অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৭২.

0
1

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭২.

রাত সোয়া দুটোর সময় হামজা আকস্মিক রিমিকে ছেড়ে সাদা চশমাখানা টেবিলের ওপর রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তার ভেতরে কিছু তৈরি হলো। জটিল কিছু। ততক্ষণ হামজার মস্তিষ্ক কাটার মেশিনের ব্লেডের মতো চলেছিল। সামনে যা আসবে, ফালা ফালা হয়ে যাবে।

রিমি কাঁদছে। কিন্তু হামজা থামানোর চেষ্টা করল না। তার আবার বুকও জ্বলছে। এই জ্বলন অবর্ণনীয়! ব্যক্তিগত দুঃখ। এটা নতুন তার জন্য। ব্যক্তিগত দুঃখ বলতে এক অপরিচিত ব্যাপারের সাথে সে কিছুদিন চলাফেরা করছে। হামজা কখনও কাউকে ভালোবাসেনি। কিন্তু রিমির ক্ষেত্রেও কি কথাটা খাটে? এই প্রশ্নটাই সমস্যা তৈরি করছে মূলত।

রিমি তাকে শাস্তি দিতে যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তার দায়ভার কার? জয়ের বউয়ের নয়? হামজা কি ছাড়বে সেই দুঃসাহসী নারীটিকে? ধরলে নারীটি সইতে পারবে হামজার থাবা?

সে ফতোয়া বদলে একখানা নেভি-ব্লু পাঞ্জাবী পরল। এসির নিবিড় হাওয়ায় ঘুম জড়িয়ে আসছে চোখে। মস্তিষ্কের ভারে তার কঠিন শরীরটাও নুইয়ে আসা ভাব। ঘুমটা দরকার হামজার। তার আগে কিছুটা মদ খাওয়া দরকার। নয়ত এই অস্থিরতায় ঘুম আসে না। তার জন্য জয়কে দরকার। কিন্তু জয় বড়ঘরে আজ।

জয়ের রুমখানা পেরোনোর সময় দেখল দরজার নব লক। জয়ের বউ ভেতরেই ঘুমাচ্ছে তো? ব্যক্তিত্বের চাপে রাত-দুপুরে নবটা ঘুরিয়ে জয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে ওর ঘুমন্ত বউকে দেখার কাজটা করা হলো না। তবে একটা নিশ্চয়তা আছে বটে। জয়কে এখনও পুরোপুরি বশ করতে পারেনি ওর বউ! এটাই ধারণা হামজার। ঘরেই আছে আরমিণ।

আড়াইটার দিকে হামজা সংসদ সদস্যের বাসভবনে পৌঁছাল। দারোয়ান ঘুমে ঢুলছিল। হামজা না হলে সে ফটক খোলা তো দূর, লাগলে একটা মার্ডার করতো। এমপি সাহেবের নিরাপত্তা প্রথমত। কিন্তু হামজাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে সালাম ঠুকে বলল, “স্যার আপনের জন্যে ম্যালাক্ষণ বসে ছিল। এখন মনে হয় শুইয়া পড়ছে!ʼʼ

হামজা চুপচাপ নিশাচরের মতো ভেতরে ঢুকল। হাতে দুটো ফাইল। কেইস ফাইলের কপি— অভিযোগপত্র। আরেক হাতে একটা মাঝারি ঝোলা গাড়ি থেকে বের করল।

মাঝরাতে সংসদ সদস্যের বসার ঘরখানা হামজার শরীরের কড়া সুগন্ধির রহস্যে মেখে উঠল। নেমে এলেন ভুড়ি দুলিয়ে সংসদ সদস্য সাহেব। বড় করে হাসলেন। হাসল না হামজা। তার ভরিক্কি সৌম্য চেহারা, আঁধার কূপের মতো চোখদুটো স্থির, শান্ত, ঠিক শিকারী পেঁচার মতোন। সে সালাম অবধি দিলো না।

এমপি সাহেব বললেন, “তোমার রাত বারোটায় আসার কথা ছিল।ʼʼ

সোফায় বসে ফাইলগুলো এগিয়ে দিয়ে হামজা বলল, “ওদিকের ব্যবস্থা কতদূর করলেন?ʼʼ

ফাইলগুলো দেখতে চাইলেন এমপি সাহেব, হামজা বাঁধা দিলো, “পরে দেখে নেবেন। আমি শেষরাতের গাড়িতে রাজধানী যাব। কথা শেষ করি।ʼʼ

-“মাসুদ! চা-পানি দে রে!ʼʼ

-“লাগবে না। আলোচনায় আসি।ʼʼ

হামজা ঝোলা থেকে মোট তিনটা হ্যান্ডগান ও চারটা লোডেড ম্যাগাজিন বের করে সেন্টার-টেবিলের ওপর রেখে বলল, “এগুলোর লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স শুধু আমার একটা পিস্তলের আছে। এগুলো এখন বাড়িতে রাখা যাচ্ছে না। আপনি রাখুন। পরে নেব।ʼʼ

রেগে উঠলেন এমপি সাহেব, “তার মানে যখন-তখন তল্লাশি হবার পর্যায়ে আছো, হ্যাঁ? মরতে বাকি রাখোনি?ʼʼ

হামজা নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল। দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা গেল এমপির মুখে। ঘনঘন মাথা নাড়লেন, “তোমার জয় যা করছে, ভালো করেনি। ভালো করেনি।ʼʼ

-“ওর সেই অভ্যাস নেই। সে যাহোক, পলাশ আজগর মার্ডার কেইসে পুলিশ এখনও ডেডবডি পায়ইনি, অথচ জয়কে সাসপেক্ট নম্বর ওয়ানে রেখেছে। মাজহার, ঝন্টু কাকাসহ আরও পুরোনো কেইসগুলো কেউ নতুন করে খুলেছে। গোড়া থেকে সব তদন্ত শুরু হয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চগুলোতে। সেখানে আমার বাড়িটা গবেষণার বিষয়। বুঝতে পারছেন?ʼʼ

অবাক হলেন এমপি, “কে খুলেছে সেইসব কেইস?ʼʼ

-“বলব সব। এখন কথা হলো, কয়দিন যে চাপাটা দিয়েছিলাম, তা আলগা করেছে কেউ বা তারা। তাকে এবং তাদেরকে ধরে বলি দিলেও এখন আর তা ঢাকা যাচ্ছে না। চারদিকের অবস্থা ভালো না। অন্তত এটার কাজ দ্রুত এগোনো দরকার আপাতত। ঢাকা থেকে ফিরে আমি নিজেই একবার যাব পুলিশ কাস্টাডিতে। অন্তত একটা নো-ফল্ট স্টেটমেন্ট দিয়ে আসতে হবে, নিজেকে সাফ রাখতে হবে যথাসম্ভব। কিন্তু জয়কে আমি থানার বারান্দায়ও দেখতে চাই না।ʼʼ গভীর বার্তা দিলো হামজা।

গলার স্বর চড়ল এমপির, “শোনো ইয়াং ম্যান! ঠান্ডা ঠান্ডা! তুমি নিশ্চিত মার্ডার আর তার কালপ্রিটকে পবিত্র গোলাপ ফুল বানানোর প্রস্তাব করতে আসছো। নরকে যাওয়া কাম এইটা, সহজ নাকি?ʼʼ

হামজা নির্বিকার বসে রইল। দুটো গ্লাসে এক শট অ্যালকোহল, দুটো করে পুদিনা পাতা, এক টুকরো আদা, একটু বিট লবন ও সোডা মিশিয়ে দুটো ড্রিংক তৈরি করলেন এমপি সাহেব। একটা গ্লাস হামজাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পুলিশ পলাশের বডিটা পেয়ে গেলে ব্যাপার হাতছাড়া হয়ে যাবে গো হামজা। ওইটার ভালো ব্যবস্থা করো।ʼʼ

-“বডি পাবে না।ʼʼ হেলান দিয়ে বসে গ্লাসে দুটো চুমুক দিলো হামজা।

-“পাবে না?ʼʼ

-“খাবার হিসেবে কুকুরের পেটে চলে গেছে। হজমও হয়ে গেছে। আপনি আপাতত ব্যবস্থা করুন যেন জয়কে ইন্টেরোগেশনে ডাকা না হয়। পুলিশ ফোর্সের প্রমাণের হিসেবে এত সহজে যাবার নয়। আমি বেঁচে আছি এখনও।ʼʼ

এমপি সাহেব একটু দুঃখিত ও অবাক হয়ে বললেন, “এত খারাপভাবে মারলে পলাশ ছেলেটাকে?ʼʼ সোজা হয়ে বসে ঘাড়ে হাত রাখলেন এমপি সাহেব। কিছুক্ষণ হা করে শ্বাস ফেলে বললেন, “ডুবো না হামজা, কোনোভাবেই ডুবো না! যেমনে ভাসতেছ, একবার ডুবলে জাহাজের ভাঙা পাটাতনও পাওয়া যাবে না গো!ʼʼ

-“দলের ছয়টা ছেলে পুলিশ হেফাজতে। রূপকথা আজগর, পরাগ ওরা নিজেদের শেষ সময় গুণছে শেলের পেছনে। আমার কবির বন্দি। আবার জঙ্গি শুয়োরের বাচ্চারা যখন-তখন হামলা করবে, আমি নিশ্চিত। আরেকটা কিছু চাল চালছে। ভেতরে ছিদ্র হওয়া ব্যাপার। আমার ব্যক্তিগত..ʼʼ

এমপি সাহেব সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছেন বুঝে সংযত হয়ে উঠল হামজা। সে ব্যক্তিগত আলাপ পেড়ে ফেলেছে ক্রোধে। এক সামান্য নারী তাকে মুচড়ে রেখে দিয়েছে তা লোক জানার নয়।

সে বলল, “বাড়িতে নিরাপত্তার বাঁধ প্রায় ভেঙে গেছে। সেই সেদিন ভেঙেছে যেদিন মুরসালীন বাড়িতে দেদারসে ঢুকে পড়েছিল।ʼʼ

সোজা হয়ে মনোযোগ এনে বসলেন এমপি, “একটা কথা বলবে হামজা?ʼʼ

হামজা বুঝল কী বলবেন এমপি। সে চুপ রইল। এমপি বললেন, “তোমার বাড়িতে তোমাকে জড়িয়ে কোনো বিরোধী আগাছা বেড়ে উঠেছে বলে আমার ধারণা, সেটা কি জয় নয় তো আবার?ʼʼ

ঝানু রাজনৈতিক লোকের সঠিক আন্দাজ হামজাকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। কিন্তু সেই আগাছা জয় নয়। বরং জয় নিজেই সেই আগাছার শিকার হতে চলেছে। তাকে উদ্ধার করা দরকার। হামজার ভেতরে আবারও একটা ভয়ের উদ্রেক হলো, সে কেন এই মুহুর্তে রুমে ঢুকে আরমিণকে গলা টিপে মেরে এলো না?

কিন্তু তার উত্তেজনা বাইরে আসে না বলে ভেতরে তা চেপে গিয়ে বলল, “আমার বাড়িতে এখন শুধু প্রতিবেলা পুলিশি তল্লাশি চলবে। থামাতে পারব না। সন্দেহ গাঢ় করা যাবে না। থামালেই আগ্রহ পেয়ে বসবে। সেক্ষেত্রে তল্লাশি পুরোদমে করতে দেবার জন্য সহযোগিতা করতে হবে আমাকে।ʼʼ

হামজা থামল। পূর্ণ মনোযোগী হলেন এমপি সাহেব। হামজা ঠোঁট কামড়ে বিরতি কাটিয়ে ইঙ্গিতবহ সুরে সূক্ষ্ণ গলায় জানালো, “বড়ঘর পরিষ্কার করতে হবে।ʼʼ

এমপি সাহেব থুতনিতে হাত চেপে বসলেন, “আমার বাড়িতে হ্যান্ড-অভার করবে ওদের? আমার বেসমেন্টে রাখতে পারো। আমার বাড়িতে পুলিশে তল্লাশি চলে না।ʼʼ হাসলেন এমপি।

-“সোজা ওপরে অথবা কারাগার। বড়ঘর থেকে আপনার বাড়িতে ওদেরকে অতিথি করে পাঠাতে এই মাঝরাতের মিটিংয়ে আমি আসিনি।ʼʼ অশিষ্ট শোনালো হামজার গলা।

-“তো এখন কী চাও?ʼʼ

-“মুরসালীন মহানকে মেরে হাত ময়লা করব না আমি। ওকে পচানোর শখ আমার। কারাগারের ব্যবস্থা করবেন আপনি। বাকি ছোটবড় যা আছে, আমি সামলে নেব। তার জন্য অন্তত ক’টা দিন চাই। আপনি সেই কয়টা দিন পুলিশকে আমার বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে রাখুন। আপাতত এইটুকু মাস্ট বি।ʼʼ

মাথা নাড়লেন এমপি, “মুরসালীন সাবেক বিগ্রেডিয়ারের ছেলে। সরকারী ক্ষমতা সামান্য হলেও আছে বলা চলে। আর আমি আমার ক্ষমতার অপব্যবহার রয়েসয়ে করতে চাই। জানো–অতি ভজন মানুষের পাকস্থলীর হজমশক্তি কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে খেলে অনেক খাওয়া যায়। ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়া শিক্ষিত ছেলে। ওকে ভেতরে দিতে হালকা হলেও একটা টোপ চাই। যেন আমার রেপুটেশন সাফ থাকে, এমনকি আমার পালিত প্রশাসনের কাছেও।ʼʼ

-“আমি আপনাকে ভারী টোপ দিতে এসেছি।ʼʼ

ভ্রু জড়ালেন এমপি সাহেব, “হু?ʼʼ

চট করে অভিব্যক্তি বদলালো হামজা, “কিন্তু কথা হলো, আপনি নিতে পারবেন তো আচমকা?ʼʼ

এমপি সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। হামজা ভণিতা করার ছেলে না। বারুদ সে। হাভজার ভণিতায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

হামজা বলল, “আমার ওপরে রাগ করতে পারবেন না। আমি আসলে…আমার নিজেরও কিছুটা স্বার্থ ছিল বটে!ʼʼ

এই এক কথায় কাজ হয়ে গেল অবশ্য। এমপি সাহেব পণ করে নিলেন নিজের অজান্তেই, হামজা এখন চিরন্তন সত্যি বলবে।

-“এই, হামজা! ধাঁধা বানাবা না। তোমার মুখে সরাসরি কথা শুনতে ভাল্লাগে।ʼʼ

-“সীমান্তকে মুরসালীন খুন করেছে।ʼʼ

এমপি সাহেব যেন দুম করে দমে গেলেন চমকে। একেবারে দেবে বসে গেলেন সোফায়। হামজার মিথ্যেটা সত্যির চেয়েও বড় সত্যির হয়ে ওঠে মানুষের কাছে। কারণ হামজা দক্ষ, নিখুঁত তার ধূর্ততার চাল।

-“তুমি আজকে এই এখন আজ আমারে এই কথা বলতেছ? আমি পাগলের মতোন মাসের পর মাস খুনীরে খুঁজছি।ʼʼ ঝানু পলিটিশিয়ান হামজার সাথে টিকলেন না, দিশেহারা হতে দেখা গেল তাকে।

হামজা নির্বিকার চিত্তে বলল, “ওই যে বললাম স্বার্থ! আমি যদি তখনই বলে দিতাম, মুরসালীনই সীমান্তর খু^নী, আপনি ওকে তখনই মেরে ফেলতেন অথবা জেলে দিতেন। কিন্তু জয়ের পুরোনো হিসেব আর আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে দিয়ে। কিন্তু আমি সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম—ওকে দিয়ে আমার কাজ ফুরোলে আপনার হাতে তুলে দেবার। আজ সেই দিন।ʼʼ

এমপি সাহেব কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন। সীমান্ত এমপি সাহেবের স্ত্রীর বড়বোনের ছোটছেলে। হামজার বোনের সাথে ছেলেটার বিয়েতে এমপি সাহেবের হাত ছিল, তা হামজা জানে না। বিষয়টা আজও চেপে গেলেন। কেবল সীমান্তর মায়ের অবস্থাটা চোখে ভাসল। মহিলা ছেলের শোকে অন্ধ প্রায়। পুত্রবধুর নাম একবারও মুখে নেন না, নাতনির নামও না। কিন্তু ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। রোজ কল করে বলেন, “তুমি এমপি হয়ে কী লাভ? কী লাভটা কী?ʼʼ

এমপি সাহেবের ইগো খুব আঘাতপ্রাপ্ত হয়। উনার ইচ্ছে করল, এই মুহুর্তে সীমান্তর খুʼনী মুরসালীনকে ধরে খণ্ড খণ্ড করে পুকুরে শখ করে পোষা কুমিরকে খেতে দিতে। হামজা বরশী ফেলে চুপচাপ সোফার ওপর বসে রইল। এমপি সাহেবের ভাবুক মুখটা দেখে তার হাসি পাচ্ছে।

-“প্রমাণ আছে তোমার কাছে?ʼʼ

-“তা জোগাড় না করে খবর দেব আমি আপনাকে?ʼʼ

রাগ ভুলে একটু সন্তুষ্টি এলো ছেলেটার ওপর এমপির মুখে, কী আছে?ʼʼ

-“অস্ত্র। চাপ্পর দিয়ে কুঁপিয়ে মেরেছিল সীমান্তকে। সেটা রক্তাক্ত অবস্থায় আমি উদ্ধার করতে পেরেছি। শুকনো রক্ত।ʼʼ
এরপর ভীষণ দুঃখিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি কীভাবে আমার বোনের বিধবা হবার এই শোক সহ্য করেছি, তা আর না বলি। শুধু বলব, মুরসালীনের ক্ষেত্রে আমি যতটা ধৈর্য ধরেছি, আর কেউ এতটা সুযোগ পায়নি আমার কাছে।ʼʼ

-“তুমি এখান থেকেই ঢাকা চলে যাবে?ʼʼ

হামজা জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাথা নেড়ে সায় দিলো। এমপি সাহেব জানালেন, “একটু আগে বড়ঘরে বাপ্পী কামরুল, দোলন সাহেব, রবিউল গেছে। জয় বাড়িতে না?ʼʼ

-“ও বড়ঘরেই আজ। ওরা কেন গেছে?ʼʼ

এমপি সাহেব চোখের শীতলতায় বোঝালেন, ওদেরকে ছিঁড়তে। একেকজন যদি দু-চারটে করেও মারে, “সেটুকুই বা আসে কোত্থেকে। মুখে বললেন, দোলনকে পাঠিয়েছি, শেষবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে। ঘাটিটা কোথায় ওদের সংগঠনের? জানা দরকার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দরকার ছিল না। আমি আর্মির ব্যাটাকে জিন্দা কবর দেব এবার। আর স্টেটমেন্টের চিন্তা করব না।ʼʼ

ঢাকা যাবার পথে জয়কে একবার কল করে জানতে ইচ্ছে করেছিল হামজার, বড়ঘরের খবর! আরমিণ হামজার অনুপস্থিতিতে কী ঘটাচ্ছে, তা নিয়েও ভাবনা এলো। কিন্তু তাকে সকাল হতে হতে রাজধানীতে পৌঁছাতে হবে।


জয় ফিরে এসে আবার বসল সেই লোহার খণ্ডের ওপর। অন্তূর হাতটা ধরা তখনও। অন্তূ দাঁড়িয়েই রইল। শরীর ভালো লাগছে না। চোখের সামনে মাঝেমধ্যেই অন্ধকার হয়ে আসছে। অবরুদ্ধ বড়ঘরটা জুড়ে ভ্যাপসা গন্ধ। পেট গুলিয়ে বমি আসতে চাইছে।

মুরসালীন জয়কে বলল, “তুই তো আমার কাছে এত সময় দিস না। আজ তোর গুরু কোথায় রে জয়?ʼʼ

-“তোদের নাম্বার লেগে যাচ্ছে তো! দোআ কালেমা পড়! ঢাকা গেছে।ʼʼ

মুরসালীন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “নয়ত আমার কাছে তোকে বেশিক্ষণ ছেড়ে রাখার রিস্ক সে নিতো না।ʼʼ

জয় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহটা হাঁটুর ওপর একটু ঝুঁকিয়ে বসে বলল, “তুই মারিসনি তো কে মেরেছে জিন্নাহকে? সত্যিই মরে গেছে রে জিন্নাহ?ʼʼ

মুরসালীন বলল, “জয়নাল আমিরকে মারার জন্য তুই আমার আব্বার হৃৎপিণ্ড খণ্ড করেছিলি, এবার যে জিন্নাহকে মেরেছে, তার কি করবি সেটা জেনেই আমি তোকে সব বলে দেব! বল।ʼʼ

জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসতেছি, আমির বংশ নির্বংশ হবে। তারপর আসলেই সেইটার প্রক্রিয়া শুরু হইলো এক রাইতে, তখন আমার বয়স সাত। এটা বহুত লোকের আকাঙ্ক্ষা, কামনা–আমার বংশে কেউ থাকবে না। বড়বাবা এই কথাটাকে সহ্য করতে পারতো না। বড় হয়ে আমি টের পেলাম, আমিও পারি না। তুই জানিস মুরসালীন, আমার কেউ নাই? বাপ-দাদা-চাচা-ভাই…আমার আগে-পিছে কেউ নাই! আমি এতগুলো দিন দিলের ভিতরে পুষলাম আমি ছাড়াও আরেকটা দেহ আছে, যার শরীরে আমিরদের রক্ত বইছে। আইজ তুই কস, সেও নাই। তাইলে আমি যে এমন বহুত লোকরে মারছি, যারা আমারে নির্বংশ, লেজকাটা বলছে, তাদের কাছে যাইয়া আমার কি এখন মাফ চাওয়া উচিত?ʼʼ

মুরসালীন চুপ করে কেবল জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ! জয় ঢালাই মেঝে দেখছে। সে নিজের কথা বলার সময় মানুষের চোখ চোখ রাখে না। বড় ভয়, লোকে চোখের কথা না পড়ে ফেলে!

মুরসালীন বলল, “এমন অসংখ্য সত্ত্বার কাছে মাফ চাওয়ার আছে। কিন্তু আফসোস, তুই তাদেরকে পাবি না আর। তারা কেউ আর তোকে ক্ষমা করতে দুনিয়াতে নেই।ʼʼ

জয় হেসে ফেলল, “তার মধ্যে প্রধান তোর বাপ আর ভাই। তাই তো?ʼʼ

-“হতেও পারে। যদি বলি হ্যাঁ, খুব ভুল হবে না। কেন জানিস?ʼʼ

-“হ জানি। কারণ তোর বাপ আমার দেবতা আছিল। কত আদর যত্নে আমারে বন্দি কইরা রাখছিল, কত সুন্দর দিন কাটাইলাম, সেলিমরে চোখের সামনে দেখতে দেখতে পাগল হইলাম!ʼʼ

মুরসালীন বড় আফসোসের সাথে বলল, “তুই সেই মানুষটাকে কেবল নিজের নোংরা, পাগলাটে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভুল বিচার করে খুব নৃশংস মৃত্যু দিয়েছিস, যে তোকে তিনটা বছর আগলে রেখেছিল!ʼʼ

জয় কেশে উঠল, “আগলে রেখেছিল? কস কী বাপ? মাথা ঘুরতেছে। একগ্লাস নেবু পানি খাইতে পারলে জানডা শান্তি লাগতো।ʼʼ

-“এটাও স্বাভাবিক। একজন অবিশ্বাসীর কাছে ধর্মীয় আচার শিক্ষাটা জুলুম মনে হওয়াই উচিত।ʼʼ

জয় মাথা দুলালো, “নাহ! আমি অবিশ্বাসী কে বলে? আমি হইলাম একজন সচেতন লোক। আমার বিশ্বাসের ম্যালা দাম। আবার আমার এই অবিশ্বাস বারবার ঠিক প্রমাণিত হইছে। কেমনে শুনবি?ʼʼ

মুরসালীন তাকিয়ে রইল। জয় বলল, “আমি নিজে বহুত মাইনষের কাল হইছি, যারা বিশ্বাসী–ধর্মে, পালনকর্তায়। কিন্তু ওদের ধর্ম আর পালনকর্তা ওদেরকে আমার হাত থেকে রক্ষা করে নাই। যেমনটা আমারে করে নাই!ʼʼ কাধ ঝাঁকাল জয়।

হতাশ সুরে চোখ ফিরিয়ে বলল মুরসালীন, “তুই জন্মেইছিস অবিশ্বাসী হয়ে, জয়। যে পঙ্গু কারণগুলো তুই তোর খোদাদ্রোহ অথবা দেশদ্রোহের দেখাস, তা শুধুই তোর স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ।ʼʼ

জয় মুচকি হাসল, “এই অবিশ্বাস আমার খুঁটি, মুরসালীন। আমি বিশ্বাস করতে জানলে কবে কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাইতাম। আমি আমাকে মানি, শুধু আমাকে। কিন্তু যখন বিশ্বাসের কথা ওঠে, আমিও আমার কাছে বেকার। আমি শুধু মানি, জয় আমির নিজে নিজেকে বানিয়েছে অপরকে ভেঙে, সে হাসতে শিখেছে মানুষকে কাঁদিয়ে। মানুষ তারে নিজ থেকে কিছু দেয় নাই, মাঝেমধ্যে তো বাঁচার জায়গাটুকুও দিতে চায় নাই! তোর আল্লাহ কিছুই দেয় নাই তারে। একটা পরিবার, একটা ঠিকানা, একটু সঙ্গ, একটু স্নে……এই অ-ভরসা তোর ধর্মের হাতে কামানো। তোর ধর্ম তোরে কী দিছে? এই বন্দিদশা?ʼʼ

-“বন্দি তো তুইও! তোর নফসের কাছে বন্দি, তোর অপ্রকৃতিতস্থ, বিকৃত চিন্তাধারার কাছে বন্দি। মদ ও পাপ সেই কারাগার, যা মানুষকে সাময়িক সস্তি দেয়, সাথে দেয় চিরস্থায়ী বন্দিত্ব। এই দুটোর মাঝে বিরতি এলেই পাপী ও নেশাগ্রস্থর ছটফটে মৃত্যু অনিবার্য! তোর রুহ্ সেই পাপের কাছে বন্দি।ʼʼ

ঠোঁট বাঁকাল জয়, “আর তুই অন্ধবিশ্বাসের কাছে। দেখ ভাই, আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবনডা খারাপ। তুই একজন খাঁটি বিশ্বাসী, ভালো লোক। তোর জীবনডা আরও খারাপ। তাইলে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর পরিস্থিতি যদি একই হয়, আমি খালি খালি আমার বিশ্বাস খরচা করবডা ক্যান? বিশ্বাস বেচে একদিন বড়লোক হবো আমি।ʼʼ

মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল, “বিশ্বাস করতে শক্তি লাগে। অসীম শক্তি। তুই ভীষণ দূর্বল, জয়। বিশ্বাস হলো কাঁচ। যা ঠুনকো আর ততটাই ধারালো। যখন-তখন ভেঙে যাবে আর তা বিঁধলে সেই রক্তক্ষরণে তোর মৃত্যুও হতে পারে। কাচ ভীতুদের হাতিয়ার হতে পারে না। কাচ নিয়ে খেলতে সিনা চাই বিশাল। তুই ভীতু। তোকে সামান্য আঘাতেও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা যায়। আর সেই ভাঙনটা ধরে ভেতরে। যেটা আরও ভয়ানক।ʼʼ

জয় মাথাটা নত করে নিঃশব্দে হাসল, “তুই আমার অতখানি সহ্য করিস নাই।ʼʼ

মুরসালীন হেসে উঠল, “তাই তো। আমি তোর অতখানি সহ্য করিনি, তোর চেয়ে বেশি হয়ে গেছে।ʼʼ

জয় আলতো মাথা নাড়ে, “তাই নাকি?ʼʼ

-“আমি-তুই শুধু পথের বৈপরিত্যে আলাদা, নয়ত আমার কাছে সবরকম সুযোগ ছিল তুই হয়ে যাবার!ʼʼ

জয় দু’পাশে মাথা দুলিয়ে হাসল, “আমি হওয়া সহজ না।ʼʼ

-“খুব সহজ। তুই হওয়া খুবই সহজ।ʼʼ

-“বলিস কী? প্রসেসিংটা বল তো! আবার জন্মাইলে সহজ পদ্ধতিটা ট্রাই করব জয় আমির হবার। প্রসেসিং কী?ʼʼ

-“পঙ্গু দৃষ্টিভঙ্গি, ঠুনকো বিশ্বাস, অপাত্রে কৃতজ্ঞতা, একপাক্ষিক বিচার, স্বার্থলোভী ধর্মভরসা…!ʼʼ

-“আবার সেই ভরসা- বিশ্বাসের প্যাঁচাল! সম্বন্ধির ছাওয়াল আমি অবিশ্বাসী তাতে তোর আব্বার কী হে? তোরে তো আমি আমারে হেদায়েতের নসিহত করতে বলি নাই!ʼʼ

-“ধর্ম ছাড়া যে কেউ তুই। আমিও হয়ে যেতাম। ওই যে বললাম সব সুযোগ ছিল। শুধু পারিবারিক শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা হওয়ায় আজ আমি-তুই প্রধান বিরোধী!ʼʼ

–“আমার তো পরিবার নাই!ʼʼ

-“আমার কাছে যে পরিবার ও শিক্ষা ছিল তা অন্তত তোর কাছেও ছিল! কিন্তু সেটাকে তুই ভরসা করিসনি, উল্টো ঘেন্না করেছিস, সেই শিক্ষাগুলোকে শত্রু মেনে নিয়ে সেটার বিরুদ্ধে বরং লড়াই করেছিস।ʼʼ

জয়ের নাক শিউরে উঠল, “তোর-আমার পরিস্থিতি কি এক ছিল?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দেয়, আংশিক না। পরে হ্যাঁ। তুই আমার আব্বাকে মেরেছিস, তখন আমরা তিন ভাইবোন অন্তত ততটুকু ছোট, যখন আব্বাকে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। কিন্তু সেই বয়স থেকে দলীয় হামলায় যাযাবর জীবপ-যাপন করেছি আম্মাকে সাথে নিয়ে। শেষমেশ আব্বার বদৌলতে মুরসালীন একটা চাকরি পেল, কিন্তু তাকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ এলো। এই আমি জেল খাটা, পুলিশের হয়রানী, তোদের দাবরানি খেতে খেতে অনার্স পাশ করলাম। তোর শরীরের আঘাতের চিহ্ন গুণে আমার সঙ্গে মিলিয়ে নিস, পূর্ণ আছে। তারপর আমার বোন…ʼʼ

মুরসালীন কেমন কোরে যেন হাসল এই পর্যায়ে, “পার্থক্য হলো এসব আমাকে আমার পথে আরও অটল করেছে, আর তোকে ছিটকে বিপথে নিয়ে ফেলেছে। পার্থক্য ওই বিশ্বাস আর দৃষ্টিকোণের! আজ এতগুলো দিনে আমার রক্ত ছাড়া আর কিছু বের করতে পারেনি তোর গুরু। হয়ত এটা আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মবিশ্বাস, আমার একত্ববাদ..

তুই স্বার্থে আল্লাহকে তোর রক্ষার হাতিয়ার কল্পনা করেছিস, কখনও তাকে বিশ্বাস, মনে-প্রাণে ভরসা অথবা পালন করিসনি। তোকে বলা হয়েছিল, আল্লাহ রক্ষাকর্তা। যখন তোর বিপদ এলো, তোর আল্লাহর কথা মনে পড়ল। কিন্তু বিপদ রক্ষা হলো না, তুই বিমুখ হয়ে গেলি! ধর্মবিশ্বাস তোর কাছে বিপদের হাতিয়ার হয়েছিল, জীবনটা তোর কাছে এক্সপেরিমেন্টাল হয়েছিল। তুই তোর চাচার ধাচে গড়ে ওঠা এক অন্ধ, স্বার্থন্বেষী!ʼʼ

-“ইনডাইরেক্টলিও স্বার্থপর বলিস না আমাকে। আমার ভেতরে বেঁধে। ভায়োলেন্স হয়ে যাইতে পারি।ʼʼ

-“ঠিক আছে। ডাইরেক্টলি বললাম। তুই খুব নিম্নমানের স্বার্থবাদী, সুবিধাভোগী মানুষ।ʼ৻

জয় মাথা নাড়ল, “মেজাজ বদলাস না আমার। বড়বাবা আসবে না এখানে। আমাকে বল।ʼʼ

দোলন সাহেব হেসে বলে উঠলেন, “মুরসালীন মহান, সেই একটা জয়নাল আমির তো তোমার ভেতরেও আছে!ʼʼ

মুরসালীন ইঙ্গিত বুঝল। তার চোখদুটো দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠল, সেই চোখ সামলে অদ্ভুত হেসে বলল, “আমি মুরসালীন পাঁচশোবার জন্মালে হাজার বার আমার বোনের ধর্ষককে বলি দিয়ে সেই রক্তে গোসল করব, স্যার। এখানে কোনো যুক্তি-তর্ক, ঠিক-বেঠিক, আইন-ধর্মের কোনো ঠাঁই নেই। এসবে কোনো আফসোস ও পাপের চিন্তা আমি রাখিনি ভেতরে। শুধু জানি, আমার বোনের ধর্ষকের রেহাই নেই, যতদিন আমার শ্বাস চলছে। হুমায়ুন পাটোয়ারীর মৃত্যু আমার হাতে লেখা ছিল, আরেকজনেরটা বাকি।ʼʼ

দোলন সাহেব জানালেন, “তারটা তোমার হাতে লেখা ছিল না।ʼʼ

মুরসালীন ভ্রু জড়াল, “পলাশ আজগর মরে গেছে, স্যার! কে মেরেছে?ʼʼ

দোলন সাহেব চুপ রইলেন। অথচ মুরসালীন চট করে ধরে ফেলল ব্যাপারটা, “কেন? জয় তার দোসরকে মেরে ফেলেছে কেন? ও কি ওর কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীকেই মৃত্যু ছাড়া অন্য প্রতিদান দেয় না? কী চলছে বাইরে?ʼʼ

দোলন সাহেব প্রসঙ্গ ধরলেন, “জয়নাল আমিরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা কেন, মুরসালীন? জয়নব ও জেবাও জয়নালের বোন ছিল, মুরসালীন।ʼʼ

মুরসালীনের চোখ কি ভিজে উঠেছে! বিস্মিত হলো তাকে দেখা মানুষগুলো। এই মুরসালীন রক্তে গোসল করে উঠলেও পাথরের মতো অনড়, আজ তার কণ্ঠস্বর ভেঙে এসেছে।

মুরসালীন তা লুকোতে আলগোছে হেসে উঠল, “এই দুনিয়ার প্রত্যেকটা ভাই একেকটা জয়নাল আমির হোক! আমিও জয়নাল আমির, স্যার! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমার জয়নাল আমির’ত্বে নিজের বোনের ইজ্জতের বদলে অন্যের বোন-মায়ের ইজ্জতের নেশা নেই। যা আমির বংশে আছে।ʼʼ

-“আমার জানামতে জয় তখন দিনাজপুরে ছিল না।ʼʼ

-“যায়-আসতো না, স্যার। ভাড়াটে লোক দিয়ে সৈয়দ বাড়ির নারীদের ইজ্জত ছিনতাই করা মানুষের ভাতিজা জয়। ইজ্জতের বদলে ওরা ইজ্জত নিতে জানে, স্যার। নিজের স্ত্রীকেও ছাড় দেয়নি। সেই ইতিহাসও পড়া আমার।ʼʼ

অন্তূ আশ্চর্য হয়ে বসে পড়ল মেঝের ওপর। জয় এখনও সেই ঢালাই মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। একটাবারও চোখ তুলে তাকায়নি, যতক্ষণ দোলন সাহেব ও মুরসালীন কথা বলেছে। অন্তূ অন্তত এবার আশা করেছিল জয় মুরসালীনকে কঠিন আঘাত করবে। জয় ঝুঁকে বসে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কপালে ঘঁষছে। মুখটা শক্ত, নাকের পাটা শিউরে উঠেছে, কিন্তু শান্ত! চাপা অস্থিরতা কপালের ভাঁজে দেখা গেল। একহাতে তখনও অন্তূর হাত।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জয় কেবল জিজ্ঞেস করল, “জিন্নাহরে কে মারছে মুরসালীন?ʼʼ

দোলন সাহেব কিছু বলতে গিয়েও থামলেন। আর লাভ নেই। মুরসালীন চোখ দুটো আলতো করে বুজে হাসল, “তোর গুরুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।ʼʼ

জয় মুখ তুলে চাইল। অনিয়ন্ত্রিতই তার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে অন্তূ হাত শক্ত করে চেপে ধরল আরেকটু।

মুরসালীন হাত নেড়ে বিদায় জানাল, “যাহ্ এখন। আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।ʼʼ

মুরসালীন আর তাকাল না জয়ের দিকে। সে তার ছেঁড়া শার্টের একপ্রান্ত ছিঁড়ে শরীরের ধুলোবালি ও শুকনো রক্ত মোছার চেষ্টা করল। তাজা ক্ষততে পানি লাগলে ভীষণ জ্বালা ধরে। আশেপাশে পানিও নেই। মুরসালীন তায়াম্মুম করে ফজরের নামাজে বসল।

জয় আস্তে কোরে উঠে দাঁড়াল অন্তূকে নিয়ে। অনেকক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। তিনটে দেহ অচেতন হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালে পাঠানো দরকার। তার সেসব আর ইচ্ছে করছে না। এমপি সাহেব এদের অবস্থা জানার পর আরেকটা ঝড় আসবে। আসতে পারে আরমিণের ওপরও! কিন্তু জয়ের মাথাটা ফাঁকা লাগছে।

মুরসালীন নামাজে সালাম ফিরিয়ে বসল, তখনও জয় দাঁড়িয়ে। তার আশপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে আছে। দু একজন ঘুম ভেঙে আধো চোখ খুলছে আবার শরীরের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছে।

জয় খানিক পরে সব ওভাবেই ফেলে অন্তূকে নিয়ে দোতলায় উঠে এলো। অন্তূর শরীর চলছে না। কোনোরকম সে অযু করে এসে নামাজে বসল।

কোনো কথা নেই। খানিকটা দূরে বসে জয় মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে মন ভরে খানিকটা মদ খেলো। এরপর শরীরে একটা সাডেটিভ ইঞ্জেকশন পুশ করে শুয়ে পড়ল।

সারাদিন একটানা ঘুমিয়ে ঘুমটা ছুটল মাগরিব আজানের পর। অন্তূ নামাজে বসেছে। জয় চোখ বুজে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। কিন্তু এর মাঝে অন্তূ আচমকা নামাজের মাঝে উঠে বাথরুমে দৌড়ায়। তার পায়ের আওয়াজে ঝিম ছেড়ে গেল জয়ের। এক দৌড়ে বাথরুমে পৌঁছে অন্তূকে ধরল, “কী হইছে? এই মেয়ে!ʼʼ

অন্তূ তাকাল। জয় আবার শুধায়, “কী? ওইভাবে দৌড়ায়ে আসলা ক্যান? শরীর খারাপ?ʼʼ

-“উহু!ʼʼ

অন্তূ জয়কে ছাড়িয়ে চোখে-মুখে পানি দিলো। তখনও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে জয়।

অন্তূ বলল, “আপনার বড়ঘরে গেলেই আমার শরীর খারাপ হয়। তার ওপর আপনার যা মন মাতানো জীবনের গল্প! মানসিক ভাবে খালি পাগল হওয়া বাকি। আর তো শরীর! আমি ঠিক আছি। আপনার খাবার বাড়া আছে। খেয়ে আসুন।ʼʼ

জয় আচমকা অন্তূকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। অন্তূ ঘটনার আকস্মিকতায় মৃদু চেঁচিয়ে উঠল, “এই এই! জয়। নামান আমাকে। নেশা চড়ে গেছে আপনার। নামান, নামান! পড়ে যাব আমি। এটা কী ধরণের কাজ? নামান! আল্লাহ!ʼʼ

গম্ভীর মুখে বলল, “চুপ। আমার সাথে ছলনা করবে না। নেশা করে কেন, মরার পরও তোমার বোঝা ওঠানোর সাধ্যি আছে জয় আমিরের। ঘুমাইছো? নাকি সারাদিন সংসার সামলানোর নাটক করছো? কী হইছে তোমার? চেহারার এই হাল কেন?ʼʼ

-“আমার সত্যি কিছু হয়নি। আশ্চর্য! দিব্যি ভালো আছি আমি। আপনার মতো আনহাইজিনিক পরিবেশে কমফোর্ট থাকার অভিজ্ঞতা নেই আমার।ʼʼ

জয় অন্তূকে বিছানায় টানটান শুইয়ে দিয়ে ওভাবেই ঝুঁকে রইল। জয়ের চোখে চোখ পড়লে অন্তূ মুখ ফেরায়।

জয় আচমকা অন্তূর গালটা ধরে নিজের দিকে ফেরালো, “আমার দিকে তাকাও! কী হইছে? কেমন লাগতেছে? আমি তোমার জীবনে কাল হয়ে তো বহুকাল আগেই আসছি, কিন্তু শরীর-চেহারায় এইরকম দূর্বলতা নতুন। অসুস্থ তুমি? ঘুমাওনি?ʼʼ

অন্তূ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। জয় কখনোই এভাবে নমনীয়তার সাথে, এমন হুটহাট তাকে ছোঁয় না। ইগোর চোটে ছোঁয়-ই না বলা চলে। অন্তূ জয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “কিচ্ছু হয়নি। ঘুমেরই অভাব। এই যা!ʼʼ

জয় সোজা হয়ে বসল বিছানায়, একটা বড় করে শ্বাস ফেলে আড়মোড়া ভাঙল। চট করে নিজের চিরায়ত রূপে ফিরল, “আমার ধারণা আমার এত দুক্কের গল্প শুনে আপনার উপরে তুমার একটা পিরিত পিরিত ভাব আইছে। নতুন প্রেমের আছড়। ঠিক না, ঘরওয়ালি?ʼʼ

অন্তূ চোখ বুজে ঘাড় কাত করে শুয়ে বলল, “আপনি আমার সেরকম স্বামী নন। আপনি স্বামী হবার আগে আসামী আমার! আপনার সামান্য একাংশের প্রেমে পড়াই যায়, অথচ বাকি অধিকাংশকে এড়ানোর উপায় কই!ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল অন্তূকে। অন্তূর সৌন্দর্যে একটা ম্লান ছায়া পড়েছে। উজ্জ্বলতা হারানো মৃত তারকার মতোন এক অন্ধকার নেমেছে। জয়কে কেউ ভেতর থেকঃ ডেকে শুধায়, ‘এর দায় তোর নয় তো, জয়!ʼ

জয় অস্বীকৃতি জানায়, ‘আমার কেন?ʼ

ভেতর থেকে উত্তর আসে, ‘তুই যে সৌন্দর্য খুঁজছিস তা আমজাদ আলী প্রামাণিকের মেয়ের, তুই যা দেখছিস তা তোর স্ত্রীর! তাহলে দায় কার?ʼ

‘স্ত্রীর!ʼ কথাটা বিঁধল ভেতরে। আজ এই কথাটাকে নিয়ে মুরসালীন অপমানজনক ইঙ্গিত করেছে। জয়ের ভেতরে একটু আক্রোশ জেগে উঠল। তার স্ত্রী, অথচ সে-ই আসামী! এমনটাই তো বুঝিয়েছে মুরসালীন!

এখনও মেয়েটার শারীরিক সৌন্দর্য অক্ষত। চিকন স্বর্ণের চুড়ি পরা হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে শুয়েছে। সেই হাতদুটো সুন্দর। জয়ের চোখে অন্তূর শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ, অন্তূর গলার নিচটা। ফর্সা গলায় স্বর্ণের চেইন। বরাবর জয়ের চোখ লেগে যায় ওখানে।

জয় অন্তূকে ডিঙিয়ে ওপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্তূ উঠে বসে। জয় চোখ বুজেই হাত চেপে ধরল, “উঠো না, ঘরওয়ালি। শুয়ে থাকো আমার সাথে।ʼʼ

‌-“নামাজ শেষ হয়নি আমার। খেয়ে আসুন আপনি।ʼʼ

জয় অন্তূর হাত আরেকটু চেপে ধরে বলল, “নামাজ কাজাও পড়া যায়। আমি একটু ঘুমাবো তোমাকে সাথে নিয়ে। শরীর-মেজাজ কোনোটাই ভালো না। আমার পাশে শুয়ে পড়ো।ʼʼ

অন্তূ কপাল জড়িয়ে তাকাল জয়ের দিকে। নিশ্চিন্তে চোখ বুজে শুয়ে আছে। শক্ত করে চেপে ধরে আছে অন্তূর হাত। এই কাজটা আজ সারারাত থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার করেছে।

অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করল, “জিন্নাহ আমিরকে যদি হামজা সাহেব মেরে থাকেন!ʼ

জয় চোখ খুলে সোজা অন্তূর চোখের দিকে তাকায়। নির্ঘুম চোখদুটো লাল, সজাগ।

চলবে..

[এরপর খুব দ্রুত এগোবে গল্পের ধারা। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। আজকের পর্বটা আমার পছন্দ হয়নি। আপনারাও একটু মানিয়ে নিন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here