[সতর্কতা: সহিংসতা আছে পর্বটিতে]]
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৫৭.
রাত নয়টার দিকে ঘুম ছাড়ল জয়ের। বাইরে মহিলাদের কোলাহল। আগামীদিন একটা বিরাট আয়োজন পাটোয়ারী বাড়িতে। রসুন-পেয়াজ কাটাকুটো এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা চলছে।
অন্তূ ঘরে ঢুকল। বাচ্চাদের পানি খাইয়েছে, টুকটাক শুকনো খাবার দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে ওদের বের করা যায়? চতুর দুর্বৃত্তের মতো দুই ভাইয়ের চোখ। তা ফাঁকি দেবার উপায় খুঁজে পায়নি সে।
ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার দিকে। জয় বরাবরের মতো উপুড় হয়ে শুয়েছিল। হাতে মোটা চুরুট। ধোঁয়ার দুর্গন্ধে ঘরজুড়ে। জয় জিজ্ঞেস করল, “দুধে কী মাল মিশিয়েছিলে, ঘরওয়ালী? মাথা ঝিমিঝিম করতেছে এখনও।ʼʼ
-“ক্লোজেপাম ড্রাগস। অল্প পরিমাণে দিয়েছি। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন, রেশ কেটে যাবে।ʼʼ
-“তোমার ভয় লাগল না কথাটা স্বীকার করতে?ʼʼ
-“প্রশ্নই ওঠেনা। আমি নিজের কৃতকর্ম যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বীকার করে নিতে অভ্যস্ত, হোক সেটা ভালো অথবা খারাপ। দ্বিমুখীতা আগে একদমই ছিল না আমার মাঝে।ʼʼ
জয় সন্তুষ্ট হাসে। তাদের দুজনের মাঝে অসংখ্য বৈশিষ্ট্যগত মিল। তবু তারা পরস্পরের বিপরীতে রক্তপিপাসু একে-অপরের! এটা কি নিয়তি অথবা অন্যকিছু?
অপ্রকৃতস্থর মতো জোরে করে হেসে উঠল জয়, “দুশমনী হো তো এইসি। তোমার-আমার এই ইকুয়েশন দুনিয়ার ইতিহাসে প্রথম না? যেখানে সব বুঝেশুনে….ʼʼ
-“বলতে পারেন। আর এটাও অনস্বীকার্য, অতি মাত্রায় ঝানু আপনি। অথচ এতসব অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা কুপথে ব্যায় করে ফেললেন। সেক্ষেত্রে এখানে আমিও জানি আপনি জানেন, আপনিও জানেন তা আমি জানি। সেটা আমরা দুজনই জানি, আমি আপনি সেটাও জানি।ʼʼ
-“কথাটা কার মতো জানি বললে।ʼʼ
-“কার মতো?ʼʼ
জয় চুপ থেকে বলল, বড়ঘরে ছিলে কতক্ষণ?
দরকার যতক্ষণ। আপনি শুয়ে থাকুন, বাইরে কাজ আছে।
জড়ানো কণ্ঠে জয় গান ধরল,
‘সোহাগের দিলাম বেড়া, ঘরের চারিপাশে
মায়ার লাগাইলাম আড়া নিন্দার বাতাসে গো,
নিন্দারও বাতাসে…..
সাধেরও পিরিতের ঘর, হয়না যেন নড়বড়,
তাই ধৈর্য্যের রাখলাম একটু ঢাল…
ও মন-ওরে..
সুখেতে রব চিরকাল, ও মনহ ওরে সুখেতে রব চিরকাল..ʼ
—
গতরাত একটার দিকে হামজা ও জয় বের হলো বাড়ি থেকে। রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ প্রায়। লোকজন না থাকলে বের হওয়াটা ভালো। নয়ত ঘিরে ধরে সবাই।
জয় চুপচাপ হাঁটছে, কথা বলছে না কোনো। হামজা পকেট থেকে ছোট্ট একটা হিপফ্ল্যাস্ক বের করে দুটো চুমুক দিলো। জয় বলল, “কী ব্যাপার, ভাউ? মাল খাচ্ছ কেন?ʼʼ
-“রোজ রোজ তোর হাতে মানুষ তুলে দিতে পারিনা।ʼʼ
-“আমি তোমার হাতে মানুষ তুলে দিতে পারি না। অভ্যাসের খেলাপ হবে। তুমি শুধু বাড়ির সামনে অবধি যাবে। ভেতরে যাব আমি।ʼʼ
-“তুই বাইরে থাকবি।ʼʼ
জয় ঘাড় নাড়ল, “উহু। খু-ন করার আগে যাদের মাল খেতে হয়, তাদের হাতে মানুষ তুলে দিতে পারিনা আমি। মানুষের রুহুর একটা ইজ্জত আছে, ও একটা মাতালের হাতে দেহ ছাড়বে কেন?ʼʼ
জয়ের কথায় হামজা হেসে ফেলে কোমড়ে একটা লাত্থি মারল। তাতে পা ফসকায় জয়ের। হামজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তুলল না জয়কে। বলল, “ওঠ। উঠে দাঁড়া।ʼʼ
এভাবেই গড়েছে হামজা জয়কে। পড়ে গেলে টেনে তোলেনি কখনও। ছেড়ে দিয়েছে। এরপর বলেছে, ‘নিজ শক্তিতে উঠে দাঁড়া তো, জয়। কাম-অন। গেট-আপ। বি স্ট্রং ইন ইওর অউন স্ট্রেন্থ! ইউ অনলি নিড ইওরসেল্ফ, ফাকিং নো ওয়ান ইলস! ইভেন ইনক্লুডেড মি।ʼ
জয় রক্তাক্ত হাঁটু নিয়ে জেদে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বারবার পড়ে যেত, তবু শেষ অবধিও হামজা হাত বাড়ায়নি কখনও। জয় যখন নিজে উঠে দাঁড়িয়েছে, তখন জাপটে ধরেছে জয়কে, তার আগে নয়।
আজও তাই করল। অথচ আজ আর চেষ্টা একবারের বেশি নয়, এক ঝারাতে সোজা উঠে দাঁড়ায় জয় মেরুদণ্ড সোজা করে।
পোলের লাইট কোথাও কোথাও নষ্ট। সেসব জায়গা অন্ধকার, ফাঁকা রাস্তা। কুকুরগুলো জোট পাকিয়েছে। জয়কে অন্ধকারে দেখেও চিনতে ভুল হয়না ওদের। পিছু নিলো। ঠিক যেন সৈন্যবাহিনী দুই ভাইয়ের পিছে পিছে নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে চলেছে।
হামজা জিজ্ঞেস করল, “মাজহারের বডিটা কোথায় ফেলেছিস?ʼʼ
-“পুরোনো গোরস্থানের ধারে পঁচা পুকুরের পানিতে।ʼʼ
হামজা শান্ত চোখে চাইল, “অর্থাৎ আমার শ্বশুরবাড়ির লোক এখনও জানেই না যে, মাজহার উপরে পৌঁছে গেছে?ʼʼ
হামজার মুঠোতে পেঁচানো গামছাটা নিয়ে জয় মুখে জড়াতে জড়াতে বলল, “আশা করা যায়, বডি পঁচে পানির সাথে মিশে যাবে, তবু খবর পাবেনা। বডিই পাবেনা, খবর কেমনে?ʼʼ
-“তাছাড়া ওর বাপ জানে, তরুকে মেরে ও পলাশের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়েছে। খোঁজও করছে না। কাউকে করতেও দিচ্ছে না।ʼʼ
-“খোঁজ করতে বলার আগে সেও নিখোঁজ হয়ে যাবে, ভাউ। তোমার একটু দুঃখিত হওয়া উচিত। হাজার হোক, চাচা শ্বশুর।ʼʼ
হামজা দুঃখিত গলায় বলল, “দুঃখিতই তো আমি, খুব দুঃখিত। নিজ হাতে খাতির করতে পারছি না। এর চেয়ে বড় বড় দুঃখ কী হতে পারে? হাজার হোক চাচাশ্বশুর। উনার ভাইয়ের মেয়ে আমার বউ। আমার হাতে উনার রক্ত লাগবে, এটা অধর্ম হয়ে যাবে। অধর্ম আমার স্বভাবে নেই।ʼʼ
-“আমারও।ʼʼ জয় কথাটা উচ্চারণ করতেই দুইভাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। উন্মাদের মতো হাস দুজন। গায়ে কাঁটা দেয়া সেই নির্জন রাস্তায় ওদের অপ্রকৃতস্থ হাসির ঝনঝনে আওয়াজ ভৌতিক লাগল শুনতে।
মাজহারদের বাড়ির প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে একদম রাস্তার সাথে। পাশেরটা হামজার শ্বশুরবাড়ি। ওরা দুইভাই বাড়ির পেছনে গেল। জয় লুঙ্গিতে কাছা মেরে প্রাচীর টপকালো। হামজা পেছনের আশপাশ দেখে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়াল। মাজহারদের বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। টের পেল না হামজা। দূরের পোল থেকে সামান্য আলো আসছে। সে ফাঁকা রাস্তায় পায়াচারী শুরু করল। চিন্তা হচ্ছে খুব জয়ের জন্য।
বাড়ির ভেতরে ঢোকার কোনো পথ খোলা নেই। জয় নিচে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে প্রতিটা জানালায় কয়েকটা করে ঢিল ছুঁড়ে মারল।
ঝন্টু সাহেব মাল খেয়ে মাতাল। তবু বকবক করতে করতে বেরিয়ে এলেন। জয় তখন বাড়ির পেছনের দিকের জানালায় ঢিল মারল। ঝন্টু সাহেব সেদিক গেলে জয় সামনের খোলা পথ দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সোফাতে বসল আরাম করে। দোতলার সিড়ি প্যাঁচানো এ বাড়ির।
ঝন্টু সাহেব বকতে বকতে ফিরে এলেন কাউকে না পেয়ে। জয়কে দেখতেই পা ফসকে পড়ে যাবার মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লেন। জয় হাসল, “আরেহ কাকা! আস্তে-ধীরে আসেন। এই বয়সে দৌড়ঝাপ খারাপ।ʼʼ
ঝন্টু ঢোক গিললেন, “জয়, তুমি এত রাত্তিরে? কী ব্যাপার, কী হইছে?ʼʼ
-“রাতে ঘুম হয়না, কাকা। রোডে রোডে ঘুরি, আজ ঘুরতে ঘুরতে আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আত্মীয় মানুষ আপনি, দেখা না করে গেলে রাগটাগ করবেন, মনে কষ্ট পাবেন। বসেন, দুটা দুক্কের কতা কই।ʼʼ
জয় আলো জ্বালায়নি। আধো অন্ধকার বসার ঘরটা। চোখদুটো লাল উনার। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মাথা টাল খাচ্ছে। তবু বসলেন। জয় সোফার ওপর থেকে ল্যাপটপ টেবিলে রেখে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “আনলক করেন, কাকা। মুভি-টুভি দেখি দুই চাচা-ভাতিজা বসে বসে। ভালো না আইডিয়াটা, কাকা?ʼʼ
ঝন্টু সাহেব বুঝতে পারছিলেন না কিছু, ভয়ে উনার দম পড়ছেনা ঠিকমতো। জয় একটা পেনডাইভ কানেক্ট করল ল্যাপটপে। এরপর একটা সুন্দর পজিশনে ল্যাপটপটা রেখে খুব আয়েশ করে বসল জয়। তার চোখে-মুখে যেন খুশি উপচে পড়ছে, ঠিক যেমন ছোট শিশুরা নতুন খেলনা পেলে উচ্ছ্বসিত হয়, তেমন!
ভিক্টিমের চোখে তীব্র ভয় না দেখলে জয় মারার জোশটা পায়না। ঝন্টু সাহেবের ঘেমে যাওয়া ছটফটে চেহারাটা দেখে যা শান্তি লাগছিল জয়ের, সেটুকু চোখ বুজে প্রসন্ন হেসে শোষন করল নিজের মাঝে সে। স্ক্রিনে ভিডিও চালু হয়ে গেছে—
মাটির ওপর একটা ইটের খণ্ড পড়ে ছিল। জয় সেটাকে তাকে রেখে মাজহারের মুখটা থুবরে ফেলল সেটার ওপর, যেমন বাস্কেটে বল ঢোকায় প্লেয়াররা। মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো মাজহারের। নির্জন একটা জঙলি জায়গা। দিনেও বোধহয় লোক যায়না। মাজহার রক্তাক্ত মুখ নিয়ে জয়ের দুটো পা আঁকড়ে ধরল, “মারিস না, আমায়। আমি কিছু করি নাই। পলাশ করছে যা করছে। আমি কিচ্ছু করি নাই।ʼʼ দরদর করে রক্ত পড়ছে মুখ দিয়ে।
জয় আরাম করে বসল সামনে মাজহারের। মুচকি হেসে নরম করে বলল, “ধুর! করলেই বা কী? দোষের তো কিছু না। ওভাবে বলছিস কেন, পাগল? স্বাভাবিক হ।ʼʼ
মাজহার বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল। জয় কাধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল,, “পলাশ কোথায় রে?ʼʼ
-“আমি জানিনা, জয়। বিশ্বাস কর।ʼʼ
-“করলাম। তবু আবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করতেছে, করি? পলাশ কোথায় রে, মাজহার?ʼʼ
শান্ত-শীতল মহান নমনীয়তা জয়ের মুখে। একটুও রাগ নেই ওখানে, আর না উগ্রতা, মুচকি হাসছে ঠোঁটদুটো, চোখে কী যেন! মাজহারের মনে হচ্ছিল, জয়ের সামনে পছন্দের খাবার রাখা হয়েছে, সেটা খাওয়ার আগে মানুষ যেমন খুশি খুশি থাকে, জয়ের মুখভঙ্গিটা ওরকম। বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল, বলল, “তাহলে ছেড়ে দিবি আমায়?ʼʼ
-“হ্যাঁ, ওর খোঁজ দেয়ামাত্র মুক্ত করে দেব।ʼʼ
মাজহার পলাশের সম্ভাব্য ঠিকানাটা বলল কোনোমতো।
ভিডিওর এ পর্যায়ে জয় হাততালি দিয়ে উঠল, “চমৎকার ভিডিওগ্রাফি না কাকা? কবিরের করা। ছেলেটা এত ভালো ক্যামেরাম্যান? ওর এক বোতল ব্রান্ডি পাওনা রইল আমার কাছে। আপনার ভালো লাগছে কাকা ভিডিওটা? হে হে! বাচ্চাদের মতো পা দুলিয়ে হাতে তালি দিলো জয়।ʼʼ
ঝন্টু সাহেব কখন জানি সোফা থেকে গড়িয়ে বসে জয়ের পা দুটো চেপে ধরবে। জয় তাড়া দিলো, “ধ্যাৎ, মনোযোগ দেন কাকা ভিডিওতে। আপনার জন্য আবার পেছাতে হবে ভিডিও।ʼʼ
ঝন্টু সাহেব তাকাতে চাচ্ছিলেন না। ছেলেকে এক জ্যান্ত রক্তখেঁকো পিশাচের সামনে দেখতে বাবাদের ভালো লাগে না। জয় উঠে দাঁড়িয়ে জোর করে উনার কপালের দুপাশে ধরে ভিডিওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। চোখ যাতে বুজতে না পারে, তাই দুই চোখের পাতা টেনে আঙুল চেপে ধরে রাখল।
কবির ক্যামেরা কোথাও রেখে মাজহারকে টান করে শুইয়ে পা দুটো চেপে ধরে আছে। জয় মাজহারের দু’হাতের ওপর দুই পা প্রসারিত করে চেপে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার একহাত ছেড়ে বসল। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সবটা মুখে গোজার সমি গালটা বোধহয় ফেঁড়ে গেল মাজহারের। এরপর খ্যাঁচ করে একটা শব্দ। বামহাতটা বাহু থেকে আলাদা হয়ে গেল। অথচ কোনো আওয়াজ হলো না। বামহাতটা কাটার পর কয়েকটা শিরা-উপশিরার সাথে ঝুলছিল, জয় পা দিয়ে চেপে ধরে হ্যাঁচকা একটা টান মারল। ছিঁড়ে এলো হাতটা।
বাঁধের ফুটো দিয়ে ছুটে আসা পানির মতো রক্তগুলো জয়ের সাদা লুঙ্গি ভেজাচ্ছিল।
মাজহারের চোখে যেন রক্ত উঠে গেছে। মৃত্যুসম যন্ত্রণা, অথচ চিৎকার করার উপায় নেই। জয় সামান্য হাসল, “ক্ষমা করিস, মাজহার। তরুকে কথা দিয়েছি তো। নয়ত তোর সাথে আমার কোনও শত্রুতা নেই রে। তোকে কথা দিয়েছি মুক্ত করে দেব, কথা রাখছি। ʼʼ
একটা কাঁচের শিশির মুখ খুলতে খুলতে আপনমনেই বিরবির করল, “জীবনে মেলা পাপ করছি, কিন্তু রেইপ করিনাই। করাটা বিষয়টা, কিন্তু আমার প্যানিক আছে, তাই এই পাপটা আমার হাত থেকে বেঁচে গেছে। মামাকে মুরসালীন আর আমার ঘরের শালী মিলে মেরেছে, আমি কিছুই মনে করিনি। কিছু বলিওনি এর বদলে ওদের। বলব কেন? মামা তো আসলেই কাজটা ভালো করেছিল না! খারাপ কাজ একটা, তাইনা বল?ʼʼ
মাজহারকে উলঙ্গ করে সবটুকু তরল ওর পুরুসাঙ্গের ওপর একটু একটু করে রয়েসয়ে ঢালল। আগুনের ছোঁয়ায় পলিথিন যেমন ঝলসে-গলে টপটপ করে পড়ে, ঠিক তেমন মাজহারের বিশেষ মাংসপিণ্ডটুকু গলে গলে পড়ে গেল। আন্দাজ করা যায় তরলটুকু গাঢ় কোনো এসিড অথবা সেরকমই কোনো কেমিক্যালই হবে।
এবং এরপর জয় খুব যত্নে দুই পা কাটল মাজহারের, খুব দক্ষ কসাইয়ের মতো। কবীরের বমি পেয়ে যাচ্ছিল। পেটে পাক গুলিয়ে আসছিল। কেমন মাথা ঝিমঝিমে অবস্থা।সে কখনও মর্গে মৃতদেহ কাটাও দেখেনি, আজ জীবিতদেহের ব্যবচ্ছেদ দেখতে হলো জয়ের বদৌলতে। মাজহারের দেহটা ততক্ষণে হয়ে এসেছে। রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে।
মাথাটা কেটে নিয়ে দেহটা একটু দূরে পুকুরে ফেলে এসে করে বস্তায় ভরে নিলো জয়। আফশোসে মুখ ছোট হয়ে এসেছিল জয়ের। শুধু মনে হচ্ছিল, মাজহার বোধহয় সুখে মরে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি যেন। রাগ হচ্ছিল এখন জয়ের।
তবু আর কী করার? মানুষের জীবন একটাই? আর তো সম্ভব না মাজহারকে আবার তুলে মারা! যথাসম্ভব প্রমাণ লুকিয়ে মূল গোরস্থানের দিকে চলল।
ভিডিও শেষ।
ঝন্টু সাহেবকে দাঁত চেপে সবটুকু দেখতে হয়েছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে উনার। জয় পেনডাইভ খুলে পকেটে রেখে সুন্দর হাসল, “ভালো লেগেছে তো কাকা? স্পেশালি আপনার জন্য এত পরিশ্রম করে ভিডিওটা বানিয়েছি।ʼʼ
ঝন্টুকে সাহেবকে মারতে খুব একটা খাটুনি করল না জয়। কেউ নেমে আসল না এতক্ষণেও। বাসায় লোক থাকেনা। মাজহারের মা শ্বাসকষ্টের রোগী। ইনহেলার টেনে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েন। আর কেউ নেই বাসায়।
জয় সোফার কুশন দিয়ে মুখটা চেপে ধরে ব্লেড দিয়ে আস্তে আস্তে গলাটা কাটলো। এভাবেই তরুর গলা কাটা হয়েছিল। জয়ের ধারণা কাজটা তরুর বেহুশির সময়ে করা। খুব নিখুঁত সরলরেখায় কাটা হয়েছিল। একটুও এদিক-ওদিক হয়েছিল না। জয় চেষ্টা করল পলাশকে ফলো করতে। কিন্তু হলো না, ঝন্টু সাহেব খুব ছটফট করছিলেন। একেবেঁকে গেল। কোথাও কোথাও হাতের অনিয়ন্ত্রণে ব্লেড বেশি গেঁথে গিয়ে ভেতরের শ্বাসনালি অবধি কেটে ফেলল।
জয় বেরিয়ে এলো আস্তে করে। তখনও গলা কাটা মুরগীর মতো হাত পা আছড়াচ্ছেন ঝন্টু সাহেব। রুহু বের হতে একটু সময় লাগবে। দেহের র-ক্ত সবটুকু বের হওয়া অবধি ছটফট করবেন তিনি মৃ-ত্যুযন্ত্রণায়। জয়ের খুব ইচ্ছে করছিল দাঁড়িয়ে থেকে তৃপ্তিদায়ক দৃশ্যটা দেখার। কিন্তু ঝুঁকি নেয়া যাবেনা। বাড়ির পেছনের প্রাচীর টপকে বেরিয়ে এলো। লুঙ্গিতে চিরচিরে রক্তের ছিটা এসে লেগেছে। লুঙ্গিতে ফের কাছা মেরে গলার গামছাটা দিয়ে লুঙ্গির মতো বাঁধল কোমড়ে। সাবধানতার মার নেই।
—
পলাশ জেলাতেই আছে। ওকে কোনোভাবেই পুলিশের হাতে পড়তে দেয়া যাবেনা। পুলিশের কাছে অর্ডার আছে পলাশকে পাওয়ামাত্র ক্রসফায়ারে দেবার। তা হতে দেয়া যায়না। জ্বর একটু কমলেই পলাশকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে বেরিয়ে যেতে হবে।
রাত দেড়টার দিকে অন্তূ ঘরে এলো। জয় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফিরে তাকাল না খাটের হেড-বোর্ডের ওপর রাখা মদের বোতলে নখ বাজাতে বাজাতে ষষ্ঠ সিগারেটটায় টান দিলো। দরজা আটকানোর শব্দেও ফিরে তাকাল না।
অন্তূ আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসল জয়ের পাশে। কিছুক্ষণ চুপচাপ উগ্র-উদাস পুরুষটিকে পরখ করে অদ্ভুত স্বরে বলল, “মায়ার মানুষ ফাঁকি দিয়ে খুব ভেতর পোড়ে, জয় আমির?ʼʼ
জয় তাকাল, লাল হয়ে থাকা চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি সে। চিৎ হয়ে পাশ ফিরল। অন্তূ বলল, “আমার বাপটাও তরুর মতো ফাঁকিবাজ ছিল, জানেন? সব আগুন নিজেরা শুষে আমাদের শীতলতা দিতেই জীবনে আসে এইসব ফাঁকিবাজেরা। আব্বু আমায় কতদিন অন্তূ বলে ডাকেনা!ʼʼ
অন্তূ একদৃষ্টে জয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল। জয় উঠে হেড-বোর্ডে বালিশ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইল। অন্তূ বলল, “অথচ তার অর্ধেক জীবন তার নিজের ছেলে নিয়েছে, বাকিটা আমি পূর্ণ করে দিয়েছি।ʼʼ
জয় হাসল, “নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার, ঘরওয়ালি। তুমি আমার নাম নিতে ভুলে গেছ। ভাগে আমিও আছি।ʼʼ
স্লান হাসল অন্তূ, “ওহ, তাই নাকি?ʼʼ
-“জি জি, ম্যাডাম!ʼʼ
-“আপনি কবে থেকে পাপ স্বীকার করতে শুরু করলেন?ʼʼ
-“চিরকালই করি।ʼʼ লম্বা টান দিলো। ধোঁয়ায় ভরে উঠল নাকমুখ।
-“সে তো ভাব হিসেবে। তাতে একফোঁটাও আফশোস থাকেনা, থাকে ভনিতা।ʼʼ
জয় হাসল, “যথার্থই বলেছেন, উকিল ম্যাডাম।ʼʼ
অন্তূর গলাটা অদ্ভুত দৃঢ় হলো, চোখে চোখ মিলিয়ে কেমন করে যেন বলল, “ফিরে আসুন।ʼʼ
-“ঠাঁই নেই।ʼʼ
-“ঠাঁই দরকার আপনার?ʼʼ
-“হু, দরকার ছিল।ʼʼ
-“ঠাঁই থাকলে খারাপ হতেন না?ʼʼ
-“আমি বলেছি তোমায়, আমার খারাপ হবার কোনো কারণ নেই। আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ।ʼʼ
-“তাহলে ঠাঁইয়ের কথা বললেন কেন?ʼʼ
জয় দুষ্টু-রসিক হাসল, তবু তা স্লান, “আচ্ছা, ঠাঁই? তুমি হয়ে যাও?ʼʼ
অন্তূ বিদ্রুপের হাসি হাসল, “আমি? আমি নিজেই তো এক নড়বড়ে এক খুঁটি। আপনাকে সামলাতে গিয়ে বড়জোর উপড়ে যাব, আর তারপর আপনাকে নিয়ে পড়ব।ʼʼ
-“তুমি আমার ওপর, আর আমি তোমার ওপর ভর করলে তো দুজনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। কী বলো?ʼʼ চোখ মারল জয়।
অন্তূ সামান্য চোখ বুজে দৃঢ়চিত্তে মাথা নাড়ে, “পারিনা।ʼʼ
জয় অন্তূর দিকে তাকিয়ে থেকেই বোতলটা তুলে নিলো। অন্তূ তা কেড়ে নিলো, “খবরদার। আজ নয়।ʼʼ
-“একটু গিলতে দাও।ʼʼ
-“আজ অন্তত নয়। আমি কথা বলছি।ʼʼ
-“সেজন্যই একটু দাও। অল্প খাব।ʼʼ
-“সেজন্য?ʼʼ
-“হু। তুমি আর আমার সাথে কথা বলো না সচরাচর। মানে আমার অভ্যাস নেই। আজ বলছো, অস্বাভাবিক লাগছে। একটু খেতে দাও আজ।ʼʼ
অন্তূ বোতলটা ঝেরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। কাঁচের বোতলটা আওয়াজ তুলে ঝনঝন করে ভেঙে খানখান হয়ে যায়। জয় চোখ বুজে তা অনুভব করে, তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে, “উফফ! শালা কাঁচ ভাঙার আওয়াজ এত সুন্দর হয় কেন? এত্ত ভাল্লাগে! ফাকিং লাভ দিস!ʼʼ
অন্তূ তাচ্ছিল্য করে হাসে, “হৃদয় ভাঙার আওয়াজ এর চেয়েও ভালো লাগে আপনার। আর জানেন অধিকাংশ সময় হৃদয়কে কাঁচের সাথে তুলনা করা হয়।ʼʼ
জয় কথা বলল না। মাঝেমধ্যেই কেমন ভদ্রলোকের মতো আচরণ করে। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা, মিষ্টি হাসা, নরম আচরণ!
অন্তূ যেন আনমনা স্বরে বলল, “আমি তো একসময় বেশ আদর্শবতী ছিলাম…ʼʼ
জয় আড়চোখে চোখ তুলল, “হু, ছিলে।ʼʼ
-“ছিলাম নাকি?ʼʼ
-“ছিলে তো।ʼʼ
“ওহ, হ্যাঁ ছিলাম বোধহয়। সেসব সেই কবেকার কথা। ভুলেই গেছি!ʼʼ অদ্ভুত হাসল অন্তূ, “মাঝেমধ্যে মনেহয় কী জানেন? যদি আমাদের বিয়েটা হুটহাট, তামাশাবিহীন হয়ে যেত, মানে অন্য কোনোভাবে হয়ে যেতও, আপনি যেমনই ছিলেন, ছিলেন। আমি হয়ত মাফ করে দিতাম। তারপর নিজের আদর্শ দিয়ে আপনাকে হয়ত ভালো জয় আমির করে তুলতাম। খুব সিনেমাটিক চিন্তা তাই না?ʼʼ
হেসে মাথা নাড়ল জয়, “খুব সিনেমাটিক।ʼʼ
অন্তূ পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। জয় বলল, “এরপর?ʼʼ
অন্তূ হেসে মাথায় নামায়, “অথচ আমি আপনাকে ক্ষমা তো দূর, শাস্তি না দিয়ে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আসশোস! ইশ, যদি ওমন না হতো..ʼʼ
জয় দুধারে মাথা নাড়ে, “পারতে না, ঘরওয়ালি?ʼʼ
-“পারতাম না?ʼʼ
“পারতে না।ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। জয় কিছু বলবে। এই লোক নিজের ব্যাপারে একটা কথা বলতে যা ফুটেজ খায়! অনেকটা সময় দিতে হয়, চুপচাপ তা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তবে সামান্য বলে। আর মাঝখানে একটা শব্দ উচ্চারণ করলে চোখের পলকে প্রসঙ্গ বদলানোয় যা চমকপ্রদ দক্ষতা!
জয় সিগারেট শেষ করল, একটু সোজা হয়ে বসল। এরপর বলল, “কুমোর কারা বলো তো?ʼʼ
-“যারা মাটির জিনিসপত্র বানায়।ʼʼ
-“ব্রিলিয়ান্ট। ওরা একদল ভালো কারিগর। জানো ওরা মাটির জিনিসপত্র কীভাবে বানায়?ʼʼ
অন্তূ চুপ রইল। জয় বলল, “প্রথমে কাঁচা মাটি মাখানো হয়। কাঁচা, নরম মাটি কিন্তু। এরপর হাতের কারিগরিতে যেমন ইচ্ছা আকৃতি দেয়া হয়। হতে পারে সেটা ফুলদানী, থালা-বাটি অথবা রেনডম কিছু। এরপর শুকানো হয় সেগুলোকে। এখানেই শেষ হলে ঠিক ছিল।ʼʼ
কেমন করে হাসল জয়, “মাগার এখানেই শেষ না। তারপর সেই শুকনো জিনিসগুলোকে আগুনে ফেলে দেয়া হয়। কাঁচা মাটির তৈরি ওই জিনিসগুলো আগুনে পুড়তে পুড়তে পুড়তে পুড়তে একসময় লাল টকটকা, কঠিন মাটির পাত্র হিসেবে তৈরি হয়। তখন তুমি বড়জোর ওগুলোকে আছড়ে ভেঙে ফেলতে পারবে। ওতে আর হাজার পানি ঢাললেও তা আগের সেই কাঁচা নরম মাটিতে পরিণত হবে না, ঘরওয়ালি। যাকে তুমি আবার হাতে মাখিয়ে নতুন আকৃতি দিয়ে নতুন জিনিস বানাতে পারো।ʼʼ
অন্তূ ভ্রুটা সন্তর্পণে কুঁচকে ফেলল। জয় হাসল, “আমি যখন কাঁচামাটি ছিলাম, বালক জয় আমির, নরম, ভীতু এক ছোট্ট ছেলে। তখন আমাকে গড়া হয়েছে এই জয় আমিরের আকৃতিতে। এরপর আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি বছরের পর বছর পুড়েছি। এরপর এই শক্ত, কঠিন লাল মাটির জয় আমির তৈরি হয়েছে। তাকে তুমি বড়জোর আঘাত করে ভেঙে টুকরো থেকে আরও ছোট টুকরোতে পরিণত করতে পারবে। কিন্তু হাজার তোমার আদর্শের পানি আমার ওপর পড়লেও আমি আর সেই আগের কাঁচা জয় আমিরে কনভার্ট হবোনা, যাকে তুমি ইচ্ছেমতো শেইপ দিয়ে সাজাতে পারো।ʼʼ
অন্তূ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুকের ওঠানামা দ্রুত হচ্ছিল। জয়ের ঠোঁটে সামান্য হাসি। সে সিগারেট ধরালো আরাম করে। খোলা প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ঠোঁটে গুঁজে লাইটার জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। এরপর চট করে অন্তূর কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। গাটা তখনও গরম ভীষণ।
চলবে…
[রিচেইক করিনি। অসংখ্য টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]