#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬৩. (বর্ধিতাংশ)
বিয়ের কমবেশি ছয়মাস পর অন্তূ প্রথমবার হামজার কাছে ভার্সিটি যাবার অনুমতি পেয়েছিল। একদিন জয় সঙ্গে নিয়ে কিছু বই কিনে দিয়েছিল, আর এরপর আবার।
অনুপস্থিতি ও বিস্তর পড়ালেখার ঘাটতি পড়ে গেছে। জয় কোথাও গেছে। তার কত কাজ থাকে চারদিকে!
কবীর ড্রাইভিং করতে করতে হঠাৎ-ই বলল, “ভাবী!ʼʼ
-“হু।ʼʼ
-“একটা কথা।ʼʼ
-“বলুন।ʼʼ
-“আপনে কি আমারেও ঘেন্না করেন?ʼʼ
-“আর কাকে কাকে করি?ʼʼ
কবীর থতমত খেলো একটু, পরে বলল, “জয় ভাইয়ের ওপর আপনার ঘেন্না আছে। আমি জানি।ʼʼ
-“ভুল জানেন।ʼʼ
কবীর চকিতে পেছন ফিরে তাকাল। অন্তূর অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত।
-“আপনি খুব অদ্ভুত।ʼʼ
-“তাই নাকি?ʼʼ
কবীর আবার তাকাল একবার। অন্তূ বলল, “সামনে তাকিয়ে ড্রাইভিং করুন। নয়ত দুজনেই সোজা পরকালে পৌঁছে যাব।ʼʼ
কবীর একটু লজ্জিত হাসল, “আমি কত বেয়াদবী করছি আপনের সাথে।ʼʼ
-“ও কিছু না। ক্ষমতার দাপটে কতকিছু করে লোকে। ওসব আমাদের ধরতে আছে নাকি? ধরে কত খেসারত গেল, দেখেছেন? আপনি কিছু করেন নি, করেছে আপনার ক্ষমতা। আর আপনার ক্ষমতা কী, কে জানেন তো!ʼʼ
কবীর অবাক হয়ে যাচ্ছিল নতুন করে। এই নারীটির জন্য তার খারাপ লাগে, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, তবু সত্যি। যেদিন জয় নারীটির সম্মানকে মানুষের মাঝে হরির লুটের মতো বিলিয়ে দিচ্ছিল, সেদিনও কবীরের এক অদ্ভুত জ্বালা উঠেছিল বুকে। আবার এটাও সত্যি সে জয়কে অন্ধের মতো ভালোবাসে। কিন্তু জয় খারাপ কাজ করলে তার খারাপ লাগে, তবু বাঁধা দেয়না।
ভার্সিটির ফটকের সামনে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত এলো কবীর গাড়ির দরজা খুলে দিতে। অন্তূ নিজে দরজা খুলে নেমে বলল, “এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখাবেন না আমার সঙ্গে। আমি বিশেষ কেউ নেই। আগে যেই ভার্সিটি পড়ুয়া এক সাধারণ মেয়ে ছিলাম, আজও তাই আছি। কোনো পাপীষ্ঠর ঘরের বউ হওয়াটা সম্মানের নয়।ʼʼ
কবীর মাথা নিচু করে আস্তে করে বলল, “আমি ক্লাস শেষে নিতে আসব।ʼʼ
-“আসবেন।ʼʼ
অন্তূ ভেতরে চলে গেল। কবীরকে দেখে ছেলেরা এগিয়ে এলো, জয় আমিরের খোঁজ চাইল। কবীর তাকিয়ে দেখল অন্তূকে।
—
পরাগের সামনে চারজন কর্মকর্তা বসা। দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। আজিম মালিথা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ভাইয়ের প্ল্যান কী ছিল?ʼʼ
-“আউটডোর।ʼʼ
-“দেশের বাইরে আছে?ʼʼ
-“না। প্লান তাই ছিল।ʼʼ
-“তাহলে এখন?ʼʼ
-“বেঁচে নেই হয়ত।ʼʼ
একে অপরের দিকে তাকাল, “বেঁচে নেই মানে?ʼʼ
-“মানে মরে গেছে।ʼʼ
-“ইয়ার্কি মারছেন?ʼʼ
পরাগ হাসল, “রিমান্ডে বসে কেউ ইয়ার্কি মারে না।ʼʼ
-“ওকে মেরেছে কে?ʼʼ
-“তা তো বলতে পারি না।ʼʼ
-“পারেন না? পারবেন, পারবেন। কত না পারা-পারা হয়ে যায় এখানে।ʼʼ
পরাগ চুপ রইল।
-“তাহলে এটা কীভাবে বলতে পারেন, বেঁচে নেই।ʼʼ
-“না থাকারই কথা।ʼʼ
-“আপনি সিওর?ʼʼ
-“ওরকমই।ʼʼ
হাসল কর্মকর্তারা। আজিম অদ্ভুতভাবে মাথা দোলালেন, “মানুষ যেকোনো বিষয়ে দুই শর্তে নিশ্চিত থাকে। এক, সে ঘটনাটা নিজে চোখে দেখলে। দুই, কাজটা সে নিজে করলে।ʼʼ
পরাগ নির্বিকার বসে রইল। আজিম হাসল, “আপনার ক্ষেত্রে প্রথমটা হবার চান্স নেই। কারণ আপনি সেই রাত থেকেই আমাদের হেফাজতে। হাত থেকে রক্ত পড়া অবস্থায় আপনাকে আঁটক করা হয়েছে। এখন বাকি থাকে দ্বিতীয়টা।ʼʼ
-“পলাশ আজগরকে আমি মেরেছি?ʼʼ
-“সেটা তো আপনি বলবেন আমাদের।ʼʼ
“না, তা বলব না।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
-“মিথ্যাচার হবে।ʼʼ
উঠে দাঁড়ালেন আজিম, “নাটক পছন্দ না আমাদের। হেঁয়ালি শোনার চাকরি করিনা আমরা।ʼʼ
পরাগ হাসল, “এমন আরও কত কিছুই করেন, যেসবের চাকরি করেন না আপনারা। বরং সেসব চাকরির দায়িত্বের বিরোধ। এটাও শুনুন নাহয়, স্যার। ভালোই তো।ʼʼ
পরাগের ঘাঁড় বরাবর একটা বুটের লাত্থি পড়ল। মনে হলো, গলার কোনো শিরা বুঝি ছিঁড়ে গেছে। চোখ অন্ধকার হয়ে এলো।
-“যা জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তার জবাব দে, বাইঞ্চোদ।ʼʼ
পরাগ অল্প হাসল। দাঁত নড়ে গেছে কয়েকটা। মাড়ি ফেটে নোনতা রক্তে গাল ভরা। গিলতেও ঘেন্না লাগছে। তবু গিলে ফেলে হাসল, “ওকে মারার কারণ ছিল আমার কাছে, তবে আমার থেকেও জোরালো কারণ থাকা মানুষের তো অভাব নেই পলাশের। তাই আমার চান্সটা মিস গেল।ʼʼ
-“ঘরের শত্রু বিভীষণ। তোর মতো ছোট ভাইয়েরা কি জন্মায়ই রাবনদের পেছনে আঙুল দেবার জন্য রে?ʼʼ হাসল ওরা।
পরাগ মাথা নিচু করে আলতো হাসল। তা দেখা গেল না। থুহ করে থুতু ফেলল। থুতুর সাথে র-ক্তের ভাগ বেশি। চুল মুঠো করে ধরে মুখ তুলল অফিসার। ঘাঁড়টা মট করে উঠল পরাগের।
অফিসার বলল, “চান্স মিস যায়নি। হয়ত তুই হাতে মারিসনি, কিন্তু মার্ডারারকে সার্বিক সহায়তা তো করতে পারিস? কে মেরেছে, তার নাম বল। যে মেরেছে, সে-ই সেদিন পলাশকে উদ্ধার করেছে। এখন বুঝতে পারছি, সেদিন ওগুলো পলাশের লোক ছিল না। ওরই শিকারী ছিল। আমি নিশ্চিত, এমনই হয়েছে।ʼʼ
পরাগ মনে মনে প্রশংসা করল কর্মকর্তার আন্দাজ ও বুদ্ধির। তবু আফসোস। এই রকম বুদ্ধি জায়গামতো প্রয়োগ করেনা।
পরাগকে চুপ থাকতে দেখে হতাশ শ্বাস ফেলে ক্লান্ত হয়ে বসল অফিসার। প্লাস তুলে নিয়ে পরাগের ডান হাতের তর্জনী আঙুলে ঠেকিয়ে বলল, “বলে দে। টর্চার করার বিশেষ শখ নেই আমাদের। সেদিন দুজন কর্মকর্তার স্পটে মৃত্যু হয়েছে। শুধু নামটা বল। ধরে গরম তেলে ভাজবো, ওই বাস্টার্ডের বডিটারে।ʼʼ
পরাগ চুপ। নখের মাথায় প্লাস বাঁধিয়ে একটানে নখটা তুলে আনলো আঙুলের মাথা থেকে। আর্তনাদ করে উঠল পরাগ। শরীরটা বেঁকে এলো। এর চেয়ে মরণ ভালো। শরীরের যন্ত্রণায় মাথাটা ঝিমিয়ে আসছে। তার মা-টাকে পলাশ কোথায় যেন লুকিয়েছে। ভয় ছিল, পুলিশের কাছে সব গটগটিয়ে বলে দেবে। পরাগের চোখের সামনে ভেসে উঠল সালমার মুখটা।
সে মাকে ভালোবাসে খুব, এমন নয়। তবে মা তাকে ভালোবাসে। যখন পরাগ মুস্তাকিন বনেছিল, তখন রোজ কল করে খবর নিতো, ঢাকায় থাকতেও তাই। সে যখন পলাশের পাপের দায়ে জেল খেটেছে, সালমার অনুরোধে রাজন আজগর জামিন করেছিল পরাগের।
অফিসার বলল, “যাহ, তুই মনে মনেই তার নামটা নে। আমি শুনে নিচ্ছি। বল, উচ্চারণ কর তো একবার। কর কর। দেখি তোর মনের কথা শুনতে পাই কিনা!ʼʼ
পরাগ চোখ বুজে অল্প হাসে। মনে মনে বারবার উচ্চারণ করে, “জয় আমির, হামজা, জয় আমির, জয় আমির, হামজা, হামজা, হামজা…ʼʼ
অফিসার এবার নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করল। আলপিন দিয়ে পরাগের নখের ভিতর এলোমেলো খোঁচা দিতে লাগল। নখের নিচের মাংসের সাথ থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিল নখগুলো। রক্তে ভরে উঠল হাতটা পরাগের। এতে সে অজ্ঞান হবেনা বোধহয়, মরবে না, তবে প্রতি মুহুর্তে মরবে।
-“নাম বল।ʼʼ
পরাগ নিশ্চুপ। পরাগকে সেলের ছাদের হ্যাঙ্গারে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। এক মুহুর্তে সমস্ত দেহের রক্ত মাথা মুখে ভর করল। শ্বাস নিতে পারা যায়না এ অবস্থায়, হৃদযন্ত্রে র-ক্তের ঘাটতি, অক্সিজেনের ঘাটতি, পুরো শরীরে র-ক্ত চলাচলে বিঘ্ন, শরীরটা অসাড়, অবস।
অফিসার আবার বলে, “নামটা বল। ছেড়ে দেব এখনকার মতো।ʼʼ
পরাগ হাতদুটো মাটির দিকে ঝুলে পড়ায় মাংসপেশিতে কঠিন টান লাগছে। দেহের সমস্ত ভর জড়ো হচ্ছে নিচের দিকে। সহ্যের মাত্রা ছড়াচ্ছে।
পরাগ জানে, তার মৃত্যুদণ্ড হবে। তার জীবনে পাপ ও দৃশ্যমান পাপের মতো দেখতে ভুল বোঝাবুঝি কম নয়। জয়ের নাম বলায় কোনো সমস্যা ছিল না তার। কিন্তু জয়ের কাজ ফুরোয়নি এখনও। ও জয় কাজবাজ সেরে মরুক গে, পরাগের কী! জয় বাঁচতে চাইলে তাকে মারতে চাওয়া যেত। ও ব্যাটা কখন জানি নিজেই আত্মসমর্পণ করবে।
পরাগের নাম বলতে ইচ্ছে করছে না। সে বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছে। তাহলে তো সোনায়-সোহাগা। যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি। চোখটা বুজে এলো। আস্তে আস্তে চেতনা লোপ পাচ্ছে তার।
—
অন্তূ রিক্সা থেকে নেমে দৌঁড়ে বাড়িতে ঢুকল। এতটা অস্থির ও চঞ্চল তাকে দেখা যায়না। কবীর দৌড়ে গিয়ে ভাড়া পরিশোধ করল। এখনও সময় বাকি কত! ফিরে এসেছে অন্তূ।
রিমি ও তুলি ছুটে গেল। অন্তূ জয়ের মতো জগ উচিয়ে ধরে ঢকঢক করে ঠিক জগের অর্ধেকটা পানি খায়। এরপর ধপ করে বসে চেয়ারে।
তুলি ঝাঁকাল অন্তূকে, “এই মেয়ে! কী হয়েছে? ভয় পেয়েছ? কেউ কিছু বলেছে? রাস্তায় কিছু হয়েছে?ʼʼ
রিমি বসে পড়ল অন্তূর কোল ধরে, “আরমিণ! কিছু বলছেন না কেন? কিছু হয়েছে?ʼʼ
অন্তূ চট করে হাসল, তা অদ্ভুত দেখালো, “আব্বুর কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়ি ফিরলেই আব্বুকে পাব। তাই দৌঁড়ে এসেছি।ʼʼ
দুজনের কাছে খুবই বেমানান ও অবিশ্বাসযোগ্য লাগল কথাগুলো।
অন্তূ অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল সেদিন। বাথরুমে জয়ের তিন-চারটা ভেজা লুঙ্গি পড়ে আছে। এভাবে তিন-চারশো হয়ে গেলেও নতুন কিনে এনে পরবে, তবু ধুয়ে দেবে না। এই কাজটা তরু করতো। কখনও শাহানা। বিয়ে হয়ে এসে বউভাতের দিন রিমিকে জয়ের লুঙ্গি ধুতে হয়েছিল।
ভিজে পড়ে থেকে থেকে পিচ্ছিল হয়ে গেছে লুঙ্গিগুলো। অন্তূ ধুয়ে দিলো।
গোসল শেষ করে যোহরের নামাজ শেষে দীর্ঘ হলো তার মোনাজাত। মহান প্রতিপালকের কাছে হাত তুলে অনেকক্ষণ বসে রইল। কিন্তু কাঁদল না। ঠোঁট নড়ল না। তিনি অন্তর্যামী। তাঁর কাছে আহাজারী করার কী? বান্দার ভেতরের র-ক্তক্ষরণ তিনি দেখেন।
বড়ঘরে পাহারা নিযুক্ত করা হয়েছে। সবগুলো দরজা-পথে লোক মোতায়েন হয়েছে। অন্তূ ফিরে এলো। সেদিন দুপুরে খেলো না।
অন্তূর ভেতরে একটা সন্দেহ জেগে উঠেছে। হামজার তাকে হঠাৎ-ই ভার্সিটিতে যেতে দেবার অনুমতিটা ঠিকঠাক লাগছে না।
—
দু-ভাই ছাদে বসে অনেকরাত অবধি মদ খেল। হামজা জিজ্ঞেস করল, “রূপকথার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলি?ʼʼ
-“কথা আপা কারাগারে সেইফ না, ভাই।ʼʼ
-“কারাগারে সেইফটির প্রশ্ন?ʼʼ
দুজন হু হা করে হাসল। এক প্যাগ গিলে শান্ত হয়ে আকাশের দিকে তাকাল হামজা, “জয়!ʼʼ
-“হু!ʼʼ
-“কোনদিকে এগোচ্ছি রে আমরা?ʼʼ
-“যদি একটু আধ্যাত্মিক শব্দের মাধ্যমে বলতে চাও তো, আমরা এগোচ্ছি কালগর্ভের দিকে।ʼʼ
-“সময়ের গর্ভ?ʼʼ
-“তাও যে-সে সময় না। মহাসময়।ʼʼ
দুজন মাতালের মতো হেলেদুলে হাসল।
হামজা সিগারেটে দুটো টান দিয়ে চোখ ফিরিয়ে বলল, “রাতে খেয়েছিস?ʼʼ
-“পেট ভরা ভরা লাগছে। মনে হচ্ছে ভকভক করে বমি হয়ে যাবে।ʼʼ
-“গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি কর। আজ আর গিলিস না।ʼʼ
হামজাও শুয়ে পড়ল সটান হয়ে।
সেলের বাইরে রূপকথা জয়কে দেখে হেসেছিল। জয় জিজ্ঞেস করল, “দিনকাল ভালো তো?ʼʼ
রূপকথা উঠে এসে সেলের শিক ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “ভালোই তো। কেন এসেছিস? বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না?ʼʼ
-“লাগবে না কেন? বেঁচে থাকার জন্যই তো বেঁচে থাকা।ʼʼ
রূপকথাকে হাসপাতাল থেকে এনে সেলে রাখা হয়েছে। বাহুতে ব্যান্ডেজ জড়ানো। ছেঁড়া, নোংরা শাড়ির আচল মেঝেতে ঘেঁষছে। সুন্দর মুখটা বিবর্ণ, অথচ ঠোঁট হাসছে। ভয়ানক রহস্যেঘেরা মলিন সেই হাসি।
সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল জয়ের চোখের দিকে। জয় চোখ ফেরালো না। কিন্তু খানিকবাদে আচমকা যখন জয় হেসে উঠল একদৃষ্টে চেয়ে, রূপকথার বুকের ভেতরটা ছলকে উঠল সেই হাসিতে। শরীরটা শিরশির করে কেঁপে উঠল জয়ের চোখে তাকিয়ে। জয় তখন জোরে করে হেসে উঠল।
রূপকথা এগিয়ে এসে সেলের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে হাত ধরল জয়ের, “কী করছিস তুই, জয়? কী চাস জীবনে?ʼʼ
-“এত প্রশ্ন কেন?ʼʼ
-“জবাব দিলেই তো হয়।ʼʼ
-“না দিলেও হয়। আসলে আমি কিছুই করতেছি না। লাইফ এনজয় করতেছি।ʼʼ
-“কেন এসেছিস?ʼʼ
-“এলাম ঘুরতে ঘুরতে। জেলখানা একটা ভালো পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। হামজা সাহেব সংসদে সিট পেলে দেখি এই ব্যবস্থা করা যায় কিনা!ʼʼ
দুজন বসল। একজন সেলের ওপারে একজন এপারে। কিন্তু বসল কাধে কাধ মিলিয়ে। মাঝখানে লোহার শিকের ফারাক। রূপকথা আচমকাই বলে, “তোর কি আমাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে, জয়?ʼʼ
-“হচ্ছেই তো। কষ্টে বুক ফাটে, পাতিল হাড়ি কুত্তায় চাটে। এইরকম ধরণের কষ্ট হচ্ছে।ʼʼ
রূপকথা হাসল, “আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছিস?ʼʼ
-“তোমার স্বামীকে? ছিঃ। মেরে ফেলব কেন?ʼʼ
-“না মেরেই ভালো করেছিস।ʼʼ
জয় রূপকথার বাহুর থকথকে গলিত মাংসের দিকে চেয়ে রইল, ব্যান্ডেজ আলগা করে ফেলেছে রূপকথা। জয় হাসল, “আমার নাম জানতে চাইছিল ওরা!ʼʼ
-“না। পলাশ কোথায়, তা জানতে চেয়েছিল।ʼʼ
-“আমার কাছেই পলাশ ছিল। এ তথ্যটাই মূলত দরকার ছিল ওদের। বললেই ছেড়ে দিতো।ʼʼ
-“কিন্তু বলতে ইচ্ছে করল না।ʼʼ
জয় গা দুলিয়ে হাসল, “জয় আমিরের ওপর রক্তের ঋণ চাপিও না। ʼ
-“চাপালে কী?ʼʼ
-“অনবরত রক্ত ঝরে তার শরীরে, বয়ে যাবে কোথাও।ঋণ পরিশোধ হবেনা।ʼʼ
-“তোর কাছে আছে কী, কী দিবি আমায়। তুই তো কাঙাল। ʼʼ
-“তাও এক কথা। একটা চাকরি-বাকরি করা লাগবে। সামনের পর বেকার বলে বদনাম ঝারছো, মানবিকতার অভাব।ʼʼ
খানিক চুপ থেকে রূপকথা বলল, “কয় খন্ড করছিস রে?ʼʼ
-“মনে নেই এক্সাক্ট। কমবেশি চার-পাঁচ।ʼʼ
জয় আর দাঁড়ায়নি। চলে এসেছিল।
টানটান হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু চোখ-মুখ ঘোলা হয়ে আসছে। হ্যাং-অভার ধরছে। মাথার নিচে হাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে গান ধরল জয়,
ইট-গামলায় ইট বানায়া, চৌদিকে ভাটা সাজাইয়া
মাঝখানে আগুন জ্বালাইয়া দিলো গোওও
ভেতরে পুড়িয়া সারা, মাটি হইয়া যায় অঙ্গারা
এখন আমি কী করি উপায়…
হামজা নিচে নেমে গেল। প্রেশার বেড়েছে বোধহয়। মদ্যপান নিষিদ্ধ তার জন্য। ঘরে ঢুকে দেখল রিমি শুয়ে আছে। তাকে দেখেও উঠল না, কথাও বলল না। মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘরে শুতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও জঙ্গলে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আসতে।
জয় ঘরে এলো দুটোর দিকে। অন্তূ বসে আছে মেঝেতে। জয় দেখেও না দেখার মতো গিয়ে ধুপ করে শুয়ে পড়ল। অন্তূ কিছুক্ষণ পর ডাকল, “আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।ʼʼ
-“চুপ থাক। ঘুমাচ্ছি আমি। যা কথা পরে-টরে।ʼʼ
-“এখন বলাটা দরকার।ʼʼ
-“মুখ বন্ধ রাখ, শালী। মাথা ধরেছে খুব। ঘুমাবো আমি।ʼʼ
অন্তূ বসে রইল। তখন দুটো বাজছিল রাত। জয় ঘন্টা দুয়েক মরার মতো ঘুমালো। চারটার দিকে উঠল। অন্তূ বসে আছে ওভাবেই। বিরক্ত হয়ে বলল, “কী কথা, কও।ʼʼ
-“জয়নাল আমির আপনার চাচা, না!ʼʼ
-“ছোট চাচা। বলেছিলাম আমি।ʼʼ
-“জাভেদ আমির?ʼʼ
-“থিউরেটিক্যালি আমার বাপ।ʼʼ
-“বড় চাচার নাম কী?ʼʼ
জয় ভ্রু কুঁচকে ফেলল, “ভার্সিটিতে গিয়েছিলে?ʼʼ
-“গিয়েছিলাম।ʼʼ
অন্তূ জয়ের এমন অলৌকিক আন্দাজশক্তিতে একসময় ভীষণ অবাক হতো। এখন হয়না। মনে হতো জয় আধ্যাত্মিক ক্ষমতা জানে। মানুষের মন ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা সব তার আয়ত্ত্বে।
জয় লাফিয়ে নামল খাট থেকে, “জিন্নাহ আমির নামের কারও কথা বলেছে ওরা?ʼʼ
অন্তূ বিস্ময়ে ভ্রু জড়াল, “নিজস্ব জিন পোষেন নাকি?ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল দুপাশে, “অভিজ্ঞতা বেশি।ʼʼ
-“ততটাও বোধহয় বেশি না, যতটা চতুর আপনি।ʼʼ
-“আমার বাপের বড়ভাইয়ের ছেলে।ʼʼ
-“জিন্নাহ আমির!ʼʼ
জয় আচমকা শক্ত হলো, “হ। কারা আইছিল?ʼʼ
-“কয়েকজন।ʼʼ
-“কী বলল?ʼʼ
-“মুরসালীন মহানকে ছেড়ে দিতে বলেছে। তাহলে জিন্নাহ আমিরকে ফেরৎ দেবে ওরা।ʼʼ
জয় খানিক চুপ থেকে থেকে মাথা ঝারা মেরে হাসল, “জিন্নাহকে গুম করেছে আজ আড়াইবছর। বেঁচে আছে কিনা, সন্দেহ। খানকির বাচ্চারা এখনও নাম ভাঙিয়ে খাইতে চায়। শুয়োরের বাচ্চাদের কে বোঝাবে, জয় আমির গু খায় না। তার নাম কয় নাই?ʼʼ
-“আনসারী মোল্লা বোধহয়।ʼʼ
-“সাথে আর কে কে ছিল?ʼʼ
অন্তূ কথা বলল না। গভীর চোখদুটোয় জীবনের কাতরতা! বারান্দার অন্ধকারে চেয়ে রইল।
জয় বলল, “তোমাকে কী বলেছে?ʼʼ
কাঠের পুতুলের মতো বলল অন্তূ “আপনাকে বুঝিয়ে বলতে বলেছে।ʼʼ
-“নয়ত?ʼʼ
-“আমার ভাবী আর আম্মু…ওহ সাথে আমাদের বাড়িও পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেবার কথা জানালো।ʼʼ
জয় হেসে উঠল, “তোহ ঘরওয়ালি! তোমার প্রাণপ্রিয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর আগ্রাসী ব্যাপার-স্যাপার কেমন এনজয় করলে?ʼʼ
-“বুঝতে পারিনা আমি এসব। দৃষ্টিকোণ বদলাতে থাকে একেকসময়। আমি রাজনীতিকে বুঝতে চেষ্টা করছি, অথচ পারছি না।ʼʼ
জয় হো হো করে হাসল, “রাজনীতি বোঝার মতো বিষয় নয়, সিস্টার। ওটা একটা নীতি, দ্যাটস মিন পলিসি। ওটা মেনে চলতে হয়, ব্যাস। বুঝতে গেলে হারিয়ে যাবে, কূল পাবেনা।ʼʼ
-“কেমন পলিসি?ʼʼ
-“ব্ল্যাডি ডিপলোম্যাটিক পলিসি।ʼʼ
-“ওদের তিনজন প্রধান নেতাকর্মীর শাস্তির রায় কার্যকর হয়েছে।ʼʼ
-“ওরা যুদ্ধাপরাধী। মানবাধিকার বিচারে সাঁজা পাচ্ছে। তাতে কী?ʼʼ
-“ওরা ছাড়া আর কেউ নেই? ওরাই কেন? কারণ ওরা বিরোধী দলের সঙ্গে জোট করেছে তাই? ওরা নিজেদের বক্তব্যে আপনাদের সরকার ও শাসনব্যবস্থার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়, মানুষের মাঝে সেসব কথা পৌঁছায়, তাই নাকি অন্যকারণ! মুরসালীনও কি তাই?ʼʼ
-“মুরসালীনের বাপেরা ছিল মোল্লার বংশধর। ধর্মের প্রতি দুর্বল। কিন্তু ও মূলত বিরোধী দলের চামচা। আবার ধর্মীয় দলের ওপরও ব্যাপক টান।ʼʼ
-“সে হিসেবে চামচা তো আপনিও।ʼʼ
জয় তাকিয়ে রইল। অন্তূ হাসল, “ক্ষমতাসীনদের পেছনে লেজ নাড়ানো গাঢ় চামচামি। ওরা বরং হিম্মতদার, যারা ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও লড়ছে।ʼʼ
-“লড়ছে? ২০১৪ তে যেটুকু লাফিয়েছে, আর ২০১৫ এর শুরুতে তিন-চার মাস যা আগুন জ্বালানো অবরোধ করেছে। এরপর তো ওরা ডাউন, ঘরওয়ালি। তুমি হিজড়াদের সঙ্গ দিচ্ছ। ওরা মরে ভূত সব।ʼʼ
-“সঙ্গ আমি কারোই দিচ্ছি না। আমি শুধু চাইছি, ওদের মুক্তি দিন। ওরা অপরাধ করেনি। আর কিছু বলতে পারছি না। কারণ আমি রাজনীতি বুঝতে চেষ্টা করছি সবে, বুঝতে পারছি না মোটেই।ʼʼ
-“ওরা বরশীর আগায় ঝুলানো টোপ। মাছ ছিপে ওঠা না অবধি ছাড়তে পারি না।ʼʼ
-“ওরা এমনিতেও দূর্বল। থেমে গেছে সেই কবে। তবু এখনও? ওদের দলের লোক দেদারসে কারাগারে যাচ্ছে, মামলা খাচ্ছে। আর কত? অন্তত বাচ্চাগুলোকে মুক্তি দিন।ʼʼ
জয় মেঝের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। অন্তূ খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল, “কেন করছেন এসব, বলুন তো!ʼʼ
জয় কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল। ফজরের আজান শেষ হলো।
-“ওরা যুদ্ধাপরাধী, মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ড করা জঙ্গি গোষ্ঠী। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে আর পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছে সেসময়। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ওদের ঘেন্না করাটা নিয়ম।ʼʼ
-“আর তাতে ক্ষমতা হাসিলও হয় খুব সহজে, কী বলেন!ʼʼ
জয় হাসল, “ওটা হামজা ভাইয়ের জন্য। আমার ওসব কিছু না।ʼʼ
-“অথচ আপনি নিজেকে কতন পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন! যেখান থেকে ফেরার পথ নেই।ʼʼ
-“মেরে ফেলবে?ʼʼ
-“মৃত্যু আপনার জন্য নয়, জয় আমির। মৃত্যু তাদের জন্য যারা মৃত্যুকে ভয় পায়। মৃত্যু অন্তত আপনার ‘শাস্তি’ হতে পারে না।ʼʼ
জয় নিঃশব্দে হাসল কেবল। কিচ্ছু বলল না।
-“আজ আমাকে ভার্সিটিতে যেতে দেয়া হয়েছিল। কোনো বিশেষ ব্যাপার নাকি? কী করেছেন ওদের সঙ্গে?ʼʼ
জয় দুপাশে মাথা এই ব্যাপারটাকে সাইড করে মাথা নেড়ে ভ্রু উঁচিয়ে গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী হয়েছে?ʼʼ
অন্তূ তাকাল জয়ের দিকে। তাদের দুজনের নীরব এই বোঝাবুঝির মাঝে যে অসীম বিরোধ, তার কোনো পরিণতি নেই।
-“ভাবীর বাচ্চা পেটের ভেতরেই অসুস্থ। আম্মু কল করেছিল।ʼʼ
-“ব্যাপারটা মঙ্গলকর। তোমার ভাই নাই। বাচ্চাটা থাকা মানে ভাবীর জীবন ক্ষয়।ʼʼ
অন্তূ কঠোর চোখে তাকাল, “জানোয়ার, আপনি।ʼʼ
—
সকালবেলা জানা গেল, কবীরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হামজা পাটোয়ারী পৌরসভার মেয়র। তাকে সরাসরি প্রথমেই আনা হলো না আইনি জিজ্ঞাসাবাদে। কিন্তু খুব শীঘ্রই যে আনা হবে, তা চিরন্তন সত্য।
জয় আমির খাঁড়া দুপুরে বড় ঘরে উপস্থিত হলো। পেছনে অন্তূ। জয় গলা চেপে ধরল অন্তূর, “তুই কোথায় যাচ্ছিস?ʼʼ
অন্তূর তপ্ত শ্বাস জয়ের হাতে পড়ছিল। আরও শক্ত করে চেপে ধরল গলাটা জয়, “রুমে যা। কুপিয়ে কেটে ফেলব একদম।ʼʼ
-“হয় কুপিয়ে কাটবেন, অথবা আমি আপনার সঙ্গে বড়ঘরে যাব।ʼʼ
জয়ের চোখে রক্ত ছুটে বেরোচ্ছে। ঘুম পুরো হয়নি। নেশার ঘোর কাটেনি, মাথা ঝিম মেরে আছে। ছেড়ে দিলো গলাটা। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ড্যাগ ভরে রান্না হয়েছে। খেতে দেবার জন্য বাড়ির মেয়েদের দরকার।
মুরসালীনের সামনে জয় সেদিন অবধিও সেভাবে বসেনি, ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। যা করার বাপ্পী, সোহাগ, আজাদ আর প্রধানত হামজা করেছে। সেদিন প্রথমবার জয় আমির সৈয়দ মুরসালীন মহানের সম্মুখে বসল।
চাটাই পেতে দেয়া হলো। সবাইকে একসঙ্গে খাওয়ানো হলো সেদিন অবরুদ্ধ কুঠুরিতে। জয় ওদের সাথে বসে পোগ্রাসে গিলল।
খেতে খেতে মুরসালীন বলে, “জয়! মনে পড়ে তোর? এভাবে দিনের পর দিন দস্তরখান বিছিয়ে কলার পাতায় খাবার খেয়েছি একপাতে?ʼʼ
জয় তাকাল না। কথাও বলল না। অন্তূ ওদের পেটপুড়ে খাওয়ালো। যতটা সম্ভব যত্ন করে খাওয়ালো। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অভুক্ত বাচ্চারা খাচ্ছে, নিদারুণ খিদে
আর পিপাসা ওদের। পরনের পাঞ্জাবী ছেঁড়া-ফাঁড়া, নোংরায় ঢাকা।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। আগামী পর্ব দ্রুত দেব ইনশাআল্লাহ।