#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭১.
○
ফজরের আজান পড়ছে কোথাও বা। কিন্তু বড়ঘরে শব্দ, আলো, বাতাস প্রবেশ নিষেধ। দেয়াল পুরু, মেঝে সমতল থেকেও বেশ কয়েক ফুট নিচে।
মুরসালীন শরীরের ব্যথায় ঝিমিয়ে বসল। জয় থেমে গেছে, তার গল্প বোধহয় শেষ! সে ক্লান্ত হলেও খুশি। তার একটা কারণ আছে। সে যতবার ফরহাদ মুহাম্মাদ বারীকে মারার বিষয়টা মনে করে, সে ভীষণ খুশি অনুভব করে। এইমাত্র সেই কথাটা বলার ফলে ভেতরে খুব খুশি অনুভূত হচ্ছে।
একবার রূপকথা বলেছিল, ‘অন্তূ! যতদিন তুমি জীবিত আছো, কোনো অভিজ্ঞতাকেই চূড়ান্ত ভাববে না। মৃত্যু মুহুর্তেও তোমার চিরস্থায়ী একটি ধারণা ভেঙে যেতে পারে।ʼ
কথাটা ভুল নয়। অন্তূ আজ গল্প শুনতে শুনতে উপলব্ধি করেছে বিষয়টা। সে জানতো সে চিরতরে আবেগহীন হয়ে পড়ছে। কিন্তু আজ তার বিপরীতে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটেছে।
জয় যতক্ষণ কথা বলেছে, জয়ের দৃষ্টি আঁটকে ছিল ঢালাই মেঝেতে। জয় আমির একটাবারও যদি অন্তূর দিকে তাকাতো, দেখে ফেলতো, অন্তূ আজও কাঁদে। অন্তূ যে হাতে ঘন্টা কয়েক আগে আগ্নেয়াস্ত্র চালিয়েছে, জয়েদের গল্প শোনার সময় আজ অন্তূর সেই হাতদুটোও শরীরের সাথে থরথরিয়ে কেঁপেছে, চোখ লাল হয়ে তারপর ভিজেও উঠেছে! এসব দেখে ফেললে কী বিশ্রী ব্যাপার হতো! কিন্তু এখন অন্তূর কান্না পাচ্ছে না।
জয় আমির কখনোই এক বিন্দুতে স্থির থাকে না। সে প্রতিক্ষণে তার রেখা বদল করে। এক মুহুর্তে তাকে শিকার মনে হলে পরের মুহুর্তে শিকারী লাগে। এই দ্বিধাটা অসহ্য জয়ের চরিত্রে। এই দ্বিধা অন্তূ আগে কখনও কারও চরিত্রে টের পায়নি।
সে জয়কে জিজ্ঞেস করল, “আপনি মেরে ফেললেন ফরহাদ চাচাকে?ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “মেরে ফেললাম।ʼʼ
-“কেন মেরে ফেললেন?ʼʼ
জয় চোখ চোখ তুলে তাকাল, “কেন? আসলেই তো! মারলাম কেন?ʼʼ
-“তিনি আপনার চাচাকে মেরেছিলেন তাই।ʼʼ
-“ওহ হ্যাঁ। সে আমার বড়বাবারে মারছিল তাই।ʼʼ
-“তিনি আপনার বড়চাচাকে কেন মেরেছিলেন?ʼʼ
জয় সায় দিলো, “আরেহ! সেটাই তো! কেন মেরেছিলেন?ʼʼ
অন্তূ ধমকাল, “ইয়ার্কি নয়। ফরহাদ চাচা জয়নাল আমিরকে কেন মেরেছিলেন?ʼʼ
জয় হাই তুলল একটা। সে বিশাল ক্লান্ত। অন্তূ বলল, “আমি বলব? আপনি নিতে পারবেন তো? নাকি ক্ষমতা উগড়ে আসবে?ʼʼ
-“আসবে না। আপনি বলুন, উকিল মহোদয়া!ʼʼ
-“কারণ আপনার চাচা একজন সন্ত্রাস ছিলেন। পরে যখন আমির নিবাস থেকে নিজের বাপ-ভাইকে মারার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়, সেটা অপবাদ হলেও উনি আপনার নিষ্পাপ চাচা নন।ʼʼ
জয় ছাদের দিকে তাকিয়ে হাসে, “শুরু করলে উকালতি!ʼʼ
-“জি না। এখনও ল তেই ভর্তি হইনি। অত জ্ঞান বা দক্ষতা নেই আমার। সাধারণ জ্ঞান। সেক্ষেত্রে আমি কি ভুল বলেছি?ʼʼ
-“নাহ তো!ʼʼ
-“আপনার হেঁয়ালি আমাকে অস্থির করে তুলছে। আপনি কথা বলুন, স্পষ্ট কথা।ʼʼ
জয় বিজ্ঞের মতো মাথা দুলালো, “তুমি আমাকে অভিযোগ করতে বলতেছ?ʼʼ
-“যদি বলি?ʼʼ
-“পারি না।ʼʼ
অন্তূ গর্জে উঠল, “আপনি নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছেন। মানুষকে আপনার ব্যাপারে কখনোই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেন না। আল্লাহর কসম, আপনি আজ হেঁয়ালি করলে আমি বিনা বিবেচনায় রুহ বের করে নেব আপনার।ʼʼ
জয় সামান্য হাসল। অন্তূ মাথা নাড়ে, “হাসবেন না। এভাবে হাসবেন না আমার দিকে তাকিয়ে।ʼʼ
জয় ঠোঁটে আঙুল রাখল, “ঠিকাছে। হাসব না। আমার একটা কনফিউশন আছে।ʼʼ
-“হু!ʼʼ
জয় ফিসফিস করে বলল, “অর্থাৎ তুমি আমার সব জেনে তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে এতদিন কাটালে? ‘মারবে না ছাড়বে! হ্যাঁহ? কেন মারবে? জয় আমির কেমন, কেন এমন?ʼ এত কৌতূহল কীসের আপনার, ঘরওয়ালি!ʼʼ
অন্তূ কণ্ঠ নিচু হলো, “এমন জলজ্যন্ত এক ঢেউ, যা সবকিছু ভাসাতে সক্ষম, তার ভাসার গল্প জানতে একটু কৌতূহল জায়েজ!ʼʼ
জয় হাসিমুখে একটা ঢোক গিলল। এতে তার পুরুষালি গলার উঁচু স্বরনালীর এপলসটা উঠানামা করে উঠল একবার। সেখানে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বড় মোহনীয়, সৌম্য, অভিজাত পুরুষ লাগে তাকে মাঝেমধ্যেই! জমিদারীর রক্ত রক্তের দায়ে ধুয়ে আলকাতরা হলেও তা ভুলেভালে রঙ চকচক করেই ওঠে বোধহয়!
জয় আলগোছে অন্তূর হাতদুটো নিজের বাহু থেকে ছড়িয়ে নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে খেলতে খেলতে বলল, “এত পেরেশান কেন হচ্ছ? হু!ʼʼ
অন্তূ জয়ের চোখে তাকাল। খুব খেয়াল করলে দেখা যায়, জয় আমিরের চোখের মণি অতিরিক্ত কালো, একদম কৃষ্ণগহ্বরের মতো। যেখানে আলোও অস্তিত্বহীন।
অন্তূ নজর স্থির রেখে ধীর আওয়াজে বলে, “আমি প্রথমরাতে যখন আপনার কাছে নিজেকে সমর্পন করেছি, আপনার ভেতরে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে। পুরুষের উত্তেজনায় নারী তাকে পুরোদমে শোষণ করতে পারে। আমি সেদিন এক অসুস্থ জয় আমিরকে পেয়েছিলাম। যার ভেতরটা শূন্য, কিন্তু পুরু দেয়ালে ঘেরা! সেই দেয়ালের গণ্ডির সীমানায় প্রতিক্ষণে ফাঁপা হাহাকার ছিটকে বেড়ায়। কিন্তু সেই পুরু দেয়াল তা বাইরে আসতে বাঁধা দেয়!ʼʼ
-“কে বলে তুমি উকিল হবে? আমি বদদোয়া দিলাম, তুমি দুনিয়ার সেরা, বিশাল, বিরাট, অনেক বড়, বৃহত্তম, মহান সাহিত্যিক, কবি, দার্শনিক হবে। এখন বলো বদদোয়া কেন দিলাম?ʼʼ
-“কারণ আপনার দোয়া কবুল হবার চান্স নেই।ʼʼ
দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। পর মুহুর্তেই চোখ নামাল, দুজনই। জয় ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, “আর অসুস্থ জয় আমিরের কাছে আপনার সেদিনের বলিদান আপনাকে কী জানালো?ʼʼ
-“আর সেদিনের আমার সেই বলিদান আমাকে শুধুই জানিয়েছে, ‘জয় আমিরকে জানতে হবে।’ গোড়া থেকে। আমি আপনার চঞ্চল পাপীষ্ঠ সত্ত্বার পেছনে আরেকটা জয় আমিরকে খুঁজেছি। অথবা আমি সেদিনই পারতাম আপনাকে কুচি কুচি করে কাটতে। কিন্তু আপনি জানেন, আমি আপনাকে কখনোই মারার চেষ্টা করিনি। উত্তেজিত করেছি, অতিষ্ঠ করেছি, ক্ষেপিয়ে তুলেছি কিন্তু চূড়ান্ত আঘাত করিনি। আজকের এই দিনটাকে নিয়ে আসতেই হয়ত এত আয়োজন।
অথচ আজ এই মুহুর্তেও আমার মনে হচ্ছে, আমি সেখানেই পড়ে রইলাম। দ্বিধা, জটিলতা, মারপ্যাচ, অস্থির সিদ্ধান্তরেখা… এখনও মনে হচ্ছে, আপনার বিচার করা যায় না, আপনাকে বিচার করা যায় না। বহুদূর হিসেব করে ফিরেও হঠাৎ চোখ মেললে দেখা যায় আমি সেই একই বিন্দুতে আঁটকে রয়েছি—কে জয় আমির? কেমন সে? কেন এমন সে? তার দায়ভার কীসের ওপর ন্যাস্ত করা যেতে পারে? এমনটা হবার ছিল না।
কিন্তু আমি বিবেচনার বিন্দু হারিয়ে ফেলছি। আপনার এত এত পাপ, প্রাপ্ত আঘাত আর ক্রমিক ঘটনাবলী এক বিন্দুতে শান্ত হচ্ছে না। তার ওপর আপনার আজব ব্যক্তিত্ব! যতটুকু খুলছি, ততটুকুই পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
তবে একটা কথা উল্লেখযোগ্য, আজ এখন আমার ব্যক্তিগত দেনা-পাওনা আমি পাশে রেখেছি। তা আমার-আপনার একান্ত হিসেবের খাতায় জমা থাক আপাতত।ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল দু’পাশে, “মেরে ফেলো। শ্যুট মি! গুলি দেব? লোডেড ম্যাগাজিন আছে মনেহয় একটা পকেটে। এইটা অটো-সেমি মাল। একবার ম্যাগাজিন লোড করবে, এরপর ব্যাস বুম বুম বুম! দেব, দেব, সিস্টার? জটিলতাকে জিইয়ে রাখা মানেই কসরত। উড়িয়ে দাও। বিদ্রোহ করো! ভেঙে ফেলো আমার ভিত। চ্যাড়াব্যাড়া করে দাও একদম খুলি-টুলি!ʼʼ
অন্তূ তাকিয়ে রইল কেমন করে যেন জয়ের দিকে। একটু বিরক্তি, একটু কৌতূহল, হয়ত কিছু ঘৃণা অথবা বিরোধ কিংবা অনুরাগ হবে হয়ত! জয় মেঝের দিকে চেয়ে থেকে হাসল, “উহুহু! এভাবে তাকিয়ে থেকো না, ঘরওয়ালি!ʼʼ
অন্তূর স্বর বিরক্তিতে মিশে কঠিন হলো, “হু? কেন?ʼʼ
-“আমার মনে হবে তুমি আমার অতীত শোনার পর আমার দুঃখে দুঃখিত হয়ে আমার উকালতি করতে চাইতেছ। অবশ্যই তুমি অনেক বড় উকিল হতে পারো, কিন্তু জয় আমির তোমার মক্কেল হতে পারে না, ডিয়ার!ʼʼ জয় চোখ তুলে চট করে একবার চোখ মারল।
অন্তূ হাসল। চোখ সরিয়ে বলল, “অবশ্যই আপনি অনেকবড় ক্ষিপ্র বাজ হতে পারেন, কিন্তু আপনার পোষ মানার ক্ষেত্রটার আমাকে ঘিরেই হতে পারে। আর বাজপাখি পোষ মানলে সে তার পোষকের আওতায় শিকার করে।ʼʼ
চট করে অন্তৃ কথাটা ধরাতে না দেবার লক্ষ্যে দ্রুত প্রসঙ্গ বদলালো, “সন্ন্যাস গ্রহণ করলেও পারতেন। কারও দয়া, উপদেশ, আদেশ, অনুরাগ, ভালোবাসা…সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে লুঙ্গি ছেড়ে শালু গায়ে দিয়ে বেড়াতেন!ʼʼ
জয় আচমকা মাথা ঝারা মেরে হেসে উঠল, কিছু একটা এড়িয়ে হাসল, “হু! করব! তোমার একটা ব্যবস্থা করে ডিরেক্ট বাম ভোলে! হক মওলা! ধরো কলকি মারো টান..ʼʼ
অন্তূ বিরক্ত হয়ে আলতো ঝারা মেরে নিজের হাত ছড়িয়ে নিয়ে দৃঢ় গলায় মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করল, “সেলিম ফারুকী যা করেছিল, তা আপনার পিতা জানতেন?ʼʼ
-“কখনোই জানতে পারেননি। আমি জেনেছি কথাটা সেলিম ফারুকীরও মৃত্যুর পর।ʼʼ
-“অতদিনেও জানলেন না কেন? সন্দেহ হয়নি কেন কখনও?ʼʼ
-“হামজা ভাই যা বলে এসেছিলেন, তারপর আর কখনও মাদ্রাসার ত্রি-সীমানায় প্রবেশ করতে পারেনি সেলিম।ʼʼ
-“তার আগেও সন্দেহ হবার কথা। আর যতদিনে মেয়র সাহেব গিয়ে তামাশা করে এলেন ততদিনের জয় আমিরের ওখানে থাকার তিন বছর হয়ে গেছিল। হুমায়িরা মায়ের সঙ্গে যা হয়েছিল, তার কোনো তদন্ত তিন বছরের মাঝেও কেন করেননি আপনারা?ʼʼ
জয় মুখ ভেঙচালো মনে মনে, “শালির মেয়ে স্বামীকে স্বামী মানে না, অথচ তার মাকে মা ডাকে। শালি ভন্ডর ঘরের ভন্ড! তোর পেছনে কুত্তা ছেড়ে দিয়ে দৌড়ানি দিলেও মনের দুক্কু মিটবে না।ʼʼ
মুরসালীনের মেরুদন্ডে কঠিন ক্ষত। সে দেয়ালে হেলান দিলো তারপরও, চোখ বুজে বলল, “ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে গেছিল। আব্বা কোনোদিন ভাবতেও পারেনি, সেলিমকে ধরে জিজ্ঞেস করলে সব জানা যেতে পারতো। ʼʼ
অন্তূ বলল, “যুক্তি দূর্বল লাগছে। তার সঙ্গে আপনাদের শত্রুতা ছিল, হোক সেটা ধর্মীয়ভাবেই। উনার পথ আলাদা ছিল। উনি ভন্ডদের অনুসারী ছিলেন। তবু আপনাদের সন্দেহ হলো না! আর আমার ধারণা, উনিই এসে আপনাদেরকে খোঁজ দিয়েছিলেন জয় আমির ও আম্মার ব্যাপারে।ʼʼ
-“ঠিক।ʼʼ
-“সেটাকে কীভাবে নিলেন আপনারা?ʼʼ
-“সেলিম কোনোভাবে জানতে পেরেছিল, আমিরদের বউয়ের ওই অবস্থা–এমনটাই জানিয়েছিল সেলিম। আব্বা জানতো, ও-ই জয়কে উদ্ধারকারী। ওর দিকে সন্দেহটা না যাবার এটাই একটা কারণ।ʼʼ
-“আরেকটা বিষয়, জয় আমিরকে সেদিন জবাই করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু উনার আম্মা মরে গেলে অথবা মেরে ফেলা হলেও পরে জয় আমিরকে কেন জীবিত অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে রাখা হলো? কেন?
-“এটা আমি পরে জানতে পেরেছি। জয়নাল আমির গ্রেফতার হবার খবর পুরো দিনাজপুরে তোলপাড় হয়ে জানাজানি হলো। কিন্তু জয় ও ওর মাকে ধরার জন্য বেশ কয়েকটা দলের সাথে সাথে রক্ষার জন্য আবার রাজন আজগরের লোকজন জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। পায়নি ঠিকই। তবে ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিল সেলিমরা। পরে জঙ্গলে ফেলে যায়। এবং বলাই বাহুল্য, সন্ত্রাস সংগঠনে জয়নাল আমির ও আজগরেরা দোসর ছিল। এবং এজন্যই সেই কৃতজ্ঞতায় এই মাতাল আজও চাটে ওদেরকে।ʼʼ
জয় দুম করে লাত্থি মারল মুরসালীনকে, “টিনের চালে কাউয়া, তুমি আমার শাউয়া! বিটিরশালী, তোর মাকে কিন্তু যখন-তখন সালাম দিয়ে আসব। তোর ফ্যাদা প্যাচালে রাত গেল। কথা কম ক, আর আস্তে ক। আমি একটু ঘুমাই। গুড নাইট।ʼʼ সে লোহার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। খুব ঘুম পাচ্ছে তার।
মুরসালীন ব্যথা পাওয়া স্থানে হাত চেপে ধরে বলল, “এবং একটা কথা বলে রাখা দরকার, এই পাগলা কিন্তু এখনও মানে সেলিমসহ ওর সঙ্গিদেরকে সৈয়দ বাড়ির নির্দেশে পাঠানো হয়েছিল সেদিন রাতে আমির বাড়িতে।ʼʼ
জয় বলল, “হক কথা দিনে ছত্রিশবার স্মরণ করা যায়।ʼʼ
মুরসালীন বলল, “তুই না মরে গেলি এই মাত্র!ʼʼ
-“ধুর শালা। এত তাড়াতাড়ি তো মাইনষে মুতেও না। মরব মানে ঘুমাবো কেমনে?ʼʼ
মুরসালীন অন্তূকে জানালো, “আব্বার খুব অনুগত ছিল সেলিম। আরেকটা বিষয় আছে।ʼʼ
অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “কী বিষয়?ʼʼ
-“সেলিমের বড়বোনকে কিন্তু জয়নাল আমিরের সঙ্গীরা ইজ্জতহারা করে মেরেছিল যুদ্ধের সময়। সেজন্য সেলিম ফারুকীর পরিবারের কাছে আব্বা বংশের বড় ছেলে হিসেবে একটা দায়বদ্ধতা ছিল। সেলিমের ছোট বোনকে আমার মেজো চাচা বিয়ে করেছিলেন দোষ ঢাকতে। নয়ত যেমন জয়নাল আমির ভাবতেন আমাদের মাদ্রাসা আমার দাদু মিলিটারীর জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন, ফারুকীরাও ওরমকম একটা ভুল বুঝতে খুব তৎপর ছিল। ওরা ভাবতো, আমার পরিবার নিজেদের কোনো পাপে এতগুলো প্রাণ হারিয়েছে জয়নাল আমিরের হাতে।ʼʼ
আরেকটা ব্যাপার ছিল—জয়নাল আমিরের প্রিয় ভাতিজা জয়কে আব্বা আশ্রয় দিয়েছিল, এ নিয়েও ঘোর আপত্তি ছিল। সে বারবার আব্বার কাছে মিনতি করেছে, জয়কে বের করে দিতে। কিন্তু আব্বা জয়কে কাছছাড়া করেননি কখনও। এ নিয়েও একটা সন্দেহ ছিল ওদের। ওদের ধারণা ছিল, সৈয়দ পরিবার বোধহয় জয়নাল আমিরকে দোষী মানে না। কোনোভাবে বাচাতে চাইছে। ক্ষমা-টমা করে দিয়েছে। এজন্য জয়ের পক্ষ হয়ে অথবা জয়ের মায়ের বিচারের জন্য ওদের সঙ্গে কোনো আলাপে আব্বা যেতে পারেননি খুব একটা।ʼʼ
অন্তূ মাথা নাড়ল, “কিন্তু ফরহাদ চাচা কেন জয় আমিরকে কাছছাড়া করতে চাননি?ʼʼ
-“ওকে জীবিত রাখতে। সেই সময় ওকে ছাড়লে লোকজন মাংস আকারে কেটে পিস পিস করে বাড়ি নিয়ে যেত। ওকে মারার জন্য কতগুলো দল ওকে খুঁজছিল, ও আজও জানে না। ও যখন হামজা ভাইয়ের কাছে এলো, তখনও কতবার টপকে যেতে যেতে বেঁচেছে, সেই গল্প তো বলেনি এখনও।
কিন্তু সেলিম রোজ একবার করে মিনতি করতো আব্বার কাছে, জয়কে মাদ্রাসা থেকে মুক্ত করার জন্য। তখন জানতাম না– কেন? পরে জেনেছি, সে ভয় পেতো, জয় কখনও তার উপস্থিতি ছাড়া আব্বার কাছে পৌঁছে তার মায়ের ঘটনা বলে না দেয়। তার উদ্দেশ্য ছিল, জয়কে একবার মাদ্রাসা থেকে বের করতে পারলে চিরতরে জয়ের মুখটা বন্ধ করে দেবে, আর আমির বংশের সমাপ্তিও।
আব্বা বাড়ি এলে সেলিম আব্বার সাথে লেগে থাকতো। জয়কে জিজ্ঞেস করুন, সে কখনও সেলিমকে ছাড়া একা আব্বার কাছে যাবার সুযোগ পেয়েছে কিনা!ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরে বলল, “আপনার আব্বা জয়কে রক্ষা করতে চেয়েছেন সেলিমসহ বাকি শত্রুদের হাত থেকে, এটা বলতে চাইছেন?ʼʼ
মুরসালীন জবাব দেবার আগেই জয় এক চোখ খুলে বলল, “অ্যাঁহ? উকিল সিস্টার, আপনে ওই শালার ছেলের কথা দিলে নিয়েন না। আসলে ওর বাপে আমারে জঙ্গি বানাইতে চাইছিল। কিন্তু আমি নেহাত ভালো লোক, তাই ফাঁদে পা দেইনি। ধন্যবাদ। গুড নাইট!ʼʼ
মুরসালীন শান্ত চিত্তে হাসল, “ওইটা লীগ না, জয়! সংখ্যা বাড়াতে কুত্তা-বিলাইও জয় বাংলার সৈনিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তুই যাদের কথা বলছিস, তারা কারা তোর একটু হলেও ধারণা আছে। তোর মতো কাফেরকে ওরা সংগঠনে নেবে, এটা স্বপ্নও হতে পারে না।
একটা মজার কথা শুনবি? এই যে তোরা আমাকে সংগঠনের ছেলে ভাবিস না! আমাকে ওরা গ্রহণই করেনি। মুস্তাকিন ছিল ধার্মিক। কিন্তু আমি জন্মেইছিলাম গাফিল হয়ে। তুই চলে আসার দুই বছর পরেও আমার দ্বারা হিফজ্ হলো না। আব্বা রাগ করে আমার হাল ছেড়ে আমাকে জেনারেল স্কুলে ভর্তি করলেন। মুস্তাকিন যতটা ধার্মিক, ন্যায়পরায়ন, সভ্য ছিল; আমি ততটাই বিমুখ হলাম। মুস্তাকিন ভাই চলে যাবার পর আমাকে শুধু মাদ্রাসা কমিটির দায়িত্বে রাখা হয়েছে ঠেকায় পড়ে। কারণ সৈয়দদের মাঝে এক আমিই আছি। তুই আর কতটা মূর্খতা প্রকাশ করবি? যেখানে আমি চান্স পাইনি, সেখানে ওরা তোর মতো একটা অবিশ্বাসীকে দলে রাখতো? আব্বা তোকে শুধু মানুষ বানাতে চেয়েছিলেন। ধর্মের প্রতি তোর যা ভয়ানক ধারণা জন্মেছিল, তা অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। ছোট্ট বয়সে তোর ভেতরে যে বিষ ঢালা হয়েছিল, তা নিংড়ে নিতে চেয়ে আব্বা বড়ো মাশুল গুণেছে জয়। তুই ভালো প্রতিদান দিয়েছিস!ʼʼ
জয় উঠে বসল। যেন খুব চেঁচামেচিতে তার ঘুমটাই ভেঙে গেছে। সে খুব অবাক হয়ে বলল, “আরেস্সালা! এত মহানুভবতার গল্প একসাথে শুনে বদহজম হয়ে যাবে তো! তুই আমার একটা কথা শুনবি, মুরসালীন?ʼʼ
মুরসালীন সোজা হয়ে বসল, “আমার কান তোর নামে কোরবান!ʼʼ
জয় বলল, “তুই কি জানিস–দোষ আর পাছা এক জিনিস। মানুষ নিজেরটা ছাড়া সবারটা দেখে।ʼʼ
-“যেমন তুই।ʼʼ
-“চুপ থাক শালা!ʼʼ
মুরসালীন কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে মুচকি হাসল, “তুই কি জানিস, জয়! একজন প্রতিশোধপরায়ন মানুষ একটি কাচা মাটির স্তুপ। সুযোগ সন্ধানী মানুষ চাইলেই সেই মাটিকে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো হাতিয়ার বানিয়ে ব্যবহার করতে পারে নিজ স্বার্থে। মাছ ধরবে পানি ছুঁবে না। পানি ছুঁবে সেই হাতিয়ার। তুই জানিস জয়, হাতিয়ারের চোখ থাকে না। হাতিয়ার অন্ধ হয়। তাকে চালনাকারীর চোখ দিয়ে সে শত্রুকে দেখে আঘাত করে।ʼʼ
-“তুই কি আমারে কইলি?ʼʼ
-“নাঃ! তুই একটা জয় আমিরের গল্প শোনালি, আমি তাকে বলছি।ʼʼ
-“দে আজ তুইও জ্ঞান দে। হাতি নদে পড়লে চামচিকায়ও পেছন মারে।ʼʼ
-“তুই নদে পড়েছিস শুনে ভালো লাগল। কিন্তু তুই তো হাতি না, তুই হলি গাধা। যাহোক, তুই ঘোষ্ট-রাইডার সিনেমা দেখেছিস, জয়?ʼʼ
-“হ।ʼʼ জয় মাথা নিচু করে হেসে ফেলল।
তা দেখে মুরসালীনও হাসল। মুরসালীন যা বোঝাতে চাইছে, তা এক লহমায় বুঝে হেসে ফেলেছে জয়। তাতে মুরসালীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আব্বা বলতো, আমি যে জয়কে ছাড়বো! আমার মনে চায় ওরে ভালো একটা তালিম দেই। দেশ-জাতির ভবিষ্যতে লাগাই ওর মাথাটারে। জাভেদ যা পয়দা করে রেখে গেছে, ও এক বারুদ! যে কামেই লাগাবি, তা ডিরেক্ট কামিয়াব। অথচ ওর এত চতুর আর চিতার মতোন দ্রুতগামী বুদ্ধি শকুনে খাবে।ʼʼ
-“তোর বাপে খালি আমার চরকায় তেল ঘষতো ক্যান হামেশা? নিজের চরকা ভাঙা ছিল নাকি তেল বেশি কিনে ফেলেছিল?ʼʼ
-“তুই বুঝে অবুঝ। আর বুঝে অবুঝেরা তাদের সুবিধামতো বোঝে। ধর যেটা বুঝতে ইচ্ছে করছে, সেটা বুঝছে। যেটা ইচ্ছা করছে না, সেটা বুঝেও বুঝছে না।ʼʼ
জয়ের হাসি বাড়ল সামান্য, “তাদের কোনো চিকিৎসা নাই। তুই তোর ডাক্তারি ফিরিয়ে নে। হাম নাহি শুধরেঙ্গে জি হাম নাহি শুধরেঙ্গে।ʼʼ
মুরসালীন বলল, “ঘোষ্ট রাইডার সিনেমার নায়ক জনি। ওর বাপের ক্যান্সার হয়েছে। একদিন একজন এসে বলল, তুমি আমাকে তোমার আত্মা দেবে, এই শর্তে এই কাগজটাতে সাইন করো, তার বদলে তোমার বাপকে আমি সুস্থ করে দেব। তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। জনি সাইন করে দিলো। কারণ তখন তার শুধুই তার বাপকে বাঁচাতে হবে। আগে-পরে বাদ। রাতারাতি তার বাপ সুস্থ হলো। কিছুদিন কাটলো। একদিন ওই লোক এলো। কাগজটা দেখালো। জনি তখন নিরুপায়। সে আগেই চুক্তিপত্রে সাইন করে ফেলেছে। তখন বিষয়টা খারাপ মনে হয়নি।
কিন্তু এবার টের পেল, সেই লোকটা মূলত শয়তান। শয়তান তার কাছে তার আত্মা কিনে নিয়েছে। এবার তার আত্মাকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারে, জনি তা করতে বাধ্য। এরপর শয়তান জনিকে দিয়ে দেদারসে মানুষ মারতে থাকল। জনিকে জাহান্নামের দেবতা বানালো। সে যাকে ছোঁয় সে এক মুহুর্তে জ্বলে ভষ্ম হয়ে যায়।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে উঠল, “সিনেমাও দেখিস তুই? এ তো কঠিন পাপ! থুহ থু!ʼʼ
মুরসালীন মাথা নাড়ল, “আমি সৈয়দ বংশের কলঙ্ক! সব পাপাচারে ভাগ আছে আমার। তুই কি বুঝেছিস আমি কী বলেছি?ʼʼ
-“না।ʼʼ
দোলন সাহেব হেসে উঠে নিজের উপস্থিতির জানান দিলেন, “আমি যদি বুঝে না বুঝি আমাকে বোঝায় কোন শালা? ঠিক না, জয়?ʼʼ
জয় হাত তুলে সংগ্রামী ভঙ্গিমায় বলল, “ঠেক ঠেক! একমত, স্যার, একমত!ʼʼ
মুরসালীন হাসল, “হামজা ভাইয়ের চোখ দিয়ে দেখা শত্রুদের ব্যাপারে যা বুঝলে তারা আর তোর শত্রু থাকবে না, তুই তা বুঝতেই চেষ্টা করিসনি। কারণ ছোটবেলায় যে অবস্থান তোর কাছে নারকীয় মনে হয়েছিল, হামজা ছিল তখন তোর মুক্তির দূত! আর তুই নিজের অজান্তেই অসীম কৃতজ্ঞতায় হামজা ভাইকে তোর রুহ্ সঁপেছিস। আজ চাইলেও তার কর্মে অভিযোগ অথবা আপত্তি আসে না। তুই করতে চাস না।ʼʼ
জয় আনমনে স্বগোতক্তি করে, “হামজা ভাই আমারে একদিন কইলো, জয় রে! তোর-আমার গন্তব্য দুইটা, পথ এক। পথের শেষে একই বিন্দুতে একই রকম দেখতে দুইটা গন্তব্য! চল হাঁটি।ʼʼ
মুরসালীন নিস্তেজ চিত্তে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল, “গন্তব্য মানুষকে মৃত্যু অবধি পৌঁছে দেয়!ʼʼ
তার নরম দিলে জয়ের জন্য এক ঘা লাগল! পথভ্রষ্ট এই জয়কে মুস্তাকিন মহান ছোটবেলায় মাদ্রাসার দস্তরখানে বসিয়ে কত বুঝিয়েছে! ওই জয় পর্বতের মতো অটল চিত্তে কেবল চুপ থাকতো। ভেতরে কী জমাতো, কে জানে! আজ মনে হয় বিদ্বেষ। এই জগৎসংসার, সমাজ, দেশ, মানুষের প্রতি তার অসীম বিদ্বেষ একটু একটু কমে জমে এক মহাসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। তা ঢেউ থামানোর উপায় নেই।
জয় তীব্র-বেগে মাথা নেড়ে স্বীকার করে, “হ, হ! মৃত্যুউউ!ʼʼ
অন্তূ খেয়াল মেলে দেখল জয়ের সেই পাগলামিটুকু। জয় আমির সত্যিই মৃত্যুর ওপর বড়োই আকর্ষিত! সে বলল, “সেই গন্তব্যে আপনার জন্য নিশ্চিত মৃত্যু লেখা থাকলেও মেয়র সাহেবের জন্য গচ্ছিত আছে ক্ষমতার ডালি। পথটা হলো, বিরোধীদের ধরে কচুকাটা করা। তাতে আপনার ভেতরে ইনপুট করা প্রতিশোধের বিষাক্ত প্রবৃত্তি মিটবে, আর আপনার তৈরি করা রাস্তা মেয়র সাহেবকে তার উদ্দেশ্য হাসিলে এক পিচ্ছিল পথ বানিয়ে দেবে। এই তো আপনাদের সেই এক পথ দুই গন্তব্য?ʼʼ
-“ব্রিলিয়ান্ট! আপনি চাইলে ভালো উকিল হতে পারতেন, ঘরওয়ালি!ʼʼ
অন্তূ গভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, “জেনেশুনে ক্ষয় হতে কেউ এত আগ্রহী হয়, জয় আমির?ʼʼ
জয় হাসল, “আমারে কেউ অক্ষত পায় নাই, ম্যাডাম! সুতরাং ক্ষয় হওয়ার মাল আরেকটু ক্ষয় হইলেই বরং প্রকৃতির নিয়ম বজায় থাকে। আমার উপরে মরিচা ধরছে সেই কোনকালে।ʼʼ
মুরসালীন গম্ভীর স্বরে শুধায়, “আব্বাকে কেন মেরেছিস? তোর মুখে শুনি! বল, কী কারণে মেরেছিস?ʼʼ
জয় লোহার খণ্ড থেকে আস্তে কোরে নেমে ঢালাই মেঝেটার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মুরসালীন ঠিক ওর পাশে একইভাবে শুয়ে পড়ল। দুটো দেহ পাশাপাশি পড়ে রইল। একটা ক্ষত-বিক্ষত আরেকটা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত!
-“আমার বড়বাবাকে আমি শেষবার কবে দেখছি জানিস? সেই রাত্তিরে। ওই যে ওই রাত্তিরে। বড়বাবা তার ভাবীকে বলেছিল, ‘জয়কে নিয়ে পালান, ভাবী। জলদি যান।ʼʼ
-“তোর বড়বাবা বিশাল বড় হিরো ছিল রে, জয়?ʼʼ
-“আমার বড়বাবা ছিল।ʼʼ
-“আইন, রাষ্ট্র ও দেশের মানুষের কী ছিল?ʼʼ
জয় হেসে ফেলল, “আইন, রাষ্ট্র, দেশের মানুষ?ʼʼ ডেকে উঠল জোরে করে , “ও দোলন স্যার? আছেন না? আমার ঘরওয়ালির হাতের ইশপেশাল বুলেট নসিব হয় নাই তো?ʼʼ
এতক্ষণে সবাই যেন ভুলে গেছিল, তারা ছাড়াও আরও একজন আজ জয় আমিরের গল্পের শ্রোতা রয়েছেন বড় ঘরে। দোলন সাহেব বললেন, “নাহ। হয়নি।ʼʼ
-“ব্যাডলাক! সেই দুঃখে আপনারে একখান গোপন কথা কই, স্যার?ʼʼ
-“হু?ʼʼ
জয় বাচ্চাদের মতো চেঁচিয়ে ঘোষণা করে, “আমি ছাড়া এই ঘরে আর কোনো দেশোদ্রোহী নাই, স্যার।ʼʼ
অন্তূর শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। চোখ বুজল সে। জয় আমির মিথ্যা বলে না। অন্তূ জয়ের গল্পের মাঝে এটাই তো আবিষ্কার করেছে এতক্ষণে! দেশ, দেশের মানুষ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র…এই সবের দ্রোহ একা বহনকারী জয় আমির আজ এই জয় আমির। যার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, পাপাচার, মানুষের ভোগান্তি, দেশের-দশের ভাঙন, ধ্বংস!
মুরসালীন চট করে ঘাঁড় ঘোরায়। জয় দাঁত বের করে হাসল, “আমার বড়বাবা তা-ই ছিল। বুঝেছিস তুই মুরসালীন?ʼʼ
-“জয়, তুই অকৃতজ্ঞ।ʼʼ
জয় আপত্তি জানায়, “নাহ! আমি অকৃতজ্ঞ না।ʼʼ
-“তুই আর সবার প্রতিদান চুকাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিস, শুধু যে বা যারা তোকে জীবন দিয়েছে তাদের জীবন শুষে বলিয়ান হয়েছিস। উত্তম বিচার বটে!ʼʼ
-“তোর আব্বা! তোর আব্বা আমির পরিবারকে খেয়েছে।ʼʼ
-“জবান সামলা।ʼʼ
-“কোথায় সামলাবো? ঘরওয়ালি! তুমার ওড়নার আঁচলডা দেও তো।ʼʼ তাড়াতাড়ি কোরে অন্তূর ওড়নার তলে জিহ্বা ঢাকল।
-“হামজা ভাই তোকে দিয়ে সার্কাসেও কাজ করিয়েছে নাকি? এমন জোকার জোকার হাল হয়েছে কেন তোর? আব্বা তোর অবস্থা এমনটাই আশংকা করতো তোর চলে আসার পর।ʼʼ
-“মুরসালীন তোর কথা শেষ কর। আমি রুমে যাব। মাথা ব্যথা করতেছে।ʼʼ
-“স্বাভাবিক! কথাবার্তা সেইদিকে যাচ্ছে, যা তুই আলোচনা করতে খুব অপছন্দ করিস। কিন্তু করতে হবে। সময় নেই আমাদের হাতে।ʼʼ
জয় মাথার নিচে হাতের কনুই দিয়ে বলল, “হ! ঠিক কথা। সময় নাই আমাদের হাতে।ʼʼ
মুরসালীন বড় হতাশার সাথে বলল, “জয়নাল কাকা সর্বশেষ যে পাপটা করেছিল, তা তোর সাথে।ʼʼ
-“পাপ? আমাকে ভালোবাসাটা?ʼʼ
-“মূর্খ! ভালোবাসা বুঝিস তুই?ʼʼ
-“তা বুঝি না অবশ্য!ʼʼ
-“তোর দুর্ভাগ্য। ভালোবাসা কাকে বলে বুঝিস না তুই, অথচ দাবী করিস কেউ কেউ তোকে ভালোবাসে। তুই একটা শক্তিশালী ঘুটি মাত্র। যা সবার দাবার চাল হয়েছে। যে যেমন পেরেছে তোকে ভালোবাসার নামে বিষে চুবিয়েছে। আল্লাহ পাক তোকে যে পরিমাণ নেয়ামত, মেধা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, তা তুই কুকুরদের খোড়াক হিসেবে বিতরণ করে এক অধমে পরিণত হয়েছিস!ʼʼ
-“পুরোনো আলাপ। সেসব থাক। বোঝা তো, ভালোবাসা কী? আজ নতুন কিছু বুঝি।ʼʼ
-“যদি বলি, তোর স্ত্রী তোকে ভালোবাসে!ʼʼ
জয় যেন হাসতে ভুলে গেল। সে অতিরিক্ত হাসি পাওয়ার ফলে হাসতে ভুলে গিয়ে নিঃশ্বাস আঁটকে পড়ে রইল।
মুরসালীন আস্তে আস্তে উঠে বসে বলল, “সে তোকে এই পথ ছাড়তে বলেছে কখনও?ʼʼ
হাসি জোর করে চেপে মুখ ফুলিয়ে বলল, “হ।ʼʼ
-“আর কেউ?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“মনে কর, কেউ তো বলেছে সে ছাড়া!?ʼʼ
-“মনে নাই। ক্যান?ʼʼ
জয় চোখ খুলে তাকায়। মুরসালীন বলল, “কেন বলেনি? কেন তোকে কেউ এই মরার খেলা খেলতে মানা করেনি? অন্য পথের কথা বলেনি? বল, তুই বল। আমি তোর মুখে শুনব।ʼʼ
জয় কিছু বলল না। উঠে গিয়ে কামরুলের পকেট হাতরে সিগারেট বের করে এনে জ্বালালো।
মুরসালীন দৃঢ়স্বরে বলল, “কারণ কেউ তোরে কোনোদিন বাঁচাইবার চায় নাই। কেউ তোরে মানুষ মনে করে নাই। কেউ তোরে বোঝেই নাই! তুই যে মেধাবি, তুই অভিজাত বংশের রক্তে পয়দা, তোর ভিতরে মানুষ আছে, এটা তোকে ভুলিয়ে রাখতে এই দুনিয়ার যত আয়োজন! কিন্তু তোর স্ত্রী..ʼʼ
জয় সিগারেট ঠোঁট থেকে নামিয়ে তীব্র বাঁধা দিলো, “চুপ! চুপ! কিছুই না। আমি ওর আসামী মাত্র, আসামী। এর বেশি কিছু না। ভালোবাসা-বাসির মইদ্দে টানিস না।ʼʼ
-“তুই কোন ভালোবাসার কথা বলছিস, জানি না। কিন্তু ভালোবাসার বহুত প্রকারের মাঝে একটা এমনও আছে—
জয় চোখ বুজে লম্বা একটা টান সিগারেটে দিয়ে পুরো ধোঁয়াটুকু গিললো। তারপর নিঃশব্দে হাসল, এইটা যদি ভালোবাসা হয়, তাইলে তা সর্বজনীন! সবার জন্য প্রযোজ্য। ও এক আদর্শ মেয়ে, ভাই। আমার জায়গায় অন্য কোনো নষ্ট জয় থাইকলে তারেও ভালো হইতে বলতো। এইটাতে বিশেষত্ব খুঁজলে আমি তোরে দুই চামচ খাঁটি গু খাইতে সাজেশন দেব।ʼʼ
মুরসালীন বলল, “তুই যে পথে নেমেছিস, তাতে আছে কী?ʼʼ
-“তোরা যে পথে আছিস, তাতে আছে কী?ʼʼ
-“কী চাস?ʼʼ
-“কী আছে, দে! আমার তো কিছুই নাই। যা দিবি হাতে, তাই যাবে সাথে। দে..ʼʼ জয় হাত পাতলো।
-“চাস কী তুই? দেশের জন্য প্রেম আছে, মানুষের জন্য মমতা আছে, নারীর প্রতি সম্মান আছে, মনুষত্ব বোধ আছে। আমার দেশের মাটি আমি বেঁচে থাকতে আমার দ্বারা নোংরা হবে না, সেই দৃঢ় প্রত্যায় আছে বুকের ভেতরে। কী চাস তুই?ʼʼ
জয় আমির উপহাস করে হাসল। ঝারা মেরে মাথা নাড়ল দু’পাশে,
-“আমি জয় আমির যেইদিন খালি একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে ছিলাম, আমি আমার দাদুভাইয়ের কাটা মাথা দেখছি, বাপের মাংস ছিঁড়ে আসা শরীর দেখছি, সেই জন্মদাত্রীর লজ্জাস্থান হরণ হইতে দেখছি, যা চিরে দুনিয়ায় আসছি। আমি জয় আমির খিদের জ্বালায় তোর দ্যাশের জমিনের মাটি খুবলে খাইছি। একখান মজার কথা শুনবি? তোর দ্যাশের মাটি ক্ষুধার্ত জয় আমিরের খিদে মেটাইতে পারে নাই। তোর দ্যাশের মানুষ আমার মতোন জয় আমিররে ঘরে তুইলা আশ্রয় দেয় নাই। তোর দ্যাশের মানুষ, তোরা নারীদেরকে ম্যালা সম্মান করিস। খালি আমার ফুপু জয়নব, আমার আম্মা হুমায়িরা আর আরমিণেরা যখন ইজ্জত হারায় তখন তোর দ্যাশের মানুষ এইগুলারে সম্মান করতে জানে না। আমি ভুল কইছি মনেহয়। তোর দ্যাশের মানুষ নারীরে সম্মান দেয়, এই তিনডা তো নারীই ছিল না। ঠিক কইছি না?
ওই যে বইসা আছে শালির মেয়ে! ওইডারে জিগা! ওইডারে যেইদিন বেশ্যা মাগি বানাইছি আমি জয় আমির, তোর সমাজ-দ্যাশের মাইনষে ওরে একবার জিগায় নাই পর্যন্ত —’ওই ছেঁড়ি! আমিরের পোলায় তোরে সত্যি ছুঁইছে নাকি?ʼ জিগা ওরে! দেখ ওই শালি আইজও কাঁন্দে খালি। কিছু কইবার পারে না, করবার পারে না। ওরে ওইদিন আমি আমার নাম না দিলে ওয় কবে বদনাম হইয়া খতম হই যাইতো! তোর দ্যাশের মাটি ওর বালডা ছিঁড়তো!? তোর দেশপ্রেম কারে কী দিছে? তোরে কার বালডা দিছে? আজ এইখানে পচতেছিস মাসের পর মাস! এই তো! হ, তোর দ্যাশ-সমাজ ম্যালা ভালো। মহান মহান।ʼʼ
জয় আমির আবারও হেসে ফেলল কেমন করে যেন, “তোরা তো ভালো আছিসই, মুরসালীন! আমি এক জয় আমির খারাপ হইলে তোর দ্যাশ-দুনিয়ার থেকে কিচ্ছু খসবে না বা জোড়া লাগবে না।ʼʼ
জয় অন্তূর হাতখানা আবারও শক্ত করে চেপে ধরল। সেই হাতজোড়া থরথর করে কাঁপছে। জয় কিন্তু ভুলেও তাকাল না অন্তূর মুখের দিকে। আরমিণের কান্না সে দেখে না। ওই ছেঁড়ি কাঁদলে আড়ালে কাঁদবে। আজ সামনে কেঁদে ফেলেছে। সেই দোষ তো জয়ের না! অন্তূ হাতখানা চেপে ধরে ওকে নিয়ে গা ঝেরে উঠে দাঁড়াল জয় আমির,
-“ছেড়ে দে আমায়, মুরসালীন। এক জনম আমি জয় আমির হবো, পরের বার মাটি হয়ে হুমায়িরার পেটে জন্মাবো। সেইবার তোরা কেউ চাইলেও আমারে আর জয় আমির বানাইতে পারবি না কইলাম। এইবার খালি আমারে জয় আমির হইতে দে।ʼʼ
অন্তূকে তুলে নিয়ে নিস্তেজ দেহগুলো মাড়িয়ে চামড়ার স্যান্ডেলের খসখসে আওয়াজ তুলে অনেকটা এগিয়ে এলো জয়। পিঠ-পিছে অন্তূর ওড়না ঝুলছিল। তা একহাতে গায়ে জড়িয়ে অন্তূকে আগলে নিয়ে বড়ঘরের মাঝ বরাবর পেরিয়ে আসার সময় মুরসালীন আওয়াজ দিলো,
-“জিন্নাহ আমিরকে আমি মারিনি, জয়। তোর গল্প, আমার কথা আর তোর ভুল বোঝাবুঝি শেষ হতে এখনও অনেকটা বাকি।ʼʼ
চলবে..
[যেবার তাড়াতাড়ি গল্প দিতে চাই, সেবার আরও বেশি দেরি হয়ে যায়। গত চারদিন আগে বেশ কিছুটা অসুস্থতার ফলে হাসপাতালে এডমিট থাকতে হয়েছে। তার আগে থেকেই একটু অসুস্থ ছিলাম। আমি পারলে দিনে একাধিক পর্ব দিতাম, আমার কী যে ইচ্ছে করে!! একটা নতুন পর্ব আপলোড করে আপনাদের চেয়ে বেশি আনন্দ আমার হয়। কিন্তু পারি না নিয়মিত। এটা একটা নিত্যদিনের দীর্ঘশ্বাস হয়ে রইল আমার।
আজ বিশাল একটা পর্ব দিয়েছি। বিশাল মানে বিশাল। কিন্তু পর্বটা মনেহয় খুব অগোছালো হয়েছে। আপনারা একটু মানিয়ে নেবেন, এবং ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।
সে যাই হোক! আপনারা একটু রাগ-টাগ করতেই পারেন। জায়েজ! অল্প-সল্প বকাও দেবন বরং। আমি মাথা পেতে নেব। আমার প্রাপ্য। এখনও অসুস্থতা পুরোপুরি কাটেনি। প্রার্থনা করবেন আমার জন্য। ভালোবাসা আমার ধৈর্যশীল পাঠকদেরকে।]