোথাও সরাইছো নাকি? কই রাখছি, মনে পড়তেছে না।ʼʼ খুব ক্লান্ত আর কঠিন তার কণ্ঠস্বর।

অন্তূ অবশ পায়ে উঠে দাঁড়ায়। জয় তখন ড্রয়ার খুলে দুটো ছোট-বড় ড্যাগার বের করল। শার্টের প্রান্ত উচিয়ে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কোমড়ে লুঙ্গির গিঁট শক্ত করল। ড্যাগারদুটোর চকচকে মাথা সাদা লুঙ্গির থানে ঘঁষে মুছে তা গুঁজল কোমড়ে। একটা ছোট্ট স্ক্রু ড্রাইভার, এক প্যাকেট ব্লেড, দুটো দিয়াশলাই ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রাখল।

অন্তূ এগিয়ে গিয়ে আলমারীর নিচের চেম্বার খুলে একটা কাপড়ের পুঁটলি বের করে। এটা অন্তূর সেই ওড়না। ওড়নাটা সে পেয়েছিল কয়েকদিন আগে। এর ভেতরে জয় নিজের একমাত্র বিশ্বস্ত সাথীটাকে যত্নে জড়িয়ে রেখে দিয়েছিল—নিজের ব্যবহৃত সেমি-অটোমেটিক নাইন এম-এম ক্যালিবারের পিস্তলটা। অন্তূ সেটার ভেতরেই জয়ের ব্যবহৃত আরেক প্রিয় অস্ত্র–চাপ্পরটা রেখে দিয়েছে। যা দিয়ে সাধারণত পশুর মাংস ছড়ানো হয়। জয় এটাকে কী কাজে ব্যবহার করে, তা তখনও জানা হয়নি।

সেটা বের করে অন্তূ নিজের ওড়না দিয়ে অস্ত্রটার ধারালো প্রান্তটা সযত্নে মুছতে মুছতে এনে জয়ের হাতে তুলে দিলো, “এই নিন।ʼʼ

জয়ের মুখের অভিব্যক্তি দুর্বোধ্য। সেখানে কাঠিন্য আছে, সাথে আছে এক প্রকার ঘোর, পাগলাটে নেশা। অন্তূর দিকে তাকিয়ে রইল কেমন করে যেন। অন্তূ সেদিন অস্ত্রটা জয়ের হাতে যত্ন করে তুলে দিয়ে বলেছিল, “যান। পাগলা জানোয়ার বধ করতে যাচ্ছেন, জয় আমির। জয়ী হয়ে ফিরুন। আমি অপেক্ষায় থাকব আপনার বিজয়ের।ʼʼ

জয় চাপ্পরটা দুই ঠ্যাঙের মাঝে চেপে ধরে লাল গামছাটা তুলে গলায় পেঁচালো। এক হাতে চাপ্পর ধরে অপর হাতে অন্তূর চুলগুলো আলতো হাতে মুঠো করে ধরে কপালে একটা কঠিন-ভেজা চুমু খেল। লাল গামছাটা মুখে মুখোশের মতো করে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে গেল চুপচাপ রুম থেকে।


পরাগকে সেদিন অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো রাজন আজগরের বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন, তাই না?ʼʼ

পরাগ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল, “দাসীর ছেলের আর মানুষ হওয়া কী, ম্যাডাম? রাজন আজগরের বউ চলে গেছিল মুখে লাত্থি মেরে। রাজন আজগর শুদ্ধ পুরুষ নয়। তার দ্বিতীয় বিয়ের দরকার নেই। আর সেক্ষেত্রে জায়েজ একটা পুত্রসন্তান হবার সুযোগও ছিল না, যে তার উত্তরসূরী হতে পারে।ʼʼ

অন্তূ বুঝল, তবু বলল, “আপনি তো ছিলেন। উত্তরসূরী আপনি হতে কেন পারেন না? তার ঔরসেই জন্ম আপনার। সে চরিত্রহীন তাই আপনার মাকে বিয়ে করেনি…ʼʼ

-“আপনি এত অজ্ঞ তো নন, ম্যাডাম। শোনেননি, রাজারা দাসীর সাথে নষ্টামি তো করতো ঠিকই, কিন্তু সেইসব সন্তানেরা দাস হয়েই রয়ে যেত। সিংহাসনের ভাগ কিন্তু বিয়ে করা রাণীর সন্তানদেরই। হাজার হোক পলাশ রাজনেরই ভাইয়ে ছেলে, ওরই রক্ত। আর আমি দাসীর গর্ভের জারজ সন্তান। আমি দাস হয়ে রয়ে গেলাম পলাশের।ʼʼ

-“আব্বুর স্কুলে পড়তেন আপনি। পড়ালেখা কে করালো?ʼʼ

“এ কারবার সামলাতে অথবা সহকারী হিসেবে থাকতে পড়ালেখার মেলা দরকার ম্যাডাম। আমাকে পড়ালেখা করানো হলো। আমার মা রূপকথা আর পলাশকে মানুষ করল নিজের সন্তানের মতো, কিন্তু সেসবের ভিড়ে আমার জন্যই তার সময় থাকতো না। আমি তার আশেপাশে ঘেঁষার সুযোগই পেতাম না। পলাশের গেলামকে পালা হচ্ছিল ওই বাড়িতে। পলাশ যখন কারবারে হাত দেবে, বড় হয়ে আমি তার দাসবৃত্তি খাটবো, এই তো।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ শুনছিল। পরাগ মলিন হাসল, “অথচ জানেন ম্যাডাম, আমি রূপকথাকে বোনের মতোই ভালোবাসতাম। ছোট থেকেই। কিন্তু রাজকন্যা আর দাসীর ছেলে কি কখনও ভাই-বোন হতে পারে। যত বড় হতে থাকলাম, পদে পদে টের পেলাম—আমার মা একটা দাসী সাথে পতিতাও, আর আমি দাস। কলেজ পাশ করার পর ভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগে সুন্দর একটা ঘটনা ঘটল। পলাশ জীবনে খুন আর ধর্ষণ কত করেছে, সে হিসেবে আমার কাছে নেই। তবে সেইবার সে এক প্রভাবশালীর বউকে তুলে এনে ছিঁড়েছুটে খেয়েছিল। ওই কেইসটা আর লুকাতে পারা যাচ্ছিল না। তখন কী করল জানেন?ʼʼ

অন্তূ বলে উঠল, “তার দায় আপনাকে দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো।ʼʼ

পরাগ জোরে জোরে হাততালি মেরে পাগলের মতো হেসে উঠল, “উফফফ! ম্যাডাম, আপনি যা ব্রিলিয়ান্ট না! আই লাইক ইউ সো মাচ।ʼʼ

অন্তূ মুচকি হেসেছিল, “ভার্সিটিতে আর ভর্তি হওয়া হলো না আপনার?ʼʼ

-“আইনের খাতায় লাল দাগ পড়ে গেল আমার নামের। তারপর আর কী করে? অথচ আমার ইন্টারের রেজাল্ট কিন্তু ম্যাডাম সেই ভালো ছিল। ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স হতে পারতো।ʼʼ

-“কত বছর জেলে ছিলেন?ʼʼ

-“আড়াই বছরের মতোন। তারপর জামিন করা হলো। ততদিনে আমার ক্যারিয়ার শেষ। ওপপস! শালা, গোলামের আবার ক্যারিয়ার। ধ্যাৎ!ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল পরাগের মিথ্যা হাসির আড়ালে থাকা মলিন মুখখানা। পরে বলল, “আপনাকে যখন একজন মৃত মানুষের জায়গা নিতে বলা হলো, আপনি রাজী হয়ে গেলেন অভিনয় করতে?ʼʼ

শব্দ করে হেসে উঠল পরাগ, “যেখানে পলাশের খুন আর ধর্ষণের দায়ে চুপচাপ জেল খাটতে পেরেছি, পড়ালেখা বরবাদ করতে পেরেছি, দেদারসে ওর হুকুমে মানূষ খুন করতে পেরেছি, এ আর কী? তাছাড়া আমি আর মা ওদের পারিবারিক দাস। কতকিছু করেছি ওদের জন্য, এই সামান্য অভিনয়টুকু কী এমন?ʼʼ

অন্তূ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “তবে যাই বলুন, আপনার কথাবার্তা এবং চালচলনে কিন্তু আপনাকে মোটেও মাত্র ইন্টারপাশ লাগেনা। বেশ উন্নত একটা ব্যক্তিত্ব আছে আপনার, কাজে লাগাতে পারেন। একজন ভালো মানুষ হতে পারেন।ʼʼ

-“প্রশংসা করলেন? উফফ, জীবন ধন্য এই পরাগের। ক্ষমা করতে পারেন আপনি আমায়?ʼʼ

অন্তূ যেন শেষ কথাটা এড়িয়ে গেল। তাতেই বোঝা গেল, তার দৃঢ়তা। ক্ষমা! এই শব্দটাকেই অন্তূ এড়িয়ে চলে। সে নিজের আপন ভাইকে ক্ষমা করেনি আজ অবধি, পরাগকে কেন করবে? প্রশ্নই ওঠেনা। তা বুঝে পরাগ হাসল মাথা নিচু করে। সেদিন সে এগিয়ে যায়নি পলাশের হাত থেকে এক রমনীকে বাঁচাতে। জয় আমির দান মেরে দিয়েছে। তার হাত-পা দাসত্বের বেড়িতে বাঁধা না থাকে কি সে যেত? আর এই চমৎকার বুদ্ধিমতি মেয়েটিকে জিতে নিতে পারতো? কে জানে!

অন্তূ সব এড়িয়ে কেবল বলল, “চলে যান এসব ছেঁড়েছুড়ে।

-“খেলা শেষ না করে না।

অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল, “খেলা?ʼʼ

পরাগ কূটিল হাসল, “পলাশের দাসবৃত্তি আর নয়, ম্যাডাম। একে একে গুড়িয়ে চুরচুর করে দেব আজগর প্রোপার্টিজের কারবার। এরপর নিরুদ্দেশ হবো চিরকালের জন্য। শেষ দেখা হলো আজ ধরুন আপনার সাথে।ʼʼ

অন্তূ একটু অবাক হয়েছিল, “আপনি কি জয় আমিরকে সহায়তা করেছেন?ʼʼ

-“না করার কী আছে? আমি পলাশের ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমি ম্যাডাম অত খারাপ নই। মা চিরকাল দাসীগিরি করে এসেছে, রক্তে তা ছিল আমার। তাই বহুবছর দাস খেটেছি। কিন্তু পড়ালেখা করতে গিয়ে, সমাজের সাধারণ স্তরের ভালো মানুষদের সাথে মিশতে গিয়ে বিবেকের ঢাকনা একটু একটু করে খুলে যেত। আমি দেখতে পারতাম না পলাশ আর ওর চাচার এসব কুকর্ম, ওর আদেশ মানতে গিয়ে যেসব করতে হতো, তা করতেও বিবেকের দংশনে পড়তাম। এজন্যই তো দুবছরের জেলটা খাটালো আরও। আর না, ম্যাডাম। শেষ পাপটা করলাম এবার। বিশ্বাসঘাতকতা। মাফ না পাই। কিছু মানুষ বেঁচে যাচ পলাশের হাত থেকে। এতে যেটুকু পূণ্য হবে, চলবে।ʼʼ

অন্তূ বুঝেছিল, জয় আমির ও হামজাই নয় শুধু, আরও একজন পলাশের পেছনে লেগেছে এবার। কিন্তু জয় আমির শুধুই নিজেকে ধরা দিচ্ছে পলাশের কাছে। লোকটার কি জানের মায়া নেই? পরাগকে পলাশের সামনে সে আনেনি এই ঘটনায়, তা যেন অন্তূ নিশ্চিত। কারণ জয় আমির পাপের দায় নিতে খুব পছন্দ করে। পাগল-মাতাল লোক। কেউ একটু সহায়তা করলে তার জন্য জান হাজির। এইসব লোক ধ্বংস হয় খুব খারাপ ভাবে। তা জয় নিজেও জানে, তবু কোনো সতর্কতা নেই?

অন্তূ শেষে আন্দাজে আরেকটা ঢিল ছুঁড়েছিল, “আপনাকে কেউ একজন সহায়তা করেছে, সে কে?ʼʼ

পরাগ হেসেছিল শুধু। অন্তূ বলেছিল, “রূপকথা আজগর নামের কেউ নাকি?ʼʼ

অন্তূর রসিকতায় পরাগের হাসি চওড়া হয়েছিল। অনেকক্ষণ অন্তূর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “আপনি আমার কোথাও একটা সুঁচালো ধাক্কা মেরেছিলেন ম্যাডাম। যেই ধাক্কা সামলে উঠতে চেয়েছি। আজ এই মুহুর্তে আবার নড়বড়ে লাগছে নিজেকে।

তখনই অন্তূ উঠে দাঁড়িয়েছিল এই পর্যায়ে, “অথচ আমি বিবাহিতা, মি. পরাগ। এ ধরণের কথা বলাও অসঙ্গত আমার সঙ্গে।ʼʼ

-“জানি ম্যাডাম। আর আপনার এই ব্যক্তিত্বই পুরুষের মরণের কারণ। যে জয় আমিরকে এত কঠিন ঘেন্না আপনার। তবু তার অগোচরে নিজের চরিত্রের সঙ্গে আপোষ নয়। আপনি তাকে মানেন?ʼʼ

অন্তূ গম্ভীর স্বরে শুধু বলেছিল, “আমি সেই বিয়ের খোৎবা ও তিন কবুলকে মানি কেবল। আর কিছু নয়। আসি আমি আজ।ʼʼ

অন্তূ উঠে দরজার দিকে যায়। পরাগ তবু অপলক চেয়ে ছিল। বুকটা চিনচিন করছে। সে জানে এই নারী আর ফিরে তাকাবেনা। তবু চেহারাটা দেখার লোভ সংবরণ করা বড় দুঃসাধ্য। পরাগ জোর করে বসে রইল। সংযমের বাঁধটাকে শক্ত করে বসে রইল। এগিয়ে গেল না। নারীটিকে বেরিয়ে যেতে দিলো। বুক চিড়ে যাচ্ছ। এই ক্ষত ভরাট হয়ে যাবে। তবে এই মুহুর্তে বড় ভোগান্তিতে ফেলছে। এটা তো বিরহ নয়, প্রবাহ। পরাগ হেসেছিল। অন্তূ বেরিয়ে এলে জোরে জোরে শব্দ করে হেসেছিল।


রাত সাড়ে চারটার দিকে জয় ফিরেছিল সে রাতে। ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে দূর মসজিদ থেকে। ঘোর অবরুদ্ধ রাত। আকাশে চাঁদ নেই। চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে সে রাতে বোধহয় জয় আমিরকে সুযোগ দিয়েছিল লহু রঙে হাত রাঙাবার খেলায় মত্ত হতে। সেই ভোররাতে র^ক্তে শরীর ধুয়ে সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকল জয় আমির। আলত আঁধারির সদরঘরটায় তার ছিপছিপে কঠিন অবয়বের পেটানো লুঙ্গি পরিহিত দেহটার লম্বা ছায়া পড়ল।

সদর দরজার এপারে এগিয়ে দেয়াল ঘেঁষে র^ক্তাক্ত চাপ্পরটা থপ করে ফেলল। ধাতব অস্ত্রের ঝনঝনানিতে চমক উঠল অন্তূ। চাপ্পরটা মেঝেতে পড়ার সাথে সাথে চাপ্পরের গায়ে লেগে থাকা রক্ত ছিটিয়ে পড়ল মেঝের সাদা টাইলসের ওপর।

অন্তূ শান্ত পায়ে বেরিয়ে এল রুম থেকে। জয় আমির ফিরেছে। শিকার না করে ফেরেনি, দৃঢ় বিশ্বাস অন্তূর। সে জানে জয় আমির শিকার করায় ওস্তাদ। ঠিক যেভাবে চায়, পরিস্থিতি সেভাবেই প্রবাহিত হয়, তার অনুকূলে। এটা জয় আমিরের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অথবা জৌলুস-অর্জন।

হামজা বসে আছে তখনও সোফাতেই। তার অপেক্ষার অবসান হলো। শান্ত নজর মেলে তাকিয়ে দেখল বিদ্ধস্ত জয়কে। মুখে একপ্রকার তৃপ্তি। খুঁটিয়ে দেখল, জয়ের শরীরে আঘাত আছে কিনা! বোঝা যাচ্ছে না। তবু হামজা জানে, জয় শিকারে গেলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়না। সে যতবার আঘআতপ্রাপ্ত হয়েছে, নিজে সারেন্ডার করে যেচে পড়ে মার খেয়েছে, তবু আইনের কর্মকর্তাদের কাছে নতি স্বীকার করেনি। যা মুখে এসেছে, বকে গেছে। উত্তর দেবার সময় একবারও চিন্তা করার অভ্যাস নেই, পরিণতি হবে। সামনে কে, কী হতে পারে তার সাথে। সেসবের ধার না ধারায় জীবনে আঘাতের কমতি অন্তত নেই দেহে।

এই গুণটা জয়ের বউয়ের মাঝে আছে। সব হারাতে রাজী তবু ভিত নড়তে দেয়া যাবেনা।

হামজা আস্তে করে বলল, “গোসল করে আয় এখানে। চোট পেয়েছিস কোথাও?ʼʼ

কথা বলল না জয়। কপালে মাটি। চোখদুটো শান্ত, স্থির। ঘড়ি দেখল সে চোখ তুলে। হাতের চটের বস্তাটা হাত থেকে ফেলে দিলো। এখনও বস্তার নিচ দিয়ে ঘন লাল তরল চুইয়ে চুইয়ে দু-এক বিন্দু মেঝেতে পড়ছে।

সাদা ধবধবে লুঙ্গিখানা র^ক্তে ধুয়ে উঠেছে। মুখে বাঁধা গামছাটা তখন মুখ থেকে নামানো, গলায় ঝুলছে। মুখ, গলা, হাতের কনুই অবধি র^ক্তের ছিঁটা। তার ওপর কাঁচা মাটির আস্তরণ। লুঙ্গিতে মাটি ভরা। গলার লাল টকটকে গামছাতেও মাটি, ঘাম, র^ক্ত। হাতের কব্জি অবধি মাটিতে ঢাকা। নখের ভেতর মাটি। খুবলে মাটি খুঁড়েছে বোধহয়।রক্তের সাথে মাটি মিশে একাকার পুরো শরীরটা। চাপ্পরের ধারালো দিকটায় শুকনো রক্তের ওপর এখনও অল্প-সল্প আধজমাট বাঁধা রক্ত। পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলটা বস্তাতে বোধহয়। খালি পায়ের গোড়ালির ওপর অবধি মাটি। সেই মাটিতেও তাজা র^ক্ত মিশে আছে।

সেই মাটি পায়ের তালু থেকে ঝরে মেঝেতে ছড়াতে ছড়াতে রুমে ঢুকল। গামছা দিয়ে আরেকবার ঘাম ও র-ক্তে একাকার মুখটা মুছে গোসলে ঢুকল।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here