অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৬৬.

0
1

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৬.

গাড়িতে উঠতে গিয়ে হামজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ড্রাইভিং সিটে কবীর নেই। নিটু বসে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে হালকা। সকাল দশটা বাজে।

গাড়ি ছাড়ার সময় হলে অন্তূ ছুটে এসে পেছন থেকে ডাকল, “মেয়র সাহেব!ʼʼ

হামজা ফিরে তাকালে অন্তূ বলল, “শুভ সকাল, মেয়র সাহেব!ʼʼ

হামজা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নামায়, আলতো হেসে বলে, “শুভ সকাল!?ʼʼ

-“কোথাও যাচ্ছেন, নিশ্চয়ই! আমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। বৃষ্টির ভেতরে রিক্সা পাওয়া ঝামেলা।ʼʼ

হামজার ভ্রু কুঁচকে উঠল। অদম্য সাহস মেয়েটার। আড়ষ্ঠতা, সংকোচ কিচ্ছু নেই। হামজার সঙ্গে কথা বলার সময় এমনকি রিমির কণ্ঠেও এক প্রকার জড়তা ও সমীহ থাকে। কতকাল হামজা নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে কাউকে কথা বলতে শোনেনি, দেখেনি।

হামজা জানায়, “আজ ভার্সিটিতে যাবে না, তুমি। আমার অনুমতি নেই।ʼʼ

অন্তূ এগিয়ে এসে হামজার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলল, “আপনার আদেশ-নিষেধের পরোয়া করি না আমি, মেয়র সাহেব। জানেন তো আপনি।ʼʼ

অন্তূ হামজার পাশে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। বসে থাকে দুজন পাশাপাশি। হামজার শরীর থেকে হ্যাভি বডি-স্প্রে-এর গন্ধ উড়ছে। দুজনের মাঝে আধা-ফিট ফাঁক। কেউ কারও দিকে তাকায় না। রাস্তারা পিছনের দিকে পিছিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি এগিয়ে যায়। দুজনের এই নীরবতা এক ক্ষমতাধর ধূর্ত পুরুষের সঙ্গে এক আঘাতপ্রাপ্তা ঘায়েল নারীসত্ত্বার অঘোষিত যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে যায় নিঃশব্দে। অনেক পুরোনো এই বিরোধ! সাধারণ সম্পর্কে অন্তূর এই বিরোধ ভাসুরের সঙ্গে।

এক সময় হামজা সিটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে অল্প হাসে, “থাবা দিয়ে ধরলে আর পার পাবে না। অনেককিছু করেছ, করছো। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, আমাদের বিরোধীতা করে জেতা যায় না।ʼʼ

-“আপনাদের নয়, মেয়র সাহেব। ‘আপনাদেরʼ বলছেন কেন? বিরোধীতা কবে আপনাদের সঙ্গে ছিল? বিরোধিতার সম্পর্ক আমার জয় আমিরের সঙ্গে। আগুন-পানির মতো। হয় আমি, নয় সে। আমি সক্রিয় হলে সে নিভে যাবে। সে সক্রিয় হলে আমি বাষ্প হয়ে নিঃশেষ হব।ʼʼ

অন্তূ অল্প থেমে তাকাল হামজার দিকে, “আপনার সঙ্গে আমার যা, তা বিরোধিতা নয়, মেয়র সাহেব। ওটা কারবার, এক প্রকার লেনদেন। তা শুধু আপনার সঙ্গে, শুরু থেকেই তা কেবলই আপনার সঙ্গে।ʼʼ

হামজা হাসে, “কোন শুরু?ʼʼ

অন্তূও কেমন করে যেন হাসে, “আমার ইজ্জত, আমার জীবন, আমার আব্বুর অবসান! ভুললে চলবে?ʼʼ

হামজা গা দুলিয়ে হেসে উঠল, “এসবের দায় আমার নাকি?ʼʼ
অন্তূ প্রগাঢ় চোখে তাকাল, তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল। শ্বাসের ভারে বুকের উঠানামা বাড়ল, মুখটা কঠিন হয়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে এলো।

-“আপনি সেদিন যখন বলেছিলেন—’লোকজন চাইলে আপনি আমাকে জয় আমিরের বউ করতে পারেন।ʼ তখনও বুঝিনি। কিন্তু বুঝেছি সেই কয়দিনে, যে কয়দিন আব্বুর শোক কাটাতে আমি ও বাড়িতে কাটিয়েছি।ʼʼ

হাসি মুখে রেখে হামজা ভ্রু উঁচায়, “কী বুঝলে?ʼʼ

-“পলাশ আজগর নয়, আপনি আব্বুকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর পলাশের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবং সেটা শুধুই আমাকে দমাতে। কয়দিন আপনার সামনে আমার খুব আলোচনা উঠছিল বারবার, তাই না?

সে সময় মুমতাহিণার মৃত্যু আর জয় আমিরের অসভ্যতা নিয়ে আমি খুব সোচ্চার হয়ে উঠেছিলাম। আপনার ভয় ছিল—কোথাও জয়ের রেপুটেশন আর আপনার ক্ষমতায় আঁচ না লেগে যায়। সেই যে ভার্সিটি পরিষদে আমার পক্ষ থেকে জয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ। আর তাতে জয়ের ক্ষমতাচ্যুতির আশঙ্কা! তা সামলাতে বেগ পেতে হয়েছিল আপনাকে!ʼʼ

হামজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে কোরে সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে ঠোঁটে গোঁজে। চোখ বুজে ধোঁয়া ছেড়ে চোখ মেলে তাকিয়ে বলে, “আর?ʼʼ

অন্তূ জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো। বৃষ্টির ঝাপটা কমেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।

গাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তারপর পাটোয়ারী বাড়িতে সেচ্ছায় পা রাখলাম। খুব আগ্রহের সাথে। তখনও জানতাম না মুমতাহিণার মরণক্ষেত্র এটাই। শুধু আন্দাজ ছিল। সেটা সত্যি মনে হতে থাকল ধীরে ধীরে। আমি তখন মাঝেমধ্যে ইচ্ছাকৃত আবার কখনও অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। বোকামির মতো দেখতে কিছু কাজ করেছি।

শেষে সত্যি হলো আমার ধারণা। তখন বুঝলাম, আপনার আমাকে দমাতে চাওয়ার এটাও আরেকটা আর প্রধান কারণ। আমি যেহেতু কার্যালয়ে ঘুরেছি, মুমতাহিণার ব্যাপারে খুব ভাবছি। আমার প্রচেষ্টায় এই জটিল প্যাঁচটা কোনোভাবে খুলে গেলে সবটা ক্ষতি মূলত আপনারই! শিকড় আপনি, মূল আপনি। এবং আশ্চর্যজনকভাবে এই কাহিনি গাছের কাঠামোটাও আপনি।

আপনি জানলেন, আমার দূর্বলতা দুটো—আমার আব্বু, আমার সম্মান। আপনি পলাশের মাধ্যমে এক্সাক্ট সেই দুই জায়গাতেই হাত মারলেন। আপনি খুব বোঝেন–আমার মতো মেয়েকে কাবু করতে লম্পট নজরের বিকল্প নেই। সেদিন আব্বুর অবস্থা আর পলাশের আগ্রাসী হামলা আমাকে যে পরিমাণ ভঙ্গুর করেছিল! আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেছি সত্যি! এত্ত ধারালো আর হিসেবি বুদ্ধির মালিক আপনি। নিখুঁত, মেয়র সাহেব!

আমি বিষয়টা বুঝেছিলাম এটা ভাবতে গিয়ে—পলাশ চাইলেই অন্তিককে কেটে টুকরো করতে পারতো। কিন্তু সে অন্তিককে পালানোর সুযোগ দিয়ে আব্বুকে ধরলো! একবার অবশ্য মাথায় এসেছিল–পরিবারকে জিম্মি করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার বদলে অন্তিককে টাকা নিয়ে নয় বরং পলাশের ডেরায় আমাকে ডাকা হলো ফোন করে। টাকার প্রসঙ্গ সাইডে রইল। মূখ্য হলো আমার অসম্মান আর আব্বুর আঘাত। আমাকে অসম্মান করতে চাওয়া, জয়ের নির্লিপ্ততা, আব্বুকে ওভাবে প্রায় অকারণে আঘাত করা।

সবকিছুর হিসেব কষতে গিয়ে একটাই সূত্র সামনে এলো—আমাকে ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে দেওয়া, আমাকে রুখতেই সব আয়োজন। আর তাতে খুব সহায়ক হয়েছিল অন্তিকের জেদের বশে করা একটা ভুল। মেয়র সাহেব, আমি কি ঠিক বলেছি?ʼʼ

হামজা বাহবা দেবার মতো ভঙ্গি করে হাসল, “তুমি সুযোগ পেলে আসলেই খুব ভালো ইনভেস্টিগেটর অথবা লয়্যার হতে পারতে। কিন্তু আফসোস! সেই সুযোগটা না পাবার ফলে তোমার এমন তীব্র মেধা বিফলে যাবে।ʼʼ

অন্তূ হাসল, “আব্বু একটা কথা বলতো।ʼʼ

ভ্রু উঁচায় হামজা, “আচ্ছা! কী বলতো?ʼʼ

-“বলতো—শিক্ষা সুযোগের অপেক্ষা করে! কিন্তু অভিজ্ঞতা সুযোগকে কেড়ে নেয়।ʼʼ

-“তোমার সেই অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে করছো তুমি যে, আমার কাছ থেকে সুযোগ কেড়ে নেবে?ʼʼ

অন্তূ গাড়ি থেকে নেমে ফিরে তাকাল, “আপনার পিঠ দেয়ালের কাছাকাছি। এটাকে সতর্কবার্তাই ধরে নিন, মেয়রসাহেব! খুব বেশি সময় পাবেন না নিজের ধারালো মস্তিষ্ককে কাজে লাগাতে। চাল চালতেও অল্প সময় দরকার পড়ে।ʼʼ

ততক্ষণে হামজাকে টের পেয়ে ভার্সিটির ছেলেরা গাড়ি ঘিরে ধরেছে। সেই ভিড়ের মাঝে মিশে গেল অন্তূ। হামজা শান্তভঙ্গিতে কেবল চেয়ে রইল সেই ভিড়ের কোলাহল ছাপিয়ে। তার মনে হচ্ছিল—অন্তূকে নিয়ে আরও সতর্ক হওয়ার ছিল। কিন্তু আর কত? নিজের ধারণ করা একটা কথা মনে পড়ল—’আঘাতপ্রাপ্ত কোনো নারী যদি কুচক্রী হয়ে ওঠে, সেই নারীর তৈরিকৃত ফিতনাকে মোকাবেলা করা অসাধ্য হয়ে পড়ে।ʼ


তুলি ঘর থেকে বেরোয় না। রিমিও নিশ্চুপ। গোটা বাড়িটা যেন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে। সেখানে বসবাস ছয়জন মানুষের। কিন্তু তারা সকলে যেন মৃত। জয় বাড়িতে থাকে কদাচিৎ। যতক্ষণ থাকে হয় ঘুমায় নয়ত বেহেড থাকে।

এখন আর সবাই একসাথে টেবিলে বসে খাওয়া হয় না এ বাড়িতে। তুলির রুমে খাবার দিতে গিয়ে অন্তূ দেখল, তুলি নামাজে বসেছে। অন্তূ ভাবে—কেউ কেউ বেশি কষ্টে ধর্ম বিমুখ হয়ে পড়ে, কেউ-বা ধর্মমুখী। তুলির কাছে বসে থেকে লাভ নেই। সে কথা বলে না। হাসলে দেখতে উন্মাদিনীর মতোন লাগে।

অন্তূ রুমে ঢুকতেই জয় গোসল করে বের হলো। ক্ষত-বিক্ষত বুক-পিঠ। কী ভয়ানক সব দাগ! গর্ত হয়ে হয়ে আছে। কোথাও বা সেলাইয়ের দাগ, কোথাও চামড়া ঠেলে মাংস বেরিয়ে আছে। গলায় লাল গামছা ঝুলছে। পরনে আরেকটা গামছা। সে তোয়ালে ব্যবহার করে না। তার পোশাক গামছা, লুঙ্গি, শার্ট প্যান্ট, হাফ-প্যান্ট। পাঞ্জাবী পরে হামজার ধমকে লোক দেখাতে। নামাজটাও কয়েকবার তেমনভাবে পড়তে হয়েছে।

লোকের সামনে পড়ে গেলে ভালোমানুষী দেখাতে নামাজে যাবার ভঙ্গি করেছে হামজার কথায়। এতে একটা আলাদা মজা আছে তার মতে। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া দারুণ এক মজার বিষয়! নয়ত তার কোনো ইচ্ছা নেই মানুষের কাছে ধার্মিক প্রমাণিত হবার।

অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “লুঙ্গি কই আমার, ঘরওয়ালি!ʼʼ

-“ছাদে।ʼʼ

-“এনে দাও।

-“দুঃখিত!ʼʼ

জয় ঠোঁট উল্টে কাধ ঝাঁকালো, “ওকে! তাইলে গামছাটা খুলে শুয়ে পরতে হবে। ভেজা গামছা পরে তো আর শোয়া যায় না।ʼʼ

জয় গামছার গিট্টুতে হাত রাখে। আর দেখল না অন্তূ। বিদ্যুতের গতিতে পেছন ফিরল, দুই চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলল, “বেহায়া, নির্লজ্জ ব্যাটাছেলে। আল্লাহ, মুক্তি দিন।ʼʼ

পেছন থেকে উচ্চস্বরে হো হো করে হাসির শব্দ শোনা গেল জয়ের। সেই হাসিতে ঘর বাজছে। জয় বলল, “তাকাও তাকাও! পেছন ফিরে তাকাও, ঘরওয়ালি। সিনারি দেখাই।ʼʼ

অন্তূ চিবিয়ে বলল, “আপনার মতো নোংরা লোকই কেন ছিল তকদিরে?ʼʼ

-“তোমাদের মতে যিনি তকদির লেখেন তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত। আমি তো ওসব তকদির-ফকদির মানি না।ʼʼ

অন্তূ দুই হাতে মুখ ঢেকে দাঁত খিঁচে বলল, “পশুর চেয়েও অধম পুরুষ মানুষ, আপনি! জাহান্নামে যান।ʼʼ

তার ধারণা জয়ের দ্বারা সব সম্ভব। আসলেই যদি গামছা খুলে দাঁড়ায়! অন্তূর গা গুলিয়ে এলো। তখনই জয় সামনে এসে দাঁড়াল, “লুঙ্গি এনে দেবে নাকি হাতটা টেনে মুখ থেকে সরিয়ে দেব?ʼʼ

অন্তূ হাতে মুখ ঢেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। জয় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। গামছা সে খোলেইনি। তার সভ্য বউ তাতেই বেকাবু।

লুঙ্গি এনে দেখল জয় আলমারী থেকে নতুন একটা লুঙ্গি পরে সিগারেট ধরিয়েছে। ক্ষুব্ধ হাতে লুঙ্গিটা জয়ের সজোরে মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল অন্তূ। জয় লুঙ্গি সরিয়ে জোরে জোরে হাসে। তারপর বলে, “একটু ভাত-টাত খাইয়ে দেবে?ʼʼ
-“বিষ দেব।ʼʼ

-“তা দাও, সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার হাতে খাইয়ে দাও।ʼʼ

-“আপনার হাতে বোমা পড়েছে নাকি?ʼʼ

-“তোর মুখে বোমা পড়ুক, শালী। ভাত আন।ʼʼ

জয়ের অশিষ্টতা আজও অন্তূর ভেতরে আগুন জ্বালায়। এতগুলো দিনেও সয় না নিজের এমন অসম্মান। দুটো দীর্ঘশ্বাস টেনে শান্তস্বরে বলল, “এভাবে নয়। যেভাবে বললে আনবো, সেভাবে বলুন। নয়ত জানেন এখানে না খেয়ে মরলেও ভাত পাবেন না।ʼʼ

অন্তূকে টেনে কাছে দাঁড় করিয়ে চোখের দিকে তাকায় জয়। অস্তমিত স্বরে বলে, “আমি যা বলব, সেটার বিপরীত যা হয়, তাই। না?ʼʼ

-“সম্পর্কটা তো তেমনই!ʼʼ

জয়ের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে দেয় অন্তূ। জয় অল্প হাসে মাথা নত করে। কোমলভাবে, স্মিত নজরে অন্তূকে স্পর্শ করলে অথবা কথা বললে অন্তূ সেটা খুব কঠিনভাবে, আলগোছে এড়িয়ে যায়। অর্থাৎ সে তাদের মাঝে বিরোধকে খুব যত্ন করে ঠাঁই দিলেও কোমলতাকে ভুলেও ঠাঁই দেয় না।

মাথা তোলে জয়, “সম্পর্ক বুঝি না আমি।ʼʼ

খানিক দূরত্ব রেখে বসে অন্তূ, “আমিও বুঝি না।ʼʼ

জয় যখন নরম, স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিল, তখন অন্তূ গিয়ে খাবার এনে দিলো। তার আগে নয়। জয় হাসে। কপালে আঙুল চেপে ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে হাসে। তার বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবকিছু আছে অন্তূর মাঝে। কিন্তু সেসবের রূপটা বিপরীতের মতো। ঠিক যেমন বস্তু, ও সেটার আয়নায় দেখা যাওয়া প্রতিবিম্বের সরূপ! এজন্যই তাদের কোনো পরিণতি নেই। একই ধর্মী দুই পক্ষের কোনো পরিণতি থাকে না, শুধু বিরোধ ও বিকর্ষণ ছাড়া।

অন্তূ বা জয় কেউ কারও দিকে তাকায় না সচরাচর। অভ্যাস নেই তাদের। কিন্তু যখন তাকায় তখন দুজন একত্রে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে কেবল দহন ছাড়া কিছু থাকে না।

জয় খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি খাইছো?ʼʼ

অন্তূ জয়ের খাওয়া দেখছিল মুখ বিকৃত করে। বিশাল বিশাল যেমন হাতের তালু, সেরকম একেকটা বিরাট সাইজের লোকমা। বিকট লাগে অন্তূর চোখে। হাতদুটো কঠিন, হাতের মোটা মোটা রগ চামড়ার ওপর ঠেলে ওঠা। কালো পশমে ঢাকা কনুইয়ের নিচ থেকে শ্যামলা হাত। বিশাল বিশাল আঙুল।

-“আপনি এভাবে খান কেন? ভদ্রভাবে, মানুষের মতো খাবেন।ʼʼ

এরপর জয় আরও বিশ্রীভাবে খাবার খেতে শুরু করল। অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ফেরায়।

খাওয়া শেষে সফ্ট-ড্রিংকস হিসেবে দুই প্যাগ মদ খেলো।

রাত দেড়টা অবধি উপুড় হয়ে বিছানার ওপর পড়ে রইল। জয়ের রুমের বেলকনির দরজার পাশে একটা মরিচা ধরা রকিং চেয়ার আছে। অন্তূ সেই চেয়ারটায় বসে থাকে। কোলে বই। কিন্তূ অন্তূ পেছনের দিকে মাথা হেলিয়ে চেয়ারে বসে দুলতে থাকে। চোখ দুটো বোজা।

জয়ের রুমে একটা পেন্ডুলাম ঘড়িয়ে আছে। ঘন্টা পর পর ঢং ঢং করে বাজে। জয়ের খুব পছন্দের জিনিস এটা। হামজা কোথা থেকে কিনে এনেছিল, জয় কেড়ে নিয়েছে।

অন্তূ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে জয়ের দিকে। মুখ এদিকে ফেরানো। চোখ বুজে আছে। চোখের পাতা কাঁপছে। অর্থাৎ ঘুমায়নি। জয়কে সে রাতে ঘুমাতে দেখেনি। রোজ পাশাপাশি শুয়ে দুজন টের পায়–কেউ ঘুমায়নি।

পেন্ডুলাম ঢং ঢং করে বেজে জানায় রাত একটা বাজল। অন্তূ উঠে গিয়ে অল্প একটু জায়গা নিয়ে শোয়। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। তার আর জয়ের মাঝে অসীম দূরত্ব। সেই দূরত্বকে সাথী করে দুজন রাতের পর রাত পাশাপাশি শুয়ে কাটিয়েছে। শেষরাতে কখনও কখনও জয়ের হাতটা এসে অন্তূর শরীরের ওপর পড়লে, অন্তূ তড়াক করে জেগে উঠেছে। সরিয়ে দিয়েছে জয়ের হাতখানা।

অন্তূ চিৎ হয়ে শোয়। একটু চুপ থেকে বলে, “জয়!ʼʼ

বেশ খানিকক্ষণ পর জবাব দেয় জয়, “হু!ʼʼ

অন্তূ আর কথা বলে না। ভেতরের জমে আসা সংশয়, দ্বিধা ভেতরের দাফন করে। তার কেউ নেই। এই পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা কারও নয়, বা তারও কেউ নয়। ভাবীর খোঁজ জানে না সে। আম্মু কী হালতে আছে, জানা নেই। হামজা তার সঙ্গে কী করবে জানা নেই।

জয় উঠল। বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। অন্তূ উঠে বসে বলল, “আমি যাব আপনার সঙ্গে?ʼʼ

জয় জবাব দিলো না, তাকালও না। বেরিয়ে গেল। অন্তূ জগ ভরা পানি নিয়ে জয়ের পেছনে ছুটলো। জয় কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

সিঁড়িঘরের দরজা খুলে হনহনিয়ে কয়েক সিঁড়ি এগিয়ে গেল জয়। তার হাঁটার ধাপ বড়, লম্বা শরীর। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্তূ অভ্যস্ত নয়। তার পা ভড়কে যায়। জগটা শব্দ করে পড়ে গেল, পানি ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে। মুহুর্তের মাঝে হাত বাড়িয়ে পড়ন্ত অন্তূকে জাপটে ধরে জয়। পড়লে মৃত্যু অথবা সেরকম কিছু হতে পারতো।

অন্তূর বুকে অনেকক্ষণ ঢিপিঢিপ চলছিল। জয়ের থেকে নিজেকে ছড়াতে চায় অন্তূ। জয় আঁটকে ধরে, গম্ভীর স্বরে বলে, “আমার কাছে আসো কেন? যখন দূরত্বই সই, তখন প্রয়োজনেও বা আমাকে চাওয়া কেন? তোমরা ভালো মানুষেরা স্বার্থপর হও খুব।

অন্তূ স্থির হয়ে দাঁড়ায়, “সবটা ভুল নয় আপনার কথা। তবে আংশিক ভুল বুঝেছেন।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ

অন্তূর হাতটা চেপে ধরে জয়। অন্তূ বলে, “আমি নামতে পারব।ʼʼ

জয় চাপা ধমক দেয়, “চুপ্প!ʼʼ

বাকি সিঁড়িটা অন্তূর হাত চেপে ধরে নামায় জয়।

স্থির হয়ে দাঁড়ায় দুজন। এমন অন্ধকারে, নিজের শরীরটাও কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান নয়। অন্তূ বলে, “আপনি যেচে পড়ে উপকার করে খোঁটা দিচ্ছেন?ʼʼ

-“তো কি ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার ছিল?ʼʼ

-“বাঁচিয়ে রাখার মানুষ তো নন আপনি আমার, জয় আমির। এই যে বললেন, আমরা স্বার্থপর। আপনি বুঝি স্বার্থহীন? আর স্বার্থহীন মানুষেরা সমাজে বসবাস করে, এবং সাথে এমন সব কুকর্ম করে বেড়ায়?ʼʼ

-“স্বার্থের জন্য খারাপ কাজ করি আমি?ʼʼ

-“নিঃস্বার্থে? নিঃস্বার্থে আপনি মানুষ মারেন, চারদিকে এতসব করে বেড়ান? নিঃস্বার্থে মানুষ সন্ন্যাসী হয়, সংসারধর্ম ত্যাগ করে পাগলবেশে ঘুরে বেড়ায়। ক্ষমার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে মোহমুক্তির পথে চলে যায়। নিঃস্বার্থ শব্দের অর্থ বোঝেন? নাকি শুধু মুখে রসিকতার খই ফুটিয়ে বেপরোয়া বাতাসে গা ভাসাচ্ছেন? যে মানুষ আত্মত্যাগী, উপরন্তু সর্বত্যাগী হয়, তাকে নিঃস্বার্থ বলে। আপনি প্রতিনিয়ত কিছু হাসিলের লক্ষ্যে, কিছু পূরণ করার উদ্দেশ্যে ছুটছেন। হয়ত কোনো পুরোনো ক্ষোভ অথবা জমে থাকা ঋণ। আর তা ফেরত চান আপনি, সেটা নিঃস্বার্থতা? নাকি আমার সঙ্গে সামান্য ব্যাপার থেকে আপনারা যা যা করেছেন এ অবধি, সেটা নিঃস্বার্থতা? যদিও সেসব অপরাধ নয়, তবু যদি ক্ষমা চরতেন তবু ভাবা যেত। বদলার আগুনে জ্বলে এতসবের পরেও নিঃস্বার্থতা?

মুখে রসিক রসিক কথা বলে ভীষণ কুল সাজা যায়! ভং ধরা যায়, আপনি খুব চাপা, খুব বেপরোয়া, লালসাহীন, বিশাল রহস্যময় মানুষ আপনি..

শব্দের প্রয়োগ শিখবেন। আমি আপনার কাছে প্রয়োজন পুরাতে আসিনি। আপনারা সেই ব্যবস্থা করেছেন, যাতে আমি আপনাদের অধিনস্থ হই। এখন দায় উঠাবেন না? বউ হবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম? নাকি আপনার কাছে র‌্যাগ খেতে গিয়েছিলাম? অথবা আপনাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করব বলে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলাম যে, প্লিজ আমার সম্মুখে এসে অন্যায় করুন, আমি তা রুখি! আমার সম্মুখে অকাজ হবে, আমি চুপ করে থাকব না, এটা আমার নিজস্বতা।

আপনি কী, কেন আমি জানি না। কিন্তু আমি অন্তূ যা হারিয়েছি, তা অপরাধ না করার অপরাধে, সাধারণ একটা ক্ষমতাহীন মেয়ে হবার অপরাধে। তার একাংশ হারাননি আপনারা। আমি অজানাকে জানি বোধহয়, সেটুকু ভাবনার বিস্তৃতি আছে। সেই শক্তিতে আমি এটা বলতে পারি—আপনাদের সঙ্গে যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, তো সেটার কারণ আপনারাও! কারণ আপনারা বংশগত রাজনৈতিক মানুষ, আপনাদের সাথে খারাপ হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি? সাধারণ জনতা আমরা। আমি কেন এতকিছু সহ্য করছি? শুধু আপনাদের অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়ায় তার দায় মেটাবেন না? মিটিয়ে যেতে হবে। আমি অন্তূ, আমার হারানোর সবটুকু শোধ পুরিয়ে নিয়ে মরব বোধহয়। কারণ আমি আপনার মতো নিঃস্বার্থ নই। আমারা মা-ভাবী, আমার সম্মান, আমার ক্যারিয়ার রাস্তায় ভাসছে। সেসবের হাল ধরতে হবে।ʼʼ

জয় অন্তূর চুল মুঠো করে ধরলে অন্তূ হাসে, “ইশ! সত্যি কথা নিতে পারেন না, আপনারা!ʼʼ

-“কী করবি তুই?ʼʼ

-“কখন বললাম কী করব? কী করার আছে আমার? হাত তো বাঁধা আপনার নামের শিকলে।ʼʼ

-“কথা ছলে ছলচাতুরী?ʼʼ

-“শুনেছিলাম–চোরকে কাবু করতে চোরের মতো করে ভাবতে হয়।ʼʼ

জয় অন্তূকে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো, ফিসফিস করে বলল, “আমি চোর না হে। খোলা বাজারে লোক ডেকে পাপ করে আসা পাপী আমি। চোর হবি তুই, পেছনে চাল চালিস।ʼʼ

-“তাহলে সেদিন পলাশের ছাদে যখন থুতু দিয়েছিলাম, তখনই ধরতেন। পরে অত ছক কষে, আয়োজন করে, নাটক সাজাতেন না। সংজ্ঞা কি মিললো ছলচাতুরী আর চোরের? আমার মুখ খোলাবেন না। বেশ তো চুপ আছি। খোঁচা মেরে ঘা তাজা করা কেন? আপনি জানেন, আমি মুখ খুললে আর সামনের জন কথা বলতে পারে না।ʼʼ

চলবে..

[ অনেকদিন পর পর গল্প দিই! এজন্য মনে হতে পারে, একই জায়গায় গল্প বুঝি অনেকদিন থেমে আছে। তবে যদি একত্রে সব পড়তেন, তবে দেখতেন আসলে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো সব সংক্ষেপে তুলে ধরলেও অনেক স্পেস চাই। আমি যে কত ভয় পাই উপাখ্যান বড় হয়ে যাবার। পঞ্চাশ পর্বে শেষ হয়নি, এই অফসোসে মরছি। যাহোক, সামনের পর্ব থেকে আপনাদের আকাঙ্ক্ষিত সেই অংশ। এরপর টানটান হবে পর্বগুলো। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে নিয়মিত হবার। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here