#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭৩.
○
সৈয়দ ফরহাদ মুহাম্মাদ বারীকে মেরে জয় পাগল হয়ে উঠল জিন্নাহ ও তার মাকে খুঁজতে। পেলো না। চারদিকে তোলপাড় উঠে গেল ব্রিগেডিয়ারের মৃত্যুর খবরে, যেখানে তখন বাংলায় তাদের অনুকূল সময় চলছে।
সিনিয়র বিগ্রেডিয়ার বারী সাহেবকে প্রমাণহীনভাবে খুব সহজে মারতে পারার পেছনে অবশ্য একটা কারণ ছিল। জয় খুব সহজে ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিল, সেটাও একান্তে, ফরহাদ সাহেবের রাজধানীর ফ্ল্যাটে। দিনের বেলা।
জয় চলে আসার পর তিনি অধীর অপেক্ষা করেছেন, জয় দেখা করতে আসবে, একটাবার হলেও আসবে। জয় যায়নি। ফরহাদ সাহেব জানতেন জয় তাঁকে বড় ঘৃণা করে। কিন্তু তবু আশা রেখেছিলেন। বাঁকা জয়ের প্রতি একটা অঘোষিত স্নেহ তাঁর জমেছিল ভেতরে।
জয় অবশেষে উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। মানুষটা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আবার একটু লজ্জিতও। জয় নিশ্চয়ই জবাবদিহি চাইবে–কেন তিনি জয়ের বড়বাবাকে মেরেছেন? জেদি ছেলেটা কর্তব্যের মানে বুঝবে না। যাকে ছোটবেলায় নৈতিকতা শেখাতে গিয়েই নেতিবাচক চরিত্রে পরিণত হয়েছে তিনি।
জয় কেবল একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল, “বড়বাবাকে মারলেন কেন, স্যার?ʼʼ
ফরহাদ সাহেব একটু কথা গুছিয়ে নেবার ফাঁকে জয় আবার বলে, “আপনি জানেন আমার কেউ নাই। আমার খাতিরে ছেড়ে দিলেন না কেন? সব তো কেড়ে নিছেন। দেখেন, আপনারা সফল। আমার কাছে কেউ নাই, কিচ্ছু নাই। আপনি আমার বড়বাবাকেও নিয়ে নিলেন। কেন, স্যার? আমি তো আপনার কিছু ক্ষতি করি নাই! করছি, স্যার?ʼʼ
বারী সাহেব সামান্য হেসে জয়কে হাত নেড়ে কাছে ডেকে বলেছিলেন, “তুই যে আইন মানতে নারাজ রে আমিরের ব্যাটা! নয়ত তোরে বুঝাইতাম!ʼʼ
-“আইন সব আপনাদের কেন? আমরা কেন আইন পাই না? আইন তো আমাদেরও দরকার পড়তে পারে, স্যার! পাই না কেন?ʼʼ
জয় আমির কাঁদতে পারবে না। তাই শুধু তার চোখের মণির শিরা লাল টকটকে হয়ে উঠল। নয়দিন আগেও সে তার বড়বাবার স-ঙ্গে দেখা করবে ভেবে উত্তেজনায় কাঁপছিল। তার মনে পড়ে গেল, সেই বড়বাবাকে চিরতরে তার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার হুকুমদাতা বিগ্রেডিয়ার তার সামনে। জয় প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করার ধৈর্য পায়নি।
শেষ মুহুর্তে ফরহাদ সাহেবের মুখে একটা জ্যোতিময় হাসি ফুটে উঠেছিল। সেই হাসিতে ব্যথা ছিল, ছিল মলিনতা! তার চোখদুটো গভীরভাবে শুধু জয়কেই দেখছিল। তিনি শুধু বলেছিলেন, “তুই এই পথে যাবি বলেই আশংকা করেছিলাম রে আমিরের ব্যাটা! দো’আ থাকল, আল্লাহ তোরে পথ দেখান! ধৈর্য দিন!ʼʼ
তিনি অস্পষ্টভাবে কালেমা শাহাদত পড়লেন–’আশ্শহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাল্লাহ্…ʼ
জয় সেসব কিছুই দেখতে পায়নি। তখন তার চোখের সামনে এক অবরুদ্ধ নিশীথের আঁধার পর্দা। সেই পর্দায় বড়বাবার কঠিন মুখটা ভাসছে। জয় শেষবার সেই রাতে বড়বাবার কোলে চড়ে যে বড়বাবার চেহারাটা দেখেছিল–অভিজাত, কঠিন লাল, গম্ভীর মুখখানা! সে সেই মুখখানা দেখতে দেখতে বড় নৃশংসতার সাথে ফরহাদ সাহেবকে খু”ন করে ফেলল। বড়বাবা তাকে তখনও বলছে, ‘হাসবি শুধু। হাসবি, জয়। হাস্!ʼ
জয় হাসল। ফরহাদ সাহেবের রক্তে মাখা হাত টিস্যুতে মুছতে মুছতে জোরে জোরে হাসল। চোখদুটো জ্বলছে। তখন জয় আরও জোরে জোরে হাসতে হাসতে নির্জন সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো।
দিনাজজপুর ফেরার পর হামজা জয়কে আবার পাঠিয়ে দিলো রাজন আজগরের কাছে। তখন রাজন আজগর নিজেই দেশে ছিলেন না প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু তার লোকেদের সঙ্গে জয় রাজধানীতে থাকতে পারবে।
জয়কে পাওয়া গেল না বলে হামজাকে রিমান্ডে নেয়া হলো। উল্টো করে ঝুলিয়ে কাঁচা বাঁশ দিয়ে পেটানো হলো। ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে ধরে গেল। পাথরের দেয়ালে আঘাতের প্রতিধ্বনি ওঠে, তবু হামজা বলে না, জয় কোথায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর সামান্য চিকিৎসায় আবার চেতনা ফেরানো হলো তার।
একুশ বছরের এক যুবকের এই সহনশীলতায় কর্মকর্তারা হয়রান হলেন। হামজাকে আশ্বাস দিলেন, “আমরা শুধু জয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তুমি বলছো সে খু-ন করেনি। তাহলে সামনে আনতে সমস্যা কোথায় জয়কে?ʼʼ
হামজা বলে, “আমি জানি না স্যার জয় কোথায়? আমি কিছুদিন যাবৎ হলে ছিলাম। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয় না। ও কোথায় আমার জানা নেই।ʼʼ
-“তুমি জয়ের বাপ-মা, তুমিই তার সব, সবাই জানে। অনেকে একই সাক্ষী দিয়েছে। বেশি শেয়ানাগিরি করলে একেবারে ভেতরে ঢুকিয়ে দেব। তখন এই শেয়ানাগিরি পেছন দিয়ে যাবে।ʼʼ
-“তাই দিন। যেখানে আমি জানিই না জয় কোথায়, তাহলে ভেতরে রাখলেই কী বাইরে রাখলেই বা কী? জয় কিন্তু একদম বাচ্চা ছেলে না, স্যার। আপনারা সন্দেহ যখন করেছেন ওকে, ওর কি জানের মায়া নেই? আপনাদের মিথ্যা অভিযোগের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়েছে হয়ত।ʼʼ
বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন কর্মকর্তারা। হামজার কথায় উনারা নিজেরাই পেচিয়ে গেলেন এই সংশয়ে– আসলেই কি জয় আমির খুনটা করেছে নাকি করেনি!
কিন্তু হামজার ওপর টর্চারিংয়ের চতুর্থ দিন জয় এসে হাজির, সে আত্মসমর্পণ করল। কর্মকর্তারা দুই ভাইয়ের কার্যক্রমে হতবাক হয়ে গেলেন। জয় এসে বলল, “আপনারা নাকি আমারে খুঁজতেছেন?ʼʼ
-“খুন করে পালালে তো খুঁজবোই।
-“পালালে কেউ এসে ধরা দেয় না, স্যার! আর খুন করলেও না। আপনাদের সমস্যাটা হইলো—আসল খুনিকে খুঁজে না পাইলে আমার মতো দূর্বল, নিষ্পাপদেরকে টার্গেট করেন কেইস ডিসমিস করার জন্য। দুঃখজনক।ʼʼ
জয়ের কথায় সবাই যেমন বিভ্রান্ত হলো তেমনই ওর দুঃসাহসে হতবাক! জয় হামজার সাথে দেখা করার জন্য সামান্য একটু সুযোগ চাইল। যেহেতু সে নিজে এসে আত্মসমর্পণ করেছে, সে অনেকটা ছাড় পেল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে নেবার আগে হামজার সেলেই রাখা হলো।
হামজা আক্রমণাত্মক হয়ে তেড়ে এলো, “শুয়োরের বাচ্চা। এখানে এসেছিস কেন? মরার এত শখ হয়েছে তোর?ʼʼ
-“নিজের শখ আমার উপরে চাপাইও না, বড়সাহেব। খুন তো করছিই! তা স্বীকার না করে মার খাচ্ছ তুমি। মরার শখ আমার হলো কীভাবে?ʼʼ
হামজা গলা চেপে ধরল, “আমি মার খাচ্ছি তাতে তোর বাপের কী? তোকে বলেছিলাম না আন্ডারগ্রাউন্ড থাক। সময় ভালো না! ক্যান আসছিস এইখানে?ʼʼ
জয় একগাল হাসল, “একা একা মার খাচ্ছ, ব্যাপারটা ভালো লাগতেছিল না। আমার ভাগ নিতে আসলাম। হক ছাড়া যাবে না।ʼʼ
হামজা দিশেহারা হয়ে পড়ল, “বাইঞ্চোদের বাচ্চা! একবার ধরা খাইলে আর ছাড়া পাবি না। নিশ্চিত মার্ডার! শালার.. তোরে…আমি তোরে কী করব ক তো! এইজন্যে তোরে আন্ডারগ্রাউন্ড করছিলাম রে হারামির বাচ্চা?ʼʼ
জয় আরাম করে নোংরা মেঝেতে টানটান হয়ে শুয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে পা দুলাতে দুলাতে বলে, “তুমি একবার আমারে কইছিলা, ‘একসাথে বাঁচতে না পারলে একসাথে মরে যাব। একা একা বেঁচে থাকার দরকার নেই। বুঝলি, জয়?ʼ আইজ তার পরীক্ষা দিবার আইছি। আমার তো কেউ নাই। তোমারে এরা এমনে শ্যাষ কইরা ফালাইলে আমি বাল বাইরে এমনেই মইরা যাইতাম!ʼʼ
হামজা শক্ত করে জয়ের হাতটা চেপে ধরে ধরেই রাখে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, “চুপ থাক। তোর কথা কানে ঢুকলে রক্ত গরম হচ্ছে।ʼʼ
জয় বেহায়ার মতো দাঁত বের করে একটু হাসল। এখন তার চোখে-মুখে একটুও ভয় নেই। হামজা মার খাবে আর সে পালিয়ে থাকবে এ আবার কোনদেশি কথা?
জয়কে যখন নিতে আসল ইন্টেরোগেশনে নেবার জন্য, কোনোভাবেই হামজার হাতের বাঁধন থেকে জয়কে ছাড়ানো গেল না।
পুলিশ কাঠের লাঠি দিয়ে হামজার কব্জির ওপর মারল এক বাড়ি। খট করে শব্দ হয়ে কব্জিটা বোধহয় ছুটেই গেল! জয়ের হাত ছুটে গেল। পুলিশেরা একটা পন্থা নীরবেই পেয়ে গেল। হামজার সামনে জয়কে মারতে শুরু করা হলো।
জয়কে প্রশ্ন করা হলে সে উত্তর না দিয়ে বরং উল্টো-পাল্টা প্রশ্ন করছিল। যেমন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “খুনটা তুই কেন করেছিস, জয়?ʼʼ
জয় জিজ্ঞেস করল, “খুন করা কি খারাপ?ʼʼ
-“তোর মতে কি ভালো?ʼʼ
সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি যদি খুন করি, আমার কী শাস্তি হবে?ʼʼ
-“প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তোর ফাঁসি হতে পারে। করেছিস কি না খুন, তাই বল।ʼʼ
-“খুন যে করবে তারই ফাঁসি হবে?ʼʼ
-“ধরা পড়লে অবশ্যই শাস্তি হবে।ʼʼ
জয়ের ভেতরে এবার নিজের কৃতকর্মের ওপর দৃঢ়তা এলো। সে একটুও পাপ করেনি। তার গোটা পরিবার খুন হয়েছে। তার বদলে সেই খুনীদেরকে জয় তাদেরকে দিলেই বরং সেটা আইন। গোটা সৈয়দ পরিবারকে মরতে হবে। এজন্য তাকে বাঁচতে হবে। মরতে অবশ্য তার খারাপ লাগে না। কিন্তু শাস্তি না দিয়ে মরা যাবে না।
তাকে মারতে মারতে প্রায় জ্ঞানহারা করে ফেলা হলো। কিশোর বলে ছাড় পেল না সে। কিন্তু স্বীকার করল না কিছুই।
এক সময় কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে জয়ের। মেঝেতে পড়ে নাকে আঘাত পাবার পরেও জয় নিজের সবটুকু চেষ্টা করে নিজেকে আর্তনাদ করা থেকে থামাতে। তার ভয় হয়–তার আঘাতে হামজা নির্ঘাত খুনের দায় নিজে স্বীকার করে বসবে।
হলো সেরকমই। হামজা পুলিশের পায়ের কাছে বসে পড়ল, “জয় কিছু করে নাই স্যার! ওরে মারবেন না।ʼʼ
-“পুলিশ পৈশাচিক হাসল, তাইলে কি তুই করছিস?ʼʼ
হামজা চট করে বলে, “হ!ʼʼ
-“অ্যাহ্!ʼʼ
“-জি স্যার। মানে খুন করি নাই। কিন্তু আমার অপরাধ আছে, স্যার। জানি কে খুন করছে।ʼʼ
জয় তখন শরীরের ভর ছেড়ে চামড়া ছেঁড়া শরীরে মেঝের ওপর পড়ে আছে। আগ্রহ পেয়ে বসল পুলিশ। হামজা সেলিমের নাম বলে দিলো। পুলিশ জিজ্ঞেস করলেন, “সে কেন মারবে বিগ্রেডিয়ারকে?ʼʼ
হামজা জানালো, “কারণ সেলিম বারী স্যারের মাদ্রাসায় কিছু বছর আগে আগুন দেবার সময়ও আমাকে কাজে লাগিয়ে কিছু বছর আগেও একবার সেই মাদ্রাসায় আগুন দিয়েছিল। তারপর মাদ্রাসা থেকে খুব মারধর করে তেড়ে দেয়া হয় সেলিম কাকাকে। সেই রাগ…ʼʼ
-“তো তুই বলতে চাচ্ছিস, সে এবার বারী সাহেবকে মারতেও তোকেই ব্যবহার করেছে?ʼʼ
-“হ্যাঁ, স্যার। জয়কে বারী সাহেব খুব ভালোবাসতো। আমাকে হুমকি দিয়ে সেলিম জয়ের মাধ্যমে বারী সাহেবের সাথে দেখা করার সুযোগ করে নিছিলো স্যার। আমি জয়কে পাঠাইছিলাম সেলিম কাকার সাথে। এই আমার অপরাধ। কিন্তু জয় খুন হওয়া দেখেনি। ওকে বের করে দিয়েছিল সেলিম কাকা। আর ওর সিড়ি বেয়ে নামাই দেখেছেন আপনারা। তারপর আর সেলিম কাকার সাথে দেখাও হয় নাই আমাদের।ʼʼ
প্রমাণের অভাবে আরও কিছুদিন টর্চার করে ফায়দা না পেয়ে দুই কিশোরকে ছেড়ে দেয়া হলো বটে। এবং হামজার কথা বেশ বিশ্বাসযোগ্য হলো, কারণ সেলিম আসলেই নিখোঁজ ছিল। এই কাজটা হামজার বড়ভাইয়েরা অন্তত করেছিল হামজাকে রক্ষা করতে। সেলিমকে সাময়িক গুম করা হয়েছিল।
সেলিমের লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটাতে মুস্তাকিনসহ সংগঠনের সবাইও হামজার স্টেটমেন্ট আরেকবার বিশ্বাস করল। কারণ সেলিমের দ্বারা এমন কিছু অসম্ভব নয়। আবার সে খুনের পরপরইআ লাপাতা। আবার সে জয় চলে আসার পরপরও সত্যিআ অনেকবার মাদ্রাসা ও জয়-হামজাকে একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্থ করার চেষ্টা করেছে।
জয় ও হামজার ভালো চিকিৎসা হলো না। কারাগারের মারগুলো শরীরে বসে গেল। সদ্য যুবক বয়সে হামজার উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদযন্ত্রে বিভিন্ন রোগশোক দেখা দিয়েছিল এতে। দিনদিন এসব ঘটনাবলী হামজার ভেতরে পৈশাচিকতার ভাণ্ডার গড়ে তুলছিল। তার কেবল ক্ষমতাই চাই, ক্ষমতা!
সেই মারের আঘাত কাচা থাকতে থাকতেই জয় নিখোঁজ হলো। সেলিম ফারুকী বড় সূক্ষ্ণ কৌশলের সঙ্গে জয়ের মস্তিষ্ক ও শরীরকে একসাথে ধ্বংস করার কৌশলে মজলেন। অন্ধকার কবরের মতো কোথাও একটা তাকে আটকে রাখা হলো মাসখানেকের মতোন। সেলিম ফারুকী জয়ের সাথে সেই দিনগুলোতে যা যা করেছিল, জয় সেই সময়টা মৃত্যুর সঙ্গ নিয়ে বেঁচে ছিল। কিন্তু মৃত্যু এবারও তার সঙ্গে প্রতারণা করল।
সেলিম ফারুকীর কৌশলী টর্চার জয়ের মস্তিক ও শরীরের চিরস্থায়ী ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হলো। জয়ের মাংসপেশী ও রক্ততে বিভিন্ন আজব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল এ সময়।
সেখান থেকে ফেরার পর থেকে জয়ের মাংসের ভেতরে কামড়াতো। নাক দিয়ে রক্ত পড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভয়ানক উপসর্গ ও শরীরের যন্ত্রণা! ড্রাগে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল সে। সেলিম ফারুকীর ইনজেক্ট করা অবিরাম ড্রাগ জয়কে ড্রাগের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলল।
নিয়মিত সেবনের জন্য যেসব মেডিসিন ডাক্তার দিলো, তা তাকে কোনোদিন গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ডাক্তার একটা চমৎকার ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, জয়ের লোহিত রক্তকণিকার গুণগত মান নষ্ট হবার পথে। এবং সে যে সকল ড্রাগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তা তার শরীরের নষ্ট কোষের বৃদ্ধিতে বেশ ভালো সহায়তা করছে। এটা ভবিষ্যতে ব্লাড-ক্যান্সারের রূপ নিতে পারে। জয়ের শরীরের ব্লাড-করপাসলের মাদার-সেলগুলো সব মিলিয়ে খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।
তিনটে বছর মুস্তাকিন বিশ্বাস করেছিল–তার আব্বাকে সেলিম মেরেছে। সে সময়টা সে হন্য হয়ে সেলিমকে খুঁজেছে। কিন্তু সেলিম সন্দেহের দায়ে পলাতক। এতে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল সে অপরাধী।
কিন্তু ২০০৬ এর শুরুর দিকে মুরসালীন জানতে পারল সেলিম মারেনি, মেরেছে জয়। যে জিন্নাহকে জয় বছরের পর বছর খুঁজে পায়নি, সেই জিন্নাহ আমির মুরসালীন ও তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে বন্দি হলো জয়কে ধরার টোপ হিসেবে।
সময়টা হামজা ও জয়ের জন্য অতিরিক্ত প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। তখন বিরোধী সরকারের সময়সীমা প্রায় শেষের দিকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার সময় হয়ে এসেছে প্রায়।
হামজা ও জয় জানের মায়া ত্যাগ করে নিজেদের দলীয় প্রচারণায় নামলো। তাদের শেষ সুযোগ এটা! এবার দল ক্ষমতায় আসতেই হবে, অন্তত তাদের দুজনের অনেক পুরোনো হিসেব চুকানোর দায়ে হলেও।
সে সময় জিন্নাহকে ছাড়িয়ে আনতে জয় পাগল হয়ে উঠেছিল। তার একূল-ওকুলে কেউ নেই জিন্নাহ ছাড়া! এতে করে বর্তমানের দলীয় কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটছিল। যা হামজার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তাদেরকে জিততে হবে। যেকোনোভাবে। জীবনের হিসেবের খাতাগুলো পড়ে আছে, শরীরের আঘাত, পেটে খিদে, প্রবৃত্তির নেশাগ্রস্থতা, বদলার আগুন….হামজা এগুলোকে এড়ানোর সাধ্যি রাখে না। তাকে জিততেই হবে।
জয় যতটা উতলা হয়ে উঠছিল জিন্নাহকে মুক্ত করতে, একবার ওকে দেখতে, হামজা ততটাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল জয়কে হারানোর আতঙ্কে। সবে তাদের যাত্রা শুরুই হয়নি, তার মাঝে জিন্নাহ ঢুকে এলো। মুস্তাকিন জিন্নাহর মুক্তির বদলে জয়কে চায়। যেখানে জয়কে নিজের রাখতে হামজা দুনিয়ার সাথে একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেই পারে। জয় তার রগে রগে মিশে যাওয়া সঙ্গদোষ, ডান হাতের মুঠিতে আঁকড়ে ধরার মতো হাত, বুকের সাথে মিশিয়ে পিঠে চাপড় মারার মতোন শক্ত সিনা, জয় তার এক জনমের পাপাচারের সঙ্গী! সে জয়কে ছোট্ট বয়সে জিতে এনেছে। তার রুহ্ না গেলে জয় যাবে না।
জয়কে সে আশ্বাস দিলো, নির্বাচনে জিত তাদের হবে। তারপর দুনিয়া তাদের। এখন শুধু প্রচারণার কাজে মন লাগা।
দেশে মার্শাল ল জারী হলো। হামজা সেনাবাহিনীর হাতে মার খেলো। দেহে ছেপে যাওয়া দাগের সংখ্যা বাড়ল, গাঢ় হলো ক্ষতগুলো, ভেতরের আগুন নিভে, ব্যথা গলে তা লাভায় পরিণত হলো। যা জলন্ত কিন্তু শান্ত, গলিত। তা দাউদাউ করে জ্বলে না, কেবল নিঃশব্দে বয়ে যায় জমিন পুড়িয়ে ছাই করতে করতে।
নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ এর ডিসেম্বরের শেষ তারিখে। জিতে গেল হামজার দল। এবার হামজার অধিপত্য বিস্তারে আর বাঁধা এলে হামজা তা মানবে কেন? বাঁধা হয়ে যা আসবে, তা ছাই হবে।
মুস্তাকিনদের ভেসে বেড়ানোর দিন এলো। চারদিকে তাদের আটক, গুম-খুন বাড়ল। সেরকম ভাসমান এক সময় বন্দি জিন্নাহ আমির গায়েব হয়ে গেল তাদের আঁটকখানা থেকে। কেউ জানল না জিন্নাহ কোথায়!
জিন্নাহ্ আমির হামজার হাতে বলী হয়ে গেল একরাতে। জয়ের শেষ পিছুটানকে মেরে হামজা হাত মুছে ফেলল কালো পাঞ্জাবীর নিচের পৃষ্ঠে। জয় জানেনি তা। দিন যত যাচ্ছিল, জয় উন্মাদ হয়ে উঠছিল জিন্নাহকে পেতে, আর তারল আগ্রাসন বাড়ছিল সৈয়দ পরিবারের প্রতি। যা হামজা চাইছিল ঠিক সেই মোতাবেকই সব এগোলো।
হামজার ওয়ার্কসপ উঠল। বাড়ির নকশায় বড়ঘর তৈরি হলো। নিজে নকশা তৈয়ার করেছিল পাটোয়ারী বাড়ির। বড়ঘরটা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৬৫-৩০ ফুট। বড়ঘর তৈরির খাতিরে হামজার বাড়ি মোট মিলিয়ে বিশাল হলো। দোতলার অর্ধেকের বেশি খালি পড়ে থাকে। সেখানটা পরিত্যক্ত।
বড়ঘরের গুদামের অংশে মেটাল-মেল্টিং মেশিন এলো! ২০১২-তে বড়ঘরে সেই ধাতু গলানোর চুল্লিতে সর্বপ্রথম সেলিম ফারুকী গলেছিল। তাকে পিস পিস করে কেটে কেটে গলানো হয়েছিল চুল্লিতে। হামজা কেটেছে, জয় গলিয়েছে। সেলিমের বাঁ হাতের একাংশ পচে ক্ষয় হয়েছে বড়ঘরেই।
সেলিম ফারুকীর হাতে পাথরের আংটির কমতি ছিল না। অন্তূ প্রথমদিন বড়ঘরে ঢুকে সেই ক্ষয়িত হাতের আংটিগুলো দেখেছিল।
মুস্তাকিন মহান পিবিআই ডিপার্টমেন্টে ইনভেস্টিগেটর নিযুক্ত হলো, তখন বাংলাদেশে পিবিআই ডিপার্টমেন্ট পুলিশের এক নতুন ব্রাঞ্চ। চাকরির এক বছরেরও কম সময়েই মুস্তাকিনের দল-বিরোধী তদন্ত কার্যক্রমের ফলে উপর মহল থেকে আদেশ এলো তাকে প্রথমে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পরে দুনিয়া থেকে।
কিন্তু জয়ের বদৌলতে মুস্তাকিনের জায়গা হলো, হামজার বড়ঘর। সময় ২০১৩ এর শেষের দিকে।
মুস্তাকিনের চেহারার সাথে খুব বেশি মিল ছিল মুমতাহিণার। মিল-মহব্বতও বেশি দুই ভাই-বোনের। মুস্তাকিনের চেহারায় নমনীয়তার সাথে বীরত্বপূর্ণ তেজ বেশি লক্ষ করা যায়। এক গাল মাঝারি চাপদাড়ি। গায়ের রঙ পুরুষ হিসেবে ফর্সা। টাখনু অবধি গোটানো প্যান্ট। মাঝারি চুলগুলো বিন্যস্ত। কপালের মাঝখানে নামাজের কড়া পড়া কালো দাগ। বড় শোভনীয় এক পৌরুষ দীপ্তি চোখে-মুখে। জোরে হাসতে দেখা যায় না লোকটাকে। মুচকিই হাসিই বেশি। চোখদুটো গভীর, বিচক্ষণ, বিনয়ী!
মুস্তাকিন বড়ঘরের চারদিকটা দেখে নিয়ে হা করে শ্বাস ফেলে মেঝেতে বসল। জয়কে দেখে একগাল মুচকি হাসল, “ভালো আছিস?ʼʼ
জয় গিয়ে সামনে বসলে মুস্তাকিন বলল, “এখন কী করছিস?ʼʼ
-“কী করতেছি বললে খুশি হবি? আজ তোর খুশির দিন।ʼʼ
-“আমার খুশি হবার মতো কিছু করছিস না, তুই। সুতরাং যা বলবি, তাতেই সামান্য দুঃখ পাব। তবু বল।ʼʼ
জয় দাঁত বের করে হাসল, “আমার অবস্থা মনে কর—’ও দয়াল জান নিবা নাও, দম ক্যা বাইর হইয়া যায়ʼ টাইপের। গরীব-ধরীব মানুষ, দুক্কের দিন একরকম কেটে যাচ্চে। কিন্তু তাই বলে তোর কোনো দুঃখ আমি রাখব না। তোর দুঃখ দূর করতেই এইখানে আনছি তোরে।ʼʼ
একটু থেমে খুব জ্ঞানীর মতো করে জয় বলল, “বুঝলি মুস্তাকিন, মাইনষের কপাল আর লুঙ্গির গিট্টু কখন কীভাবে খুলে যায়, কেউ জানে না। আজ তোরটা খুলব।ʼʼ
পলাশ চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “লুঙ্গির না কপালের রে, জয়?ʼʼ
-“লুঙ্গিরটা খুললে কপাল আপনা-আপনিই খুলে যায়, পলাশ ভাই। কপালের সব নেয়ামত তো লুঙ্গির তলেই!ʼʼ
মুস্তাকিন জয়কে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে টের পেল কেউ আসছে। ধীর-স্থির পদক্ষেপে হামজা এসে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা এক হাসি দিলো, “ভালো আছো?ʼʼ
-“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো?ʼʼ
-“সবসময়। তোমার ভালো থাকারও একটা ব্যবস্থা করতে চাই। তোমার জন্য একটা সুযোগ আছে। সেটা জানানোর আলাপ করতেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা। তুমি আবার খারাপভাবে নাওনি তো এভাবে তুলে আনার বিষয়টা?ʼʼ
মুস্তাকিন হামজার ধূর্ত মুখখানির দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, “না। আমাকে এখানে আসতে হবে, তা নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। তবে আপনার সুযোগ বোধহয় আমি গ্রহণ না করে আপনাকে অসন্তুষ্ট করতে চলেছি, হামজা ভাই। এতে আপনি কিছু মনে না করলেই হলো।ʼʼ
হামজা বড় উচ্ছ্বাসিত হয়ে হাসল, “তার ব্যবস্থাও আছে, চিন্তা কোরো না, ভাই। আমি আছি না!ʼʼ
মুস্তাকিন বিরবির করল, “তা তো বটেই! সেই ব্যবস্থা শুরুর অপেক্ষায়।ʼʼ
পলাশ উঠে এলো। তার হাসিতে বড়ঘর জুড়ে উঠল। সে হাসলে চোখ কুঁচকে ওঠে, তাতে চোখের মণির জ্বলজ্বলে ভাবটা বেশি ফুটে ওঠে। এসেই সে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল মুস্তাকিনকে দেখে।
হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “গুড জব, ছোটভাই! অল্পদিনের চাকরিতে আমারে একদম নড়চড় করে রেখে দিচ্ছিলে! তোমার তদন্তের কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট আমি। আরেকটু সুযোগ পাইলে একদম আমারেই খালাশ করে দিতা, কোনো সন্দেহ নাই। সাহসের ব্যাপার-স্যাপার! গুড জব, গুড জব। আই এপ্রিশিয়েট! গুড।ʼʼ
মুস্তাকিন একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।ʼʼ
জয় জিজ্ঞেস করল, “জিন্নাহ কোথায় রে?ʼʼ
-“নেই।ʼʼ
জয় ভ্রু উঁচায়, “উহ্? কীহ্? শুনি নাই। আবার ক।ʼʼ
মুস্তাকিন শান্ত চোখে চেয়ে রইল। জয় আবার জিজ্ঞেস করে, “জিন্নাহ্কে ফিরিয়ে দে। তোর জান দেব।ʼʼ
মুস্তাকিন হাসে, “চেয়েছি?ʼʼ
জয় মুস্তাকিনের কাধে হাত রাখল, “চাইবি। সত্যি বলছি, বিশ্বাস কর। তুই জান চাইবি আমার কাছে।ʼʼ
-“হ্যাঁ, আব্বারটা। দে ফিরিয়ে দে।ʼʼ
জয়ের চোয়াল আটলো, “জিন্নাহ্কে এতদিন আঁটকে রেখে আমারে পাস নাই। নতুন আর কীসের আশায় বাচ্চা ছেলেটারে কষ্ট দিচ্ছিস? আমি শুরু করলে তোর পুরো সংগঠনের রুহুতে কাঁপন উঠাবো। জয় আমির ওয়াদায় পাক্কা।ʼʼ
“জিন্নাহ্কে ফিরিয়ে দিলে তার বদলে তুই ফাঁসিতে ঝুলবি আব্বাকে খুন করার অপরাধে? দলের নয়জন যুবক তোদের হাতে বলি হয়েছে, তার অপরাধে? কারাগার ভরে উঠছে দিনে দিনে আমাদের লোক দিয়ে, তার অপরাধে?ʼʼ
-“অপরাধ? কোনটারে বা তোরা অপরাধ কস, আমি ওই বই থেকে অপরাধের সংজ্ঞা শিখি নাই।ʼʼ
-“তুই যে বই থেকে অপরাধের সংজ্ঞা শিখেছিস, ওটা মূলত অপরাধ শেখার বই ছিল। ‘অপরাধ কীʼ এই বিষয়টা আলাদা বইয়ে শেখানো হয়। ওটাকে নৈতিকতা বলে।ʼʼ
-“নৈতিকতা আর চিংড়ি মাছ এক আমার কাছে। স্বাদ ভালো, কিন্তু গা চুলকায়।ʼʼ
মুস্তাকিন জয়কে দেখল। ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি, তাতে এক প্রকার হিংস্র উন্মাদনা।
-“জিন্নাহ্কে ফেরত দিবি, মুস্তাকিন? তোর শরীরের নৈতিক রক্ত আমার অনৈতিক হাতে লাগলে চামড়া জ্বলার সম্ভাবনা আছে। যা আমি চাইতেছি না আপাতত।ʼʼ
-“সমস্যা নেই। শুরু কর। উর্দুতে একটা কথা আছে—কাল করবে তো আজ, আজ করবে তো এখন। করবি যখন, করে ফেল। দ্বিধা কেন? জিন্নাহ্ কোথায় আমি জানি না। মরলেও জানি না, বাঁচলেও জানি না।ʼʼ
হামজা চুপচাপ মেশিনের খণ্ডের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভালো দর্শক। চুপচাপ দেখতে তার ভালো লাগে।
পলাশ মুস্তাকিনের মুখটা মাটিতে ফেলে নিচের চোয়ালটা জুতো দিয়ে চেপে ধরে ঢালাই মেঝেতে ঘষল। তাতে মুরসালীনের চোয়ালের চামড়া ছিঁড়ে যায়। পলাশের বড় শান্তি লাগল তা দেখতে।
পলাশ অমায়িক হেসে বলল, “আমার নামে কমপক্ষে ছাব্বিশটা কেইস খুলছো তুমি, মুস্তাকিন। আমি কি এতই খারাপ? তুমি ভাই মানুষ চেনো না, যারে তারে নিয়া খেলতে আসো। তোমার কাম অপরাধীদের নিয়ে, আমার পেছনে লাগছো ক্যান? আমি কি অপরাধী? আমি একজন সফল ব্যবসায়ী। তোমার কোনো ধারণা আছে এই খানে আসতে আমার কত পরিশ্রম গেছে?ʼʼ
জুতোর বাঁট দিয়ে মুস্তাকিনের মুখের ওপর কষে এক লাত্থি মারল পলাশ। মুস্তাকিনের নিচের ঠোঁটটা থেতলে, ফেটে রক্ত ছিটকে এলো। নাক দিয়ে চিরচির করে রক্ত বেরিয়ে এলো। কপালের ত্বক ছিলে গেল, চোখে আঘাত লেগে ঝাপসা হলো চোখ, জ্বলুনি উঠল খুব। মুস্তাকিনের ঠোঁটের রক্তটুকু পলাশ আঙুলের ডগায় তুলে নিয়ে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল।
মুস্তাকিন আবার উঠে বসে। ক্ষত-বিক্ষত মুখে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে, “কাপুরুষ গায়ে লেখা থাকে না, পলাশ আজগর। আমি তদন্ত ভরা ময়দানে করে তোর গেইম অভার করছিলাম, আর তুই আমার এক ফোঁটা রক্ত নিতে দেখ কত আয়োজন করেছিস! একজনের জন্য এই ঘরে তিনজন, বাইরে শ খানেক দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিস। এইটাকেই বরং বীরত্ব ধরে মরি যে এক আমিকে দমন করতে তোদের গোটা ফৌজ দাঁড়িয়ে যেতে হয়। খোলা ময়দানে আমার একার জন্য তুই একা আসতি নাহয়! হারলেও অন্তত এইটুকু আনন্দ তো নিয়ে মরতাম যে জীবনের শেষ মোকাবেলাটা কোনো পুরুষের সাথে হয়েছিল! এখন তো মরার পরেও এই আফসোস থাকবে যে কতকগুলো কুকুরের দলীয় দংশনে প্রাণ হারিয়েছি আমি সৈয়দ মুস্তাকিন মহান।ʼʼ
পলাশ দুঃখিত ভঙ্গিতে হাসল, “আমি তোর আফসোসের চিন্তা করছি না, ইনভেস্টিগেটর! আমি আমার সৌভাগ্যের কথা ভাবছি যে তোর মতো একজন সৎ, বীর, আইনের কর্মকর্তার মহান শরীরে আমি আমার কুত্তা মার্কা দাঁত বসাতে পারব। এই দুঃখে আমি তোকে জীবিত রাখব, ইনভেস্টিগেটর। পরাগের মাঝে আমি তোর পরিচয় জীবিত রাখব। ওকে লোক চেনে না, তোর বীরত্বপূর্ণ নামে চিনবে।ʼʼ
পলাশ অলস পায়ে হেঁটে গিয়ে একটা বস্তা টেনে এনে জয়ের সামনে রাখে। তাতে হকিস্টিক, মেহগনির কাঁচা খড়ি, রড, ছুরি, দা, চাপ্পর, বড় বড় কয়েকটা স্ক্রু-ড্রাইভার, হাতুরি, ছোট্ট কুড়াল, কয়েকটা শাবল ইত্যাদি। বেশ ভার বস্তাটা। পলাশের জোয়ান, বলবান শরীরও ঘেমে উঠল এই খাটুনিতে।
জয় শরীরের শার্ট ও গেঞ্জি খুলে শার্টটা ফেলে দিলো মেঝেতে, গেঞ্জিটা মুস্তাকিনের মুখে গুজে দিয়ে তখন রড দিয়ে পিটাতে শুরু করল, হামজা আস্তে কোরে সেখান থেকে চলে যায়। সে নতুন বিয়ে করেছে। রিমি জিজ্ঞেস করলে বলবে, সিগারেট টানতে গেছিল। বেশি দেরি করলে কথাটা অবিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, কারণ সিগারেট খেতে খুব বেশি দেরি লাগে না।
মুস্তাকিনের ডান হাতের কনুইয়ের অস্থি-সন্ধিটা খটাং করে ছুটে হাতটা ঝুলে গেল মোটা ইস্পাত রডের আঘাতে। শরীরের চামড়া উঠে মাংসপেশিগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠে এলো কোনো কোনো আঘাতে। মুস্তাকিন প্রথমবার জ্ঞান হারানোর আগে মুখে গুজে থাকা গেঞ্জির ওপরই একবার বমি করে ফেলল।
জয় ক্লান্ত হয়ে রড ফেলে দেয়। গেঞ্জিটা বের করে আনে। মুস্তাকিন অচেতনের মতো পড়ে রইল। সেদিন জিজ্ঞাসাবাদ আর হলো না। ডাক্তার দু’দিন ধরে চিকিৎসা দিলো মুস্তাকিনকে বড়ঘরেই। ডাক্তার তার জীবনের শেষ চিকিৎসাটা বেশ যত্নের সাথে, ব্যথিত হৃদয়েই করল।
মুস্তাকিনের জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তারের দেহটা ধাতু-গলানোর মেশিনের জ্বালানি হয়ে গেল। হামজা ডাক্তারকে বড়ঘর থেকে বাইরে পাঠানোর ঝুঁকি নেবে কেন?
সেই একই প্রশ্ন জয়ের, “জিন্নাহ্কে ফিরিয়ে দে। তোকে খুন করার খুব একটা ইচ্ছে নেই আমার।ʼʼ
মুস্তাকিন বুঝেছিল, জয়ের ভেতরের উন্মাদনা। সে যদি বলে জিন্নাহ্ নিখোঁজ, জয় বিশ্বাস করবে না। সে জন্মগত অবিশ্বাসী। সে ধরে নেবে জিন্নাহ্কে ওরা মেরে ফেলেছে। মুস্তাকিনের চোখের সামনে আম্মা, মুমতাহিণা, মুরসালীন আর মাদ্রাসার ছোট ছোট এতিমগুলোর মুখ ভেসে উঠল। জয় ওদেরকে মশার ঠ্যাংয়ের মতো ছিঁড়ে ফেলবে।
মুস্তাকিন শেষ মুহূর্তেও স্বীকার করেনি জিন্নাহ্ হারিয়ে গেছে। সে বছর ধরে জিন্নাহর খোঁজ করেছে। কিন্তু না খুঁজে পেয়েছে, না কে তাকে অপহরণ করতে পারে তার কোনো প্রমাণ বা হদিশ মিলেছে। তার ধারণা ছিল, কেউ জিন্নাহ্কে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে জয়ের ভেতরে এই খেয়াল কোনোভাবেই আসতে দিতে পারে না যে জিন্নাহ্ বেঁচে নেই। জয় উন্মাদ ও অন্ধ। তাকে বিশ্বাস করানো যাবে না জিন্নাহ্কে মুরসালীন মারেনি। মুস্তাকিন জয়ের ভেতরে এই ভয়টুকু রাখল যে সৈয়দ পরিবারে হামলা হলে জিন্নাহর জান যেতে পারে। যাতে মুস্তাকিনের পরিবার আপাতত সুরক্ষিত থাকে জয়ের কাছ থেকে।
মুস্তাকিন শেষ মুহুর্তে একবার মুরসালীনের সাথে দু-চারটে কথা বলার জন্য আর আম্মা ও মুমতাহিণাকে দেখার জন্য বড় ছটফট করেছিল।
জয়ের কাছে সেসব বেকার। সে কবে এইসব মায়ার সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে এসবের ঊর্ধ্বে চলে গিয়ে এক পিশাচ হয়ে বেঁচে আছে। যে জীবন্মৃত। তাকে মৃত্যু দেয়া সম্ভব নয়। কারণ সে জীবিতই নেই। জয়ের অতৃপ্ত রুহ্ মৃত্যুকে প্রদক্ষিণ করে কিছুদিনের সময় চেয়ে নিয়ে পিশাচ হিসেবে রক্তের নেশায় ফিরে আসা চলন্ত ধ্বংস।
ছেঁড়া-ছুটো মুরসালীনকেই জয় সারারাত ধরে পিটালো। ফাঁড়া খড়ির ধার কাঁটাযুক্ত চাবুকের চেয়ে ক্ষয়কারী। মুরসালীনের দেহের মাংস খড়ির সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে এলো। বেশ কয়েকবার রক্তবমি করে ফেলল। নাক ও কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ফজরের আজানের আগে জয় টের পায়, মুস্তাকিন শুধুই একটা ছেঁড়া দেহ। জয়ের কোনো কাজে সে লাগবে না। মুস্তাকিনকে চিৎ করে শুইয়ে প্রসস্থ শাবলের এক কোপে মুস্তাকিনের গলাটা আলাদা করে ফেলল দেহ থেকে। ঠিক আলাদা নয়, সামান্য একটু ঘাঁড়ের কাছে চামড়ার সাথে বেঁধে রইল। এক দলা রক্ত ফিনকি দিয়ে ছুটে এসে জয়ের বুক, মুখ, হার ভরিয়ে দেয়।
জয় সেই রক্তে ডুবে ধপ করে বসে মেঝেতে। চোখ দুটো বুজে বসে থাকে ওভাবেই মিনিট পাঁচেক।
শেষরাতে দোতলায় উঠে এসে গোসল করে বেশ কয়েকটা ড্রাগ শরীরে ইনজেক্ট করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে সে সাজায় মুরসালীনকে ধরার প্লান। মুরসালীনের পদক্ষেপ বড় বিচক্ষণ। জয় উপায় খুঁজে পায়, মুরসালীনকে ধরতে মুমতাহিণা একটা ভালো টোপ।
মুস্তাকিনদের মাদ্রাসায় যেসব রাজাকার ও জঙ্গি পয়দা হচ্ছে, তাদেরকে নিপাত ডাক এলো হামজার কাছে। জয়ের কাছে বিষয়টা খারাপ লাগল না। বাচ্চাদের জীবন খারাপ কাটাটাই নিয়ম। জয়ের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। আর জিন্নাহও তো পচে মরছে! সেও তো কিশোর।
○
অন্তূর শরীরটা প্রতি মুহুর্তে আরও বেশি দূর্বল হয়ে পড়ছে। সে বেশ কিছুক্ষণ পর শুধু জয়কে এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পারল, “আপনি মুস্তাকিন মহানকেও মেরে ফেললেন?ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “মেরে ফেললাম।ʼʼ
অন্তূ কত কিছু বলতে চায়, কিন্তু একটা ঢোকের সাথে সবটা গিলে নিয়ে শুধু আস্তে কোরে বলে, “তার কাছে তো জিন্নাহ নাও থাকতে পারে!ʼʼ
-“ছিল। কিন্তু পরে আর পাইনি। সামলে ফেলেছিল আমারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুমানোর জন্যে।ʼʼ
-“আর তারপর?ʼʼ
-“তারপর মুরসালীনকে খুঁজতে শুরু করলাম।ʼʼ
-“পলাশ কেন সাহায্য করেছিল এতে?ʼʼ
-“মুস্তাকিনকে মারার পর পলাশের গুদামে আগুন দিয়েছিল মুরসালীন।ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ চোখ বুজে বসে রইল। তার এই প্রতিক্রিয়াটা অদ্ভুত। সে এ নিয়ে আর কিছু বলল না। তার শরীরটা দূর্বল হয়ে পড়েছে। আজকাল নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা শরীরের। যখন-তখন সুস্থ-অসুস্থতার চক্র ঘুরতে থাকে।
জয় তার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ও জানা গল্পটুকু অন্তূকে বলে একটা মোটা চুরুট ধরালো। অশান্ত জয়কে খুব বেশি দেখা যায় না। সিগার টানা জয়টাই মূলত অশান্ত, অস্থির, বুকে ব্যথা চাপা জয়। অন্তূ টের পায় জয়ের ভেতরে এখন তোলপাড় চলছে। এই তোলপাড়ের নাম–হামজা। তোলপাড়ের নাম হিসেবে নামটা নতুন।
জয় সিগারের ধোয়া ছাড়ল নাক-মুখ ভরে। তাতেই অন্তূর নিস্তব্ধতা ভাঙে। ধোয়া নাকে যেতেই এক লাফে ছিটকে খাটের কিনারায় বসে বমি করে ফেলল। বমিতে শুধু পিচ্ছিল থুতু। অর্থাৎ সারাদিন কিচ্ছু খায়নি। ওড়নাটাকে মুড়ে মোটা করে নাকে চেপে ধরল অন্তূ। জয় প্রথমে বুঝল না, যখন বুঝল এক লাফে উঠে গিয়ে সিগার ফেলে এসে অন্তূকে চেপে ধরে, “ঘরওয়ালি! এইহ্! ঘরওয়ালি, আরমেইণ! ঠিক আছো তুমি? কী হইছে? এই মেয়ে! কী সমস্যা কী?ʼʼ
অন্তূ নাক-চোখ-মুখ চেপে ধরে বসে রইল। ইশারায় বোঝালো তার মাথা ঘুরছে, তেমন কিছু না।
জয়ের মুখটা শক্ত হলো, “শালির মেয়ে মার খাবি আমার হাতে? তোর কী হইছে? জণ্ডিস? খাস না, বমি করিস, চেহারার হাল বেহাল। আবার জিগাইলে কস কিছু হয় নাই। মরবি? আমারে না মাইরাই মরবি?ʼʼ
অন্তূ চোখ-মুখ ওড়নায় চেপে কাত হয়ে শুয়ে রইল চুপচাপ। জয় ঝুকে পড়ে আলতো হাতে ঝাকায়, “আরমিণ! ..ওই..ʼʼ
-“হু!ʼʼ
-“আমি সিগার ফেলে আসছি। আর নাই ধোঁয়া। তাকাও আমার দিকে। শোনো।ʼʼ
অন্তূ তাকায়। জয় দ্রুত গিয়ে রুমের দরজা-জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। এসি অফ করে ফ্যান দিলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজানো তার এক সারি পারফিউম থেকে একটা তুলে ঘরে স্প্রে করল। অন্তূ তবু নাক ছাড়ে না। তার যেকোনো গন্ধই অসহ্য লাগে।
জয় আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। পরনের শার্টের দুটো বোতাম খুলে গম্ভীর স্বরে বলল, “চলো!ʼʼ
-“কোথায়?ʼʼ
-“অসুস্থ তুমি। ডাক্তার দেখিয়ে আনি।ʼʼ
-“প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ
-“জোর করলে আবার বোলো না, আমার দোষ!ʼʼ
-“আপনার কোনো দোষ নেই। দোষ তো…ʼʼ
আচমকা কঠিন হয়ে উঠল জয়ের কণ্ঠস্বর, হাত ধরে চাপ দিয়ে বলল, “অসুস্থ দেখাচ্ছে, আরমিণ! ওঠ্!ʼʼ
অন্তূ ছিটকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “ছুঁবেন না আমাকে। বললাম না, কিছুই হয়নি আমার! আপনার সাথে কোথাও যাব না আমি।ʼʼ
কথাটা বলে অন্তূ চোখ অর্ধ খুলে জয়ের ভাবমূর্তি লক্ষ করে। কিন্তু জয় আশ্চর্যজনকভাবে কোনো আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অন্তূকে ভাবনায় ফেলে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরল ভাতের থালা নিয়ে। খাবার দেখে অন্তূর নাড়ি-ভূড়ি বোধহয় গলার কাছে উঠে এলো।
জয় খাবার মুখের কাছে আনতেই বালিশ তুলে মুখের ওপর রাখে অন্তূ। উঠে বসতে চায়। জয় অন্তূর হাত থেকে বালিশটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল একদিকে। বাহু চেপে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে পিঠের পেছনে বালিশ খাড়া করে দিয়ে অন্তূকে হেলান দিয়ে বসায়।
অন্তূ মুখ ফিরিয়ে বলে, “আমি খাব না। জোর করলে কিন্তু এই মুহুর্তে বের হয়ে যাব বাড়ি থেকে।ʼʼ
জয় শুধু ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার নষ্ট হাতদুটো যথেষ্ট শক্ত, আরমিণ। তোমার গায়ে তুলতে বাধ্য কোরো না। তোমার নরম শরীরে সইবে না।ʼʼ
-“মারবেন? মেরে ফেলুন না! আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন? কেউ সামান্য বিরোধিতা করলেও রেহাই নেই। শিখেছেন তো তা-ই।ʼʼ
জয় খাবার তুলে অন্তূর মুখের সামনে ধরে বলল, “তখন আসোনি কেন অন্যকিছু শেখাতে?ʼʼ
অন্তূ মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “সেই দায় আমার ছিল না।ʼʼ
-“এখন আর তাহলে নতুন করে সেই দায় টানার দরকার নাই। যা শেখার তো শিখেই গেছি। এখন আর কী করার! ধরো, হা করো।ʼʼ
-“এখন দায় দেখাই কারণ এখন আমি…ʼʼ অন্তূ থেমে জয়ের খাবারের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়।
জয় জিজ্ঞেস করে, “কী এখন তুমি? আমার ঘরওয়ালি?ʼʼ
-“এখন আপনি যা করছেন তা আমার উপস্থিতিতে। আমার আশপাশে। আবার যা করেছেন তাও আমাকে শুনতে হচ্ছে।ʼʼ
-“শুনতেছো ক্যান? কান বন্ধ রাখো। আমি তো শোনাইতে চাই নাই। তুমিই শোনার জন্য পেছনে পড়েছিলে!ʼʼ
-“সেটা কারণবশত!ʼʼ
জয় হাসল, “লাভ নেই। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার গল্প শোনার পর আমাকে নতুন করে বিচার করার সুযোগ পাবে, তাহলে আমি বলব—তুমি আমাকে যত জানবে চক্রবৃদ্ধি হারে শুধু পাপ পাবে। আমার জান নিতে অধৈর্য হবে আরও।ʼʼ
অন্তূ তাচ্ছিল্য করে হাসল, “আপনি কি আমাকে আপনার জান নিতে উৎসাহিত করছেন?ʼʼ
-“তোমার হাতদুটো সুন্দর। কোন এক বুজুর্গ বলেছিলেন, সুন্দর হাতের আঘাতে মরলে বেহেশত নসীব হবার সুযোগ থাকে। কোন শালির ছাওয়াল বলেছিল, জানি না।ʼʼ
-“রসিকতা করছেন?ʼʼ
জয় জিজ্ঞেস করল, “খাবে না?ʼʼ
-“খাব না। বমি পাচ্ছে। জুলুম করছেন আমার ওপর।ʼʼ
জয় হাত ধুয়ে ফেলল কেন যেন। অন্তূর মুখে উচ্চারিত ‘জুলুম’ কথাটার আছড় লাগল যেন।
অন্তূ বড় শান্ত কণ্ঠে বলল, “পাপ যথেষ্ট করেছেন। এবার ছাড়লেও পারেন। আমি আর কখনও বলব না আপনাকে একথা। আমি এবার চূড়ান্ত ক্লান্ত, জয় আমির।ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “তুমি আইছো আমার অন্ধকার অ-জীবনে। পাপ আর পূণ্যের মাঝে যেই সীমানা-প্রাচীরখানা থাকে, তার ওইপাশে আলো এইপাশে আন্ধার। আলোর ভিতরে বসবাস করা মানুষদের এইপাশে প্রবেশের অনুমতি নাই। তুমি সেই নিষেধ অমান্য করে, সীমা লঙ্ঘন করে এইপাশে পা রাখছো। দোষ কার?ʼʼ
-“সেই প্রাচীরখানা ভেঙে ফেলুন না! সেটাই তো বলছি। ওই প্রাচীরটার নাম–অনুতাপহীনতা। আত্মসমর্পণ করুন।তাহলেই তো এপাশের আলো ওপাশের অন্ধকারকে সরিয়ে আলোকিত করে তোলে। আলো গতি রুখে দেয়া যায় না। তা সামান্য পথ পেলেও অন্ধকারকে ধ্বংস করে।ʼʼ অন্তূ চোখ বুজে মাথাটা হেডবোর্ডে ঠেকায়।
জয় কেমন করে যেন হাসল, “এই প্রাচীর আমার মতোন পাপীরা নিজেদের বহুদিনের পাপ-সাধনার মাধ্যমে নিজ হাতে গড়ে তোলে, ঘরওয়ালি! তা চাইলেই ভাঙা সম্ভব হয় না। এই অন্ধকারের সাথে আমার রুহ্ অবধি জড়ানো। হয় রুহ্টা বের করে নাও, নয়ত আমাকে ছেড়ে দাও আমার পথে।ʼʼ
-“এখনও পথ ফুরায়নি? মানুষের ব্যথার অভিশাপ আর কত কামালে আপনি তৃপ্ত হবেন? আমি জানতে চাই।ʼʼ
জয় হেসে উঠল, “কেউ আমায় ‘পাপীʼ বলে ডাকলে আমার শান্তি লাগে। আমার রক্ত আর অনুপ্রেরণা খারাপ, ঘরওয়ালি। বড়বাবা বলতো, ‘পাপ যখন করবি, লোকে পাপী বললে দোষের কী? তবে পাপের চেয়ে বেশি বললে সেই পাপটুকু করে পূরণ করে দিবি। এই যা!ʼ বড়সাহেব বলে, ‘পাপীদেরকে পাপের পথে থামতে নেই। পরিণতি ভয়াবহ হয়।ʼ ʼʼ
অন্তূ কিছু বলতে যাচ্ছিল, জয় চট করে অন্তূর ঠোঁটে ডানহাতের তর্জনী চেপে ধরল, “গোসলও করো নাই। কী করছো সারাদিন?ʼʼ
অন্তূকে আবারও কোলে তুলে নিলো জয়। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “কী ছলনা পাকাচ্ছ, বলো তো ছলনাময়ী? আমি কি বুঝতে ভুল করছি আজকাল আমার ঘরের দুশমনকে?ʼʼ
অন্তূ চোখ কুঁচকে জয়ের শার্ট আঁকড়ে ধরে একটু। জয় থেমে গেল। ধুক ধুক করে উঠল তার হৃদযন্ত্রখানি। তাও টের পেল অন্তূ।
অন্তূকে বাথরুমের মেঝেতে বসিয়ে ঝরনা ছাড়ে জয়। রাত নয়টার এই গোসলে অন্তূর শরীরে পানি ঝরে পড়তেই দূর্বল শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। অন্তূ মস্তিষ্কে প্যানিক চড়ল। সেই মহা-গোসলের ক্ষণ তার মাথায় হামলা করল। অন্তূ সেদিন বাড়িতে গোসল করেছিল, এই জয় আমির তখন তাদেরই বাড়িতে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসা অন্তূকে খুন করতে। অন্তূ কি ভুলেছে তা?
জয় অন্তূর ওড়নাটা খুলে নেয়। পানিতে ভিজে অন্তূর দেহে কাপড় লেপ্টে গেছে। জয় তা এড়াতে চায়। তার চোখ যায় অন্তূর মুখে। অন্তূর চোখ বেয়ে যে নোনাজল ঝরছে তা ঝরনার পানি ধুয়ে নিয়ে বেয়ে যাচ্ছে অন্তূর শরীর বেয়ে। জয় ঢোকল গিলল।
অন্তূর সালোয়ার কামিজটা কম্পিত হাতে খুলতে যায় জয়। আবার থেমে আগে নিজের আধভেজা সাদা শার্টখানা খোলে। অন্তূর শরীরটা কাঁপছে। চোখদুটো বন্ধ। কাঁদছে অন্তূ। জয় অন্তূর শরীর থেকে কাপড় খুলে নিয়ে নিজের শার্টটা পেঁচিয়ে দিলো অন্তূর দেহে।
অন্তূর ভেজা থুতনিতে আঙুল নেড়ে জয় বলে, “তোমাকে হাসতে বা কাঁদতে তেমন দেখিনি আমি। হাসবে না জানি। কান্নাও চলবে। কাঁদো.ʼʼ
জয়কে কেউ ডেকে বলল, ‘আজকের পর তোর বউয়ের সৌন্দর্যের মামলা উঠলে বলে দিস, তোর বউয়ের সৌন্দর্যকে ম্লান করার সাধ্যি কান্নারও নেই। বরং কান্না সৌন্দর্য পায় তার চোখে এসে।ʼ
জয় মলিন হাসে। অন্তূকে গায়ে পানি ঢালে। অন্তূর শরীর ছুঁতে গেলে অন্তূ যেন এই জগতে ফেরে। আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠে, “আপনার ছোঁয়াকে বিষাক্তভাবে অনুভব করছি আমি।ʼʼ
জয় অন্তূর গলায় বডিওয়াশ মাখাতে মাখাতে ধীর আওয়াজে বলে, “তাহলে নিশ্চিত থাকো, তুমি জয় আমিরের ছোঁয়াই পাচ্ছ।ʼʼ
অন্তূ চোখদুটো আরও শক্ত করে বুজে বলল, “আমি কি আপনাকে বাঁধা দিতে পারি না এই মুহুর্তে?ʼʼ
-“পারো না।ʼʼ
-“আপনার মতো পাপী কেন আমাকে ছোঁয়ার বৈধতা পেলো জয় আমির?ʼʼ
-“প্রশ্নটা ঘুরিয়ে আমি তোমাকে করতে পারি —তোমার মতো নিষ্পাপ কেন আমার মতো পাপীর জন্য বৈধ হলো?ʼʼ
-“আমি নিষ্পাপ নই।ʼʼ
-“সে তো আমার ছোঁয়া লাগার পর।ʼʼ
অন্তূর শরীরটা জয় মুছিয়ে দিলো তোয়ালেতে। বুকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে তোয়ালেতে অন্তূর শরীরটা মুড়িয়ে আবারও পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়ে ওভাবেই ঝুঁকে রইল অন্তূর দিকে। অন্তূ নাক ও চোখ লাল। চোখদুটো বোজা। জয়ের ভেতরে পুরোনো একটা হিংসা জাগলো, তার তুলনায় অন্তূ অতিরিক্ত ফর্সা।
জয় আরেকটু ঝুঁকে অন্তূর কানের ভেজা লতিতে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলে, “আজ তোমার আসামীর নামের অভিযোগের খাতায় আরেকটা অভিযোগ লিখে নাও। সে তোমার অসুস্থতার ফায়দা লুটবে আজ। কিন্তু তুমি বাঁধা দিতে পারবে না। তুমি ঘেন্নায় কাঁদবে, কিন্তু সে তা গ্রাহ্য করবে না।ʼʼ
চলবে…
[নোট: আজকের পর্ব তেজস্মিতা লেখেনি। আর রিচেইক তো করেইনি। ভুলভাল রয়েছে, ক্ষমা করবেন। আর অনেককিছুই আমার মনমতো হয়নি। যা লিখতে চেয়েছিলাম, তেমন ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। আমার শেষের দিকটা মনমতো হয়নি। পরে এডিট মারব একটা। হাতের ব্যথায় আর সম্ভব না এখন।]