#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬৪.
প্রায় বিকেল হয়ে এসেছিল। কিন্তু বড়ঘরে সময়-কাল ও আলোর অস্তিত্ব নেই।
আব্দুল আহাদ কয়েক লোকমা খাবার মুখে দিয়েই গলগল করে বমি করে ফেলল। এবং শেষের দিকে বমির সঙ্গে রক্তের ছোপ উঠে এলো। অন্তূ বসলে আব্দুল আহাদ অন্তূর হাতখানা চেপে ধরে। আবারও বমি করতে চায়। পেটে খাবার পড়ে না কতদিন ঠিকমতো। লালা ঝরল শুধু, সাথে রক্ত।
জয় গপাগপ আরামে খেয়ে উঠল।
আব্দুল আহাদ মেঝের ওপরই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। অন্তূ জগ ভরে পানি এনে মাথায় দেয়। খাওয়ার পানি চাইল, কিন্তু খেতে পারল না। অন্তূ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আব্দুল আহাদের জীর্ণ মুখটার দিকে।
অন্তূ যতবার বড়ঘরে এসেছে, বাচ্চারা সস্তি পায়, সবাই অন্তূর দিকে চাতকের মতো চেয়ে থাকে। কিছু আশা করে। তারা জানেনা, অন্তূর হাত বাঁধা। এটাও জানে না, অন্তূ আজ ভীষণ নিঠুর, উদ্দেশ্যপ্রবণ, স্বার্থপর…!
অন্তূ কিছুই করল না। সে আজ একটুও তামাশা করতে চায় না, জয় আমিরের সঙ্গে আপাতত সে একটুও রেষারেষি চায় না। সে এখানে আজ ইনিয়ে-বিনিয়ে থাকতে চায়। জয়ের সঙ্গ চাই তার, ততটা গভীর সঙ্গ, যাতে সে জয় আমির নামক অতল গহ্বরের অন্তত মুখটার আপাত হদিশ পায়। বাকিটা সে বোঝে, সে জয় আমিরকে আত্মস্থ করেছে। সে জয় আমিরকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করে, কখনও ক্ষেপিয়ে তুলে, কখনও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার নামে খুলে পড়ে দেখে নিয়েছে। শুধু জানা বাকি কিছুটা। তা জানলেই যেকোনো একটা গূঢ় সিদ্ধান্ত!
ওরা অনেকদিন পেটভরে খাবার পেয়ে কেউ-ই সইতে পারছিল না। চোখ-মুখ উল্টে আসছিল, অসুস্থতা বাড়ল সবার।
অন্তূ জয়ের খুব পাশে গিয়ে বসে, জয়ের এঁটো হাতে খুব ধীরে পানি ঢালতে ঢালতে বলে, “দেখতে ভালো লাগছে না ওদের দুর্ভোগ। হোক যে কারণেই, সেসব বিতর্কিত। আপাতত তা বুঝতে না যাই। শুধু জানা ভালো, ওরা নিষ্পাপ, নাবালক। ওদেরকে মেরে ফেলুন, অথবা বেঁচে থাকতে দিন।ʼʼ
জয় হাতদুটো আরাম করে ধুয়ে চোখ তুলে তাকাল, এরপর বলল, “ওরা মরে গেছে না বেঁচে আছে, সেইটা আগে ক্লিয়ার করো।ʼʼ
-“ওরা বেঁচে থেকে থেকে রোজ মরছে। আপনি বোধহয় বোঝেন এই বেঁচে থাকাটা।ʼʼ
জয় ভ্রু উঁচায়, “আমি বুঝি নাকি?ʼʼ
-“বোঝেন। আপনি এভাবেই বেঁচে বেঁচে মরেছেন বহুকাল।ʼʼ
-“তাই নাকি?ʼʼ তাকাল জয়, “আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লে আম পড়বে? দেখা গেল, ঢিল আমের গায়ে না লেগে গাছের ডালের মৌচাকে লাগল। এরপর?ʼʼ
-“মৌমাছির কামড়ের ভয় পেতে বলছেন?ʼʼ
জয় হেলেদুলে হাসল। ক্ষেত্রবিশেষ চরম সল্পভাষী হিসেবে ধরা পড়েছে জয়। তার যত বাজে কথা, আবোল-তাবোল রসিকতা বাহার। কাজের কথা অথবা নিজের কথা ভুলেও বেরোয় না জবান দিয়ে। অতি রসিকতার জেরে মানুষ সুযোগ পায় না ওর সঙ্গে আন্তরিক আলাপ পাড়ার। সেই সুযোগ কাড়তেই জয়ের রসিকতার আয়োজন, এত আন্তরিকতাহীন চলন। অন্তূর আবিষ্কার এসব।
-“তো আমি চরম মাপের খিলাড়ি তাইলে! তবু তুমি শালী কদর করলা না।ʼʼ
জয়ের চোখের মেটে রঙা মণিতে চোখের নজর ফেলে অন্তূ, “আফসোস, আপনার বাঁচার লোভ নেই।ʼʼ
-“মরার শখও নেই। চাইলেই মেরে দিতে পারতে। কত রাত সুযোগ গেল।ʼʼ
-“ভয় অথবা অনীহা নেই যে!ʼʼ
-“না-ন না! তুমি আসলে আমার প্রেমে পড়ছো। খালি স্বীকার যাও না। তো একটা চ্যালেঞ্জ জিতলাম। কী কও?ʼʼ চোখ মারল জয়।
অন্তূ বলে, “মৃত্যু কি আপনার শাস্তি হতে পারে? সত্যি বলুন। ভয় পান না আপনি মরণে। ব্যাপারটা জটিল হয়েছে এখানে।ʼʼ
-“অপবাদ দিচ্ছ, ডিয়ার। ছেড়ে দাও। আমি খুব ভীতু। তুমি জানোনা, তাই বলছো।ʼʼ অন্তূর ওড়না টেনে নিয়ে ভেজা হাতটা মুছল জয়।
অন্তূ তির্যক হাসল, “দুনিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতা না জন্মে যায়, পাপকে পাপ মনে হতে যেন শুরু না করে, লোক আপনার কুৎসিত ব্যক্তিত্ব ছাড়াও এক সর্বহারা দূর্বল কাঙালকে না দেখে ফেলে, সেসব ব্যাপারে ভীষণ ভীতু আপনি। জানি তো। অস্বীকার করছি বুঝি!ʼʼ
অন্তূর বাক্যবিন্যাসে এক প্রকার অভিজাত নাটকীয়তা ছিল, যা শুনতে শ্রতিমধুর ও অদ্ভুত শোনালো।
জয় শব্দ করে হাসল, “সর্বহারা আমি? আমার ব্যাপারে এসব ভুলভাল কথা কোন শালা শেখায় তোমাকে?ʼʼ
অন্তূ নিঃশব্দে ঠোঁট বাঁকিয়ে সল্প হাসল, “আপনার সেই শালার নাম মোস্ট প্রোবাবলি–জয় আমির।ʼʼ
চকিতে তাকায় জয়। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে দেখে অন্তূকে কিছুক্ষণ। অন্তূর স্থির চোখের ঘন পাপড়িতে যে বিরোধের আগুন! মসৃণ ঠোঁটে কত আওয়াজহীন প্রতিবাদ! কঠিন ঢোক গেলার মাঝে অসহ্যকে সহ্য করার অব্যর্থ চেষ্টারা। আর মাথায় টানা লম্বা ঘোমটায় জড়িয়ে থাকা জয় আমিরের নাম। জয় দেখে সেসব। অল্পক্ষণ দেখে। এরপরই চট করে অন্তূর কালচে পানির পুরনো গভীর কূপের মতো চোখের মণি থেকে চোখ সরায়।
এক হাঁটু খাঁড়া করে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে দীর্ঘ এক টান দেয়। অন্তূ মেঝেতে ঠেসে বসে জয়ের পাশে। মাথার ওড়নাটা কপাল অবধি টানে। জয়কে দেখতে তখন পুরনো আমলের অহংকারী, অনৈতিক জমিদারের মতোন দেখায়, আর অন্তূ তার বিরোধী পূণ্যবতী গিন্নি।
আজ ক’দিন যেন আচরণ বদলেছে অন্তূর। জয়ের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী সে শুরু থেকেই, কিন্তু আজকাল তা অন্যরকম রূপ নিয়েছে।
বসে থাকে দুজন অনেকক্ষণ। কেমন যেন পারিপার্শ্বিক হালটা। সাতাশটা ক্ষত-বিক্ষত, বন্দি দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক বিশাল আলো-বাতাসহীন ইস্পাতের গুদামে। তার একপাশে দুটো নর-নারী পাশাপাশি খুব কাছে বসে থাকে চুপচাপ। কেউ কারও দিকে একবারও তাকায় না। প্রগাঢ় শ্বাসের উঠানামা চলে কতক্ষণ। নিগূঢ় রহস্যের পাক ঘোরে সেই শ্বাসের অদৃশ্য কুণ্ডলীর হাওয়ার মিলনে।
জয় নিজের বাঁ হাতের তালু মেলে ধরে অপলক চেয়ে থাকে সেদিকে। ভাগ্য নাকি ভবিষ্যত দেখার প্রয়াস! জয়ের যে কত সব উদ্ভট খেয়াল জাগে ক্ষণে! পাশে বসে অন্তূ দেখে পরিশ্রান্ত দেহগুলো। আশাপাশটা ভয়ানক। কিন্তু অন্তূর ভয় লাগে না। বিশাল বিশাল লৌহচুল্লি, ছাই, কয়লা, রাসায়নিক পদার্থ, ছাঁচ, হাতল, নোংরা চটের বস্তা, মানুষের হাড়, লোহার খণ্ড, কার্বন কোক সংরক্ষণের পাত্র, লোহার তৈরি খাম্বার আকৃতির বিশাল বিশাল গোলক—কত কী ছড়িয়ে আছে। টিমটিমে বাতি জ্বলছে। আধো অন্ধকারে ভ্যাঁপসা দুর্গন্ধ সব মিলিয়ে।
অন্তূ সেসবে চোখ নিবদ্ধ রেখে আস্তে কোরে ঠোঁট নাড়ায়, “আপনাকে আমি এর চেয়ে বেশি অসহায় হিসেবে দেখবো, জয় আমির। আমি জানি, দেখব। আপনার অসহায়ত্ব আর সবার মতো কাতর আর দৃশ্যমান হবেনা। আপনি হাসবেন, খুব হাসবেন সেদিন একবার। আমি আপনার সেই অসহায়ত্ব দেখব। সেদিন কেউ আপনাকে দেখলে আপনার পাপ ভুলে বরং আপনার জন্য মায়ায় কেঁদে উঠবে। আর আপনি ঠিক ততটাই হাসবেন। আমি আপনার সেই অসহায়ত্ব দেখব।ʼʼ
জয় হাতের তালুতে আস্তে আস্তে পাঁচটা আঙুল গুটিয়ে মুঠ পাকিয়ে গা দুলিয়ে হাসে, “তোমার আল্লাহ তোমার ফরিয়াদ মিছেমিছি হলেও কবুল করুন। জয় আমিরকে তিনি অসহায় করুন। আমিন।ʼʼ
-“অর্থাৎ আপনাকে অসহায় করা অসম্ভব? আপনাকে অসহায় করতে পারবেন না তিনি–বলছেন?ʼʼ
-“সহায় করতে পারেননি। অসহায় করতে পারবেন– ভাবছো কেন, ঘরওয়ালি? শ্যুড নট বি ফরগোটেন, ঘর ভাঙতে সেই ঘরামির দরকার পড়ে, যে ঘরামি ঘর বানিয়েছিল। অর্থাৎ, ভাঙতে পারেন কেবল তিনি, গড়েছেন যে।ʼʼ
-“আর আপনার ধারণা—আপনাকে আপনি গড়েছেন! ভাঙলে কেবল আপনি ভাঙতে পারেন, আর কিছুই না! তাই?ʼʼ
অন্তূ না তাকিয়েও টের পায় এতক্ষণে জয় তাকিয়েছে তার দিকে। সে তাকায় জয়ের চোখে। দুজনের চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলে ক্ষণকাল। কোনো এক মুহুর্তে দুজন একসাথে চোখ ফেরায় দু’দিকে। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো ভয়াবহ সম্পর্ক নয় তো তাদের! চোখের ভাষায় কথা বলা সম্পর্করা হয় ভীষণ ভয়ানক। ওসব সম্পর্ক তাদের নয়। তাদের সম্পর্ক আলাপ-আলোচনা সেরে, একত্রে বসে ছক-পরিকল্পনা এঁকে পরস্পরের বুকে ছুরি গাঁথার।
রিমি সবকিছু গোছগাছ করে আবারও এলো। তার মুখ স্লান, চোখদুটো স্থির কিন্তু বিষণ্ন। সেদিন জয় ওদের সরালো না। বেখেয়ালী লাগছিল তাকে ভীষণ।
হাঁটু খাঁড়া করে মেঝেতে বসল। মুরসালীন ঢালাই দেয়ালে পিঠ ঠেকায়। গোটা শরীরে ক্ষত। চিকিৎসা অথবা ওষুধ পড়েনি সেসব ক্ষততে। ওরা মোট সাতাশজন। তার মধ্যে বড় ছয়জন। মুরসালীন বাদে আরও আছে তারিক, আশরাফ, নাঈম, তওফীক, ইমদাদ।
এরা সব ২০১৪-১৫ এর শুরুর জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সহিংসতায় জড়িত ছিল। রাজধানীর বিরোধী দলীয় ছাত্র আন্দোলনে সরব সবগুলো। গাড়ি জ্বালিয়েছে, মানুষ পুড়িয়েছে, ইট-পাটকেল, ককটেল ছুঁড়েছে, রাস্তায় অবরোধ করেছে। কঠিন অপরাধ। পুলিশ পেলে ছাড়বে না।
হামজা এলো অন্ধ কুটিরে। সাথে বাপ্পী মণ্ডল, কামরুল, চয়ন, দোলন। এই সাতাশজনকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও তাদের শান্তি। এখন আর স্টেটমেন্ট বা হদিশ দরকার নেই। তবে একদম আলোচনাহীনভাবে কারও গায়ে হাত লাগানো যায় না।
জয় ও হামজা বসে রইল চুপচাপ। তাদের কোনো কাজ নেই। অন্তূর ওড়নার একপ্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে রইল রিমি।
মুরসালীন নিজেদের স্বপক্ষে কথা বললে কথাও বলা যায়না। কথা ও যুক্তিতে পটু। হওয়া উচিতও। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সরকার ও রাজনীতি অর্থাৎ পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগের ছাত্র ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভরা।
মুরসালীনের চেহারার কাঠামো নিরেট। অযত্নে দাড়ি বেড়ে যাওয়ায় দেখতে আরও কেমন যেন লাগছিল দেখতে।
বদিউজ্জামান দোলন আপিল বিভাগের আইনজীবী হলেও তিনি রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত আইনজীবী হিসেবেই খ্যাত কর্মী। শিক্ষিত মানুষ। রাজনীতির ভালো জ্ঞান ধারণা রাখেন।
তিনি মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই যে এইসব র-ক্তার-ক্তি কর্মকাণ্ড করে বেড়াও, লাভ কী হচ্ছে?ʼʼ
মুরসালীন স্বভাবসুলভ হাসল, “একটা গল্প শুনবেন, স্যার?ʼʼ
-“গল্প?ʼʼ
-“জি, স্যার। গল্প।ʼʼ
দোলন সাহেব তাকিয়ে রইলেন। মুস্তাকিন মহানের মতোই দেখতে অনেকটা। তবে মুরসালীনের চেহারাটা কিছু ধারালো। মুস্তাকিন খুব গম্ভীর ছিল, এবং সল্পভাষী, চুপচাপ, নিঃশব্দ চলন। ছোটটা হয়েছে চতুর, চঞ্চল।
মুরসালীন বলল, “পাশাপাশি দুই মহিলার বাড়ি ছিল। তাদের মধ্যে একটুও বনিবনা ছিল না। কিন্তু সারাদিন চেঁচাতে দেখা যেত এক মহিলাকে। সে সারাটাদিন অপর মহিলাকে খিস্তি করতো। লোক বিরক্ত ছিল সেই মহিলার ওপর। একদিন তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে গিয়ে আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ও তো একদম চুপ। অথচ তুমিই খালি এমনে চেঁচাও, পাড়ায় নাম খারাপ হয় তোমার।ʼ
মহিলা দুঃখের সাথে বলল, ‘আপনারা খালি আমার চেঁচানোটা দেখেন, শোনেন। অথচ ও রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দরজায় দাঁড়িয়ে বেড়ার ওপর দিয়ে আমাকে ঝাটা উঁচিয়ে পেটানোর ইশারা করে চুপ করে থাকে। আর আমি সেই দুঃখে সারাদিন চেঁচাই।ʼʼ
দোলন সাহেব কপাল জড়ালেন। মুরসালীন হাসল, “আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা, স্যার?ʼʼ
দোলন সাহেবকে পেরিয়ে চয়ন এগিয়ে এলো, “শুয়োরের বাচ্চা, তোর ফ্যাঁদা প্যাঁচাল শুনতে আসি নাই আমরা এইখানে।ʼʼ
দোলন সাহেব চয়নকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, “তোমার অপরাধ কী জানো তুমি?ʼʼ
-“বর্তমান সরকার ও সরকার বিরোধী আমি। এটা আপনাদের ধারণা।ʼʼ
-“আমাদের ধারণা? সত্যি নয়?ʼʼ
-“আংশিক সত্যি।ʼʼ
-“বাকিটা মিথ্যা কীভাবে?ʼʼ
-“সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।ʼʼ
-“আচ্ছা পরে শুনছি।ʼʼ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দোলন সাহেব বললেন, “শিক্ষিত ছেলে তুমি। জানাশোনা নেহাত কম নয়। পথটা কি ঠিক তোমাদের?ʼʼ
মুরসালীন জবাব দিলো না সাথে সাথে। চতুর লোকটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। প্রশ্নের ধরণ ও গলার স্বরেই মানুষকে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখেন দোলন সাহেব।
-“স্যার, আমি নিরপেক্ষ কেউ একজন।ʼʼ
-“নিরপেক্ষ?ʼʼ হাসলেন দোলন সাহেব।
-“জি, স্যার। আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, বোধহয়।ʼʼ
-“না পারারই তো কথা। তাই না?ʼʼ
-“আমি কোনো দলের সমর্থক নই। আমি শুধু কার্যক্রমগুলোকে সহ্য করতে পারায় ব্যর্থ। আবার আপনাদের সমর্থন করা যায় না বলে যে বাকিদের করতে পারি, এটা আরও কঠিন ভুল।ʼʼ
-“তাই নাকি? অথচ তুমি কোনো এক দলের প্রতি অনরাগী। তুমি যে দলের দিকে বেশি গড়িয়েছ, তারা খুব মানবিক?
-“অন্তত আপনাদের চেয়ে।ʼʼ
কামরুল দোলন সাহেবকে পার করে চপাৎ করে এক ঘুষি মারল মুরসালীনের মুখে। দাঁতের কোণা বেয়ে রক্ত বেরিয়ে মুখটা ভরে গেল। মুরসালীনের হাত খোলা ছিল, তবু প্রতিক্রিয়া দেখাল না কোনো।
-“আমাদের চাইতে ওরা মানবিক? যারা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন নিয়ে জোট করে আর দেদারসে মানুষ মারে, ওরা মানবিক?ʼʼ বাপ্পী মন্ডল খেঁকিয়ে উঠল।
-“মানুষ মারার কথা বলছেন? কী আশ্চর্য! সাগর কেন নদীকে দোষারোপ করবে বুকে পানি ধারণ করায়?ʼʼ
-“কী বলতে চাও, তুমি?ʼʼ দোলন সাহেব বললেন।
-“স্যার, কথা বললে অনেক হয়ে যাবে। বলব কি? আর শর্ত হলো, আমি যতক্ষণ কথা বলব, আপনারা শুধুই শুনবেন। না কোনো জবাব, না প্রতিক্রিয়া। পরে দেখাবেন, যা জমে ততক্ষণে। আমি তো পালাচ্ছি না।ʼʼ
অন্তূ দীর্ঘ করে শ্বাস টানলো। তার নিজের ওপর থেকে আত্মগ্লানির বোঝা নামছে। তার প্রতিবাদ তাকে তিলে তিলে ক্ষয় করেছে, সাথে সব কেড়েছে। এই গ্লানি টানা বড় কষ্টের। অথচ আজ সৈয়দ মুরসালীন মহানের মুখের আত্মগরিমা, একেকটা সূঁচালো বাণের মতো কথার তীর, আর যুক্তি তার ভয় কাটাচ্ছিল। মুরসালীনের শরীরে ব্যথা নেই, চোখে মৃত্যুর ভয় নেই, কথায় জড়তা নেই। তবে সে কেন এত জমে গেছে!
দোলন সাহেব বললেন, “বলো।ʼʼ
-“বলাটা ব্যাপার না। সমস্যা হলো, আপনারা নিতে পারবেন তো! না, আসলে স্বাধীন বাংলাদেশে আবার কথা বলা পাখিদের লোকে খাঁচায় পোষে তো!ʼʼ
কটমট করছিল সবগুলো। মুরসালীনের কথাবার্তার সুর ভীষণ তীক্ষ্ণ, সরল উপহাস। কিন্তু দোলন সাহেব বিঁষ গিলে হাসলেন, “বলো।ʼʼ
মুরসালীন বলল, “আমার আব্বা খু-ন হয়েছে ২০০২-এ। কে মেরেছে জানেন?ʼʼ
-“আন্দাজ করতে পারি।ʼʼ
মুরসালীন মৃদু হাসল, এরপর বলল, “আপনি জেনে থাকবেন হয়ত, সেই বছর বিরোধী দলীয় প্রধানের নির্দেশে ৮৫ দিনের একটি অপারেশন চলেছিল। সন্ত্রাসবাদ নিপাতমূলক ব্যবস্থা– অপারেশন ক্লিনহাট। যদি বলেন ওই দলকে সাপোর্ট করার একটা মাত্র কারণ বলো। সেই একটা কারণ এটা হতে পারে।ʼʼ
দোলন সাহেব হেসে উঠলেন, “এই একটা কারণে ডুম হয়ে গেলে? কাঁচা বুদ্ধি তো না তোমার। বিবেচক তুমি।
মুরসালীন হাসল, “মিছেমিছি সুনাম করবেন না। আর আমি ডুম হইনি, স্যার। একটা মাপকাঠি পেয়েছি মাত্র।আপনাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ আজ অবধি কী পেয়েছে কী, স্যার? নাহ, বহুত কিছুই পেয়েছে অবশ্য, সেসব থাক। মূলত, তথাকথিত স্বাধীনতা যুদ্ধে জিতে পাওয়া এই তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ আজ অবধি বাংলাদেশের রাজনীতির দখলে থাকা কোনো পক্ষের কাছেই কিছু পায়নি, শুধু ক্ষয় ছাড়া। অবশ্য কী পেল সেটা বিষয় না, কিছু পেয়েছে, এ-ই অনেক।ʼʼ
মুরসালীনের গা জ্বালানো কথাবার্তায় স্থির থাকা দায়। দোলন সাহেবের জন্য ওরা চুপ করে বসে আঙুলে মেঝে খুঁটতে লাগল।
দোলন সাহেব কেমন করে যেন হাসলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার গন্ধ আসছে তোমার কথা থেকে।ʼʼ
মুরসালীন হেসে ফেলল, “অর্থাৎ আমি সেইসকল রাজাকার, যু-দ্ধা-পরা-ধীদের অন্তর্ভুক্ত। দিয়ে দিন স্যার ফাঁ-সি। দেশের শত্রু দশের শত্রু নিপাত হোক নিপাত হোক।ʼʼ
এমদাদ সমস্বরে বলে উঠল, “নিপাত হোক…ʼʼ একটা ঝংকার উঠে গেল এবার সবার স্বরে, “নিপাত হোক নিপাত হোক।ʼʼ সেইসব ক্লান্ত কণ্ঠে মলিন উপহাস!
মুরসালীন বলল, “স্যার, বর্তমান দেশে যে কয়টা দল শীর্ষে আছে, তাদের একটাও দেশ পরিচালনাকারী নয় স্যার। চোষক, শোষক, মিশ্র, ভন্ড সব, স্যার। সবাই শুধু দেশটাকে হাতে রাখতে চায়। তবে এটাও ঠিক। চাইবে না-ই বা কেন? তাদের সবার কারও না কারও কৃতিত্ব আছে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে। তার একটা প্রতিদান তো সবার প্রাপ্য। সেই প্রতিদানটা হলো দেশের গদি। যা কেউ ছাড়তে রাজী নয়।ʼʼ
মুরসালীন হাসল, “ছাড়বেটা কেন? কারও বাপের দেশ, কারও স্বামীর দেশ। ছাড়ার মতো ব্যাপার নাকি? উত্তরাধিকারসূত্রে আইনতভাবে দেশ তাদের। কিন্তু সমস্যা হলো স্যার, ভাগী-শরীক অনেক, কিন্তু দেশ একটাই। আমরা যতই নিজেদের দুঃখী বলি, সবচেয়ে বিপদে কিন্তু স্যার দেশই আছে, ভেবে দেখুন। একা সে কতজনের হবে? কতলোকে মিলে তাকে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত করেছে! ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ যাবার পর সেখানেও এমনই হয়েছিল, জানেন তো! যেসব বিপ্লবীরা ইংরেজ তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করল, স্বাধীনতার পর দেশের গদি নিয়ে ওদের মধ্যেই কামড়াকামড়ি লেগে গেল। স্বাধীনতার পর নিজেদের এই দেশ ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যা ইংরেজ সরকারের আমলের চেয়েও ভয়ানক। কারণ গৃহযুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই।ʼʼ
অন্তূ নির্নিমেষ তাকিয়ে শুনছিল সেসব। তার বুকটা কাঁপল। ইচ্ছে করল মুরসালীনকে বাঁধা দিতে। মুরসালীনদের বাঁচতে হবে। ওরা ফুরিয়ে গেলে কেয়ামত হবে দুনিয়ায়। অন্তূ মনে হলো–মুরসালীনের ভাবনার মতো খাঁটি ভাবনা আর হয়না। দেশের সব দলই তো একমাত্র ক্ষমতাই চায়, নিজেদের অস্তিত্বের জোগান অর্থাৎ ক্ষমতা! কেউ তো ছাড়তে চায়না, কেউ ত্যাগ করতে রাজী নয়! কিন্তু মুরসালীনের কি ভয় পাওয়া উচিত নয়? ওকে মেরে ফেলবে এরা, তারপর এভাবে এসব ভাববে কে?
দোলন সাহেব শক্ত হয়ে বসে রইলেন। মুরসালীনের শর্ত অনুযায়ী কথা বলা যাবেনা।
মুরসালীন বলল, “আমার আব্বা ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন। উনার প্রাক্তনেরা ছিলেন–শহীদ জিয়াউর রহমানের মতো কিংবদন্তিগণ। বলাই বাহুল্য আব্বা কোন দলের প্রতি সামান্য হলেও অনুরাগী ছিলেন। অপারেশন ক্লিনহার্টে পলাশ আজগরের বাবাকে দেশছাড়া এবং ওর দাদাকে বন্দি করেছিলেন তার জুনিয়রেরা। পলাশ আজগরের দাদা কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। সেই শোধ নিতে গিয়ে পলাশ আজগর আমার খোঁজ না পেয়ে আমার বোনকে ধ/র্ষ/ণ ও খু/ন করেছে। আমার ভাইকে জয় আমির আগেই মেরে ফেলেছে। স্যার, আমি রাজনীতিতে নয়, রাজনীতি আমাতে জড়িয়েছে। এতসবের পরও নিরপেক্ষ থাকি কী করে? ব্যক্তিজীবনকে এড়ানো দ্বায়, স্যার! তার ওপর বংশ পরম্পরায় পাওয়া এই রোগ।ʼʼ
ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। জয় আঙুলের ভাঁজে চাবি ঘোরাচ্ছে বসে। হামজা লৌহখণ্ডের ওপর আঁকিবুকি করছে। অন্তূ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মুরসালীনের কথা। জয়ের দিকে তাকাল। এক ফোঁটা অনুশোচনা অথবা অভিব্যক্তিল পরিবর্তন নেই মুখে। বিরক্তিও নেই এসব কথা শোনাতে, আগ্রহ তো নেই-ই।
দোলন সাহেব বললেন, “অনেক ভুল-বোঝাবুঝি আছে তোমার মাঝে।ʼʼ
মুরসালীন হাসল, “মানুষ মাত্রই ভুল।ʼʼ
চয়ন উঠে এসে মুরসালীনের সামনে দাঁড়াল। হ্যাংলা পাতলা চেহারা, হাতের আঙুল ছয়টা। কালো কুচুটে চেহারা। দাঁতের মাড়ি চেপে ধরে বলল, “সব কথার ওই এক কথা—দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তুমার ব্যথা আছে।ʼʼ অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে বলল, “তুই রাজাকারই তো শালা। যুদ্ধে তোর আমিরদের ফাটছে একসময়। এহন তোরও ফাটে। আর কস তুই যুদ্ধা-পরাধী-গোরে সমর্থক না?ʼʼ
মুরসালীন মাথা নাড়ল, “এখনও বলছি।ʼʼ
আর কে ঠেকায়! চয়ন একাধারে কয়েকটা কঠিন আঘাত করে গেল মুরসালীনের শরীরে।
থেতলানোর ওপর থেতলে গেল মুখটা। রক্তে মুখ ভরে উঠল। পুরোনো চটা পড়া ক্ষত তাজা হয়ে উঠল সব। চয়ন বলল, “তুই আন্দোলন করিস, ওগোর সাহায্য করোস, আমাদের বিরুদ্ধে কথা তুলোস, পুরোপুরি এক্টিভ তুই, শালা। তবু বাটপারি? নটকি মাগীর পুত। তোরে জিন্দা কব্বরে গাইড়া রাখমু একদম।ʼʼ
মুরসালীন কিছুটা সময় নিলো। হাত দিয়ে রক্ত মুছলো। কয়েকটা শ্বাস নিলো জোরে জোরে। এরপর বলল, “কোনো দলের জন্য নয় সেসব। ব্যক্তিগত সমস্যা আর মানুষের দুর্ভোগ দেখে টুকটাক হাত চুলকায়…ʼʼ
-“তোমার ধারণা নয় খালি, গোড়া থেকে ভুল।ʼʼ
ভীষণ শান্ত মানুষ হিসেবে আবিষ্কৃত হলেন দোলন সাহেব। রাগছেন না, কাউকেই বাঁধা দিচ্ছেন না। সুন্দরভাবে মুরসালীনের মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন।
মুরসালীন একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, “তাহলে তো অনেক পেছনে যেতে হয়, স্যার।ʼʼ
-“কতদূর?ʼʼ দোলন সাহেব হাসলেন, “মোঘল আমলে?ʼʼ
-“না। অতদূর না। ভারত বিভাগের কাছে গেলেই আপাতত চলবে।ʼʼ
-“চললেই হলো।ʼʼ
-“স্যার, এই পৃথিবীতে যতগুলো দেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়েছে, তারা সবাই ছিল একেক নম্বরের স্টুপিড। আপনার ওই জোয়ান শরীরের গরম রক্ত, ভীষণ এডভেঞ্চার চায় স্যার। শরীরের তেজে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে যেতে রক্ত টগবগ করে তখন। আপনি জানেন, বেশির ভাগ বিপ্লবী যুবক ছিল!ʼʼ
কামরুল বলে উঠল, “তাই নাকি? আমি তোমাকে এতটাও স্বাধীনতাবিরোধী ভেবেছিলাম না! বাপরে! ভয়ই লাগতেছে তোমারে এখন। পাকিস্তানের গোলামি করতে এত সৌখিন তুমি, অথচ এতগুলা দিন বাইরে ঘুরছো! এখন তো দেখছি, তোমাকে ফাঁসি দিয়েও শাস্তি পুরো করা যাবেনা।ʼʼ
মুরসালীন হেসে উঠল। দাঁতের ফাঁকে জমাট রক্ত দেখা গেল। বলল, “শূলের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হবে। পাঁচ খণ্ড করে দেশের একেকটা জাদুঘরে স্থাপনা হিসেবে রাখলে ভালো। নামফলকে লেখা থাকবে–’সেরা দেশদ্রোহীদের মাঝে একজন সৈয়দ মুরসালীন মহানের দেহখণ্ড। কেউ হাত ছোঁয়াবেন না।ʼʼ
দোলন সাহেব বরাবরের মতো শান্ত স্বরে বললেন, “কেন এই বিরোধ! যুক্তিযুক্ত মানুষ তুমি, দু চারটে যুক্ত-ব্যাখ্যা দাও, শুনি।ʼʼ
-“আমি যৌক্তিক মানুষ নই। পর্যবেক্ষক টুকটাক। আমার পর্যবেক্ষণ মতে–যুদ্ধ করে কী পেয়েছি আমরা? একটা স্বাধীন ভূখণ্ড? আর সেক্ষেত্রে স্বাধানীতার সংজ্ঞা হয় এমন—পরের দেশের শাসক পেছন মারবে কেন? পেছন মারবে মারুক, নিজের দেশের শাসক মারুক। আমরা এরকম একটা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। স্বাধীনতাপ্রবণ বাঙালি আজ অবধি স্বাধীনতা মানে এটাকেই বুঝে ষোলোই ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উদযাপন করে আসছে। অথচ আমি বলি—১৬ই ডিসেম্বরে পাক বাহিনী দেশ স্বাধীন করে দিয়ে যায়নি, নিজেদের হাত থেকে অন্য আরেক হানাদার বাহিনীর কাছে কেবল দেশটা হস্তান্তর করে রেখে গেছে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের কাছে দেশ থাকলেই বা কী, অথবা দেশের হানাদারের কাছে! আমরা তো জন্মেছিই কেবল শোষিত হবার জন্যই। যার তার হাতে হলেই হলো!ʼʼ
মুরসালীন একটু থেমে বলল, “স্বাধীনতার আগে আর পরের পার্থক্য শুধু–পরের দেশের শাসক এবং নিজের দেশের শাসক। অনেকটা ওরকম—নিজের লোক চিবিয়ে খেলে সহ্য হয়, পর টোকা দিলেও না। বুঝতে পারছেন স্যার?ʼʼ
-“তুমি যা বোঝাতে চাচ্ছ, তা যারা বুঝবে তারা এখন ফাঁসির অপেক্ষায়। আমরা বুঝব না এসব।ʼʼ
-“একটা গল্প শুনবেন স্যার?ʼʼ
-“অনেক গল্প জানো তুমি।ʼʼ
-“তা জানি টুকটাক। তবে এখন গল্প থাক। ব্যাপারটা হলো–অবুঝকে বোঝানো গেলেও যারা বুঝে বোঝেনা, তাদেরকে বোঝানো অসম্ভব। ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম পাড়ানো যায় না, স্যার।ʼʼ
মাথা দুলিয়ে হাসলেন দোলন সাহেব, “তোমার নিজের স্বাধীনতা বিরোধি মানসিকতার স্বপক্ষে আরও অনেক ধারণা থাকবে। সেগুলোও শুনতে ইচ্ছে করছে।ʼʼ
-“জি স্যার, জানা দরকার। নয়ত আমার ফাঁসিটাকে জনগণের কাছে জায়েজ করতে কষ্ট হবে। তা যেমন ধরুন, আগে বিদেশীরা আমাদের দেশে এসে আমাদের জনগণ ও সম্পদ শোষন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যেত। স্বাধীনতার পর বিদেশীদের এই খাটুনিটা কমেছে। অর্থাৎ বিপ্লবীরা রক্ত ঝরিয়ে দেশ স্বাধীন করে এখন নিজেরাই জনগণ ও দেশের সম্পদ শুষে নিয়ে গিয়ে ইংরেজদের দেশে দিয়ে আসছে। এটা ভালো, স্যার। ওরা এসে কেন নিয়ে যাবে, আমরা গিয়ে দিয়ে আসব। পরোপরকারী শাসকগোষ্ঠী।ʼʼ
মুরসালীনের মুখটা কঠিন হলো, “স্যার, আমি শুধু দেখেছি ওরা নিজেদের অতীতের কৃতিত্ব তুলে ধরে নিজেদেরকে দেশের সর্বেসর্বা প্রমাণ করা ছাড়া বিশেষ কিছু করেনি। আর তা নিয়ে দলীয় বিবাদে ওরা চুল ছেঁড়াছিড়ি করছে, আমরা আম জনতা বলি হচ্ছি। স্যার, আমি কোনো দলেরই সমর্থক নই। কেবল মাঝেমধ্যে দোলাচলে গড়িয়ে পড়ি একেক পাশে, এই যা।ʼʼ
সব কথা রেখে দোলন সাহেব ভ্রু উচিয়ে সতর্ক কণ্ঠে বললেন, “আর সবশেষে কথাটা কিন্তু এ-ই আসছে, ওরাও যুদ্ধের বিরোধী ছিল, তুমিও। ওরাও কওমী জামায়াতের সমর্থক ছিল, তুমিও।ʼʼ
-“খুব ভুল বললেন। সেগুলো কি ব্যাখ্যা করব, স্যার।ʼʼ
-“করো করো। আমি শুনতে চাই।ʼʼ
-“ছোটবেলায় যখন যুদ্ধের গল্প অথবা উপন্যাস পড়তাম, পাকিস্তানিদের ওপর এত কঠিন ক্ষোভ জমতো, ইচ্ছে করতো এখন সুযোগ পেলে এখনই ঘাঁড়ে রাইফেল আর হাতের ওপর জানটা নিয়ে যু-দ্ধে চলে যাই, ওদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দেশবাসীকে রক্ষা করি।ʼʼ
মুরসালীন জোরে জোরে হাসল, “বাচ্চা ছিলাম, স্যার। বুঝতাম না। কিন্তু একটু একটু করে বড় হলাম–এরপর দেখলাম–পরের দেশের শাসকেরা এতটা ভয়নাক ছিলই না বাঙালি জাতির ওপর, তথাকথিত সেই স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালির সাথে যা যা হয়ে আসছে! তো সেই একই পরাধীনতা যদি এখনও বাঙালিকে গ্রাস করে রাখে, তবে আপনার মনে হয় না স্যার, যুদ্ধটা কেবলই দেশপ্রেমিক বিপ্লবী শহীদদের র-ক্তের অপচয় ছিল? কারণ আমরা বাঙালি তো আজও স্বাধীনতা পাইনি। শুধু নাম পেয়েছি স্বাধীন জাতির। এই ফাঁপা নাম কামানোর জন্য এত আয়োজন ছিল! এত র-ক্ত, এত ত্যাগ, এত সম্মানহানি, এত হাহাকার!ʼʼ
একটু থেমে মুরসালীন বলল, “স্যার, এ কারণে হলেও সে-সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, তাদেরকে আমার সচেতন মনে হয়। আর স্যার–ʼʼ
থামল মুরসালীন। দোলন সাহেব বললেন, “বলো বলো। থামলে চলবে না আজ। বলে যাও।ʼʼ
মুরসালীন হাসল, “আপনারা যাদের যুদ্ধাপরাধী বলে শাস্তি দিচ্ছেন, তাদের বয়স হিসেব করলে আপনাদেরকে মূর্খ অথবা শয়তান ছাড়া কিছু বলা যায় না। নাবালক শিশু ছিল তারা বয়স হিসেবে, তাদের দিচ্ছেন দেশদ্রোহীর শাস্তি একালে এসে। আবার আজও যারা শিশু, তারাও আপনাদের শিকার! স্যার মূলত, আপনাদের সমস্যাটা কোথায় বলুন তো! সমস্যা মূলত ইসলামে। কারণ ইসলামের জীবনবিধান আপনাদের একরত্তি কর্মকাণ্ডকেও সমর্থন করে না। সমস্যা আপনাদের মূলত, কথা বলা মুখে। যে মুখগুলো মূর্খ-বোকা বাঙালদের সম্মুখে আপনাদের স্বরূপ তুলে ধরে নিজেদের বয়ানের মাধ্যমে। সমস্যা মূলত, আপনাদের অ-নীতিতে। যে নীতি শিবিরের ছেলেরা গুড়িয়ে দিতে চায়। তাই যেন দেশে আর কোনো বিবেচক মুক্তিপ্রেমী গরম রক্তের যুবক তৈরি না হয়, সেই ব্যবস্থা করছেন আপনারা। যারা তৈরি হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের মিটিয়ে দিচ্ছেন। আপনাদের সমস্যা নেই জয়েদের থেকে। কারণ ওরা আপনাদের কাছে অনৈতিক সুবিধা আর সব রকম প্রশ্রয় পেয়ে অন্ধ, ওরা অবিবেচক, ওরা আপনাদের কাছে ঋণী, তাই বিরুদ্ধে বলার মানসিকতা হব না ওদের। অথচ আপনারা কোথাকার কোন মিছেমিছি যুদ্ধাপরাধ, কোথাকার কী টেনে এনে পথ সাফ করছেন! কৌশল ভালো, তবে সস্তা।ʼʼ
চলবে…
[১. বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে যাবেন। যার যার মতামত ও দৃষ্টিকোণ তার তার কাছে। আর এখানে যা লেখা হয়েছে, তাতে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ মেলাতে যাবেন না। আপনারা অবশ্য তাতে পটু। উপাখ্যানের একটা চরিত্র খাবলা ধরে গু খেলে আপনারা ধরে নেন লেখিকাও তিন বেলা নিয়ম করে গু খায় বলে চরিত্রও ওরকম বানিয়েছে। তবে যে লেখিকা গু খাওয়া চরিত্র বানায়, সে কিন্তু একই গল্পে পোলাও-বিরিয়ানী খাওয়া চরিত্রও বানায়। সুতরাং গল্পের চরিত্রকথন আর লেখিকার বর্ণনার পার্থক্য বোঝার জ্ঞানটুকু ভেতরে রাখলে ভালো।
২. আপনারা যত সহজে একটা পর্ব পড়ে অভিযোগ ঝেরে চলে যান, অথবা ভাবেন ইচ্ছাকৃত আপনাদের অপেক্ষা করিয়ে ভীষণ লাভবান হচ্ছি আমি, তা নয়। গোটা উপাখ্যানের ভিত্তি মিলিয়ে একেকটা পর্ব সাজিয়ে তোলাটা তেমন সোজা কাজ নয়। এছাড়া আমি লিখছি এক বিতর্কিত ও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে। অনেককিছু কাটছাট করতে হয়, বিবেচনার ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। বিস্তর মানসিক প্রস্তুতি লাগে লিখতে বসতে।
আমি ভীষণ অদক্ষ, ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।আর মন্তব্য করবেন।☹️ যা মনে হবে, জানাবেন। ভালোবাসা আমার ধৈর্যশীল পাঠকসকলকে।]