অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৬১.

0
2

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬১.

সকালের রান্নাটা তুলি করল। বাড়িতে কোয়েলসহ ওরা চারজন। ওয়ার্কশপে আজ ছয়জন খাটছে। আর বড়ঘরে আছে সাতাশজন।

সকাল এগারোটায় রিমি রুম থেকে বের হলো। হামজা সোফাতে বসে বই পড়ছে। ভীষণ মনোযোগ বইয়ের পাতায় তার। জর্জ অরওয়েলের লেখা ‘নাইনটিন এইটটি ফোরʼ বইটি তার হাতে। ইংরেজ লেখকের লেখা এই বইটি চমৎকার এক রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থার আখ্যান। আগের দিন হল রিমি রাগ করতো। ওকে ঘুম পাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে এসব ভারী ভারী বই পড়ার অভ্যেস আছে এই লোকের।

চোখে সাদা চশমা। চৌত্রিশ বছর বয়সী সৌম্য পুরুষটির দিকে কতক্ষণ চেয়ে রইল রিমি। পরনে সবসময়কার মতোন ফতোয়া। কালো কুচকুচে চাপ দাড়ি-গোফের ভিড়ে পুরু ঠোঁট। কোয়েল এসে হামজার কোলে ঝেপে পড়ে বইটা কেড়ে নিলো, তখন রিমির মনোযোগ সরে।

হামজা রেগে গিয়ে আবার সামলায়। সে রাগে না। কোয়েলকে পাঁজা করে তুলে নাকে নাক ঘষে বলল, “তো আম্মাজান, আপনার খাওয়া হয়েছে?ʼʼ

-“জয় কোতায় গেতে, বলো। তাতাড়ি বলো।ʼʼ

-“উমম..বেড়াতে গেছে। তুমি যাবে বেড়াতে, আম্মা?ʼʼ

অভিমানে মুখ ফুলালো কোয়েল, “ওর বউতাকে ঠিকই সাথে নিয়ে গেল, আমায় নিলো না। আসুক এবার..ʼʼ

হামজা হেসে ফেলল। অভিমানে মুখ ছোট করে মামার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে কোয়েল। একটু পর ফুঁপিয়ে ওঠে, “মামা!ʼʼ

হামজা চমকে ওঠে। নরম, আধভাঙা কণ্ঠের মামা ডাকটা কেমন যেন শোনালো কানে হামজার। “বাবা!ʼʼ ঠিক যেন এমন।

ঘন চোখের পাপড়ি ভিজে উঠেছে কোয়েলের। এত্ত সুন্দরী হয়েছে তুলির মেয়েটা! তুলির চেয়েও সুন্দরী! ত্বকের ওপর দিয়ে রক্তের বর্ণ ছুটে আসে, গোলাপী চামড়ার রঙ বাচ্চাটার। সেই ছোট্ট চোখের ছলছলে দৃষ্টি হামজাকে অস্থির করল, জড়িয়ে ধরল অজান্তেই সে, “কী হয়েছে, আম্মাজান! কাঁদছেন কেন?ʼʼ

পানি গড়িয়ে পড়ল কোয়েলের চোখ বেয়ে, “পাপা’তা আসেনা কেন? তরুতাও নেই। কার থাতে খেলব বলো তো! পাপা বলেথিল, চলকেট আর টয় আনবে আমাদ্দন্য। এলোই না! আমি তাল ওপল লাগ কলেতি। শোনো, মামা। তরুকে কোতায় পাথিয়েছ? আমার খেলার লোকই তো নেই কেউ।ʼʼ

বই রেখে কোয়েলকে কোলে তুলে বলল, “আপনি কি মামার সাথে বেড়াতে যেতে চান, আম্মাজান? মামা যদি আপনাকে নিয়ে যেতে চায়?ʼʼ

কথাটা একটু সময় নিয়ে বুঝে হাসল কোয়েল। ভেজা চোখ, ঠোঁটে হাসি! হামজা আলতো হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কোয়েলকে। সে বাচ্চাদের আদর দিতে পারেনা, কীভাবে কী করবে, তা-ই বুঝে পায়না।

রিমি বিছানা গোছাচ্ছিল। সারারাত কেঁদেছে। শেষরাতে যখন হামজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, তারপর একাধারে কেঁদেছে। হামজা দেখল ভারী মুখখানা রিমির। কিছু বলল না, চুপচাপ মানিব্যাগটা টাউজারের পকেটে পুরে কোয়লকে নিয়ে বের হলো।

রাস্তায় এত মানুষের অভিবাদন, সালাম, সম্মান—সবটাই মুখের রোবটিক হাসি দিয়ে সামলে নিলো। ভেতরে নাম না জানা এক অস্থিরতা। অসহ্য লাগছে বিষয়টা। অপরিচিত যন্ত্রণা এ এক।

ভোররাতে সে রুম থেকে বেরিয়ে দুই জগ পানি ভরে নিয়ে সোজা বড়ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। মেঝের ওপর ক্লান্ত দেহগুলো ছিটিয়ে পড়ে আছে। ক্লান্ত, অভুক্ত, ক্ষততে ভরা দেহগুলো ঘুমিয়ে আছে ওভাবেই। জেগে আছে তিনজন। কীসের যেন এক আলোচনা চলছিল, হামজার উপস্থিতিতে চুপ হলো সকলে।

জগদুটো রেখে হামজা বসল মোড়া টেনে নিয়ে। মুরসালীনকে বলল, “পানি খাবে?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দিলো না। চুপচাপ চেয়ে রইল। হামজা ক্লান্ত স্বরে বলল, “জেদ কমেছে?ʼʼ

মুরসালীন হাসে, “জেদ? উহু! আগুন, হামজা ভাই, খড়ের গাদায় লাগা আগুন। যা শুধু ধিকধিক করে বাড়ে। সাতটা বছর ধরে জমছে ছাইগুলো, নেহাত কমার তো না, কী বলেন? ভাই হারিয়েছি, বোন হারিয়েছি…ʼʼ

কথা কেড়ে নিলো হামজা, “ওরকম ছাই সবার ভেতরেই চাপা আছে। টুকটাক চাপা থাকা ছাই ভেতরে জমা ভালোই তো।ʼʼ


প্রতিটা গোয়েন্দা সংস্থা, লোকাল থানা, আইনি কার্যালয়—সবখানে, এমনকি রাস্তায় লোক নিযুক্ত করা। পুলিশ কোনোভাবে পলাশের এই বাড়ির দিকে ভিড়লেই খবর চলে আসবে।

সেদিন রাতে হামজা এসবিকে সুন্দর একটা তথ্য জানিয়ে রেখেছে কল করে। বলেছে, “পলাশ আজগর, দ্য মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল আইনের হাত থেকে বেঁচে দেশের সীমান্তে অবস্থান করছে। সুযোগ বুঝে ওপারে পাড়ি দেবে। আপনারা সীমান্ত এলাকাগুলো কড়া নজরদারীতে রাখুন।ʼʼ

আইন কর্মকর্তাদের ধারণা, তাদের তিনজন কর্মকর্তাকে
খু/ন করেছে পলাশ আজগরের লোক, এরপর তাদেরকে ঘোল খাইয়ে পালিয়েছে। এখন দেশ ছাড়ার মতলব। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ঝেপে পড়েছে তারা পলাশের পেছনে। কোনোভাবেই সীমান্ত পার হতে দেয়া চলবে না। হামজা পলাশকে ইচ্ছেমতো খাতির করার সময় পেল এতে।

সারাদিন রান্নাবাড়া করে, সকলকে খাইয়ে কাহিল অবস্থা জয়ের। সাদা লুঙ্গির ওপর কোমড়ে লাল গামছা বাঁধা, সাদা লুঙ্গি নোংরায় জর্জরিত। খাঁটি বাবুর্চি লাগছিল দেখতে। একটু পর পর গামছায় ঘাম মুছছে। সকলের খাওয়া হলো, সে তখনও অভুক্ত। প্রতিটা আয়োজনে তার সঙ্গে এটা হয়। এমনও হয়, সকলকে পেটপুড়ে খাইয়ে তার জন্য অবশিষ্ট কিছু বাঁচেনা। এটা তার রীতি। নিজের পেট ভেসে যাক, মেহমানদের কমতি রাখা যাবে না।

দুজনের গোসল-খাওয়া কোনোটাই হয়নি। রূপকথা সন্ধ্যার পর জয় ও পরাগকে খাইয়ে দিতে বসল। খাওয়া হলো না শুধু পলাশের।

সবে পরাগ দুই লোকমা ও জয় এক লোকমা খাবার গালে পুড়েছে, তখনই গুলির শব্দ এলো। অর্থাৎ, দারোয়ান বসির শেষ! ভাতটুকু না চিবিয়ে বরং থুহ করে ফেলে দিলো জয়। সময় নেই খাওয়ার। দৌঁড়ে ভেতরে গিয়ে পিস্তল ও কুড়ালটা বের করে নিয়ে বাহির আঙিনার দিকে চলে গেল। ছেলেরা তখন সিগারেট ফুঁকতে গেছে কোথাও। পরাগ দৌঁড়াল জয়ের পেছনে।

ছয়জন মুখোশধারী আততায়ী। পলাশের শুভাকাঙ্ক্ষীর এক ঝলক। ছয়জন ছয়দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। জয়ের সঙ্গে প্রথমে যার দেখা হলো, কুড়ালের আঘাতে তার হাত কাধ থেকে নেমে গেল। চিৎকারটা মিলিয়ে গেল। এত নির্জন একটা জায়গা! বিশাল এরিয়াটার গোটাটাই পলাশদের দখলে। ভুলেও কেউ পা দেয়না দূর-দূরান্ত অবধি। গাঙটা লাশের স্তুপ, তা জানে লোকে।

পরাগ পেছনের দিকে গেল। নৌকা বয়ে গাঙের কিনারা ঘেঁষে উঠে এসেছে তার সামনে দুজন।

বাকি তিনজন তখন বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। জয় দ্রুত ভেতরে ঢুকল। ওদের টার্গেট পলাশকে মুক্ত করা। এটা বুঝতে জয়ের যতটুকু দেরি লাগল, ততক্ষণে অন্তূর গলায় ড্যাগার ধরেছে ওরা। অন্তূকে জিজ্ঞেস করে, “পলাশ কই?ʼʼ

অন্তূর মনে হচ্ছিল, এ যেন সিনেমা! বলল, “আমি জানিনা। আমি এসেছি গতকাল রাতে। আপনারা কি পলাশকে মারতে এসেছেন?ʼʼ

একজন অন্তূর গলা টিপে ধরে খেঁকিয়ে উঠল, “বেশি কথা কস? নাটক করবি না, বল পলাশ ভাই কই?ʼʼ

অন্তূ দেখল, ওরা প্রচণ্ড উত্তেজিত। যখন-তখন ছুরি চালাবে সন্দেহ নেই। বলল, “উপরতলায় আছে। উপরতলার তিন নম্বর রুমে। দরজা খোলাই আছে, একটু আগে দেখে এসেছি আমি।ʼʼ অন্তূ আদতেও জানেনা, উপরতলায় তিন নম্বর রুম বলতে কিছু আছে কিনা! সে উপরতলায় ওঠেইনি আসার পর থেকে। পলাশ মূলত বেসমেন্টে আঁটক।

দুজন উঠে যায় উপরতলায়। একজন অন্তূকে আঁটকে রাখল। রূপকথা আছে উপরতলায়। অন্তূ আড়চোখে তাকায় একবার। ড্যাগারের চোখা মাথাটা অন্তূর গলার চামড়া ছিড়ে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। তীব্র জ্বলুনি হচ্ছে। অন্তূর মাথা আর কাজ করছিল না। যেহেতু ওরা বাড়ি অবধি চলে এসেছে, অন্তূকে মেরে ফেললেও ওরা ঠিক পলাশকে ছাড়াতে পারবে।

তখন জয় ঢুকল। জয়কে দেখেই লোকটা খপাৎ করে অন্তূর চুল মুঠো করে ধরল। ড্যাগার আরও একটু শক্ত করে চাপলো কণ্ঠনালির ওপর, জয়কে বলল, “আর এক পা এগোবি তো…

-“উহুম! মেরে ফেল্।ʼʼ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু হাত উঁচু করে ধরল, ”বন্দুক থাকলে শ্যুট করে দে, ভাই। টপকে দে শালীকে। শালী চরম বেইমান। আমার খায়, আমার পড়ে, আমার পেছনেই বাঁশ নিয়ে দৌঁড়ায়। ও বেঁচে থেকে লস ছাড়া লাভ নাই আমার। খুলি-টুলি উড়িয়ে দে একদম।ʼʼ

লোকটা এক মুহুর্তের জন্য থমকালো এতে। তা যথেষ্ট। জয় অন্তূর দিকে কেবল একবার তাকাল এক মুহুর্তের জন্য। এরপর গুলি চালালো, ঠ্যাং বরাবর। লোকটা ব্যথায় ছিটকে ওঠার সময় ছুরির আঘাত লাগতো, লাগল না। অন্তূ জয়ের ট্রিগার লক্ষ করে মাথা পিছিয়ে নেয়। জয় এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে হাসল, “দুনিয়ায় গাছের চাইতে বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বেড়ে গেছে রে মনসুর! এটা কি ঠিক? হামজা ভাই তোরে কত বছর পালছে। পলাশ তোরে কোন তাবিজে কিনছে, বাপ?ʼʼ জয় লোকটার মুখ বাঁধা থাকার পরেও কণ্ঠ চিনল।

কুড়ালের এক কোপে মাথাটা ঘাঁড় থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেল। এক ঝটকা রক্ত মুখে ছিটে এলো জয়ের। বুকের পশমের ফাঁকে রক্তের দানা আঁটকে রইল।

পরাগ ভেতরে উঠে আসে। ক্ষ্যাপা দুটো নেমে এলো উপরতলা থেকে। অন্তূকে পেলে এবার বলি দেবে, এমন মনোভাব। কিন্তু পরাগকে দেখে থমকে গেল, ওরা পরাগকে এখানে আশা করেনি। জয়ের দিকে নজর যেতেই মুখ শুকিয়ে এলো। রূপকথা নেমে আসল, “পলাশ এখানে নেই। ওপর থেকে শুনে এলে না আমার মুখে?ʼʼ

ওরা আজ আর মালকিনকে পরোয়া করছে না। রূপকথাকে হাতের কাছে পেয়ে ওকেই জিম্মি বানালো। এটা পলাশের অর্ডার। পলাশের বউ পলাশের দুশমন। বউকে ছাড় দিয়ে লাভ নেই।

দুজন রূপকথাকে অস্ত্রের তলে ধরে পিছিয়ে গেল কয়েক কদম। জয় আঙুল ঢুকিয়ে দাঁত থেকে মাংসের টুকরো বের করছে। ওরা সতর্ক দূরত্ব বাড়িয়ে একটা ছুরি ছুঁড়ে মারল জয়ের দিকে। জয় তড়াক করে ছুরিয়ে দিকে পরাগকে ধাক্কা মেরে নিজেকে বাঁচায়। পরাগের হাতে লাগল ছুরি। এরপর দুটো মোট তিনটা লাশ পড়ল মেঝেতে।

অন্তূর ওড়না টেনে নিয়ে দাঁতের রক্ত মুছল জয়, “বিশ্রী স্বাদ এই শালাদের র-ক্তেও, ঠিক বলিনি, পরাগ?ʼʼ

পরাগ বদলে বকে উঠল, “তোর রক্তের চেয়ে অন্তত ভালো স্বাদ।ʼʼ

জয় ভাব নিয়ে ঠোঁট বাঁকায়, “রক্তটা আমার বলে কথা। কিন্তু কথা হইল, তুমি টেস্ট কবে করছো , ভাই ফ্রগ?ʼʼ

ফ্রগ শব্দের অর্থ–ব্যাঙ। পরাগ থেকে ফ্রগ, জয়ের আবিষ্কার এসব। পরাগ হাসল, “তোমার পেছন যে মারব আমি, বাট দ্য লেডিস ইন ফ্রন্ট অফ মি…ʼʼ রক্তে শার্ট ভিজে উঠেছে পরাগের।

অন্তূর ওড়না হাতের এক ছোট্ট ক্ষততে প্যাঁচাচ্ছিল জয়। তাতে অন্তূর গায়ের ওড়না সর আসছে। অন্তূ হেঁচকা এক টান মারল ওড়নায়, পড়তে পড়তে বাঁচে জয়। একটা থাপ্পড় তুলল অন্তূর দিকে, আবার মারল না।

খানিক আগে অল্প খাবার খেয়ে বমি করেছিল অন্তূ। মুখটা শুকনো।

অন্তূকে বেসমেন্টের সামনে এনে বলল, “একটা মজার জিনিস দেখাই চলো। তারপর বাড়ি কেন, জাহান্নামে যেতে চাইলেও দুইজন একসাথে পাড়ি দেব সেই পথ! আফটার অল তুমি আমার ঘরের শালী!ʼʼ

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালায় জয়। অন্তূ সোজা হয়ে দাঁড়াল। কেউ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের শুকনো দাগ। পায়ে তার শিকলের বেড়ি।

জয় এগিয়ে গিয়ে লাত্থি মেরে দেহটা উল্টে চিৎ করল। অন্তূর শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে শিউরে ওঠে। পলাশের ছেঁড়া-ফাঁড়া দেহ। ছ্যাঁচড়ার মতো হাসল পলাশ। প্যাচপ্যাচে হাসি। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সরু নাকের পাটার নিচে শুকনো রক্ত। হাত তুলে যখন অন্তূকে ঈশারা করল, অন্তূর গা-টা ঘিনঘিনিয়ে উঠল। ওর পুরো হাত ঠেতলে গেছে। আধমরা হাল। এতটা বেহাল অবস্থায় কেউ জীবিত থাকতে পারে? শরীরের থকথকে ঘা-গুলো থেকে কষানি ও পুঁজ ঝরছে, কোথাও কোথাও জমে আছে। জীবন্ত মাংসে পোকা হলে যেমন গলে গলে পড়ে, কষানি জমে ক্ষতগুলো সেইরকম দেখাচ্ছিল।

অন্তূ নিজের অজান্তে দু-কদম পিছিয়ে গেল। আব্বুর সেই চেহারাটা মনে পড়ল। ছেঁড়া শার্ট, ঠেতলে যাওয়া মুখ, কানের কাছে সিগারেটের আগুনের পোড়া, শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়া অসংখ্য ক্ষত….অন্তূ চোখ বোজে। কী আশ্চর্য! অন্তূর শরীরটা কাঁপছে, চোখ ভরে আসছে! আব্বুর কানে যখন সিগারেটের আগুন চেপে ধরা হয়েছিল, পুড়েছিল জায়গাটা, আব্বু কি চিৎকার করেছিল ব্যথায়!

চোখ খোলে অন্তূ। সেই তো কতদিন আগের ব্যথা, আব্বু নেই, এর মাঝে অন্তূর সাথে কত কী হয়েছে, কত সহনশীলতা এসেছে অন্তূর মাঝে, তবু কেন সইছে না!

তরু! ব্লেডে ছিন্নভিন্ন শরীর, দু’পায়ের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে মেঝে ভেজানো পাঁজা ধরা রক্তের স্রোত, নগ্ন শরীর। মুমতাহিণার খুবলে খাওয়া অর্ধপঁচা নষ্ট শরীর…

জয় আরাম করে একটা চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। মুখে রক্ত লেপ্টানো। কবীর পলাশকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বাঁধে। বেশ শক্তিশালীই লাগছিল তখন পলাশকে। হাসছে, দূর্বল চিত্তে ওমন বিশ্রী হাসি অদ্ভুত দেখায়।

অন্তূ তাকায় জয়ের দিকে। জয় স্থির চোখে ইশারা করে পলাশের দিকে, এগিয়ে যেতে বলে। তাতে কীসের যেন প্রশ্রয়, বহুদিনের পরিকল্পনা বোধহয়, অন্তূর জন্য এক উপহার নাকি? ঠিক যেমন বাচ্চার জন্মদিনে অভিভাবক দিয়ে থাকে, জয় সেভাবেই ইশারা করল উপহারের বাক্সের দিকে।

অন্তূ বিক্ষিপ্ত ভারী শ্বাস ফেলে। নাক শিউরে ওঠে তার, গলার ভেতরে দলা পাকায়। অন্তূ এগিয়ে যাবার সময় জয় একহাতে সিগারেট ঠোঁটের ভাজে ধরে অন্যহাত দিয়ে অন্তূকে সেই কুড়ালটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “জানটা আমার জন্য রেখো।ʼʼ

অন্তূ এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে এলো। শরীর কাঁপছে তার। হাতে বল নেই। তার হাত এখনও বুঝি মানুষ খুন করার মতো অথবা পৈশাচিক যন্ত্রণা দেবার মতো শক্ত হয়নি! অন্তূ হতাশ হয়, তার হাতে এখনও নমনীয়তা অবশিষ্ট। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে পিছিয়ে এসে জয়ের হাতে কুড়াল ফিরিয়ে দেয়।

জয় হাসল। সে জানতো এমনটা হবে। নয়ত কেউ কুড়াল হাতে তুলে দিয়ে শিকারের জান রক্ষার আশা করতে পারে? শেষ একটান দিয়ে গোটা অর্ধেক চুরুটটাই ফেলে দিলো। চোখে-মুখে লেগে থাকা রক্ত তখন জমাট ধরেছে। কবীর একটা বাক্স নিয়ে এলো। তাতে হাতুর, বাটাল, ছেনি, র‌্যান্স, স্ক্রু ড্রাইভার ইত্যাদি সব যন্ত্র মজুত।

পলাশের দুই হাতের পেরেকের আঘাতের জায়গাগুলো পঁচে-গলে পড়ার মতো থকথকে। হাত দুটো যেন আগুনের আঁচে বেশ যত্ন করে ঝলসানো হয়েছে, অবর্ণনীয় সাঁজা।

সেই হাতদুটোকে জয় ইস্পাতের বীমের ওপর রাখে। মানুষের হাতের প্রতিটা আঙুলে তিনটা করে হাড়ের সন্ধি থাকে। জয়ের লোহা পেটানো হাত। হাতুর দিয়ে লোহা পিটিয়ে সোজা করার মতো পিটিয়ে পিটিয়ে পলাশের হাতের একেকটা গিড়া ছুটালো। কী যে আর্তনাদ আর চিৎকার সেসব। রূপকথা ছুটে এলো। দরজার কাছে দাঁড়াল। ওকে দেখে পলাশ কয়েক মুহুর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। জয় যখন আরেকটা আঙুলের সন্ধিতে আঘাত হানে, আবার সেই চিৎকার! রূপকথা এবার চলে গেল, একবার পেছন ফিরে তাকালো, আবার চলে গেল। পলাশ তাকিয়ে দেখল তা।

দুই হাতের ত্রিশটা অস্থি-সন্ধি, তালুর সাথেকার আঙুলের সন্ধি, শেষ অবধি কব্জিসন্ধিটা। খুব যত্ন করে সেগুলো ভাঙল জয়। হাতদুটো লুলা হলো পলাশের। শুধু চামড়ার সাথে ঝুলে রইল। কোথাও কোথাও ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। জয়ের হাত ঢেকে গেল সেই নতুন তরল রক্তে। জয়ের মনে হলো, এই রক্তটুকু বোধহয় তরুর রক্তের ওপর পড়লে তরুর রক্তের স্রোত থামতো, ধুয়ে যেত সবটা।

পলাশের চিৎকারে কবীর হাতে কান চাপে। ওমন পৈশাচিক যন্ত্রণাকাতর চিৎকার সহ্য করা যায়না। মনে হচ্ছে, নরকের দূত যেন কোনো পাপীকে তার কর্মফল দিচ্ছে, এত্ত ভয়াবহ কাতর চিৎকারে মানসিক অবস্থা বিগড়ে যায় মানুষের। অন্তূর এলোমেলো শ্বাস উঠেছিল। পলাশ চিৎকার করছিল। অথচ অন্তূ শুনল, আমজাদ সাহেবকে পলাশ মারছে, সিগারেটের আগুন চেপে ধরে কান ঝলসাচ্ছে, আমজাদ সাহেব আর্তনাদ করছেন, কেউ নেই বাঁচানোর সেই আওয়াজগুলো অন্তূ শুনতে পাচ্ছিল।

এক সময় মস্তিষ্কের উন্মদনা আর সইতে না পেরে জোরে করে চেঁচিয়ে উঠল অন্তূ কানে হাত চেপে। পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে ছটফট করল। জয় হাতুর ফেলে দৌড়ে উঠে আসে। আগলে ধরে অন্তূকে, শান্ত করার চেষ্টা করে। অন্তূ চোখ-মুখ খিঁচে বুজে হাউমাউ করে কাঁদছে, ‘আব্বু আব্বুʼ করে ডাকছে, যেমনটা বাচ্চারা ঘুম ভেঙে মাকে ডাকে। জয় অস্থির হয়ে উঠল, সামলানো যাচ্ছিল না অন্তূকে। পলাশ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। কবীরের মনে হলো, পলাশের চিৎকার তার ভালোই লাগছিল এতক্ষণ, কিন্তু বুক ফাটা কান্নাটা অন্তূ কাঁদছে। কবীর টের পায় তার চোখ ভরে উঠেছে। এত করুণ শোনায় কোনো মেয়ের কণ্ঠে বাপের নাম ধরা কান্না!

জয় নিজের রক্তমাখা হাতদুটো অন্তূর গালে রেখে ছোট বাচ্চা বোঝানোর মতো বলে, “ঘরওয়ালি, তাকাও। শোনো, আমি আছি। কিচ্ছু হয়নি। আমার বাপ-মা কোনোদিনই নাই। আমার কেউ নেই। মরে গেছি আমি? ওসব বালের ঝামেলা না থাকলেই ভালো, বিন্দাস লাইফ। চুপ করো। তোমার কাছে আমি আছি আপাতত। শোনো, আরমিণ! ঘরওয়ালি…ʼʼ

অন্তূ আরও বেসামাল হয়ে ওঠে, পলাশের দিকে ইশারা করে, “ও আমার আব্বুকে মেরেছিল, আপনি সেদিন কিচ্ছু. …

কথা শেষ হয়না, রক্তমাখা ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে একটা চুমু খায় জয় অন্তূর ঠোঁটে। ঠোঁট সরাতেই অন্তূ আবার ছটফটিয়ে ওঠে, “আপনি ছিলেন ওখানে, তবু কিচ্ছু করেননি, আমার কেউ নেই, সুযোগ আসলে আমি আপনাকে….ʼʼ

জয় এবারও কথা শেষ করতে দেয়না। অন্তূর চোয়ালদুটো দু-হাতে চেপে ধরে আবার ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে থামায়। এবার আরও গাঢ় ছিল সেটা। জয়ের ঠোঁটের জমাট রক্ত অন্তূর ঠোঁটে লাগে। অন্তূর ছটফটানিতে ওড়না পড়ে যাচ্ছিল কাঁধ থেকে। অন্তূ কাতরাতে কাতরাতে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাগলের মতো, “আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। সবাই যেভাবে শেষ হচ্ছে, আপনিও হবেন, ওদের থেকে আলাদা নন আপনি…ʼʼ

জয় রক্তমাখা হাতে অন্তূর ওড়না তুলে কাধে জড়িয়ে দিয়ে আঁকড়ে ধরল অন্তূকে ঠোঁট দিয়ে। জয়ের উন্মাদনায় অন্তূ পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে ছারখার দুজন তখন। অঝোরে কাঁদছে অন্তূর চোখদুটো। জয় ছাড়ল না আর তৃতীয়বার। তার চটা ভ্রুতে রক্ত, মুখের সিংহভাগ রক্তে জর্জরিত। সেই অবস্থায় অন্তূকে তৃতীয়বারে এতটা শক্ত করে চেপে ধরে চুমু খেল, অন্তূর দেহটা আড়াল হয়ে গেল জয়ের শরীরের বাঁধনে। চোখদুটো খিঁচে বুজে রইল। পানি খাওয়ার মতো অন্তূর দুঃখটুকু শোষন করল জয়। টপটপ করে পানিগুলো অন্তূর গাল বেয়ে পড়ছিল, জয় তার তোয়াক্কা না করে গিলল সবটা। বারবার দুইগালে হাত বুলায় জয়। অন্তূ থামছে না। কান্নার তোড় বাঁধ ভাঙা, উপচে পড়া বিক্ষিপ্ত স্রোতের মতো। সেই উন্মাদ স্রোতের বাহ্যিক কঠিন, আর অভ্যন্তরীণ দুর্বোধ্য এক বাঁধ তখন জয় আমির।

কবীর মলিন হাসে। তার কাছে দৃশ্যটা সেদিন রোমান্টিক লাগেনি। মনে হয়েছে, এ এক মহাবিচ্ছেদের ক্ষণ বুঝি! কী আশ্চর্য! এটাকে কেউ মহাবিচ্ছেদ বলতে পারে বুঝি!

যেখানে জয় আমিরের মতো এক জন্মগত ছিন্নভিন্ন প্রলয়ঙ্কর ঢেউ, তার নিজস্ব প্রবাহে ছুটে গিয়ে কোনো বিক্ষিপ্ত নদীকে আলিঙ্গন করছে, তার অতল গহ্বরে একবার ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের তলহীন তলদেশ দেখিয়ে বলছে, ‘আমি এক চির শূণ্যতর কৃষ্ণগহ্বর, তার গভীরতা অসীম, সেই অসীমতায় তোর দুঃখ কেন আরমিণ, গোটা বিশ্ববহ্মাণ্ডকে তলিয়ে নিতে পারি।ʼ

অন্তূ সেদিন এক সময় এলোমেলো হয়েছিল। শক্ত হাতে বাঁধা দেওয়া হাতদুটো নরম করে গুটিয়ে জয় আমিরের রক্ত মাখা শার্টটা আঁকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদেছিল। বলেছিল, “আমি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না, জয় আমির। যেমন ওরা পায়নি শেষ অবধি, আপনিও প্রকৃতির কাছে ক্ষমা পাবেন না অন্তত।ʼʼ

জয় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরেনি সেদিন। জড়িয়ে নেবার সম্পর্ক তো নয় তাদের। অন্তূ হিংস্র হাতে জয়ের শার্ট খামছে ধরে বুকের ওপর কপাল ঠেকিয়েছিল। রক্তমাখা জয় আমির তখন বেসমেন্টের নষ্ট ব্যাটারীহীন ঘড়ির দিকে চেয়ে ছিল অপলক।

পরাগ জয়কে মারতে এলো। দৃশ্যটা দেখে আলতো হাসল। কবীর তার দিকে তাকিয়ে হাসল, এরপর বেরিয়ে গেল বেসমেন্ট থেকে।

জয়ের ফোন বাজছিল বিগত পাঁচ মিনিট ধরে। কবীর ফোন এনে দিলো। অন্তূর পাশে বসে একগ্লাস পানি দিয়ে বলল, “ভাবী, পানি খান। অল্প একটু খান। আপনার শরীর তো ভালো না এমনিই।ʼʼ

কল রিসিভ করতেই হামজার দারাজ গলা ভেসে এলো, “এই শুয়োরের বাচ্চা। কোথায় মদ গিলে পড়ে আছিস? হুশ থাকেনা?ʼʼ

জয় গম্ভীর হয়ে বলল, “এমনও তো হতে পারে, হানিমুন যাপন করছিলাম। জোয়ান ভাই বউ নিয়ে ঘুরতে এসেছে, আক্কেল নাই তোমার?ʼʼ

হামজা এই রসিকতায় আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল, “জানোয়ারের বাচ্চা, তোর আব্বারা দেখ মনেহয় এতক্ষণে পৌঁছে গেছে গাঙের কূলে।ʼʼ

শুধু রূপকথা থাকল সেখানে। সবাই বেরিয়ে পড়ল উল্টো পথ ধরে। পলাশকে পেছনের ছিটে শুইয়ে দেয়া হলো। পরাগ অন্য পথে গেল। জয় অন্তূ, কবীর ও পলাশ এক গাড়িতে গেল।

গাঙের কূলের রাস্তায় কোথাও কোথাও হাঁটু পানি। শ্মশানের পাড় ঘেঁষে পরিত্যক্ত এলাকা। এরপর শুধু ইটের ভাটা, মেল-কারাখানা এসব। রাত দশটাকে মনে হচ্ছে মাঝরাত। জনশূন্য পথঘাট। ধীরেধীরে ওরা আরও ভয়বহ এলাকার দিকে পাড়ি দিচ্ছিল।

কাঠের মিল অনেকগুলো এবার। আলোও কম সব ওদিকে। ঘন জঙ্গল, ও বিস্তর মাঠ। শনশনে মাঠ। অভিশপ্ত এক রাত। কবীরকে গাড়ি চালাতে দিয়ে পলাশকে জাগাতে চেষ্টা করল জয়।

গাড়ি এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে কোনো আশ্রয় খুঁজতে গেল জয়। এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে বড়জোর আধাঘন্টার মধ্যে পুলিশের হাতে পড়তে হবে নির্ঘাত। কোনো বসতিতে ঢুকে পড়ার চেয়ে ভালো কাজ নেই এই মুহুর্তে।

সব মিল মালিকেরা দূরবর্তী। চৌকিদাররা পাহারায় আছে। পাহারা বাদ দিয়ে ঝোপে-ঝাড়ে গাঁজা টানতে বসেছে সব। এখানে বসতি নেই। বহুদূর পর পর বসত বাড়ির মতো। জয় কয়েকটা বাড়িতে গেল, কিন্তু ডাকতে দ্বিধা হলো। তার ওপর তার পরনের শার্ট-লুঙ্গি, মুখ-গলা রক্তে মাখামাখি। পিস্তল দেখিয়ে আশ্রয় আদায় করা ছাড়া উপায় নেই। পিস্তল বের করে তা মিছেমিছি লোড করল। বুলেট নেই কাছে। ম্যাগাজিনও খালি।

কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে একটা ছোট্ট টিনের বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকল। একজন মহিলা বেরিয়ে এলো। অন্ধকারে কেউ কারও মুখ চিনছিল না। মহিলা ভেতরে আলো আনতে গেল বোধহয়। জয় হাত পিছমোড়া করে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা ডানহাতে রাখল। তার যা অবস্থা, তা দেখে যেকোনো মহিলা ভয়ে একটা কান ফাটানো চিৎকার পাড়বেই পাড়বে।

চলবে…

[অসংখ্য ভুলত্রুটি আর টাইপিং মিসটেক আছে। রি-চেইক করার সময় পাইনি। ভুলত্রুটি সব ক্ষমা করবেন। আপনাদের যা তাড়া…আর আমিও কথা দিয়েছিলাম। মন্তব্য করবেন বড় বড়😒]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here