#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬৯. (প্রথমাংশ)
জয় আমির জন্মগ্রহণ করল দেশের এক উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে। ১৯৮৭ সন। বাংলাদেশে সামরিক শাসন চলছে। উত্তাল দেশের অবস্থা। তখন সকল বিরোধী দল পারস্পারিক সংঘাত একপাশে রেখে স্বৈরাচার পতনের লক্ষ্যে হাতে হাত রেখেছে।
জাভেদ আমির ধীরে ধীরে আবারও রাজনীতিতে ফিরলেন ঠিকই। কিন্তু এবার তার দৃষ্টিকোণ ও মনোভাব বোঝা বড় দায়।
১৯৯০ এর শেষে স্বৈরাচারের পতন হলো।
জয়কে স্কুলে ভর্তি করা হলো চার বছর বয়সে। তার জিদেই। সে দেখেছে সকলে স্কুলে যায়। তারও যাওয়া দরকার। বাড়িতে দুটো মহিলা রাখা আছে জয়ের যত্নের জন্য। তাদেরকে সহ্য করা যাচ্ছে না। একটার বয়স কম। বিশ-বাইশ বছর হবে। খুব নজরে, যত্নে রাখে। অত যত্ন-আত্তি বড়লোকপনায় বিরক্ত সে। তার মাথায় ফুলদানী দিয়ে মেরে জখম করে দিয়েছে সে। তার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। তবু মেয়েটার লজ্জা নেই, আবার আসে জয়ের দেখাশোনা করতে। জয় তাই আরও বিতৃষ্ণ মেয়েটার ওপর।
জাভেদ আমিরের সাথে ঝামেলা তার। সে রোজ স্কুল থেকে বড়বাবা কাছে যায়। বাপের ছোটভাইকে সে ডাকে বড়বাবা। এটার কারণ আছে। বাবা শাসন করে। তার বাবাকে ভালো লাগে না। বাবার চেয়েও বেশি আপন ও বড় তার চাচা। তাই জয়নাল আমির তার বড়বাবা। এত চতুর সে কোত্থেকে হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে হুমায়িরার।
জয়নাল আমির নিতে আসেন স্কুলের গেইটে। চাকরেরা ভয়ে সরে আসে, বাঁধা দিতে পারে না জয়নাল আমিরকে। জাভেদ একবার জিজ্ঞেস করলেন, “এই বেয়াদব! জয়নালের সাথে গেছিলি?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
দৌড়ে গিয়ে দাদুর কোলে চড়ে বলল, “আমার ভালো লাগে। তুমি আর নিষেধ করবে না। আমি যাবই।ʼʼ
তবু জাভেদ দুটো থাপ্পর মারলেন। খুব জোরে নয় তবে লাগল। কিন্তু জয়ের মুখ দেখে মনে হলো না, তার কিছু হয়েছে। পরেরদিন সে সন্ধ্যার পর ফিরল চাচার কাছ থেকে। আগে বিকেলে ফিরতো।
বাবা থাকলে তার বন্ধুদের আড্ডা মিস যায়। আমির বাড়ির ফটকের সামনে এসে তাকে ডাকার সাহস কারও নেই। তা মনেহয় একমাত্র বাবার জন্যই। দারোয়ানটা চরম খিটখিটে। একবার তাকে অবশ্য কুকুরের দৌড়ানি খাইয়েছিল সে। পুকুরে গোসল করার উপায় নেই। তাছাড়া তার কিছু অবলা শাগরেদ আছে। গোয়ালের গরুগুলো, ফটকের বাইরে বসে ঝিমানো কুকুরেরা, বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় বাচ্চা তোলা বিড়াল, কবুতর। এগুলোর পরিচর্যা করতে পারা যায় না বাবার জন্য। আরও আছে তার বাজিগর। বাজিগরগুলো দিয়েছে বড়বাবা। ছয়টা থেকে নয়টা হয়েছে ওরা। একটার জোড়া নেই। সে নাড়তে চাড়তে গিয়ে ডিম নষ্ট করে ফেলেছিল। সে কি কান্না! তার দোষ নাকি দাদুর। কারণ দাদু মাত্র চারবার ডিম নাড়তে নিষেধ করেছে। এর বেশি বলেনি। বাবার হাত থেকে ওগুলোকে বাঁচিয়ে রাখারও চাপ আছে। বাবা সুযোগ পেলেই বড়বাবার দেওয়া পাখিদের উড়িয়ে দেবে। কম চাপে থাকে না সে। বড় ব্যস্ত মানুষ।
এমন বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা জয়ের দ্বারা সম্ভব না।
হুমায়িরার কাছে একবার বিচার এলো, ক্লাসের চারটে ছেলেকে মেরে জখম করে দিয়ে এসেছে। কারণ, ওরা তাকে রাজাকারের ভাতিজা বলেছে। সে তখন টু-তে। সে ক্লাসে দল গঠন করেছে। একদল যারা জয়কে রাজাকারের ভাতিজা বলে না, দেশোদ্রোহীর ছেলে বলে না। আরেকদল যারা বলতে চায় কিন্তু এখন ভয়ে বলতে পারে না। তারা হলো জয়ের বিরোধী দল।
দাদুর সাথে খাতির তার ভালোই। কিন্তু রাগ হয় যখন দাদুর কাছে বন্দুক চালানো শিখতে চাইলে শেখায় না। দাদুর লাঠি লুকিয়ে সে সপ্তাখানেক ভুগিয়েছে দাদুকে। তাতে জলিল আমির আরও ক্ষেপেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, জয়কে আর কোনোভাবেই তিনি ভালোবাসবেন না। কিন্তু জয়ের তো ভালোবাসা লাগে না।
সে এমন সব কাজ করবে যাতে দাদুর পক্ষে তাকে ভালোবাসা সত্যিই কঠিন হয়। সে দাদুর সংবাদপত্র ছিঁড়ে কুটিকুটি করে রাখে। পান খায় দাদু। সে চুনের ভেতর পানি ঢেলে টলটলে বানিয়ে রাখে। নামাজে যাওয়ার সময় টুপি নিয়ে খেলতে চলে যায়। একবার দাদুর জন্য বেড়ে রাখা তরকারীতে মরিচের গুড়ো মিশিয়ে নেড়েচেড়ে রেখে দিয়েছিল। হুমায়িরা তাকে ঝাল খেতে দেন না। কিন্তু সে জানে মরিচের গুড়ো ঝাল। তা খেয়ে দাদুর অবস্থা খারাপ। পানি খেয়ে শান্ত হলে সে আস্তে কোরে গিয়ে দাদুর সামনে গিয়ে হাত পেছমোড়া করে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মিশিয়েছি তোমার খাবারে ঝাল। বলো, আর কোনোদিন ভালো বাসবে না বলে হুমকি দেবে? চুপচাপ ভালো না বাসবে। বুঝলে?ʼʼ
এরকম বিরোধীতা চলল কিছুদিন। দাদু একদিন এসে খুব চোটপাট করলেন। জয় একটা কথাও অস্বীকার করেনি। সব স্বীকার করেছে। এমনকি যা অপরাধ করেনি তাও।
বড়বাবা বলেন, “লোকের কাছে ভালো হবার চেষ্টা করার দরকার নেই। মানুষ ভালোদের দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টায় মত্ত থাকে কেবল। একই কাজ খারাপ হিসেবে পরিচিত লোকেরা করলে ঠিক আছে। কিন্তু ভালো মানুষ হিসেবে তা তুই করেছিস এটা প্রমাণ হলে তারা তোকে আর বাঁচতে দেবে না।
খারাপ হিসেবে পরিচিতদের স্বাধীনতা বেশি। তারা যা খুশি করতে পারে। তুই যা খারাপ করছিস সেটাও তোর, আর নিজের কৃতকর্ম হোক ভালো বা খারাপ তা অস্বীকার করাটা ছোটলোকি। তুই খারাপ এটা তোর স্বীকার করার সাহস না থাকলে তুই কাপুরুষ। কারণ ওটা তোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তুই যখন কারও কাছে ভালো সাজতে নাটক করবি বা কারও মনমতো চলবি, ব্যাপারটা অনেকটা এমন হলো না যে তুই তার কাছে দায়বদ্ধ! তোর কোনো নিজস্বতা নেই।
ভালো সাজতে চায় ভন্ডরা, ভীতুরা, খাতির পাওয়ার লোভীরা। আর এটাই দায়বদ্ধতা, দূর্বলতা, একপ্রকার বাধ্যতা। যেন কেউ তোকে খারাপ ভাবলে তোর যায় আসে। কখনও কারও কাছে ভালো হবার জন্য কোনোরকম সামান্য চেষ্টাও করবি না। কেউ তোর নিজস্বতাকে মেনে নিয়ে থাকলে আছে, নয়ত তোর কাউকে দরকার নেই নিজেকে ছাড়া!ʼʼ
জয় মনোযোগ দিয়ে শোনে। কিছু কথা বোঝে, আর যা বোঝে না তাও মনে রাখার চেষ্টা করে। সে টের পায়, চাচার চিন্তা-ধারার সবই তার ছোট্ট মস্তিষ্কের চিন্তাধারার সাথে প্রায়-ই মিলে যায়। বাবা তাকে হাজার মানা করলেও সে চাচার কাছে যাবেই।
দাদু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এসব কেন করেছিস?ʼʼ
সে মুখ গোমড়া করে বলল, “তুমি তো বললে ভালোবাসবে না। কিন্তু আমি তেমন কিছু করিইনি আগে। এখন করছি। যাতে ভালো না বাসার কারণ থাকে। অকারণে ভালোবাসবে না কেন?ʼʼ
ক্লাস থ্রি-তে তার একটা গৃহশিক্ষক রাখা হলো। মাস্টার আসার আগে সে যায় ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়তে। হামজা এসে সেদিন এক ঝুড়ি আম দিয়ে গেছে। কিন্তু চুরি করা আমের স্বাদই আলাদা।
জাভেদ ব্যবসার কাজে প্রায়-ই ঢাকা-চট্রগ্রাম থাকেন। তখন বিচার আসে জলিল আমিরের কাছে। হুমায়িরাকে ধরে মহিলারা বলে জয়ের কুকীর্তির কথা। সেদিন আম পাড়তে গেছে মন্ডলদের বাগানে। মন্ডল বাড়ির ছেলেরা এসে বাঁধা দিচ্ছিল। বড়দের ডেকে আনার হুমকি দিচ্ছিল।
আম না পড়ে যে ডাল-পাতা ভেঙে পড়েছে, তা-ই তুলে বেদম মেরেছে ওদের। ওদের অপরাধ, নিজেরা কোনো একশন না নিয়ে বড়দের ডাকার মতো এমন ছোটলোকি হুমকি ওরা কেন দিলো? যা করবে ওরা করবে। কাপুরুষের মতো বড়দের ডাকতে চেয়ে ওরা জয়ের মারামারির মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছে। যুদ্ধে-বিগ্রহ হবে সমান সমানে। তারপর দেখা যাবে কে জেতে।
মাস্টার এসে বসে আছেন আধঘন্টা। জলিল আমির দু’বার খড়ি নিয়ে খুঁজে এসেছেন। পাননি খুঁজে ওকে। পাবার কথা নয়। সে বাগানের ওপারে ভাঙা গোয়ালের কোণায় সভায় ব্যস্ত। ও পাড়ার কয়েকটা পুঁচকে জয়ের নামে নালিশ করেছে। জাভেদ আমির এলে ওদের বাবা-মা আসবে বিচার নিয়ে। এটা হতে দেয়া যায় না। ওদেরকে শাসাতে হবে। যাতে বাবা-মাকে গিয়ে বলে, জয় ভালো না। তবে ওদের কিছু করেনি। বিচার দেওয়া ক্যান্সেল।
শেষমেষ অধৈর্য হয়ে মাস্টার গেলেন খুঁজতে। খুব বিনয়ের সাথে বললেন, “জয়! বাবা। আসো পড়বে। পরে এসে খেলবে। আসো।ʼʼ
জয় বিরক্তিতে চোখে-মুখ খিঁচে তাকাল। উঠল না সভা ছেড়ে। মাস্টারকে বলল, “এখন ব্যস্ত আছি। বসেন ঘরে গিয়ে। পরে আসতেছি।ʼʼ
মাস্টার হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন।
-“কী হলো? যান! জরুরী কাজে আছি। আপনে কি এখন দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের আলাপ শুনবেন?ʼʼ
মাস্টার রেগেমেগে একাকার। তবু চুপচাপ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভেতরবাড়িতে ঢুকে হুমায়িরাকে বললেন, “আপনার ছেলেকে আর পাড়ার ছেলেদের সাথে মিশতে দেবেন না। ওর মুখের ভাষার শুদ্ধতা হারিয়ে যাচ্ছে।ʼʼ
হুমায়িরা রাতে শাসন করলেন। তারপর দিন মাস্টারকে আধঘন্টা বসিয়ে রেখে পরে এসে পড়তে বসল। পড়ার দশ মিনিট না-ই যেতে উঠে পড়ে বলল, “আর পড়ব না আজ। আপনে যান। আমার কাজ আছে।ʼʼ
হনহন করে বেরিয়ে চলে গেল।
সেই রাগটুকু মাস্টার চাপা রাখলেন। পরেরদিন পড়ার সময় মাস্টার পড়াচ্ছেন, সে কাগজ দিয়ে নৌকা, বাঁশি, ব্যাঙ ইত্যাদি বানাচ্ছে। মাস্টারের ধৈর্যচ্যূত হবার পর্যায়ে। তারপর তিন চারবার উঠে গিয়ে পানি খেয়ে এলো। টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঝিমোতে লাগল। শেষমেষ মাস্টার স্কেল দিয়ে মারলেন দুটো ঠাস ঠাস করে।
জয় কাঁদতে কাঁদতে হুমায়িরার কাছে ছুটল। মাস্টারে কাছে সে আর পড়বে না। মাস্টার মারে। সে কি কান্না তার! সে সময় হামজা এলো। হুমায়িরা কান মলে ধরলেন, “এবার বল, মাস্টার কেন মেরেছে তোকে? বাদর ছেলে!ʼʼ
-“মাস্টার ভালো না।ʼʼ
জয় কাঁদছে। তার বানোয়াট কান্না দেখে হাসি পাচ্ছে হামজার।
-“তুই কিছু করিসনি?ʼʼ
-“না।ʼʼ
জয় জীবনে কাঁদে। কাঁদলে তা সত্যি, এটা না মানার উপায় পেলেন না হুমায়িরা। জলিল আমির রাজপুত্রের মতোন পালছেন নাতিকে। তবু হুমায়িরা বললেন, “সেদিন মাস্টার নালিশ করেছিল বলে বাদ দেওয়ালি?ʼʼ
কিন্তু সে তো তারপরেও দু’দিন পড়েছে।
কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো। এবং এটা করার জন্যই সে তারপরেও দু’দিন পড়েছে মাস্টারের কাছে। কিন্তু মাস্টারকে বাদ দেওয়ানোর একটা ছুঁতো দরকার বিধায় দুটো দিন খুব জ্বালাতন করে মার আদায় করেছে মাস্টারের কাছে।
হামজাকে দেখে শান্ত হলেন হুমায়িরা। সবার খোঁজ-খবর নিলেন। শাহানা ভাবী তেলের পিঠা বানিয়ে দিয়েছে হামজার কাছে। হুমায়িরার শরীরটা ভালো না। গর্ভাবস্থার চারমাস চলছে। কাজের মেয়ে দুটো গেছে গ্রামে। জয় সারাদিন বাদরামি করে বেড়ায়, তাকে সামলানো চার মজুরের কাজের সমান।
বিকেল পর্যন্ত রইল হামজা। ফুপু যতক্ষণ রান্না করল, সে দাঁড়িয়ে রইল ফুপুর পাশে। হামজার ছিপছিপে শুকনো শরীর, পরনের লুঙ্গি আর ফতোয়াটা ময়লা। মুখটা শুকনো। নরম চালচলন। মুখে স্মিত হাসি, তবে মলিন। বয়স চৌদ্দ। এই বয়সেই লম্বা হয়ে গেছে দেখার মতো।
জয় হামজাকে পেলে সব ভুলে যায়। জয়ের স্বাস্থচেহারা একদম আমির পরিবারের সবার মতোই অভিজাত হয়েছে। খালি স্বভাবটা দিনদিন বখাটের মতো হচ্ছে সঙ্গদোষে।
হুমায়িরা হামজাকে রেঁধে খাওয়ালেন, ও বাড়ির খবর শুনলেন। আজ ক’দিন হুমায়ুন পাটোয়ারী বাড়িতে নেই। সংসারের দায় তার নয়। হামজা, তুলি, শাহানা ভেসে গেলেও সে দায় তার নয়। সে দেশে-বিদেশে ঘুরছে, মহিলাদের বিয়ের প্রলভন দিয়ে তাদের ভোগের অপরাধে কত এলাকা থেকে মার খেয়েও ফিরেছে।
হামজা ক্লাস এইটে। বাসায় চাল নেই। হামজার স্কুলের বেতন দেয়া হয় না আজ চারমাস। মাস্টার বেতন না নিয়ে স্কুলে যেতে মানা করে দিয়েছে।
হুমায়িরা কিছু কাঁচা তরকারী, চাউল, পোশাক আর কিছু টাকা বের করে হামজার হাতে দিলেন। বাড়িতে লোক নেই। ছুটিতে গেছে কাজের লোকেরা। জয়কে সাথে নিয়ে হামজাকে এগিয়ে দিয়ে এলেন অনেকটা দূর। হামজা পায়ে পড়তে যায়, “ফুপু, তোর পায়ে লাগি। আমি একাই চলে যাব। আমার কিচ্ছু হবে না। তোর পেটে আমার ছোট বোন। এই রাইতে বাইরে বাইর হইলে যদি বোনুর কিছু হয়, তোর খবর আছে। বাইর হস না ফুপু আম্মা।ʼʼ
হুমায়িরা শুনলেন না, “অন্ধকারে একা ছাড়ব? কেউ যদি টাকাটা কেড়ে নেয়?ʼʼ
-“তুই কি বাড়ি পর্যন্ত যাবি? তখনও তো নিতে পারে।
-“তবু আমার সান্ত্বণা থাকবে। চল।ʼʼ
জলিল আমির লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ফটকের কাছে পুত্রবধুর অপেক্ষায়।
হামজা ফুপুর ডান হাতখানা ছাড়ল না যতক্ষণ হাঁটল। জয় মায়ের হাত ছেড়ে ছুটে এসে হামজার হাত চেপে ধরে তিড়িং-বিড়িং ছুটছে।
দু’দিন পর জাভেদ ফিরলেন। ক্লান্ত চেহারা। হুমায়িরা দেখেই দেখে বুঝে ফেললেন, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু জাভেদ বড় চাপা মানুষ। রাজধানী থেকে ফিরেছেন, তা কেবল বুঝলেন জলিল আমির।
আমির নিবাসে লোকজন কম। ফটকের দারোয়ান মনসুর মিয়া, বাগানের মালী মন্টু, আর দুজন আছে বাংলো ঘরে বিপদ-আপদের জন্য।
জলিল আমিরের অভ্যাস সদর ঘরে আরাম কেদারায় দুলতে দুলতে ঘুমানো। লাঠিটা কেদারার সাথে হেলান দিয়ে রাখা। বুকের ওপর বই, চোখে চশমা আছেই। নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন।
মনসুর মিয়ার চাকরিটা সুখের। সারারাত সে ঘুমায় ফটকের ধারের চেয়ারটায় বসে। বাড়ির কর্তা জলিল সাহেব জানেন, ঝারিও মারেন, এমনকি কয়েকবার লাঠি নিয়ে তেড়েছেনও, কিন্তু চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেন না। মনসুর মিয়া নিশ্চিত ছাড়াবেনও না।
মাঝরাত। কয়টা, মনসুর জানে না। কেউ ডাকছে মনসুর মিয়াকে। খুব করুণ সুরে। তার খুব বিপদ। বাড়ির কর্তার কড়া হুকুম, “যত রাত হোক আর যা-ই হোক, কেউ সাহায্য চাইলে ফটক যদি না খুলিস, তোর চাকরি কইলাম শ্যাষ রে, মনসুর।ʼʼ
মনসুর দ্বিধায় ভুগল, তার ভয় করছে। তবু খুলল। কোনো অসহায় লোক না তারা। একজনও না। আট-দশজন। মুখে কালো কাপড় বাঁধা। চোখটা খুব সামান্য দেখা যাচ্ছে। ঘন্টাখানেক আগে আমির বাড়ির দোতলার বাতি নিভেছে।একঘন্টা পর এরা কী করতে এসেছে?
মনসুর মন্টু আর বাংলো ঘরের দুজনকে ডাকল। তারা উঠে এসে দাঁড়িয়ে রইল। মনসুরকে জবাই করা হলো। তারা খুব নরম মনের। তাই মুখ ফিরিয়ে রাখল। দেখল না দৃশ্যটা, বরং ফটকটা ভেতর থেকে ভালোভাবে আঁটকে এলো।
পথ দেখিয়ে দিলো। সদর দরজার নকল চাবিও তাদের কাছেই। দুর্বৃত্তদের হাতে চাবি তুলে দিয়ে তাদের কাজ শেষ। তারা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।
জলিল আমির সেদিন খুঁড়াতে খুঁড়াতে গিয়ে নিজের বন্দুকটা তুলে নিয়েছিলেন ঠিকই, তবে গুলি চালাতে পারেননি। তাঁর বুকের ওপর চড়ে বসে তাকে যখন জবাই করা হচ্ছিল, কেবল উনার গলা দিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজ আসছিল। তিনি শেষবার কালিমা শাহাদত পড়লেন। শেষ করতে পারলেন না অবশ্য, জবান বন্ধ হয়ে গেল।
জাভেদ আমির আব্বার ডাকে নিচে নেমে আসার আগে যে বন্দুক নিতে গেলেন দোতলার বড় বারান্দার ওপারে, ততক্ষণে কিন্তু দুর্বৃত্তরা শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে।
জাভেদ আমিরের গুলিতে চারজন পড়ে গেল। তখনও নয়জন আমির নিবাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জীবিত নয়জনের মাঝে কিন্তু জলিল আমিরের পালিত দুজনসহ মন্টুও আছে।
জাভেদ আমির মনোবল হারিয়ে ফেললেন কেমন যেন। তবু বিশ্বাসঘাতকদের বুকে গুলি চালাতে তার হাত কাঁপতে শেখেনি একজনের ঠ্যাঙয়ে শেষ গুলিটা করতে পেরেছিলেন উনি। উনাকে চারজন মিলে ধরে ছেঁচড়ে নিয়ে শোবার ঘরে হুমায়িরা আর জয়ের সামনে উপস্থিত করা হলো।
ছোট্ট জয় আমির ছোট্ট হাতে তার ছোট্ট সঙ্গীদের খুব মারে। সেদিন তার ঠাঁয় হয়েছিল মায়ে পিঠপিছে। সে বাবার পেছনে ছুটে গিয়ে সদর ঘরে দাদুর মাথা ছাড়া দেহটা দেখেছে। মাথাটা দেহর সাথে নেই দাদুর। তার পা নড়ছিল না, তবু সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে ঠিকই মায়ের কাছে। অবশ্য সিঁড়ি বইতে গিয়ে কয়েকবার পড়ে গিয়ে চামড়া-মাঃস ছিলে গেছে শরীরের কয়েক জায়গার! রক্ত ঝরছে, জ্বলছেও। কিন্তু তার বুক ভেঙে কান্না আসছে। দাদুর মাথাটা কোথায়? দাদু কি তাকে কাল সকালে বাগানের ভেতর লাঠি নিয়ে তাড়বে না? বলবে না, “শোন জয়! যতবড় বিপদই সামনে এসে দাঁড়াক, কেবল আল্লাহকে ডাকবি।ʼʼ
জয়ের প্রশ্ন, “আল্লাহ কে?ʼʼ
-“আমাদেরকে যিনি বানিয়েছেন।ʼʼ
-“সে আমাদের রক্ষা করবে?ʼʼ
-“সব অবস্থায়। ধর, বারবার ডাকছিস তবু তোর বিপদ উদ্ধার হচ্ছে না, তবু বিশ্বাস হারাবি না। তাহলে কাফের হয়ে যাবি!ʼʼ
-“কাফের কী?ʼʼ
-“খারাপ।ʼʼ
-“বড়বাবা বলেছে, খারাপ হওয়াটা খারাপ না।ʼʼ
-“চুপ। ওই কুলাঙ্গারের কথা বলবি না।ʼʼ
হুমায়িরা নামাজ পড়লে সে গিয়ে জ্বালাতন করে। ঘাঁড়ে উঠে বসে, সামনে গিয়ে জায়নামাজের ওপর বাবু মেরে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেটকিয়ে হাসে। তখন নামাজ শেষে হুমায়িরা বলতেন, “এমন করতে নেই, আব্বা। আল্লাহ নারাজ হয়।ʼʼ
-“আল্লাহ নারাজ হলে কী?ʼʼ
-“ছিঃ। এসব বলতে নেই। আল্লাহ আমাদের রক্ষাকর্তা আব্বা। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়।ʼʼ
জয় আজ মায়ের পেছনে লুকিয়ে মনে মনে ডাকছে আল্লাহকে, “আল্লাহ! রক্ষা করেন আল্লাহ।ʼʼ
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। রিচেইক করিনি।]