#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬০. (বর্ধিতাংশ)
অন্তূ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চুপচাপ। বাইরের পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর! গাঙের পানি ছলছল রবে বয়ে যাচ্ছে, আকাশে চাঁদ নেই, গাঙেল কূলের আবহাওয়া একটু মঘলা বোধহয়!
রূপকথা যাবার পর পরাগ ল্যাপটপ ছেড়ে বসল, অন্তূর দিকে তাকিয়ে বলল, “পলাশ ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন-তখন হামলা করবেই। আর যদি তা না পারে, তো পুলিশ নিয়ে আসবে। পলাশের জন্যে এই মুহুর্তে জেলখানার চাইতে সুখকর জায়গা দুইটা নাই।ʼʼ
জয় বিশাল এক হাঁ করে হাই তুলল, “ব্যাপার না। তুমি আছো না? তুলে দেব ওদের হাতে। তুমিও তো একই কম্পানির প্রোডাক্ট। আমি আমার বউটা নিয়ে ভাগতে পারলেই হলো।ʼʼ
পরাগ কাঠের ভারী চেয়ারটা ঠেলে মারল জয়ের দিকে, জয় দ্রুত সরে গিয়ে বাঁচল, লাগলে নির্ঘাত হাসপাতাল। পরাগ শান্ত স্বরে বলল, “তোমার মতো বেইমানের ওপর ভরসা করাও শালার এক চরম ফাতরামি ছিল।ʼʼ
জয় উঠে দাঁড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ল, “আমি তো জন্মগত আর খানদানী বেইমান। আমি বেইমানী করি পুরো ইমানদারীর সাথে। আমার বেইমানীতে কোনও গাফলতি থাকেনা, খাঁটি বেইমানী। কিন্তু ভয় হলো, তোমার মতো ইমানদারদের নিয়ে..পবিত্র গাদ্দার…ʼʼ
পরাগ মুখ বাঁকিয়ে হাসল, “যেমনে তোর পেয়ারের পলাশ ভাই আজ শালা হয়ে গেছে, ওরকম কিছু ঠাপ আমিও খাইছি, বুঝলি না রে!ʼʼ
জয় অন্তূর দিকে তাকাল। তার খেয়াল নেই ওদের দিকে। পরাগ ল্যাপটপে কিছু দেখে চট করে উঠে দাঁড়াল, “আজ পলাশকে আমার হাত থেকে তুমি বাঁচাইতে পারবা না। তোমার নাটক আর নিতে পারতেছি না। মারবাই যখন, তখন ফিল্ডিং মারাইতেছ ক্যান এমনে?ʼʼ
জয় তাড়াহুড়ো করে পরাগের পিছে যাবার আগে হাতের বোতলের মদ গিলে শেষ করে আগে। তারপর পরাগের পেছনে দৌঁড়ায়। আবার কী মনে পড়ে দৌড়ে ফিরে আসে, এরপর একটা ভরা বোতল নিয়ে আবার দৌড়।
পরাগ গিয়ে দরজায় দুটো সজোরে লাত্থি মারল। রূপকথার কথা শুনে রেগে উঠল, “জয় না, আমি। খোল, দরজা! আমার মা’র কিছু হইলে তোর চৌদ্দগুষ্ঠির অবস্থা আমি তোর ওই বেজন্মার মতো করে ছাড়ব, রূপ। দরজা খোল।ʼʼ
রূপকথা অবাক হয়ে দরজা খোলে, “বুয়ার কী হয়েছে?ʼʼ
-“আমি কেন এসেছি এখানে?ʼʼ
-“বলিসনি কিছুই। এসে থেকে ল্যাপটপে বসে আছিস।ʼʼ
-“তোর ওই..বানচোত.ʼʼ বিশ্রী ভাষায় বকে ওঠে পরাগ, “আমার মাকে কোথায় পাঠিয়েছে সেটা শোন্, যতক্ষণে বলবে, ততক্ষণ ওর আয়ু আছে। চিরকাল তোদের ফরমায়েস খেটেছে, তার বদলে লাত্থি, মানহানি ছাড়া কিছু পায়নি। তোর বাপ মরেছে, এবার ওই শুয়োরের বাচ্চাও মরবে, বাকিটার ভোগ আমার আর মা’র। তোল ওকে।ʼʼ
জয় এসে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল পরাগকে। পরাগ সমানতালে বকে যাচ্ছে। জয় একবার খামচে মুখটা চেপে ধরল। পরাগ ঝপাট করে এক ঘুষি মারে জয়ের নাকের ওপর। তখন ওরা গাঙের কূলে চলে এসেছে। অন্ধকার চারদিক, প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, পাখি ডাকছে।
জয়ের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে প্রায়ই। ঘুষির আঘাতে কপকপ করে রক্ত বেরিয়ে এলো। আঙুলের ডগায় রক্ত মুছে পরাগকে দুটো ঘুষিসহ শেষ অবধি এক লাত্থিতে গাঙের পানিতে ফেলে দিলো। টাল সামলাতে না পেরে নিজেও গাঙের কূলের কাদায় পা পিছলে পড়ল। পরাগ পা ধরে টেনে পানিতে নামানোর চেষ্টা করে। জয় শক্ত করে কীসের একটা শিকড় টেনে ধরে নিজেকে পানিতে পড়া থেকে বাঁচালো তো, অথচ পুরো শরীর ইতোমধ্যে ভিজে গেছে, কাদামাটিতে পরনের পোশাক শেষ। শেষ অবধি ঝারা মেরে পরাগকে পানিতে ফেলে রেখে বকতে বকতে উঠে এলো। পরাগ পড়ে রইল পানিতে, ফজরের আজানের আগে গাঙে গোসল করা ভালো।
গাঙের এধার ঘেঁষে অনেকটা দূর দেখে এলো জয়। তেমন কেউ ছিল না।
কাদামাটিসহ ভেজা শরীরে বেসমেন্টে এসে বসল। আরও কয়েক প্যাগ মারা দরকার। নয়ত ঘুম আসবে না।
রূপকথা পলাশের কপালে হাত রাখে। কপালটা গরম। তাকিয়ে রইল। নিজের শরীরের শুকনো ক্ষতগুলো চিরবির করে উঠছে যেন। পলাশের সামনে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত পড়ে থাকতে দেখেছে অজস্র বেলা, কিন্তু পলাশকে কখনও এভাবে দেখা হয়নি।
রূপকথা আনমনে বলে ওঠে, “জানো, জয়! বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার গর্ভে একটা সন্তান এসেছিল।ʼʼ
জয় হিপফ্ল্যাস্কে দুটো চুমুক দিয়ে বলল, “হু, শুনেছিলাম।ʼʼ
রূপকথা বলে চলে, “তখন আমার গর্ভাবস্থার চার মাস। সেই সময় একরাতে পলাশের হাতে পড়লাম। পরদিন সকালে আমার গর্ভপাত হলো। দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে আমি খুব কেঁদেছিলাম.. জানো!ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “কাঁদা তো ভালো। চোখের জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ময়লা সব চোখের পানির সাথে ধুয়ে-মুছে যায়। হোয়াট এভার, এক সিপ মারবেন? দুঃখের সময় এটা ভালো কাজ দেয়।ʼʼ
রূপকথা তাকাল, একই সুরে বলতে লাগল, “তুমি জানো, পাপীর ঘর করা কারাবাসের চেয়েও কঠিন! পাপীষ্ঠর সাথে বাস করতে করতে বড়জোর পাপী হওয়া যায় ঠিকমতো, এর বেশি উপকার নেই!ʼʼ
জয় ঘাঁড় ঝাঁকাল, “উহু! আপনি এইসব মেয়েলী দুঃখের কথা আমায় শুনিয়ে কোনো ফায়দা পাবেন না, একফোঁটা সান্ত্বণা অবধিও না। রাদার, আমার বউকে শোনান, সে নিজেও ভুক্তভোগী। তাই সে আপনার দুঃখ বুঝবেও, সহমত পোষনও করবে, আবার মাল-মশলা মেরে নিজের দুঃখের প্যাঁচালও শোনাবে। আলাপ জমবে ভালো। তার চেয়ে বড় কথা, আমিও আপনার স্বামীর তরিকারই মুরীদ! আমার কাছে এসব কাহিনী শোনানোর ধান্দাটা লস প্রজেক্টে যাবে।ʼʼ
রূপকথা বসে রইল চুপচাপ কিছুক্ষণ। সে বিদেশ থেকে পড়ালেখা সেরে দেশে ফিরে কয়েদ খাটছিল এতগুলো বছর! পরিস্থিতিবিশেষ পারিপার্শ্বিক সকল অর্জন ফিকে পড়ে যায়! যার বাবা জঘন্য অপরাধী, স্বামীটা হিংস্র পশুকেও হার মানায়, রূপকথার কী করা উচিত ছিল সে অবস্থায়!
শেষরাতের দিকে পলাশ চোখ খুলে উঠে বসল আস্তে কোরে। রূপকথাকে বসে থাকতে দেখে চমকে গেল, জড়ানো গলায় বলল, “রূপ!ʼʼ
রূপকথা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে আছে। পলাশ বলল, “ওরা তোকে আঁটকে রেখেছে, রূপ?ʼʼ
রূপকথা অপলক তাকিয়ে বলে, “নিজের বাড়িতে আঁটকে রাখা কেমন? আমি তো এখানেই ছিলাম।ʼʼ
পলাশের হাত দুটোয় গভীর ক্ষত। পেরেক গাঁথা হয়েছে হাতে। দক্ষ এই কাজটা হামজার। কাঠের আসবাবে পেরেক গাঁথার মতো করে পলাশের হাতে পেরেক মারা হয়েছে।
চাপটি ধরা রক্তের দানা হাতে কাদামাটির মতো শুকিয়ে আছে। সেই হাত বাড়িয়ে পলাশ ছোঁয় রূপকথাকে। রূপকথা চোখ বোজে। বুকের মধ্যিখানটায় যেন ত্রিশূল বিঁধছে, বুকটা চিড়ছে ধীরে ধীরে, গেঁথে যাচ্ছে গভীরে। তার জীবনটা জীবন হলেও পারতো, তার স্বামীটা মানুষ হলেও পারতো, সে এক জোড়াতালি দেয়া ছিন্নভিন্ন শরীরের অধিকারিনী না হয়ে একজন সুন্দর পুরুষের সুশ্রী স্ত্রী হলেও পারতো, সে কোনো ঘৃণ্য রুচিসম্পন্ন পিতার সন্তান না হয়ে আমজাদ সাহেবের মতো বাবার মেয়ে হলেও পারতো। চোখ খোলে রূপকথা। কই! আমজাদ সাহেবের মেয়েটাও যে ভালো নেই। মূলত ভালো থাকাটা জীবন নয়!
পলাশ হাসল। সে হাসলে চোখদুটো ছোট হয়ে যায়। ভয়ানক দেখায়। হেসে বলল, “তুইও বিশ্বাসঘাতকতা করলি, রূপ?ʼʼ
রূপকথা মলিন হাসে, “বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল নাকি আমাদের? উত্তর যেহেতু ‘নাʼ। সেখানে বিশ্বাসের ঘাতক হবার সুযোগটা কোথায়, বলো?ʼʼ
পলাশ গলা টিপে ধরল রূপকথার। হাতের ক্ষত থেকে মরা রক্ত গড়িয়ে রূপকথার গলায় লাগে। পলাশ হাতটা আরও দৃঢ় করে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তবু রূপকথা নির্লিপ্ত। পলাশ বলল, “শিকল খুলে দিতে বল তোর, লাংকে। খানকিগিরি করতে রয়ে না গেছিস এখানে? ওদের স্পেশাল সেবাযত্ন করার জন্য রাখেছে ওরা তোরে? আমি মরলে ওই কাজই করে খাস…লোটির চেংরি। মারা খাইতে খাইতে জীবন যাবে তোর…তোর আমি…ʼʼ
পলাশের হাতের থাবা শক্ত হলো। তাতে হাত থেকে রক্ত পড়ছিল। জয় এসে সেই ক্ষততে লবন লাগিয়েছে।
শরীরের জোর নেই নেই করেও অমানুষিক শক্তি যেন। চোখ উল্টে এলো, গোঙরাচ্ছিল রূপকথা। পলাশ ছাড়ল না। অকথ্য ভাষায় বকে গেল। পায়ে গুলি লাগা জায়গাটাতে একটা নোংরা কাপড় বাঁধা। সেই কাপড়ের ময়লা-জীবাণুর জোরে ক’দিন ওভাবে থাকলে ক্ষততে ইনফ্যকশন হয়েই ক্যান্সার ধরে যাবে যেন। না খাওয়া আজ দু’দিন।
খানিক পর ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিলো রূপকথাকে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। রূপকথা কিছুক্ষণ কাশতেও পারল না। শ্বাস ছাড়ল বেশ কিছুক্ষণ পর। তারপর বলল, “আর কোনো ইচ্ছা আছে তোমার মৃত্যুর আগে? আমাকে আর কোনোভাবে টর্চার করতে চাও? আমি জানি, তোমার শেষ ইচ্ছা হিসেবে তুমি আমার শরীরটাকেই বেছে নেবে ছেঁড়া-ফাঁড়ার জন্য।ʼʼ
পলাশ একবার তাকিয়ে আবার মাথা নত করল। কয়েক সেকেন্ড পর টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত পড়ে মেঝেতে। পলাশ দ্রুত মাথা তুলল। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তার শরীরটাকে অচল করে ছেড়েছে ওরা। এ পর্যায়ে পলাশের ভেতরে একটা ভিক্ষুক জেগে উঠল, যে ভিক্ষুকটা মৃ/ত্যু ভিক্ষা করতে চায়। মেঝের ওপর টান হয়ে শুয়ে পড়ল। দুই হাতের প্রতিটা রগে রগে পেরেক গাঁথা হয়েছে। হাতুরি দিয়ে ধীরে ধীরে পেরেকগুলো গেঁথে আবার তোলার সময়ও বেশ সময় নিয়ে দুই আঙুলে পেরেক টেনে টেনে বের করেছে হামজা। কতটা রক্ত বেরিয়ে গেছে, মাপা গেলে ভালো হতো। তাহলে একটা হিসেব পাওয়া যেত, শরীরে আর কতটুকু রক্ত বাকি আছে।
শ্বাস ধীর হয়ে এলো পলাশের। চোখ বুজে খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে আস্তে কোরে পানি চাইল।
জয়-হামজা ততক্ষণ মানুষকে অত্যাচার করে, যতক্ষণ সে সজ্ঞানে থাকে, জ্ঞান হারালে মাফ। আবার চিকিৎসা করে, সুস্থ করে, জ্ঞান ফিরলে নতুন মাত্রায় শুরু। পলাশ দুটো দিন আয়ুও পেয়েছে এই বদৌলতেই। আজ রাতটাও পেল। কারণ সে অজ্ঞান ছিল। ভিক্টিমের চোখে কাতরানি না দেখলে জয় টর্চার করে সুখ পায়না। এটা ওদের গোটা সোসাইটির উসুল। এই নীতির মূল হোতাটা রুদ্র ইয়াজিদ। তারপর হামজা, জয়, পলাশ….!
রূপকথা পলাশকে উচু করে ধরে পানি খাওয়াতে গেলে পলাশ গা দুলিয়ে হাসে, আজব দেখতে লাগে তখন। দাঁতের ফাঁকে কালো রক্ত। হেসে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি আমাকে এই অবস্থায় দেখে কষ্ট হচ্ছে, রূপ?ʼʼ
-“হচ্ছে তো। তুমি জানোনা, আমার কতটা কষ্ট লাগছে, যখন ভাবছি আমার স্বামীকে এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মুখে দেখেও আমার তাকে বাঁচাতে ইচ্ছে করছে না, তাকে মুক্তি দেবার তাগিদ পাচ্ছি না ভেতরে, এটা ভাবলেই বুক ভেঙেচুড়ে কষ্ট আসছে, তখন কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অথচ তুমি না আমার পলাশ ভাইয়া, আমার স্বামী…! আমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আপন বলতে তোমার কেউ নেই এই মুহুর্তে, আর আমিটাও তোমার খুব কাছের আপন কেউ। তোমার এই শেষ মুহুর্তে সেই আমি তোমার সামনে আছি, পাশে আছি, তোমাকে পানি খাওয়াচ্ছি, এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়? অথচ তোমার জন্য স্বাভাবিক মায়াটুকউ লাগছে না। এটা কতটা ব্যথাদায়ক, ভাবতে পারো? এটা ভেবে তোমার কষ্ট হবার কথা? হচ্ছে?ʼʼ
পলাশ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। আশ্চর্য! শরীরের মরণসম ব্যথাটা এখন ঝাপসা লাগছে, বুকে কীসের যেন অস্থিরতা! পলাশ অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেল। এই জীবনে সে কখনও আবেগবোধ করেনি। কসাইয়ের মতো মানুষ জবাই করা, নারীদেহ ছিঁড়ে খাওয়া, মানুষের শেষ সম্বলটুকু হস্তাগত করে নেয়া, কারও ব্যবসার গোটা পুঁজি, মুনাফা সবটা এক হানায় চাঁদা হিসেবে হাতিয়ে নেয়া। বাপের সামনে মেয়ে, মেয়ের সামনে বাপকে মারা….কী যে সুখ লাগতো এসবে! তার মস্তিষ্কের কোনো অংশে আবেগ, অনুভূতি নামক দুটো শব্দের অস্তিত্ব নেই, এটা চিরন্তন সত্যের মতো। অথচ আজ পলাশ বুকের ভেতরে হাতরে নতুন এক রকম কিছু অনুভব করল। এই জীবনে এই রকম কিছুর সাথে তার পরিচয় ঘটেনি। এই রূপকথা তার পা দুটো দু’হাতের বাহুতে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো মিনতি করেছে, “ও পলাশ ভাইয়া, ছেড়ে দাও আমায়। ও পলাশ ভাইয়া, পলাশ ভাইয়া গো…ʼʼ এই চিৎকার আর মিনতি করা কান্নাগুলো পলাশের কানে বাঁশির সুরের মতো সুখকর ঠেকতো। নিজেকে পুরুষ মনে হতো তখন।
আজ পলাশ হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকল। তার এই দুনিয়ায় কেউ নেই আপন। রূপকথা আছে, সে খুব আপন তার। তার স্ত্রী, চাচার মেয়ে। অথচ সে তাকে বাঁচাবে না, রূপের নাকি ইচ্ছেই করছে না একটুও। কঠিন মৃত্যু তার সামনে। এই একমাত্র আপনটার সাথে সে খুব অন্যায় করেছে, তাই একমাত্র আপনজন সামনে আছে, তবু তার এই নারকীয় হাল দেখেও মায়া লাগছে না!
রূপকথা নিচু স্বরে কিন্তু কণ্ঠস্বরে অনুযোগের দৃঢ়তা মিশিয়ে বলল, “আর এই মায়া না লাগার পেছনের পেক্ষাপটগুলো খুব ভয়াবহ, বুঝতে পারছো তুমি?ʼʼ
পলাশ ঝারা মেরে উঠতে চেয়ে পড়ে যায়। তার রূপকথা ভীষণ রুপবতী, ঠিক রূপকথার রাজকুমারীদের মতোন, শিক্ষিত, কথা বলে কী সুন্দর করে! আজ এসব মনে পড়ছে তার। উঠে বসে পলাশ। হাত বাড়িয়ে রূপকথার ঠোঁট ছোঁয়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
রূপকথা যান্ত্রিকভাবে উঠে দাঁড়ায়। পলাশের ক্ষতবিক্ষত দূর্বল হাতটা তখনপিছলে যায় রূপকথার জামদানী শাড়ি ঘেঁষে। রূপকথা আর পেছন ফিরে তাকায় না। আচমকা তার বুক জ্বলছে, পুরোনো দিনগুলো ভয়ঙ্কর ভাবে স্মৃতিপটে আক্রমণ করছে। এখন আর পলাশের সামনে থাকা চলবে না। সেও তো একা হয়ে যাবে। তার আর কেউ থাকবে না। হাসল রূপকথা, পলাশ থাকলে কেউ থাকা হতো?
—
চোখ দুটো জ্বলছে অন্তূর। ঘুম নেই কত রাত! যাকে ভোলা হয়নি, তাকে মনে পড়ার প্রশ্ন ওঠে না। তবু গতরাত থেকে আব্বুকে মনে পড়ছে, এ কেমন মনে পড়া, তার তো ব্যাখ্যা নেই! আছে কেবল খণ্ড খণ্ড ব্যথা। অন্তূর মনে হলো, এই তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তার উচিত এখন ওই গাঙের জলে মুখ চুবিয়ে দশ মিনিট ধরে রাখা, তাতে সব থেমে যাবে— তার হৃদঘড়িটা, সাথে সকল ব্যথাও।
বাগানের ঘাসগুলোও অযত্নে বেড়েছে। সকাল সকাল কবীর পুরো দলবল নিয়ে পলাশের এই বাড়িতে হাজির।জয় একটা কোরবানীর আয়োজন করবে, তরুর জানের ছদকা হিসেবে, ওদের দাওয়াত এখানে। অন্তূ ঝোপের কিনারে পাকা ঢিলার ওপর বসে থাকে।
জয় প্যান্ট, হাইবুট ছেড়েছে। কবীর সকালে সাদা লুঙ্গি ও চিরায়ত চামড়ার স্যান্ডেল এনে দিয়েছে।
রূপকথা এসে নিঃশব্দে বসে অন্তূর পাশে। অন্তূ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে, মুখে যেন দুঃখ ফুটে না ওঠে, তাই হাসার অভিনয় করে।
জয় চুলো জ্বালাচ্ছিল। ভাঙা ডাল কুড়িয়ে এনে এনে জড়ো করছে ছেলেরা। ধোঁয়া চোখে লেগে কেদেকেটে অস্থির অবস্থা তার, লুঙ্গিতে কালি ভরে গেছে। অনেক কষ্টে চুলো জ্বলেই উঠেছিল সবে, পরাগ কোত্থেকে এক বালতি পানি এনে ঢেলে দিয়ে আরাম করে হেঁটে গিয়ে মুরগী জবাই করতে লাগল।
জয় চোখের মণি ঘুরিয়ে দেখল পুরো ব্যাপারটা। এরপর আস্তে করে বকলো দুটো, “শালার জাঙ্গিয়ার ভেতরে কাঁকড়া ঢুকাইতে পারলে শান্তি লাগত। ল্যাউড়ার বাল!ʼʼ
জীবনেও কখনও ভালো সম্পর্ক ছিল না জয়ের সাথে পরাগের। তখন জয় ক্লাস এইটে। ঘুরতে গিয়ে দুজন বাজি ধরে এক দ্বীপে গেল পালিয়ে নৌকা নিয়ে। জয়কে দ্বীপে নামিয়ে নৌকা নিয়ে চলে যাবার সময় একটা পকেট ছুরি ছুঁড়ে দিয়ে পরাগ বলল, “নে, এটা দিয়ে মাছ শিকার করে খাস, আর মাছ না পেয়ে বেশি খিদে লাগলে মরে যাস। আমার দোয়া থাকবে তোর সাথে। সালাম, বন্ধু।ʼʼ
এরপর জয় কীভাবে দু’দিন পর সেখান থেকে ফিরেছিল, সে এক ইতিহাস। তারপর আর দুজনের জীবনে বনিবনা হয়নি।
অন্তূ সেদিন রূপকথাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি জয় আমিরকে বেশ জানেন, তাই না?ʼʼ
রূপকথা কিছুটা সময় নিয়ে জবাব দেয়, “আমার বিয়ে হয়েছে ২০০৯-এ। তখন জয় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। সেই সময় হোটেলে রোজ ওর যাতায়াত ছিল। কখনও কখনও অতিরিক্ত মদ খেয়ে সাথে চুরুট টেনে কাশতে কাশতে বমি করে ভাসিয়ে ফেলতো। জ্বরে গা পুড়ে যেত, তবু কোনো মেয়ের সাহস ছিল না ওর কাছে গিয়ে ওকে সেবা দেয়।ʼʼ
রূপকথা সামান্য হাসল, “জানো তো, সে আবার কারও সেবা, আদর-যত্নের ভুক্তভোগী না। তখন আমাদের আগের ভিলার পাশেরটা বিল্ডিংটা হোটেল ছিল। কোনো কারণে গেলে দেখেছি, বেহুশের মতো পড়ে আছে, তবু কাউকে সেবা করতে দিচ্ছে না। আমি গিয়ে ধমকে-ধামকে জোর করে টেনে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। প্রথমদিন এক থাপ্পরও খেয়েছিল আমার হাতের বেশি ভাব ধরায়।ʼʼ
অন্তূ মুখ তুলল, “কখনও সরাসরি তাকে স্নেহের কাঙাল মনে হয়নি।ʼʼ
-“জয়ের যেটুকু যা দেখা যায়, সবটাই ওর নিজের স্ক্রিপ্টেড। তুমি তাকে খুব ভালো জানো, এবং আরও অনেকে জানবে হয়ত, কিন্তু তোমার মতো করে কেউ জানেনা। কত রাত জ্বরের ঘোরে কাতরেছে, মাথায় পানি দিতে গিয়ে শার্ট খুললে দেখেছি শরীরে অজস্র দাগ, কোনোটা তাজা-কোনোটা অনেক পুরোনো। অথচ এত এত রাত পড়ে থেকেছে বেহেড অবস্থায়, তবু কোনোদিন ওর অতীত বা ভেতর সম্পর্কে একটা কথা জানতে পারিনি।ʼʼ
অন্তূ কথা ঘোরায়, “থাপ্পড় খেয়ে কী করল?ʼʼ
দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে উদাসীন স্বরে বলল রূপকথা, “বেক্কেলের মতো চেয়ে রইল। এরপর চুপচাপ যা বললাম, শুনল।ʼʼ রূপকথা একটু চুপ থেকে বলল, “সেসব দিনে ঘুমের ঘোরে তরুকে ডাকতো–দুটো ঘুমের ওষুধ দেবার জন্য।ʼʼ
অন্তূ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “সকল যন্ত্রণার একটাই ওষুধ, ঘুমের ওষুধ আর নয়ত মদ গিলে ঘুমানো? চমৎকার তো!ʼʼ
রূপকথা তাকাল অন্তূর দিকে, “তুমি জানো, তোমার আর ওর মাঝে অসংখ্য মিল আছে?ʼʼ
অন্তূ তীব্র প্রতিবাদ জানায়, “প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ
রূপকথা শাড়ির আচলে ঘাম মুছে বলল, “অস্বীকার করে অনস্বীকার্যকে এড়াতে পারবে না। জয়ের আয়নায় দেখা যাওয়া প্রতিবিম্বটা হলে তুমি। একই তবে বিপরীত।ʼʼ
দুজন একযোগে তাকাল জয়ের দিকে। সে এখন ঘাসের ওপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘাঁড়ের নিচে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গাঙের পাশে সবসময় শনশনে বাতাস। কপালের কাছের চুলগুলো উড়ছে। অপর হাতটাও এবার ঘাঁড়ের নিচে গুঁজে গলা ছেড়ে এক ভারী টান ধরল,
আমি চলতি পথে দু’দিন থামিলাম,
আরেহ ভালোবাসার মালাখানি গলে পরিলাম….
আমার সাধের মালা যায় রে ছিঁড়ে….
রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে
ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে,
রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে…
রূপকথা একদৃষ্টে জয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “জয়কে আমার একটা মানচিত্রের মতোন লাগে। একেক দিকের দৃষ্টির কোণ থেকে তাকে একেকভাবে আবিষ্কার করা যায়।ʼʼ
-“পাপের কোনো দিক-কোণ নেই। যেদিক থেকেই দেখুন, ওটা পাপ এবং পাপ।ʼʼ
রূপকথা হাসে, “ভুল বলোনি। পলাশের হাত থেকে এই জয় কতবার আমাকে ছাড়িয়েছে! এরপর একবার পলাশের সাথে ঝামেলা করে আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখল, তখন…ʼʼ
নিশ্চিত হতে শুধায় অন্তূ, “কোন বাড়িতে?ʼʼ
-“আমির নিবাস।ʼʼ
-“আপনি ওখানে ছিলেন?ʼʼ
-“ছিলাম। মজার কথা শুনবে? রেখে এলো আমায়, অথচ জীবনে দেখতে গেল না আর–বেঁচে আছি না মরেছি। আমি যে ওকে না জানিয়ে চলে গেছিলাম ও বাড়ি থেকে থেকে, সেটাও জেনেছে ও এক সপ্তাহ পর।ʼʼ
অন্তূর হাসি পেল। এছাড়া এরা আর কী আশা রাখে জয় আমিরের কাছে? বলল, “বাড়িটা কেমন, বলতে পারেন?ʼʼ
-“তোমার শ্বশুরবাড়ি তো। সেটার ব্যাপারে আমার কাছে জানা কেন? নিজে গিয়ে জানবে।ʼʼ
-“আমি? সে হিসেব থাক আপাতত। আপনিই বলুন!ʼʼ
অল্প চুপ থেকে রূপকথা চোখ তুলে তাকাল অন্তূর দিকে, “তুমি আমাকে ঘৃণা করো, অন্তূ?ʼʼ
অন্তূ প্রসঙ্গ বদলায়, “বাড়িটা কি পুরোনো আমলের?ʼʼ
রূপকথা আর জবাব দিলো না। পদে পদে অন্তূর মাঝে জয় আমিরের ছাপ ফুটে ওঠে। যা মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়, সেই কথাটা ভীষণ সন্তর্পণে এড়িয়ে যায় এরা। রূপকথার বুক আরেকটু ভার হলো। অন্তূর সুপ্ত ঘৃণা রয়েই গেছে তার উপর আজও।
চলবে…
[পরের পর্ব আগামীকাল সন্ধ্যার পর পাবেন ইনশাআল্লাহ। এবং ওটা শেয়ার করার জন্য আমি বেশ এক্সাইটেড😁]