#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৫৮.
পলাশের দলের সকলেই ছন্নছাড়া। যে যেমন পেরেছে আত্মগোপন করেছে, দেশে অথবা বাইরে। এমনটা একবার হয়েছিল যুগখানেক আগে।
২০০২-এ বিরোধী দলীয় নেত্রীর নেতৃত্বে গোটা দেশজুড়ে একটি সন্ত্রাস ও অপরাধীমুক্ত অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল–যা’অপারেশন ক্লিনহার্টʼ নামে পরিচিত। কয়েক মাসের এই দেশব্যাপী অভিযানে গোটা দেশের সন্ত্রাস ও অপরাধীরা সিংহভাগ আঁটকা পড়েছিল বিভিন্ন সংস্থার আইরক্ষাকারীদের থাবায়। তখন দেশটা হয়ে গেল শান্ত। সকল সন্ত্রাসদের হয় দেশ ছাড়তে হলো, অথবা দল-ধ্বংস। তখনই একবার হামলা হয়েছিল রাজন আজগরের কারবারে। কিন্তু তখন তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পলাশ তখন বেশ ছোট।
কিন্তু এবার গোটা পরিস্থিতি অনুকূলে, আইনসংস্থা থেকে শুরু করে দালাল, নেতাগণ..তবু এক জয় আর নিজের ঘরে পালা এক মীরজাফর পলাশকে ধ্বংস করে ছেড়েছে।
রিমি কাপড় আয়রন করছে ঘরে। রাত এগারোটা। হামজা সোফায় বসে ছিল। চোখদুটো বোজা। বহুকাল রাতে ঘুমানো হয়নি। এটা অবশ্য অল্প ভুল। রিমিকে জড়িয়ে নিলে মেয়েটা যখন নিশ্চিন্তে ওর বুকে মাথা লুকাতো ছোট্ট কবুতর ছানার মতো, তখন দুনিয়াদারীর ঝঞ্ঝাট আপাত একরাত ভুলে সে ঘুমিয়েছে বারবার। তবে সেসব অনেকদিন আগের কথা। বহুদিন মেয়েটা তার কাছে তো আসে, কিন্তু সেই কাছে আসাতেই যেন যত দূরত্ব! তাতে সংশয়, ঘৃণা অথবা দ্বিধার সমন্বয় ছাড়া কিছু নেই। ভেতরটা প্রশ্ন করে ওঠে, “হামজা তুই কি ভুল করিসনি?ʼʼ
-“করলেও ভুলটা কী?ʼʼ
-“শত্রুকে ঘরে তোলা।ʼʼ
-“ওইটুকু একটা পুঁচকে, নিঃসঙ্গ মেয়ে আমার শত্রু?ʼʼ
-“এটাও নতুন বোকামি তোর। যার মনে তোদের জন্য সেই শুরু থেকে বে-হিসেবী ঘৃণা, সে কমজোর হোক, তবু মনে রাখতে হবে, সে তোর বিরুদ্ধে যেকোনো কিছু করতে পারে। আর অন্তত এ কারণে হলেও শত্রুকে ছোট করে দেখতে নেই। জেনেবুঝে কেন?ʼʼ
-“আমার রেপুটেশন বজায় রেখে সবটা বদনাম আরমিণের ওপর বয়ে নিয়ে যেতে আমার ওকে জয়ের বউ হিসেবে মেনে নেয়ার বিকল্প ছিল না। আমি যখন জয়ের বউ হিসেবে ওকে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি, তখন মানুষ আমার ওপর সন্তুষ্টিতে গোটা পাপটাই আরমিণকে নিবেদন করেছে। এটা ট্রিক্স অর পলিটিক্স, হোয়াটএভার! তাছাড়া ও এখন যা করছে, তার সবটাই আমার নাগালের ভেতর, এ বাড়ির বাইরে থাকলে আরও অনেক কিছুই করতে পারতো। চরম জেদি আর চতুর মেয়েলোক। ওর প্রতিটা বোকামির মতো দেখতে কর্মও ওর পরিকল্পিত।ʼʼ
-“তাহলে ওকে সরিয়ে দে। ওর এত ক্ষতি করেও তো দমেনি, ওকে-ই সরাতে হবে। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে কী লিখেছিলেন জানিস?—মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।ʼʼ
হামজা একটু সপ্রতিভ হলো, উত্তেজিত হলো, ক্ষেপে উঠল, আবার নিভে গেল। সে শান্ত মানুষ। আস্তে করে শুধু বলল, “জয় মানবে না।ʼʼ
-“তুই জয়ের পরোয়া করিস?ʼʼ
হামজা নিজের দুহাতের তালু মেলে দেখে, এরপর মৃদু হাসে, “এ দুহাতে গড়েছি জয়কে। এই হাতে ওর ঘাম মুছে দেয়ার শক্তি থাকলেও ওকে মিটিয়ে দেবার শক্তি কি আছে?ʼʼ
-“থাকতে হবে। দরকার পড়লে ওর শেষ নিশানটুকুও মিটিয়ে দেবার শক্তি চাই হাতে। পেতে হলে দিতে হয়। ক্ষমতায়নের পথে ও হোক তোর প্রথম বিসর্জন।ʼʼ
হাঁপিয়ে ওঠে হামজা নিজের সাথেকার এই ভয়ানক আলোচনায়। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে জয়কে ডাকে, -“জয়, ও জয়!ʼʼ
জয় বেরিয়ে এলো রুম থেকে। হামজা জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্থিরতা অনুভব করে। লোকে বলে জয়ের ওই শক্ত কাঠামোর মুখটা নিষ্ঠুর, হামজা তাতে শুধুই মায়া দেখেছে।
জয় খেঁকিয়ে উঠল, “কী সমস্যা? ঘরে বউ নাই, আমায় ডাকাডাকির কী আছে?ʼʼ
গম্ভীর হয় হামজা, “বস।ʼʼ
জয় বসল না, চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল হামজার কোলে। হামজা কাধ এলিয়ে সোফায় বসে, চোখ বুজে প্রশ্ন করে, “আমার যদি তোকে কোনোদিন বলি দিতে হয়?ʼʼ
হো হো করে হেসে উঠল জয়, “কোন দেবীর নামে?ʼʼ
-“কোন দেবীর নামে বলি হতে পছন্দ করবি তুই?ʼʼ
জয় জবাব না দিয়ে উঠে নিচের দিকে ঝুঁকে বসে হামজার পাশে, “পেরেশান কোনোকিছু নিয়ে?ʼʼ
হামজা তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ জয়ের দিকে, তারপর সামান্য হাসল। জয় গান ধরল, “জীবন মানেই তো যন্ত্রণা, বেঁচে থাকতে বোধহয় শেষ হবেনা।ʼʼ সুর থামিয়ে বলল, “অতএব বেঁচে থাকা ইজ ইক্যুয়েল টু বোকাচুদামি। যার নেশা আমার নাই। কবে দিচ্ছ বলি?ʼʼ
হামজা চুপচাপ বসে থাকে। তার আর জয়ের মাঝে কোনো দেয়াল নেই, যা সব সরাসরি। তাদের সম্পর্কের ঐতিহ্য একটাই—সেখানে কোনো লুকোচুরি নেই। সামনে কঠিন দিন। খুব কঠিন। হামজা জয়কে বলে, “তুই এখন বের হবি তো?ʼʼ
জয় তখন একটা টেনিস বলে রেড-টেপ জড়াচ্ছে। হামজা উঠে গিয়ে জয়ের দুটো ওষুধ ও পানি আনল। গম্ভীর হয়ে বলল, “এদুটো খেয়ে নে। আমি রুমে যাব।ʼʼ
-“যাও আমি খাচ্ছি।ʼʼ
মাড়ি চাপে হামজা, “কানসারার পর মারব একটা, শুয়োর। আমার সামনে খাবি, শরীর এখনও একটু গরম। গলা বসে আছে। ধর, নে।ʼʼ
বাড়িটা গা ছমছমে। একসময় বেশ লোকজনে ভর্তি ছিল। আজ নেই। তারা কেউ চলে-টলে যায়নি, এক একে করে পরপারে পৌঁছে গেছে! কী ভয়ানক! তুলির জীবনের কী ব্যবস্থা হবে, কে জানে! হামজা এখন অন্য তালে বেসামাল।
জয় ঘরে যায়। অন্তূ ডান-কাত হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ডাকে অন্তূকে। অন্তূ একডাকে উঠে বসে, জয় বলে, “চলো। ঘুরে আসি।ʼʼ
-“কোথায়?ʼʼ
-“শহর ঘুরে আসি। মধুচাঁদে তো গেলাম না, আজ চলো যাই।ʼʼ
অন্তূ বোঝে, জয় অকারণে ঘুরতে যাচ্ছে না। বের হবার আগে জয় একটা চুড়ির বাক্স রাখল ড্রেসিং টেবিলের ওপর, “এ দুটো হাতে লাগাও।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
জয় শুধু ঠান্ডা চোখে তাকাল একবার।কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। অন্তূ মুচকি হাসল গোপনে। ভয় ও গোলামি দুটোই আপেক্ষিক। ভয় পেলে মানুষ ভয় দেখাবে, গোলামি করলে কেউ কারও মালিক হতে পারবে। ভয় না পেলে লোকে ক্লান্ত হয়ে আর চেষ্টা করবে না, গোলামি না খেটে যদি কেউ জান দেয়া কবুল করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার জান নেয়া হয়না, গোলামি খাটানোরও প্রবনতা কমে আসে সেক্ষেত্রে। এই খেলায় অন্তূ জিতে গেছে এতদিনের প্রচেষ্টায়। জয় ও হামজা দুজনের বদ্ধ ধারণা জন্মেছে, অন্তূকে জোর করে থামানো অথবা রাজী করানো যায়না।
জয়ের এই বাপ্পারাজ টাইপ ভাব দেখে অন্তূর মুখ বিকৃত হয়ে এলো। চোখ উল্টে মাথা ঝাঁকাল। জয়ের ভালো ভাব দেখলে, অন্তূর শুধু একটাই কথা মাথায় আসে, ‘পেছন মেরে বালুর সেঁক!ʼ
চুড়িগুলো চোখ ধাঁধানো সুন্দর। চিকন স্বর্ণের দুটো চুড়ি। অন্তূর ফর্সা হাতে চোখ কাঁড়ছিল। জয় গম্ভীর মুখে দেখল তা।
বাথরুমের ফেইক-রুফ থেকে একটা সাদা ধবধবে কাপড়ে মোড়া কিছু একটা বের করল জয়। তাতে একটা হাতে ব্যবহারের মতো ছোট চকচকে কুড়াল।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “এটা কী কাজে ব্যবহার করেন?ʼʼ
-“করিনি এর আগে।ʼʼ
-“তাহলে রেখেছেন কেন?ʼʼ
-“আমানত। আমানত না ঠিক, হাত বদল হয়ে আমার কাছে চলে এসেছিল মালটা।ʼʼ
-“কার?ʼʼ
-“কারও হবে।ʼʼ
অন্তূর কৌতূহল হয়, “কে সে? দায়সারা জবাব দেবেন না আমার প্রশ্নের।ʼʼ
জয় লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরতে পরতে জবাব দেয়, “এক নারী।ʼʼ অস্পষ্ট শুনতে লাগে। কারণ শার্টের প্রান্ত তখন দাঁত দিয়ে চেপে ধরে ছিল।
অন্তূ অবাক হয়। জয় কখনও কোনো মেয়েকে এমন সম্মান দিয়েছে, তা অন্তূর জানা নেই। সে জিজ্ঞেস করে, “নারীটা কে?ʼʼ অন্তূ ভ্রু কুঁচকে মিষ্টি, “এই, আপনার আগেকার প্রেমিকা-টেমিকা হবে নাকি?ʼʼ
জয় হাসল, “তার মধ্যে সেইসব সিস্টেমই নেই। তার সাথে যে-সময় দেখা হয়েছিল, তখন আমার ভেতরেও প্রেম-পিরিতির সিস্টেম ছিল না।ʼʼ
অন্তূ ভ্রু নাচিয়েঠোঁট উল্টায়, “তবু বিশেষ কেউ-ই হবে। নয়ত আপনার মতো লোক কাউকে এতখানি সম্মান তো দিতে পারেনা!ʼʼ
-“তোমাকে দেইনি?ʼʼ
অন্তূ শব্দ করে হেসে উঠল, তাতে অজস্র বিদ্রুপ ঝরে পড়ল, “তা দেননি আবার! দিয়েছেন তো।ʼʼ
জয়ের মুখটা চেক চেক প্রিন্টের লাল-সাদা গামছায় বাঁধা। জয় গাড়ি নিলো ক্লাবের ওখান থেকে। অন্তূ দেখল, সেই দুর্গের মতো ক্লাবঘর পুড়ে ধ্বংসপ্রায় হয়ে গেছে। কবীর সাথে যেতে চায়, “ভাই, আমি যাই আপনার সাথে?ʼʼ
-“তোর শ্বশুরের বিয়ে খাইতে যাচ্ছি, শালা? সাথে গিয়ে মুরগীর রানে কামড় বসাবা?ʼʼ
-“ভাই, আমি ড্রাইভ করবো। আপনে আর ভাবী বসে থাকবেন। আপনার তো শরীল খারাপ….ʼʼ
-“ন্যাকামি করিস না, বাপ। বাসায় যায়ে দুই প্যাগ মাল খেয়ে শুয়ে পড়, যা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!ʼʼ
কবীর তবু পেছন ডাকে, “ভাই, আপনে ভাবীরে নিয়া একা একা যাবেন…ʼʼ
-“পরেরবার তোর বউটারে দিস সাথে। আজ নিজেরটা নিয়ে ঘুরে আসি। গুড নাইট।ʼʼ
গাড়ি চলছে। যেন ঘোড়া ছুটেছে। অন্তূর পরাণ যায় যায়। মনে হচ্ছিল রকেট ছুটেছে। অন্তূর চুলগুলো পতাকার মতো উড়ছিল, অন্তূ চিৎকার করল, “এত জোরে কোনো মানুষ গাড়ি চালায়? আমি নিশ্চিত, এই গুণের জন্যও মাঝেমধ্যে আপনার শরীরের ফাল্লা উড়ে যায়। আস্তে চালান বলছি, অথবা এক্ষুনি এই মাঝ রাস্তায় নেমে যাব। পাগল লোক।ʼʼ
জয় গা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। গাড়ির বেগ আরও বাড়াল, অন্তূ বিতৃষ্ণায় আর কথা বলল না। জয় গাড়ির বেগের সাথে মিলিয়ে গান ধরল, ‘ওই ঝলমলে রোদ আকাশে, তুমি-আমি উড়ি বাতাসে….ʼʼ
অন্তূ কপালে হাত চেপে বসে রইল। অন্ধকার আকাশ, যেখানে চাঁদ অবধি নেই। এইরকম এক মাঝরাতে এমন ঝলমলে সূর্যের গান কেউ ভাবতে পারে? তাও আবার কী এক উদ্ভট গান! গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে আর শিষ দিচ্ছে। খানিক পর স্পীড কমল। অন্তূ একটা কথাও বলল না। ও কমাতে বলেছিল বলে আরও বাড়িয়েছিল স্পীড।
এবার স্পীড স্বাভাবিক রেখে গলা ছাড়ল জয়,
এই ভাঙাচোরা বুক নিয়ে, অবাধ্য অসুখ নিয়ে
স্বপ্নে রাখা মুখ চলেছে খুঁজে…..
কুয়াশা-ধোঁয়াশা ভরা রাস্তাতে,
নেমেছে বাজপাখি খালিহাতে….
কানামাছি খেলে যায়, কার সাথে মুখ বুজে
দুই পৃথিবী…. কীসের চাহিদায় ঘরছাড়া…
দুই পৃথিবী-ইইই..কোন চাওয়া-পাওয়ায় দিশেহারা…
গা শিউরে ওঠা জয়ের গলার সেই টান। শনশনে বাতাসের সাথে দিগ্বিদিক বাজিয়ে ছুটে চলল। গাড়ি চলছে। গরমের রাতে চলন্ত শীতল বাতাস বেশ লাগছিল গায়ে। অন্তূ চারপাশের ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চায়। পাশে বসে আছে স্বয়ং এক প্রেহেলিকা-পাপ। অনবরত শিষ দিচ্ছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। কখনও কখনও স্টিয়ারিংয়ে আঙুল বাজিয়ে গুণগুণ করছে।
একসময় একদম নির্জন গ্রামের দিকে চলে এলো। অন্ধকার রাস্তা, দূর-দূরান্ত অবধি আলো নেই। জয় গাড়ি থামাল, “নাঃ, বউ! আর পারছি না। স্যরি। রাত হলে আমার শরীরে সংগ্রামের আগুন জ্বলে। তাকে নেভাতে মাল ঢালতেই হবে পেটে।ʼʼ
পেছনের সিট থেকে মদের বোতল তুলে শব্দ করে কর্ক খুলল। তারপর একহাতে যতটুকু চালানো যায়, ততটুকু গাড়ি চালিয়ে আরেকহাতে বোতল মুখে ঠেকিয়ে গিলতে লাগল। উৎকট গন্ধ নাকে লাগছিল।
মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে লোকটা, এই নির্জন রাত, তার ওপর গাড়ি চলছে ধীরে। যেকোনো বিপদ হতে পারে। অন্তূর ভয় লাগছিল খুব। নিজের বোকামির ওপর ধিক্কার আসছিল। সে কী ভেবে জয়ের সাথে আসতে রাজী হলো, সেটাই বুঝতে পারছিল না। এই লোক আসলেই অযথা ঘুরতে বেরিয়েছে, ফূর্তি করতে বেরিয়েছে।
অন্তূ খানিকক্ষণ চুপ থেকে আর পারল না, কড়া স্বরে বলল, “বোতলটা কেঁড়ে নিয়ে আপনার মাথায় ভাঙি, তার আগে গেলা বন্ধ করুন। বেহেড হয়ে যাবেন যখন-তখন, সেই অবস্থায় একটা দুর্ঘটনা ঘটাতে চান?ʼʼ
-“আমার বেহেড হওয়া এত সস্তা না, ঘরওয়ালি।ʼʼ কেমন মাতাল মাতাল জড়ানো কণ্ঠে বলল, “আজ তোমাকে খুব আদর করতে মন চাচ্ছে, বুঝলে? ইভেন রাইট নাও। গাড়ির ভেতর বউয়ের আদর, আহঃ! ভাবা যায়?ʼʼ
বলেই মদের বোতলটা সিটের ওপর রেখে অন্তূর দিকে হাত বাড়াল। বোতলের তরল গড়িয়ে পড়ে পুরো গাড়িতে বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। অন্তূ ঝারা মেরে জয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে বলে, “আপনি বেহেড হয়ে যাচ্ছেন। আমি এই রাস্তায় অন্তত আপনার জুলুম মেনে নেব না।ʼʼ
-“না নিলে। তাতে আমার কী?ʼʼ
আবার হাত বাড়াল। অন্তূর চোয়ালে আঙুল বোলালো। অন্তূ চুপ করে বসে থাকে। ওকে জ্বালানোই মূল উদ্দেশ্য জয়ের আপাতত। কাজ পাচ্ছে না কোনো।
রাত দুটো বাজল গন্তব্যে পৌঁছাতে। বিশাল গাঙ। চাঁদহীন আকাশের নিচে অত বড় গাঙ রহস্য ছড়াচ্ছিল। আশপাশ শ্মশান। তখনই জয় নামল, “পাশেই একটা শ্মশান আছে। যাবে?ʼʼ
অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল। একদম স্বাভাবিকভাবে নামল জয়। ওর মনের কথা বুঝল যেন, “কী ভাবছো? বললাম তো, আমি সহজে বেহেড হইনা। ওই শালা মালও জোচ্চর। ট্যাকা দিয়ে কিনে খাই, অথচ মাতাল করেনা আমায়। শ্মশানে যাবে তো চলো ঘুরে আসি।ʼʼ
-“কেন যাব? আপনাকে দাফন করতে?ʼʼ
জয় খুব কাছে এসে দাঁড়াল, ফিসফিস করে বলল, “শশ্মানে মরা পোড়ায়, দাফন করে কবরে। মদ খেলাম আমি, মাথা গুলিয়ে গেছে তোমার? সব ঠিকঠাক তো, ঘরওয়ালি?ʼʼ
বিশ্রী গন্ধ জয়ের শরীরে। শার্ট ভিজে গেছে মদে। অন্তূ ধাক্কা দিলো, “সরে দাঁড়ান। এই, আপনার গাড়িতে ডিও নেই? থাকলে স্প্রে করে আসুন। আপনার মতো খাটাশের সাথে হাঁটতে পারব না। দুর্গন্ধ।ʼʼ
এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব, “শালি। তোমার বাপেরা আশেপাশেই লুকিয়ে আছে হয়ত। তুলে দিয়ে আসব?ʼʼ
-“চলুন, তুলে দিয়ে আসুন। আপনিও যা ওরাও তাই। খালি পার্থক্য হলো, আপনার একটা তথাকথিত হালাল পরিচয় আছে, ওদের নেই।ʼʼ
জয় অন্তূর হাত মুচড়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলো। হাঁটতে খারাপ লাগছিল না। পরিবেশটা ভয়ানক সুন্দর। অন্ধকারে গাঙের পানি কালো দেখাচ্ছে, গাছগুলো যেন কাঁচা রাস্তার দুধারে জীবিত সব, সারি ধরে দাঁড়িয়ে।
ওরা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটছিল। দুপাশে ধানের ক্ষেত। অনেকক্ষণ পর অল্প পকেট থেকে ছোট্ট একটা বডিস্প্রে বের করে শরীরে লাগালো জয়। তারপর আবার চলতি পথেই হিপফ্ল্যাস্কে চুমুক দিচ্ছিল।
অন্তূ একবারও জিজ্ঞেস করেনি, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জয় ওকে। নিঃশব্দে হেসে জিজ্ঞেস করল, “ঘরওয়ালি, একবারও তো জানতে চাইলে না, কোথায় নিয়ে যাচ্ছি!ʼʼ
অন্তূ হাসল, “এই জগতে আমার হারানোর মতো কিছু নেই, সুতরাং পিছুটান নেই। আছে জানটা। অথচ পিছুটান না থাকলে জান হারানোর স্বাভাবিক ভয়টা থাকেনা মানুষের।ʼʼ
জয়ের মনে হলো, সে আবারও নিজের গুণগুলো তার ঘরের বিরোধীর বৈশিষ্ট্যে খুঁজে পেল। বেসিক ফিচার সব জয়ের, আর মিলেও যায় সবগুলো।
অন্তূ বলে চলে, “আর কী ক্ষতি করতে পারেন আপনি আমার?ʼʼ
-“তোমার আমাকে ভয় লাগেনা?ʼʼ গম্ভীর হলো জয়।
-“না। লাগেনা। আগে লাগতো, বিয়ের আগে। পরে আর লাগেনা।ʼʼ
অন্তূ ভালোভাবে দেখল, সে কখনও কাঠের বাড়ি দেখেনি। দাঁড়িয়ে আছে, তেমন একটা বাড়ির সামনে। একটা বাগান বাড়ি। অন্তূ মনে হলো, এটাই কি ‘আমির নিবাসʼ?
চারপাশে মাঠ। প্রাচীরের ভেতরের বাগানটা বড়। সেখানে শুধু গাছ আর গাছ। পেছনে অল্প কিছুটা মাঠ, তারপর বয়ে গেছে গাঙটা। অন্ধকারে অদ্ভুত লাগছিল গোটা পরিবেশটা। জয়কে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি আপনাদের বাড়ি?ʼʼ
-“না। আমার বাপ-দাদারে কি পাগলে থাপাইছিল যে এইরকম ঝোড়জাতার মধ্যে বাড়ি করতে আসছিল? এসো। প্রাচীর টপকাতে হবে।ʼʼ
-“আশ্চর্য! আমরা কি চুরি করতে যাচ্ছি? যাব না আমি দরকা, পড়লে, তবউ প্রাচীর টপকাতে পারব না।ʼʼ
-“থাপ্পর মারি একটা? সময় নষ্ট না করে যা বলতেছি সেইটা করো। আমি উঠায়ে দিচ্ছি।ʼʼ
অন্তূ গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, “আমি প্রাচীর টপকাতে পারব না। আমি এমন একটা প্রয়োজন দেখছি না যে এখানে ঢুকতেই হবে।ʼʼ
-“মাগী মানুষ এত ত্যাড়া! শালীর মেয়ে, সবসময় ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে খাতা রেডিই রাখে।ʼʼ
জয় এক লাফে প্রাচীর টপকে ফেলল। সেই শব্দেই পাহারাদার সতর্ক হলো। এরপর যেই গেইট খুলতে গেল, ওমনি রাইফেল হাতে দাড়োয়ান উঠে দাঁড়াল, “এই শালা কেডা রে, থাম, শালা মাগীর চেংরা। বুক ঝাজরা কইরা দিমু একদম।ʼʼ
হামজা লোক নিযুক্ত করেছে, তা জানতো জয়। তবে সেই লোক যে জয়কেও চেনেনা ঠিকমতো, এ তো মুশকিল! জয় বোঝানোর চেষ্টা করল, “বসির ভাই, আমি…ʼʼ
লোকটা বিনা নোটিশে চট করে গুলি চালালো। শর্টরেঞ্জের ডাবল-বুলেট রাইফেল, দূরত্ব বড়জোর এক গজও না, বুলেট একটু ছুঁয়ে গেলেও জয় আমিরের মৃত্যু নিশ্চিত। গুলি সে তাক করল জয় আমিরের বুকের বাঁ পাশটা।লোকটা ভুল যেটা করল, গুলি ছোঁড়ার আগে রি-লোড করল একবার, এবং শব্দটা কানে যেতেই জয় নিচু হলো।
গুলিটা লাগেনি দেখে বসির আবার গুলি চালাতে প্রস্তুত, জয় বকে উঠল, “রাইফেলটা তোর শাউয়ার মধ্যে ভরে দিই, শালা খানকির বাচ্চা।ʼʼ
কাউকে ভেতরে যেতে দেবার অনুমতি নেই। সে কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পআলন করে হামজার মনোযোগ আয় করতে চায়। দ্বিতীয় গুলিটা চালালো বসির। অন্ধকারে নিশানাচ্যুত হয়ে গেল। জয় প্লেস-ক্রস করে এগিয়ে এসে হাতটা চেপে ধরল বসিরের, “ভ্যাড়াচ্চুদা, তোর মাইরে…..শালা গুলি চালাবা, দেখেশুনে চালাও সম্বন্ধির চেংরা। তোর আব্বা যে দাঁড়ায়ে আছি, হুশ করে ফায়ার করবি তো।ʼʼ
রাইফেলটা কেঁড়ে নিয়ে লোকটাকে মাটিতে ফেলে মুখের ওপর পায়ের হাই-বুটটা চেপে ধরল। স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে বসিরের মুখটা গেঁড়ে যাচ্ছিল, গা ছমছমে ভোঁতা গোঙানির আওয়াজ করছে বসির, দম আঁটকে আসছে। জয় তবু পা তুলল না। অনেকক্ষণ মাটিতে মাথাটা চেপে ধরে রইল জুতো দিয়ে। আনুমানিক মরার অল্প আগে ছেড়ে দিলো। উবু হয়ে বসে বলল, “আমি, জয়। জয় আমির। এরপর ফায়ার না শুনে তারপর করবি, শালা নোটকির পুত!ʼʼ
লোকটা উঠে দাঁড়াতে পারল না, তবু এবার হাত উঁচিয়ে সালাম ঠুকতে চেষ্টা করল। জয় চাবিটা নিয়ে গেইটটা খুলে দিলো। অন্তূ দৌঁড়ে ভেতরে ঢোকে, “কী হয়েছে আবার ভেতরে? গুলি চলল যে। বেঁচে আছেন?ʼʼ
জয় আলগোছে হাসে, “মরিনি এখনও।ʼʼ
অন্তূ বলল, “তাহলেই হলো। আমার আবার ফিরতে হবে এখান থেকে, একা তো যেতেও পারব না আপনি ছাড়া।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে উঠল। অন্তূ হাত ধরে কাঁদা পার করিয়ে গেইট আঁটকে ভেতরে এগিয়ে গেল।
দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুলল মিনিট দুয়েক পরে। অন্তূ অবাক হয়ে যায়। রূপকথা মিষ্টি হেসে অন্তূর হাত ধরে, “কেমন আছো, মিষ্টি মেয়ে।ʼʼ
জয় বুট পরেই ভেতরে ঢুকছিল, রূপকথা চেঁচালো, “খবরদার কাঁদা পায়ে ঢুকবে না, জয়। জুতো খোলো।ʼʼ
জয় সারেন্ডার করার মতো দু হাত উঁচু করে জুতো খুলল।
বাড়ির ভেতরটা আলো-আঁধার। অন্তূ সেই আধারে দেখে কেউ সোফায় বসে আছে। সেন্টার টেবিলের ওপর ল্যাপটপ। সে তাতেই কিছু কাজ করছে। এবং ল্যাপটপের আলোয় মুখটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছিল। পরাগ আজগর না! হ্যাঁ তাই তো। সে আর রূপকথা এখানে কী করছে? জায়গাটাই বা কোথায়?
চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]