অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৩৮.
কুহুর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের পুকুরঘাটটা বেশ সুন্দর। পুকুরের চারপাশ জুড়ে মাঝারি আকারের বিভিন্ন কাঠগাছ। ইট দিয়ে বাঁধানো চমৎকার সিঁড়িওয়ালা ঘাট। তার দুপাশ দিয়ে হরেকরকম ফুলগাছ। সবসময় কোন না কোন ফুল ফুটেই আছে। মন ভালো করার জন্যে এমন একটা দৃশ্যপট যথেষ্ট। ঘাটের সিঁড়ির ওপর বসে আছে কুহু। ড্রয়িং খাতাটা উড়ুর ওপর রেখে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ বানাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে নীরবের কথা। ভাবতে ভাবতে আনমনেই হেসে উঠছে। নীরবই ডেকেছে ওকে এখানে। আজ এখানেই দেখা করার কথা ওদের। বেলা তিনটায়।
ঠিক তিনটা বাজেই হাজির হলো নীরব। প্রায় লাফিয়ে বসল কুহুর পাশে। কুহু চকিতে তাকাল। তাকিয়ে নীরবকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। নীরব ভ্রু নাচালো। ঠোঁটে মৃদু হাসি। কুহুও হাসল। ড্রয়িং খাতাটা কোলের ওপর রেখেই দ্রুত মোবাইলটা বের করল। চলে গেল হোয়াটস্ অ্যাপে। লিখল, ‘আপনি এতো ঠিকঠাক সময় কীকরে আসেন? খুব পাংচুয়াল তাইনা?’
নীরব হেসে ফেলল। বলল, ‘পাংচুয়াল? আমি? তুমি জানো ক্লাসে দেরীতে ঢোকার জন্যে কতবার সারা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হতো আমাকে? শুধু তোমার বেলাতেই নিয়মটা পাল্টে যায়। ইউ নো, তোমাকে দেখার জন্যে ছটফট করি আমি। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ সামনেই বসিয়ে রাখি তোমাকে। অপলক চোখে শুধু দেখতেই থাকি।’
কুহু তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। কেমন একটা লাগছে। অদ্ভুত অনুভূতি। ধীর হাতে টাইপ করল, ‘কেনো?’
নীরব কুহুর দিকে একটু এগিয়ে বসল। কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ আগেও অনেকবার বলেছি। ইউ আর রিয়েল ভেরী কিউট।’
নিমেষেই লাল হয়ে উঠল কুহুর দুটো গাল। চোখ বন্ধ করে ফেলেছে ও। ব্যপারটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল নীরব। হাসল। সোজা হয়ে বসল ধীরে ধীরে। কুহু চোখ খুললেও নীরবের দিকে তাকালো না। মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। নীরব বুঝলো মেয়ে লজ্জা পেয়েছে। তাই কথা ঘোরাতে বলল, ‘কী ব্যপার? ম্যাডামকে আজ এতো খুশি খুশি লাগছে? চোখমুখ চকচক করছে একদম।’
কুহু চট করে ঘুরে বসল নীরবের দিকে। লজ্জা পালিয়ে গেছে। কথা বলার মতো পছন্দের বিষয় পেয়ে গেছে ও। দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে লিখল, ‘জানেন? ভাইয়া বিয়ে করছে।’
‘ সত্যি! কী সাংঘাতিক! তোমার ঐ দানব ভাইটা রাজি হলো? মানে সিরিয়াসলি? এই অসম্ভবকে সম্ভব কে করলো বলোতো? মহাযোগীর ধ্যান ভঙ্গ করল কোন অপ্সরা?’
কুহু চোখ ছোট করে শক্ত একটা কিল মারল নীরবের বাহুতে। নীরব হেসে দিয়ে বলল, ‘জাস্ট কিডিং। তা ঘরোয়াভাবে হচ্ছে নাকি_’
কুহু লিখল, ‘রুদ্র আমেরের বিয়ে বলে কথা। ধুমধাম করে হবে সব।’
‘তা পাত্রীটা কে? নিশ্চয়ই তোমার সেই জ্যোতি আপু?’
কুহু গোমড়া মুখ করে মাথা নাড়ল। নীরব অবাক চেহার করে বলল, ‘না? কী বলো? তোমার মুখে যা বর্ণনা শুনেছিলাম তাতে আমিতো ধরেই নিয়েছিলাম, তোমার ঐ একরোখা ভাইকে বাঁধতে পারলে একমাত্র জ্যোতি আপুই পারবে। দুজনকে একসঙ্গে কিন্তু দারুণ মানাতো।’
কুহু হতাশ শ্বাস ফেলে লিখল, ‘আমারও তাই মনে হয়। ভাইয়ার জন্যে সবসময় জ্যোতি আপুই সেরা। কিন্তু কী করব বলুন? ভাইয়ার নিজস্ব পছন্দ। এক্ষেত্রেতো আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত মতামত চাপিয়ে দিতে পারিনা।’
নীরব বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তা পারিনা। বাট তোমার ভাবিটা কে? দেখতে কেমন?’
‘ভাবিকে আমি দেখিনি এখনো। আজ যাব দেখতে। বাবা বলেছে বিয়ের আগ পর্যন্ত ভাবির কাছেই থাকতে।’
নীরব ঠোঁট উল্টে মাথা ঝাঁকালো। অর্থাৎ এলাহি ব্যপার-স্যাপার। হঠাৎ উৎসাহি কন্ঠে বলে উঠল, ‘আমি ড্রপ করে দেই আজ তাহলে?’
কুহুর সুন্দর মুখটায় আধার নামল। নিরাশ ভঙ্গিতে লিখল, ‘কালো হাতিদুটো ছাড়বেনা আপনার সাথে।’
নীরবও হতাশ হল। রাগ হল দুই প্রহরীর ওপর। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঐ দুটোকে মাঘের রাতে এই পুকুরে টানা একশটা চুবানি দিতে। বিশ বছরের একটা মেয়েকে এতো পাহারা দেওয়ার কী আছে? মাস দুই পরেতো নীরব চলে যাবে ভার্সিটি ছেড়ে। এরকম হলে তখন কীকরে দেখা হবে কুহুর সাথে? ফন্দি আঁটা ছাড়া উপায় নেই। এদিকে কুহুর মলিন মুখ দেখেও নীরবের খারাপ লাগল। ব্যপারটা স্বাভাবিক করতে বলল, ‘বড় ভাইর বিয়েতো হয়েই যাচ্ছে। ছোট বোনের বিয়েটা কবে হবে?’
কুহু মৃদু চমকে তাকাল নীরবের দিকে। কিছু বলল না। ঠোঁটে চাঁপা হাসি রেখে অন্যদিকে তাকাল। কুহুর ঠোঁটে হাসি দেখে স্বস্তি পেল নীরব। বলল, ‘জানো, আমি ঠিক করেছি অনলাইনে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিখব।’
কুহু নীরবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচাল, অর্থাৎ কেনো?
নীরব আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসল কুহুর। নিচু কন্ঠে বলল, ‘ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে তো।’
–
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছে প্রিয়তা। শরীরটা ভালো লাগছিল না আজ। গা ম্যাচম্যাচ করছিল। তাই অলসতায় গোসল করতে দেরী হয়ে গেল। হঠাৎ দরজায় নক পড়ায় দ্রুত পায়ে রুমে এলো প্রিয়তা। ব্যস্ত হাতে দরজাটা খুলল। সামনে তাকিয়ে চমকাল খানিকটা। দেখল, চমৎকার সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘিয়ে রঙের জরজেটের শাড়ি, বোট গলার থ্রি কোয়ার্টার লাল ব্লাউজ, পিঠ অবধি খোলা চুল। কিন্তু চোখে কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। প্রিয়তা খানিকটা ইতস্তত করেষবলল, ‘আপনি?’
জ্যোতি প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই বলল, ‘জ্যোতি। রুদ্রর বাড়ি থেকে এসছি। তুমি প্রিয়তা তো?’
প্রিয়তা সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, ‘ জি। আসুন না। বসুন।’
জ্যোতি ভেতরে এসে বসল। প্রিয়তা বলল, ‘লাঞ্চ করেছেন আপু?’
‘ হ্যাঁ করেছি। এতো ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই? বসোনা।’
নিজের পাশে হাত রেখে বলল জ্যোতি। প্রিয়তা বসল। জ্যোতি বলল, ‘ আমি আমের ভিলারই সদস্য। বাকি পরিচয়টা ঐ বাড়ি গেলেই ধীরে ধীরে জানতে পারবে। আর তোমার ননদ আসছে কিছুক্ষণের মধ্যে। বিয়ের আগ পর্যন্ত ও তোমার কাছেই থাকবে।’
প্রিয়তা মাথা নাড়ল। জ্যোতি প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর আমাকে আপনি না বলে তুমি করেই বলো। কাছেরই লোক।’
উত্তরে মৃদু হাসল প্রিয়তা। জ্যোতি ঘরের বাইরে ইশারা করে বলল, ‘ ঐ দুজন কারা?’
প্রিয়তা নিচু কন্ঠে বলল, ‘ উনি রেখে গেছেন ওদের। আমায় সাহায্য করার জন্যে।’
‘ ভালোবাসা!’
হালকা হেসে উঠে দাঁড়ালো জ্যোতি। চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে কৌতুকের স্বরে বলল, ‘ এই ফ্লাটেই মাসখানেক একসঙ্গে ছিলে তোমরা। তাইনা?’
প্রিয়তার চোখ নামিয়ে নিল। খানিক সংকোচ নিয়ে বলল, ‘আমরা নই। শুধু আমি। উনি এখানে থাকতেন না। শুধু এসে দেখা করে যেতেন।’
জ্যোতি প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলল, ‘ কিন্তু ঐসময় অনেকদিনই কিন্তু রুদ্র বাড়ি ফেরেনি রাতে।’
‘আমি ঠিক জানিনা।’
ব্যপারটা পেঁচিয়ে যাচ্ছে বুঝেও সরল জবাব দিল প্রিয়তা। জ্যোতি কেমন অদ্ভুতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওকে। আসার পর থেকেই। হয়তো বিশেষত্ব খুঁজছে। রুদ্র আমের নামক পাষাণকেও গলিয়ে দিল! এমন কী বিশেষ আছে এই মেয়ের মধ্যে? যা জ্যোতির মধ্যে নেই। ওকে জানতেই হবে। এইদিকে জ্যোতির ওরকম দৃষ্টিতে অস্বস্তি হচ্ছে প্রিয়তার। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। জ্যোতি হঠাৎই শান্ত গলায় বলল, ‘কী দিয়ে মন গলালে রুদ্রর। এমন কী করলে যে তোমার পেছনে পাগল হয়ে গেল? জাদুটোনা?’
প্রিয়তা এবার সরাসরি তাকাল জ্যোতির দিকে। জ্যোতির চোখেমুখে কৌতুক খেলা করছে। প্রিয়তা বুঝল না কী বলবে। জ্যোতি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে বোকা মেয়ে! মজা করছিলাম। আসলে আমাদের আয়রন হার্ট রুদ্র আমের হঠাৎই কারো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কি-না। সেইজন্য।’
স্বস্তি পেল প্রিয়তা। লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে বলল, ‘ভালোবাসাতো সময় দেখে, জায়গা বেছে, লোক বেছে হয়না আপু। হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই। আর যখন বুঝতে পারে ভালোবেসে ফেলেছে, তখন অনেক দেরী হয়ে যায়। আর কিছু করার থাকেনা।’
শেষ বাক্যটা ভীষণ অন্যমনস্কভাবে বলল প্রিয়তা। জ্যোতি অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর হঠাৎই জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। কিন্তু খানিক বাদেই মুখে সামান্য হাসি ফুটল ওর। আস্তে করে হাত রাখল জ্যোতির পিঠে। জ্যোতি বলল, ‘ভীষণ মিষ্টি মেয়ে তুমি। না দেখলে বিশ্বাস-ই হতোনা, এতো মিষ্টি মেয়েও এক্সিস্ট করে।’
প্রিয়তা কিছু বলবে তখনই আবার টোকা পড়ল দরজায়। প্রিয়তা আর জ্যোতি একে ওপরকে ছেড়ে তাকাল। প্রিয়তা দেখল সাদা কুর্তি পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম বাচ্চাদের মতোই নিষ্পাপ মুখখানা। মুখে মিষ্টি হাসি। জ্যোতি হেসে বলল, ‘ এই হল তোমার ননদ। কুহু!’
কুহু দ্রুত পায়ে এসে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা খানিকটা ইতস্তত করে ধরল ওকে। কয়েক সেকেন্ড পর ওকে ছেড়ে ইশারায় কিছু বলল কুহু। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বুঝল না কিছু। জ্যোতি বলল, ‘ও বলছে তুমি খুব সুন্দরী। একদম পরীর মতো। আর থ্যাংকিউ দিল। ওর বেয়ারা ভাইকে লাইনে নিয়ে আসার জন্যে। আসলে ও জন্ম থেকেই কথা বলতে পারেনা। তাই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করে।’
প্রিয়তার মন খারাপ হয়ে গেল। এতো মিষ্টি মেয়েটা কি-না কথা বলতে পারেনা! পরক্ষণেই ভাবল, নিশ্চয়ই ওর এমন কোন প্রতিভা আছে, যার কাছে এই অক্ষমতাটুকু নগণ্য। মুখে বলল, ‘ তুমিতো মিষ্টির চেয়েও বেশি মিষ্টি।’
কুহু খুশি হয়ে গেল। ইশারায় বলল, ‘ আমি এই কদিন তোমার কাছে থাকব। জানো?’
কথাটা জ্যোতি বুঝিয়ে দিল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা কুহুর গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘ না থাকতে চাইলে জোর করে রেখে দিতাম। এতো মিষ্টি মেয়েকে ছাড়া যায়?’
কুহুর খুশি দেখে কে? ঝটপট ওর ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কিছু একটা করছে। প্রিয়তা অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটার চঞ্চলতা। সত্যিই ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। ফোনে কাজ শেষ করে কুহু ইশারায় বলল, ‘পিৎজা অর্ডার করেছি। খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা দেব।’
জ্যোতি সেটা বুঝিয়ে বলল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা গাল ফুলিয়ে আসাম করে বসল। অসহায় মুখ করে জ্যোতি আর কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ঐ বাড়ির তোমরা সবাই কী খাও বলোতো? সবাই এতো সুন্দর আর মিষ্টি কেন? আমার হিংসে হচ্ছে।’
প্রিয়তার কথায় জ্যোতি আর কুহু একে ওপরের দিকে তাকাল। হেসে ফেলল দুজনেই। কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে প্রিয়তাও যোগ দিল সেই হাসিতে।
–
দেখতে দেখতে আরও তিনটে দিন পাড় হলো। আমের ভিলার সবাই বিয়ের তোড়জোড় করতে ব্যস্ত। সকলেই নিজ নিজ কাজে চরম ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এরমধ্যে প্রিয়তার সাথে সেভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি রুদ্রর। মেয়েটা কেমন এড়িয়ে চলে ওকে। কথা বলতে চায়না। মুখ গোমড়া করে থাকে। রুদ্র ঠিক করে নিয়েছে বিয়ের আগে প্রিয়তার সাথে কথা বলে নেওয়া দরকার। বিয়ের দিনটাতে যাতে দুজনেই দুজনের কাছে পরিষ্কার থাকে। দ্বিধাহীন মন নিয়ে নতুন সম্পর্ক, নতুন জীবন শুরু করতে পারে।
রাত প্রায় দশটা বাজে। আকাশে ঘন মেঘ করেছে। খানিক বাদে বাদে বিদ্যুতের ঝলকানিতে আলোকিত হয় ওঠছে চারপাশ। মাঝারি বেগে বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে বছরের প্রথম বর্ষণটা আজকেই হবে। প্রকৃতি তাই বলছে।
ছাদের রেলিং ধরে বিস্তৃত শহরটাকে দেখছে প্রিয়তা। পরনে কালো কুর্তি। খোলা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে বাতাসের তালে। গভীর এক ভাবনায় ডুবে আছে মেয়েটা।
প্রিয়তাকে খুঁজতে ছাদে এসে থমকে দাঁড়াল রুদ্র। আবছা অন্ধকার ছাদে যেন কোন অপরূপা পরী দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সামলালো রুদ্র। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। বলল, ‘ঘরে চলো প্রিয়তা। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।’
‘আপনি এখানে?’ নির্বিকারভাবে জানতে চাইল প্রিয়তা। রুদ্রর দিকে তাকায় নি।
‘রাতে ঘুমাবো না এখানে। চিন্তা করোনা। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল আমার।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। তাকালোও না। প্রিয়তাকে চুপ দেখে রুদ্র বলল, ‘দুদিন পরে আমাদের বিয়ে প্রিয়। তুমি এখনো অভিমান করে আছো আমার ওপর? নাকি সত্যিই বিয়েটা করতে চাইছোনা?’
প্রিয়তা এবার তাকাল রুদ্রর দিকে। কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘যদি বলি এই বিয়েটা করতে চাইনা আমি। তাহলে? ভেঙ্গে দেবেন বিয়েটা? ছেড়ে দেবেন আমাকে? আপনার বাবা মানবেন?’
রুদ্র এবার এগিয়ে এলো। প্রিয়তার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘আমাকে তুমি চাওনা? কথাটা আমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে?’
প্রিয়তার কঠিন দৃষ্টি এবার কোমল হল। ধীরে ধীরে তা আদ্র হয়ে উঠল। রুদ্রর চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলল, ‘আমি দ্বিধায় ভুগছি।’
রুদ্র অধৈর্য হল। প্রিয়তার দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, ‘আমি জানি আমার তোমাকে ছাড়া চলবেনা। তুমি জানো তুমি আমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাহলে কীসের দ্বিধা প্রিয়? কীসের সংকোচ? কীসের অপূর্ণতা?’
‘ বিশ্বাসের।’
‘ বিশ্বাসের?’
হতবাক হলো রুদ্র। প্রিয়তা ওকে নিয়ে বিশ্বাস করেনা! কথাটা মানতে কষ্ট হল রুদ্রর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল, ‘লোকে বলে বিশ্বাস না করলে নাকি ভালোবাসা যায়না। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালোবাসা নেই। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। ভালোবাসতে বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়না। কিন্তু যেকোন সম্পর্কে বিশ্বাস স্তম্ভের মতো কাজ করে। ভালোবাসাতো অল্প সময়ে, অল্প আলাপেও হয়ে যায়। ঐটুকু সময় কাউকে বিশ্বাস করার জন্যে যথেষ্ট নয়। কিন্তু সম্পর্ক! জগতের সব সম্পর্ক শুরুই হয় বিশ্বাস দিয়ে। বন্ধু হোক, স্বামী-স্ত্রী হোক, সব সম্পর্কই বিশ্বাস দিয়ে শুরু হয়। ভরসা দিয়ে শুরু হয়। তাই যেকোন সম্পর্ক দৃঢ় রাখার জন্যে একে ওপরের ওপর বিশ্বাস থাকা চাই। ভালোবাসাহীন সম্পর্ক হয়। কিন্তু বিশ্বাসহীন সম্পর্ক তাসের ঘরের চেয়েও দুর্বল। তাই যেকোন সম্পর্ক শুরু করার আগে একে ওপরের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখাটা জরুরি।’
রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আর তুমি আমার ওপর সেই বিশ্বাস রাখতে পারছোনা?’
‘ না পারছিনা। আর বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই।’
‘ অবিশ্বাসের কারণ?’
আবার বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল আকাশে। তুলনামূলক আলোর মাত্রা বেশি ছিল এবার। মাঝারি আওয়াজে গর্জন করে উঠল মেঘ। অভিমান, অভিযোগে জর্জরিত কন্ঠে প্রিয়তা বলল, ‘আপনার ইচ্ছে হলো আর আপনি আমাকে চট্টগ্রাম দিয়ে আসলেন। একবার জানতেও চাইলেন না আমি কী চাই। আমার কী ইচ্ছা। অথচ ঐ কয়েকটা দিন প্রতিটা মুহূর্তে প্রেমের, ভালোবাসার তীব্র অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন আপনি আমাকে। নিজের কাছে টেনেছিলেন। কিন্তু আপনার ইচ্ছে হওয়াতে কত সহজেই ছেড়ে দিলেন আমায়। কীকরে ধরে নেব যে আগামীতে আবার আপনার মন পাল্টাবেনা? হয়তো আবার আপনি আমাকে বলে বসবেন যে “প্রিয়তা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও। বিয়েটা আমি ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছি। যা হয়েছে সব ভুলে যাও।” আমার জীবটাতো আপনার এই অস্থায়ী মতের ওপর চলতে পারেনা।’
রুদ্র কিছু বলতে নিচ্ছিল। প্রিয়তা হাত উঁচু করে থামিয়ে দিল। বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি। চট্টগ্রাম যে আপনি আমাকে নিজের মর্জিতে আনতে গেছেন সেটাও কিন্তু না। আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার পর একটা কল অবধি করেন নি আপনি। খোঁজও নেননি মেয়েটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। বারো দিন। টানা বারোদিন পর গিয়েছিলেন আপনি আমার কাছে। তাও বাবার আদেশে। যদি উনি আদেশ না দিতেন তাহলে? তাহলেতো আজও আমি ঐ চট্টগ্রামেই থাকতাম আর আপনি গুলশান। না এই বিয়ে হতো, আর না সম্পর্ক। তাহলে এটাই দাঁড়ালো যে আমার বিয়েটাও বাবার আদেশে হচ্ছে। বাবাকে আমি সম্মান করি। কিন্তু কাল যদি উনি আবার বলেন প্রিয়তাকে ছেড়ে দাও। আপনি নিশ্চয়ই তাই করবেন? বাবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আমার জীবনটাতো কারো আদেশের ভিত্তিতেও চলতে পারেনা রুদ্র। এবার আপনি বলুন, এইসবকিছু ভুলে আমি কীকরে আপনাকে বিশ্বাস করব? কীকরে আমাদের সম্পর্কটা শুরু করব?’
রুদ্র তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। এতক্ষণ বুকের ওপর হাত ভাজ শুনছিল কথাগুলো। কথা শেষ হতেই আরেকটু এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে। একটানে প্রিয়তাকে নিজের কাছে টেনে বলল, ‘ইউ নো হোয়াট প্রিয়? বাবার পরে এই প্রথম কেউ আমার সামনে দাঁড়িয়ে এতোগুলো কথা বলল আর আমি চুপচাপ শুনলাম। এর আগে সবসময় আমি বলতাম, লোকে শুনতো। আজ অবধি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, নির্দিধায় এতো কথা বলার সাহসই হয়নি কারো। এই জন্যেই তুমি আমার জন্যে পার্ফেক্ট। আমার যোগ্য সহধর্মিনী।’
প্রিয়তা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র কৌতুক ছেড়ে গম্ভীর হলো এবার। প্রিয়তার দুই বাহুতে ভরসার হাত রেখে বলল, ‘আমার বাবাকে তুমি এখনো চেনোনি প্রিয়। তুমি কীকরে চিনবে? ওনার সন্তান হয়েও এখনো পুরোপুরি তাকে চিনে উঠতে পারিনি আমি। সত্যি বলতে চেনার চেষ্টাও করিনা। কিছু মানুষকে পুরোপুরি বুঝতে ইচ্ছে করেনা। ঐ না বোঝার মধ্যেও আলাদা তৃপ্তি আছে। তবে যেটুকুই চিনেছি, তাতে একটা কথা তোমাকে দিতে পারি। উনি তোমাকে নিজের মেয়ে বলেছেন। আর উনি একবার যা বলেন, সেই কথা থেকে কেউ কোনদিন ওনাকে টলাতে পারেনা। সুতরাং যেই মুহূর্তে উনি তোমাকে মেয়ে বলেছেন, সেই মুহূর্ত থেকে যদি পৃথিবীর উল্টেও যায়, তোমার সাথে যদি আমার বিয়ে নাও হয়, তবুও তুমি ওনার মেয়ে। ওনার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তাই থাকবে। মানুষ হিসেবে উনি যেমনই হোক, নিজের মেয়ের কোন ক্ষতি উনি করবেন না।’
প্রিয়তা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। কিছু বলছে না। রুদ্র একটু থেমে বলল, ‘আর রইল আমার কথা? আমি তোমার সুরক্ষার চিন্তা করেই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, ভালো থাকতে পারিনি। তাই হয়তো বাবা সেই অসম্ভব আদেশটা করেছিলেন আমায়। আমার জীবনযাত্রা কেমন তোমার ধারণা নেই প্রিয়তা। করা সম্ভবও না। আমি একজন ক্রিমিনাল তুমি তা জানো। কিন্তু এটা জানোনা যে আমি এমন একজন ক্রিমিনাল যাকে বাগে পাওয়ার জন্যে গোটা দেশের প্রশাসন অবধি ওত পেতে রয়েছে। ক্ষমতাধর একাধিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক যার লা-শ ফেলার জন্যে ছটফট করছে। এরচেয়ে বেশি কিছু তোমাকে বলতে পারছিনা। কিন্তু সেকারণেই এরকম জীবনে তোমাকে জড়াতে চাইনি আমি। তবে এখন আমার তোমাকে চাই। আর আমি চাই মানে সেটা আমার। তুমিও আমার প্রিয়। স্যরি টু সে, এক্ষেত্রে তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম আমি দিতে পারছিনা আমি। এতোগুলো কথা বললাম কারণ দুদিন পরেই আমাদের বিয়ে। এইটুকু জানার অধিকার তোমার আছে। আমি_’
শেষ করতে পারল না রুদ্র। প্রিয়তা হঠাৎই জাপটে ধরলো রুদ্রকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রুদ্র অবাক হলো। বাতাসের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। শো শো আওয়াজ কানে লাগছে এবার। ফরফর শব্দ করে উড়ছে ওদের পোষাক, চুল। প্রিয়তা কান্নামাখা গলায় বলল, ‘আমি যাদেরকেই ভালোবাসি সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায় রুদ্র। আমার বাবা-মাকে খুব ভালো বাসতাম আমি, খুব। কিন্তু আমার অর্ধেক পৃথিবীকে শূণ্য করে হঠাৎই মা চলে গেল। তখন আমার পৃথিবীজুড়ে শুধু বাবাই ছিল। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর বাবাটাও কেমন পর হয়ে গেল। কদিনের মধ্যেই আরেকজনকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। আমার চেনা বাবা হারিয়ে গেল। অচেনা হয়ে গেল। যেই বাবা আমার গায়ে ফুলের টোকাও দেয়নি, সে আমার গায়ে হাতও তুলতে শুরু করল। আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, আমার চেনা পৃথিবীটা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। চোখে পরে রাখা রঙিন চশমাটা আচমকাই ভেঙ্গে গেল। ভেবেছিলাম নতুন মায়ের কাছে হয়তো ভালোবাসা পাব। কিন্তু, কিন্তু সে তো আমার বাবাকেই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল ওরা। একবার ভাবলোও না আমার কী হবে। আমি কীভাবে থাকব। তখন বুঝেছিলাম এই বিশাল পৃথিবীতে আমি কতটা একা।’
প্রিয়তার হিঁচকি উঠল। রুদ্র প্রিয়তার পিঠে হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে বলল, ‘প্রিয়?’
প্রিয়তা থামল না। বলে চলেছে ও, ‘স্কুলে থাকাকালীন একজনকে ভালো লেগেছিল আমার। আমার একা জীবনের একমাত্র বন্ধ ছিল সে। ছায়ার মতো লেগে থাকতো আমার সঙ্গে। আমার সব আবদার পূরণ করতো। আমার সামন্য মন খারাপও ওর সহ্য হতোনা। আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী। কিন্তু একদিন হঠাৎই রাস্তা পাড় হতে গিয়ে বাসের নিচে পড়ে_’
প্রিয়তার কান্নার বেগ বাড়ল। পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে উঠল। তবুও থামল না ও। বলল, ‘ওও চলে গেল আমাকে ছেড়ে। আবার একা হয়ে গেলাম আমি। তারপর কোনদিন কাউকে ভালোবাসার সাহস হয়নি। এরপর আপনি এলেন আমার জীবনে। অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঝড়ের মতোই। আপনাকে ভালোবেসে ফেললাম। না চাইতেও। কিন্তু আপনিও আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আবার একা করে দিয়েছিলেন। আর যাবেন না প্লিজ। আপনি কে, কী, কেমন আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। কিচ্ছু জানতে চাইনা। আমার শুধু আপনাকেই চাই। কথা দিন, ওদের মতো আমাকে কোনদিন ছেড়ে যাবেন না? আবার একা করে দেবেন না আমাকে। প্লিজ?’
মেঘ ভয়ানক শব্দে গর্জন করে উঠতেই প্রিয়তার আরও শক্ত করে আকড়ে ধরল রুদ্রকে। এবার রুদ্রও দুহাতে আগলে নিল তার প্রিয়কে। আলতো করে চুমু খেলো মাথায়। নরম কন্ঠে বলল, ‘মৃত্যু ছাড়া কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা, প্রিয়। কথা দিচ্ছি।’
প্রিয়তা শান্ত হলো। ভয়ানক এক বজ্রপাতের সঙ্গে শুরু হলো আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বছরের প্রথম বর্ষণে সিক্ত হলো দুটো শরীর, মন।
#চলবে…
#অন্তর্নিহিত_কালকূট