অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৭০. (প্রথমাংশ )

0
3

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭০. (প্রথমাংশ )

জয়ের গলার কচি ত্বক বিদীর্ণ হয়ে চিনচিন করে রক্ত বেরিয়ে এলো। কিন্তু কেন যে কণ্ঠনালিতে ছুরির বসার আগেই দ্বিতীয়জন এসে বাঁচিয়ে নিয়েছিল জয়কে! সেদিন জয় ফুরিয়ে যেত। তার জীবনটা সংক্ষিপ্ত। সে জানে। এবং অনিশ্চিতও। কিন্তু সেদিন জয় আমির ফুরিয়ে গেলে অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত হতো। কিন্তু তার জীবনটা অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত নয়, শুধু সংক্ষিপ্ত। সেই সংক্ষিপ্ত জীবনটায় অভিজ্ঞতা ও ঘটনার কমতিটা থাকা যাবে না। তাই এরপর তার জীবনে অভিজ্ঞতা ও ঘটনার স্রোত-তরঙ্গ বিরামহীন তেড়ে এলো। আর শান্ত হলো না সেই স্রোত।

তখন জয় আচমকা মৃত্যুর ওপার থেকে জেগে উঠে খুবই অসন্তুষ্ট। তাকে বাঁচানোওয়ালা লোকটা সেই দাড়িওয়ালা। কোকড়ানো বাবরি চুল। গলায় তাবিজ। পরনে লুঙ্গি। মুখে তৃপ্তির হাসি।

নিভু চোখে শেষবার লোকটাকে দেখেছিল জয়। কিন্তু তার ভেতরে এক প্রকার প্রেমের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে।অনুভূতিটা অদ্ভূত। প্রেমটা তার মৃত্যুর ওপর। একটা সুন্দর অন্ধকারত্ব। যেখানে জীবন নেই, বিরোধ নেই, রাজনীতি নেই, ক্ষুধা নেই, ব্যথা নেই, চাহিদা অথবা ক্ষমতার লড়াই নেই। মৃত্যুর এত এত সৌন্দর্য ছোট্ট জয়কে মুগ্ধ করেছিল, সেই মুগ্ধতা আর কাটেনি কখনও।

জয় মরে গেল। গলার চিনচিনে ব্যথাটা আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকার। শরীরের ভর অনুভূত হচ্ছে না, শূন্যের ওপর ভাসমান হালকা দেহতে একটুও ক্ষুধা-ক্লান্তি আর লালসা নেই।

কতক্ষণ পর তার মৃত্যু ঘুম ভেঙেছিল! আবারও মাথার ওপরে আকাশ। আকাশটাকে ঠিকমতো দেখার উপায় নেই। বিশাল বিশাল কড়ই গাছের ডালগুলো আকাশকে জমিনের চোখের আড়াল করতে খুব তৎপর। চোখদুটো ঘোলা। প্রকৃতিও মেঘাচ্ছন্ন, আবার সাঁঝের বেলা।

জয় উঠে বসল। গলার ব্যথায় গা কেঁপে উঠল। শরীরের তাপে চামড়া ঝলসে যাবার উপক্রম। পরনের জামাটা ভেজা, প্রকৃতিও। অর্থাৎ বর্ষণ নেমেছিল প্রকৃতিতে।

হুমায়িরার দেহটা পড়ে আছে। নগ্ন দেহ, রক্তাক্ত। পেটটা উঁচু তখনও। জয় দৌঁড়ে গিয়ে বসে পড়ল মায়ের পাশে। ডাকল কয়েকবার। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। সে জেনে গেছে দুটো কাজ খুবই অহেতুক। এক আল্লাহ নামক রক্ষাকর্তাকে ডাকা আর দ্বিতীয়টা কাঁদা। বড়বাবা বলেছে হাসতে। সে হাসতে চেষ্টা করল। না! হাসিটা আসছে না। না আসুক, তবু কান্নাও করা যাবে না। কেঁদে কিছু হয় না। লোকে দেখলে বা শুনলে আরও বিরক্ত হয়ে জবাই করতে আসে।

সে মরেনি! কীভাবে সম্ভব! সে জ্ঞান হারিয়েছিল। ওরা এখানে ফেলে গেছে! জয়ের খুব ভয় লাগছে। এত অন্ধকার কেন? বিভিন্ন ধরণের আওয়াজ কানে আসছে। সেসব আওয়াজ ভোঁতা। একটাও স্পষ্ট-প্রকট নয়। তাতে ভেজা আঁধারে মোড়ানো প্রকৃতিটা গুমোট হয়ে উঠেছে।

সে কয়েকবার হুমায়িরাকে ডাকল, “আম্মু! আম্মু গো! ওঠো আম্মু! আম্মু, আমার একটু খিদে পাচ্ছে। চলো যাই আমরা। আম্মু!ʼʼ

তার রাগ হলো। হুমায়িরা কথা বলছেন না। মাঝরাত অবধি জয় থেমে থেমে অনেকবার হুমায়িরার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। হুমায়িরা ওঠেন না। শেষরাতে জয় কাঁদল। জঙ্গলের ভয়াবহতা, ক্ষুধার জ্বালা, মায়ের কথা না বলা তাকে কাঁদালো। কিন্তু শব্দ করে কাঁদল না। সে কাঁদল নিচু স্বরে। জোরে কাঁদলে ঝুঁকি আছে। তার ভেতরে আবারও মৃত্যু-প্রেম জেগেছিল। সেদিন সে বুঝতে পারেনি বটে, তার ভেতরে যে একটা নাম-পরিচয়হীন কিছুর প্রতি নিগূঢ় টান কাজ করছে, তা আসলে মৃত্যু। যে মৃত্যু তার কাছে আসছে বারবার, দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, জয় এগিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যু তখনই জয়কে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। এই লুকোচুরির জন্য জয়ের ভেতরে মৃত্যুর জন্য যেমন নেশা পয়দা হলো, তেমনই এক বিরহ-বিদ্রোহও।

সকালের আলোয় গাছের পাতাগুলোকে দেখে তার খাবার মনে হলো। পাতা অনেক ওপরে। হাতের নাগালে জমিনের মাটি আছে। জয় আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খামচে মুখে নিলো। চিবিয়ে চিবিয়ে গিলতে চেষ্টা করল। স্বাদটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জঙ্গলটা চোখের সামনে ঘুরছে। কিন্তু খাওয়াটা দরকার। সে পড়ে থাকা গাছের শুকনো ডাল দিয়ে মাটি আচড়ে তা তুলে খেলো। মা উঠলে তাকেও খাওয়াতো। মা শুয়ে আছে, তাই মায়ের খিদেও নেই। জয়েরও উচিত শুয়ে পড়া। তার মাথা ঘুরছে আসলেই। খুব বেশিক্ষণ জেগে থাকা চলবে না। নিঃশ্বাস নিতে পারা যাচ্ছে না।

জয়ের মাথায় এই বুদ্ধি এসেছিল, সে দৌড়ে জঙ্গল পেরিয়ে কারও বাড়িতে যাবে, সাহায্য চাইবে। কিন্তু উঠে দাঁড়ানো গেলে তা সম্ভব হতো। সে উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। শুয়ে শুয়ে আরও কিছুটা মাটি সে গালে নিয়ে চিবিয়েছিল। মাটিতে ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে না। রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। নিভে যাচ্ছে সেই সাথে জয়ের চেতনা। জয় গিয়ে মায়ের নগ্ন বুকটার ওপর তার ভরশূন্য মাথাটা রেখে আস্তে কোরে শুয়ে পড়ল।


সৈয়দ বাড়ির মসজিদে হুমায়িরার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জয় তখন অন্দরে অচেতন পড়ে আছে।

সে শেষবার যখন হুমায়িরাকে দেখেছিল, তখন সে প্রায় জীবন্মৃত। জীবন ও মৃত্যুর সেতুর ওপরে সাত বছর বয়সী জয় টলমলে পায়ে একা দাঁড়ানো। তাছাড়া হুমায়িরার পরিণতিগত অবস্থা ছেলে হিসেবে স্মৃতিতে ধারণ করতে নেই। মায়ের ওই চিত্র যুবক ছেলের স্মরণে আসতে নেই। জয় তা ধারণ করতে চায়নি। স্মৃতিতে রাখতে চায়নি। যা মানুষ স্মৃতিতে রাখতে অস্বীকৃতি জানায়, মস্তিষ্ক তা ধারণ করে না সচরাচর। এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক মানুষের অনুগত।

জয়ের মস্তিষ্কে বিকৃতি হয়েছিল। খুব ছোট বয়সের সেই বিকৃতি খুব নিখুঁত, সূক্ষ্ণ আর জটিল। তা হামজা জানে। জয় জানে না, মানেও না। সে নারীসঙ্গকে নিজের মতো করে রীতিগত করে নিয়েছিল, অনেকটা অধিপত্যের মতো। কিন্তু আবার সম্মানের দায় ছিল না তার। নারীর অসম্মান তার কাছে বিশেষ কোনো সংবেদনশীল ব্যাপার নয়। কিন্তু ধ-র্ষণে তার তীব্র বাতিক, এমনকি ধর্ষণের আশেপাশে থাকার জটিল ও অসীম অনীহা! কিন্তু জয় জানে ও মানে সে সব ভুলে গেছে। কড়া ড্রাগ ও একাধিকবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তাকে উদ্দীপনাহীন করে তুলেছে। এটা তার ধারণা।

মাঝেমধ্যে মনে এলে হামজা জয়কে ড্রাগ ধরিয়ে দিয়েছে। মনে আসাটা হুমায়িরার মুখ নয়। হুমায়িরার চেহারা জয়ের মনে পড়ে না, এটা তার ধারণা। কিন্তু কখনও যদি হুমায়িরার পরিণতিগত চিত্র মনে পড়ে আবছা হয়ে, তখন সে কড়া ড্রাগ সেবন করে।

সৈয়দ বাড়িতে বেশ কয়েকটা তার বয়সী বাচ্চা ছিল। সৈয়দ ফরহাদ মোহাম্মদ বারীর দুই সন্তান মুস্তাকিন ও মুরসালীন। আরও আছে রুবাইয়াত। সে মুস্তাকিনের চাচাতো বোন।

ওরা বারবার এসে জয়কে দেখে যাচ্ছে। ওদের বয়সী একটা ছোট্ট ছেলে বিছানায় অচেতন পড়ে আছে। খুব অবাককর ঘটনা। দু’দিন আগে রুবাইয়াতের মামা অর্থাৎ মেজো চাচার শালা ছেলেটাকে সৈয়দ বাড়িতে এনেছে। তারা ছেলেটাকে চেনে না।

মুস্তাকিনের বয়স নয় পেরিয়েছে। সে নাজেরা শেষ করে হিফজ্ বিভাগে গেছে। মুরসালীনের বয়স সাত। সে আরবী পড়তে চায় না, চরম ফাঁকিবাজ। নামাজের সময় তার পেট ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে। এখনও কায়দা, আমসিপাড়াই শেষ করেনি।

সন্ধ্যা অবধি ওরা বারবার ঘুরে ঘুরে অচেতন বাচ্চাটাকে দেখে গেছে। সন্ধ্যার পর সবক থাকে, হুজুর মারবে খুব। এজন্য অগত্যা চলে যেতে হলো মাদ্রাসায়। মাগরিবের নামাজ না পড়লে আব্বা ফিরে শুনলে বেত দিয়ে পিটাবে।

মুস্তাকিনের মেজো চাচি হাজেরা। স্বামীর সাথে রাতে তার খুব বড়সড়ো একটা ঝগড়া হয়ে গেছে। আমির বাড়ির ছেলেকে সৈয়দ বাড়িতে আনার মতো কাজ কী করে করতে পারল তার স্বামী! উনার বড় বোনের স্বামী আজ উনার স্বামী। বড়বোনকে জয়নাল আমির ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। এরপর মৃত বোনের সঙ্গে হাজেরাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বাড়ির সকলে সেসব ভুলে গেলেও হাজেরা বোনের সাথে হওয়া অন্যায় ভোলেনি। সে জানিয়ে দিয়েছে স্বামীকে, আর থাকবে না এ বাড়িতে, অন্তত যতদিন ওই ইবলিশের বাচ্চা এই বাড়িতে আছে।

কাজ হয়নি। বলাৎকার হওয়া আমির বাড়ির বউকে যখন এ বাড়িতে এনে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হলো, হাজেরার ইচ্ছা করেছে মৃতদেহটা কুচি কুচি করে কাটতে। এখন ছেলেটাকেও তাই করতে ইচ্ছে করছে তার।

ইবলিশের বাচ্চাকে রেঁধে খাওয়ানো, যত্ন করে বাঁচিয়ে তোলার পাপ তিনি করতে পারবে না। যার চাচার হাত এ বাড়ির রক্তে রঙিন, তার ভাতিজাকে হাজেরা যখন-তখন গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে।

পরদিন সকালে জয়ের ঘুম ভাঙল। স্যালাইন চলছে তার শরীরে। সে চারদিকের কিছুই চেনে না। আতঙ্কে বুক খালি হয়ে এলো। আবার কোথায় আনা হয়েছে তার মা আর তাকে? সে টলমলে পায়ে এক দৌড়ে ঘরের বাইরে এলো। মনে হলো কিছু ছিঁড়ে এলো। হাতের ক্যানোলা। তা খুলে এসেছে, হাতের শিরাতে রক্ত জমেছে। আশপাশে লোক নেই। মাকে খুঁজে বের করে তাকে নিয়ে পালাতে হবে।

চারপাশে ঘর। একতলা বাড়ি। সব ঘরগুলো গোল হয়ে একের পর এক সজ্জিত হয়ে মাঝখানে গোলাকার উঠান তৈরি করেছে। সে বুঝতে পারল না কোন ঘরে তার মা আছে। ঘরের দরজাগুলো সবুজ রঙের। হাতটা জ্বলছে। তাকিয়ে দেখল, সুঁচ ফোটানো শিরাটা রক্ত জমে কালো-খয়েরি হয়ে গেছে।

কেউ ঢুকছে। লোহার গেট খুলে আবার সিটকিনি লাগানোর শব্দ এলো। জয় তবু নড়ল না। সে কোথায় আছে, তা জানা দরকার। লোকটা ঢুকে কাঁধ থেকে হাজী রুমালটা খুলে দড়ির ওপর রাখল। চেঁচিয়ে ডাকল, “হাজেরা বুবু! গামছাটা দে বুবু। গা ঘাইমা শ্যাষ।ʼʼ

জয়ের পা দুটো কাঁপছে। থামানো যাচ্ছে না। সে চাইছে দৌড়ে পালাতে, কিন্তু পা সরছে না। এটা সেই দাড়িওয়ালা, বাবরি চুলের লোকটা। তার মা কোথায়? লোকটা ঘেমেছে কেন? সেদিন মায়ের সাথে খারাপ কিছু করার পরেও লোকটা ঘেমেছিল খুব। জয়ের হাড্ডিসার বুকের পাজরটায় তুফান উঠল। ঢিপঢিপ করছে।

লোকটা তাকিয়ে জয়কে দেখেই কেমন করে যেন হাসল, “কী খবর আমির সাহেব? আমি ভাবছিলাম আপনের ইন্তেকাল হয়ে যাবে। কৈ মাছের জান, এহ? হা হা হা! খুব ভালো। আল্লাহ হায়াৎ দিছে। থাকেন বাইচা।ʼʼ

জয় ছিটকে একদৌড়ে ঘরে যেতে গিয়ে ঢালাই করা উঠানের ওপর পড়ে ঠ্যাংয়ের চামড়া ছিলে গেল। উঠে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে সেই ঘরে গিয়ে দরজটা চাপিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথা ঘুরছে নাকি ঘরটা, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘুরছে। চারপাশটা চোখের সামনে স্থির হচ্ছে না। সে এই ঘরে, কিন্তু মা কোথায়? বুকটা এত নিষ্ঠুরভাবে কাঁপছে!

সে লোকটাকে ছাড়বে না। কিন্তু সামনে যেতেই তো পারবে না। নিজের ওপর খুবই রাগ হলো। সে লোকাটাকে আঘাত করতে চায়, কিন্তু লোকটার চেহারা মনে পড়লেই চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে, বুকের ভেতরে লাফালাফি চলছে, শরীরটা ঘামছে।

সে দরজা আটকানোর সময় খুব জোরে দরজার কপাট চাপিয়েছে। বিকট শব্দ। পুকর পাড় থেকে বাড়ির মহিলারা ছুটে এলো। জয়ের ছোট্ট দূর্বল দেহটা দরজা চাপিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো। একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। আলতো হাতে জয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী হইছে আব্বা তোর! ভয় পাইছো?ʼʼ

মহিলাটিকে সে চেনে না। কিন্তু ভালো মনে হলো। পেছনের জনের দৃষ্টি কিন্তু জয়ের ওপর ভালো না। সে জয়কে বড় ঘেন্নার নজরে দেখছে। জোহরের আজান হলো সৈয়দ বাড়ির মসজিদে। মনে হলো যেন ঘরের মধ্যে হচ্ছে আজান।

পেছনের মহিলা সেই বাবরিওয়ালাকে গামছা দিলো। তা জয় আড়চোখে দেখে চোখদুটো বুজে রাখল।

দুপুরের পর দুটো বাচ্চা আসে বাড়িতে। তাদের পরনে টুপি, সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা। জয়কে বারবার দেখে। ভালো মহিলাটি ওদের মা, মরিয়ম। মরিয়ম জয়কে নিজের ছেলেদের সঙ্গে বসিয়ে খাওয়ান। জয় কথাবার্তা বলে না। লোকজন কম দেখলে ঘরে ঘরে মাকে খোঁজার চেষ্টা করে।

সৈয়দ বাড়ির পেছনের সীমানার একটু দূরে আরেকটা বাড়ি। বাড়ি নয় ঠিক, কোয়ার্টারের মতোন আবাসিক। সেখানে অনেক যুবকের বাস। ওরা এ বাড়ির অধীনেই থাকে, সেটা বুঝেছিল জয়।

বাবরিওয়ালাও এই বাড়িতে নিয়মিত আসে। সে জানতে পেরেছে রুবাইয়াতের মা হাজেরার ভাই হলো বাবরিওয়ালা। বাবরিওয়ালার নাম সেলিম ফারুকী।

বাবরিওয়ালার হাতে বিভিন্ন পাথরের মোট তেরোটা আংটি আছে। একেক আঙুলে দুটো-তিনটে কোরেও। গলায় তাবিজ আছে কয়েকটা।, মাঝেমধ্যে তসবীহ ঝুলতে দেখা যায়। রাতে নাকি সে ধ্যান করে। চোখদুটো নেশা নেশা। ধ্যান করলে চোখ নেশা নেশা হয়। আল্লাহর ধ্যান। রুবাইয়াত তার মামার ব্যাপারে এসব জানিয়েছে জয়কে।

জয়ের আল্লাহর প্রতি বিরাগটা বাড়ছে দিনদিন। যে আল্লাহর ধ্যান সেলিম ফারুকী করে, সে কিনা তার মাকে রক্ষা করবে সেই আল্লাহকে কত বিশ্বাসের সাথে ডেকেছিল সে! নিজের বোকামিতে সে লজ্জিত। সেলিম যার ধ্যান করে সেই আল্লাহ অবশ্যই সেলিমের পক্ষেই থাকবে, তার মাকে বাঁচাতে আসবে কেন?

মাস দুয়েকের মাঝে তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হয়নি। বড়কর্তার হুকুম। জয় জানে না বড়কর্তা কে। গোল উঠান, একটা খোপের মতো ঘর, আর গোসল করার জন্য কলপাড়। সেই কলপাড়ের পাশে পুকুর, তার ওপারে কলার বাগান, ঝোপ-ঝাড়। এটুকুই জয়ের সীমানা। জয় ঘরের ভেতরেই থাকে। বাইরে বের হলে হাজেরা এবং সেলিমের সাথে দেখা হয়। তার ভয় লাগে।

দুই মাস পর বাড়িতে একজন বিশেষ কেউ ঢুকলেন। ব্রিগেডিয়ার সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী সাহেব। জয় বুঝল এই সেই বাড়ির কর্তা। মুস্তাকিনের আব্বা।

ফরহাদ সাহেব জয়কে সৈয়দদের কওমী মাদ্রাসায় পড়তে দিলেন। জয় বুঝতে পেরেছিল এই গোটা পরিবারের অর্থাৎ যে পরিবারকে ঘেন্না করতে শেখানো হয়েছে তাকে ছোটবেলা থেকে, তা অহেতুক নয়। বড়বাবা কেন সৈয়দ পরিবারকে এত ঘেন্না করতেন, তা সে বুঝল। এটাও বুঝল, এখন সৈয়দ বাড়ির সবকিছুর প্রতিনিধিত্ব করছেন সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী।

তিনি রোজ সকালে উঠে কোরআন তেলওয়াত করেন। জয়ের কানে খুবই বিরক্ত লাগে। যে আল্লাহই সেলিমের মতো মানুষের, তার বাণী যে এত যত্ন করে পাঠ করে তার প্রতিও জয়ের বিদ্বেষ। আজ অবধি তার মায়ের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। উনার নির্দেশে জয়কে বন্দি রাখা হয়েছে।

তিনি দুই মাসের ছুটিতে এসেছেন। ফরহাদ সাহেবের কাছে একবার খবর এলো, জয়কে পিটিয়ে শরীরের চামড়া ছিলে ফেললেও সে পড়ে না। জিহ্বা অবধি নড়ায় না। নামাজে যায় না। গেলেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মোনাজাত করে না কখনও।

এ নিয়ে জয়কে ওই ছোটবেলায় যে পরিমাণ মার খেতে হয়েছিল হুজুরদের হাতে, তার শরীরটা হয়ে উঠল ব্যথাহীন। দু চারটে চামড়া ছিলা বেতের আঘাত তখন আরামদায়ক ব্যাপার তার কাছে।

জয় জেনে গেছে, এই কোরআন সেই আল্লাহর বাণী যাকে ডাকার পরেও তিনি তার মাকে বাঁচাতে আসেননি। সে এই দুই মাসেও ডেকেছিল আগের সব ভুলে। সে এখন আর মাকে চায় না, কিন্তু বড়বাবা তো পারে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে! এই রক্ষাটুকু সে আবারও বেহায়ার মতো চেয়েছিল আল্লাহর কাছে। আল্লাহ করেননি।

আলিফ–টা অবধি উচ্চারণ করানো গেল না জয়কে দিয়ে। বোবাও মুখ দিয়ে আওয়াজ করে, জয় দাঁতে দাঁত আটকে বসে থাকে চুপচাপ। মুরসালীন তাকে খোঁচায়, “বল জয়। পড়। গুনাহ হয়। এমন করিস না। হুজুর তোকে আরও মারবে। ওরা তোকে কাফের ভাবে। তুই কি আসলেই তাই? পড় জয়।ʼʼ

তাতে জেদ বাড়ে। জয় পড়ে না তো পড়েই না। মার খেয়ে হাতের তালু ফেটে যায়, কখনও মারের চোটে ছোট্ট শরীরটায় জ্বর আসতো। কিন্তু হিফজখানায় রাত তিনটের সময় তাহাজ্জুদের নামাজে ডেকে তোলা হয়। জ্বর নিয়ে উঠে বসতে হতো। না উঠলে ঘুমন্ত অবস্থাতেই বেতের সপাৎ সপাৎ বাড়ি। এছাড়া সবাই জেনে গেছে জয় কাফের। নেহাত ফরহাদ সাহেবের নির্দেশ না হলে কবেই জয়কে বের করে দেয়া হতো মাদ্রাসা থেকে। তার ওপর নামাজে না দাঁড়ালে জ্বর আসা শরীরে মার পড়ে।

তাদেরকে সুন্নতী তরিকায় এক খাঞ্চায় কয়েকজনকে খেতে দেয়া হয়। এতে মুসলমান ভাইদের মাঝে স্নেহপ্রীতি বাড়ে। জয় খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ পড়ে না। বিসমিল্লাহর শেষে আল্লাহ আছে। সে একবার মুস্তাকিনকে জিজ্ঞেস করল, বিসমিল্লাহ মানে কী?

মুরসালীন খুব খুশি হলো। হয়ত জয়ের ভেতরের গোমরাহি দূর হচ্ছে। সে হেসে জানালো, “আল্লাহর নামে শুরু করা। আল্লাহর নামে খাওয়া শুরু করলে বরকত হয়। খাওয়াটা ইবাদতের শামিল হয়।ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “আল্লাহ বলতে কিছু নেই। খাওয়া আল্লাহর নামে শুরু করারও কিছু নেই।ʼʼ

সেদিন আর খাওয়া হয়নি। হুজুর খুব মারলেন। মারার কারণ আছে। তাকে অনেক স্নেহের সাথে বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলে সে আরও বেশি কটূক্তি করে, এমন সব কথাবার্তা বলে যা সহ্য করা যায় না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে মেরে বোঝানোর চেষ্টাটাই করা হয় এখন। তাছাড়া জয়ের ওপর রাগ তাদের কম না তার কর্মকাণ্ডে।

দু’দিন কিছু খাওয়া নেই, মুখে স্বাদ নেই, জ্বরে গা তিরতির করে পুড়ছে। এখানে মরিয়ম নেই, মা হারিয়ে যাবার পর মরিয়মের কাছে একমাত্র যা স্নেস সে পেয়েছে। তাকে সেবা করার কেউ নেই। সব ছাত্ররা জেনে গেছে, সে কাফের। তার যেকোনো কষ্ট ওদেরকে সুখ দেয়। মাদ্রাসায় একটা নাস্তিক আছে, এটা খুব কলঙ্কের বিষয়। মুরসালীন আর মুস্তাকিন ছাড়া কেউ তার পাশ অবধি মারায় না, পারলে বিভিন্নভাবে মার খাওয়ায়, জ্বালাতন করে, আঘাত করে, গালি দেয়।

শেষ অবধি না পেরে সৈয়দ বাড়ির অন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হলো জয়কে। মরিয়ম মাথায় পানি ঢালেন। ওষুধ খাওয়ার আগে মরিয়ম জয়কে খেতে দিয়ে পানি আনতে গেলেন। হাজেরা এসে পা দিয়ে থালাটা উল্টে দিলো। কান মলে ধরে বলল, ইবলিসের বাচ্চা, “তোরে বলছি না বাড়ির ভেতরে আসবি না। তোরে আমি সহ্য করতে পারি না। বাইরেই মরবি। আসবি না অন্দরে। শয়তানের বাচ্চা।ʼʼ

পরের ছুটিতে ফরহাদ সাহেব এসে জয়কে একদিন ডাকলেন, পড়িস না কেন আব্বা? অবিশ্বাস কেন এত?

আমার মা কোথায়?

ফরহাদ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। খানিক পর বললেন, আল্লাহর আমানত আল্লাহ নিয়ে গেছে..

জয়ের ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। সে কটূক্তি করে বেজায় আপত্তিকর মন্তব্য করে বসল। যা সহ্য করা যায় না। কিন্তু ফরহাদ সাহেব অসীম ধৈর্যের সাথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন। কিন্তু সেলিম পাশেই ছিল। সে জয়কে কখনোই ফরহাদ সাহেবের কাছে একা ছাড়ে না। সে এসে জয়ের গাল চিপকে ধরে চুল মুঠো করে ধরল।

ফরহাদ সাহেব বললেন, “ছেড়ে দাও সেলিম। ছোট মানুষ। বুঝবে ইনশাআল্লাহ। আমি মানা করেছি ওকে আঘাত করতে।ʼʼ

-“জানেন না ভাইজান ও কতটা বাড় বাড়তেছে দিনদিন। মাদ্রাসায় ওর জন্যে ছাত্ররা অভিভাবকরা অতিষ্ট। ওরে এমনে শাস্তি না দিলে ও নিজের সাথে সবাইরে নষ্ট বানাই ফেলবে। আমি বলে রাখলাম আপনারে।ʼʼ

ফরহাদ সাহেব জয়কে বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবেশটা ভেঙে গেল, উনার মেজাজটা থমকে গেল জয়ের আচরণে। জয়কে সেলিমের হাত থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে উনি উঠে চলে গেলেন কোয়ার্টারের দিকে।

জয়ের শরীরটা কালো হয়ে গেছে। শরীরে বেতের আঘাত, হাতের মার, না খাওয়া, অনাথ-অসহায়ত্বের ছাপ খুব তীব্র।

মুরসালীন ও মুস্তাকিন জয়ের সাথে মেশার চেষ্টা করতো। কিন্ত জয়কে বোঝা যায় না। তার ভেতরে খাওয়া, গোসল, আদর-যত্নের কোনো চাহিদা দেখা যায় না। মার খেলে কাঁদে না, হাসে। উন্মাদের মতো হাসে। তার হাসিটা তার ঠোঁটে সেভ করা। কিছুতেই তা মোছে না। বড়বাবা হাসতে বলেছে।

বাড়ির লোকেদের অবশ্য পছন্দ ছিল না জয়ের সাথে দুই ভাইয়ের মিশতে চাওয়া। জয় একটা শয়তান, তার ঘাঁড়ে শয়তানের বাসা আছে, সেখানে অনেকগুলো শয়তান বাস করে—মাদ্রাসায় ছেলেরা সবাই এটা জানে।

চোখের সামনে রোজ সে সেলিমকে দেখে। মাজার থেকে মাদ্রাসায় তসবীহ জপতে জপতে আসে। বৈরাগী লোক। বিয়ে সাদীহীন সংসারত্যাগী একজন সাধু গোছের লোক সেলিম। খুব আল্লাহভীরু, ধার্মিক, মাজারপ্রেমী মানুষ। জয় তাকে দেখলেই লুকিয়ে পড়ে। ছোট্ট মস্তিষ্কে সুগভীরভাবে জড়ানো আতঙ্ক কাটতে চায় না।

সে তিনবছর ছিল সৈয়দ বাড়িতে। সেই তিন বছরের বন্দি জীবনে মাদ্রাসা থেকে বাইরে বেরোবার সুযোগ হয়নি। তাকে আলাদা পাহারায় রাখা হতো। বিকেল হলে ছেলেরা বাইরে হাঁটাহাঁটি ও খেলাধুলা করতে গেলেও তার সেই সুযোগ ছিল না। জয় বুঝতে পেরেছিল, মাদ্রাসায় একটা সংগঠন চলে। সেটার ঘোর বিরোধী ছিল বড়বাবা। তাকেও হতে হবে।


হুমায়ুন পাটোয়ারী মাসে চার-পাঁচটা বিয়ে করে বেড়ান। খুবই দক্ষ মেয়েলোক পটাতে। কিন্তু ফাঁসলেন তুলির মায়ের কাছে। তুলির মা দেখতে তুলির চেয়েও সুন্দর ছিল। মহিলা গর্ভবতী হলো। হুমায়ুন পাটোয়ারী বারবার গর্ভপাত করতে বলেও লাভ হলো না। বরং মহিলা পুলিশে যাবার হুমকি দিচ্ছিল। হুমায়ুন আশ্বাস দিলেন, বাচ্চাটা হয়ে গেলে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পাড়ার লোক মেরে তেড়ে দিয়েছিল দুজনকেই।

শাহানার সন্তান নেই। হামজাকে মানুষ করছেন। এর পর একটা মেয়ে পেলে খারাপ হয় না। ফুটফুটে তুলির জন্মের পর তুলিকে রেখে দিলেন নিজের কাছে। এক রাতে হুমায়ুন তুলির মাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে মাঠের ডিপটি কলের নালিতে শুইয়ে জবাই করে ফেললেন। লাশটা গুম করে ফেললেন। শাহানা তাতে খুবই খুশি। নিজেরাই খেতে পান না, আবার সতীনকে কী খাওয়াবেন। বারবার জেল-জরিমানা দিতে আর সংসার চালাতে বিঘা বিঘা জমি বিক্রি করে সব শেষ করে ফেলেছেন হুমায়ুন।

হুমায়িরা তাদের সংসার চালাতেন, বিশেষত হামজার পড়ার খরচ। হুমায়ুন হামজাকে নিয়ে খুবই বিরক্ত এ ব্যাপারে। ছেলেটা পড়ালেখা ছাড়তে চায় না। শান্ত স্বরে শুধু বলে, “আমি পড়ব, আব্বা।ʼʼ

এরপর হুমায়ুন দু-তিন দিন ধরে অবিরাম চেঁচালেও আর কোনো জবাব দেবে না হামজা, এবং নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবে এটা ভাবাও যায় না।

কতবার যে হুমায়ুন মেরে ধরে হামজাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। ছেলে থাকতে তিনি কেন কাজ করবেন? কিন্তু হামজা পড়ালেখা ছাড়ে না। হুমায়িরা নিখোঁজ হবার পর হামজার পড়ার খরচ বন্ধ হয়ে গেল, সংসার আর চলে না। হামজা না খেয়ে থাকতে পারে। তার নির্লিপ্ততা কঠিন। দু’দিন না খেয়ে থাকলেও ভাত চায় না। কারও সাথে বেশি কথা নেই, হাসি নেই। মলিন কাপড়, শীর্ণ দেহ কিন্তু চেহারাটা ভারী।

হুমায়ুন পাটোয়ারী ঢাকায় সিকান্দার আলী সরদারের লোহার কারখানায় কাজে লাগিয়ে দিয়ে এলেন হামজাকে। অত বড় প্রতিষ্ঠান, অত বড় নাম, বড় প্রাসাদের মতোন সরদার বাড়ি, বিশাল ক্ষমতা হামজার চোখে লাগল। তার চেয়ে কত ছোট রুদ্র ইয়াজিদ সরদারের রাজকীয় লালন-পালন সব সে দেখতে লাগল। রাজধানীর শীর্ষ ত্রাস পরিবার সরদার পরিবার। সেখানে থেকে হামজার ভেতরের সুপ্ত চাহিদার আসমান বাইরে আসার রাস্তা পেল। সে যে দুনিয়াকে জিততে জন্মেছে, তার খবর ও ঝলক বাইরে বেরিয়ে এলো রাজধানীর মাটিতে পা রেখে।

শাহানা বলে দিয়েছিলেন, তুই কী করবি জানি না। শুধু সংসারের খরচা চাই।

সে কী করবে তার পরোয়া নেই। শুধু তার কাছে সংসারের খরচ চায়। হামজা কী করবে? যা খুশি করতে পারে, কিন্তু সংসারের খরচ জোটাতে হবে, ব্যাস। সে ছিনতাই দিয়ে শুরু করল। এরপর তা থেকে ধরা পড়ার মাঝ দিয়ে গেল এক সন্ত্রাসের কাছে। সরদার পরিবারের দুশমন, প্রতিপক্ষ। এই গাদ্দারির অপরাধে তখন তাকে সরদর পরিবার খুঁজছে। কিছুদিন প্রাণ বাঁচিয়ে লুকিয়ে থেকে তার এক বছর লস গেল। কিন্তু পড়লেখা চালাতে হবে তাকে। তার জন্য পয়সা দরকার, অনেক।

এরপর সে বড়ভাইদেরকে পেলো। তৎকালীন সরকার-বিরোধী দলীয় বড় ভাই। যারা খুব সহজে শুধু মুখের সমর্থনের জন্য হামজার মতো পুঁচকে ছেলেদের পেছনে পয়সা খরচ করে। শুধু এটাই যে তখনকার সরকারী দলের প্রতি হামজার ক্ষোভের কারণ ছিল তাও না। জয়নাল কাকার কারাবাস, ফুপুর মৃত্যু, জয়ের বন্দিদশা সবের পেছনে ওদের লোকই! সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী ওই দলেরই সমর্থকগোষ্ঠীর একজন। এটার একটা ভিত্তি আছে। ফরহাদ মহম্মদ বারী সাহেব বিরোধী দলীয় প্রধানের জুনিয়ত অফিসার। অনুরাগের সম্পর্ক। তাকে পেলে হামজা টুকরো টুকরো করে কেটে লোহার চুল্লিতে ঝলসাবে।

হামজা শান্ত-শিষ্ট ভাবনার ছেলে। সে বুঝে বুঝে কিছুদিনে এমন দু-একটা কিশোর বয়সের ঊর্ধ্বে যাওয়া কিছু কাজ করে ফেলল, যা বড়ভাইদের নজর কাড়তে যথেষ্ট ছিল। সে স্কুলে ভর্তি হলো আবার। বাড়িতে টুকটাক খরচা দিতে গেলে পড়া বা বিলাসিতা হয় না। এখন আর রোজ নিয়ম করে বাড়ি ফেরাও হয় না। রাস্তায় থাকার প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। মানুষকে অমানুষ বানাতে রাস্তার অবদান অনেক। হামজার মানুষ সত্ত্বার বিদায়ক্ষণ চলছে।

একদিন শেষরাতে হামজা হাঁটতে হাঁটতে হাকিমপুর এলো। মাদ্রাসার চারধারে বাঁশের চ্যাগার। তা ডিঙিয়ে চড়তে গিয়ে বাঁশের ফাঁড়া অংশের আঘাতে ঠ্যাংয়ের মাংস ছিঁড়ে গেল। কলকল করে রক্ত বেরোচ্ছে। কপালের চামড়ি ছিলে গেছে।

সে জানে না জয়কে কোন বিভাগে রাখা হয়েছে। পেছনের পথ দিয়ে মাদ্রাসার সারি ধরা কক্ষগুলোর পেছনের দিকের জানালার দিকে পৌঁছাল।

চৌকিদারের হাতে ধরা পড়ল হামজা। সংগঠনের ছেলেরা সব বেরিয়ে এলো। হামজার নিশ্চুপতা প্রমাণ করল, সে কোনো বদ উদ্দেশ্যে অথবা কারও নির্দেশে মাদ্রাসা আঙিনায় অনিষ্ট করার লক্ষ্যে প্রবেশ করেছে। তাকে প্রায় আধঘন্টা যাবৎ জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, ‘সে কেন এই শেষরাতে এভাবে মাদ্রাসায় ঢুকেছে?ʼ

কতজনে কতরকম মধুর করে জিজ্ঞেস করল, তারা শুধু জানতে চায়, ‘কে এসেছে সে?ʼ

কোনো জবাব নেই। নিঃশ্বাসের শব্দও পাওয়া যায়নি হামজার কাছে। জয়কে ইশারায় বলে দিলো, “চুপ থাক। একদম চুপ। তুই চিনিস না আমাকে।ʼʼ

তার অনড়, অটল, স্থিরচিত্ত সবাইকে অবাক এবং ক্ষুব্ধ করল। কোনো ভালো উদ্দেশ্যেই যদি কিশোর ঢুকবে মাদ্রাসায় তাহলে বলতে বাঁধা থাকার কথা না। তাকে আঁটকে রাখা হলো। বেতের আঘাতে পরনের মলিন ফতোয়া ছিঁড়ে গেল। তবু কোনো কথা নেই। কিন্তু জয় সহ্য করতে পারছিল না। সে জানে বেতের আঘাত পিঠে সইতে কেমন লাগে। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমার ভাই। আমার সাথে দেখা করতে আসছে। আমারে মারেন, হুজুর। ছাড়েন হামজা ভাইরে।ʼ

সকলে অবাক হয়ে গেল। এবং এতে ক্ষোভটা বাড়ারই কথা, বাড়লও। মার এবং জিজ্ঞাসাবাদ কঠিন হয়ে উঠল। মাঠের প্রাঙ্গনে খাঁড়া গাছগুলোর মতোই অটল হামজা। চোখদুটো কথা বলে, ভয়ংকর তার নীরবতা। মাঝেমধ্যেই শীর্ণ পিঠটা বেঁকে আসছে। দেহের চামড়া ফেটে গেছে। ঝিমিয়ে এলো হামজার দেহটা। জয় বড় অবাক হয়েছিল। তার তো কেউ নেই। সে দুই বছরে খুব বুঝেছে এই জগৎটা তার কিন্তু সে জগতের কারও কেউ বা কিচ্ছু নয়। আজ হামজার এই নীরব আগ্রাসন অন্য বার্তা দিলো। এই বার্তা জয় আর ভোলেনি কখনও। তার জীবনে মৃত্যু, আঘাত ও হামজার জন্য যে অশেষ অনুরাগ ও নেশা জন্মেছিল, তা কাটেনি আর। তিনটা তার জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেল। এই তিনটার যেকোনো একটার জন্য বাকি দুটো কবুল। হামজার জন্য মৃত্যু ও আঘাত, মৃত্যুর জন্য হামজা ও আঘাত, অথবা আঘাতের জন্য মৃত্যু ও হামজা সাদরে গ্রহণযোগ্য হলো জয়ের জন্য। এই তত্ত্বটা দিনদিন আরও তীব্র হয়েছিল। কারণ এখানেই শেষ হয়নি মৃত্যু, আঘাত ও হামজার উপস্থিতি তার জীবনে। যতদিন না মৃত্যু তাকে গ্রহণ করে সাথে নিচ্ছে ততদিন আঘাত ও হামজার সাথে তার বিচ্ছেদ নেই।

ফজরের নামাজের ওয়াক্তে সেলিম এলো মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে। সে খুবই অবাক এতটুকু কিশোরের এতখানি ধৃষ্টতা দেখে। সে খুবই হতাশ হয়ে বলল, “এইজন্যেই কইছিলাম আমিরের ব্যাটারে আমার হাতে তুলে দেয়া হোক। ফরহাদ ভাই ক্যান ওরে মানুষ বানাইবার বৃথা চেষ্টা করতেছে? আবার নিজেগোরে ধ্বংস করবার লাইগাই তো। একবার ওর চাচায় যা করছে তাতে দিল ভরে নাই। আল্লাহ কবে যে একটু সচেতন বানাইব ফরহাদ ভাইজানরে। হক মওলা, ইয়া খুদা তেরা ফরমান! শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা থেকে সবাইরে রক্ষা করেন মওলা!ʼʼ

হামজা চুল চিমটি মেরে ধরে সন্দেহিন স্বরে বললেন, “কার হুকুমে মাদ্রাসায় ঢুকছিস কইয়া ফেল তো, বাবা।ʼʼ সবার উদ্দেশ্যে বলল, “ওর ছোটকাকা কারাগার থেইকা ফেরোয়ার। এখন কতকিছু হইব, দেইখো আমি কইয়া রাখলাম। দেখো এইডারে জয়নাল পাঠাইছে কিনা! এই চেংরা কাম না সারতে পারলে আবার কোন আক্রমন করবো, তার ঠিক আছে?ʼʼ

জয় পুলকিত হয়ে উঠে হামজার দিকে তাকাল। কিন্তু বাকিরা আৎকে উঠল। আরও বেশি তৎপর হলো হামজাকে মেরে কথা বের করতে।

হামজা কথা বলল না। সেলিম কয়েকটা চড়-থাপ্পরও লাগালো। কিছু উস্কানিমূলক কথা বলে আরও দু একটা লাত্থি খাওয়ালো।

নামাজের পর আবার আলোচনায় বসা হবে। জয় এই ফাঁকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “হামজা ভাই, এইখানে আইছো ক্যান? তুমি কেমনে জানলা আমি এইখানে?ʼʼ

হামজা হাসল। ঠোঁট ফেটে গেছে। হাসিটা কেমন যেন দেখতে লাগল। হেসে বলল, “শুনছি শেষরাতে তোদেরকে উঠায়ে তাহাজ্জুদ পড়ানো হয়, তাই না? ভাবছিলাম কলপাড়ে দাঁড়াব, তুই মখ ধুইতে আসলে দুইজন পালাবো। ব্যাড লাক।ʼʼ

জয়ও হাসল। হামজা অবাক হয়। এমন এক সময়ে জয়ের হাসিটা অস্বাভাবিক। কিন্তু সে হাসছে। সবে জয়ের বয়স মাত্র তখন কমবেশি নয়, দশ হয়নি। তাকে কে শিখিয়েছে এমন হাসি হাসতে? জয়কে জিজ্ঞেস করলে জয় বলতো, “বড়বাবা তত্ত্ব দিয়েছে, পরিস্থিতি সেটা প্রমাণ করে সূত্রে পরিণত করেছে।ʼʼ

হামজা জিজ্ঞেস করল না। জয় হেসে বলল, “তো এই কথাটা বললেই তো কম মারতো ওরা।ʼʼ

জয়ের ছোট্ট হাতটা চেপে ধরে হামজা উঠে বসে বলল, “সিক্রেট প্ল্যান বলে দিলে আবার নতুন প্লান বানাইতে হতো পরেরবার। আমি এই প্ল্যানেই তোকে আজাদ করব এইখান থেকে। জয় বাংলা!ʼʼ চোখ মারল হামজা।

জয় হেসে ফেলল, আস্তে করে বলল, “হু? জয় বাংলা? বলো, বলো জয় আমির।ʼʼ

কথা ফুরোয়নি। কিন্তু জয়কে টেনে মসজিদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। হামজার কী হবে জানা নেই। হামজা আবার শুয়ে পড়ল মাটির ওপর। গা থেতলে গেছে, শরীরে জোর নেই, যন্ত্রণায় ভেঙে আসছে। জয় পেছন ফিরে একবার তাকাল। হামজা তাকিয়ে আছে তারই দিকে নিভু নিভু চোখে।

চলবে…

[চার হাজার শব্দের বিশাল পর্ব দিয়েছি। যা দুই পর্বের সমান। টাইপিং মিসটেকহ অন্য যেকোনো ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here