অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৪২.

0
54

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৪২.

পুলিশের দুজন লোক এসে বাড়ির সকলের হাতের ছাপ নিলো। গেস্টদের হাতের ছাপও আজকের মধ্যে কালেক্ট করা হবে। ইন্সপেক্টর আজিজ চলে যেতেই নিচ্ছিলেন; হঠাৎই জ্যোতি বলে উঠল, ‘ওখানে রাখা একটা ছু-রি দিয়ে কিন্তু আমি ফল কে-টেছিলাম। এটাই যদি সেই ছু-রি হয় তবে আমার হাতের ছাপও পাওয়া যাবে। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। দুজন মহিলার সামনেই কে-টেছিলাম আমি।’

আজিজ ঘুরে তাকালেন জ্যোতির দিকে। মৃদু হেসে বললেন, ‘তার দরকার হবেনা হয়তো।’

দুপুরবেলা আমের ভিলার পরিবেশটা পুনরার গমগমে হয়ে উঠল। বিয়ের অনুষ্ঠান রাশেদ আমের করেছেন। তাই আলাদা করে কোন রিসিপশনের আয়োজন করা হয়নি। তবে বাড়ির সব সার্ভেন্ট, আমের ফাউন্ডেশনের কর্মচারীদের এবং কাছের কিছু ক্লাইন্ট এবং বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই বিয়েটা নিয়ে আমের ভিলার কর্মচারী থেকে শুরু করে গার্ড সকলেই খুব খুশি। রুদ্রকে ওরা সকলেই ভীষণ ভয় পায়, কিন্তু তারসাথে প্রচন্ড ভালোও বাসে। সকলেই মনে মনে চাইতো তাদের গম্ভীর, রাগী ছোট সাহেব একটা মিষ্টি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসুক। গম্ভীর আমের ভিলার নিস্তব্ধতা, সেই মেয়ে নিজের মিষ্টি গুঞ্জনে মুখরিত করে তুলুক। এতোদিনের আশা অবশেষে পূরণ হলো। প্রিয়তাকেও মনে ধরেছে সকলের। সুন্দরী, দেখতেও যথেষ্ট শান্ত, মিষ্টি। মুগ্ধ করা নম্র, কোমল তার কথা চলন, আচরণ। অপছন্দ করার কোন কারণ নেই। বরং রুদ্র-প্রিয়তাকে রাজযোটক ঘোষণা করে দিয়েছে অনেকে। নার্গিস বেগম তো প্রিয়তার থুতনি ধরে বলেই ফেলেছে, ‘ আগেতো ভেবেছিলাম ছোটবাবার জন্যে জ্যোতি মেডামের চাইতে সুন্দরী মেয়ে পাবোই না। কিন্তু নতুন বউতো ওকেও ছাপিয়ে গেলোগো। একদম রাজা-রাণীর জুটি।’

কথাটা পছন্দ হয়নি প্রিয়তার। তুলনা জিনিসটা পছন্দ না ওর। তাছাড়া জ্যোতিও উপস্থিত ছিল সেখানে। কোন আক্কেলে মহিলা এমন কথা বলল সেটাই বুঝল না প্রিয়তা। নববধূ বলেই চুপ থাকল। শক্ত হয়ে বসে থাকল মাথা নিচু করে। মাথা তবে জ্যোতির মুখ কালো করে বেরিয়ে যাওয়া দেখে খারাপ লেগেছে ওর। বোধ হয় কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।

আমের ভিলার ছাদে সকলের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রিয়তাকে নিজের হাতে রান্না করতে হয়েছে সবার জন্যে। যদিও ওকে সাহায্য করার জন্যে জ্যোতি, নার্গিস, আরও মেইডরা ছিল। তবুও এতো মানুষের রান্না করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে বেচারি। অপরদিকে রুদ্রও সকাল থেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। এতসব ব্যস্ততার মাঝে রুদ্র আর প্রিয়তার দেখা হয়নি একবারও।

ছাদে গিয়ে খাওয়ার জায়গায় নীরবকে দেখতে পেয়ে থমকে হল কুহু। বোকার মতো তাকিয়ে রইল সেদিকে। নীরবের চোখ কুহুর ওপর পড়তেই ভুবন ভোলানো এক হাসি দিল। ভ্রু কোঁচকালো কুহু। নিরব ভ্রু নাচাল। কুহুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিজের ফোনটা তুলে দেখাল ওকে। কুহুও দ্রুত নিজের ফোন বের করল। নীরব মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘অবাক হয়েছো?’

কুহু একবার দূরে বসে থাকা নীরবের দিকে তাকিয়ে দ্রুত লিখল, ‘আপনি এখানে কীকরে?’

‘ বিয়েতেও এসেছিলাম। তুমি খেয়াল করোনি। থাকিনি বেশিক্ষণ। তোমার বাবার সাথে আমার বাবার আলাপ আছে। ব্যবসা সূত্রে। আমিও আগে জানতাম না। কালই জেনেছি। আজও আমাদের ডেকেছে তোমার বাবা। তাই আসা।’

মেসেজটা পড়ে বোকা দৃষ্টিতে নীরবের দিকে কুহু। নীরব হাত দিয়ে ফোনের মতো বানিয়ে কানে ধরল। ঘাড় কাত করে মৃদু হাসল। অর্থাৎ রাতে কথা হবে।

উচ্ছ্বাস রুদ্রর সঙ্গে ব্যস্ত থাকলেও বারবার তাকাচ্ছিল চারপাশে। আশা করেছিল আজও হয়তো নাজিফার দেখা পাবে। কিন্তু নাজিফার বাবার দেখা পেলেও নাজিফার দেখা পায়নি বেচারা। অবশেষে হতাশ হয়েই কাজে মন দিতে হয়েছে তাকে।

যেহেতু গতকাল বাসর হয়নি, তাই আজকেই রুদ্র-প্রিয়তার বাসরের আয়োজন করা হলো। জ্যোতি, কুহু, মীরা তিনজন মিলে খুব সময় নিয়ে সাজাল রুদ্রর ঘর। প্রিয়তাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে জ্যোতি। সাজানোর সময় কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিল জ্যোতি। প্রিয়তার শরীরের প্রতিটা অঙ্গের ওপর হিংসে হচ্ছিলো ওর। প্রিয়তার প্রতিটা অঙ্গকে যখন ও সাজাচ্ছিল। মন-মস্তিষ্কে বারবার আঘাত করছিল, আজ এই অঙ্গগুলোকে গভীর ভালোবাসার স্পর্শে শিহরিত করবে রুদ্র। এই সজ্জা, এই সৌন্দর্যের প্রতিটা অংশকে উপভোগ করবে। সম্পূর্ণভাবেই রুদ্র আমেরকে পাবে প্রিয়তা। সম্পূর্ণভাবে। কথাগুলো চিন্তা করতেই বুকের ভেতরটা জ্ব-লে জ্যোতির। চোখ ফেঁটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে ঢোক গিলছে বারবার বারবার। জ্যোতির দৃষ্টিতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো প্রিয়তার। ওর ছলছলে চোখদুটো সেই অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কেবল দেখছিল জ্যোতিকে।

রাত এগারোটার দিকে ওপরে এলো রুদ্র। সারাদিন বেশ ব্যস্ত ছিল। প্রিয়তার সঙ্গে দু একবার দেখা হলেও কথা বলার সুযোগ হয়নি। উচ্ছ্বাস আর রঞ্জুকে বাকি কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তবেই ওপরে এলো রুদ্র। করিডর ধরে এগোতেই সামনে পড়ল জ্যোতি। দুজনেই থেমে গেল। জ্যোতি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। জ্যোতিকে দেখলে ইদানিং খানিকটা অস্বস্তি হয় রুদ্রর। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত শূণ্য সে দৃষ্টি।
জ্যোতি রিক্ত চোখে চেয়ে রইল রুদ্রের যাওয়ার দিকে। হঠাৎ জ্বালা করে উঠল চোখদুটো। পুনরায় নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে যেন কেউ পাথর ঠেসে ধরেছে। কষ্ট হচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। কেন এমন একজনকে ভালোবাসলো যে ওর ভাগ্যেই ছিলোনা। প্রণয়ের এই তীব্র দহন কেন ওর ভাগ্যেই লেখা ছিল? এই চাপা যন্ত্রণা, নীরব চিৎকার, ছটফটানী ও কাকে দেখাবে? কাকে বোঝাবে?
জ্যোতি আপনমনে ভাবল, একসময় কী বলেছিল রুদ্র? তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে নাকি ঐসব মেয়েদের মতোই আসতে হবে। বৈধভাবে নাকি কখনও রুদ্রের সান্নিধ্য পাওয়া যাবেনা। তাহলে আজকে কেন নিজের কথার খেলাপ করতে চলেছে সে। প্রিয়তাকে তো সে বৈধ অধিকার দিতে চলেছে। রাশেদ বাবাও তো জ্যোতির মন বোঝেনি। কিংবা বুঝে থাকলেও গুরুত্ব দেয়নি জ্যোতির অনুভূতিকে। নিজের ছেলের পছন্দকেই গুরুত্ব দিয়েছে। সবাই স্বার্থপর। তাহলে ও কেন নিঃস্বার্থ হবে?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে সোজা নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল জ্যোতি। কোন কথা বলল না কুহুর সঙ্গে। উল্টো দিকে ফিরে রইল। কুহু বুঝেও চুপ থাকল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। কুহুও চেয়েছিল রুদ্রর ঘরোনী জ্যোতিই হোক। প্রিয়তাকে মন থেকে মেনে নিয়েছে ও। মেয়েটা সত্যিই অসাধারণ। কিন্তু তবুও মনে হয়, রুদ্রর পাশে জ্যোতিকে আরও বেশি মানাতো। কিন্তু এখানে তো কারো কিছু করার নেই। কারো কোন হাত নেই। ভালোবাসা জিনিসটাই হয়তো এমন। এখানে ভাগ্য ছাড়া কাকে দোষ দেবে? কার কী করার আছে? ‘ভালোবাসা’ শব্দটা মাথায় ঘুরতেই নীরবের কথাই মনে পড়ল কুহুর। নীরবের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনেই মেসেজ পাঠিয়ে দিল তার নাম্বারে।

রুদ্র ঘরে ঢুকে দরজা লাগাতেই আড়ষ্ট হয়ে বসল প্রিয়তা। হাঁটুর ওপর রাখা হাত দুটো শাড়ি খামচে ধরল। আধঘন্টা আগে মীরা, কুহু, জ্যোতি বসিয়ে রেখ‍ে গেছে ওকে এখানে। কীসব দুষ্টুমি করছিল! তবে রুদ্রের সাথে হাসি-তামাশা করার সাহস আমের ভিলার কারো নেই। তাই সেই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে সকলেই।

ঘরজুড়ে হরেক রকম ফুল আর মোমবাতির মিষ্টি সুগন্ধ। লাইট সব অফ করা। কেবল সুগন্ধি মোমবাতির আলোতেই আলোকিত ঘরটা। রুদ্র তাকাল প্রিয়তার দিকে। ফুলে সুসজ্জিত বিছানার ঠিক মাঝে মাথা নিচু করে, শক্ত হয়ে বসে আছে। রুদ্র মুচকি হাসল। ধীরপায়ে গিয়ে বসল বিছানায়। তাতে আরেকটু গুটিয়ে গেল প্রিয়তা। রুদ্র হাত বাড়িয়ে হলদে রঙের একটা মোমবাতি নিল। আরেক হাতে আলতো করে ধরল প্রিয়তার নোয়ানো চিবুক। প্রিয়তা চোখ বুজে ফেলল। রুদ্র ওর নিচু মাথাটা উঁচু করে ধরল। মোমবাতিটা দুজনের মাঝামাঝি ধরে দেখল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। ঠোঁট কাঁপছে। খয়েরী রঙের শাড়ি হাতা ভেঙ্গে পরানো, গা ভর্তি ভারী গহনা। ঘোমটা দেয়নি, খোঁপা করা চুলে ফুলের গাঁজরা লাগানো। সব মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো রূপ। রুদ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, ‘মাশাআল্লাহ! স্বয়ং চাঁদ নেমে এসেছে আমার ঘরে।’

প্রিয়তা কেঁপে উঠল। আরও শক্ত হয়ে বসল। রুদ্র মৃদু হেসে মোমবাতিটা জায়গায় রাখল। প্রিয়তার চিবুক ছেড়ে বলল, ‘ভয় পাচ্ছো নাকি আমাকে?’

প্রিয়তা তাকাল রুদ্রর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। জবাব দিলোনা। রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা প্রিয়, আমাদের বিয়েটা কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে? লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ? নাকি দুটোই?’

প্রিয়তা এবারও উত্তর দিলোনা। রুদ্র বুঝল মেয়েটার অভিমান কমেনি এখনো। তারওপর বাসর রাতে নাকি এমনিতেই চুপ থাকে মেয়েরা। রুদ্র উঠে দাঁড়াল। হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল, ‘গয়নাগুলো খুলে ফেলো। গরম পড়েছে আজ।’

রুদ্রের নির্দেশ শুনে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল প্রিয়তা। ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে টুলে বসল। আয়না দিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর প্রতিবিম্বের দিকে। কিছুক্ষণ বাদে রুদ্র তাকাতেই হকচিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। রুদ্র পাঞ্জাবীর বোতাম খুলছিল। কী একটা ভেবে থেমে গেল। এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা তখন চুড়ি খুলছে। গলায় কারো হাতের ছোঁয়া পেয়েই চমকে উঠল ও। তাকিয়ে দেখল রুদ্র ওর হার খুলে দিচ্ছে। প্রিয়তা চট করে উঠে দাঁড়াল। ইতস্তত করে বলল, ‘আমি পারব।’

কিন্তু রুদ্র শুনলো না। কাঁধ ধরে আবার টুলে বসিয়ে দিল প্রিয়তাকে। শাসনের ভঙ্গিতে বলল, ‘চুপচাপ বসে থাকো।’

প্রিয়তা আর বাঁধা দেওয়ার সাহস পেলোনা। মাথা নুইয়ে বসে রইল। কিন্তু মনে এখনো অভিমান পুষে রেখেছে সে। রাখাটাই স্বাভাবিক। রুদ্র খুব যত্ন নিয়ে এক এক করে ভারী গহনাগুলো খুলে দিলো। পুরোটা সময় মাথা নুইয়ে, শক্ত হয়ে বসে ছিল প্রিয়তা। এরপর প্রিয়তার দু কাঁধে হাত রেখে বেশ অনেকটা ঝুঁকে গেল রুদ্র। আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল। প্রিয়তা এখনো মাথা নিচু করে বসে আছে। স্থির পুতুলের মতো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে রুদ্র মৃদু গলায় ডাকল, ‘প্রিয়?’

প্রিয়তা চোখ তুলে তাকাল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড রুদ্রের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। রুদ্রর নিঃশ্বাসগুলো বারবার ঘাড়ে পড়ায় কেমন অস্থির লাগছে ওর। প্রিয়তার মাথার চুলে রুদ্র নিজের নাক স্পর্শ করতেই নড়ে উঠল প্রিয়তা। দ্রুত উঠে সরে এলো ওখান থেকে। রুদ্র হেসে ফেলল। উঠে আবার গেল প্রিয়তার কাছে। হাত ধরে ঘোরালো নিজের দিকে। প্রিয়তা আজ চেষ্টা করেও পারছেনা রুদ্রের চোখে চোখ রাখতে। লজ্জায়, অভিমানে, আড়ষ্টতায় শিউরে উঠছে ও। রুদ্র নিজের দু হাতের মুঠোয় প্রিয়তার দুহাত চেপে ধরে বলল, ‘জানো, মেয়েদের এই জিনিসটা আমার খুব অসহ্য লাগতো। এইযে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া ব্যপারটা। টোটাল ন্যাকামি মনে হতো। কিন্তু আজ তোমার লজ্জা পাওয়াটা মন্দ লাগছেনা। বরং মারাত্মক ভালো লাগছে। কেন বলোতো?’

বরাবরের মতোই জবাব দিলোনা প্রিয়তা। আস্তে করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। এই ছেলে আজ ওকে অভিমান করে থাকতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। কী শুরু করেছে! প্রিয়তা কাঁপাকাঁপা হাতে টি-টেবিল থেকে দুধের গ্লাসটা নিল। ঘুরে গ্লাসটা এগিয়ে দিল রুদ্রর দিকে। রুদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘আমি এতো রাতে দুধ খাইনা।’

প্রিয়তা সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘ নার্গিস খালা দিতে বলেছেন। আজক‍ের রাতে নাকি দিতে হয়।’

রুদ্র একবার তাকাল দুধের গ্লাসটার দিকে। তারপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে বলল, ‘কেন দিতে হয় জানো?’

প্রিয়তা বোকার মতো মাথা নাড়ল। অর্থাৎ না। রুদ্র হাসল। অস্বস্তি বাড়ল প্রিয়তার। ও হাসার মতো কী বলল? রুদ্র আর বাক্য ব্যয় করল না। ভদ্র ছেলের মতো অর্ধেক গ্লাসের মতো দুধ খেল। খাওয়ার সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রিয়তার দিকে। কী অদ্ভুত দৃষ্টি! প্রিয়তা মিষ্টির হাফপ্লেটটার দিকে হাত বাড়াতে গেলেই আঁতকে উঠল রুদ্র। অস্হির গলায় বলল, ‘অ‍্যাই, মিষ্টি না প্লিজ। এমনিতেই আমার মিষ্টি অপছন্দ। এইসময় তো একদমই না।’

কেমন অসহায় শোনাল রুদ্রের গলা। প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হাসল। অভিমান, অভিযোগ কখন পালিয়ে গেছে নিজেও বুঝল না। নিচু গলায় বলল, ‘আচ্ছা। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।’

দশ মিনিটের মধ্যেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র। পরনে একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর টাউজার। ঘরে প্রিয়তাকে দেখতে পেলোনা। দরজা বন্ধ। বুঝলো বউ তার বারান্দায় আছে। এখনো ওর ওপর রেগে আছে কি-না কে জানে?

বারান্দায় গিয়ে রুদ্র আরেকদফা থমকালো। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। চাঁদের আলো সরাসরি এসে ওর গায়ে পড়ছে। দৈব মানবী মনে হচ্ছে ওকে। রুদ্র এগিয়ে গেল। পেছন থেকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল তার প্রিয়কে। প্রিয়তা চমকাল। দ্রুত হাত রাখল ওর পেটে রাখা রুদ্রের হাতে। রুদ্র প্রিয়তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ‘এখনো রেগে থাকবে, প্রিয়?’

প্রিয়তা নিরুত্তর। রুদ্র বাঁধন আরও শক্ত করে বলল, ‘আজকের রাতটাতেও এতো অভিমান? এমন রাত কিন্তু রোজ আসবেনা।’

প্রিয়তা এবার রুদ্রের হাতের বাঁধন আলগা করে ঘুরল রুদ্রের দিকে। রুদ্রের হাত এখনো ওর কোমরে। প্রিয়তার চোখে জল দেখে চমকে উঠল রুদ্র। কাঁদছিল নাকি মেয়েটা? রুদ্র অস্থির গলায় বলল, ‘কী হয়েছে প্রিয়? কাঁদছো কেন? আমি কোনভাবে হার্ট করেছি তোমাকে? আ’ম স্যরি। বাট ডোন্ট ক্রাই।’

প্রিয়তা কিছু বলল না। আস্তে করে রুদ্রর বুকে মাথা রেখে বলল, ‘ আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না তো?’

রুদ্র একহাতে জড়িয়ে নিল প্রিয়তাকে। আরেকহাত প্রিয়তার মাথায় রেখে বলল, ‘কখনও না। হঠাৎ এমন অদ্ভুত ভাবনা কেনো এলো? বিশ্বাস করোনা আমাকে?’

‘নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি আপনাকে।’ অকপটে বলল প্রিয়তা।

‘তাহলে?’

‘ভালোবাসা আমার কপালে বেশিদিন সয়না রুদ্র। আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছি। আর এই ভালোবাসাটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয়।’

‘ভয় নেই প্রিয়। আমি জানি আমার জীবন আলাদা। আমি জানিনা পরবর্তী সেকেন্ডে আমি শ্বাস নিতে পারব কিনা। জানিনা শত্রুর গু-লিতে কখন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকব কোন এক রাস্তায়। তাই তোমাকে ছেড়ে যাবোনা সে কথা দিতে পারছিনা।’

প্রিয়তা শক্ত করে খামছে ধরল রুদ্রর গেঞ্জি। রুদ্র বলে চলল, ‘কিন্তু এইটুকু বলতে পারি, আজ এইযে এই মুহুর্তে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, এইযে তোমার নিঃশ্বাস আমার বুকে আছড়ে পড়ছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাকে এভাবেই আগলে রাখব আমি। পৃথিবীতে এই বুকের যদি অস্তিত্ব থাকে, তোমার শেষ নিঃশ্বাসও এখানেই পড়বে।’

প্রিয়তা কিছু বলল না। লেপ্টে রইল রুদ্রর বুকে। রুদ্র প্রিয়তার মাথা গভীর চুমু খেয়ে বলল, ‘কিন্তু সে দিন কখনও আসবেনা প্রিয়। আমি আসতে দেবনা।’

এরপর সব চুপচাপ। কিছুক্ষণ কেটে গেল নীরবেই। রুদ্র প্রিয়তাকে সোজা করে দাঁড় করাল। চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলল, ‘ছাড়ো এসব কথা। একটা জিনিস দেওয়ার আছে তোমাকে।’

কথাটা বলে একহাতে ট্রাউজারের পকেটে হাত গলিয়ে দিল রুদ্র। বেরিয়ে এলো একটা সোনার পেন্ডেন্ট। লকেটের সাইজটা মোটামুটি বড়। প্রিয়তাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিল রুদ্র। রেলিং ধরে দাঁড়াল মেয়েটা। রুদ্র আলতো হাতে প্রিয়তার চুলগুলো সামনের একপাশে পাঠিয়ে দিল। পেন্ডেন্টটা ওর গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বিয়ের পর আমার দেওয়া প্রথম উপহার। কখনও খুলবেনা এটা।’

প্রিয়তা নিজের গলায় হাত রেখে মৃদু হাসল। পরানো শেষে তাকাল রুদ্রের দিকে। রুদ্রের ঠোঁটেও মুচকি হাসি ঝুলে আছে। প্রিয়তা আবার মাথা রাখল রুদ্রের বুকে। পরম নিশ্চিন্তে বন্ধ করে ফেলল চোখজোড়া। রুদ্রও জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। কিন্তু এবারের আলিঙ্গনে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। অসাড় হয়ে এলো সর্বাঙ্গ। রুদ্রের শরীরের উষ্ণতায় সব এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করল। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। সমগ্র জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল ওরা নিজেদের।
প্রথম রাতে বেশ ভীষণ গরম পড়লেও, মাঝরাত থেকে বাসাত বইতে শুরু করল, সে বাতাস তীব্র রূপ নিল, শেষরাতে মেঘ ডাকল, বিদ্যুৎ চমকালো, দীর্ঘক্ষণ চলল ঝড়ের তান্ডব। অবশেষে শান্ত, কোমল, উজ্জ্বল ভোর দিয়েই সূচনা হল নতুন একটি দিনের।

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here